বন্ধুর পথের বন্ধু

তামান্না ঝুমু
তামান্না ঝুমু - উন্নয়ন পরামর্শক
7 মিনিটে পড়ুন
সাময়িকী আর্কাইভ

আমি একসময় স্কুলের ক্যাফেটেরিয়ায় কাজ করতাম। এক স্কুলে কাজ করার সময় আমার সহকর্মী ছিল ডোনা। ডোনা শেফ ছিল। কাজে ছিল অত্যন্ত একনিষ্ঠ ও পরিচ্ছন্ন।  প্রায় এক হাজার বাচ্চার বিশাল স্কুল। এদের প্রাতঃরাশ ও মধ্যাহ্নভোজনের দায়িত্বে ছিলাম আমরা দশ-বারোজন। শেফ হিসেবে গুরুদায়িত্বভার ডোনার ওপরে। কারো কাজে একটু স্লথগতি, অনিষ্ঠা, অপরিচ্ছন্নতা বা অমনোযোগ পরিলক্ষিত হলে ডোনা সঙ্গে সঙ্গে তার প্রতি কঠোর হতো। আবার যেকারো ভালো কাজের প্রশংসা করতেও সে কার্পণ্য করতো না। ডোনার নেতৃত্বে আমাদের সেই রন্ধনশালা ও তৎসংলগ্ন ভোজনালয়টি সর্বদাই থাকতো পরিপাটি ও হীরের মতো ঝকঝকে। ডোনার মাথার চুল সবসময় খুব ছোট ক’রে ছাঁটা থাকতো। পাশ্চাত্য-সংস্কৃতিতে মেয়েদের চুল ছেঁটে রাখা খুব অপ্রচলিত বা অস্বাভাবিক নয়। নর-নারীদের অনেকেই এখানে চুল ছেঁটে রাখে বা কোনো অসুখের কারণেও কোনো সময় কারো কারো চুল ঝ’রে গিয়ে থাকতে পারে। এ-নিয়ে তাদের আড়ালে বা সমুখে কেউ কখনো নেতিবাচক কথাবার্তা বলে না এখানে।

একদিন কোনো এক কথাপ্রসঙ্গে এক সহকর্মীর কাছে জানতে পারলাম, ডোনার চুল ছেঁটে রাখবার পেছনে একটি বিশেষ কারণ আছে। তা হলো, বেশ অনেক বছর আগে ডোনার এক বোনের ক্যান্সার হয়। কেমো থেরাপিতে ওর চুল ঝ’রে যায়। চুলের জন্য ওর খুব মন খারাপ হয়। ক্যান্সার খুব ভয়াবহ যন্ত্রণার একটি রোগ; এর কষ্ট যেমনি শারীরিক তেমনি মানসিকও। এবং এই যন্ত্রণা কেবল রোগীর একার নয়, তার নিকটাত্মীয়দেরও। ঝ’রে যাওয়া চুলের জন্য ডোনার বোনের মনোবেদনা দেখে ডোনাও একদিন ওর নিজের মাথা ন্যাড়া ক’রে ফ্যালে। চুলহীন মাথায় বোনের সামনে এসে দাঁড়ায়। বলে, দ্যাখ তো, বুবু, আমায় কেমন দেখাচ্ছে? ডোনাকে চুলহীন দেখে বোন কেঁদে বুক ভাসায়। বলে, আমার চুল তো কেমোতে ঝরেছে; তুই কেন শুধু শুধু নিজের চুল ফেলে দিতে গেলি, বোকা মেয়ে? তাছাড়া আমার চুল তো আবার গজাবে রে! ডোনা বলে, তোমার মাথার সুন্দর কোঁকড়ানো চুলের জন্য তোমার যেমন মন খারাপ হয়েছে, তেমনি আমারও মন খারাপ হয়েছে। তোমার মাথায় চুল নেই, আমারও তাই না থাকুক। তোমার যেমন আবার চুল গজাবে, তেমনি আমারও গজাবে। তোমার এই বন্ধুর পথের যাত্রী শুধু তুমি একাই কেন হবে? আমাকেও তোমার সঙ্গে নাও। আমাকেও তোমার সঙ্গে তোমার হাত ধ’রে হাঁটতে দাও।

