শতবর্ষী দুই মহান নেতা: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং কাজী নজরুল ইসলাম

ড. কাজী মোজাম্মেল হেসেন
ড. কাজী মোজাম্মেল হেসেন
35 মিনিটে পড়ুন

কাজী নজরুল ইসলাম একজন কবি, প্রেমের কবি, বুলবুল কবি, বিদ্রোহের কবি; বাঙলার কবি, বাঙালির কবি, বাংলাদেশের কবি, মুসলিম বাংলার জাগরণের কবি এবং আমাদের এক অগ্রদূত কবি। কবি ব্যতীত কাজী নজরুল ইসলামের রয়েছে বহুমাত্রিক পরিচয়: একজন খ্যাতমান সংগীতজ্ঞ, সুরকার, গীতিকার, রাজনীতিবীদ, সংগঠক, সমাজ-সংস্কারক ও বিদ্রোহী বীর।

একইভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের স্বাধীন বাংলার এক অবিস্মরণীয় নাম। বাংলাদেশ স্বাধীনের অগ্রনায়ক; আমাদের রাষ্ট্রনায়ক এবং জাতির পিতা। তার রাজনীতির মূল লক্ষ ছিল বাঙালিসহ সমগ্র মানবজাতির ভালোবাসা ও মঙ্গল কামনা। প্রমাণ হিসাবে শেখ মুজিবুর রহমানের ৩.৫.৭৩ তারিখের লেখাটি দাঁড় করানো যায়। যেখানে তিনি লেখেন: ‘একজন মানুষ হিসাবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসাবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পৃক্ত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।’

সকল মহৎ কবিতারই একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। কাজী নজরুলের ইসলামের কবিতার সাধারণ বৈশিষ্ট: পাঠককে কাছে টেনে নিয়ে তাকে কবির সঙ্গে পথ চলতে সাহায্য করে। আর সে কারণে নজরুল আজও আমাদের প্রাণের কবি, আদরের কবি, মহৎ কবি, মানবতার কবি, সাম্যের কবি, জয় বাংলার কবি, জাতীয় কবি। একইভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একজন বিচক্ষণ, সার্থক ও আদর্শবাদী রাজনীতিবিদ। যিনি আমাদের একটি স্বাধীন বাংলাদেশ এনে দেয়ায় প্রাতস্মরণীয় হয়ে আছেন।

ষাটের দশকে মওলানা ভাষানী বাঙালিদের জন্য যে স্বাধীন ভূখণ্ডের দাবি তুলেছিলেন; সে দাবির বাস্তব রূপ দান করা হয়েছিল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর একজন খাঁটি বাঙালি শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে। বাংলা ভাষা আন্দোলন, স্বাধীকার আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয়সহ সকল আন্দোলনের সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান। আর সে কারণে তিনি আজও বাংলাদেশের স্থপতি, প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি, বাংলার বন্ধু- আমাদের বঙ্গবন্ধু। অন্নাদাশঙ্কর রায়ের ভাষায় বলা যায়- ‘যতকাল রবে পদ্মা-মেঘনা-গৌরী-যমুনা বহমান/ ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।’

জীবনভর বাংলা ও বাংলাদেশের জনগণের অধিকার অর্জনসহ দুর্ভোগের হাত থেকে তাদের রেহাই দিয়ে মুখে হাঁসি ফুঁটানোর উদ্দেশ্যে রাজনীতি করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সোনার বাংলা গড়ে মানুষের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক অধিকার পুরণের মাধ্যমে মানুষ উন্নত জীবন পাবে, দারিদ্রের কষাঘাত থেকে মুক্তি পাবে, সেই চিন্তায় প্রতিনিয়ত তার মন বিভোর থাকত। আর সে কারণেই তিনি তার নিজের সকল আরাম-আয়েস ত্যাগ করে জনগণের দাবি আদায়ের উদ্দেশ্যে আদর্শবাদী ও ত্যাগী নেতা হয়ে জীবনভর সংগ্রাম করে বাঙালি জাতিকে দিয়ে গেছেন স্বাধীনতা; দিয়ে গেছেন বীরের মর্য়াদা।

দেশ ও দশের সুখের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জীবনের বেশির ভাগ সময় কারাগারে কাটিয়েছেন। ভোগ করতে হয়েছে তাকে নানা অত্যাচার-বিচার। বৈদেশিক শক্তির নির্জাতন-নিপীড়ণ থেকে দেশের জনগণকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে তিনি নিজে বিদ্রোহ করেছেন, আন্দোলন করেছেন। অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রামী বীরের ভূমিলা পালন করেছেন কিন্তু কখনো মাথা নত করেন নি। বাঙালির স্বপ্ন পূরণে জয়ী হয়ে, দেশ স্বাধীনে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি হয়েছেন বাংলাদেশের জাতির পিতা এবং বঙ্গবন্ধু।

কাজী নজরুল ইসলাম এবং শেখ মুজিবুর রহমান দুজনেই বাঙলা ও বাঙালিকে ভালোবাসতেন। দুজনেই ছিলেন সমমনা এবং দুজনেই ছিলেন একে অপরের উপর আস্থাশীল। দুজনেই ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রমী বীর। দুজনেই মানুষের অধিকারের স্বপক্ষের কাজ করেছেন। রাজনৈতিক দিক থেকে বিচার-বিশ্লেষণে দুজনেরই ধ্যাণ-ধারণা ও চিন্তা-চেতনায় ধরা পড়ে পরিপূরকতা। মানসিক চিন্তা-চেতনায়ও তাঁরা ছিলেন সমমনা এবং সম পথের পথিক। ফলে তারা উভয়েই ছিলের বাংলাদেশের রূপকার এবং স্রষ্টা। উভয়ের রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনা ও আদর্শ-দর্শনে খুঁজে পাওয়া যায় দূরদর্শিতা। কাজী নজরুল ইসলাম বহু পূর্বে এ বাংলায় স্বাধীনতার বীজ বপন করলেও স্বাধীনতার ফসল ঘরে তোলার কাজটি সুসম্পন্ন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

জন্মের দিক থেকে কাজী নজরুল ইসলাম এবং শেখ মুজিবুর রহমান উভয়ের মধ্যে একুশ বছর দুই মাস সাত দিনের ব্যবধান থাকলেও (কাজী নজরুল ইসলাম ২৪ মে ১৯৯৯, পশ্চিম বঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে এবং শেখ মুজিবুর রহমান ১৭ মার্চ ১৯২০, গোপালগঞ্জ মহাকুমার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে) চিন্তা-চেতনা, দ্রোহ-বিদ্রোহে তাদের মধ্যে রয়েছে বিরাট মিল। তবে দুজনেই ছিলেন নির্ভীক নির্লোভ, অসীম সাহসী তেজী ও ত্যাগী নেতা। দুজনেই সমভাবে এ বাংলায় দ্রোহের বাণী প্রচার করে কাজী নজরুল ইসলাম হয়েছেন সাহিত্যের বিদ্রোহী বীর এবং শেখ মুজিবুর রহমান হয়েছেন রাজনীতির রাজদ্রোহী বীর। এদের একজন হয়েছেন ‘পয়েন্ট অব লিটারেচার’, অপরজন হয়েছেন ‘পয়েট অব পলিটিক্স।’ তবে স্বপ্ন, আদর্শ ও দর্শনের দিক থেকে তারা ছিল অভিন্ন এবং পরিপূরক।

