গল্পকার অনীশ ব্যানার্জ্জী’র ছয়টি অণুগল্প

অনীশ ব্যানার্জ্জী
অনীশ ব্যানার্জ্জী
7 মিনিটে পড়ুন
সাময়িকী আর্কাইভ

মা বাবা

গভীর রাতে সে ঘুমাচ্ছে একাকী, মা বাবা অনেকদিন আগেই গত হয়েছেন। নিদ্রা এতখানি গভীর ছিল যে ভূমিকম্প শুরু হয়েছে কখন ঘুমের মধ্যে টেরই পায়নি সে। হঠাৎ একটা কাঁচ ভাঙার আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল তার। আলো জ্বেলে মশারি থেকে নেমে দেখে মৃত মা বাবার ছবিটা পড়ে ভেঙে গেছে। মাটিতে পা রাখতেই কম্পন অনুভব করতে পারে সে, বুঝল ভূমিকম্প শুরু হয়েছে এবার বাড়ি থেকে পালাতে হবে। বাবা মায়ের ছবিটা হাতে নিয়েই বেরোতে যাবে এমন হঠাৎ সিলিং ফ্যান খুলে পড়ল বিছানায়। অল্পের জন্য রক্ষা পেল সে, ভাগ্যিস ছবিটা ভাঙার শব্দে সে নেমে এসেছে নইলে ফ্যানটা তার উপরেই পড়ত। ছবির ভিতর থেকে আওয়াজ এল, “মরে গেলেও আমরা সবসময় তোর সাথেই আছি, এই ভাবেই সমস্ত বিপদ থেকে উদ্ধার করব তোকে।” সে কাঁদতে কাঁদতে অশ্রুজলে মা বাবার ছবিটা বুকে জড়িয়ে ধরল। সে অনুভব করল যে মা বাবার সত্যিই মৃত্যু নেই তাঁরা অমর।

ধর্মের ভিখারি

প্রতি বছরের ন্যায় এই বছরও দুর্গাপূজার আগে লড়ি লড়ি কাপড় বিলি করছেন এক সমাজসেবী। লাইন দিয়ে একে একে শাড়ি গ্রহন করছে সকলে, দুই স্ত্রীলোক শাড়ি নিয়ে ওখানেই খুলে ভালো করে দেখতে লাগলেন। সমাজসেবী বললেন, “ওরে চিন্তা করিস না, ওত দেখার দরকার নেই, ছেড়া কাটা নেই।”
একজন বলল, “মন্দিরের ছবি আছে নাকি দেখেনিচ্ছি, মন্দিরের ছবি থাকলে নামাজ পড়ব কেমন করে? আমি যে মুসলিম।”
আর একজন বলল, “আমিও দেখছি ৭৮৬ বা মসজিদের ছবি আছে নাকি, আমি হিন্দু বাবু।”
বাবু মনে মনে ভাবলেন অভাব সব ভুলিয়ে দিয়েছে কিন্তু ধর্মকে ভোলাতে পারেনি।
বাবু একরাশ ক্ষোভ নিয়ে বললেন, “তা লজ্জা নিবারন আগে না ধর্ম আগে?”
মুসলিম বলল, “অবশ্যই ধর্ম আগে“
বাবু বললেন, “তা ধর্ম তোদের অন্নবস্ত্র দেবে তো?”
হিন্দু বলল, “শাড়ি দিচ্ছেন দিন বাবু জ্ঞান দেবেন না দয়া করে”

