‘ঘোড়েল’ পর্ব – চৌদ্দ

মুসা আলি
মুসা আলি
14 মিনিটে পড়ুন

সকাল নটা পর্যন্ত পটলার দোকানে অপেক্ষা করেও সুবিমলকে দেখতে পেল না জয়। তাহলে কী অন্য কোনো জরুরি কাজে জড়িয়ে পড়েছেন? আর দেরি করল না জয়, সাইকেলে সুবিমলের বাড়ির ভিতরে ঢুকে দেখল, রায়দা গুম মুখে বারান্দার উপরে বসে আছেন। —কী ব্যাপার, বাজারে গেলেন না?
একটা প্লট মাথায় এসেছে কিন্তু ঠিকমতো সাজিয়ে নিতে পারছি নে, তাই বসে বসে ভাবছি।
আবার কোন প্লট নিয়ে ভাবছেন?
ভেবেছিলুম, তুই আমাকে আগেভাগে একটা সুপরামর্শ দিবি, সেই সুযোগটুকুও দিলি নে। প্রদীপের সঙ্গে মিলেমিশে রাজিবুল যেভাবে সভা গরম করে দিল, তা নিয়ে ভাবছিস্ নে?
এতদিন জানতুম, রাজিবুলদা রাজনীতি করেন না।
ওর সামাজিক অবস্থান জানিস?
কোনদিন আমাকে বলেন নি।
খুব ব্রিলিয়্যান্ট, এম. এস. সি. পাশ। পাশের গ্রামে হাইস্কুলে শিক্ষকতা করে। গত বছর থেকে গ্রামের মসজিদে ইমামতি করার দায়িত্ব নিয়েছেন, মানে ধর্মের কলে কাঠি মেরে লোক খেপানোর সুযোগ রয়েছে ওর হাতে। দেখলি নে, সেদিন সভায় প্রায় অর্ধেক সংখ্যালঘু মানুষ এসেছিল। আমার স্থির বিশ্বাস, পিছনে রাজিবুলের যথেষ্ট উস্কানি ছিল।
এবার বুঝেছি সুবিমলদা।
এতেই দুতিনটে গুরুতর সমস্যা তৈরি হতে পারে আমাদের সংগঠনের সামনে। সংখ্যালঘু মানুষের মধ্যে আমাদের ইমেজ অনেকখানি ফিকে হয়ে যেতে পারে, প্রদীপ রাজনীতিতে আসার নতুন সুযোগও পেয়ে যেতে পারে, সব মিলিয়ে তালগোল পাকানো অবস্থার মুখোমুখি হতে পারি আমরা। আশু প্রয়োজন, রাজিবুলকে বুঝিয়ে এখনিই আমাদের সংগঠনে টেনে আনা।
তাহলে কী রাজিবুলদার কাছে যেতে বলছেন?
কী বলবি ওকে?
সেই ছক আপনাকেই সাজিয়ে দিতে হবে।
নতুন একটা প্লট তৈরি করলে কেমন হয়?
বলুন শুনি।
ওর গ্রামে যে সামাজিক বিরোধ রয়েছে তা উস্কে দিয়ে চরম সংঘর্ষের রূপ দেব?
তাতে রাজিবুলদার অসুবিধা কোথায়?
বোকা কোথাকার, সংঘর্ষ হলে কেসপত্তর হবে, তাতেই রাজিবুলের নাম জুড়ে দেওয়া যেতে পারে। তাহলে পুলিশ আসবে, ওয়ারেন্ট নিয়ে রাজিবুলকে এ্যারেস্ট করা সম্ভব হবে, বড়ো বড়ো সেকশন জুড়ে দিতে পারলেই হাজতে বসে দিন গুণতে হবে রাজিবুলকে।
এ ঘটনায় সাধারণ মানুষ অন্য সেন্টিমেন্টে নিতে পারে।
এক অর্থে ঠিক বলেছিস।
একটা পরামর্শ দেব আপনাকে?
বল শুনি।
পঞ্চায়েত সমিতির পক্ষ থেকে বড়ো করে সম্বর্ধনা সভার আয়োজন করা যেতে পারে, কৃতি সামাজিক মানুষ হিসেবে সেখানে রাজিবুলদাকে সম্মান জানালে কী নরম হয়ে পড়তে পারেন?
