মহর্ষির মহাবিদ্রোহকালীন মহাপরিভ্রমণ…

যজ্ঞেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়
যজ্ঞেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়
14 মিনিটে পড়ুন
ছবি: সংগৃহীত।

“সভ্নাঁ জীয়াকা তুম্ দাতা, সো মৈঁ বিসর না জাই,” অর্থাৎ সকল জীবের তুমি দাতা, তাহা যেন আমি বিস্মৃত না হই, উক্ত কথাটি পরমাত্মার উদ্দেশ্যে বলেছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, হিমালয়ের দুর্গম বোয়ালি নামক পর্বতে। তিনি তখন দীর্ঘ দুই বৎসর কালীন ভ্রমণ করছিলেন ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে তথা হিমালয়ের নানান পর্বত শিখরে। এটি তাঁর এ যাবৎ কালীন দীর্ঘ ভ্রমণ আর সময়কালটা ছিল ১৮৫৬ হতে ১৮৫৮, যার মধ্যে ঘটে যাচ্ছে মহাবিদ্রোহ, যেটা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তাঁর হিমালয় যাত্রায় প্রভাব ফেলেছে।

আশ্বিন মাস এলেই মহর্ষি অন্তর থেকে বেরিয়ে পড়ার ডাক অনুভব করতেন, সেটার কারণ খুঁজতে অবশ্যই ফিরে যেতে হবে ওঁনার বাল্যকালে। একদিন বালক দেবেন্দ্রনাথ, রাজা রামমোহন রায়কে নিজ বাড়ির দুর্গাপূজার নিমন্ত্রণ করতে গিয়েছিলেন। রামমোহন রায়ের এই বান্ধবপুত্র সেদিন প্রথম দর্শনেই তাঁর ব্যক্তিত্ব ও মতাদর্শে আকৃষ্ট হয়ে পড়লেন। রামমোহন রায়ের দেখাদেখি ক্রমে বালক দেবেন্দ্রনাথের মনে কয়েকটি সিদ্ধান্তের উদয় হলো যে, “প্রতিমা ঈশ্বর নহে। সুতরাং আমি কোন প্রতিমাকে পূজা করিব না, প্রনাম করিব না, কোন পৌত্তলিক পূজার নিমন্ত্রণ গ্রহন করিব না, তখন জানিতে পারিলাম না যে, কি আগুনে প্রবেশ করিলাম। ভাইদের লইয়া দল বাঁধিয়া প্রতিজ্ঞা করিলাম যে, কোনদিন প্রতিমাকে প্রনাম করিব না।”

সাথে পিতামহীর মৃত্যু তাঁর মধ্যে গভীর ছাপ ফেলে, পিতা দ্বারকানাথ তখন এলাহাবাদ ভ্রমণে। শ্মশানে বসে উপলব্ধি করলেন, শ্মশানের সেই উদাস আনন্দ, জাগতিক আনন্দ হতে একদমই ভিন্ন। তাঁর মনে হলো “এতদিন শুধু বিলাসের আমোদে ডুবিয়া ছিলাম। ধর্ম কি, ঈশ্বর কি, কিছুই জানি নাই, কিছুই শিখি নাই। আমার চারিদিকে কেবল বিলাসী আমোদের অনুকূল বায়ু অহর্নিশ প্রবাহিত হইতেছিল। এতো প্রতিকূল অবস্থাতেও ঈশ্বর আপনি দয়া করিয়া আমার মনে বৈরাগ্য দিলেন ও আমার সংসারশক্তি কাড়িয়া লইলেন এবং নূতন জীবন প্রদান করিলেন। সংসারেও আমার কোন প্রকার সুখ ছিল না এবং ঈশ্বরের আনন্দও ভোগ করিতে পারিতেছিলাম না।”