কাজী নজরুল ইসলাম বৃটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে ‘বিদ্রোহী ’ কবিতা লিখে খ্যাত হয়েছেন বিদ্রোহী কবি এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার নিজ দেশের মানুষের সুখ-সমৃদ্ধির জন্য পাকিস্তানী শাসকদের বিরুদ্ধে ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’, ঘোষণা দিয়ে খ্যাত হয়েছেন রাজদ্রোহী, দেশদ্রোহী এবং রাষ্ট্রদ্রোহ বীর। রাষ্ট্রদ্রোহীতার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জীবনভর কারা বরণ করেছেন সর্বমোট চার হাজার ছয় শত বিরাশি দিন এবং কাজী নজরুল ইসলাম কারা বরণ করেছেন সর্বমোট তিন শত ত্রিশ দিন (১ বছর থেকে একমাস কম)।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সার্বক্ষণিক রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকলেও কাজী নজরুল ইসলাম সার্বক্ষণিক রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। সাহিত্য সাধনায়ই তিনি জীবনের বেশিভাগ সময় ব্যয় করেছেন। তবে বরাবরই নজরুলের রাজনৈতিক হাতিয়ার ছিল তার লেখনি। একইভাবে শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনীতির প্রধান হাতিয়ার ছিল তার বজ্রকণ্ঠ- যা দেশের জনগণকে আপেষহীন সংগ্রামী হতে সাহায্য করেছিল। দেশের স্বার্থে নীতিতে তিনি ছিলেন অটল। সংগ্রাম-প্রতিবাদের ক্ষেত্রে তিনি ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়াতেও ভয় পান নি। ব্রজকণ্ঠে আওয়াজ তুলে লাখো বাঙালি একত্র করে অন্যায়-অবিচার রুখে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে তার মতো আর একজন বাঙালি আজও এ বাংলায় খুঁজে পাওয়া যাবে না।

নীতিগত আদর্শ-দ্রোহ এবং মানুষের সুখ-শান্তি কামনার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কাজী নজরুল ইসলামকে ভীষণভাবে ভক্তি-শ্রদ্ধা করতেন এবং ভালোবাসতেন। নজরুলের চিন্তা-চেতনা ও আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে বঙ্গবন্ধু নজরুলেরই চলার পথে হেঁটে ৭১-এ বাংলাদেশ স্বাধীন করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হয়ে যান এ বাংলার রাষ্ট্রপতি ও জাতির পিতা। একইভাবে ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে ভারত থেকে স্বাধীন বংলায় এনে জাতীয় কবির মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করে তাকে এ দেশে স্থায়ী বসবাসের সুযোগ করে দেন।

আমরা জানি, কাজী নজরুল ইসলাম বাঙালির যুগস্রষ্টা কবি। বাংলার নবজাগরণের অগ্রদূত- তিনি দ্রোহের কবি, তারুণ্যের কবি, বিদ্রোহী কবি, সংগ্রাম এবং সাম্যের কবি। বাংলার সাহিত্য-সংগীতের রয়েছে তাঁর অবিস্মরণীয় অবদান। তাঁর বহুমাত্রিক প্রতিভার পরশে বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সংগীত, সাংবাদিকতা, নাটক, চলচ্ছিত্র, রাজনীতিসহ প্রতিটি ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে দ্যুতিময়। তাঁর লেখনি এ দেশের মানুষকে অন্যায়, অত্যাচার-অবিচার-অসত্য, গ্লানি মোচনে সাহসী করে তুলতে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। তাঁর শিকল পড়ার গান, মানবতার গান, বিদ্রেহের গান, ঝিমিয়ে পড়া বাঙালি জাতিকে জাগিয়ে তুলে বৃটিশ ও পাকিস্তানী শাসকদের এ দেশ থেকে বিতাড়িত করার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীনের প্রথম স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর হাতেই স্বাধীন বাংলার প্রথম বীজ বপিত হয়। তার কাছ থেকেই ধার করা হয় ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি: যা এক সময় লক্ষ কণ্ঠে ধ্বনিত হয়ে এ দেশ থেকে পাকিস্তানীদের তাড়াতে সাহায্য করে।

কাজী নজরুল ইসলাম পরাধীনতার হাত থেকে দেশকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে ছোটবেলা থেকে বাঙালি ছেলে-মেয়েদের যে মন্ত্রটি শেখানোর অনুরোধ জানিয়েছেন তা ছিল এ রকম: ‘এই পবিত্র বাংলাদেশ বাঙালির- আমাদের।… বাংলা বাঙালির হোক? বাঙালির জয় হোক।’ প্রথম দিকে কাজী নজরুল ইসলামের ব্যবহৃত ‘জয় বাংলা’ (পূর্ণ অভিনন্দন) শব্দটির ব্যাপক প্রচলন আমাদের মধ্যে শোনা না গেলেও ‘বাঙালির জয় হোক’, ‘বাংলার জয় হোক’ ধ্বনিগুলো নজরুলের সময় থেকেই এ দেশে প্রচলিত ছিল। যা পরবর্তীতে আমাদের প্রাণের ধ্বনিতে পরিণত হয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের শ্লোগান হয়ে অমোঘ শক্তিতে পরিণত হয়েছিল।

১৯৭১-এর ৭ মার্চ রেসকোর্সের জনসমূদ্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গর্জে উঠে বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা’- যা ছিল নজরুলের প্রতিধ্বনি এবং আমাদের স্বাধীনতার পূর্ণ আহ্বান। এ ভাষণেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম নজরুল ‘জয় বাংলা’ শব্দাট ব্যবহার করেন। যা পরবর্তীতে বাংলার ঘরে-ঘরে, বাঙালির মুখে-মুখে, দৈনন্দিন জীবনাচারে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রধান হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত হয়ে শক্তির উৎসে পরিণত হয়।

কাজী নজরুল ইসলাম এবং শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে বয়সের দিক থেকে উনিশ বছরের ব্যবধান থাকলেও; তাদের চিন্তা-চেতনা, আচার-আচরণ, দ্রহ-বিদ্রোহে ব্যবধানতো ছিলই না; বরং দুজনেই সমবেত কণ্ঠে সমভাবে উচ্চারিত করেছেন মানবতার সুর, মুক্তির সুর, দ্রোহের সুরসহ দেশ স্বাধীনের নব সুর।

নজরুলের সৃষ্টিশীল জীবনে ভারতীয় রাজনীতিতে জটিলতা থাকলেও তখনকার আন্দোলন ছিল ভারতীয় স্বাধীনতার লক্ষে তাড়িত আন্দোলন- যার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিল নজরুলের বিদ্রোহচেতনা। একইভাবে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার মানুষের লুণ্ঠিত অধিকার প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার থাকায়; জীবনভর তিনি বিদেশি শক্তির বিরুদ্ধে লড়েছেন, আন্দোলন করেছেন, জেল-জুলুম সহ্য করেছেন- কিন্তু একবারের তরেও পিছু হটেন নি তিনি।

