‘ঘোড়েল’ পর্ব – তিন

মুসা আলি
মুসা আলি
25 মিনিটে পড়ুন

আমমানুষ রায়বাবুর রাজনৈতিক জীবনের গণদেবতা, তাদের জোরালো সমর্থন আছে বলেই সুবিমল স্থানীয় রাজনীতির আসরে নিজেকে এত বেশি সচল ব্যক্তিত্ব হিসেবে তুলে ধরতে পেরেছেন। তাদের প্রয়োজনে সুবিমলকে থানায়ও যেতে হল। ওসিকে শাসিয়ে বললেন, আপনি না পারলে আমাকে বলুন, রাজনৈতিক শক্তি দিয়ে মোকাবিলা করব। আমরা প্রশাসনে থাকব আর এভাবে শৃঙ্খলাভঙ্গের দৃষ্টান্ত দুবেলা ঘটবে, মেনে নেওয়া যায় না।
প্রিন্সিপাল দেবেশ রায় খুব আশা করেছিলেন দ্বিতীয় দিনের শুরু থেকেই সুবিমল রায় মাঠে থাকবেন কিন্তু সূচনাপর্বে দেখতে না পেয়ে বললেন, আর দেরি করা চলে না। ঘোষক লৌহবল নিক্ষেপ প্রতিযোগিতার কথা জানিয়ে দিল। গতবছর সুচরিতা এই ইভেন্টে প্রথম হয়েছিল, মালবিকা ছিল দ্বিতীয় স্থানে। দ্বিতীয়বর্ষের ছাত্রছাত্রীরা গলা ফাটানো চিৎকারে জানিয়ে দিল, মালবিকাই জিতবে। হারের বদলা নিতে পারবে সে।
মালবিকা বল ছুড়ে দিতেই চারিদিকে চড়চড় করে হাততালি পড়ল। বিশেষ দুর্ভাবনায় দুলতে লাগল প্রদীপ। তাহলে সুচরিতা লৌহবল নিক্ষেপে এবছর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হারবে? নাহলে দ্বিতীয় বর্ষের ওরা এত জোর দিয়ে বলতে পারত না।
তবুও একটা গোপন দুরাশা সমুদ্রের জলের উপর হঠাৎ লাফিয়ে ওঠা ডলফিন মাছের মতো প্রদীপের মনের নদীতে ভেসে থাকল নিজস্ব অবস্থান নিয়ে। না জিততে পারলে সুচরিতা যে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার দৌড়ে অনেকখানি পিছিয়ে যাবে, এ নিয়ে প্রদীপের মনে কোনো সংশয় থাকল না। সুচরিতা নিজেও সেই ভাবনায় দুলছিল। প্রদীপ গর্জে ডঠল, সর্ব শক্তি দিয়ে….।
কম্পিত সুচরিতা একবার আড়চোখে প্রদীপকে দেখে নিল। মাইকে একটু পরে ঘোষণা হল, যথাসাধ্য চেষ্টা করেও সুচরিতা মালবিকার সীমা অতিক্রম করতে পারল না। প্রদীপের মুখে বিমূঢ়তার ছবি, হতাশার আগুন। মালবিকার চেয়ে এত পিছনে কেন? প্রশ্ন জাগল মনে। আবার দ্বিতীয় বারের জন্যে লৌহবল নিক্ষেপ শুরু হল কিন্তু মালবিকা নিজের গড়া সীমা টপকাতে পারল না। পিছন থেকে প্রদীপের গজর্ন, একেবারে বেদম হয়ে পড়েছে, এই সুযোগ।
সুচরিতা নতুন শক্তি পেল, ভিতরের ইচ্ছা কয়েকগুণ বেড়ে গেল, সজোরে বল ছুঁড়ে দিল। তৃতীয় বর্ষের ছাত্রছাত্রীরা হাততালি দিয়ে উৎসাহিত করল। মালবিকার সীমা সুচরিতা স্পর্শ করতে পেরেছে। প্রবল উত্তেজনায় হাততালির মজা ছিল সেখানেই। সেই অদ্ভুত কানাকানির সম্পর্ক ছড়িয়ে পড়ল সারা মাঠে। শেষ পর্যন্ত কে জিতবে, তা তৃতীয় বারের বল নিক্ষেপে নির্ধারিত হবে। তবুও দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে উদ্দীপনার অভাব ছিল না। তাদের স্থির বিশ্বাস, শেষ পর্যন্ত মালবিকাই জিতবে।
একটু পরে সুচরিতার পালা ঘুরে এল। শেষতম সুযোগ। না পারলে তাকে ছিটকে যেতেই হবে। প্রদীপ সজোরে গলা ফাটালো। বিমূঢ় জয় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবতে বাধ্য হল, গুরু থাকলে প্রদীপ এভাবে হ্যাংলামি করতে পারত না। মনের তলানিতে অসহ্য ছটপটানি, প্রদীপ যেন জোর করে তার অধিকার হাতিয়ে নিতে চাচ্ছে।
সুচরিতা সজোরে বল ছুঁড়ে দিল এবং তা মালবিকার সীমা ছাড়িয়ে গেল। প্রদীপ ছুটে গিয়ে দাঁড়ালো সুচরিতার সামনে। খুব ইচ্ছা করছিল হ্যাণ্ডসেক করতে কিন্তু তা পারল না জয়কে দেখতে পেয়ে। মুখ উঁচু করে একবার চারদিক দেখে নিল। সুবিমলকে দেখে তার মধ্যে একটা অচেনা ভয় ঢুকে পড়েছে। লোকটা বড়ো ভীষণ প্রকৃতির। এত রাশভারী যে তাঁর নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়া কোনোক্রমেই সম্ভব নয়।
সুচরিতা পায়ে পায়ে মাঠের দক্ষিণ পাশে গিয়ে ঝাউগাছের ছায়ায় দাঁড়ালো। প্রদীপ তার সামনে দাঁড়িয়ে। সেই প্রথম সুচরির সঙ্গে হ্যাণ্ডসেক করার জন্যে প্রদীপের শরীরে অন্তহীন শিহরণ কিন্তু আড়ষ্টতার সমুদ্রে ডুবতে ডুবতে তা অথই জলে হারিয়ে গেল।
জয় অদূরে দাঁড়িয়ে ছিল, তার মনে কত কথার ফুলঝুরি।
প্রদীপ ডান হাত শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে বলল, কোনো অজুহাত নয়, লং-জাম্পেও জিততে হবে তোমাকে।
ভুলে যেও না মালবিকা ওই ইভেন্টেও নাম দিয়েছে।
তাতে অসুবিধা কোথায়?
