প্রবহমান: পর্ব – এক

হোসনে আরা মণি
হোসনে আরা মণি
17 মিনিটে পড়ুন
প্রবহমান

ন্যালনেলে জিভে আমার ত্যালত্যাল করে
মা-বাপের ঘর না রে তুলে নেবো গালে।

কই মাছগুলোন ভাতুরিয়া বিলের। বর্ষাকালে বিলের চেহারা যাই থাক এই জাড় যায় যায় সময়ে বিলের বুকে পানি বেশি নেই। বিলের মধ্যিখানে দোপ যেখানে একটু গভীর সেখানেই এখন হাঁটুপানি। তবে এঁটেল কাদার পাঁক সে পানির তলায় এতই পুরু করে বিছানো যে একবার কেউ নামলে হয়, অমনি উরু দুটো শালকাঠের খুঁটির মতন পোঁতা হয়ে যায় আর পানি ছুঁয়ে দিতে চায় থুতনিতলার সুন্নতি মাপের দাড়ি। পাঁকের গভীরে পুঁতে যাওয়া পা টেনে তুলে কদম ফেলা সহজ না; বড় মেহন্নতের কম্ম সেটা। তয় মেহন্নত করতে জানলে আর শিকারে দক্ষতা থাকলে আখেরে যে লাভ হয়, তার পরিমাণ বড় কম না। কম ছে কম এক খালই কই-মাগুর-শিং-টাকি-বাইম-মেনি-ট্যাংরা-খলসে-পুঁটি আর বাঁকে ঝোলায়ে লোক দেখায়ে বাড়ি বয়ে নেয়ার মত শোল কিংবা গজাড়।

লোকমান এক খালই কৈ-মাগুর-টাকি আর গামছায় বাঁধা খলশে-পুঁটি নিয়ে বাড়ি ফিরল ভাটেল বেলায়। হাটুরেরা তখন গামছা কাঁধে ধামা মাথায় হাট থেকে ফিরতে শুরু করছে দুই-একজন করে। রওজান বিবি খাসি মোরগটারে হাটে পাঠাবে বলে সকাল থেকে বেঁধে রাখছিলো। লোকমানকে দেখে তাই মুখ নাড়া দিয়ে বলে ওঠে, আবাগির বিটা হাটবারের দিন দিনমান কহানে কাটায়ে আইলো, হাট ভাঙ্গলি তয় হাটে যাবিরে আঁটকুরের পুত?

লোকমান হাসে। কালো মাড়িতে পোতা সাদা দাঁত দু’কান পর্যন্ত প্রকাশ করে সে হাসে। তার হাসিতে রওজান বিবির পিত্তিটাই বুঝি জ্বলে যায়। আরো শক্ত কিছু বলতে যাবে এমন সময় তার চোখ পড়ে লোকমানের হাতের দিকে। ব্যাপার বুঝে রওজান বিবি একটু নরম হয়। শীতের শেষ দিকে এক খালই মাছ হেলা করবার জিনিস নয়।

বর্ষাকালে অবশ্য ভিন্ন কথা। তখন খাল-বিল উপচানো, পুকুর ছাপানো পানিতে মাছের খলবলানি ডাঙ্গার প্রাণিদের চেয়ে ঢের বেশি। তখন একটা ঝাঁকি জাল ঠিকমত একবার ফেলতে পারলেই দুই বেলার ব্যবস্থা হয়। কত কত মাছ যে তখন অপচয় হয়! মেছো স্বভাবী মানুষ যারা, মাছ ধরারটা যাদের ভাঙের নেশার চেয়েও বেশি, তারা অকারণেই মাছ ধরে। তাদের বৌদের সামর্থ্যে যতটা কুলোয় ততটা তারা কোটে-বাছে, শুঁটকি করে; বাকিটা ফেলে দেয় হাঁস-মুরগির খোঁয়াড়ের দোরে। বাতাসে তখন ভাসে মাছের আঁশটে গন্ধ। আকাশে ওড়ে চিল-বাজ-ঈগল। পানির বুকে লুকোচুরি খেলে পানকৌড়ির ঝাঁক। মেছোরা মাছ ধরার পাশে পানকৌড়িও ধরতে চেষ্টা করে, তবে সফল হয় কদাচিৎ। পানকৌড়ি ডুবসাঁতারে পটু অতি সতর্ক পাখি।

