মহাবেল ক্রিসেন্টিয়া

জায়েদ ফরিদ
জায়েদ ফরিদ
8 মিনিটে পড়ুন
মহাবেল গাছ (Crescentia cujete) ছবি: সংগৃহীত।

দেখতে যেন বিশাল এক বেল। সাধারণ কাঁচা সবুজ বেলকে বড় করলে নিশ্চিত এমনই হবে দেখতে। গাছ ছোটো, কিন্তু ফলটা বিপুল আকারের, বেশ বেমানান মনে হলেও কিন্তু কৌতূহলজনক। মনে হয়, কোনো মহীরুহের বড়ো ফল এনে ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে গাছে। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে পশ্চিম ও দক্ষিণ আফ্রিকার কিছু এলাকা ও দক্ষিণ আমেরিকার কিছু অঞ্চলে মহাবেলের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানা যায়। ভারতবর্ষে এর দেশীয়করণ হয়েছে, কিন্তু তেমন বিস্তার ঘটেনি কারণ হয়তো এর ফল বিষাক্ত, এমনকি পাতা ও বীজও। তবে আদি নিবাসের জায়গাগুলোতে এমন বিষাক্ত গাছেরও বহুল ব্যবহার রয়েছে যা ভাবলে বিস্মিত হতে হয়।

সাধারণ বেল (এগ্‌লি মারমেলস- Aegle marmelos) পূজা-রমজানে একটি উপাদেয় খাবার হিসাবে চিহ্নিত। বিশেষত চাক করে কাটা কচি বেলশুঁঠ পেটের পীড়ার এক মহৌষধ। তবে দীর্ঘকাল পাকা বেল খাওয়া অনুচিত, এতে অন্ত্রে সূক্ষ্ম ছিদ্র হতে পারে, হজমে বিলম্ব এবং কুপিত বায়ু সৃষ্টি করতে পারে। এই কথা উল্লিখিত হয়েছে আয়ুর্বেদ-গ্রন্থ চরক সংহিতায়। সংস্কৃত ‘বিল্ব’ থেকে ‘বেল’ শব্দের উৎপত্তি, যার মূল ‘বিল্‌’ অর্থ ছিদ্র। অন্ত্রে ছিদ্র করে বলেই বিল্ব বা বেল। তবে দীর্ঘ ব্যবহার থেকেই এমন হয়, বিরতি দিয়ে খেলে হয় না। উল্টোদিকে, বেলশুঁঠ খেলে এই ছিদ্র বন্ধ হয়ে যায়। একই ফলের এমন বিপরীত আচরণ সম্পর্কে আমাদের অবহিত করেছেন প্রণম্য প্রাচীন সংহিতাকারগণ।

2 6 মহাবেল ক্রিসেন্টিয়া
শুকনো ফলের গায়ে নক্সা- ছবি: Doreen Pendgracs

উদ্ভিদ জগতে মহাবেলের অনুপম দ্বিপদী নাম ‘ক্রিসেন্টিয়া কুজেট’ (Crescentia cujete L.)। ক্রিসেন্টিয়া গণের নামটি ‘ক্রিসেন্ট’ বা চন্দ্রের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। এটি ১৪ শতকের ইতালীয় কৃষিবিদ ক্রিসেঞ্জির (Crescenzi) নাম থেকে আগত। গোটা ভারতবর্ষে ফলটির বাংলা নাম নিয়ে বিভ্রাট রয়েছে সাধারণ্যে। ডুগডুগি, তানপুরা, বোম্বাই বেল, পাগলা বেল ইত্যাদি বহু নামে একে ডাকা হয়। কিন্তু ডাকলেই তো হলো না, নামকরণের কিছুটা সার্থকতা থাকতে হবে। পথের ধারে বান্দর-খেলা দেখানোর সময় লোক জমানো বা দর্শকের মনোযোগ আকর্ষণের জন্য ব্যবহার করা হতো ডুগডুগি, যা ডুগডুগ শব্দ করে বাজে। যন্ত্রটির কোমর চিকন, বেতের মোড়ার মত, মহাবেল দিয়ে এটি কখনও তৈরি হয় না। তানপুরা বিশাল নিতম্বের অধিকারী, বোষ্টমী কদুর খোল দিয়ে তা নির্মাণ করা হয়, মহাবেল দিয়ে নয়। ফল দেখতে বড়ো বলে বোম্বাই আম বা বোম্বাই লিচুর মতো এরও এক নাম হয়েছে বোম্বাই বেল। পাগলা বেল কোনো নাম নয়, পাগলামিই মনে হয়, যা বিভ্রান্তির বহিঃপ্রকাশ মাত্র। যাহোক, মহা যে বেল তা ‘মহাবেল’ বলেই সঙ্গত মনে হয়েছে।