দুইবোন গলা জড়িয়ে ধ’রে কাঁদে। বোনকে জড়িয়ে ডোনা আয়নার সামনে দাঁড়ায়। বলে, দ্যাখো বুবু, চুল ছাড়াও তোমাকে কেমন সুন্দর দেখাচ্ছে! তোমার সৌন্দর্য তো তোমার চুলে নয়, তা তোমার মনে। তোমার মনটা এতো সুন্দর, তোমার মাথায় চুল আছে বা নেই তাতে কী আসে যায়? এবার দু’বোন গলা জড়িয়ে হাসে। অনেকদিন পর ওরা হাসে।

ডোনার বোনের ক্যান্সার পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়ে ধীরে ধীরে। জীবন আর মরণের  প্রাণান্তকর যুদ্ধের শেষ হয় একসময়। সময় বড় নিষ্ঠুর আর কৃপণ হয়ে যায়। মাথায় চুল গজানোর অবসরটুকুও সময় আর দেয় না ওকে। চুলহীন মাথাতেই ও পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়।

তারপর থেকে ডোনা আর কোনোদিন নিজের মাথার চুল বাড়তে দেয় নি। বোন পৃথিবী ছেড়েছে অনেকবছর। আজও ডোনা সেই বোনের হাত ধ’রে দুস্তর কান্তার পথ হাঁটছে, বুকে পুঞ্জিত ব্যথা নিয়ে। ডোনা কাজ করছে, হাসছে। কিন্তু মাথার ওপরে বোনের চিহ্ন।

ড্যানির মাথার চুল খুব ঘন আর সুন্দর। একদিন দেখি, ওর মাথা ন্যাড়া। ভেবেছিলাম, হয়তো এমনিতেই ও মাথা ন্যাড়া করেছে অথবা কোনো অসুখ-বিসুখও হয়ে থাকতে পারে। পরে জানতে পারলাম, ওর এক ঘনিষ্ঠ বান্ধবীর ক্যনাসার হয়েছে। কেমো থেরাপিতে ওর চুল প’ড়ে গেছে। তাই ড্যানিসহ আরো কয়েকজন বন্ধু-বান্ধব এবং আত্মীয়-স্বজনও নিজেদের মাথার চুল ফেলে দিয়েছে; যাতে এই কঠিন যাত্রায় ও নিজেকে একা মনে না করে। আমাদের জীবনে নানা সময়ে নানাভাবে দুর্দিন আসে। কেউ যদি তখন পাশে এসে দাঁড়ায় আর বলে, “বন্ধু, এই বন্ধুর পথের যাত্রী তুমি একা নও, আমরাও আছি তোমার সঙ্গে সহযাত্রী হিসেবে, তোমার সমব্যথী হিসেবে”– তাহলে দুস্তর পথ অনেকটা সহজ হয়ে যায়, ভার অনেকটা ক’মে যায়, মনের বেদনা অনেকখানি হালকা হয়ে যায়।  

এরকম আরো কয়েকজনের কথা শুনেছি , যারা কোনো আত্মীয় বা বন্ধুর এমন কঠিন সময়ে সংহতি ও সমর্থন জানানোর জন্য নিজেদের অনেক আদরের চুল ফেলে দিয়েছে।

