বাউল ও ফকির প্রসঙ্গ: প্রেক্ষিত লালন সাঁইজি

বলন কাঁইজি
বলন কাঁইজি
16 মিনিটে পড়ুন

বাংলাদেশের বিখ্যাত মরমী কবি ও আত্মতাত্ত্বিক সাধক মহাত্মা লালন সাঁইজিকে নিয়ে ঝড় তোলা হয়েছে; তোলপাড় আরম্ভ করা হয়েছে; বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে আরম্ভ করা হয়েছে প্রবন্ধবাজি। কখনো তাঁর জাত-জন্ম নিয়ে, আবার কখনো তাঁর বাউল বা ফকির হওয়া নিয়ে। উপমহাদেশের বাঘা-বাঘা গবেষক আদাজল খেয়ে নেমে পড়েছেন; কেউ প্রবন্ধ লিখে প্রমাণ করতে চাইছেন; সাঁইজি জন্মগত হিন্দু ছিলেন। অন্যদিকে কেউ প্রমাণ করতে চাইছেন; তিনি জন্মগত মুসলমান। আরেক দল গবেষক বলতে চাইছেন; সাঁইজির জাতিতত্ত্ব বা সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে আলোচনা করা বড্ড বাড়াবাড়ি। এছাড়া মহাত্মা লালন সাঁইজির কাল্পনিক জীবনকাহিনী প্রস্তুত করে; তা দ্বারা পুতুলনাচ, যাত্রাপালা, নাটক ও সিনেমার তো শেষ নেই। লালন পরিচয়, বাউল পরিচয় ও ফকির পরিচয় এ ৩টি পর্বে আলোচনাটি শেষ করতে বাসনা রাখছি।

মজার ব্যাপারটা হলো; আত্মদর্শন, মানববিজ্ঞান, শ্বরবিজ্ঞান, ঈশ্বরবিজ্ঞান বা ব্রহ্মবিজ্ঞানের জ্ঞানহীন গবেষকরা কেউই Theology & Mythology বুঝার চেষ্টা করছেন না। চেষ্টা করছেন না নরত্বারোপ (personification, anthropomorphism) বিষয়টিকে আমলে নিতে।

লালন কাহিনীর সূচনাটাই রূপকথা (Mythology)। বসন্ত (pox) রোগে আক্রান্ত লালনকে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। অতঃপর সে কালীগঙ্গা নদীতে ভাসতে ভাসতে কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়ায় আসে। মলম ও মতিজান দম্পতি তাকে অজ্ঞান ও অসুস্থ অবস্থায় পেয়ে সেবা করে সুস্থ করেন। অতঃপর সে সেখানেই থেকে যায়। এখন দেখা যাক বিশ্বের অন্যান্য পৌরাণিক সাহিত্যে ‘বসন্ত রোগ’ ও ‘নদীতে ফেলে দেওয়া’ বিষয়ে কী কী কাহিনী রয়েছে!