পিতার কথামতো তিনি জমিদারি দেখাশোনা করলেন, ইউনিয়ন ব্যাঙ্কে কাজ করলেন, সাংসারিক প্রত্যেক দায়িত্ব পালন করলেন, পার্থিব সকল বিষয়ের ভার বহন করলেন কিন্তু কিছুতে আবদ্ধ হইলেন না অথবা বলা যেতে পারে, সুদীর্ঘ জীবনকাল তিনি ঘোর বিষয় সংস্পর্শে থাকলেও কেমন অনাসক্ত ভাবে ঋষিধর্ম পালন করে গেছেন।

কবিগুরু পিতা সম্বন্ধে জীবনস্মৃতিতে বলেন, “মনের মধ্যে সকল জিনিস সুস্পষ্ট করিয়া দেখিয়া লওয়া তাহার প্রকৃতিগত ছিল, তা হিসাবের অঙ্কই হোক বা প্রাকৃতিক দৃশ্যই হোক বা অনুষ্ঠানের আয়োজনই হোক। তাঁহার স্মরনশক্তি ও ধারনাশক্তি অসাধারণ ছিল। সেইজন্য একবার মনের মধ্যে যাহা গ্রহন করিতেন তাহা কিছুতেই তাঁহার মন হইতে ভ্রষ্ট হইত না।” এখানে ওঁনার অপরিসীম মানসিক দৃঢ়তার পরিচয় পাওয়া যায়।

একদিকে ব্রাহ্মধর্ম তথা পরমাত্মার উপাসনায় বিশ্বাসী মন, অপরদিকে নিজ পরিবার মধ্যে তাঁকে মূর্তিপূজা ও দুর্গোৎসবের আয়োজন করতে হয়। এই কাজে তিনি নির্লিপ্তভাবে থাকতেন এবং পূজার অব্যবহিত পূর্বে কলকাতা ত্যাগ করতেন। ব্রহ্ম পরায়ন এই গৃহস্থ ঋষির গৃহবাসের কাল অপেক্ষা তীর্থবাসের কালই ছিল অধিক, সে তীর্থ যেমন সাধারণ তেমনি অসাধারণ। তাছাড়াও তাঁর দৈনন্দিন জীবনে প্রভাব ফেলেছিল কার টেগোর কোম্পানির পতন, ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক বন্ধ হওয়া, ভ্রাতাদের দ্বারা অতিরিক্ত ঋণ গ্রহন। তিনি বলেন “এই সকল ঘটনায় আমার মন ভগ্ন হইয়া গেল। মনে করিলাম, বাড়িতে থাকিলে এইরূপ নানা উপদ্রুব আমাকে ভোগ করিতে হইবে এবং ক্রমে ঋণজালেও বদ্ধ হইতে হইবে। আর সময় নষ্ট করিব না, একাগ্রচিত্ত হইয়া একান্তে তাহার জন্য কঠোর তপস্যা করিব। বিষয় হতে মুক্ত হইয়া ব্রম্ভ্রলোককে অনুভব করিল আমার আত্মা।

বর্ষার ঘন মেঘ মাথার উপর উড়িয়া গেলে মনে হতো ইচ্ছামত আমিও যদি যেখানে সেখানে চলিয়া যাইতে পারি, তবে আমার বড়ই আনন্দ হয়। উপনিষদেও লেখা- না ধনের দ্বারা, না পুত্রের দ্বারা, না কর্মের দ্বারা, কিন্তু কেবল এক ত্যাগের দ্বারাই সেই অমৃতত্বকে ভোগ করা যায়। তখন আর এ পৃথিবী আমার মনকে ধরিয়া রাখিতে পারিল না। সংসারের মোহগ্রন্থি সকলি আমার ভাঙ্গিয়া গেল। তখন প্রতীক্ষা করিতে লাগিলাম, কখন আশ্বিন মাস আসিবে, আমি এখান হতে বের হব, সর্বত্র ঘুরিয়া বেড়াইব, আর ফিরিব না।”
মহর্ষির বড় মেয়ে সৌদামিনী দেবীর লেখাতে এই পরিভ্রমণের উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি প্রবাসী পত্রিকায় লেখেন “পিতা শিলাইদহের জমিদারিতে তাঁহার তিন-চারিটি ছেলেকে সঙ্গে লইয়া বেড়াতে গিয়েই ঠিক করিলেন, দূরে কোথাও নির্জনে গিয়া ঈশ্বর সাধনা করিবেন। সেখান হইতেই ছেলেদের বাড়ি পাঠাইয়া তিনি সিমলা চলিয়া গেলেন। ইহাদিগকে বাড়ি পাঠাইবার সময় তাঁহার চোখ দিয়া জল পড়িতে লাগিল। পিতা মনে করিয়াছিলেন, হয়তো তাঁহার বাড়ি ফেরা আর ঘটিয়া উঠিবে না।”