তা পারে কিন্তু গুণিজনদের তালিকায় নাম ছাপতে গেলে রাজিবুলের সম্মতি নেওয়া একান্ত প্রয়োজন। সেই ব্যবস্থা করতে পারবি?
তাহলে রাজিবুলদার কাছে যেতেই হয়, আজকের মধ্যে সময় করে নিজেই যাব যে কোনো মূল্যে রাজিবুলদাকে রাজি করাতে।
সেই পথে এক ঢিলে দুই পাখি মারা সম্ভব হবে রে। মঞ্চে বসলে গোপনে সব কথা রাজিবুলের সঙ্গে সেরে নিতে পারব। তবে আলোচনার শুরুতে আমার নাম প্রকাশ করবি নে।
তাহলে কার নাম বলব?
পাগল ছেলে কোথাকার, পঞ্চায়েত সমিতির প্রতিনিধি হিসেবে তো এসব বলা যেতে পারে।
জয়ের মুখে হাসি ফুটল, বলল, বুঝেছি সুবিমলদা।
তাহলে এক্ষুণি যা।
আপনার সাইকেলটা নিয়ে যাব?
তা নিয়ে যেতে পারিস।
জয় আর কথা বাড়ালো না, সাইকেলে এগিয়ে চলল, সুবিমল ভাবনাতুর মুখে বারান্দার উপর বসে থাকলেন। রাজিবুলকে নিয়ে মাথার ভিতরে যে জট তৈরি হয়েছে, তা থেকে কিছুতেই বের হতে পারছেন না। একটু পরে সামনে চেয়ে দেখলেন, বছর আটেকের একটা ছেলে ছুটে এসে বাড়ির ভিতরে ঢুকল, সুবিমলের চকিত প্রশ্ন, এ্যাই এখানে কেন?
মালতিদি পাঠিয়েছে।
হ্যাঁ, কী বলে দিয়েছে, বল?
আমাকে বলল, হাসপাতালে যাচ্ছি ভ্যানে করে, রায়বাবুকে খবরটা দিয়ে আয়। আপনি তো সেই রায়বাবু?
কোনো উত্তর দিলেন না সুবিমল, ঘরের ভিতরে ঢুকে জামা প্যান্ট পাল্টাতে শুরু করলেন, দ্রুত শেষও করলেন, পাশের বাড়িতে ঢুকে বললেন, তমালের সাইকেলটা কী বাড়িতে আছে?
কাকু, কোথাও যাবেন নাকি?
হ্যাঁরে, হঠাৎ দরকারি কাজে বের হতে হবে।
ওই তো উঠোনের একধারে রেখে দিয়েছি, নিয়ে যান, আজ আমার কলেজ নেই।
সুবিমল সেই প্রসঙ্গে ঢুকলেন না, সাইকেল নিয়ে তরতরিয়ে এগিয়ে চললেন। ডাক্তার তপতী চ্যাটার্জীর কোয়াটারের সামনে থমকে দাঁড়িয়ে গলা খাকারি দিয়ে ডাকলেন, ভিতরে আছেন কী?
কে? দরজা খুলে দিয়ে ডাক্তার তপতীর প্রশ্ন, আপনি?
সেদিন বলেছিলাম, সেই মেয়েটা আজ ভর্তি হতে এসেছে।
তপতীর মুখে এক চিলতে হাসি।
আরেকটা কথা আপনাকে রাখতে হবে।
কী বলুন?
আপনার বাসায় বসে সময় কাটাতে পারি কী?
অবশ্যই পারেন।
তাহলে এখন প্রসূতি বিভাগে চলে যান, নিশ্চয় এত ব্যস্ততার মধ্যে আপনাকে চা করে দিতে বলব না।
আবার একটু হেসে ডাক্তার তপতী বললেন, ভিতরে নিশ্চিন্তে বসুন, টিফিন পাঠিয়ে দিচ্ছি, গরম চাও খেতে পাবেন, বাকি কথা ফোনে হবে।
সুবিমল মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন।
ডাক্তার তপতী দ্রুত পায়ে প্রসূতি বিভাগে গিয়ে দেখলেন, সত্যি সত্যি একজন সন্তান সম্ভবা ভর্তি হতে এসেছে। নামটা আগেই শুনেছিলেন, তবুও বললেন, তোমার নাম কী?