নজরুলের সময় বাঙালি মুসলমান সমাজ ছিল ফতোয়ার ভারে জর্জরিত। সংগীত, কাব্য-সাহিত্য, সাংস্কৃতিক চেতনার বিকাশসাধন ছিল তখন খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তবে কবি কাজী নজরুল ইসলাম অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সে অসাধ্য সাধনের কাজটি সম্পন্ন করেছেন তার ভাষণ ও কাব্য-সাহিত্যের মধ্য দিয়ে। তিনি নিজে গান লিখেছেন, গান গেয়েছেন, নাটক লিখেছেন, অভিনয় করেছেন এবং অন্যকেও তা করার জন্য অনুপ্রাণীত করে শিল্প-সাহিত্যে-সংগীতের গোড়ামী থেকে দেশবাসীকে দূরে রেখে মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে ধাবিত করার চেষ্টা করেছেন। কারণ নজরুল জানতেন; শিল্প-সাহিত্যের নেতিবাচক সংকীর্ন দৃষ্টিভঙ্গী ক্ষতিকর। অর সে কারণেই তিনি জীবনভর ধর্মান্ধতা, গোঁড়ামী, সাম্প্রদায়িকতা ও সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন- সংগ্রাম করেছেন, বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন।

কাজী নজরুল ইসলাম কেবলমাত্র একজন খ্যাতিমান কবিই ছিলেন না; ছিলেন একজন দক্ষ রাজনৈতিক কর্মী। তিনি প্রত্যক্ষ রাজনীতি করেছেন। ভারত থেকে বৃটিশ তাড়ানোর আন্দোলনে নিজে সামিল হয়ে লিখেছেন শোষণ-সঞ্জাত-অভিশপ্ত দারিদ্র মানুষের ব্যাথার গান; জাতীয় গজাগরণি গান। আর সে কারণে তাকে ভোগ করতে হয়েছিল নিদারুন অত্যাচার-নিপীড়ণসহ জেল-জুলুম।

তবে এ কথা সত্য যে, নজরুলই প্রথম প্রকাশ্যে ভারতের স্বাধীনতার দাবী তুলে সাহসিকতার প্রমাণ দিয়েছেন। তিনিই প্রথম লিখেছেন; ‘সরাজ-টরাজ চাইনা, চাই দেশের পূর্ণ স্বাধীনতা’। তার কাব্যেই প্রথম ব্যবহৃত হয়েছে ‘জয় বাংলা’, ‘বাংলার জয়’ এবং ‘বাংলাদেশ’, শব্দগুলো: যা ১৯৪৭-এ ভারত এবং ১৯৭১-এ বাংলাদেশ স্বাধীনের সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। তবে সুখের বিষয; নজরুল জীবিতাবস্থায় উভয় স্বাধীনতা ভোগ করে গেলেও- আত্মতৃপ্তি নিয়ে তিনি মরতে পারেন নি। কারণ উভয় স্বাধীনতার সময় তিনি ছিলেন জীবন্মৃত, অনুভূতিহীন এক বিদ্রোহী বীর।

ভারতের স্বাধীনতার সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন সাতাশ বছরের তরুণ যুবক। ফলে সে সময় ভারত বিভক্তি তার মনে ভীষণভাবে দাগ কাটলেও শেখ মুজিবুর রহমানের শ্রদ্ধারপাত্র কাজী নজরুল ইসলাম সে-সময় ছিলেন মনে-প্রাণে অবিভক্ত ভারতের পক্ষে। তবে কাজী নজরুল ইসলাম এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তারা উভয়েই দেশ থেকে বৃটিশ তাড়ানো আন্দোলনে এক থাকলেও নজরুল ছিলেন ভারত বিভক্তের বিপক্ষে।

স্কুলজীবন থেকেই শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন প্রতিবাদমুখর। গোপালগঞ্জের মিশনারী স্কুলে তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রাবস্থায় ১৯৩৯ সালে বাংলার মূখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সহ্রাওয়ার্দী গোপালগঞ্জের মিশনারী স্কুল পরিদর্শনে যান। শেখ মুজিবুর রহমান সে-সময় তাদের সন্মুখে দাঁড়িয়ে স্কুলের ছাঁদ দিয়ে পানি পড়া বন্ধের দাবী জানিয়ে যে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলেনÑ তা থেকেই জনগণ তার প্রতিবাদী সাহসিকতার প্রমাণ পেয়ে যায়। পরে ছাত্রাবস্থায় শেখ মুজিবুর রহমান কোলকাতার রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে, জীবনভর জনগণের দুঃখ-কষ্ট লাঘবের উদ্দেশ্যে আন্দোলন প্রতিবাদ বিদ্রোহ করে রাজদ্রোহী হয়ে জেল-জুলুমের মধ্যদিয়ে জীবন কাটিয়ে শেষাবধি শত্রুর গুলির আঘাতে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়।

মাত্র একুশ বছর বয়সে (১৯৪১ খ্রি.) শেখ মুজিবুর রহমান কোলকাতায় মুসলিম লীগ এবং ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। যার প্রমাণ রয়েছে তাঁর নিজের লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে এভাবে: ‘তখন রাজনীতি শুরু করেছি ভীষণভাবে। সভা করি, বক্তৃতা করি, খেলার দিকে আর নজর নেই। শুধু মুসলিম লীগ, আর ছাত্রলীগ।’

রাজনীতিতে প্রত্যক্ষ জড়িয়ে পড়ার পর, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিহার ও কোলকাতার দাঙ্গা, দূর্ভিক্ষ, ভারত ভাগসহ কোলকাতা কেন্দ্রীক প্রদেশিক মুসলিম লীগ ও মুসলিম লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে যান। ভারত ভাগের পর থেকে ১৯৫৪ সাল অবধি তিনি পূর্ব বাংলার রাজনীতি, কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সরকারের অপশাসন ও ভাষার দাবীতে তিনি বহুবার গ্রেফতার হয়ে জেলে যান। যুক্তফ্রন্ট গঠন ও নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন; ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা, পাকিস্তান ভাগ, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের বৈষম্যমূলক শাসননীতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কারণেও তাকে বহুবার কারারবণ করতে হয়েছিল।

আদমজীর দাঙ্গাসহ ১৯৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৮ সালের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামালা, ১৯৬৯ সালের ১৪৪ ধারা ও কার্ফু ভঙ্গ, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ের পরও ক্ষমতা না পাওয়া, ২৫ মার্চের পাকিস্তানীদের গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, ৭১-এর ৭ মার্চের স্বাধীনতার ডাক ও স্বাধীনতা ঘোষণার কারণে দেশদ্রোহী হয়ে কারাবন্ধিসহ জীবনে তিনি সর্বমোট চার হাজার ছয় শত বিরাশি দিন কারাভোগ করেন।