সেই মোতাবেক ৩৯ বছর বয়সে ১৮৫৬ সালের ১৯শে আশ্বিন কাশী অভিমুখে যাত্রা করেন। সঙ্গে ছিল কিশোরীনাথ চট্টোপাধ্যায়, কৃষ্ণনগরের এক গোয়ালা ও কয়েকজন ভৃত্য। নৌকে যোগে নবদ্বীপ এলেন, সেখান থেকে মুঙ্গের। মাঝে নদীতে প্রচন্ড ঝড়ে আহারাদি সব ডুবে গেল। পরে পাটনাতে এসে পুনরায় আহারাদি জোগাড় করা হল। পাটনা থেকে নৌকা যোগে কাশী অভিমুখে রওনা দিলেন, মহর্ষি গঙ্গার ধারে ধারে শস্যক্ষেতের মধ্য দিয়ে, গ্রাম ও উদ্যানের মধ্য দিয়ে হেঁটে প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখতে দেখতে যেতেন। বজরা চলতো পাশাপাশি, পরে তিনি বজরায় উঠতেন। এইভাবে কাশী পৌঁছলেন কলকাতা থেকে দেড় মাস পরে। কাশীতে দশ দিন ছিলেন, আশ্রয় গ্রহন করলেন একটা বাগানের মধ্যে ভাঙ্গা পরিত্যক্ত বাড়িতে। এরপর ডাক গাড়ি করে এলাহাবাদ অভিমুখে যাত্রা করলেন, সাথের চাকরদের বাড়ি ফিরিয়ে দিলেন, শুধু দুজন চাকর সঙ্গে রইলো। পরের দিন সন্ধ্যায় এলাহাবাদের পূর্বপারে পৌঁছলেন। গাড়ি নৌকায় চাপিয়ে রাত্রিতে নৌকায় নিদ্রা দিলেন। পরদিন নৌকা ডাক গাড়ি সমেত প্রয়াগ পৌঁছলেন। দেখলেন প্রসিদ্ধ বেনী ঘাট, এই ঘাটে লোকে মস্তক মুণ্ডন করে শ্রাদ্ধ করে, তর্পন করে, দান করে।

এলাহাবাদ থেকে আগ্রা এসে পৌঁছলেন। মহর্ষির ডাক গাড়ি দিবারাত্রি চলতো শুধু দুপুরে আহারের জন্য দাঁড়াতো। আগ্রায় এসে তাজ দেখলেন। তাজ দেখে বললেন “এ তাজ পৃথিবীর তাজ। আমি একটি মিনারে বসিয়া দেখি পশ্চিম দিকে সূর্য অস্ত যাইতেছে। নীচে নীল যমুনা। মধ্যে শুভ্র, স্বচ্ছ তাজ সৌন্দর্যের ছটা লইয়া যেন চন্দ্রমন্ডল হইতে পৃথিবীতে খসিয়া পড়িয়াছে।”

আগ্রা থেকে তিনি যমুনা দিয়ে দিল্লী অভিমুখে যাত্রা করলেন। পৌষ মাসের শীতে তিনি যমুনাতে অবগাহন করতেন। এভাবে তিনি মথুরায় এসে পৌঁছলেন, দেখলেন যমুনার তীরে নানা সাধুসন্ত দের সত্র। এক সাধু তাঁকে ডেকে পুঁথি খুলে পাঠ শোনাতে লাগলেন। তিনি দেখলেন সে সবই রামমোহন রায়ের পুস্তকের হিন্দি অনুবাদ। হয়তো পরমেশ্বর তাঁকে রামমোহন রায়ের কথা বারংবার স্মরন করিয়ে গিয়েছেন জীবনের নানা অধ্যায়ে। তিনি দেখতেন সকল ধর্ম সাম্প্রদায়িকেরাই রামমোহন রায়কে আপনার আপনার দিকে টানে।