মালতি বর।
বাড়ি কোথায়?
রামজীবনপুর।
স্বামীর নাম কি?
চুপ করে থাকল মালতি। ডাক্তার তপতী ভাবলেন, পিছনে কড লাইন থাকতে পারে কিন্তু তা জানার প্রয়োজন বোধ করলেন না। বেডে শুইয়ে দিয়ে নানা পরীক্ষা শেষ করে বললেন, এখনও বেশ দেরি রয়েছে, সন্ধের পরে ডেলিভারি হতে পাবে।
মালতি কোনো মন্তব্য করল না; সুবিমলবাবু খবর পেয়েছেন বলেই সে নিশ্চিন্ত। ডাক্তার তপতী প্রসূতি বিভাগের ওয়ার্ডে এসে সুবিমলকে ফোন করলেন, ভর্তি নিয়েছি তবে এখনও অনেক সময় বাকি আছে।
সন্ধের পরে কী?
তা নিশ্চিত করে বলা চলে।
তা হলে ভালোই হল।
এ আবার কী ভালোর কথা বলছেন?
সুবিমল চুপ করে থাকলেন।
আপনার টিফিন আর চা নিয়ে পরিমল যাচ্ছে।
সুবিমলের মুখে স্বস্তির ছাপ। এভাবে সারাটা দিন কেটে গেলে কাল থেকে আর ডি.এন.এ. টেস্ট নিয়ে ভয়ে ভয়ে থাকতে হবে না।
ডাক্তার তপতী চেয়ারে বসে গম্ভীর মুখে ভাবছেন। এক নার্স এসে খবর দিল, কে একজন এসেছেন আপনার সঙ্গে কথা বলতে, আসতে বলব কী?
অবশ্যই আসতে বলবে।
ভদ্রলোক গুম মুখে ডাক্তার তপতীর সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন।
কী নাম আপনার?
রাজিবুল ইসলাম।
কেন এসেছেন বলুন?
মালতি নামে কোনো মেয়ে কী একটু আগে প্রসূতি বিভাগে ভর্তি হয়েছে?
আপনি সম্পর্কে কে হন, সেটাই আগে বলুন।
রাজিবুল চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলেন।
নিকট আত্মীয় ছাড়া কেউ এভাবে খোঁজখবর নিতে পারেন কী?
তা পারেন না কিন্তু মেয়েটার সঙ্গে অন্য কাহিনি জড়িয়ে রয়েছে।
থাকলেও তা হাসপাতালের বাইরের ব্যাপার, ডাক্তার হিসেবে আমি তা নিয়ে চর্চা করতে পারি না। আর কিছু বলার থাকলে বলুন।
ছেলে না মেয়ে হল, তা কী আপনার কাছ থেকে জানতে পারব?
চুপ করে থেকে প্রমাণ করে দিয়েছেন, সম্পর্কে আপনি মালতির কেউ নন। তার পরেও এ প্রশ্ন করতে পারেন আমাকে? কথা বাড়ালেই থানায় খবর দিতে বাধ্য হব। সম্মান বাঁচাতে ফিরে যান হাসপাতাল থেকে, সি সি টিভি খোলা রয়েছে,যা যা বলেছেন সবই সচিত্র রেকর্ডে থেকে যাবে।
প্রদীপের পাল্লায় পড়ে রাজিবুল ভেবেছিলেন, সুবিমলের বিরুদ্ধে খুব সহজে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবেন কিন্তু অল্প সময়ে বুঝে গেলেন, অনেক গভীর বিষয়, অভিজ্ঞতার ভান্ডার পর্ণূ না হলে পাল্লাপাল্লি করা সম্ভব নয়। অগত্যা বের হয়ে এলেন প্রসূতি বিভাগ থেকে। ডাক্তার তপতী ফোন করলেন সুবিমলকে, একটা অভিনব প্রসঙ্গ আপনাকে জানিয়ে রাখি।
বলুন বলুন।
রাজিবুল নামে এক ভদ্রলোক এসেছিলেন মালতির খোঁজখবর নিতে কিন্তু সম্পর্কের কথা বলতে পারলেন না।
হাসপাতাল থেকে বের করে দিলেন না কেন?