লোকমানও পানকৌড়ির মত ডুবসাঁতারে পটু। এ সাঁতার সে যে শুধু খালে-বিলে দেয়, তাই না; দৈনন্দিন জীবনেও সে ডুবসাঁতারের খেলা খেলে। কখন, কোথায়, কতখানি ডুব দিলে উপস্থিত ঝামেলা বা বিপদকে কাটায়ে যাওয়া যায় তা তার চেয়ে ভালো কম লোকেই জানে। রওজান বিবির ঝাঁজের মুখে সে এখন হাসিমুখে খালইটা বাড়ায়ে ধরে। খালইয়ের মধ্যে চোখ পড়াতে রওজান বিবির ভেতরটা অবশ্য নরম হয়, কিন্তু মুখে সে ভাব প্রকাশ না করে বলে, ধুরো! বৌরা এই এট্টু আগে নায়ে-ধুয়ে উইঠলো, এহন অবেলায় তোর এই মাছ কুটবি কিডা?

লোকমান তাড়াতাড়ি বলে, এহন কাটা-কুটো লাগবিনে দাদী, চাড়ি আনো জিয়েয় থুই। ডেলি পানি বদলায় দিলি এক মাসেও এ মাছ মরবিনে।

নাহ্, মরবিনে! মাছের তো তোর মতন বিলেইর জান! পানি ঘুলায় মারা মাছ জিয়েই থুলি কয়দিন থাহে? হাতে উডা আবার কী?

লোকমান এবার একটু মলিন মুখে গামছার পুঁটলিটা খুলে দেখায়। বিকেলের স্নিগ্ধ আলোয় পুঁটিগুলো চকচক করলেও শ্যামল বরণ খয়রাগুলো কাদামাখা শরীরে নির্জীব পড়ে থাকে। পুঁটি-খয়রার চচ্চড়ি রওজান বিবির প্রিয় হলেও আজ এ অসময়ে এতগুলো মাছ দেখে সে তত খুশি হয় না। মোরগটা আজকের হাটে তুলতে না পারার হতাশা তাকে চট করে ছেড়ে যায় না।

রমিজের বৌ আকিমন এতক্ষণে চাড়ি নিয়ে এলে লোকমান তাতে খালইয়ের মাছগুলো ঢেলে দেয়। বেশিরভাগ মাছই জীবিত ও আতঙ্কিত। আজন্ম যে পরিবেশে তারা অভ্যস্ত তার সম্পূর্ণ বিপরীত পরিবেশে তাদের যে কী অবস্থা হয় তা নিয়ে ভাববার মতো হৃদয় সেখানে ছিল না। মানুষের সন্তানেরা মাছেদের খলবলানি দেখে লোভমাখা আমোদের চোখে। যেমন এখন ডুরে শাড়ি পরা, আধখানা ঘোমটা টানা ছোট-খাটো এক বৌ রওজান বিবির পিছন থেকে উঁকি দিয়ে চকচকে চোখে চাড়ির মাছ দেখছে। কৈ মাছগুলো কানে হেঁটে চাড়ি বেয়ে উঠতে চেষ্টা করছে দেখে আর শোল-টাকিগুলো লাফায়ে লাফায়ে পালাতে চেষ্টা করছে আর লোকমান সেগুলোকে সামলাতে নাজেহাল হচ্ছে দেখে কী এক শিশুবোধ্য আনন্দে সে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে।

কিন্তু সে হাসির ধারা সম্পূর্ণতা পাওয়ার আগেই যেনো হোঁচট খেয়ে থেমে যায়। কঠিন চোখে আকিমন তার দিকে চেয়ে বলে, বৌ মানুষের হাসি শুনে রাস্তার হাটুরেরা ফিরে চায় − লজ্জ্বা-শরম নেই?