উনি ওখান থেকে বৃন্দাবন পৌঁছলেন। সেখানে লালাবাবুর কীর্তি গোবিন্দজীর মন্দির দেখতে গেলেন। তিনি গোবিন্দজীকে প্রনাম না করায় মন্দিরের সকলে সচকিত হলেন। আগ্রা থেকে একমাসে দিল্লী পৌঁছলেন বজরা যোগে। তখন তিনি দেখলেন সেখানের বাদশাহ ঘুড়ি ওড়াচ্ছেন। তিনি ভাবলেন, এখন তো তার হাতে কাজ নেই, কি করেন?

এরপর মহর্ষি দিল্লীতে বাজারের উপর একটি বাড়ি ভাড়া করলেন। সেই সময় ওনার ছোট ভাই নগেন্দ্রনাথ তাঁকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য দিল্লী আসেন কিন্তু মহর্ষির সাথে তার দেখা হয়নি। এই না দেখা দুই ভাইয়ের মধ্যে অপূর্ণই থেকে যায়, পরের বছর নগেন্দ্রনাথের মৃত্যু ঘটে।

এরপর দিল্লী থেকে ডাকের গাড়ি করে আরো পশ্চিমে আম্বালায় পৌঁছলেন। সেখান থেকে কিশোরীনাথ চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে ডুলি করে লাহোর গেলেন। লাহোর থেকে ফিরে অমৃতসরে পৌঁছলেন। তিনি ওখানে প্রত্যহ স্বর্নমন্দিরে গিয়ে উপাসনায় যোগ দিতেন। তিনি দেখলেন এখানে সপ্ত প্রহর ঈশ্বরের উপাসনা হয় সেখানে ব্রাম্ভ্রসমাজে সপ্তাহে দুই ঘন্টা মাত্র উপাসনা হয়, এই সদ দৃষ্টান্ত ব্রাম্ভ্রদিগের অনুকরণীয়। শিখেরা নিরাকার ব্রম্ভ্রোপাসক হয়েও, সেই গুরুদ্বারার সীমানার মধ্যে শিব মন্দির স্থাপন করে ফেলেছে। অর্থাৎ পরব্রম্ভ্র জ্ঞ্যান করে, সৃষ্ট কোন বস্তুর আরাধনা করবো না, এই ব্রাম্ভ্র প্রতিজ্ঞা রক্ষা করা কারো পক্ষেই বড় সহজ নয়।

এরপর বৈশাখ মাসে অমৃতসরে গরম অনুভূত হলে তিনি সিমলার উদ্দেশে যাত্রা করলেন। সামনে সুউচ্চ পাহাড় দেখে তিনি অভিভূত হয়ে পড়লেন, “কাল আমি উহার উপরে উঠিব, পৃথিবী ছাড়িয়া স্বর্গের প্রথম সোপানে আরোহন করিব।”

মহর্ষি সিমলায় এসে উপস্থিত হলেন। ওখানে তিনি এক বছর অতিবাহিত করেন। সিমলায় থাকাকালীন মহাবিদ্রোহের ফলে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হলো। গোর্খা সেনারা ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলো, গোটা সিমলা শহর জনশূন্য হয়ে পড়লো। পরিস্থিতি দেখে মহর্ষি সিমলা ছেড়ে ডগশাহী পাহাড়ে আশ্রয় নিলেন, কিছুদিন পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে পুনরায় তিনি সিমলায় ফিরে এলেন।