তাই করেছি।
ওর সঙ্গে অন্য কেউ ছিল কী?
প্রসূতি বিভাগের বাইরে কে একজন অপেক্ষায় ছিল, ভদ্রলোক গিয়ে শুধু বললেন, এভাবে হবে না রে প্রদীপ, অন্য ব্যবস্থা নিতে হবে।
সুবিমল আঁৎকে উঠলেন। রাজিবুল আর প্রদীপ যে খোঁজখবর নিতে এসেছে, তা নিয়ে নিশ্চিত হয়ে গেলেন। সুবিমলের ভিতরে অভিনব আতঙ্ক, বললেন, আপনি অল্প সময়ের জন্যে কোয়াটারে আসতে পারবেন?
নতুন পেশেন্ট এসেছে, একটু দেরি হবে।
তাহলে তাই আসুন, আমি অপেক্ষায় থাকছি।
ডাক্তার তপতীর মধ্যে নতুন প্রশ্নের উঁকি, দুজনের নাম শুনে সুবিমলবাবু এভাবে বিড়ম্বিত বোধ করলেন কেন? কেমন যেন স্তম্ভিত হয়ে গেলেন।
ঘরে বসে সুবিমল ভিতরে ভিতরে অস্থির হতে থাকলেন, আশু কী করা উচিত, তা মাথায় আসছে না। শেষ পর্যন্ত ভাবলেন, মালতির মাকে দিয়ে থানায় কমপ্লেন করাতে পারলেই এ মুশকিল সহজে দূর হতে পারে, খুব সহজে দুটো সুবিধাও মিলবে। দুজনের কেউ হাসপাতালের ধারে কাছে আসতে পারবে না। সন্ধের পরে হাসপাতাল চত্বরে পুলিশ পিকেটিং এর ব্যবস্থা করা সম্ভব হবে।
আধ ঘন্টা পরে ডাক্তার তপতী কোয়াটারে এসে বললেন, এভাবে ব্যস্ত হয়ে ডাকলেন কেন? আপনার জন্যে দুপুরে খাওয়ার ব্যবস্থা করেছি।
ও নিয়ে চিন্তা করছি নে, আমাকে এখনিই একটু থানায় যেতে হবে।
আমি তো থানার ভয় দেখিয়ে ভদ্রলোককে হাসপাতাল থেকে বের করে দিয়েছি।
তার পরেও ভাবছি, পর্ণূ নিরাপত্তার জন্যে থানায় যাওয়া প্রয়োজন।
তাহলে তাই যান, কোয়াটারে ডাবল চাবি রয়েছে, একটা সঙ্গে নিয়ে যেতে পারেন। সারা হয়ে গেলে যখন খুশি চলে আসতে পারবেন। দুপুরে এখানেই খাবেন তো?
একটু বেলান্ত করে খেতে হবে।
তাতে কোনো অসুবিধা নেই।
সুবিমল সাইকেলে বের হয়ে পড়লেন। ভিতরে শিকারি বাঘের মতো অবস্থা, যে কোনো মূল্যে প্রদীপ রাজিবুলকে থামাতেই হবে। ওসির ঘরের সামনে পৌঁছে দেখলেন, বড়বাবু চেয়ারে বসে গম্ভীর মুখে ভাবছেন।
স্যার আসব?
আসুন, আসুন, হাতে গুঁজে দিয়ে সেই যে ভোঁকাট্টা হয়ে গেলেন, ক’দিন আর কোনো দেখা-সাক্ষাৎ নেই। নতুন কোনো ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েন নি তো?
স্যার, তাৎক্ষণিক একটা সমস্যা নিয়ে এসেছি। প্রসূতি বিভাগের প্রধান ডাক্তার তপতী চ্যাটার্জী ফোন করে জানালেন, রাজিবুল নামে কে একজন গিয়েছিলেন সদ্য ভর্তি হওয়া সন্তান সম্ভাবার নানা খোঁজখবর নিতে অথচ আত্মীয়স্বজনের মধ্যে পড়েন না। কোনো অঘটন ঘটে যাবে নাতো?
