শেষ বেলার গান

কাকলি দাস
কাকলি দাস
7 মিনিটে পড়ুন

অনুপ মাস্টার গান শেখাতে যাওয়ার আগে পাশের ঘরে উঁকি দিয়ে দেখল, তার নতুন বউ ফোনে হেসে হেসে গল্প করছে কারুর সাথে। সামনে থেকে বউকে দেখতে খুব লজ্জা হয় তার। আসলে অনুপ মাস্টার কোনও দিন ভাবতেই পারেনি যে বড়লোকের একমাত্র মেয়ে তার জীবন সঙ্গিনী হবে। সুন্দরী মেয়েটিকে গান শেখাতো অনুপ মাস্টার। কি করে যে মেয়েটি তার প্রেমে পড়ল এখনো তার কোনো কারণ খুঁজে পায় না সে। দশ বছরের ব্যবধান তাদের মধ্যে। গান শেখানোর মাঝে সুন্দরী ছাত্রী কারণে অকারণে তার হাত ধরত। অনুপ মাস্টারের খুব অস্বস্তি হত।বুঝতে পারত না কি করা উচিত তার। ধীরে ধীরে ছাত্রীর জেদ বাড়তে লাগলো। অনুপ মাস্টার অনেক বুঝিয়েছে তাকে। ছাত্রীর মা বাবা কিছুতেই এ বিয়ে দেবেন না। কিন্তু ছাত্রী নাছোড়বান্দা। আত্মহত্যার হুমকি দিল। অনুপ মাস্টারের বিধবা মাও বললেন যে, এ বিয়ে টিকবে কিনা সন্দেহ। বড়লোকের মেয়ের খেয়াল এসব।

অনুপ মাস্টারকে দেখতে তেমন ভালো নয়। পড়াশোনাতেও তেমন কিছু একটা করে উঠতে পারেনি। চোখে চশমা, তাতে আবার হাই পাওয়ার। এমনিতে মানুষ হিসেবে খুব ভাল। সবাই ভালবাসে তাকে। সম্মানও করে। গানের কন্ঠটি চমৎকার তার। টুকটাক জলসাতেও ডাক পায়। বাড়তি কিছু রোজগার হয়। গানের শিক্ষক হিসেবে ভালো নাম করেছে। ঘরে বিধবা মা। মায়ে ছেলে চলে যেত কোনো রকম। কিন্তু এখন বউ এসেছে ঘরে। রোজগার বাড়াতে হবে। আরও অনেক টিউশানি চাই, জুটেও গেল। অনুপ মাস্টার খুশি তাতে। তবু অল্পবয়সী সুন্দরী বউকে সব দিক থেকে খুশি করতে পারবে কিনা তা নিয়ে খুবই চিন্তিত।

কিছুদিন পর থেকে বউ অভিযোগ শুরু করল যে সারাদিন তার বড্ড একা কাটে। কতক্ষণই বা বুড়ি শাশুড়ির সাথে গল্প করা যায়। রান্না ঘর শাশুড়িই সামলান। কি করবে সে সারাদিন ধরে! ম্যাগাজিন পড়তেও তার আর ভালো লাগে না। টিভিও না। অনুপ মাস্টার সারাদিন টিউশনে ব্যস্ত থাকে। স্বামীকে সে মনের মত করে পায় না। অনুপ মাস্টার বউকে মাঝে মাঝে বাপের বাড়ি যাওয়ার পরামর্শ দিল। তারপর বউ বাপের বাড়ি যাওয়া শুরু করল এবং একটু বেশী রকম। অনেক দিনই গিয়ে আর ফেরেনা। এর মধ্যে সন্তান সম্ভবাও হল বউ। অনুপ মাস্টার খুব খুশি। ভাবে এত সুখ কি তার সত্যিই সইবে! কয়েক মাস বাদে পুত্র সন্তান হল তাদের।

ছেলে হবার দু তিন মাস পর বাপের বাড়ি থেকে বউ ছেলেকে নিয়ে এল অনুপ মাস্টার। কিন্তু বউ এবার জেদ ধরল চাকরি করবে সে। এই বাড়িতে থেকে পড়াশোনা হচ্ছে না। তাই বাপের বাড়ি থেকে পড়াশোনা করে চাকরি করে অনুপ মাস্টারের পাশে দাঁড়াতে চায়। অনুপ মাস্টারের রাজি না হয়ে উপায় ছিল না কোনো। সংসার চালাতে যে তাকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। বউ আবার বাপের বাড়ি ফিরে গেল।

ছেলে বড় হয়ে উঠতে লাগলো। বউ চাকরি পেল। এখন বউকে আর তেমন করে কাছে পায়না অনুপ মাস্টার। বউ চাকরি নিয়ে খুব ব্যস্ত। এই বাড়িতে আর আসেনা। ছেলেকে মাঝে মাঝে নিয়ে আসে অনুপ মাস্টার। বউ তাতে আপত্তি করে না। কিন্তু বউ আর ফিরতে চায় না এবাড়িতে। অনুপ মাস্টার লুকিয়ে চোখের জল ফেলে। বিধবা মাও লুকিয়ে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে। বউয়ের সাথে এ নিয়ে অনেক বার কথা বলার চেষ্টা করেছে কিন্তু লাভ হয়নি তাতে। সুন্দরী বউ এখন অনুপ মাস্টারকে এড়িয়ে চলে। দেখা হলেও কথা বলে না আর। দু এক বছর আগেই এই বউ কথায় কথায় তাকে পাগল করে তুলতো। হঠাৎ করে যেন সব আলো নিভে যাচ্ছে অনুপ মাস্টারের সামনে। কানাঘুষোয় শুনতে পায় বউ নাকি অফিসের কোন লোকের সাথে মেলামেশা শুরু করেছে। কিন্তু এ নিয়ে কিছু বলার ইচ্ছে হয়নি তার। ছেলেটাকে নিয়েই একটু ভালো থাকার চেষ্টা করে।