সেরা কর্মী

অফিসে হঠাৎ সেই বিভাগের মন্ত্রী পর্যবেক্ষনে এসেছে। সবাই চাইছে একটা সেলফি তুলতে। একজন কর্মী সবার সাথে মন্ত্রীর সুন্দর ছবি তুলে দিচ্ছে নিজস্বীর আর প্রয়োজন হচ্ছেনা। সবার শেষে একজন বলল, “আপনার সাথে তো ছবি হলনা”
“দরকার নেই। আমার কাছে সব মানুষই সমান”
মন্ত্রীমশাই বললেন, “আমার সাথে সাধারনের কোন তফাৎ নেই তাহলে?”
“শুধু একজায়গায় আছে। আপনার আদেশ আমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে পারি বাকিদের নয়”
“আপত্তি না থাকলে আমি আপনার সাথে একটা নিজস্বী তুলতে পারি” মন্ত্রী বললেন
কর্মী অবাক হয়ে বলল, “আমার সাথে?”
“হ্যাঁ আমি অনেক অফিস ঘুরলাম সেরা কর্মী খুঁজতে সেই খোঁজা আমার শেষ হল এইমাত্র। আপনিই সেই ব্যক্তি।”

কেউ কম নয়

শিক্ষকের তিন ছাত্র শ্যাম যদু আর মধু। শ্যাম বরাবরই মেধাবী আজ সে চিকিৎসক, যদু মধ্য মেধাসম্পন্ন আজ গ্রূপ ডি চাকুরী করছে আর নিম্ন মেধাসম্পন্ন মধু এখন গাড়ি চালায়। শিক্ষক মহাশয় সব থেকে বেশি ভালোবাসেন শ্যামের মতো ছাত্রদের কারণ তারাই তাঁর মুখ রেখেছেন, বাকিদের তেমন গ্রাহ্য করেননা। একদিন শিক্ষক মহাশয়ের পাশের বাড়ির ভদ্রলোক মধুর গাড়িটা ভাড়া করেছেন, মধু গেছে যথারীতি। সে গাড়িটা দাঁড় করিয়ে ভাবল, “ওদের তৈরি হতে হতে একবার স্যারের সঙ্গে দেখা করে আসি। এত কাছে এলাম যখন।” যেমনি ভাবা তেমনি কাজ, সে গেল শিক্ষক মহাশয়ের বাড়িতে। স্যার হাসিমুখে তাকে ভিতরে আসতে বললেন কিন্তু মনে মনে বিরক্তির ভাব। কেমন আছে না আছে একে অপরের সঙ্গে সেইসব বাক্য বিনিময় হয়, মধু জানায় পাশের বাড়ির লোক তার গাড়িটা ভাড়া নিয়েছেন। হঠাৎ সেইসময় শিক্ষক মহাশয়ের হার্ট অ্যাটাক হল, চেয়ারে বসে চেতনা হারালেন তিনি।
জ্ঞান ফিরলে তিনি চোখ মেলে দেখেন তিনি হাসপাতালে শুয়ে আছেন, তাঁর কেবিনে শ্যাম যদু আর মধু।
তাঁর স্ত্রী বললেন, “শ্যাম তোমার হার্টের অপারেশন করেছে। যদু তোমাকে রক্ত দিয়েছে আর মধু গাড়ি করে এনে এখানে ভর্তি করেছে।”
শিক্ষক বললেন, “আমার আর যদুর একই গ্রূপ বুঝি?”
যদু বলল, “হ্যাঁ স্যার, মধু জানত। আপনার রক্ত লাগবে শুনেই ফোন করে আমাকে। আমি তৎক্ষণাৎ চলে আসি”
“তা মধু তুই কী করে জানলি ওর আর আমার ব্লাডগ্রূপ এক?”
মধু বলল, “স্যার আপনিই বলেছিলেন, সংবহন পড়ানোর সময়। ব্লাড গ্রূপ বোঝানোর পর কার কী গ্রুপ সেটা সবাইকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন। যদুর উত্তর শুনে আপনিই বলেছিলেন আপনাদের একই গ্রুপ”
স্যার হেসে বললেন, “এখনও মনে রেখেছিস? কতদিন আগে পড়িয়েছি তোদের।”
শিক্ষক মহাশয়ের স্ত্রী বললেন, “আমার ছেলে বউমা বেড়াতে গেছে। তোমরা যদি না থাকতে, কি যে হত”
শ্যাম বলল, “আর চিন্তা করবেননা, বিপদ কেটে গেছে। আমি হাসপাতালে বলে দিয়েছি আপনার কোন টাকা লাগবেনা। স্যার সুস্থ হয়ে উঠুবেন খুব তাড়াতাড়ি”
স্যারের চোখ দিয়ে নেমে এল অশ্রুধারা মনে মনে বললেন, “ছাত্রের মেধা যেমনই হোক মানবতাই আসল, সবাই শিক্ষকদের সন্তানসম। শিক্ষকের কাছে কেউ কম নয়।”
এরপর শিক্ষক মহাশয় সব প্রাক্তন ছাত্রকেই সমান চোখে দেখতেন, কেউ বাড়ি এলে বিরক্ত হতেননা।