গত বছর ও দ্বিতীয় স্থানে ছিল বলেই এ বছর জেতার জন্যে যথেষ্ট অনুশীলন করেছে।
তবুও তুমি পারবে।
মালবিকা খুব স্পিডি।
তুমি কম কিসে?
তোমার কল্পনার তারিফ করতে হয়।
আগের দুটো ইভেন্টে আমার কথা মিলে গেছে।
সুচরিতা গম্ভীর হল নীল আকাশের দিকে এক পলক চোখ রেখে, নতুন করে উদ্দীপ্ত হল। উৎসাহ মানুষের জীবনে বরফগলা জলের মতো। উত্তেজনার সেই কলকলে স্রোত সুচরির মধ্যে। মনে মনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হল, তাকে জিততেই হবে।
মাইকে আবার ঘোষণা হল, বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার সবচেয়ে আকর্ষণীয় ইভেন্ট লং-জাম্প শুরু হতে চলেছে।
এখানেও সুচরিতার মূল প্রতিদ্বন্দী মালবিকা। জিততে পারলে সুচরিতার পক্ষে চ্যাম্পিয়ন হয়ে যাওয়া সহজ হবে, না পারলে কে চ্যাম্পিয়ন হবে, এখনই বলা যাচ্ছে না। অনেক সূক্ষ্ম অঙ্ক অপেক্ষা করে আছে সেই পর্যায়ে।
সমর্থকদের চড়চড় হাততালিতে আসর জমে উঠল।
মাইকে ডাক পড়ল প্রদীপের, প্রিন্সিপালের নিজস্ব তাগিদ। আধদৌড়ে অফিসের দিকে যেতে যেতে মুখ ঘুরিয়ে ঢিল ছোঁড়ার মতো করে বলল, আমার হিসেব মিলিয়ে নিও সুচরিতা, লং-জাম্পেও তুমিই ফার্স্ট হবে।
সুচরিতা ফিক করে হেসে ফেলল। পাগল ছেলে কোথাকার, তার জয়লাভ নিয়ে মত্ততা দেখানোর মেগা হিরো। কেন যে এত উদ্যোগী, তা ভেবে পেল না।
প্রিন্সিপালের ঘরে ঢুকে প্রদীপ দেখল, গম্ভীর মুখে সুবিমল রায় চেয়ারে বসে আছেন, পাশে জয়শংকর, কানের পাশে মুখ নিয়ে কী বিষ ঢালছে কে জানে!
তালে তালে মাথা নাড়ছেন রায়বাবু। প্রদীপকে দেখেই প্রিন্সিপাল খুশি হয়ে বললেন, খেলার ব্যস্ততার মধ্যেও তোমাকে ডাকতে হল।
কী করতে হবে বলুন স্যার।
স্টেশনের পাশে মিষ্টি দোকানে টিফিনের প্যাকেটগুলো রেডি হয়ে আছে। ওগুলো নিয়ে আসতে হবে, একটা ভ্যান নিয়ে যাও।
তাহলে আসছি স্যার, প্রবীর আর ইকবালকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছি।
আনা হয়ে গেলে খবরটা দিয়ে যেও, টেনশনমুক্ত হতে পারব।
তাই হবে স্যার।
সুবিমল প্রদীপের পিছনে পিছনে ঘর থেকে বের হয়ে বেশ রাসভ স্বরে ধমকে দিয়ে বললেন, এ্যাই ছেলে শোনো।
বলুন স্যার, বলেই ঘুরে দাঁড়ালো প্রদীপ।
এভাবে আমার নির্দেশ অমান্য করছ কেন?
আমি তো কিছুই করি নি।
সুচরিতাকে এভাবে ডিসটার্ব করছ কেন?
কেবল উৎসাহ দিয়েছি।
কে তোমাকে এসব করতে বলেছে?