উল্লেখ্য, ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে পূর্ব পাকিস্তানের লোকদের স্বার্থ রক্ষার্থে শেখ মুজিবুর রহমানের লড়াই শুরু হয়। ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর শহীদ সোহওয়ার্দী মৃত্যুবার্ষিকীতে আওয়ামী লীগের আলোচনা সভায় শেখ মুজিবর রহমান প্রথম পূর্ব বাংলার নাম করণ ‘বাংলাদেশ’ করার প্রস্তাব প্রদান করেছিলেন। একই অনুষ্ঠানে পাকিস্তানীরা ‘বাংলাদেশ’ নামটি তাদের অভিধান থেকে নিশ্চিহ্ন করার যে পরিকল্পনা চালাচ্ছিল তা অনুভব করে যে বক্তব্য রেখেছিলেন তা ছিল নিম্নরূপ:
‘একসময় এ দেশের বুক হইতে, মানচিত্রের পৃষ্ঠা হইতে ‘বাংলা’ কথাটির সর্বশেষ চিহ্নটুকুও চিরতরে মুছিয়া ফেলার চেষ্টা করা হইয়াছে।… একমাত্র ‘বঙ্গোপসাগর’ ছাড়া আর কোন কিছুর নামের সঙ্গে ‘বাংলা’ কথাটির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় নাই।… জনগণের পক্ষ হইতে আমি ঘোষণা করিতেছি- আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম ‘পূর্ব পাকিস্তানে’র পরিবর্তে শুধুমাত্র ‘বাংলাদেশ’ হইবে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো কাজী নজরুল ইসলাম সার্বক্ষণিক রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও কবি হয়েও দেশের স্বার্থ তাঁকে সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে হয়েছিল। ১৯১৭ সালে সিয়ারশোল রাজ হাই স্কুলের শিক্ষক ও যুগান্তর দলের গোপন বিপ্লবী নিবারণচন্দ্র ঘটকের মাধ্যমে তার প্রথম স্বাধীনতা ও বিপ্লবী আকাঙ্ক্ষার সঞ্চার ঘটে। পরে ১৯১৯ সালে করাচির সেনানিবাসে অবস্থানকালে তিনি রুশ বিপ্লব ও লালফৌজের কর্মতৎপরতায় অনুপ্রাণিত হন এবং একই বছর জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডে কবির বৃটিশবিরোধী কর্মতৎপরতা বৃদ্ধি পায়। ১৯২০ সালে ভারতীয় মুক্তিসংগ্রামের প্রধান নেতা বাল গঙ্গাধর তিলকের মৃত্যুতে ‘নবযুগ পত্রিকা’র সম্পদকীয় ভাষ্যে নজরুল সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধিতার উপর এক আবেগময়ী লেখা ছাপান। ১৯২১ সালে যুবরাজ প্রিন্স অব ওয়েলস-এর ভারত সফর উপলক্ষে দেশব্যাপী এক হরতালের ডাকে নজরুল কুমিল্লার মিছিলের শোভাযাত্রায় পুরোভাগে হারমোনিয়াম কাঁধে ঝুলিয়ে গান গাওয়ার অপরাধে সেখানকার থানায় তাকে এক রাত থাকতে হয়েছিল। একই সময়ে নজরুল মুজাফ্ফর আহমদের নেতৃত্বে কমিউনিস্ট পার্টিতে সক্রিয় ভূমকা পালনসহ গান্ধীজীর ডাকে সরাসরি সাড়া দিয়ে রাজনীতিতে অংশ নিয়ে দেশের শাসন-শোষণ-প্রবঞ্চনার মুক্তির দাবি জানিয়েছিলেন। ১৯২৫ সালে বগুড়ায় অনুষ্ঠিত নিখিল বঙ্গীয় প্রজা সম্মিলনের প্রথম অধিবেশনে নজরুল স্বশরীরে যোগ দেন এবং কলকাতার প্রোগ্রেসিভ ডেমোক্রেটিক পার্টির সপ্তম সভায় স্বরচিত সংগীত পরিবেশন করেন। ১৯২৫ সালের মে মাসে নজরুল আব্দুল হালিম ও মণীন্দ্র বন্দোপাধ্যায়ের সঙ্গে ফদিপুরের বঙ্গীয় কংগ্রেসের প্রাদেশিক সম্মেলনে যোগ দেয়ায় সেখানে গান্ধীজীর সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে।

একইভাবে ১৯২৬ সালে নজরুল কৃষ্ণনগরের নিখিল প্রজা সম্মেলন, প্রাদেশিক ছাত্র সম্মেলন ও বঙ্গীয় প্রাদেশিক ছাত্র সম্মেলনের অর্ভথনা কমিটির কাজে যুক্ত হন। একই বছর তিনি দিনাজপুর জেলার প্রজা সম্মিলনীতে যোগ দেন এবং নিখিল বঙ্গীয় ও আসাম প্রাদেশীক মৎসজীবী সম্মেলনের তৃতীয় অধিবেশনে যোগ দেয়ার জন্য মাদারিপুরে গমন করেন। সে-বছরই বছরই নজরুল ভারতীয় ব্যাবস্থাপক সভার সদস্যপ্রর্থী হয়ে কেন্দ্রীয় আইন সভার স্বরাজ দলের সদস্য নির্বাচিত হয়ে ঢাকা, ফরিদপুর, বাকেরগঞ্জ, ময়মনসিংহে জনসংযোগের কাজে অংশ নেন এবং গান্ধীজীর অহিংসা আন্দোলনের যুগে নজরুল তাঁর ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় ১৯২২ সালের ১৩ অক্টোবর সম্পাদকীয় কলামে ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা দাবী জানিয়ে দ্যার্থহীন ভাষায় লেখেন:
সর্বপ্রথম ‘ধূমকেতু’ ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়। ‘স্বরাজ টরাজ বুঝি না, কেননা, ওকথাটার মানে এক এক মহারথী এক এক রকম করে থাকেন। ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশও বিদেশীর অধীনে থাকবে না। ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ দায়িত্ব, সম্পূর্ণ স্বাধীনতা রক্ষা, শাসন-ভার, সমস্ত থাকবে ভারতীয়দের হাতে। তাতে কোনো বিদেশীর মোড়লী করবার অধিকারটুকু পর্যন্ত থাকবে না।

মুজাফ্ফর আহমেদ তার ‘কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা’য় নজরুলের ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা দাবির সমথর্নে লিখেছেন:
অনেকে হয়তো নিজেদের বৈঠকখানায় বসে পরিপূর্ণ স্বাধীনতার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। কিংবা হয়তো গোপন ইশতেহার ছেপে তার মারফতে পরিপূর্ণ স্বাধীনতার দাবী জানিয়েছেন। কিন্তু দ্ব্যর্থহীন, চাঁছা-ছোলা ভাষায় খবরের কাগজে ঘোষণা করে বাংলাদেশের নজরুলের মতো আর কে পরিপূর্ণ দাবী তুলে ধরেছিলেন তা আমার জানা নেই।

নজরুল জাতীয়তাবাদের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশ থেকে বৈদেশিক শাসকদের বিতাড়িত করে তাদের হাত থেকে দেশের লুট করা সম্পদ ফিরিয়ে আনার উপর গুরুত্ব আরোপ করে সমগ্র বাঙালি জাতিকে জেগে ওঠার আহ্বান জানিয়ে “বাঙালির বাঙলা” প্রবন্ধে লিখেছেন: বাঙালি যেদিন একতাবদ্ধ হয়ে বলতে পারবে- “বাঙালির বাংলা”- সেদিন তারা অসাধ্য সাধন করবে। সেদিন একা বাঙালিই ভারতকে স্বাধীন করতে পারবে।… বাঙালি আজন্ম দিব্যশক্তিসম্পন্ন।… বাংলার অভাব কোথায়?… আমাদের মাছ ধান পাট, আমাদের ঐশ্বর্য শত বিদেশী লুটে নিয়ে যায়, আমরা তার প্রতিবাদ করি না, উল্টো তাদের দাসত্ব করি; এ লুণ্ঠনে তাদের সাহায্য করি।