রওজান বিবি স্নেহের স্বরে বলে, অত জোরে হাসে না বু। যাও, মাছ ধুয়ার মালশা নাইতো কুলো আনো, গুড়ো মাছগুনো ঢালি।

বৌটা চুপসে যাওয়া মুখে ঘোমটাটা আরেকটু টানতে টানতে ধীর পায়ে ফিরে যায়। লোকমান তেরচা চোখে চেয়ে দেখে।

গেলো হাটে কেনা নতুন কুলোটা নিয়ে বৌ ফিরে আসে। আধমণ সর্ষে বেচে ঘর-গেরস্থালীর ডালা-কুলো সব কিনেছিলো রমিজ মিঞা। লোকমান সাথে থেকে পছন্দ করে, টিপে-টুপে কেনাকাটায় সাহায্য করেছিল। তাই কুলোটা দেখেই সে চিনতে পারে। বাড়ায়ে ধরা কুলোর দিকে তাকায়ে সে একটু দ্বিধায় পড়ে। তা দেখে রওজান বিবি স্নেহের স্বরে বিরক্তি মিশিয়ে বলে, আরাক আবাগীর নাতিনির কাম দেহ। নতুন কুলো আনিছে পচা ক্যাদার মাছ ঢালতি।

কৈ-মাগুরের চাড়িতে পানি ঢালতে ঢালতে আকিমন চোখ তুলে তাকায়। তারপর এক ঝটকায় বৌয়ের হাত থেকে কুলো টেনে নিয়ে মুখ বাঁকায়ে বলে, গিরস্থ ঘরের বৌ, মাছ ঢালার কুলো চেনো না? যেমন ঘরের ঝি, তেমনতর কাম।

রওজান বিবি আপত্তি জানায়, আহা! ওরে ক্যান গালাও? ঝিপুত মানুষ, বুঝবার পারি নেই।

রমিজের বৌ শাশুড়ির কথার জবাব দেয় না। গম্ভীর মুখে নিজেই কুলো আনতে রান্নাঘরের দিকে যায়। ছোট্ট বৌটা গলা বাড়ায়ে একবার উঁকি দিয়ে খালইয়ের মাছ দেখে নিয়ে ধীর পায়ে ভেতরবাড়ি চলে যায়।

লোকমান এই পুরো সময়টাই চোখ মোটামুটি মাটির দিকেই গেঁথে রাখতে চেষ্টা করেছিলো। তবু বেয়াড়া চোখ যা দেখার তা ঠিকই দেখে নেয়। সাত-আট বছরী গোলগাল পুতুল পুতুল মুখ-চোখঅলা একটা মেয়ে বছর দেড়েক আগে রমিজ মিঞার ‘এট্টা মোটে পুত’ শরাফত মিঞার বৌ হয়ে বছর না ঘুরতেই শ্বশুরঘর করতে এসেছে। বাপ-মা মরা এক পোড়া কপালিরে পুতের বৌ করতে আকিমনের ঘোর আপত্তি থাকলেও রমিজ মিঞা তাতে কান দেয়নি। জীবনে এই একটা কাজ রমিজ মিঞা ঘরনীর অমতে করেছে।

বড়ই ফুটফুটে সুন্দর শরাফতের বৌ। অত রূপ লোকমান আর তো কোথাও দেখেনি। এমন তো নয় যে লোকমান এই গ্রাম আর আশপাশের দুই-চার গ্রাম ছাড়া আর কোহানেও যায়নি। দূর-বহুৎ দূর − সেই কোন নড়াইল জেলা, যেখানকার নদীর নাম চিত্রা। খুব ভোরে রাজাপুর ঘাট থেকে কেয়ারি নাওয়ে চেপে নবগঙ্গার ভাটি বরাবর রওনা হলে দুই পহর বেলা পারায়ে ভাটেল বেলার সিন্দুরে মেঘ ভাসা পানির যে ঘাটে নাও ভিড়বি সেটাই নড়াইল জমিদার বাড়ির ঘাট। সেই ঘাটে যে সে নাইয়ার নাও ভিড়ানো বারণ।