এই সম্বন্ধে সৌদামিনী দেবী লিখেছেন “তিনি সিমলায় যাওয়ার দিনকয়েক পরেই সিপাইবিদ্রোহ আরম্ভ হইল। অনেকদিন তাঁহার চিঠিপত্র পাওয়া গেল না। একটা গুজব সিপাহীরা তাঁহাকে হত্যা করিয়াছে। কিছুদিন পরে তাঁহার চিঠি পাওয়া গেল, তখন সকলে সুস্থ হইলেন।”

সিমলায় ফিরে এসে তিনি ঠিক করলেন আরো উত্তর দিকের সুউচ্চ পর্বতে ভ্রমণ করবেন। সেই মোতাবেক ঝাঁপান ঠিক করা হলো, তিনি পর্বত অভিমুখে রওনা দিলেন। সেই পর্বত বিহারে তাঁর ঝুলি বিচিত্র অভিজ্ঞতায় পূর্ণ হতে থাকলো। তিনি পথমধ্যে ঝাঁপানীদের সাথেই আহার করতেন, কোথায় তাঁর সেই জমিদারির বৈভব, পরমাত্মা সবাইকে এখানে এক সারিতে নিয়ে এসেছেন। তাঁর জগতে ধনী দরিদ্র সকলেই সমান।

তিনি শুনলেন, এই সব দেশে স্ত্রীলোকের সংখ্যা খুব কম, তাই সকল ভাই মিলে একজন স্ত্রীকে বিবাহ করে। যতো উপরে উঠতে থাকলেন ততো শীতের প্রকোপ বাড়তে থাকলো। দেবদারু গাছের মতো কেলু নামের এক গাছ চোখে পড়লো, জানতে পারলেন এই গাছে আলকাতরা জন্মে। চারিদিকের ভূপ্রকৃতি দেখে তাঁর মনে হলো, “হে নাথ, যখন এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পুষ্প গুলির উপরে তোমার এত করুনা, তখন আমাদের উপর না জানি তোমার কত করুনা।”
একাকী পর্বত শিখরে বসে দেখলেন দূরে পর্বতের স্থানে স্থানে প্রদীপের মতো আলো, মনুষ্য জাতির অস্তিত্বের পরিচয় দিচ্ছে।

এখানে তিনি আষাঢ় মাসের প্রথম দিনের তুষারপাত দেখলেন। এরপর বর্ষা আরম্ভ হলো, চিরকাল মেঘ উপরে দেখেছেন, এখানে এসে দেখলেন মেঘ পর্বতের পাদমূল থেকে উঠে আসছে। ভাদ্র মাসে পাহাড় থেকে নেমে আসা জলে পথ দুর্গম হয়ে পড়লো। কার্ত্তিক মাসে শীতল বায়ু যেন আত্মাকে শীতল করে দিল। পৌষে দু তিন হাত বরফ পড়ে সব রাস্তা অবরুদ্ধ করে দিল। মহর্ষি এইসব শীতের রাতে দরজা খুলে বিছানায় বসে সব কিছু ভুলে অর্ধেক রাত্রি পর্যন্ত ব্রম্ভ্রসঙ্গীত ও হাফেজের কবিতা পাঠ করতেন। দিনের বেলায় গভীর ব্রম্ভ্রচিন্তায় নিমগ্ন থাকতেন, একাগ্রচিত্তে আত্মার মূল তত্ত্বের আলোচনা ও অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত থাকতেন।

এই প্রসঙ্গে কবিগুরুর জীবনস্মৃতি থেকে পাওয়া যায়, “এক একদিন জানি না কত রাত্রে, দেখিতাম, পিতা গায়ে একখানি লাল শাল পরিয়া হাতে একটি মোমবাতির সেজ্ লইয়া নিঃশব্দ সঞ্চরনে চলিয়াছেন, বাহিরের বারান্দায় বসিয়া উপাসনা করিতে যাইতেছেন।”
মহর্ষি বলেন “এই ব্রম্ভ্র-যজ্ঞ-ভূমি হিমালয় পর্বত হইতে আমি ঈশ্বরকে দেখিতে পাইলাম, চর্ম চক্ষুতে নয় কিন্তু জ্ঞ্যান চক্ষুতে।”

