ধুতরা বিষের রকমফের

জায়েদ ফরিদ
জায়েদ ফরিদ
9 মিনিটে পড়ুন
রাজধুতরা (Brugmansia suaveolens)-- সূত্রঃ মেডিসিন্যাস্কি

কয়েক যুগ আগের কথা। রাস্তার উল্টোদিকের বাড়িটাকে সবাই ‘ধুতরাবাড়ি’ বলে চেনে। গ্রামীন দোকানের মাচালে বসে বাড়িটার নামকরণের ইতিহাস শুনছিলাম। টিনের ঘরের সামনে খোলা উঠান, তিনদিকে এক কোমর উঁচু ঢাল, যাতে বর্ষার জল না ওঠে। এই ঢালে রাশি রাশি ধুতরা গাছ, সাদা ধুতরা, কালো ধুতরা সবই। পরিবারের সকলের খোশ-পাঁচড়া চুলকানি হওয়াতে তাদের এক কবিরাজ আত্মীয় ধুতরাপাতা ভাজি করে খাইয়েছে সবাইকে। কয়েকদিনের মধ্যেই সুফল পেয়ে ভীষণ আপ্লুত সেই পরিবার। তাই পরবর্তীতে চিকিৎসার প্রয়োজনে আর কবিরাজের দ্বারস্থ হয়নি তারা। কাপড় সেদ্ধ-করা বড় কড়াইতে নিজেরাই ধুতরাপাতা ভাজি করে খেয়েছে।

এহেন চিকিৎসার ফলস্বরূপ বিকেল বেলা বাড়ি থেকে বের হয়ে গেছে ৬ সদস্যবিশিষ্ট পরিবারের উম্মত্ত নারী-পুরুষ সবাই। এক দিন পরে ঘরে ফিরেছে তিনজন। পোষা কুকুরের চিৎকার আর গতিবিধি লক্ষ্য করে গ্রামবাসী জঙ্গল থেকে অর্ধচেতন অবস্থায় উদ্ধার করেছে দুজনকে, যারা রাস্তা চিনে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি। পরিবারের বাকি একজন আর কোনোদিনই ফিরে আসেনি।

ধুতরাবাড়ির এসব কাহিনী শুনে যখন মনটা ভারাক্রান্ত ঠিক তখনই দেখতে পেলাম এক বাচ্চা ছেলের হাতে একটি সবুজ কন্টকময় ধুতরা ফল। হাতের উল্টোপিঠকে ব্যাডমিনটন র‍্যাকেটের মতো ব্যবহার করে ধুতরা-ফলটাকে আঘাত করলো সে, তারপর সাঁই সাঁই করে ঘোরালো কয়েক পাক। এরপর স্মিত হেঁসে হাতটি দেখালো আমাকে যেখান থেকে কয়েক ফোঁটা তাজা রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। ধুতরা বিষাক্ত বলে আমরা অনেকেই জানি কিন্তু এই অভাবিত ঘটনায় বিস্ময়ের সীমা রইলো না।

ধুতরার ভিতর অ্যাট্রোপিনসহ যে ৩টি বিষাক্ত উপক্ষার (Alkaloid) রয়েছে তা আর্সেনিকের মতো স্বাদগন্ধহীন। এদের প্রভাবে মানুষ বাস্তবতা ও কল্পনার মধ্যে প্রভেদ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এতে ভয়ানক চিত্তবিভ্রম, দৃষ্টিবিভ্রম ও দিকভ্রম দেখা দেয় এবং কখনো এমনভাবে স্মৃতিবিলোপ ঘটে যে আক্রান্ত ব্যক্তি অতীতের কথা ও ঘটনা স্মরণ করতে পারে না।