কিন্তু গাঙ্গের মাঝ বরাবর হাল সোজা রেখে নাও চালায়ে নিতে তো আর মানা নেই। উজান বেলায় যেতে আর ভাটির সময় ফিরতে পানির উল্টো টান এড়াতে একটু ধার ঘেঁষেও যাওয়া চলে। লোকমান যেতে আসতে কতবার সেই ঘাটে কত গিনি সোনার মতন ঝিলিক দেয়া রূপসীদেরকে দুই-চার ঝলক দেখে নিয়েছে! গেদু মাঝির মতন জমিদার বাড়ির ঘাট পানে হাঁ করে চেয়ে সে থাকে না। অমন বদ খাসলত তার নয়। তাই বলে যা দেখার তা কি সে দেখে না? নিশ্চয় দেখে। দুই হাতে দুধসাদা শাঁখা আর সোনার বালা পরা মেয়েরা বাহারে শাড়ির আঁচলে ঘোমটা টেনে আলতা পরা পায়ে গাঙ্গের শীতল-কালো পানিতে নামে, গা ধোয়, ভেজা শাড়ি লেপ্টে থাকা শরীর লাল গামছায় আব্রু করে ভরা কলসি কাঁখে বাড়ি ফেরে।

কেউ কেউ তেঁতুলে মাজা ঝকঝকে কাঁসা-পিতলের বাসনের স্তুপ এক হাতের তালুতে তুলে ধরে আরেক হাতে বুক-মাথায় আঁচলের আড়াল সামলাতে সামলাতে ঘাটের পাড় ধরে বাড়ির পথে হেঁটে যায়। এতকাল সেই মেয়েগুলো ছিলো তার জীবনে দেখা সেরা রূপবতী, দুনিয়ার বুকে বেহেশতের হুর, ডানাকাটা পরী। কিন্তু শরাফতের বৌয়ের মুখটা সে যেদিন দেখেছে সেদিন থেকে তার ধারণা বদলে গেছে। কী যেনো আছে বৌটার মুখে। কচি, হ্যা, নেহাতই কচি সে। যখন প্রথম এ বাড়িতে আসে তখন তো সবার মুখের দিকে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকতো। লোকমানের মুখেও সে নিশ্চয় চাইতো।

কিন্তু কী এক দুর্বোধ্য কারণে লোকমান তার সাথে কথা-বার্তা তেমন বলতে পারতো না, এখন তো একেবারেই পারে না। অথচ এমন নয় যে, এ বাড়ির পর্দাপ্রথা কাজীদের বাড়ির মতো কড়া। এ বাড়ির বৌয়ের যখন তখন হালটে যাওয়া বারণ, জোরে হাসায় মানা; কিন্তু সেটা বাইরের সমাজের কাছে পরিবারকে ইজ্জ্বতদার বলে পরিচয়ের সচেতনতায়। আত্মীয়-অনাত্মীয় যে পুরুষেরা যখন-তখন বেকি বেড়া পার হয়ে উঠোনে দাঁড়ায়ে হাঁকডাক করার ক্ষমতা রাখে তাদের জন্য বৌ মানুষের কপালের উপর একটু ঘোমটা টানাই যথেষ্ট। ঘোমটা খসে গেলেও ক্ষতি নেই, ফের টেনে দিলেই হলো।

রমিজ মিঞার বাড়িতে লোকমান এমন একজন যার কাছে পর্দা করার কথা বাড়ির কেউ ভাবে না। শরাফতের বৌ তো তার চোখের সামনে রোজ একটু একটু করে বড় হচ্ছে। আরো বড় হতে হতে সম্পূর্ণ বড় হয়ে গেলেও কেউ নিশ্চয় তাকে শরাফতের বৌয়ের দিকে চোখ তুলে তাকাতে কি কথাবার্তা বলতে নিষেধ করবে না। অথচ লোকমান তার সাথে কথা বলা দূরে থাক ভালো করে তাকাতে পর্যন্ত পারে না। তাকায় সে অবশ্যই। শুধু তাকানো কেন, চেয়ে চেয়ে চোখের আশ মিটিয়ে দেখতেও সে চেষ্টা করে। কিন্তু সেটা বড় দূর থেকে, বহু দূর থেকে; কাছ থেকে সরাসরি না তাকিয়ে তেরছাভাবে।

শরাফতের বৌ প্রতিদিন শাশুড়ির মুখ ঝামটা আর দাদী শাশুড়ির আদরের সাথে শরাফতের সোহাগ গুলে শরবত করে খেয়ে দিনদিন চন্দ্রকলার মতো বাড়ছে − এমনই হলো লোকমানের ধারণা। কিন্তু আকিমনের ধারণা অন্যরকম।