ভদ্রলোকের ঠিকানা জানা আছে?
একটু আগে জেনে নিয়েছি স্যার।
তাহলে আর ভাবতে হবে না, এখনিই ব্যবস্থা নিচ্ছি। ভদ্রলোক কী করেন?
উচ্চমাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক।
আর কিছু ভাববেন না। একটু চমকে দিলেই কাজ হয়ে যাবে। সজোরে বেল বাজিয়ে দিলেন।
এ্যাটেনডেন্ট ভিতরে এসে বলল, স্যার ডেকেছেন?
রাজীব দাস কী এখন ডিউটিতে?
ওর ডিউটি বিকেলে।
আমার কাছে ডেকে নিয়ে এস।
রাজীব ওসির চেম্বারে ঢুকে বললেন, আমাকে ডেকেছেন স্যার?
এই নাম ঠিকানা, এখনি কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে বের হয়ে যাও, সামনে পেলে তুলে নিয়ে আসবে।
সুবিমলের বিনীত প্রশ্ন, স্যার এখন এখানে থাকা আমার পক্ষে শোভনীয় হবে কী?
আপনি এখন যেতে পারেন। জরুরি প্রসঙ্গ জানানোর জন্যে ধন্যবাদ আপনাকে।
আরেকটা অনুরোধ আছে স্যার।
কী করতে হবে বলুন?
সন্ধের পর হাসপাতাল চত্বরে পুলিশি টহলের ব্যবস্থা করা যায় কী?
তা খুব সহজে সম্ভব, ক’জন লাগবে বলুন?
পাঁচ ছ’জন বন্দুকধারী দিলেই যথেষ্ট।
যথাসময়ে চলে যাবে। আপনি কি তখন হাসপাতালের চত্বরে কোথাও থাকবেন? আই মিন নতুন কোনো সমস্যা দেখা দিলে ওরা আপনার মতামত নিতে পারত।
বলছেন যখন থাকতে হবে। হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, এটা রাখুন।
সংখ্যাটা বলে দিতে পারতেন।
পঞ্চাশ হাজার।
কেন দিচ্ছেন, তা তো বললেন না?
স্যার, শিশুপাচারের কবল থেকে আজকের মতো হাসপাতালকে বাঁচিয়ে দিন, কাল এসে সব বলব।
গম্ভীর ওসি চটজলদি টাকার বান্ডিলটা পকেটে ঢুকিয়ে নিলেন।
সুবিমল থানা থেকে বের হয়ে সোজা হাসপাতালের দিকে চললেন। বেশ বেলা হয়ে গেছে, দুপুরের খাওয়া লেডি ডাক্তারের কোয়াটারে সারতে হবে। নিশ্চয় তপতী ভালো খাওয়ার ব্যবস্থা করেছেন। মেয়েটি খুব উদ্যোগী। কোয়াটারের সামনে গিয়ে দেখলেন, বামপাশের রাস্তা দিয়ে হনহন পায়ে লেডি ডাক্তার এগিয়ে আসছেন। সুবিমল জানিয়ে দিলেন, সব ব্যবস্থা পাকা করে এসেছি।
কী রকম?
ওই ভদ্রলোক হাসাপাতালে এসে আর প্রশ্ন করার সুযোগ পাবে না।
কীভাবে তা সম্ভব হল বলুন?