একই প্রবন্ধে নজরুল দেশকে দখলদার দস্যু-ডাকাতদের কঠোর ভাষা উচ্চারণ করে ‘প্রহারন ধনঞ্জয়’ দিয়ে বিনাশ করার উদ্দেশ্যে বলেছেন: … তার মাঠের ধান পাট রবি ফসল, তার সোনা তামা লোহা কয়লা- তার সব ঐশ্বর্য বিদেশী দস্যু বাটপারি করে ডাকাতি করে নিয়ে যায়, সে বসে বসে দেখে। বলতে পার না “এ আমাদের ভগবানের দান, এ আমাদের মাতৃ ঐশ্বর্য! খবরদার, যে রাক্ষস একে গ্রাস করতে আসবে, যে দস্যু এ ঐশ্বর্য স্পর্শ করবে- তাকে ‘প্রহারেন ধনঞ্জয়’ দিয়ে বিনাশ করবো, সংহার করবো।

উল্লিখিত তথ্যাদি পর্যালোচনায় নজরুলের সরাসরি রাজনীতিতে অংশগ্রহণসহ ভারত ও বিদেশী দস্যু-লুটেরাদের এদেশ থেকে বিতাড়িত করার কঠোর হুশিয়ারির এক বাস্তব চিত্র পাওয়া যায়। তবে অসাম্প্রদায়িক শোষণ-শাসন বিরোধী রাজনীতির জন্য নিজের বুকের রক্ত দিয়ে দেশ স্বাধীনের স্বপক্ষীয় অবদানের প্রমাণ রয়েছে ১৯২৯ সালের ১৫ ডিসেম্বরের কোলকাতার এলেবার্ট হলে নজরুল সংবর্ধনার সভাপতি বিজ্ঞানী আশ্চর্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের ভাষণে: নজরুল ইসলাম শুধু মুসলমানের কবি নন তিনি বাংলার কবি, বাঙালির কবি। কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত খ্রিস্টান ছিলেন, কিন্তু বাঙালি জাতি তাঁহাকে বাঙালিরূপে পেয়েছিলেন। আজ নজরুল ইসলামকেও জাতিধর্ম নির্বিশেষে সকলেই শ্রদ্ধা নিবেদন করিতেছেন। কবিরা সাধারণতঃ কোমল ও ভীরু, কিন্তু নজরুল তাহা নন। কারাগারের শৃঙ্খল পড়িয়া বুকের রক্ত দিয়া তিনি যাহা লিখিয়াছেন তাহা বাঙালির প্রাণে এক নতুন স্পন্দন জাগাইয়া তুলিয়াছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম থেকেই কাজী নজরুল ইসলামকে গভীরভাবে ভক্তি-শ্রদ্ধাসহ ভালবাসতেন এবং তার আদর্শ অনুসরণ করার চেষ্টা করতেন। ফলে তাঁদের উভয়ের জীবন-দর্শন ও আচার-আচরণ খুঁটিয়ে দেখলে, সেখানেও পাওয়া যাবে অসম্ভব রকমের এটা মিল। তবে অন্যায়-অবিচার ও বিদেশী শাষকদের হাত থেকে নিজ দেশকে মুক্ত করার স্বপক্ষের আন্দোলনে তাঁরা উভয়েই ছিলেন ঐক্যমত্য ও একতাবদ্ধ। দেশের অন্যায়-অবিচার-অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে, দেশের মানুষের মুখে হাঁসি ফুটাতে ফাঁসির দড়িকেও তারা ভয় করেন নি। জেল-জুলুম সহ্য করেও অন্যায়-অবিচারের সঙ্গে তারা কখনও আপোষ করেন নি।
ছাত্রাবস্থা থেকেই শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন কাজী নজরুল ইসলামের অনুসারি। মনে-প্রাণে তাঁকে ভক্তি-শ্রদ্ধা করতেন। যার প্রমাণ মেলে শেখ মুজিবুর রহমানের নিজের লেখায়: ১৯৪২ সালের মধ্যেই হবে, ফরিদপুর ছাত্রলীগের জেলা কনফারেন্সে, শিক্ষাবিদদের আমন্ত্রণ জানান হয়েছে। তারা হলেন কাজী নজরুল ইসলাম, হুমায়ুন কবির, ইব্রামি খাঁ সাহেব। সে সভা করতে দিল না, ১৪৪ ধারা জারি করল। কনফারেন্স হল হুমায়ুন কবির সাহেবের বাড়িতে। কাজী নজরুল ইসলাম সাহেব গান শোনালেন।

হোসেন শহীদ সোহওয়ার্দী ও শরৎ বসু (১৮৮৯-১৯৫৯) একত্রে মিলে একবার একটা বৃহত্তর স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর থেকে শেখ মুজিবুর রহমান নজরুলর মতো স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন একটা স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার। তবে জীবদ্দশায় শেখ মুজিবুর রহমান তার সে স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে, বাংলাদেশ স্বাধীন করে তার প্রধানমন্ত্রী হওয়ামাত্র তিনি তাঁর প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলা দেশে এনে তাঁকে জাতীয় কবির মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করে যথাযথ মর্যাদা দিতে ভোলেন নি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং কাজী নজরুল ইসলাম দুজনেই ছিলেন দুজনার পরিপূরক। শেখ মুজিবুর রহমান কাজী নজরুল ইসলামের নিকট থেকে নানা সময় নানা সূত্র (বিশেষ করে দেশ স্বাধীনের) ধার নিয়ে এগিয়ে চলায় বলা যায়, কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ভাবশিষ্য। তবে তারা দুজনেই ছিলেন নির্ভয় নির্লোভ, অসম সাহসী ও ত্যাগী নেতা। দুজনেই ছিলেন বিদ্রোহের বাণী প্রচার। দুজনের মধ্যেই ছিল একটা আত্মিক যোগসূত্র। কোলকাতায় থাকাবস্থায় শেখ মুজিবুর রহমান প্রায়াই কাজী নজরুল ইসলামকে দেখতে যেতেন, শ্রদ্ধা জানাতেন। ফলে বাংলাদেশ স্বাধীনের পরমুহূর্তেই বঙ্গবন্ধু কাজী নজরুল ইসলামকে কলকাতা থেকে ঢাকায় এনে বাংলাদেশে স্থায়ী বসবাসের সুযোগ করে দেন এবং জাতীয় কবির মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেন।

কিশোর বয়স থেকেই নজরুলের (১৯১৩-১৪ খ্রি.) এ বাংলায় যাতায়াত ছিল। বাংলার প্রকৃতি, বাংলার মানুষ ও তাদের অকৃত্রিম শ্রদ্ধা-ভালোবাসা নজরুলকে আকর্ষিত করায়- এ অঞ্চলটি ছিল তাঁর প্রিয়ভূমি। ভালোবাসার টানে তিনি বহুবার এ অঞ্চলে আসা-যাওয়া করেছেন। অংশগ্রহণ করেছেন বহু সংগঠনে ও সভা-সমিতিতে। জড়িয়ে পড়েছিলেন এ অঞ্চলের মেয়ে নার্গিস, প্রমীলার প্রেম-বিরহের হাজারো স্মৃতিসহ বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সঙ্গে।