নিজের বিবেক নিয়ে ক্লাসমেটকে সমর্থন করেছি।
দাঁতে দাঁত রেখে রায়বাবু চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, আমাকে ঠিকমতো চেনো না বাছাধন, একেবারে ঠান্ডা করে দেব।
স্যার, কলেজ মাঠে এভাবে গুণ্ডামি করবেন না।
সুবিমলের রাসভ তম্বি, ভুলে যেও না খোকা, সুচরি আমার এলাকার মেয়ে, ওর ভালোমন্দ নিয়ে আমাকেই ভাবতে হবে। চ্যাম্পিয়ন হতে না পারলে এমন টানাহ্যাঁচড়া করব যে সারা জীবন ভুলতে পারবে না।
প্রসঙ্গটা প্রদীপের মাথায় বিদ্যুতের মতো ঢুকল কিন্তু তৎক্ষণাৎ তা বের হয়ে গেল। দুই বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে সামনে চলতে চলতে মুখ ঘুরিয়ে বলল, শরীরের টানে শিক্ষিত মানুষরা যে কীভাবে উগ্র হতে পারে, তা আপনাকে দেখে বুঝতে পারছি।
সুবিমল রায় রাগে কাঁপতে লাগলেন। প্রদীপ হনহন পায়ে বন্ধুদের নিয়ে এগিয়ে চলল। টিফিনের প্যাকেটগুলো নিয়ে ফিরল প্রায় আধঘন্টা পরে, ঘরে ঢুকে প্রিন্সিপালকে জানিয়ে দিতে গিয়ে বলল, স্যার, কাজ সারা হয়ে গেছে, মাঠে যাচ্ছি।
দেবেশ রায় একটু হাসলেন, ভালো করেই জানেন, প্রদীপের মতো ছেলে এ কলেজে একটাও নেই। সামাজিক বোধ এত বেশি যে কখন কীভাবে মানিয়ে নিতে হবে, তা বেশ বোঝে।
সুবিমল রায় জয়কে নির্দেশ দিলেন মাঠে উপস্থিত থেকে প্রদীপের উপর কড়া নজর রাখতে। বললেন, বেশি বাঁদরামি করলে আমাকে খবর দিবি। প্রয়োজন হলে আজকেই টিট করে দেব। অলরেডি ওসিকে ইনফর্ম করে দিয়েছি। তেমন হলে এ্যারেস্ট করিয়ে দেব, অবশ্য কলেজ চত্বরের ভিতরে এমন ঘটনায় ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হতে পারে। ওসি বলেছেন, ফেরার পথে স্টেশনের কাছেই। শুধু চিনিয়ে দিলেই হল, পারবি সেই দায়িত্বটুকু সামলে নিতে?
মালবিকার প্রথম হওয়া নিয়ে তখনও মাঠের মধ্যে হুল্লোড়বাজি চলছে।
দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রছাত্রীরা তার সমর্থনে হো হো শব্দে চীৎকার করে উঠল। রমেন চেঁচিয়ে উৎসাহ যোগালো, সুচরিকে ডাস্টবিনে ফেলে দে।
ছেলের হাতের মোয়া নাকি? প্রদীপের টিপ্পনি।
গত বছরের মতো এবারেও মালবিকা টেক্কা দেবেই।
শুধু কথায় ছক্কা মারা যায় না।
একটু পরেই তা প্রমাণ হয়ে যাবে।
ফিঙের দল এতক্ষণ ছিল কোথায়?
রাগে গরগর করে উঠল রমেন, এভাবে অপমান করলে ছেড়ে কথা বলব না।
তাহলে কী অন্য কিছু বলতে হবে?
আমিও মুখ খুলতে পারি।
বাদুড় বললেই কী বেশি খুশি হবি?
প্রতিবাদে গর্জে উঠল রমেন, এভাবে দাদাগিরি দেখালে কপালে দুঃখ আছে। খবর পেয়ে সুবিমল রায় দ্রুত পায়ে রমেনের পিছনে এসে দাঁড়ালেন। —এ্যাই ছেলে, এভাবে বিতর্ক করছ কেন?
দেখুন না স্যার, প্রদীপ কী বাজে বাজে কথা বলছে?
কী রকম?
আমরা নাকি ফিঙের দল।
আর কী বলেছে?
একটু আগে বাদুড় বলেছে।
ও তো নিজেই বাদুড়, মন্তব্য করে সুবিমল গম্ভীর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন। রমেনের প্রশ্ন, এভাবে বলছেন কেন স্যার?
দেখছিস না, একটা মেয়ের শরীরে ভর করে কীভাবে ঝুলে রয়েছে।
দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রছাত্রীরা হো হো করে ডঠল সুবিমলের সমর্থনে। কলেজ মাঠে এভাবে মন্তব্য করা যে ঠিক নয়, সুবিমল শুধু তা বেমালুম ভুলে গেলেন না, পায়ে পায়ে প্রদীপের সামনে গিয়ে চাপা হুমকির স্বরে বললেন, নিজেকে কেষ্ট বিষ্টু ভাবছিস নাকি? পরিণাম কত খারাপ হতে পারে জানিস?
না মানে….
আবার মানে মানে করছিস? ওরাও তোর মতো কলেজে পড়ে, ওদের বাদুড় বলেছিস কেন?
সুচরিতার জয়লাভ চায় না বলেই।
তুই একা সুচরিতাকে জেতাতে কনট্রাক্ট নিয়েছিস নাকি?
ওরা শুধু মালবিকাকে….
সে স্বাধীনতা ওদের আছে, ক্লাসমেট বলে কথা, মালবিকার পিছনে ওদের সমর্থন থাকতেই পারে।
না মানে ওরা গলা চড়িয়ে সুচরিতাকে দুর্বল করে দিতে চাচ্ছে।
বুঝেছি বাছাধন, এভাবে শুধু শুধু কল্পনায় ভাসছিস? বাবা কী করেন?
চাষের কাজ করতেন।
মানে?
বাবাকে ছোটোবেলায় হারিয়েছি।
এখনও কিছু জমিজমা আছে?