বিষজর্জর অবস্থায় আক্রান্ত ব্যক্তির শরীর যতটুকু তাপ শোষণ করে তার চেয়ে কম বিকিরণ করে, তাই দেহের তাপমাত্রা ক্রমশ বাড়তে থাকে এবং এর ফলে মস্তিষ্ক বিকল হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। আমাদের চোখের তারা অল্প আলোতে বড় হয় এবং বেশি আলোতে ছোট হয়ে যায় যাতে আলোর তীব্রতা থেকে রক্ষা পায় চোখ। কিন্তু ধুতরা বিষের প্রভাবে পেশীতে উত্তেজনা সঞ্চার হলে চোখের তারা বিস্ফারিত ও স্থির হয়ে থাকে, তখন আলো প্রবেশ করলে চোখে প্রচণ্ড ব্যথা হয়।

2 1 ধুতরা বিষের রকমফের
ধুতরার ফল (Datura metel) ছবি: সাহানা চৌধুরী মমি

ধুতরা নামটি এসেছে সম্ভবত আরবি থেকে যেখানে ধুতরা গাছ বলতে উচ্চারিত হয় ‘নাবাত আল দাতুরা’। এর নয়টি প্রজাতি আছে। ধুতরা গাছ বহুবর্ষজীবী হলেও সাধারণত ৪-৫ বছরের বেশি জীবিত থাকে না। এরা রাস্তার ধারে, অনুর্বর মাটিতে, গার্বেজ ডাম্পে, গোয়াল ঘরের আশেপাশে ও পতিত জমিতে বেশ জন্মে। বাংলাদেশে সাধারণত দুরকম ধুতরা দেখা যায়, সাদা ও কালো ধুতরা। দুটোরই বৈজ্ঞানিক নাম এক, ড্যাটুরা মেটেল (Datura metel L.)।

কালো ধুতরা, ড্যাটুরা মেটেলের একটি কাল্টিভার, ফ্যাস্টুওজা (Datura metel ‘Fastuosa’)। কালো ধুতরার ডাঁটা ও পাতা কালচে বেগুনি রঙের হয়। তবে এই ধুতরাকে অনেক সময় ‘সোনা ধুতরা’ বলতে শোনা যায় যা তার উৎকৃষ্টতর ভেষজ গুণাবলীর কারণেই। মেক্সিকোর আদিবাসী ড্যাটুরা ইনক্সিয়া (Datura inoxia) ‘মেটেল’ প্রজাতির দেশি ধুতরার খুব নিকটবর্তী গাছ, ১১শ শতকে বহুশাস্ত্রজ্ঞ ইবনে সিনা যার সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন। মেটেল প্রজাতির ফলের গায়ে স্পাইনগুলো ভোঁতা কিন্তু ইনক্সিয়ার ফলে স্পাইনগুলো সূক্ষ্ম।

বাংলাদেশে বিরল আরেক প্রকার ধুতরার কথা জানা যায় যেগুলো ভারতের বিহার ও উড়িষ্যা অঞ্চলে দেখা যায়। সাধারণ ধুতরা, গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ যার উচ্চতা ৩-৪ ফুটের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে কিন্তু উল্লিখিত উদ্ভিদের উচ্চতা ১৫ থেকে ৩০ ফুট পর্যন্ত হতে পারে। একে বড় গুল্মের পরিবর্তে ধুতরা গাছ বলাই হয়ত বেশি সঙ্গত।

বিহার অঞ্চলে এর দুটি নাম, রাজধুতরা ও গজঘন্টা। ধুতরা ও রাজধুতরা উভয় প্রকার গাছেরই বেশিরভাগ ফুল সাদা যা রাত্রে ফোটে, অন্যান্য রঙের মধ্যে হলুদ, গোলাপি, বেগুনি ও লাল রঙের দেখা যায়। এদের শুকনো ফল ফেটে বীজ বেরিয়ে পড়লে পাখিরা আহার করে ও বীজ বিসরণ ঘটে। যে কোনো রকম ধুতরার বীজ মাটির নিচে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত সুপ্ত অবস্থায় থাকতে পারে যা উপযুক্ত পরিবেশ পেলে অঙ্কুরিত হয়। ধুতরা ফুলে পরাগায়ন করে মথজাতীয় পতঙ্গ। রাজধুতরার গাছে এক ধরনের প্রজাপতির (Placidula euryanassa) শূককীট লালিত হতে দেখা যায় যারা পূর্ণাঙ্গ অবস্থায় পৌঁছাবার আগে গাছের পাতা থেকে ট্রোপেন সংগ্রহ করে দেহকে বিষাক্ত করে ফেলে। এতে ভবিষ্যতে খাদকের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার সুবিধা হয়।