একটি উদ্ভিদের সুন্দর নাম নির্বাচন করাও বৃক্ষপ্রেমীদের দায়িত্বের পর্যায়ে পড়ে। একগাদা নাম বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। অতি উল্লাসে, অতি বিশেষণে বেশি নাম দিয়ে আমরা হারিয়েছি পৌরাণিক সোমলতা যা আয়ুর্বেদাচার্য শিবকালীও স্টহিক বের করে আনতে পারেননি। সারা পৃথিবীতে মহাবেলের সর্বাধিক পরিচিত নাম ‘কালাবাশ ট্রি’ যার স্পেনীয় অর্থ লাউ।

3 7 মহাবেল ক্রিসেন্টিয়া
মহাবেলের খোল থেকে তৈরি ব্যবহার্য দ্রব্য। ছবি: সংগৃহীত

প্রাকৃতিক বনাঞ্চলে মহাবেলের ফল একবিঘৎ পরিমাণ চওড়া হলেও আধুনিক হাইব্রিড প্রজাতির ফল ৪০ সেন্টি পর্যন্ত হতে পারে। খাদ্যের দিক দিয়ে বেলের মতো উপযোগী না হলেও আদিবাসী স্থানীয় লোকজন এর ফলের ভিতরের মণ্ডকে ঔষধ হিসাবে ব্যবহার করে। খুব বেশি পেকে গেলে এর ভিতরের মণ্ড মাকাল ফলের মতো কালো হয়ে যায়, এর আগে তা সাদা থাকে। এই সাদা অংশ পেতে হলে করাত দিয়ে বেশ কসরৎ করেই বহিরাবরণ কেটে নিতে হয়। যখন করাত আবিষ্কার হয়নি তখন এটি কাটা হত ধারালো ফ্লিন্ট বা চকমকি পাথর দিয়ে। ভিতরের মণ্ড ফেলে দিয়ে এখন মহাবেলের শেল দিয়ে নানা আকৃতির পাত্র ও ডিজাইন করা সম্ভব হলেও আদিবাসীরা সাধারণ পাত্র নির্মাণে তেমন নক্সা করায় মনোযোগী নয়। অতীতে এর প্রধান ব্যবহার ছিল সংরক্ষণের নিমিত্তে জলপাত্র নির্মাণে যখন প্রাকৃতিক উপকরণ হিসাবে ব্যবহার করা হতো আফ্রিকার উটপাখির ডিমও। খোল থেকে ব্যবহার্য দ্রব্যের মধ্যে প্লেট, কাপ, চামচ, হুক্কা, মুখোশ, পাখি ধরা ফাঁদ, হস্তশিল্প ইত্যাদি তৈরি হয়।

মহাবেলের খোল থেকে আরো তৈরি হয় বিখ্যাত বাদ্যযন্ত্র ‘মারাকা’। আমাদের যন্ত্রীদের একে ‘মারাক্কাস’ বলতে শুনেছি। এটি একপ্রকার ঝুমঝুমি যা মিউজিক্যাল রিদম্‌ সৃষ্টিতে ব্যবহার করা হয়। মারাকা নির্মাণ করা হয় ফলের ভিতরের মণ্ড ফেলে দিয়ে লম্বা ডাঁটি লাগিয়ে। দুই ডাবার ভিতরে ঢোকানো হয় অসমসংখ্যক কলাবতীর শক্ত বীজ বা অন্য কিছু। কলাবতীর বীজ এতই শক্ত যে বৃটিশ আমলে গাদাবন্দুকের ধাতব ছররার বিকল্প হিসাবে একে ব্যবহার করা হয়েছিল।

4 3 মহাবেল ক্রিসেন্টিয়া
কিউবাতে নির্মিত মারাকাস বাদ্যযন্ত্র। ছবি: সংগৃহীত

ফলের মণ্ড ও বীজ হাইড্রোসায়ানিক এসিডের কারণে বিষাক্ত হলেও সেদ্ধ করে বা আগুনে পুড়িয়ে কখনও তা খাওয়ার উপযোগী করা হয়। তবে মাত্রাতিরিক্ত হলে তাতে মৃত্যুঝুঁকি আসতে পারে। কেরালায় করবী ও মহাবেল মণ্ডের বিষ পান করে অনেক মানুষ আত্মহত্যা করে বলে মেডিকেল সূত্রে জানা যায়। আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার স্থানিক লোকজন ফল থেকে সিরাপ তৈরি করে বা কখনও স্যুপের সঙ্গে গাছের পাতা খায় যা ঠান্ডার জন্য দারুণ জনপ্রিয় ওষুধ।

ফলের রস ডায়েরিয়া, নিউমোনিয়া, মাথাব্যথা, পোড়া চিকিৎসা ও অন্ত্ররোগে ব্যবহৃত হয়। ফলের মণ্ড থেকে এক ধরনের কড়া চা তৈরি হয় যার ব্যবহার দেখা যায় গর্ভপাতে এবং সহজ সন্তান প্রসবে। পাতা বা ছালের রস দিয়ে ক্ষত ধোয়া যায়, দাঁতব্যথাও পাতা চিবুলে কমে যায়।