বিঘে দুই।
তাতেই এত মাস্তানি? আর একটা কথা বললে থাবড়ে ঠান্ডা করে দেব।
রমেনকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তোমরা একটু দায়িত্ব নাও। মাঠের মধ্যে বাদুড়টা যাতে কোনোরকম ডিসটার্ব করতে না পারে, সেদিকে নজর রাখো। বাড়াবাড়ি করলে আমাকে খবর দেবে, প্রিন্সিপালের ঘরে বসে আছি। তখন বাছাধন বুঝবে, কত ধানে কত চাল।
আপনি বলছেন যখন।
সুবিমল প্রিন্সিপালের ঘরের দিকে হেঁটে চললেন। সঙ্গে জয়শংকর। একবার থমকে দাঁড়িয়ে বললেন, বাঁদরটাকে ঠান্ডা করতে একটু জোর খাটাতে হল রে।
খুব খুশি হয়েছি গুরু।
তুই এক কাজ কর, মাঠের ভিতরে থেকে যা, সুচরিকে দুপলক দেখতে পাবি। একেবারে বেগতিক দেখলে আমাকে খবর দিস, শেষ হিসেবটা ভালো করে বুঝিয়ে দেব।
জয় ফিরে চলল মাঠের দিকে। সুবিমল পায়ে পায়ে এগিয়ে চললেন। দ্বিতীয় ইভেন্ট শেষ হবার পরে সুচরিতা কখন এসে প্রিন্সিপালের রুমের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল তাঁকে অভিনন্দন জানাতে, সুবিমল তা জানতেই পারেন নি। পাশ থেকে যাবার সময় সুবিমলের খুব ইচ্ছা করছিল দুপাটি দাঁতের ফাঁকে একটু মিষ্টি হাসি উপহার দিতে কিন্তু জয় পাছে দেখে ফেলে, সেই ভয়ে তা সম্ভব হল না। রাজনীতির মানুষ, খুব সাবধানে চলতে হয়, সব দিক ম্যানেজ না করলে নয়। জয়শংকর একনম্বর সাকরেদ। অনেক দিন আঠার মতো লেগে রয়েছে। রাজনীতির মতাদর্শকে যত না ভালোবাসে, তার চেয়ে অনেক বেশি শ্রদ্ধা তাঁর প্রতি। দাদা বলতেই অজ্ঞান। অনুসরণে অন্ধত্বের কথা ভেবে সুবিমল একবার চমকে উঠলেন। প্রিন্সিপালের ঘরে ঢুকে ঢকঢক শব্দে জল খেয়ে চেয়ারে বসে পড়লেন। দুচোখ বুজিয়ে গতকালের অবাঞ্ছিত ঘটনার কথা স্মরণ করতেই ভিতরের ধুকপুকুনি দ্বিগুণ হয়ে উঠল। সেইসঙ্গে একটা কল্পিত প্রসঙ্গ, সন্ধেয় প্রাইজ বিতরণের সময় আবার ব্লাকআউট হবে নাতো? নিশ্চয় তাঁর হাত দিয়েই প্রিন্সিপাল সুচরিতার হাতে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি তুলে দিতে চাইবেন।
একটা ইভেন্ট বাকি থাকতেই সুবিমল সুচরির চ্যাম্পিয়ন হওয়া নিয়ে প্রায় নিশ্চিত হয়ে গেলেন। শরীর মনের শিহরণে দুলে উঠছেন বার বার। গত বছর স্ত্রী বিয়োগের পর থেকে নিজের শরীরকে আর ঠিকমতো নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছেন না। কতই বা বয়স হয়েছে তাঁর। সবে মাত্র পঞ্চাশ। মাথার চুলে কলপ দিলে দিব্যি যুবক যুবক লাগে। পাশ্চাত্য দেশে এই বয়সে অনেকেই প্রথম বিয়ের পিঁড়িতে বসেন অথচ উপায় নেই বলেই তাঁকে শরীরের যন্ত্রণা তিলে তিলে সহে নিতে হচ্ছে। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমল সুবিমলের মুখের বলিরেখায়, দুঠোঁটের ফাঁকে এক চিলতে হাসি, চোখের তারায় ভেসে থাকল সুচরিতার সর্বাঙ্গ, ভারি তন্বি সুন্দরী। ক্যানসার রোগের তীব্র যন্ত্রণার মতো সুবিমল ভিতরে ভিতরে ভয়ানক ছটপট করতে লাগলেন।
মাইকে ঘোষণা হল, বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার শেষ ইভেন্ট শুরু হতে চলেছে, জিতলে সুচিরতা চ্যাম্পিয়ন হয়ে যাবে, না জিতলে কার ভাগ্যে সেই সম্মান জুটবে, অনেক জটিল অঙ্কের উপর তা নির্ভর করছে। শুনতে শুনতে সুবিমল মনের গহ্বর থেকে কঠোর বাস্তবে নামলেন। খুব ইচ্ছা করছিল শর্ট প্যান্ট পড়া সুচরিতাকে একবার দুচোখ ভরে দেখে নিতে কিন্তু জয়ের ভয়ে তা সম্ভব হল না। সেই বাধা দৈর্ঘ্যে প্রস্থে কত দীর্ঘ, তা ভালো করেই জানেন সুবিমল, তবুও ভিতরের টানে বার বার দুলতে লাগলেন, উদ্বেগে অস্থির হলেন কিন্তু মাঠে গিয়ে সুচরিকে এক পলক দেখার কোনো অবস্থান খুঁজে পেলেন না।
প্রদীপ আরও বেপরোয়া। দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র রমেনও ছাড়ার পাত্র নয়। সমানতালে প্রদীপের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ল। চাপা স্বরে প্রদীপের উৎসাহ, কোনো ভয় নেই সুচরিতা।
রমেনের হুঙ্কার, মালবিকাই জিতবে।
ইভেন্ট শুরুর বাঁশি বেজে উঠল। প্রদীপ আবার চেঁচালো, সুচরিতাকে কেউ হারাতে পারবে না।
মালবিকার কাছে হারবেই।
দুটো ইভেন্টে হারার পরেও দুঃস্বপ্ন গেল না দেখছি।
সুবিমলবাবুকে কী আবার ডাকতে হবে?