রাজধুতরার সঙ্গে সাধারণ ধুতরার প্রধান তফাৎ হলো এদের ফুলের আকার ও মুখিতা। ধুতরার ফুল ঊর্ধমুখী, আকারে ৭ ইঞ্চির মতো লম্বা; রাজধুতরার ফুল প্রায় এক ফুটের মতো, নিচের দিকে ট্রাম্পেটের মতো ঝুলে থাকে যেকারণে এর এক নাম এঞ্জেলস্ ট্রাম্পেট (Angel’s Trumpet) যা অপরাপর ধুতরা ফুলের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ধুতরার চেয়ে রাজধুতরার ফুলের ঘ্রাণ বেশি মিষ্টি। এদের আদিবাস দক্ষিণ আমেরিকার এন্ডিজ পার্বত্য এলাকায়। ইংরেজিতে এটি ব্রাগম্যানসিয়া (Brugmansia) নামেই অধিক চিহ্নিত। এই গণের সাতটি প্রজাতি আছে যার সবক’টিই এখন তাদের আদি প্রাকৃতিক নিবাস থেকে লুপ্ত হয়েছে বলে মনে করা হয়।

রাজধুতরার চাষ করা হয় ব্রাজিলসহ পৃথিবীর বেশ কয়েকটি দেশে। লক্ষ্য করা গেছে, রাজধুতরার গাছ একক কাণ্ডে কোমর সমান উঁচু হওয়া পর্যন্ত তাতে ফুল ধরে না, গাছ শাখাবিভক্ত হওয়ার পরেই ফুলের সমারোহ হয়। যদি শাখাবিভক্ত হওয়ার আগে স্টেম-কাটিং করে গাছ লাগানো হয় তবে সেই গাছ থেকে ফুল পেতে হলে শাখা গজানো পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। অন্যদিকে, যদি উঁচু শাখাপ্রশাখাময় গাছ থেকে কাটিং করে রোপন করা হয় তবে তাতে বেশ ছোট অবস্থাতেই ফুল ধরতে দেখা যায়।

কার্ল লিন্নিয়াস ১৭৫৩ সালে ব্রাগম্যানসিয়াকে ড্যাটুরা (Datura) গণের অংশ বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। জানা যায়, প্রকৃত গাছ নয়, একটি অঙ্কিত চিত্র থেকেই তিনি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এর পঞ্চাশ বছর পর বিশিষ্ট ছত্রাকবিদ ‘ক্রিস্টিয়ান পার্সুন’ একে ডাচ প্রকৃতিবিদের নামানুসারে ‘ব্রাগম্যানসিয়া’ গণে অন্তর্ভুক্ত করেন। কিন্তু প্রকৃত গণ নিয়ে দেড়শ বছরের বেশি সময় পর্যন্ত মতবিরোধ থেকে যায় উদ্ভিদবিজ্ঞানীদের ভিতর। সবশেষে ১৯৭৩ সালে ‘ড. টম লকউড’ ধুতরা ও ব্রাগম্যানসিয়ার অঙ্গসংস্থান (Morphology) সম্পর্কে বিস্তৃত অধ্যয়ন করে একে স্পষ্টভাবে আলাদা করে দেন Brugmansia Genus হিসাবে যা অদ্যাবধি আর পরিবর্তিত হয়নি। এখন এর দুটি ভাগ হয়েছে, শীতপ্রধান ও উষ্ণমণ্ডলীয় গাছ হিসাবে যেমন, Brugmansia arborea শীতপ্রধান ও Brugmansia suaveolens উষ্ণমণ্ডলীয়।