হাড়হাভাতে ঘরের ঝি − ছোঁচা বিড়ালের মতন স্বভাব। দিনরাত খাই খাই ভাব নিয়ে ঘরের কোনা-কানাছ আর হেঁশেলের পাড়ে ঘুরঘুর করা ছাড়া আর কোন কাজটা আছে তার? ওর জ্বালায় তো শিকের হাঁড়িতে কিছু তুলে রেখেও শান্তি নেই। বিড়ালের কপালে শিকে ছেঁড়ার দরকার পড়ে, কিন্তু প্রত্যেক দিন একটু একটু করে ঢ্যাঙ্গা হয়ে উঠতে থাকা বৌটা হাত বাড়ালে শিকে কেন, আর কদিন পর ঘরের আড়াই না ছুঁয়ে ফেলে! তাছাড়া বৌয়ের মেড়া শরাফতটাই কি কম! বৌয়ের নোলা ভরতে গাছের ফল-পাঁকুড় যা যখন পায়, সব এনে বৌয়ের কোঁচড়ে ঢেলে দেয়। এমন হবে জানলে আকিমন কিছুতেই এ বিয়ে ঘটতে দিত না।

ছয় বছরী হিরণবালা ওরফে রাঙাবড়ুর লাবণ্য ঢলঢল সোনামুখ দেখে মায়া হওয়ায়, নাকি এতিম উদ্ধার করে সওয়াব হাসিলের বাসনায় রমিজ মিঞা এতই ব্যস্ত হয়ে পড়ছিলো যে একমাত্তর পুত্তুর আঠারো বছরী শরাফতের সাথে বিয়ে কবুল করে আসতে সে কারো মতামতেরই তোয়াক্কা করেনি। কথা ছিল বৌ তুলে আনবে বছর পাঁচ-ছয় পর। কনে ঋতুমতী না হওয়া পর্যন্ত তারে বাপের বাড়িতে রেখে দেয়ার প্রচলন আছে। উৎসব-পার্বনে আনা যেতে পারে কদিনের জন্য, আর সেই কদিন কনেকে পাহারা দিয়ে রাখতে তার বাপের বাড়ির কেউ না কেউ সাথেই থাকে। কিন্তু আকিমন বিবির কপাল! ছয় মাস না পেরোতেই অভিভাবক চাচা খবর পাঠাতে শুরু করলো। নদী-ভাঙ্গা মানুষ তারা। প্রমত্তা মধুমতীর সর্বগ্রাসী ভাঙ্গনের কবলে হিরণবালার বাপের ঘর-বাড়ি, জমিজমা যা কিছু ছিল সব গেছে। যে মহাজনী নাওটা ছিলো তা এখন চাচার দখলে।

কিন্তু এক নাওয়ের কামাইয়ে তো আর তারা হিরণের সারা বছরের খোরাকি টানতে পারে না! খোরাকির কথা অবশ্য তারা কিছুই বলেনি। বলছিল তাদের ঘরবাড়ির দুরবস্থার কথা, বলছিল তাদের আদরের রাঙাবড়ুর প্রতি তাদের ভালোবাসার কথা। তারা নিজেরা না হয় ধূ ধূ বালুময় চরে ঘর তুলে কোনমতে দিনযাপন করছে, বাপমায়ের অত সোহাগের রাঙাবড়ুরে তারা কেন এই পরিবেশে কষ্ট করতে দেখবে। তার চেয়ে অভাগী ভাইঝিটারে যদি তার শ্বশুরের বাড়ি, তার স্বামীর ঘরে তারা ঠাঁই পেতে দেখে তবে এখন মরে গেলেও চাচার মনে কোন আফসোস থাকবে না। তিনি তার কর্তব্য করতে পেরেছেন জেনে নিশ্চিন্তে মরতে পারবেন।

স্বল্পভাষী রমিজ মিঞাকে রাশভারী বলে মনে হলেও আসলে সে নরম দেলের মানুষ। অত কাঁদুনীতে আকিমনের মনটাই কেমন স্যাঁতসেঁতে হয়ে উঠেছিলো তো তার আলাভোলা ভাবুক স্বামী! কাজেই আরো তিন মাস সময় নিয়ে চৈতালি উঠলে পরে তেলফসলের অর্ধেক বেচে রূপার মল, বাঁজু, কণ্ঠি, ধানতাবিজ আর সোনার মাকড়ি, নথ ও চাঁদ-তারা টিকলিতে সাজিয়ে রমিজ মিঞা বৌমাকে ঘরে আনলো। বালেগা না হওয়া পর্যন্ত স্বামী সংসর্গ হতে রক্ষার প্রয়োজনে রমিজ মিঞা তারে নিজের ঘরে স্ত্রীর জিম্মায় রেখে রাত কাটাতে থাকলো কাছারি ঘরে।

