নিজেকে নতুন রূপে আবিষ্কার করাই কবিতা লেখার প্রথম শর্ত

তৈমুর খান
তৈমুর খান
15 মিনিটে পড়ুন

কিছু কিছু তরুণ কবিরা অনবরত কবিতা লিখে যাচ্ছে, তাদের লেখার ধরনের কোনো পরিবর্তন দেখছি না। খুব বেশি লিখলেই যে ভালো কবিতা হবে তা কিন্তু নয়। তরুণ কবিদের উচিত বেশি বেশি কবিতা পড়া। গতানুগতিকতা পরিহার করে নিজেকে নতুন রূপে আবিষ্কার করতে শেখাই তরুণ কবিদের মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। কবিতা সর্বদা পরিবর্তনশীল পরীক্ষামূলক ধারাতেই অগ্রসর হয়।

নিজেকে নতুন রূপে আবিষ্কার করাই কবিতা লেখার প্রথম শর্ত

আমাদের মনে রাখতে হবে: আমরা কোনও কবিকে অনুসরণ করতে পারি, কিন্তু অনুকরণ নয়। এ বিষয়ে টি এস এলিয়টের একটি সুন্দর কথা আছে: ‘Immature poets imitate; mature poets steal.’ অর্থাৎ অপরিণত কবিরা অনুকরণ করেন; পরিণত কবিরা চুরি করেন। এই চুরির ব্যাপারটায় তীক্ষ্ণ বুদ্ধির দরকার হয়। যেটা তরুণরা সহজে আয়ত্ত করতে পারে না।

নিজেকে নতুন রূপে আবিষ্কার করাই কবিতা লেখার প্রথম শর্ত
নিজেকে নতুন রূপে আবিষ্কার করাই কবিতা লেখার প্রথম শর্ত 45

আমেরিকান কবি এবং ঔপন্যাসিক এরিকা জং ভাষা ও ভাবনাকে কী করে কবিতা করে তুলতে হয় তা আরও স্পষ্ট করে বলেছেন: ‘What makes you a poet is a gift for language, an ability to see into the heart of things, and an ability to deal with important unconscious material. When all these things come together, you’re a poet. But there isn’t one little gimmick that makes you a poet. There isn’t any formula for it.’

অর্থাৎ যা আপনাকে কবি করে তোলে তা হল ভাষার জন্য একটি উপহার, জিনিসগুলির হৃদয়ে (গভীরে) দেখার ক্ষমতা এবং গুরুত্বপূর্ণ অচেতন উপাদানগুলির সাথে মোকাবিলা করার ক্ষমতা।এই সব কিছু একত্রিত হলে আপনি একজন কবি। কিন্তু এমন একটিও ক্ষুদ্র ছলনা নেই যা আপনাকে কবি করে তুলবে। এর কোনও সূত্রও নেই। সুতরাং কবিতা লিখতে হলে চালাকি করে কবি হওয়া যায় না। অনুকরণ করে বা টুকেও লেখা যায় না। যেমন অভিজ্ঞতা দরকার হয়, তেমনি উপলব্ধি করার ক্ষমতারও দরকার হয়। বহু কবিতা পাঠ করলে কবির নিজস্ব ভাব এবং ভাষা জাগিয়ে তোলে। এই পাঠেরই বড় অভাব দেখছি আজকের তরুণদের কাছে।

নিজেকে নতুন রূপে আবিষ্কার করাই কবিতা লেখার প্রথম শর্ত
ডব্লু এইচ অডেন

কবিতা লেখা কেউ শেখায় না, নিজেকে নিজেই শেখাতে হয়। যাঁরাই বড় কবি অথবা ব্যতিক্রমী কবি— তাঁরা কিন্তু প্রথম থেকেই বড় বা ব্যতিক্রমী হননি। তাদেরও শৈশব ছিল, নিষ্ঠা ও শ্রম ছিল। পড়াশোনা ছিল। ভাবনা ছিল নিত্য নতুন ভাবে নিজেকে প্রকাশ করার। আর ছিল ভাষার প্রতি দরদ অর্থাৎ আবেগপ্রবণতা। কেননা মনের ভাবকে অথবা উপলব্ধিকে ভাষা দেওয়া খুব কঠিন ব্যাপার। তাই এই ভাষার প্রতি যত্ন বা ভালোবাসা না থাকলে কবিতা লেখা যায় না। এই কারণেই ডব্লু এইচ অডেন কবিতার প্রথম শর্তেই বলেছেন: ‘A poet is, before anything else, a person who is passionately in love with language.’