ওসি তাকে তুলে আনতে পুলিশ পাঠিয়েছেন, বোধ হয় এতক্ষণ এ্যাকশন শুরু হয়ে গেছে।
বুঝলাম।
আপনার গুঁজে দেওয়া টাকার যে বিশেষ মূল্য রয়েছে, তা ওসিসাব হাতেনাতে বুঝিয়ে দিতে পারলেন।
বেলা গড়াতে লাগল আপন ছন্দে, বিকেল এল রোদের স্তিমিত রোষের মধ্যে। তাও পলে পলে শেষ হল। সন্ধের ধূসর ছায়া নামল মাটির বুকে। ডাক্তার তপতী তখন প্রসূতি বিভাগে খুব ব্যস্ত। অন্তিম সময় এসে গেছে। উদ্বিগ্ন মুখে সুবিমল কোয়াটারে অপেক্ষায় আছেন। সন্ধে সাতটা বেজে পনেরো মিনিট। সন্তান প্রসবের পরে মালতিকে যে স্যালাইন দেওয়া হল, তাতে ডাক্তার তপতী ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিয়েছেন। কাজ শেষ তখনকার মতো। সুবিমল কোয়াটারের সামনে অন্ধকারে চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখলেন, একটা অ্যাম্বুলেন্স ঝুপ করে বের হয়ে গেল। ফোন করলেন কিন্তু ডক্টর তপতী তা ধরলেন না। আবার ফোন করলেন, রিং বেজে শেষ হয়ে গেল। তাহলে কী লেডি ডাক্তার কোনো অসুবিধায় পড়েছেন? সুবিমলের দুশ্চিন্তা বেড়ে চলেছে, আজও কী নিজের উদ্দেশ্যে সফল হতে পারবেন না? রাজিবুল এসে নতুন করে কোনো বাধা সৃষ্টি করে নি তো? ওর সঙ্গে কী প্রদীপ ছোঁড়াটা এসেছে? দুর্ভাবনার স্রোতে ভেসে যেতে লাগলেন। পিছন থেকে তপতীর গলা ভেসে এল কানে, এত ভাবনার কিছু নেই সুবিমলবাবু।
মানে?
একটা অ্যাম্বুলেন্সকে বের হয়ে যেতে দেখেছেন কী?
তা দেখেছি।
ওতেই পাঠিয়ে দিয়েছি, আপনার আর কোনো ভয় নেই। মালতি আমাকে সবকিছু খুলে বলেছে সুবিমলবাবু।
মানে?
আপনার অবৈধ সন্তান।
সুবিমল মুখ নীচু করে থাকলেন।
এভাবে যে ধরা পড়ে যাবেন তা বোধ হয় ভাবতে পারেন নি। পাঁচটা কেস পর পর না দিতে পারলে কিন্তু এ ঘটনা আমিই প্রকাশ করে দেব।
সে প্রতিশ্রুতি তো আগেই দিয়েছি।
এজন্যে আর কোনো শেয়ার পাবেন না।
সে পরের কথা।
এখনিই হ্যাঁ বলতে হবে।
আচ্ছা তাই হবে। সুবিমল আনমনে সাইকেলে উঠে বসলেন। তপতীর মৃদু ঠাট্টা, চা করে দেওয়ার কথা বললেন নাতো? এভাবে ভারাক্রান্ত হবেন না। আপনি আমাকে দেখেছেন, আমিও আপনাকে দেখব। ভারসাম্য বজায় রাখা সম্ভব হল আর কী।
সুবিমল কোনো উত্তর না দিয়ে হন্‌হন্ করে সামনে এগিয়ে চললেন, অবশ্য মনে মনে ওসিকে একবার ধন্যবাদ দিতে ভুললেন না। রাশ টেনে ধরতে পেরেছিলেন বলেই রাজিবুল আর প্রদীপ সন্ধের পরে হাসপাতালমুখো হওয়ার মতো সাহস দেখাতে পারে নি।

চলবে…

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
লেখক: মুসা আলি
শিক্ষক জীবনের ৫৫ বছরে এসে সাহিত্যচর্চা শুরু। ইতিমধ্যে পঞ্চাশের বেশি উপন্যাসের মনসবদার। গল্প উপন্যাস লেখার ক্ষেত্রে দীর্ঘ জীবন পরিক্রমায় কঠোর বিশ্বাসী। এখন বিদগ্ধ পাঠক শুধুমাত্র কাহিনি বা চরিত্র খোঁজেন না বরং তার ভিতরে লেখক এর নিজস্ব গভীর মনন আবিষ্কার করতে চান। ঔপন্যাসিক মুসা আলি দীর্ঘ জীবন পরিক্রমার জাদুতে তার নিজস্ব মনন দিয়ে বাঙালি পাঠককে ঋদ্ধ ও সমৃদ্ধ করে তুলতে বদ্ধপরিকর।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!