শরাফত মিঞার বয়স এখন কুড়ির কোটায়। লম্বা-চওড়া কাঠামোয় টগবগে স্বাস্থ্যবান পুরুষ শরাফত সুযোগ পেলেই বৌয়ের পরে হামলে পড়তে চায়। সে নিয়ে এ বাড়িতে যা সব কাণ্ড ঘটে তার কিছু কিছু লোকমানের কানেও উড়ে গিয়ে ঢোকে। আকিমনের ভাবনায় ‘বৌয়ের মেড়া’ শরাফত যেমন বৌয়ের জন্য জান কবুল করে তেঁতুল গাছের মগডালে উঠে তেঁতুল পেড়ে আনে, গাছপাকা জামের জন্য মটকা ডালে পা রাখতে দ্বিধা করে না, তেমনি লোকমানের বিবেচনায় ‘বদমেজাজী’ শরাফত ‘অবাধ্য’ বৌয়েরে নাকি মাঝে মধ্যে চড়-চাপড়ও মারে।

চড়-চাপড় না হোক, খুন্তি-খাপাসির দুয়েকটা বাড়ি শাশুড়ি আকিমনও দিয়ে বসে। না দিয়ে উপায় কী? যা ন্যালনেলে স্বভাব বৌটার! ভালো কিছু রান্না হতে দেখলে চুলোর পাড় থেকেই ছোঁক ছোঁক করতে শুরু করে। শিয়ালের কাছে মুরগী জমা দেয়ার প্রবাদ আছে, বিড়ালরে মাছ-দুধ পাহারা দিতে দিলে কী ঘটে তাও সবার জানা, কিন্তু শরাফতের বৌয়েরে হেঁশেল পাহারায় বসালে যে কী হয় তা জানে একমাত্র আকিমন। খানিকটা রওজান বিবিও জানে, মানে আকিমনের মুখ থেকে সে শুনতে পায়; কিন্তু সে কথা রওজান বিবি তত কানে তোলে না। আহা! বাপ-মা মরা পোড়াকপালি মায়্যেডা! এই তো ভালো-মন্দ খাওয়ার বয়স।

রওজান বিবি যে বয়সকালে আকিমনরে খুব ভালো-মন্দ খাইয়েছে তা আকিমন মনে করে না। এই আদিখ্যেতায় তাই তার গা জ্বলে যায়। আষাঢ়ী ঢলে নতুন পানি পেয়ে খুশিতে খলবল করতে থাকা মাছেরা যেমন উজান বাইতে শুরু করে, তেমনি খলবলানি স্বভাব শরাফতের বৌয়ের। শ্বশুর বাড়িতে পা রেখেও সে ছিবুড়ি, গোল্লাছুট খেলতে চাইতো। পাড়ায় বেশ কিছু সই-সাঙাতও তার আছে। এখনো সুযোগ পেলেই সে তাদের সাথে এক্কাদোক্কা, কানামাছি খেলে। খেলা ছাড়াও রাজ্যের যত দস্যিপনায় তার ঝোঁক। ঘর-গেরস্থালীর কাজে মন নেই, দিব্যি আছে আকাজের খই ভাজা নিয়ে।

এইতো কদিন আগেই তার পুতুল বিয়ে দিলো ও বাড়ির ছবিরনের ছাওয়াল গ্যাদা মিঞার সাথে। নাতবৌয়ের এসব সোহাগী ধিঙ্গিপনা রওজান বিবি আমোদের চোখে দেখে। অথচ আকিমন বিয়ে হয়ে আসার মাসখানেক পর একদিন পাকা টুসটুসে একটা আম পাড়তে হাতের কাছে আঁকশি না পেয়ে সিন্দুরে আমগাছটার বেশ একটু উপর ডালে উঠেছিলো বলে শাশুড়ির সে কী গোস্বা! কতক্ষণ ধরে মুখ করে শেষে বলেছিলো, মিঞাবাড়ির বৌ, মাটি আর পাটি ছাড়া আর কুনোহানে পাও ফেলে না, মাটিত্তে পাও উঁচায় আসমানে তোলে না।