অর্থাৎ একজন কবি, অন্য কিছুর আগে, এমন একজন ব্যক্তি যিনি ভাষার প্রতি আবেগপ্রবণ। একজন তরুণ কবিকে প্রথমেই এটা ভাবা দরকার তিনি ভাষাকে কতখানি আত্মস্থ করতে পেরেছেন। নিজের অনুভূতির ক্ষরণকে ভাষার দ্রবণে কতখানি পরিণত করতে পেরেছেন। এই ভাষাকে রপ্ত করার জন্যই কিংবা নতুন শব্দকে কবিতায় ব্যবহার করার জন্য কবিকে সচেতন হতে হয়। সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাঁর ‘কবিতার বোঝাপড়া’ গ্রন্থে লিখেছেন এই ভাষা ব্যবহারের অভিজ্ঞতার কথা। নদীয়ার এক গ্রামে তাঁর দিদির বাড়িতে বেড়াতে এসে ভোরবেলায় শুনলেন ধোপাদের কাপড় কাচার শব্দ। তাঁর মনে একটা নতুন ছন্দের জন্ম হলো। এখানেই প্রথম তিনি কবিতায় ভোর বা সকাল শব্দের পরিবর্তে ব্যবহার করলেন ‘বিহান’ শব্দটি। এই ‘বিহান’ শ্রমজীবী মানুষের বহুমুখী ব্যঞ্জনায় পরিণত হলো।

সেই থেকেই কবিও কবি হিসেবে পরিচিতি পেলেন। তেমনি দিনেশ দাস ‘কাস্তে’ কবিতা লিখে ‘কাস্তে’ শব্দটি ব্যবহার করে বহুমাত্রিক ব্যঞ্জনাশ্রয়ী করে তুললেন কবিতাকে। তিনি হয়ে গেলেন ‘কাস্তেকবি’। ‘নিঃশব্দের তর্জনী’ গ্রন্থে শঙ্খ ঘোষ বলেছেন: এক বিন্দু থেকে আর এক বিন্দুতে আমাদের যাত্রা অমরত্বের জন্যই। অর্থাৎ আমাদের জীবন বিন্দুকে বিন্দুকে মিলিত করার জন্য দাগ টানা। কবিতা যে একটা দাগ এবং শব্দ যে এক একটি বিন্দু তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সুতরাং কবিতার বোধ নিজেকেই অর্জন করতে হয়, এর জন্য গুরুর প্রয়োজন হয় না। আমাদের ঘুমন্ত অনুভূতিকে জাগিয়ে দেওয়া।আমাদের দেখার মধ্যে না দেখাকে দেখিয়ে দেওয়া।

নিজেকে নতুন রূপে আবিষ্কার করাই কবিতা লেখার প্রথম শর্ত
এরিকা জং

আমাদের বলার মধ্যে না বলাকে বলে দেওয়া। অদৃশ্যকে দৃশ্যগোচর করা কবি ও কবিতার কাজ। এই কাজে একমাত্র সহায়ক হলো ভাষা। এই ভাষার জন্য অনেকদিন অপেক্ষা করতে হতে পারে। কম বয়সী তরুণ কবিরা সব সময় যে অভিজ্ঞ হবে এমনটিও ভাবা যায় না। তাই এরিকা জং এ বিষয়ে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন: ‘You must have a certain amount of maturity to be a poet. Seldom do sixteen-year-olds know themselves well enough.’ অর্থাৎ কবি হওয়ার জন্য আপনার একটি নির্দিষ্ট পরিপক্কতা থাকতে হবে। কদাচিৎ ষোল বছর বয়সীরা নিজেদের যথেষ্ট ভালো করে জানে।