কাজী নজরুল ইসলাম বরাবরই ছিলেন একজন অসাম্প্রদায়িক, মানবপ্রেমিক ও সমাজসংস্কারক। প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করা যায় তার কোলকাতার এলবার্ট হলের ১৯২৯ সালের ১৫ ডিসেম্বরের জাতীয় কবি সম্মাননায় সংবর্ধিত হওয়ার ভাষণ:
‘আমি মাত্র হিন্দু মুসলমানকে এক জায়গায় ধরে এনে হ্যান্ডসেক করার চেষ্টা করেছি। গালাগালিকে গলাগলিতে পরিণত করার চেষ্টা করেছি।’

একইভাবে তার ‘সাম্যবাদী’ কবিতার: ‘গাহি সাম্যের গান /যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাঁধা ব্যবধান/ যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান?’-এ উদ্ধৃতি থেকেও স্পষ্ট অনুভব করা যায় নজরুল অসাম্প্রদায়িক, মানবপ্রেমিক ও সমাজসংস্কারক কবি ছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ ও নীতি-আদর্শেও একই ভাব প্রকাশ পায়।

ভারত ভাগ হয়ে হিন্দুস্তান এবং পাকিস্তান হোক- নজরুল ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান তা কখনও প্রত্যাশা করেন নি। বরং তারা চেয়েছিলেন এ উপমাহদেশ থেকে সকল অন্যায়-অত্যাচার-অবিচার চিরতরে দূর হয়ে যাক। বাংলা ভাগের বিরুদ্ধে নজরুল উপহাসের সূরে তাঁর ‘ভাবার কথা’ প্রবন্ধের লিখেছেন: … ১৯০৫ সালে অপেক্ষাকৃত উর্বর মস্তিষ্ক বাঙালিদের, বিশেষত হিন্দু-মুসলমানের মনের ভিতরে বিষবৃক্ষের বীজ পুঁতবার জন্য বাঙলাদেশকে কাটবার ব্যবস্থা হলো। বুরোক্রাসির কসাইখানার ছোরা যতই ধারালো ও ভারী হোক না কেন, এবার দেখা গেলো বাংলা ত তাতে কাটলোই না, উপরন্তু ছোরা যেন চুম্বকশক্তিতে সারা ভারতের সমস্ত টুকরা কুড়িয়ে নিয়ে এসে সত্যি সত্যিই একটি জাতি গড়বার জন্য ১৯০৬ সালে কোলকাতার ময়দানের পাশে জমায়েত হল। জাতীয় মহাসমিতির বীজ সেইবার অঙ্কুরিত হয়ে চারা বেরুল।

একইভাবে ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান-হিন্দুস্তান হওয়ার পর পূর্ব বাংলার অস্তিত্ব বিনাসের উদ্দেশ্যে ধর্মান্ধ পাকিস্তানী শাষকরা ‘বাংলা’ নামটির দাফন সুসম্পন্ন করে প্রদেশটির নাম ‘পূর্ব পাকিস্তান’ রাখায়; গৌরিপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা এবং অংশুমান রায়ের সুর করা ‘বিশ্বকবির সোনার বাংলা নজরুলেরই বাংলা দেশ/ জীবনানন্দর রূপসী বাংলা, রূপের যে তার নেইকো শেষ’ গানের পূর্বের আবেগ-অনুভূতিতে যেন আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। ঘটনাটি শেখ মুজিবুর রহমানের চোখ এড়াতে পারে নি। তিনি ২৫ আগস্ট ১৯৫৫ তারিখ পাকিস্তান গণপরিষদে এ নিয়ে তুমুল বিরোধীতা করেও কোনো সহানুভ’তি অর্জন করতে পারেন নি। কারণ পাকিস্তানীরা তখন বাংলা ও বাঙালিদের নিচিহ্ন করার অপতৎপরতায় লিপ্ত ছিল। তাদের এ মনোভাব অনুধাবন করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৫ ডিসেম্বর ১৯৬৯ তারিখে শহীদ সহরাওয়ার্দির এক মুত্যু দিবসের আলোচনা সভার গর্জে উঠে প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছিলেন: একসময় এ দেশের বুক হইতে, মানচিত্রের পৃষ্ঠা হইতে বাংলা কথাটির সর্বশেষ চিহ্নটুকুও চিরতরে মুছিয়া ফেলার চেষ্টা করা হইয়াছে। … একমাত্র বঙ্গোপসাগর ছাড়া আর কোনো কিছুর নামের সঙ্গে বাংলা কথাটির অস্তিত্ব খুঁজিয়া পাওয়া যায় নাই… আমি ঘোষণা করিতেছি- আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম হইবে পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে শুধুমাত্র ‘বাংলাদেশ’।

সুখের বিষয়, শেখ মুজিবুর রহমানের প্রচেষ্টায়ই পূর্ব পাকিস্তান নামের প্রদেশটি ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর ‘বাংলাদেশ’ নাম নাম ধারণ করে একটা স্বাধীন সর্বভৌম দেশে পরিণত হয়ে বিশ্বের মানচিত্রে স্থান করে নেয় এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে করা হয়েছিল সে দেশের জাতীর পিতা।

১৯৬৯ সালের পর থেকে বাংলাদেশের গণ আন্দোলনে ‘বাংলাদেশ’, ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’, নামের যে শব্দগুলো ব্যবহৃত হয়ে আসছিল- তার মূলে ছিলেন আমাদের জাতীর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা। তিনি এ শব্দগুলো আমাদের প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের নিকট থেকে ধার এনে আমাদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। ‘বাংলাদেশ,’ ‘বাংলার জয় হোক’, ‘বাঙলির জয় হোক’ প্রভৃতি অভিধানগুলোও কাজী নজরুল ইসলাম প্রথম ব্যবহার শুরু করেন ১৩৪৯ বঙ্গাব্দে তার ‘বাঙালির বাঙলা’ প্রবন্ধে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ১৯৭১-এর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক রেসকোর্সের ভাষণে ‘জয় বাংলা’ ও ‘বাংলাদেশ” শব্দগুলো ব্যবহার করায়, বাংলার ঘরে ঘরে তা প্রচার পায় এবং শব্দগুলো দেশ স্বাধীনে মানুষকে ভীষণভাবে শক্তি, সাহস, উদ্দিপনা জাগিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে এগিয়ে নেয়।