একদিন সকালে কাজে যাচ্ছি হেঁটে হেঁটে। সুজানের বাসার সামনে দিয়ে যাবার সময় দেখি, সুজান ওর বর ও দুই বাচ্চাকে বিদায় দিচ্ছে দরোজায় দাঁড়িয়ে। ওর বর নিক কাজে যাবার পথে বাচ্চাদের স্কুলে দিয়ে যাবে। সুজানের মুখে অমলিন হাসি। আমার সঙ্গেও কুশল-বিনিময় হলো খানিক। সেদিন সুজানের মাথায় চুল ছিল না। পরে বন্ধুদের কাছে জানতে পারলাম, সুজানের ক্যান্সার হয়েছে এবং কেমোতে ওর চুল ঝ’রে গেছে। এমন দুঃসময়ে সুজানের মুখে এমন স্নিগ্ধ হাসির কারণ ওর চমৎকার পরিবার। ওর বর নিক মানুষ হিসেবে যেমন খুব ভালো তেমনি ভালো বাবা হিসেবে এবং বর হিসেবেও। সুজানের অসুখের পুরোটা যাত্রায় নিক ওর সঙ্গে ছিল ছায়ার মতো। বাচ্চাদেরকে স্কুলে নেওয়া, সুজানকে ডাক্তারের কাছে নেওয়া, প্রতিদিন সুজানের জন্য বিশেষ ডায়েটের খাবার রান্না করা ইত্যাদি ইত্যাদি নিক প্রাণপণে করেছে। বাচ্চাদের স্কুলে দিয়ে নিক কাজে যেত। বিকেলে ওদের স্কুল থেকে তুলে নিতেন সুজানের মা। স্কুল থেকে নিয়ে ওদের পার্কে খেলতে নিয়ে যে্তেন। ঘণ্টা দুয়েক খেলার পরে বাসায় আনতেন।  বাসায় এসে সুজানের দেখাশোনা করা, বাচ্চাদের ও সুজানের জন্য আলাদা-আলাদা রান্না করা, বাচ্চাদের বাড়ির কাজ দেখিয়ে দেওয়া ইত্যাদি সেরে মেয়ের সঙ্গে অনেকক্ষণ সময় কাটিয়ে তারপর মা নিজের বাড়িতে ফিরে যেতেন।

সুজানের মা ভদ্রমহিলার সঙ্গে আমার পার্কে দেখা হতো মাঝেমাঝে। বয়স আশি বছরের মতো। কিন্তু বেশ শক্ত সমর্থ। আরেকটি শহর থেকে প্রতিদিন ড্রাইভ ক’রে আসতেন মেয়ে ও নাতনীদের দেখাশোনা করার জন্য। বাবাও আসতেন কোনো কোনোদিন। ওর বাবা ডাক্তার। তাও এই বয়সেও বেশ কর্মক্ষম। এই বয়সেও ডাক্তারি করেন। এজন্য মায়ের মতন প্রতিদিন আসতে পারেন না। সুজান ভাইবোনদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ। তাই ওর বাবা-মা ওকে খুকি ব’লে ডাকেন। সুজানের মা বলতেন,” আমার খুকির মুখটা কতো সুন্দর, হাসিটা কতো সুন্দর, দেখেছ? ও যেমনি সুন্দর  তেমনি দৃঢ় ওর মনোবল। এই বন্ধুর পথ ও পারি দিতে পারবে।”

প্রায়শই শুনতাম, সুজান কখনো বেড়াতে গেছে হাওয়াই দ্বীপে, কখনো বা অন্য কোথাও। কখনো নিকের সঙ্গে, কখনো বা বাবামায়ের সঙ্গে। পশ্চিমারা এমনিতেই বেড়াতে খুব ভালোবাসে। সুজানকে সে-সময়ে আরো বেশি বেশি বেড়াতে নিয়ে যেতো ওর বাবামা ও নিক, যাতে ওর কষ্ট কিছুটা লাঘব হয়। ওর স্তন-ক্যান্সার হয়েছিল। একসময় ওর স্তন অপসারণ করা হলো। তারপরেও সুজানের মুখে সেই আগের মতোই অমলিন হাসি দেখেছিলাম। মনে ভাবলাম, এমন সুন্দর পরিবার যার থাকে, এমন চমৎকার মানুষেরা যাকে সারাক্ষণ ঘিরে থাকে, তার হাসি মলিন করে, ক্যান্সারের এমন সাধ্য কী?

ক্যান্সারকে যুদ্ধে হারিয়ে দিয়েছে সুজান। ওর হালকা বাদামি ঢেউ-খেলানো চুল আবার মাথায় ফিরে এসেছে। মুখে সবসময়ের মতো সুন্দর হাসি।

✍️এই নিবন্ধটি সাময়িকীর সুন্দর এবং সহজ জমা ফর্ম ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে। আপনার লেখা জমাদিন!

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!