যাঁরা সর্বদা অন্যদের দোষারোপ করে চলেছেন, এটা তো ঠিক নয়। কেননা কবিতা লেখা ব্যাপারটা খুবই নিজস্বতা সম্পন্ন একান্ত ভেতরের ব্যাপার। কারো দ্বারাই তা সংঘটিত করা যায় না। আর ভালো কবিতা লেখার জন্য অপেক্ষা করতে হয়। মডার্ন বা পোস্টমডার্ন, অনুপ্রাস যুক্ত বা ছন্দোবদ্ধ, গীতিকবিতা বা মহাকাব্য, দীর্ঘ কবিতা বা ক্ষুদ্র কবিতা ইত্যাদি যে কোনও পর্যায়ের কবিতাকেই যে ভালো কবিতা বলা যাবে এমনটাও কিন্তু নয়।

নিজেকে নতুন রূপে আবিষ্কার করাই কবিতা লেখার প্রথম শর্ত
জি কে চেস্টারটন

ইংরেজি ভাষার সাহিত্য সমালোচক, কবি ও ঔপন্যাসিক জি কে চেস্টারটন (১৮৭৪-১৯৩৬) এ বিষয়ে বলেছেন: ‘What the world wants, what the world is waiting for, is not Modern Poetry or Classical Poetry or Neo-Classical Poetry — but Good Poetry. And the dreadful disreputable doubt, which stirs in my own sceptical mind, is doubt about whether it would really matter much what style a poet chose to write in, in any period, as long as he wrote Good poetry.’

অর্থাৎ পৃথিবী যা চায়, বিশ্ব যা অপেক্ষা করছে, তা আধুনিক কবিতা বা ধ্রুপদী কবিতা বা নিও-ক্লাসিক্যাল কবিতা নয়— বরং ভালো কবিতা।এবং ভয়ঙ্কর অসম্মানজনক সন্দেহ, যা আমার নিজের সংশয়বাদী মনে আলোড়িত করে, তা নিয়ে সন্দেহ হয় যে একজন কবি কোন শৈলী বেছে নিয়েছেন তা সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ হবে কিনা; যে কোনও যুগে যতদিন তিনি ভালো কবিতা লিখেছেন।

একজন বিখ্যাত কবির মনেও ভয়ঙ্কর অসম্মান জনক সন্দেহ বাসা বেঁধেছিল তাঁর শিল্প সম্পর্কে। তিনি ভালো কবিতা লিখতে পারলেন কিনা, তিনি যে শৈলী বেছে নিয়েছেন তা সঠিক কিনা ইত্যাদি নানা চিন্তা তাঁকে আলোড়িত করেছে। সুতরাং আজকের কবিরা কী করে ভাবছেন তাঁদের শিল্প যুগোত্তীর্ণ হবে? যাঁরা অন্যদের দোষারোপ করে এটা করছেন তাঁরা নিজের ছায়াকেই গালি দিচ্ছেন। শিল্পের শেষ কথা কেহই বলতে পারেন না। নিশ্চয়ই এটা একটা সংশয়বাদী কর্ম। কোনওই প্রত্যাশা রাখা উচিত নয়। শুধু এক বিন্দু থেকে আর এক বিন্দুতে আমরা দাগ টেনে চলেছি।

রসাত্মক বাক্য কিংবা ব্যক্তি অনুভূতির ছন্দোময় প্রকাশ যেভাবেই কবিতা লেখা হোক না, ভালো কবিতার ধারণা কী এ বিষয়ে আমরা অনেকেই নিরুত্তর। শোক থেকে শ্লোক এর জন্ম হয়েছিল ঋষি বাল্মীকির মুখে। আদি কবিতা হিসেবে আজও আমাদের কাছে তা চিরসত্য হয়ে আছে। কিন্তু কেউ যদি প্রশ্ন করে: ভালো কবিতা কী? আমরা কি এর উত্তর দিতে পারব?