সব কথা মনে আছে আকিমনের, সব। স্বামী-শাশুড়ি মিলে কী সোহাগে যে তার জীবনটা ভরে দিয়েছে তার কিছুই সে ভোলেনি। বাপ-মায়ের এক পুত রমিজ মিঞা। রওজান বিবির পেট থেকে জ্যান্ত-মৃত সাত-সাতটা সন্তান বের হলেও এতটা বয়স পর্যন্ত বেঁচে আছে এই এক রমিজ মিঞাই। মায়ের অতি আদরের, অতি মনোযোগের ধন সে। বলতে গেলে সে তো তার মায়ের অন্ধের যষ্ঠিই। স্বাভাবিকভাবেই রওজান বিবি তারে চোক্ষে হারায়। মায়ের আঁচল ছায়ায় পড়ে থাকার দরুণ কিনা তার দৈহিক বাড়-বৃদ্ধি যেমন হয়েছে কম, তেমনি পুরুষ হয়ে ওঠার ব্যাপারেও ঘটেছে খামতি। মায়ের আঁচল ছেড়ে স্ত্রীর আঁচল তলে মুখ গুঁজবার বয়সে পৌঁছেও সে যেন আকিমনরে চোখেই দেখতে পায়নি। আর পুরুষ যদি যৌবনের শুরুতেই স্ত্রীকে চোখে দেখতে না পায় তো বাকি জীবনে আর তার দেখা হয়ে ওঠে না।

শরাফতের বৌয়ের মুখের পানে আড়চোখে একবার তাকিয়েই লোকমান দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিয়েছিল, কিন্তু ঐ মুখের যে ছাপ তার বুকে বসে যায় তা তার বুকটাকে কেমন ভারী আর মুখটাকে বিমর্ষ করে তোলে। মাছের ছুটোছুটি দেখে একজোড়া উজ্জ্বল ডাগর চোখের চকচকিয়ে ওঠা দৃষ্টি তিরষ্কারের ফুঁয়ে যেভাবে নিভে যেতে সে দেখলো তা তাকে কেমন যেন বিহ্বল করে। অন্য মনে অলস পায়ে গোসলের উদ্দেশ্যে সে যখন পুষ্করিনীতে নামে তখন হাঁটে যাওয়ার বেলা সেদিনের মত পুরোপুরি গড়ায়ে যায়।

চলবে …

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
জন্ম - মাগুরা জেলার মহম্মদপুর থানার ওমেদপুর গ্রামে নানা বাড়িতে জন্মতারিখ- প্রকৃত: ২৭ জুন ১৯৭৭, সনদীয়: ২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯ পিতা- মোঃ আব্দুল গফ্ফার মোল্লা মাতা- সালেহা ইয়াসমিন সংসারসঙ্গী- মোঃ দেলোয়ার হোসেন (মাহমুদ) তিন কন্যা- আদৃতা, অঙ্কিতা ও দীপিতা বর্তমান অবস্থান: রাজশাহী। পেশা: সরকারী চাকরি [উপপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত), জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর, বিভাগীয় কার্যালয়, রাজশাহী] প্রকাশিত গ্রন্থঃ ৭টি (৬টি গল্পগ্রন্থ, ১টি উপন্যাস) প্রথম: অপরাজিতা (সময় প্রকাশন) দ্বিতীয়: জীবনের পেয়ালায় ছোট্ট চুমুক (ইত্যাদি গ্রন্থপ্রকাশ) তৃতীয়: নদীও নারীর মত কথা কয় (বটেশ্বর বর্ণন) চতুর্থ: মহাকালে প্রান্তরে (পরিবার পাবলিকেশন্স) পঞ্চম: লিলুয়া জীবনের নারীগণ (বটেশ্বর বর্ণন) ষষ্ঠ: বিবিক্তা (বটেশ্বর বর্ণন) – উপন্যাস সপ্তম: তামসী (বইঘর)
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!