কে সুবিমল, কলেজের কেউ নন।
গতকালের ধমক আজকেই ভুলে গেলে?
আমি সুবিমলকে চিনি না।
সুবিমলবাবু কী করতে পারেন, তা তোমার ভালোই জানা আছে।
সুবিমলের ফালতু সমাচার জেনে লাভ কী?
জয় বুঝল, অবস্থা গুরুতর হয়ে উঠেছে, গুরুকে না ডাকলে নয়। ছুটল প্রিন্সিপালের ঘরের দিকে। সুবিমল উন্মুখ হয়ে বসেছিলেন, জয়কে দৌড়ে আসতে দেখে উঠে দাঁড়ালেন, খবর কী রে?
প্রদীপ আবার বাড়াবাড়ি শুরু করেছে।
কী করে বুঝলি?
সকলের সামনেই বলল, কে সুবিমল, ওকে আমি চিনি না।
এত বড়ো স্পর্ধা?
তাই বাধ্য হয়ে আসতে হল।
সুবিমল রাগে উন্মত্ত হয়ে হন্ হন্ পায়ে মাঠের দিকে এগিয়ে চললেন। আবার রমেনের হুঙ্কার, জোরে লাফ দে, সুচরি ছিটকে যাক।
প্রদীপ আর কোনো মন্তব্য করল না, একবার আড়চোখে রমেনকে দেখে নিল। একটা তুচ্ছ তুলনা মাথায় এলেও তা গলায় আটকে থাকল। তাৎক্ষণিক ফলাফলের অনিশ্চয়তা নিয়ে কেমন যেন বিড়ম্বিত। মালবিকা সজোরে লাফ দিল। হাততালির ফোয়ারা ছুটল দ্বিতীয়বর্ষের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে। স্বয়ং রেফারি উৎফুল্ল হয়ে বললেন, বাহ্! বেশ।
সুচরিতা আবেগে দুলতে লাগল। অন্য প্রতিযোগীদের পালা পর পর এল, তারাও লাফ দিল কিন্তু তা নিয়ে বেশি কৌতুহল ছিল না। সুচরিতা শেষ প্রতিযোগী, প্রদীপের মনে দোলাচলের ছায়া। তাহলে কী সুচরি এই ইভেন্টে প্রথম হতে পারবে না? পরাজয়ের ধূসর ছায়া প্রদীপের মনের পটে মন্দগতির বলের মতো গড়িয়ে গড়িয়ে এগিয়ে চলেছে। সুবিমল চোখ রাঙিয়ে বললেন, এভাবে বেলাল্লাপনা করছিস কেন?
আপনি কে?
রাগে সুবিমলের মুখ লাল হয়ে উঠল। —তাহলে কী চরম ব্যবস্থা নিতে হবে?
আপনি ব্যবস্থা নেওয়ার কে শুনি? এটা কলেজ মাঠ, বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা চলছে, সুচরি আমার ক্লাসমেট। তাকে উৎসাহিত করতেই পারি। তা নিয়ে আপনার মাথাব্যথা কেন? বাড়িতে বৌদি নেই বুঝি?
চমকে উঠলেন সুবিমল। ছেলেটা এত বেপরোয়া? এভাবেই তাঁকে আঁতে ঘা দিয়ে কথা বলতে পারল? এত সাহস পাচ্ছে কোত্থেকে? পিছনে প্রিন্সিপাল নেই তো? আগেই শুনেছিলেন, প্রদীপ প্রিন্সিপালের প্রিয় ছাত্র। খেলার মাঠে যে খুব বেশি কঠোর মনোভাব নেওয়া যায় না, সেই যুক্তি মাথার ভিতরে বিদ্যুতের মতো খেলে যাচ্ছে। চাপা স্বরে শেষ সতর্ক বার্তা, তাহলে আমার কথা শুনবি না?
কলেজে প্রিন্সিপাল শেষ কথা।
খুব বেড়ে গিয়েছিস রে।
রাজনীতি করতে এখানে এসেছেন কেন?
আবার চমকে উঠলেন সুবিমল। প্রদীপ যেন তাক করে তাঁর অনুভূতির মৌচাকে ঢিল ছুঁড়ে দিল। ছেলেটা এ সূত্র ধরে ফেলল কী করে? আর বিতর্কে জড়াতে চাইলেন না। একটা গূঢ় সন্দেহ তৈরি হল তাঁর মধ্যে। গতকাল প্রাইজ বিতরণের সময় সুচরির হাতের উপর তাঁর হাতের আঙুল চেপে বসার দৃশ্য দেখে ফেলে নি তো? প্রদীপ তখন কোথায় দাঁড়িয়েছিল, তা একবার মনে করার চেষ্টা করলেন। নতুন ধন্দ তৈরি হল মনের গভীরে। এ যা ছেলে, জানতে পারলে সময় সুযোগ বুঝে ব্যাপারটা রাষ্ট্র করে দিতে পারে। সুবিমলের ভিতরে অভিনব কলকলানি। আরেকটু সামনে সরে গিয়ে ডাকলেন, এই জয়, শুনছিস্?