‘বাঙালির বাঙলা’ প্রবন্ধে কাজী নজরুল ইসলাম ১৯২৭ সালে প্রথম ‘পবিত্র বাংলাদেশ’, ‘বাংলার জয় হোক’ শব্দ দুটো ব্যবহার করেন। একইভাবে তিনি তার ‘পূর্ণ-অভিনন্দন’ গানেও ‘জয়’ এবং ‘বাঙলা’ শব্দ দুটির বহুবার ব্যবহার করেন। ‘ভাঙ্গার গান’ গ্রন্থের ‘পূর্ণ-অভিনন্দন’ গানটি নজরুল মাদারিপুরের শান্তি-সেনা-বাহিনীর প্রধান অধ্যক্ষ পূর্ণচন্দ দাসের কারামুক্তি-উপলক্ষে ১৯২৪ সালে রচনা করেন । যেখানে নজরুল ‘বাঙলা’ শব্দটি সাত বার এবং ‘জয়’ শব্দটি পাঁচ বার ব্যবহার করেন। একইভাবে নজরুল তার বনগীতি কাব্যে ‘নমঃ নমঃ নমো/ বাঙলা দেশ মম/ চির-মনোরম/ চির-মধুর’সহ ‘বাঙলা দেশ’ শব্দটি সরাসরি ব্যবহার করেন। শেখ মুজিবুর রহমান সেখান থেকেই ‘জয় বাংলা’ ও ‘বাংলাদেশ’ শব্দ দুটো নিয়ে তাঁর নিয়মিত ভাষণে ব্যবহার করতে শুরু করেন- যা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ স্বাধীনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।

একইভাবে নজরুল তার ‘বাঙলির বাঙলা’ প্রবন্ধে ‘বাঙালির বাংলা সেদিনই স্বাধীন হবে যেদি বাংলার বাঙালি জেগে উঠবে’ লেখাসহ এ প্রবন্ধে তিনি বাঙলা নামের দেশের অধিবাসী ও তাদের গুণের বর্ণনা করে বাঙলা দেশের প্রকৃতি ও তার প্রাকৃতিক সম্পদের বাস্তব এক রূপ তুলে ধরে; বাঙালি ছেলেমেয়দের বিদেশী দস্যুদের ছেলেবেলা থেকে ‘প্রহারেণ ধনঞ্জয়’ দিয়ে বিনাস করার মন্ত্র শিখিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন। প্রবন্ধটি বিরানব্বই বছর পূর্বে অথার্ৎ ১৯২৮ সালে রচিত হলেও সেখানে ‘বাঙলা’, ‘বাঙালি’, ‘বাঙলির বাংলা’ শব্দগুলো নজরুল বহুবার ব্যবহার করেন। পরিসংখ্যানে দেখা যায়- এ প্রবন্ধে নজরুল ‘জয়’ শব্দটি দুবার, ‘বাঙালি’ শব্দটি ১১ বার এবং ‘বাংলা’ শব্দটি ৮ বার ব্যবহার করেছেন।

‘বাঙলির বাংলা’ প্রবন্ধে নজরুলের ব্যবহৃত ‘পবিত্র বাংলাদেশ’, ‘বাংলা বাঙালির হোক’, ‘বাংলার জয় হোক’, ‘বাঙালির জয় হোক’ শব্দগুলো শেখ মুজিবুর রহমানকে দারুনভাবে আকর্ষিত করায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রমে শেখ মুজিবুর রহমান নজরুল ব্যবহৃত শব্দগুলো অসংখ্যবার ব্যবহার করেন।

কাজী নজরুল ইসলাম বাঙালি জাতির স্বাধীন সত্তা বির্নিমানার্থে দেশ থেকে বৈদেশিক শাষকদের বিতাড়িত করে বাঙালি জাতিকে জেগে ওঠার আহ্বন জানিয়ে ‘‘বাঙালির বাংলা’ প্রবন্ধে লিখেছেন: বাঙালি যেদিন ঐক্যবদ্ধ হয়ে বলতে পারবে- ‘বাঙালির বাংলা’- সেদিন তারা অসাধ্য সাধন করবে। সেদিন একা বাঙালিই ভারতকে স্বাধীন করতে পারবে।

’৬৯-এর গণআন্দোলন এবং ৭১-এর স্বাধীনতা আন্দোলনে বাংলার জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়ে ‘বাঙালির বাংলা’ স্বাধীন করে, নজরুলের আদর্শ বাস্তবে প্রমাণীত করেন।

শেখ মুজিবুর রহমান ছোটেবেলা থেকেই নজরুলকে ¤্রদ্ধা করতেন, ভালোবাসতেন। তাঁর কবিতা পড়তেন, আবৃত্তি করতেন: বিশেষ করে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা। গাইতেন বন-গীতি গ্রন্থের স্বদেশী পর্যয়ের ‘নমঃ নমঃ নমো/বাংলা দেশ মম/চির মনোহর চির মধুর’ গানটি। অবসর পেলেই শুনতেন নজরুল সংগীত; পড়তেন নজরুলের ভাষণসহ নজরুল রচনাবলী। এমনকি রাজনৈতিক সংকটেও তিনি হাঁটতেন নজরুলের দেখানো পথ ধরে। প্রমাণ হিসাবে উপস্থাপন করা যায় শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র উদ্ধৃতি:
আমার কাছে তারা নজরুল ইসলামের কবিতা শুনতে চাইলেন। আমিও তাদের, ‘কে বলে তোময় ডাকাত বন্ধু’, ‘নারী’, ‘সাম্য’- আরও কয়েকটা কবিতার কিছু কিছু অংশ শুনালাম।

শেখ মুজিবুর রহমান তার রাজনৈতিক আন্দোলন, ভাষণ ও সংগ্রামে নজরুলকে প্রসন্নচিত্তে উদ্ধৃত করে সম্মানিতবোধ করতেন। ১৬ জুলাই ১৯৬৪ তারিখের ‘জুলুম প্রতিরোধ দিবস’-এর এক সভায় পাকিস্তানী শাসকচক্রের শাষণ-শোষণের বিরুদ্ধে সুশৃঙ্খল আন্দোলন গড়ে তোলার তাগিদে দৃঢ়চিত্তে তিনি উচ্চারণ করেছিলেন: শরীয়তুল্লা, তিতুমরি, সুবাস, সহরাওয়ার্দি, নজরুলের দেশের মানুষ ‘শ্বেতের’ বদলে ‘পীতের’ শাসন চায় নাই, চাহিয়াছে স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষের মর্যাদায় সুপ্রতিষ্ঠিত হইতে।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কাজী নজরুল ইসলামের চিন্তা-চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েই পূর্ব বাংলার নামকরণ ‘বাংলাদেশ’ রাখার প্রস্তাব রেখেছিলেন। ঠিক একইভাবে ৭১-এর ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের ভাষণে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’ শব্দগুলো উচ্চারণ করে নজরুল থেকে ধার নেয়া ‘জয় বাংলা’ শব্দ দিয়ে ভাষণ শেষ করে পুণরায় তিনি উচ্চারণ করেছিলেন-‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেবো। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ, ‘জয় বাংলা’। এ ভাষণেও নজরুলের প্রতি বঙ্গবন্ধুর কৃতজ্ঞতার স্পষ্ট প্রমাণ মেলে।

৫ মার্চ রাত ১২টা ৩০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে বলেছিলেন; ‘সম্ভবত এটাই আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন।’ একই সঙ্গে জনগণের নিকট তিনি একটি ঘোষণাপত্র পাঠিয়ে আবেদন জানিয়েছিলেন- … আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা বীরত্বের সঙ্গে মাতৃভূমি মুক্ত করার জন্য শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করছে।… শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যান। … কোনো আপোষ নেই। … আল্লাহ আপনাদের মঙ্গল করুন। জয় বাংলা।