পূর্ণচন্দ্র

এক অভুক্ত ভিখারি খাবারের খোঁজে ঘুড়তে অবশেষে দেখে এক মন্দিরে তার মতো অনেক অভুক্তকে খাওয়ানো হচ্ছে। সেখানে গেলে তাকেও খেতে দেয়া হয় সে অনেকদিন পর তৃপ্তি করে পেট ভরে খায়। পরদিন গিয়ে দেখে কেউ নেই সেখানে, খাবার চাইলে পুরোহিত বলেন, “আবার পূর্ণিমার পূজায় খাওয়ানো হবে।”
“পূর্ণিমা কবে আসবে?” সে জিজ্ঞাসা করে
“ওই যে চাঁদটা দেখছিস, ছোট হতে হতে একসময় মিলিয়ে যাবে। তারপর আবার যখন বড় হয়ে গোল থালার মতো হবে তখনই পূর্ণিমা। প্রত্যেক পূর্ণিমার পূজায় খাওয়ানো হয় এখানে” পুরোহিত উত্তর দেয়।
অভুক্ত পেট নিয়ে সে এটা ওটা খেয়ে বেড়ায়, কোনদিন পেট ভরে আবার কোনদিন আধপেটা। রোজ সে আকাশের দিকে তাকিয়ে চাঁদ দেখে, অবশেষে গোল থালার মতো চাঁদ দেখে মন্দিরে যায়। মন্দিরে গিয়ে খাবার চাইলে পুরোহিত বলে, “আজ চতুর্দশী, এখনও পূর্ণিমা পড়েনি। কাল পূজা হবে চলে আসিস।” হতাশ হয়ে সে ফিরে আসে আর ভাবে রোজ কেন পূর্ণচন্দ্র ওঠেনা? তাহলে তার পেটটা অন্তত পূর্ণ থাকে।

তিলে তিলে গড়া

দরিদ্র রতন আর বড়লোক খুব শ্যামল ভালো বন্ধু। কলেজ জীবন শেষ করে রতন চাকরি পেয়ে নতুন বাইক কিনেছে। শ্যামলকে বলেছে গাড়িটা চালিয়ে গ্রামের বাড়ি দিয়ে আসতে রতন পিছনে বসে যাবে। গ্রামের বাড়ি পৌঁছাতেই সবাই বেরিয়ে এল গাড়ির শব্দে। গ্রামের গরীব মানুষের মুখের হাসি যেন এক নির্মল আনন্দের বহিঃপ্রকাশ। শ্যামল অবাক হয়ে ভাবল সামান্য একটা বাইক কিনেছে তাতে এত আনন্দ। পরে বুঝল রতন তিলে তিলে সব গড়ছে আর সে সব না চাইতেই পেয়েছে। সব পেয়েছির দেশে কোন আনন্দ নেই আছে তিলে তিলে গড়ার মধ্যে।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
অনীশ ব্যানার্জ্জী, বাড়ি বর্ধমান। পেশায় ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার কিন্তু লেখালেখি তার নেশা। মাত্র সাত বছর বয়সে লেখালেখির শুরু। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় একটু বেশিই টানেন তাকে কারণ শরৎচন্দ্রের লেখা সহজ সরল অথচ বাস্তবসম্মত। সাহিত্যে জ্ঞান কম তাই সহজ ভাষাতেই লিখতে হয়, যা ভাবনা তাই ফুটে ওঠে কলমে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত তার লেখা প্রশংসিত হয়েছেন এবং সম্মাননা পেয়েছেন।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!