পারসিক রূপকথায় (Persian mythology) বর্ণিত আছে; আয়ুব নবির বসন্ত (pox) রোগ হলে তাকে বনবাসে প্রেরণ করা হয়। অতঃপর তিনি সুস্থ হয়ে লোকালয়ে ফিরে আসেন। পারসিক রূপকথায় (Persian mythology) আরো বর্ণিত আছে; ফেরাউনের ভয়ে শিশু মুসাকে সিন্দুকে ভরে জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। অতঃপর মুসা ভাসতে ভাসতে ঐ ফেরাউনের ঘাটেই এসে উপনীত হয়। ফেরাউনের স্ত্রী আছিয়া নদী থেকে কুড়িয়ে তাকে লালনপালন করে বড় করেন ইত্যাদি। অন্যদিকে ভারতীয় রূপকথায় (Indian mythology) বর্ণিত আছে; স্বামীর ভয়ে শিশুকন্যা সীতাকে পাত্রের মধ্যে ভরে সাগরের জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। অতঃপর ভাসতে ভাসতে পাত্র যজ্ঞভূমিতে এসে উপনীত হয়। মিথিলার রাজা জনক যজ্ঞভূমি কর্ষণ করতে গিয়ে সীতায় প্রাপ্ত হন। এজন্য তার নাম রাখেন ‘সীতা’। সীতা অর্থ লাঙলের ফলার চিহ্ন। হয়তো সারাবিশ্বের সাম্প্রদায়িক ও পারম্পরিক সম্প্রদায়ের নিকট তাদের স্বস্ব ভাষায় এরূপ রূপকথা (Mythology) বা কল্পকাহিনী অনেক আছে।
রূপকথার মধ্যে দিয়ে যার আত্মপ্রকাশ এবং অগোচরে যার তিরোধান তার জাত-জন্ম অন্বেষণ করা বোকামি নয় কি! যারা সাঁইজিকে হিন্দু বলে তারাও রূপকথার (Myth) ওপর নির্ভরশীল। অন্যদিকে যারা মুসলমান বলে তারাও রূপকথার (Myth) ওপর নির্ভরশীল। রূপকথা চিরদিন রূপকথাই। রূপকথা শত বছর বিচার করলেও বাস্তবতায় উপনীত হওয়া সম্ভব নয়।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো; লালনের প্রকারভেদ। এখন পর্যন্ত যতো লালন গবেষক দেখেছি কাউকে লালনের প্রকারভেদ করতে দেখিনি। এখানে লালনের প্রকারভেদটা আগে উল্লেখ করতে চাই। সত্যিকারভাবে লালন গবেষণায় মনোনিবেশ করলে চার প্রকার লালনের সন্ধান পাওয়া যায়। যথা; ১ ব্যক্তি লালন (কবি লালন) ২ কাব্য লালন ৩ উপাস্য লালন ও ৪ প্রয়াণোত্তর লালন।

ব্যক্তি লালন ও কবি লালন একজনই এতে কোন সন্দেহ নেই। কোন কোন ক্ষেত্রে ব্যক্তি ও কবি দু’জনও হতে পারে। যেমন; একজন কাব্য লেখে আরেক জনের নামে প্রকাশ করে। তবে এমন অবস্থা একেবারেই দুর্লভ। বর্তমানকালে লালন সাঁইজির ঐশীবাণীকেও লালন বলা হয়। যেমন; এবার লালন হবে, লালন হবে! অর্থাৎ লালন বাণী পরিবেশিত হবে। উপাস্য লালন ব্যাপারে লালন বাণীতেই আছে;
১ “সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে,
লালন বলে জাতের কিরূপ,
দেখলাম না এ নজরে।” (পবিত্র লালন- ৯১৩)।
২ “সবাই বলে লালন ফকির, হিন্দু কী যবন,
লালন বলে আমি আমার, না জানি সন্ধান।” (পবিত্র লালন- ৯১৯)।
৩ “আত্মাকর্তা কারে বলি,
কোন্ মুক্বামে তার গলি,
কোথা আওনা যাওনা,
সে মহলে লালন কোনজন,
তাও লালনের ঠিক হলো না।” (পবিত্র লালন- ৯৯৯)।

লালন বাণীতে প্রকাশিত লালনগুলোর সঠিক নিরূপণ করা না হলে; কে কোন লালনকে হিন্দু বলছে, কে কোন লালনকে মুসলমান বলছে, কোন সূত্র দ্বারা বলছে তা সঠিক হবে কিভাবে? এখানে পরিষ্কারভাবেই বুঝা যায়; স্বয়ং লালন সাঁইজিই একাধিক লালনের সৃষ্টি করেছেন। ১ ও ২ নং উদ্ধৃতি দ্বারা কবি লালন ও উপাস্য লালনের মধ্যে তেমন পার্থক্য বুঝা যায় না। তবে ৩ নং উদ্ধৃতিতে কবি লালন ও উপাস্য লালনের মধ্যে পরিষ্কার পার্থক্য দেখা যায়। এবার বলা যায়; লালন কাহিনীতে ব্যক্তি লালন ও কাব্য লালনের কোন বর্ণনা পাওয়া যায় না। লালন আখড়া, লালন জীবনী ও লালন দর্শনে যে লালনের বর্ণনা পাওয়া যায় এবং যতটুকু পাওয়া যায় তা হচ্ছে লালন রূপকথা (Mythology)। আর রক্তমাংসে নির্মিত কোন মানুষকে নিয়ে রূপকথা নির্মিত হয় না। বরং রূপকথা নির্মিত হয় নরত্বারোপকৃত (personify) ব্যৈক্তিক-বৈশিষ্ট্য নিয়ে। অর্থাৎ শ্বরবিজ্ঞানের ব্যৈক্তিক-বৈশিষ্ট্য সারণির ৯৯টি মূলকের যে কোন একটির প্রতি সাময়িক ব্যক্তিত্ব আরোপ করে তাকে মানুষের মতো অভিনয় করানোই হলো রূপকথা (Mythology)।