পাকাপাকি ছাড়াছাড়ির নোটিশ পাঠাল বউ। অনুপ মাস্টার দম বন্ধ করে সই করে দিল তাতে। ছেলেকে নিয়ে যেতে চাইল বউ। ছেলে বাবাকে ছেড়ে কিছুতেই গেল না।

ছেলেকে নিয়ে আশায় বুক বাঁধল অনুপ মাস্টার। এরই মধ্যে তার মা চলে গেলেন হঠাৎই। অনুপ মাস্টার ছেলেকে আরও আঁকড়ে ধরল। একটি ছোটখাটো চাকরি জোটালো। টিউশানি আর চাকরি মিলে মোটামুটি চলতে লাগলো বাবা ছেলের সংসার। ছেলেকে ভালো ভাবে মানুষ করার জন্য প্রাণপণ খাটতে লাগল। কিন্তু ছেলে বড় হবার সাথে সাথে ধীরে ধীরে ক্ষোভ উগড়ে দিতে শুরু করল বাবার উপর। তার বন্ধুদের বাড়ি কত স্বচ্ছলতা। তাদের বাবাদের কত রোজগার। অনুপ মাস্টার দুঃখ পেলেও ছেলেকে বকতে পারত না কখনো। নিজের অক্ষমতায় নিজেই লজ্জায় ডুবে যেত। ছেলে পড়াশোনায় ভালোই করত। সেদিক দিয়ে অনুপ মাস্টার মনে মনে খুব গর্ব করত। সে নিজে তো পড়াশোনায় মোটেই ভালো ছিল না। অবশ্য ছেলের মা ভালো ছিল এ ব্যাপারে। মায়ের মতই হয়েছে অনেকটা ছেলে। এখন আর ঠিক মতো মুখটা মনে করতে পারে না ছেলের মায়ের। কত বছর হয়ে গেল দেখেনা। ছেলে মাঝে মাঝে অবশ্য যায়, মায়ের সাথে দেখা করতে।

এরই মধ্যে ছেলের পড়াশোনা শেষ হল। একদিন টিউশন থেকে ফিরে দেখল ছেলে খুব খুশির মেজাজে। জানালো সে একটি বড় চাকরি পেয়েছে। অনুপ মাস্টার হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে ছেলেকে জড়িয়ে ধরল। ছেলে আরও জানালো সে বিদেশে চলে যাচ্ছে চাকরি নিয়ে। অনুপ মাস্টার আনন্দে দিশেহারা। এতদিনে তার সব দুঃখ কষ্টের অবসান ঘটলো। সে ছেলেকে মানুষের মত মানুষ করতে পেরেছে ভেবে নিশ্চিন্ত হল। চেনা পরিচিত পাড়া প্রতিবেশী সবাইকে মিস্টি খাওয়ালো। ছেলে চলে গেল বিদেশ।

অনুপ মাস্টারের এখন আর কিছুই ভালো লাগেনা। ছেলের ফেলে যাওয়া বই পত্র জামা কাপড়ে হাত বুলায়। ছেলের মায়ের মুখটা খুব মনে করার চেষ্টা করে আজকাল। পারেনা। ছেলে বলেছে একবার বাবাকে নিয়ে যাবে বিদেশে। কিন্তু ছেলে ফোন করে না তেমন। অনুপ মাস্টার ফোন করলেও রেগে যায়। বলে প্রথম চাকরি, নতুন চাকরি। খুব ব্যস্ত তাই। কথা বলার সময় নেই একদম। বেশ কয়েক মাস পর ছেলেকে একবার ফোন করে বলে বিদেশে যাওয়ার কথা। এখানে একা একা ভালো লাগে না আর তার। ছেলে তারও কয়েক মাস পর জানায় বাবাকে, কয়েক বছরের মধ্যে আসতে পারবেনা সে কোনো মতেই। কবে আসতে পারবে জানা নেই।

অনুপ মাস্টার ছেলের উত্তর পেয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলো। তারপর হারমোনিয়াম টেনে গাইতে শুরু করল, “যে রাতে মোর দুয়ারগুলি ভাঙল ঝড়ে…. “এক লাইনের বেশী গাইতে পারল না আর। হারমোনিয়ামের রিডে মাথা রেখে কান্নায় ভেঙে পড়ল। বাইরে অঝোরে বৃষ্টি নামলো।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
১৯৭২ সালের ২০ আগষ্ট কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতা স্বর্গীয় শ্রী বিজন কুমার দাস, মাতা স্বর্গীয়া সন্ধ্যা দাস। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতক। কবি,গল্পকার, বাচিকশিল্পী, সংঙ্গীত শিল্পী, কলকাতা আকাশবাণী রেডিওর নাট্যশিল্পী। প্রথম কবিতার বই, ' হলুদ পাতার খোঁজে '। প্রথম গল্প সংকলন, 'মন বৃষ্টির গল্প কথা।' পশ্চিম বাংলা এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় লেখালেখি করেন নিয়মিত।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!