অর্থাৎ নজরুলের ‘বাঙলার জয়” শব্দ থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘জয় বাংলা’ শব্দটি ধার নিয়ে তিনি এভাবে বাংলার হাটে-মাঠে-ঘাটে ছড়িয়ে দিয়ে নজরুলকে চিরস্মরণীয় করে রেখে গেছেন।

বাংলাদেশ স্বাধীনের পর জাতীর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানেরই উদ্দোগে ১৯৭২ সালের ২১ মে তারিখে কাজী নজরুল ইসলামকে কোলকাতা থেকে ঢাকায় আনার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং ২৪ মে ভারত সরকারের অনুমতিক্রমে কাজী নজরুল ইসলামের জন্মবার্ষিকীর শুভলগ্ন সামনে রেখে রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদায় (১০ জৈষ্ঠ্য ১৩৭৯) তাকে ঢাকায় আনা হয়। ঢাকায় কবিকে দেখা-শুনার জন্য তার পুত্রবধূ উমা কাজীর ও তার পরিবারকেও ঢাকায় আনা হয় এবং ঢাকায় কবিকে ধানমণ্ডি আবাসিক এলাকার ২৮ নম্বর সড়কের বি-৩৩০ নম্বরের সরকারি বাড়ির দোতলায় রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় রাখার হয়। কবির আগমনে তাকে অভ্যর্থনা ও শুভেচ্ছা জানানোর জন্য তৎকালীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরি ও প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজে কবির বাড়িতে গিয়ে করির খোঁজ-খবর নেন। কবির সেবা-শুশ্রষা ও তাঁর যাতায়াতের সুবিধার্থে ডাক্তার, নার্সসহ গাড়ির সুব্যবস্থা করে দেয়া হয়। একই সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার কবির জন্য মাসিক এক হাজার টাকার ভাতাসহ তার সুচিকিৎসার জন্য একটি মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করে দেয়: যার সদস্য ছিলেন তৎকালীন ডা. ইউসুফ আলী, ডা. নাজমুদ্দৌলা, ডা. আলী আশরাফ প্রমূখ ডাক্তার।

বাংলাদেশে আনার পর ১৯৭৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি কবিকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেয়া হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৬ তারিখে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার নজরুলকে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ‘একুশে পদক’ এবং জাতীয় কবির সম্মানে ভূষিত করেন। ২৪ মে কবির জন্ম দিনে ‘চল্ চল্ চল্’ গানটি বাংলাদেশের রণসংগীত হিসাবে ঘোষণা দেয়া হয়।

বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলন, ষাটের দশকের জাতীয় চেতনার সংগ্রাম, সাংস্কৃতিক লড়াই এবং মহান মুক্তিযুদ্ধসহ সকল আন্দোলন ও যুদ্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং নজরুল ছিলেন এক অবিনশ্বর উৎস। নজরুলের অগ্নিদীপ্ত ভাষা, সৈনিকের মার্চের ছন্দ-তাল (‘কামার পাশা’ কবিতা), জাগরণমূলক কবিতা, গান ও গদ্য রচনার উচ্ছ্বাস আমাদের জাতীয় চেতনাকে অনেক এগিয়ে দিলেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বজ্রকণ্ঠের আওয়াজ- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা’- আমাদের স্বাধীনতাকে বাস্তবে রূপ দিতে সাহায্য করেছে।

ফলে বলা যায়, বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং কাজী নজরুল ইসলাম নাম খুবই প্রাসঙ্গিক। বাঙালি জাতির আত্মবিশ্বাস ও স্বাধীন রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার ক্ষেত্র প্রস্তুতের মূল প্রবর্তক কাজী নজরুল ইসলাম হলেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার অন্যতম প্রধান স্থপতি। এঁদের প্রত্যাশিত সমাজচিন্তার পথ ধরেই বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে যুক্ত হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ও জাতীয়তাবাদী চেতনার নানা অনুসঙ্গ।

তবে, কাজী নজরুল ইসলাম এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যহীন শোষণমুক্ত ও শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠনের স্বপ্ন বাস্তবায়নে আমাদের সকলের সম্মিলিত প্রয়াস অব্যাহত রাখতে হবে। তাদের কর্ম, চিন্তা ও মননের অবিনশ্বর উপস্থিতি বজায় রেখে আমাদের নতুন প্রজন্মকে নজরুল ও বঙ্গবন্ধুুর চর্চায় নিয়েজিত রাখতে হবে। দেশপ্রেম ও সততা দিয়ে আমাদের অসাম্প্রদায়িক বৈষম্যহীন শোষণমুক্ত ও শান্তিময় বাংলাদেশ গড়ায় সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।

তথ্যসূত্র:
১.কাজী নজরুর ইসলামের প্রবন্ধ ‘পূর্ণ-অভিনন্দন’।
২. শেখ মুজিবুর রহমান; ‘আত্মজীবনী’; দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড; প্রথম প্রকাশ ২০১২; পৃষ্ঠা ১১।
৩. মুনতাসির মামুন; ‘বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ’; প্রথম খ-; সময় প্রকাশ, দ্বিতীয় প্রকাশ ২০১০; পৃষ্ঠা ১৮।
৪. মুজাফ্ ফর আহ্মদ; ‘কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা’; মুক্তধারা ২য় প্রকাশ ১৯৭৬, পৃষ্ঠা ২৪২।
৫. মুজাফ্ফর আহমদ; প্রগুক্ত; পৃষ্ঠা ২৪২Ñ২৪৩।
৬. কাজী নজরুল ইসলাম; ‘বাঙালির বাংলা’ প্রবন্ধ; নজরুল রচনাবলী; আব্দুল কাদির সম্পাদিত চতুর্থ খ-; প্রথম সংস্করণ ১৯৮৪; পৃষ্ঠা ৫৬।
৭. রফিকুল ইসলাম; ‘নজরুল-জীবনী’; ঢাকা, কবি কাজী নজরুল ইনস্টিটিউট; ২০১৫; পৃষ্ঠা ৩৯৭।
৮. শেখ মুজিবুর রহমান; ‘আত্মজীবনী’; প্রাগুক্ত; পৃষ্ঠা ১৫-১৬।
৯. আব্দুল কাদির সম্পাদিত; ‘নজরুল-রচনাবলী’, চতুর্থ খ-; প্রথম সংস্করণ ১৯৮৪; পৃষ্ঠা ১৮।
১০. মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান; ‘গঙ্গঋত্তি থেকে বাংলাদেশ’, ঢাকা; বাংলা একডেমী; ২০০৮; পৃষ্ঠা ৮৫-৮৭।
১১. শেখ মুজিবুর রহমান; ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’; প্রাগুক্ত; পৃষ্ঠা ২১৭।
১২. মানিক মোহাম্মদ রাজ্জাক; ‘বিদ্রোহী কবি ও বঙ্গবন্ধু’; জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১১৯ তম জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন, ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৫/ ২৫ মে ২০১৮; পৃষ্ঠা ৩৮।
১৩. বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ; মুনতাসীর মামুন; প্রথম খ-, পৃষ্ঠা ১৮ এবং ২০।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
চিত্রকর, লেখক ও গবেষক।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!