বনাঞ্চলে যে সব প্রাচীন গাছ দেখা যায় তাতে প্রচুর পরিমাণ অর্কিড ও ব্রমেলিয়াড দেখা যায়। গাছের কর্তিত কাণ্ডসমেত এগুলো বাজারে বিক্রি হতে দেখা যায়। অধুনা বাণিজ্যিক মুনাফার জন্য এই গাছের ফলে সুতো পেঁচিয়ে বা ছাঁচ ব্যবহার করে নানা ধরনের আকার তৈরি করা হয়। মহাবেল গাছের কাণ্ড ৩০-৪০ সেন্টি হতে পারে। এর কাঠ খুব সুন্দর কার্ভ করা যায় বলে ভাস্কর্য তৈরি হয়। আমাদের দেশে কৃষিযন্ত্র তৈরিতে যেমন বাবলা কাঠের বহুল ব্যবহার দেখা যায় তেমনি মহাবেল গাছের কাঠ দিয়েও সেসব তৈরি হয়ে থাকে।

5 1 মহাবেল ক্রিসেন্টিয়া
কাণ্ড থেকে উদ্ভূত মহাবেল ফুল ও নেকটার ডিস্ক (ডানে, ওভারির নিচে) – ছবি: P Nunes

মহাবেল গাছ সর্বোচ্চ ৩-৪ তলা দালানের সমান উঁচু হতে পারে। এতে ডালপালা এলোমেলো হতে দেখা যায়। বোঁটার দিকে সরু চামচ আকৃতির পাতাগুলো ক্লাস্টার করে থাকে ডালে। ফুল ফোটে সরাসরি কাণ্ডের গায়ে (Cauliflory) যেমনটা দেখা যায় নাগলিঙ্গম, কাঁঠাল, ডুমুর, কোকো ইত্যাদি গাছে। মহাবেল গাছ লাগানোর কয়েকবছর পর ফুল ফোটে। ফুলের রং সবুজাভ সাদা, বেগুনি রেখাযুক্ত। পরাগায়ন করে প্রধানত বাদুড়, তবে যেখানে বাদুড় বিরল সেখানে হয়তো মথ বা মৌমাছি এর পরাগায়ন করে থাকে।

ওভারির নিচে মধুগ্রন্থির উপস্থিতির কারণে মাজুলি বা বিষপিঁপড়ে দেখা যায় মহাবেল গাছে যা ফলকে বন্যপ্রাণীর কবল থেকে রক্ষা করে। পরস্পরের জন্য উপকারী এই আচরণকে একপ্রকার ‘সিম্বায়োসিস’ বা মিথোজীবিতা বলা চলে। গাছে ফল থাকে প্রায় ৭ মাস, সবুজ থেকে আস্তে আস্তে এই ফল ধূসর রঙ ধারণ করে। এর কাটিং থেকে সহজে নতুন গাছ জন্মানো যায়। বীজ থেকেও চারা হয়, অঙ্কুরোদ্গম হয় ১০-১৫ দিন পর। সবরকম মাটিতেই এটা জন্মাতে পারে, এমনকি কর্দমাক্ত মাটিতেও।

6 2 মহাবেল ক্রিসেন্টিয়া
ফল কাটার পর সাদা মণ্ড ও খালি পাত্র। ছবি: সংগৃহীত।

মহাবেল বিগনোনিয়াসিয়ি (Bignoniaceae) পরিবারের উদ্ভিদ, যে পরিবারে আট শতাধিক গাছ রয়েছে। ক্রিসেন্টিয়া গণে আছে গোটা ছয়। এদের বৈশিষ্ট্য, ফানেল বা কাপ আকৃতির উভলিঙ্গী ফুল, বীজ চ্যাপ্টা, প্রায়শ ডানাযুক্ত। এই পরিবারের কিছু পরিচিত উদ্ভিদের মধ্যে রয়েছে রুদ্রপলাশ (Spathodea campanulata), কাইজেলিয়া (Kigelia africana), ট্রাম্পেট ক্রিপার (Campsis radicans), ট্রাম্পেট ট্রি টেবেবুইয়া (Tabebuia), জ্যাকারান্ডা (Jacaranda) ইত্যাদি। দক্ষিণ আমেরিকা থেকে ভারতীয় উপমহাদেশে ক্রিসেন্টিয়ার দুটি প্রজাতি C. cujete ও C. alata দেশীয়করণ হয়েছে।

মহাবেল একটি সুন্দর পরিচ্ছন্ন গাছ যার বৃদ্ধি কম এবং কম যত্নে বেঁচে থাকতে পারে। উল্লিখিত ঔষধের জন্য আমরা এই গাছের উপর নির্ভরশীল নই, কারণ আমাদের অন্যান্য অসংখ্য গাছ রয়েছে। তবে গবেষণায় যদি দেখা যায় এর থেকে এমন ওষুধ তৈরি হচ্ছে যা অন্য গাছ থেকে পাওয়া যাচ্ছে না, তবে তা ভিন্ন কথা। পৃথিবীব্যাপী এই গাছ ভূদৃশ্যের উপযোগী বলে জনপ্রিয়তা অর্জন করছে, আমাদের দেশেও এমন গাছের এভিনিউ দেখতে আমরা নিশ্চয়ই পছন্দ করব।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!