গুরু, সুচরি শর্ট প্যান্ট পরে লং-জাম্পে নামছে।
তাতেই মজে গেলি?
চোখের দেখা দারুণ মজা।
কবি হয়ে গেলি নাকি?
সুচরির দুই উরুতে পড়ন্ত সূর্যের ঝলমলানি, তাতেই নিজেকে কবি কবি লাগছে।
সুবিমল না হেসে পারলেন না, জয়ের মাথায় নতুন প্রশ্ন এসে খেলা শুরু করল। গতকাল গুরু তো প্রদীপকে বেশ ধমকে দিতে পেরেছিলেন, আজকে সেইমূর্তিতে দেখা গেল না। পিছনে কী কারণ থাকতে পারে, তা ভেবে খুঁজে পেল না জয়, বরং দুচোখের সামনে দেখল, প্রদীপের উগ্র মেজাজে গুরু কেমন যেন বিমূঢ় হয়ে পড়লেন। অন্য কোনো রহস্য নেই তো? কাটাছেঁড়া শুরু হল জয়ের মধ্যে। প্রদীপ রাজনীতির প্রসঙ্গ তুলতেই সুবিমল আরও মুসড়ে গেলেন। কথাটা যেন কানে তুলতে চাইলেন না। গুরুর ভিতরের ডোজ খোঁজার চেষ্টায় জয় ছটপট করতে লাগল। অন্বেষণের চরকিঘুরণ শুরু হয়ে গেছে জয়ের মধ্যে। সুবিমল আর একটু সামনে সরে এসে বললেন, চুপ করে গেলুম কেন জানিস?
সেটাই নিয়ে ভাবছি।
রাজনীতি করিস, এ ভাবনা স্বাভাবিক। মূল বিষয়টা অনেক দূরের রে। কলেজ মাঠ, বেশি কিছু করতে গেলে সব হিসেব উল্টেপাল্টে যেতে পারে। সেই পথে যাওয়া ঠিক হবে না।
গতকাল তো বেশ ধমকে দিতে পেরেছিলেন।
আজ প্রদীপ ভীষণ বেপরোয়া। পিছনে যে গূঢ় কারণ লুকিয়ে রয়েছে, সেটা জানা খুব জরুরি। জানতে পারলে তা উপড়ে ফেলতে কোনো সমস্যা হবে না। খেলার মাঠে কড়া ট্যাকল করে প্রদীপকে বাড়তি এ্যাডভানটেজ দিতে যাব কেন? তাতেই বাঁদড়টা নতুন অক্সিজেন পেয়ে যেতে পারে। তার চেয়ে ঢের ভালো হবে, দুচারদিনের মধ্যে নতুন ইস্যু তুলে এনে বাছাধনকে সুচরির নাগাল ছাড়া করে দেওয়া।
এলাকার বাইরে পাঠিয়ে দেবেন বলে ভাবছেন?
ইচ্ছা সেরকম।
তাহলে বেশ হয়।
সুবিমল একটু হাসলেন। —সব বুঝিরে, কেবল তোর কথা ভেবে এত কড়া সিদ্ধান্ত নিতে হল আমাকে। লেগে থাকলে ফল পাবিই, জীবনের বাজি এভাবেই জিতে যেতে হয়। তারপর দেখবি, তোর কথা শুনে সুচরি উঠবে বসবে, নতুন কোনো হেলদোল থাকবে না। আমি যে তোর জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করছি, দেখা হলে সুচরিকে বুঝিয়ে বলবি, তাতেই মেয়েটা দুর্বল হয়ে পড়তে পারে। সংগঠনে এলে কোনো সমস্যাই থাকবে না। তুই থাকলি, সুচরি থাকল, আমি সামনে পিছনে থাকলাম, সুচরি তখন অন্য এনার্জি পেয়ে যেতে পারে। তুইও নতুন এনার্জি পেয়ে জাম্পিং মুডে থাকতে পারবি।
গুরু….।
এভাবে আঁৎকে উঠিস নে, তোর মনের কথাই বললাম। অনুভূতির তীব্র কম্পনে কাঁপলে শরীর মন অনেক সময় তা সহজে সহে নিতে পারে না, ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। ফলশ্রুতিতে শরীর স্বাস্থ্য ভাঙতে শুরু করে। নিজেকে সেই জায়গায় নিয়ে যাবি নে। এক কাজ কর, রমেনরা যেখানে দাঁড়িয়ে মালবিকাকে উৎসাহ দিচ্ছে, ওখানে গিয়ে ওদের কানাকানির হিসেবটা ভালো করে বুঝে নে। প্রদীপকে সরাতে গেলে ওদের সাহায্য লাগবেই। রাজনীতির মূল মানে বুঝিস তো? কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা। এ শিল্প প্রদীপের চেয়ে তুই অনেক বেশি বুঝিস। আমি ততক্ষণ সুচরির শেষ লাফটা দেখে নিই। বোধ হয় চ্যাম্পিয়ন হতে পারে, এলাকার মেয়ে, একেবারে সামনে চলে এলে আমরাও অনেকখানি সুবিধা পেয়ে যাব। পঞ্চায়েত ভোট আসছে, সুচরিকে সংগঠনে পেলে ওর ইমেজকে কাজে লাগাতে পারব।