সারাবিশ্বের সর্ব প্রকার পুরাণ, পৌরাণিক সাহিত্য, রূপক-সাহিত্য, রূপকথা, কল্পকাহিনী ও সাম্প্রদায়িক রূপক ইতিহাস ইত্যাদি নির্মাণের ৯৯টি মূলক নিম্নরূপ।
১.অজ্ঞতা ২.অতীতকাহিনী ৩.অন্যায় ৪.অবিশ্বাসী ৫.অর্ধদ্বার ৬.অশান্তি ৭.আগধড় ৮.আয়ু ৯.আশীর্বাদ ১০.আশ্রম ১১.ইঙ্গিত ১২.উপমা ১৩.উপস্থ ১৪.উপহার ১৫.উপাসক ১৬.কানাই ১৭.কাম ১৮.কামরস ১৯.কিশোরী ২০.কৈশোরকাল ২১.গবেষণা ২২.গর্ভকাল ২৩.চক্ষু ২৪.চন্দ্রচেতনা ২৫.চিন্তা ২৬.জন্ম ২৭.জরায়ু ২৮.জীবনীশক্তি ২৯.জৈবাস্ত্র ৩০.জ্ঞান ৩১.ডান ৩২.তীর্থযাত্রা ৩৩.দুগ্ধ ৩৪.দেহ ৩৫.দৈবিকা ৩৬.নর ৩৭.নরদেহ ৩৮.নারী ৩৯.নারীদেহ ৪০.নাসিকা ৪১.ন্যায় ৪২.পঞ্চবায়ু ৪৩.পঞ্চরস ৪৪.পবিত্রতা ৪৫.পরকিনী ৪৬.পাঁচশতশ্বাস ৪৭.পাছধড় ৪৮.পালনকর্তা ৪৯.পুরুষ ৫০.পুরুষত্ব ৫১.প্রকৃতপথ ৫২.প্রথমপ্রহর ৫৩.প্রয়াণ ৫৪.প্রসাদ ৫৫.প্রেমিক ৫৬.বন্ধু ৫৭.বর্তমানজনম ৫৮.বলাই ৫৯.বসন ৬০.বাম ৬১.বার্ধক্য ৬২.বিদ্যুৎ ৬৩.বিনয় ৬৪.বিশ্বাসী ৬৫.বৃদ্ধা ৬৬.বৈতরণী ৬৭.ব্যর্থতা ৬৮.ভগ ৬৯.ভালোবাসা ৭০.ভৃগু ৭১.মন ৭২.মনোযোগ ৭৩.মানুষ ৭৪.মুমূর্ষুতা ৭৫.মুষ্ক ৭৬.মূত্র ৭৭.মূলনীতি ৭৮.মোটাশিরা ৭৯.যৌবন ৮০.যৌবনকাল ৮১.রজ ৮২.রজকাল ৮৩.রজপট্টি ৮৪.রজস্বলা ৮৫.শত্রু ৮৬.শান্তি ৮৭.শুক্র ৮৮.শুক্রধর ৮৯.শুক্রপাত ৯০.শুক্রপাতকারী ৯১.শেষপ্রহর ৯২.শ্বাস ৯৩.সন্তান ৯৪.সন্তানপালন ৯৫.সপ্তকর্ম ৯৬.সৃষ্টিকর্তা ৯৭.স্ফীতাঙ্গ ও ৯৮.স্বভাব ৯৯.হাজার শ্বাস।
এর মধ্যে ৪৮ নং মূলকটি হলো ‘পালনকর্তা’। একে ইংরেজিতে Guardian এবং আরবি ভাষায় ‘رب’ (রাব্বা) বলা হয়। এছাড়া এর আভিধানিক প্রতিশব্দ: আদি-পালক, পালক ও পালন।