আমাদের অর্জিত বিদ্যায় কবিতার নানা সংজ্ঞা এনে সংজ্ঞায়িত করব, আর বলব গীতিপ্রবণ বাক্যের ছন্দোময় প্রকাশই ভালো কবিতা। ছন্দ কথাটি কিছুতেই আমরা ছাড়তে পারব না। কবিতার কথা বললেই ছন্দের কথাও বলব।

কিন্তু বাস্তবে আমরা কতটা ছান্দিক? সবকিছুরই ছন্দ থাকে এটা ঠিক, কিন্তু মাঝে মাঝে আমরা ছন্দোহীনও হতে পারি। আমাদের জীবন এমন বীভৎস, এমন কদর্য, এমন বিক্ষিপ্ত অথবা ছিন্নমূল হয়ে ওঠে যাকে তখন প্রকৃতই ছন্দহারা হয়ে যেতে হয়। বাস্তব এমনই যে সব সময় কবিতা লেখাতে আমাদের সম্মান জানিয়ে ছন্দের প্রশ্রয় দেবে এমনটি নাও হতে পারে। হয়তো বাইরে ছন্দের সৌকর্য নির্মিতি থাকে না বা প্রয়োজন পড়ে না, কিন্তু কাব্যিক উচ্ছলতায় আত্মধ্বনির এক অনস্বীকার্য আবেদন উপলব্ধি করা যায়। কবি ভাস্কর চক্রবর্তী দুরারোগ্য ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে প্রতিটি মুহূর্ত যখন যন্ত্রণায় পার করতেন, তখন তাঁর কাছ থেকে জীবনের ছন্দ হারিয়ে গিয়েছিল।

কবিতাকে অলংকার পরাবার ধৈর্য তাঁর ছিল না। তখন তিনি লিখেছিলেন:
“শুধু ফোটায় ফোঁটায় রক্ত ঝরে পড়ে
রক্ত। এক মুহূর্তের রক্ত
অন্য মুহূর্তের গায়ে ঝরে পড়ে।
…চশমা পরিষ্কার করে আমি ইতিহাস পড়ি।
ফোঁটায় ফোঁটায় রক্ত ঝরে পড়ে
বিছানার ওপর
রক্ত ঝরে পড়ে সমস্ত জীবন বেয়ে”

সমস্ত জীবন ধরে ঝরেপড়া রক্তকে কখনো ছন্দ শিখবার প্রয়োজন হয়নি। যন্ত্রণার ভাষা এরকমই হয়। তেমনি কবি বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত ‘জীবন’ নামে একটি কবিতায় নিজের ছন্দহারা জীবনের পটপরিবর্তনের চিত্র এভাবে চিত্রিত করলেন:
“একটি ঘোড়ার জন্য বসে থেকে থেকে
একটি পুরুষ ঘোড়া বুড়ো হয়ে যায়। সূর্য
ভেঙে গুঁড়ো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে
শেষে আকাশের গায়ে মুছে গেলে
পুরুষ ঘোড়াটি
পুরোনো দিনের কথা ভাবে,
যখন বয়স ছিল তার। যখন বিচুলি, ঘাস
বস্তা বস্তা ছোলা খেয়ে দৌড় শুরু হতো
আর সেই দেখে হেসে ঠেস দিয়ে
যুবতী ঘোড়ারা ঢলে যেতো একে একে
নিজেরাই নিজেদের গালে।

রাত্রি আরো
ঘন হলে পেয়ারা বাগানে
গাঢ় ও গহন শীত নামে।
বুড়ো ঘোড়া জানলার পাট খুলে
ঘরের ভেতর উঁকি মারে, দ্যাখে
তার মাদী ঘোড়া কাদা হয়ে গ্যাছে
কাল ঘুমে।
জীবন শুধুই কাদা কাদা—এই বলে
বুড়ো ঘোড়া আকাশে চাঁদের দিকে ছোটে।”

বুড়ো ঘোড়া তার বুড়ি ঘোড়াকে দেখে বুঝতে পারে জীবন শুধুই কাদা কাদা। এরকম জীবনের পাঠ তখন তাঁর ব্যক্তিজীবনকেও ছাপিয়ে যায়। সব মানুষের সমস্ত জীবনই কাদা কাদা হয়ে যায়।

ভালো কবিতা খুঁজতে গিয়ে আমরা তখন ছন্দ নয়, অলংকার নয়, শুধু রহস্যও নয় জীবনবাদী ছলনাহীন এক বোধের নিকটে পৌঁছে যাই। সেখানে যে ভাষা, যে উপলব্ধি উঠে আসে তা অত্যন্ত সৎ। অর্থাৎ প্রতিটি প্রকৃত কবিই এইসব কবিতার কাছে এসে উপস্থিত হন। তাঁর আত্মচেতনায় ধরা পড়ে নিরন্তর আত্মভাঙনের ভাষা। যে বিদ্যা তিনি অর্জন করেছিলেন, যে কবিতার সংজ্ঞা তিনি পাঠ করেছিলেন—এতক্ষণে তা পাল্টে যায়। কবিতা হয়ে ওঠে আত্মস্ফুরণের দীর্ঘশ্বাসের মতো। দাঁড়ের শব্দ তখন নদীর জলে নয়, পাঁজরে অনুভূত হয়। শঙ্খ ঘোষ তখনই লিখতে পারেন:


পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ, রক্তে জল ছলছল করে
নৌকোর গলুই ভেঙ্গে উঠে আসে কৃষ্ণা প্রতিপদ
জলজ গুল্মের ভারে ভরে আছে সমস্ত শরীর
আমার অতীত নেই, ভবিষ্যৎও নেই কোনোখানে।


ঝড়ে ভাঙ্গা লাইটপোস্ট একা পড়ে আছে ধানক্ষেতে
শিয়রে জোনাকি, শূন্যে কালপুরুষের তরবারি
যুদ্ধ হয়ে গেছে শেষ, নিঃশব্দ প্রহর দশ দিকে
যেদিকে তাকাও রাত্রি প্রকাণ্ড নিকষ সরোবর।”

তাঁর মানবজন্মের শরীরের প্রবাহ যে জীবনতরী ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে সেই পথও স্বচ্ছ নয়। আলো-অন্ধকারের যাত্রায় মায়া বন্ধনের বিন্যাস সেখানেও। কী জীবনের উদ্দেশ্য, কোথায় তার প্রত্যাগমন, কোথায় তার শেষ কিংবা আদৌ শেষ নয় সেই ভাবনা ব্যক্তি কবির ভাবনাকেও অতিক্রম করেছে। তা সমগ্র মানুষের সর্বকালের ভাবনায় পরিণত হয়েছে। বোধের এই অনন্ত ব্যাপ্তিই কবিতাকে মুক্তি দিয়েছে। আর এই মুক্তিই সৎ কবিতা। যদিও কবিতাংশগুলি ছন্দোহীন নয়, কিন্তু ছন্দকে ছাপিয়ে গেছে বোধের তীব্রতা। এভাবেই আমাদের বোধের তৃতীয় কোনও শক্তি আমাদের দৃষ্টি খুলে দেয়, যার দ্বারা অনন্তকে আমরা অনুধাবন করতে পারি।

13AA5D21 6544 4352 99A7 89179FC2A62C নিজেকে নতুন রূপে আবিষ্কার করাই কবিতা লেখার প্রথম শর্ত
পল এঙ্গেল

এই উপলব্ধিকেই বিখ্যাত কবি পল এঙ্গেল, নিউ ইয়র্ক টাইমসের একটি নিবন্ধে লিখেছেন:
“Poetry is ordinary language raised to the Nth power. Poetry is boned with ideas, nerved and blooded with emotions, all held together by the delicate, tough skin of words.” — (Paul Engle, from an article in The New York Times).
অর্থাৎ কবিতা হল তৃতীয় শক্তিতে উত্থাপিত সাধারণ ভাষা। কবিতা ধারণা দ্বারা অস্থির, স্নায়বিক এবং আবেগ দ্বারা রক্তাক্ত, সমস্ত শব্দের সূক্ষ্ম, শক্ত ত্বক দ্বারা একত্রিত হয়।

ভাবের জমাটবদ্ধ রূপ যখন আত্মগত প্রচ্ছদে অভিব্যক্তি লাভ করে তখনই তা সৎ কবিতা হয়ে ওঠে। সৎ কবিতা যে ভালো কবিতা এমনটা বলা যায় না। তবে সত্য ও সৌন্দর্য একসঙ্গেই সহবাস করে। বিউটি ইজ ট্রুথ, ট্রুথ বিউটি একথা কিটস বহু আগেই বসেছিলেন। তাই আমরা সত্য শিব সুন্দরের কথাও একই সঙ্গে উচ্চারণ করে থাকি। ভালো শব্দটি কখনো কখনো আপেক্ষিক হয়ে থাকে। কিন্তু সত্যের আপেক্ষিকতা নেই, যা চিরন্তন।
তাহলে মহৎ কবি কে?