শর্ট প্যান্টে সজ্জিত সুচরিতার শরীর জুড়ে মৃদু কম্পন, পড়ন্ত সূর্যের আলোয় সে যেন ভোরের ফোটা ফুল। যে কোনো মূল্যে জিততে চায়। সুবিমল দুচোখ স্থির করে সুচরির দিকে চেয়ে থাকলেন। শরীরে কয়েকবার কাঁটা দিল। জিততে পারলে মেয়েটা মথুরাপুরের মুখ উজ্জ্বল করতে পারবে, তাঁর বুকে নতুন গর্বের সুর বাজবে। মাইকের ঘোষণায় সুচরিতার জয়লাভ নিয়ে নানা মূল্যায়ন প্রকাশ পাচ্ছে। প্রদীপ ট্রাকের ঠিক পিছনে এসে অস্ফুটে বলল, জোরে কিন্তু….।
দাদার গলা যে কেমন কেঁপে গেল, ঠাট্টা করল রমেন।
কোনো উত্তর দিল না প্রদীপ। দাঁতে দাঁত চেপে সজোরে নিঃশ্বাস নিল বার দুই, সামনে পিছনে একবার তাকিয়ে নিল। সকলে সুচরির অবস্থান জানার জন্যে কীভাবে উদগ্রীব, তা জানতে পারল। বুকের গভীরে সুচরির জয়লাভ নিয়ে বিশেষ ধরণের ধুকপুকুনি। দুচোখ ছানাবড়া করে দেখল, সজোরে লাফ দিয়েও সুচরিতা মালবিকাকে টপকাতে পারল না।
আনন্দে মুখর হয়ে উঠল রমেনরা। তালে তালে নাচতে শুরু করল। প্রদীপ মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে, কিছুতেই হিসেব মিলছে না, রমেনদের তির্যক মন্তব্যগুলো পর পর আছড়ে পড়ছে তার উপর। জমকালো অন্ধকারের চেয়ে তা যেন অনেক বেশি গভীর। প্রদীপ যেন সদ্য ঘরবাড়ি হারানো এক নিরাশ্রয় মানুষ।
ডান পাশে হতোদ্যম প্রদীপকে দেখে সুচরির মধ্যে নতুন স্বপ্ন তৈরি হল। অন্যের প্রত্যাশা পূরণের মধ্যে যে সার্থকতা রয়েছে, তা নিজের বলে ভাবতে পারল সুচরিতা, বুঝল, শুধু প্রদীপ নয়, রায়বাবুও তার জয় নিয়ে অধীর অপেক্ষায় রয়েছেন। মানসিক বিড়ম্বনার সমুদ্র থেকে নিজেকে টেনে বের করে আনতে পারল। নিজের শরীরটাকে বার দুই ঝাঁকিয়ে নিল, জেতার প্রতিজ্ঞা সারা অন্তর জুড়ে। প্রদীপ আর সুবিমলের ইচ্ছা তাকে পূরণ করতেই হবে।
বামদিকে তাকালো সুচরি, সুবিমল গম্ভীর মুখে হাল্কা হাসি ফুটিয়ে নিজের ইচ্ছার দ্যুতি জানিয়ে দিলেন। মাইকে ঘোষণা হল, দ্বিতীয় পর্যায়ে মালবিকার পালা ঘুরে এল। সবার মনোযোগ ফিরল সেদিকে। কেউ কেউ ভাবল, মালবিকা জিতে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার দৌড়ে সুচরিকে আটকে দিতে পারে। সেই সূক্ষ্ম পর্যালোচনা ঘোষকের কথায় প্রকাশ পাচ্ছিল। রমেন সজোরে চেঁচিয়ে উঠল, কেউ ঠেকাতে পারবে না মালবিকাকে।
সুবিমল নতুন মূল্যায়নে দুলতে লাগলেন। কেবল সুচরিতাকে জেতাতে চায় বলেই প্রদীপকে এত বেশি তির্যক মন্তব্য শুনতে হচ্ছে। এও ভাবলেন, প্রদীপের পক্ষ নিয়ে এত প্রতিকূল পরিবেশে কথা বলা ঠিক হবে না। জয়, রমেনরা বিপরীত কিছু ভাবতে পারে। মালবিকা কিন্তু দ্বিতীয় সুযেগে নিজের গড়া সীমা অতিক্রম করতে পারল না। রমেনদের মধ্যে কেমন যেন মনমরা অবস্থা। কারুর কারুর মনে গভীর সন্দেহ তৈরি হল যদিও রমেন তখনও মালবিকার জয়ের আশায় মসগুল হয়ে ছিল। ক্ষীণস্বরে উৎসাহ জুগিয়ে বলল, তৃতীয়বারের সুযোগটা কাজে লাগাতে হবে মালবিকা।
সুচরিতা আড়চোখে রমেনকে একবার দেখে নিল। তার বাম পাশে সুবিমলের প্রত্যাশামুখর দুটো চোখ, ডানপাশে প্রদীপের চোখে শুধমুাত্র জয়ের হাতছানি। নিজের ইচ্ছাকে ইস্পাত-কঠিন করে তুলল, শেষতম শক্তি নিয়ে সজোরে লাফ দিল, চারদিকে চড়চড় শব্দে হাততালির ফোয়ারা ছুটল, সুচরিতা মালবিকার সীমা অতিক্রম করে যেতে পেরেছে। রমেনদের কেউ কেউ ভাবতে বাধ্য হল, মালবিকার পক্ষে কী তৃতীয় সুযোগে সুচরির সীমা অতিক্রম করা সম্ভব? সত্যি সত্যি মালবিকা পারল না।
প্রদীপ ছুটে এসে সুচরির সঙ্গে হ্যাণ্ডসেক সেরে নিল। সুবিমল জয়ের গায়ে মৃদু ঠেলা দিয়ে বললেন, ছেলেটা বাড়তে বাড়তে একেবারে হেঁতাল গাছ হয়ে গেছে রে, গোড়াতে কোপ না দিলে নয়।