এই ভাবে এক বছর কেটে গেল। একদিন এক নদীর সেতুর উপর দাঁড়িয়ে তার স্রোতের গতি দেখে বিস্মিত হলেন। এর জল কেমন পবিত্র ও শীতল কিন্তু নদী যতোই নীচে নামতে থাকে ততই পৃথিবীর ক্লেদ ও আবর্জনা একে মলিন ও কলুষিত করে। আবার মনে হলো নীচে নেমেই তো নদী, ভূমিকে উর্বরা ও শস্যশালিনী করবার জন্য উদ্ধত ভাব পরিত্যাগ করে নিম্নগামিনী হয়।

হঠাৎ তিনি তাঁর অর্ন্তযামী পুরুষের গম্ভীর আদেশ শুনতে পেলেন, “তুমি এ উদ্ধত ভাব পরিত্যাগ করিয়া এই নদীর মত নিম্নগামী হও। তুমি এখানে যে সত্য লাভ করিলে, যে নির্ভর ও নিষ্ঠা শিক্ষা করিলে, যাও পৃথিবীতে গিয়া তাহা প্রচার কর।”

তিনি চমকিয়ে উঠলেন, তবে কি আমাকে এই পূর্ণভূমি হিমালয় থেকে ফিরে যেতে হবে। এতো কঠোরতা স্বীকার করে সংসার থেকে বেরিয়ে আসা, আবার কি সেই সংসারেই ফিরে যেতে হবে। মহর্ষির মন অবসাদে ভরে উঠলো, কিছুতেই মনে স্থিরতা আসছিল না। এরপর তিনি ঠিক করলেন ঈশ্বরের ইচ্ছায় সব, তিনি ফিরে যাবেন। এটা ভাবা মাত্রই মন শান্ত হয়ে গেল। নদী যেমন তার বেগমুখে পাথরের বাধা মানে না, তিনিও তেমনি আর কোন বাধা মানলেন না। ১লা কার্ত্তিক বিজয়া দশমীতে যাত্রার দিন ঠিক করলেন। তিনি ভাবলেন “বিজয়া দশমীতে আমার সিমলা হইতে বিসর্জন হইলো।”
ফেরার পথে শুনলেন দিল্লীর বাদশাহকে ব্রিটিশরা ধরে নিয়ে গেছে। সিমলাতে যাওয়ার সময় ওনাকে যমুনার চরে সুখে ঘুড়ি ওড়াতে দেখেছিলেন, আজ দেখলেন যে, ইনি বন্দী হয়ে কারাগারে। সত্যি, এই সংসারে কার ভাগ্যে কখন কি ঘটে, তা কে বলতে পারে?

হঠাৎ করে চোখের সামনে ঘটে যাওয়া এই জীবনদর্শন তাঁকে আরো ঈশ্বরের চিন্তায় মগ্ন করে তুললো। আত্মজীবনীতে তিনি এই পর্বতবাস সম্বন্ধে লিখেছেন “এই দুই বৎসরের পর্বত ভ্রমণে ঈশ্বর আমার শরীরকে আধিভৌতিক কত বিবাদ হইতে রক্ষা করিলেন, আমার মনকে ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা, বিবেক ও বৈরাগ্যের কত উচ্চ শিক্ষা দিলেন, ইহার জন্য কৃতজ্ঞতা আমার হৃদয়ে ধরিল না।”

তাই তো মহর্ষির এই জীবনদর্শন, তাঁর স্নেহের রবির এই গানের কথার মতোই যথাযথ-
“ঘরেও নহে, পারেও নহে
যে জন আছে মাঝখানে।”

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
সরকারি কর্মসুত্রে বীরভূমে বাস করেন।লেখালেখি নেশা এবং ভ্রমণ পাগল একজন মানুষ তিনি। কাজের অবসরে সাহিত্য রচনা, গান, সিনেমা, ঘোরাঘুরি নিয়েই ব্যস্ত থাকেন তিনি। আনন্দবাজার সহ অন্যান্য পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে বের হয়েছে।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!