3 1 ধুতরা বিষের রকমফের
সাদা ধুতরা ফুল। ছবি: ট্রেক নেচার।

আয়ুর্বেদে ধুতরা গাছের পাতা, ফলবীজ ও শিকড় ব্যবহার থেকে যে সব চিকিৎসার কথা জানা যায় তাদের মধ্যে রয়েছে, ফোলা ও ব্যথা, টাক পড়া, চর্মরোগ, হাঁপানি, কুকুরের কামড়, পা-ফাটা, ছুলি, কানের যন্ত্রণা, ক্রিমি, স্তনের প্রদাহ, ফোড়া ও বাতের ব্যথা। এ ছাড়া দক্ষিণ ভারতীয় সিদ্ধা চিকিৎসায় যে সব রোগের উল্লেখ দেখা যায় তার মধ্যে রয়েছে পার্কিনসনস্‌ ডিজিজ, নিউর‍্যালজিয়া, প্রদাহজনিত জ্বর, দাঁতের ব্যথা, চুল পড়া, খুশকি, অর্শ ইত্যাদি।

ঔষুধি গুণে সকল ধুতরাই প্রায় এক রকম, সবকটির ভিতরেই ওষুধের জন্য প্রয়োজনীয় উপক্ষার বা অ্যালক্যালয়েড (অ্যাট্রোপিন, স্কোপোল্যামাইন ও হাইওস্কায়ামাইন) থাকে যার সবকটিই তীব্র বিষ। কিন্তু এই ভেষজ বিষেই লুকিয়ে রয়েছে কঠিন অসুখ নিরাময়ের জন্য দরকারি ওষুধবিষুদ। চরক, সুশ্রুত ইত্যাদি সংহিতায় দেখা যায় ওষুধ হিসাবে ধুতরার প্রয়োগ মূলত বাহ্যিক, অভ্যন্তরীন প্রয়োগ বিরল। ভেষজরসায়নবিদ ও বিষ-বৈদ্যরাই এসব নিয়ে চর্চা করেছেন বেশি কিন্তু কিছু কারণে তাদেরও নানাপ্রকার সীমাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে, যার অন্যতম হলো ঔষধি-বিষ আহরণ ও বিশ্লেষণের জন্য অপ্রতুল প্রযুক্তি।

আবহাওয়া, পরিবেশ, মৃত্তিকাগুণ, গাছের বয়স ও কৃষিকাল, নানা কারণে একই প্রজাতির গাছে ভিন্ন ক্ষমতাসম্পন্ন উপক্ষার তৈরি হতে পারে যা রাসায়নিক বিশ্লেষণ ব্যতিরেকে বোঝা দুঃসাধ্য। উপমহাদেশীয় প্রাচীন বৈদ্যরা এসব সীমাবদ্ধতার কারণেই একটি গাছের দ্রব্যগুণ নির্ধারণ করার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে মূল্যবান অভিজ্ঞতা অর্জন করতেন। কখনো প্রধান শিকড় বাদ দিয়ে তারা সংগ্রহ করেছেন মূলরোম, ছায়ার গাছকে রৌদ্রের গাছ থেকে আলাদা বিবেচনা করেছেন, এমন কি উত্তর দিকের শিকড় দক্ষিণ দিকের শিকড় অপেক্ষা উত্তম কি না তাও ভেবে দেখেছেন।

এখন উন্নত প্রযুক্তির সহায়তায় বিষাক্ত উপক্ষার সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের সুবিধা হয়েছে এবং এতে ওষুধের মাত্রা নির্ধারণ করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বিষাক্ত ওষুধের মাত্রা নির্ধারণের কাজটি সম্পন্ন হলে এইডস্‌, ক্যান্সার, হার্টের অসুখ জাতীয় কঠিন রোগের মোকাবিলা করতে অনেক সুবিধা হবে আমাদের।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!