নিজেকে নতুন রূপে আবিষ্কার করাই কবিতা লেখার প্রথম শর্ত
জর্জ স্যান্ড

যিনি মহাজীবনের রূপকার, নিজের মধ্য দিয়ে সমগ্রকে রূপায়িত করতে পারেন, নিজের চোখের এক ফোঁটা অশ্রুর মধ্যে সমগ্র মানবজাতির অশ্রুকে বহন করতে পারেন, নিজের ক্ষুদ্র সময়সীমাকে, মহাকালের মহাসময়ে প্রতিস্থাপন করতে পারেন তিনিই মহৎ কবি। এই কবির উপলব্ধিকেই বোঝাতে চেয়েছেন একজন ফরাসী ঔপন্যাসিক জর্জ স্যান্ড নামে সবচেয়ে বেশি পরিচিত আমানটাইন লুসিলে অরোর ডুপিন (১৮০৪-৭৬) :
“He who draws noble delights from sentiments of poetry is a true poet, though he has never written a line in all his life.” — (George Sand, from The Devil’s Pool.)

অর্থাৎ যিনি কবিতার অনুভূতি থেকে মহৎ আনন্দ আঁকেন তিনিই প্রকৃত কবি, যদিও তিনি সারা জীবনে একটি লাইনও লেখেননি। সুতরাং কবিতা লিখলেই যে প্রকৃত কবি এমনটি কিন্তু নয়। তাঁর যেকোনো সৃষ্টির মধ্যেই কবিতা প্রতীয়মান হয়ে উঠতে পারে। মহৎ আনন্দ তখন আর একজন মানুষের নয়, তা আবহমান মানুষের হয়ে যায়। শুধু কবিতার অনুভূতি তাঁর সৃষ্টির মধ্যে বিরাজ করে। এই অনুভূতির সততা সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করা চলে না। এই অনুভূতি সকলের অন্তরেই বিরাজ করে। তাই কবিতা বোঝার আগেই তার সংযোগ উপলব্ধ হয়।

১৯৩৪ সালে টি এস ইলিয়ট
১৯৩৪ সালে টি এস ইলিয়ট

টি এস এলিয়ট ‘দান্তে’ নামক একটি প্রবন্ধ লিখতে গিয়ে এ কথা উল্লেখ করেছেন: “It is a test [that] genuine poetry can communicate before it is understood.” — (T. S. Eliot, from the essay “Dante.”) অর্থাৎ এটি একটি পরীক্ষা যে প্রকৃত কবিতা বোঝার আগেই তা বোঝা হয়ে যেতে পারে। হয়তো আমরা ভাষায় তা প্রকাশ করতে পারি না। সুতরাং কবিতার শর্ত ছন্দ, অলংকার, রহস্য, ব্যাকরণ দ্বারা সীমাবদ্ধ নয়। তা ব্যতিক্রমীও হতে পারে। তা ভিন্ন পথেও আত্মপ্রকাশ ঘটাতে পারে।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
তৈমুর খান জন্ম ২৮ জানুয়ারি ১৯৬৭, বীরভূম জেলার রামপুরহাট ব্লকের পানিসাইল গ্রামে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে মাস্টার ডিগ্রি এবং প্রেমেন্দ্র মিত্রের কবিতা নিয়ে পি এইচ ডি প্রাপ্তি। পেশায় উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহ শিক্ষক। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ: কোথায় পা রাখি (১৯৯৪), বৃষ্টিতরু (১৯৯৯), খা শূন্য আমাকে খা (২০০৩), আয়নার ভেতর তু যন্ত্রণা (২০০৪), বিষাদের লেখা কবিতা (২০০৪), একটা সাপ আর কুয়াশার সংলাপ (২০০৭), জ্বরের তাঁবুর নীচে বসন্তের ডাকঘর (২০০৮), প্রত্নচরিত (২০১১), নির্বাচিত কবিতা (২০১৬), জ্যোৎস্নায় সারারাত খেলে হিরণ্য মাছেরা (২০১৭) ইত্যাদি। কবিরুল ইসলাম স্মৃতি পুরস্কার ও দৌড় সাহিত্য সম্মান, নতুন গতি সাহিত্য পুরস্কার, আলোক সরকার স্মারক পুরস্কার সহ অনেক পুরুস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!