রূপক পরিভাষা: সাঁই।

উপমান পরিভাষা: অপ, অমির, অমৃত, অমৃতসুধা, অম্বু, আসব, উদক, কনক, খজল, খবারি, খবাষ্প, গগনাম্বু, গঙ্গা, গঙ্গাজল, গঙ্গোদক, গোরস, গ্রন্থ, চন্দ্র, ছানা, জল, জলফল, জলরাজ, জীবজল, জীবাম্বু, জীবোদক, তীর্থজল, তীর্থবারি, তীর্থোদক, দধি, দধিসার, দানবারি, দিব্যোদক, নিধি, নীর, নীরজ, পক্ষী, পদোদক, পদ্ম, পাখী৬, পাদক, পাদোদক, পীযূষ, পুষ্পরাগ, প্রবাল, প্রেমনিধি, প্রেমসুধা, ফল, ফুল, ফটিকজল, বরিষণ, বৃষ্টি, মণি, মৎস্য, মাখন, মাখনা, মাখম, মাছ, মাণিক্য, মীন, মুক্তা, মৃদুজল, মোতি, যজ্ঞরস, রতন, রত্ন, রত্নধন, রস, রসগোল্লা, শ্রমজল, শ্রমবারি, সুরস, সুরা, সুধারস, সোনা, সোম, সোমরস ও স্বর্ণ।

চারিত্রিক পরিভাষা: অগস্ত্য, অধিদেব, অধিনায়ক, অধিপ, অধিপতি, অধীশ, অধীশ্বর, অধ্যক্ষ, অবনিপতি, অমিতাভ, অরণ্যচর, ইন্দিবর, ইন্দু, ইন্দ্র, ইন্দ্রনীল, উপরিচরবসু, কমল, কমলাপতি, কলাধর, কলানাথ, কাঞ্চন, কাদম্বর, কান্তিমান, কুমুদনাথ, কুলনাথ, ক্ষিতিনাথ, ক্ষিতীশ, ক্ষিতীশ্বর, ক্ষৌণীশ, গউর, গন্ধেশ্বরী, গোতম, গোলকনাথ, গৌউর, গৌতম, গৌরাঙ্গ, চন্দন, চিত্রাশ্ব, চৈতন্যদেব, জগদীশ, জগদীশ্বর, জগন্নাথ, জনার্দন, জৈগিষব্য, তমিনাথ, তারানাথ, দীননাথ, দীনবন্ধু, দীনেশ, দেবরাজ, দেবিন্দ্র, দেবেন্দ্র, দ্রবিণ, ধরণীশ্বর, ননি, নরনাথ, নরেন্দ্র, নরেশ, নরেশ্বর, নারায়ণ, নিতাই, নিত্যানন্দ, নিমাই, নিরঞ্জন, পরেশ, পরেশনাথ, পুরঞ্জয়, পুরন্দর, প্রাণেশ, প্রাণেশ্বর, বটুক, বসু, বিমল, বিশ্বরূপ, বিশ্বাবসু, বিশ্বেশ্বর, বিষ্ণু, মরিচি, মহিন্দ্র, মহেন্দ্র, মাণিক, মাহেন্দ্র, মুকুন্দ, মৃগাংক, রঘু, রঘুনাথ, রজনিকান্ত, রজনিনাথ, রমাকান্ত, রমানাথ, রমেশ, রাকেশ, রাজন, রাজা, রাজীব, রাজেন্দ্র, রাম, রামচন্দ্র, রামেশ্বর, লালক, লালন, লোকনাথ, শচীন্দ্র, শচীশ, শশাঙ্ক, শাক্যমুনি, শাক্যসিংহ, শ্রীকান্ত, শ্রীনাথ, সত্যবান, সিদ্ধার্থ, সুরেন্দ্র, সৌভরি, স্বরূপ, হরি, হরিশ্চন্দ্র, হিমাংশু ও হেমাঙ্গ।