বিকেল পাঁচটায় দ্বিতীয় দিনের খেলা শেষ হল। মঞ্চে তখন সাজো সাজো অবস্থান। প্রাইজগুলো নিয়ে আসা হয়েছে। মাইকে ঘোষণা হচ্ছে বার বার, তিনটে ইভেন্টে জিতে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী সুচরিতা চ্যাম্পিয়নের সম্মান লাভ করেছে। গত বছর অল্পের জন্যে না পারলেও এবারে সফল হয়ে জানিয়ে দিতে পারল, কঠোর অনুশীলন মানুষের জীবনে কত বড়ো সাফল্য এনে দিতে পারে।
প্রিন্সিপাল দেবেশ রায় এসে সব অতিথিকে নাম ধরে মঞ্চে উঠে আসার জন্যে বিনীত আবেদন জানালেন। সেই পর্ব শুরুও হল। সবার শেষে উঠলেন সুবিমল রায়। তখনও শরীরের মাদকতায় দুলছেন তিনি। সুচরিতা তাঁর এলাকার মেয়ে, চ্যাম্পিয়ন হয়ে এক অর্থে তাঁকেই গর্বিত করল। মনে মনে নিশ্চিত হলেন, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি তাঁর হাত দিয়ে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন প্রিন্সিপাল নিজেই। ইতিমধ্যে কলেজের কল্যাণে পঞ্চাশ লাখ টাকার আবেদন নিজেই শিক্ষামন্ত্রীর টেবিলে পৌঁছে দিয়েছেন। মন্ত্রীও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ছ’মাসের মধ্যে সেই টার্গেট পূরণ করার।
চেয়ারে বসে উন্মুখ ভাবনার খরস্রোতে ভেসে যেতে লাগলেন সুবিমল। গতকাল সন্ধেয় ব্লাক আউটের সময় সুচরিতার হাতের উপর পাঁচ আঙুল চেপে বসার উত্তেজনা শরীরের স্নায়ুতন্ত্রে বার বার দোলা দিতে থাকল। একটু পরে প্রাইজ বিতরণ শুরু হবে, পিছনের প্রস্তুতি সব সারা হয়ে গেছে। প্রিন্সিপাল দেবেশ রায় উঠে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলেন, এবছর সংস্কৃতি চর্চা, উন্নত মননের বিস্তার এবং ভালো মঞ্চ সাজানোর স্বীকৃতিস্বরূপ প্রদীপ বর্মণ বর্ষসেরা নির্বাচিত হয়েছে। তাকে মঞ্চে ডাকছি পুরষ্কার নেওয়ার জন্য। মথুরাপুর পঞ্চয়েত সমিতির সভাপতি শ্রীযুক্ত সুবিমল রায়কে অনুরোধ করছি প্রদীপের হাতে পুরষ্কারটি তুলে দেওয়ার জন্যে।
সুবিমল কেমন যেন বিমর্ষ হয়ে পড়লেন। প্রিন্সিপাল তাঁকে দিয়ে ঠিক কী করাতে চাচ্ছেন, মাথায় এল না। তাহলে কী তিনি সুচরির হাতে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার ট্রফি তুলে দেওয়ার সুযোগ পাবেন না? প্রদীপের গোপন ইচ্ছার মূল্য দিতেই কী প্রিন্সিপাল এভাবে সিদ্ধান্ত নিলেন? নাকি অন্য কোনো রাজনৈতিক নেতৃত্বের চাপে পড়ে এভাবে ভাবতে বাধ্য হলেন? দেবেশ রায়ের অনুরোধে শেষ পর্যন্ত প্রাইজটা প্রদীপের হাতে তুলে দিলেও দু’কথা বলার অনুরোধ রাখলেন না। চেয়ারে বসতে বসতে শুধু বললেন, একটা দুধে ছেলে সম্পর্কে আমার কী বলার থাকতে পারে? শিকারী বাঘের মতো মুখ নিয়ে প্রদীপকে আরেকবার দেখে নিলেন।

চলবে…

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
লেখক: মুসা আলি
শিক্ষক জীবনের ৫৫ বছরে এসে সাহিত্যচর্চা শুরু। ইতিমধ্যে পঞ্চাশের বেশি উপন্যাসের মনসবদার। গল্প উপন্যাস লেখার ক্ষেত্রে দীর্ঘ জীবন পরিক্রমায় কঠোর বিশ্বাসী। এখন বিদগ্ধ পাঠক শুধুমাত্র কাহিনি বা চরিত্র খোঁজেন না বরং তার ভিতরে লেখক এর নিজস্ব গভীর মনন আবিষ্কার করতে চান। ঔপন্যাসিক মুসা আলি দীর্ঘ জীবন পরিক্রমার জাদুতে তার নিজস্ব মনন দিয়ে বাঙালি পাঠককে ঋদ্ধ ও সমৃদ্ধ করে তুলতে বদ্ধপরিকর।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!