ছদ্মনাম পরিভাষা: অধরা, অধিদেবতা, অধিদৈবত, অনুজ, অমিয়া, অমূল্য, অমূল্যনিধি, আত্মরূপ, আত্মারাম, আদিপুরুন্দর, আয়ুষ্কর, আয়ুষ্য, ইষ্ট, ইষ্টর, ইষ্টি, ঈশ, ঈশ্বর, উপাস্য, করুণানিধি, করুণাময়, করুণাসিন্ধু, কর্পূর, কলানিধি, কল্কী, কাণ্ডারী, কান্ত, কান্তপদ্ম, কারণবারি, কারুণ্যবারি, কুলপতি, কুলপ্রদীপ, কুলর্ষভ, কুস্তরি, কৌমুদীপতি, ক্ষিতিপ, ক্ষিতিপতি, ক্ষিতিপাল, ক্ষীরাব্ধিজ, ক্ষীরোদনন্দন, গদাধর, গরুড়ধ্বজ, গরুড়বাহন, গৃহদেবতা, গৃহপতি, গৃহপাল, গোরা, গোরাচাঁদ, গোরারায়, গোরোচনা, গোলকপতি, গোলকবিহারী, গৌর, গৌরচন্দ্র, গৌরবর্ণ, গৌরাঙ্গাবতার, ঘটোৎভব, ঘরা, ঘরামি, ঘরী, চক্রপাণি, চতুর্ভূজ, চন্দ, চন্দমা, চন্দা, চন্দ্র, চন্দ্রমা, চন্দ্রসুধা, চন্দ্রিমা, চাঁদ, চাঁদা, চাঁদিমা, চান্দ, চান্দা, চিরজীবী, চূড়ামণি, চোর, ছত্রপতি, জগৎকর্তা, জগৎপতি, জগৎপিতা, জগদ্বন্ধু, জগদ্বরেণ্য, জগদ্বিখ্যাত, জগদ্বিধান, জগদ্বিধাতা, জগদ্ব্যাপী, জগন্নিবাস, জগবন্ধু, জীবিতনাথ, জীবিতেশ, জীবিতেশ্বর, জীমূতবাহন, জীমূতবাহী, তপোধন, তপোনিধি, তপোময়, তপোমূর্তি, তমোঘ্ন, তমোহর, তলানি, তারাধিপ, তারাপতি, তিলেখাজা, তীর্থাংকর, তুষারকর, তোয়, ত্রিনাথ, ত্বষ্ট, ত্বষ্টা, ত্বিষ, ত্বিষা, দয়াবান, দয়াময়, দয়াল, দয়ালু, দয়াশীল, দয়িত, দলপতি, দশমাবতার, দিগ্বিজয়ী, দীনশরণ, দেবদুর্লভ, দেবশিল্পী, দৈত্যনিসূদন, দৈত্যারি, দ্রাক্ষারস, ধব, ধবল, ধরণীপতি, ধরণীভৃৎ, ধ্রুব, নক্ষত্রনাথ, নক্ষত্রনেমি, নক্ষত্রপতি, নক্ষত্ররাজ, নক্ষত্রেশ, নদেরচাঁন, ননুয়া, নবনী, নবনীত, নমুচিসূদন, নয়নমণি, নয়নমোহন, নয়নরঞ্জন, নয়নানন্দ, নয়নাভিরাম, নরপতি, নরাধিপ, নরোত্তম, নর্মকীল, নাগেশ্বর, নাথ, নির্ঝর, নিশাকর, নিশানাথ, নিশাপতি, নিস্তারক, নীলমোতি, নীলরতন, নীলোৎপল, নৃমণি, নৃপ, নৃপতি, নৃপবর, নৃপমণি, পক্ষজ, পক্ষধর, পড়শি, পতি, পতিতপাবন, পদ্মনাভ, পদ্মপাণি, পদ্মভূ, পদ্মসম্ভব, পদ্মোদ্ভব, পদ্মোদ্ভব, পবিত্রাত্মা, পরমগুরু, পরমরতন, পরমপিতা, পরমপুরুষ, পরশমণি, পর্জন্য, পাকশাসন, পাখী, পানক, পান্না, পাবন, পীতাব্ধি, পুরুষোত্তম, পূর্ণচন্দ্র, পূর্ণচাঁদ, প্রতিপালক, প্রতিবাসী, প্রতিবেশী, প্রধান, প্রভু, প্রাণকান্ত, প্রাণনাথ, প্রাণপতি, প্রাণপ্রতিম, প্রাণপ্রিয়, প্রাণবল্লভ, প্রেমচাঁদ, প্রেমচন্দন, ফটিক, ফটিকচাঁদ, ফটিকচাঁন, ফণামণি, বজ্রধর, বজ্রপাণি, বজ্রমণি, বজ্রী, বড়লাট, বনফুল, বনবিহারী, বরয়িতা, বলনিসূদন, বসুধারা, বস্তুধন, বাপ, বারিচর, বারিরূহ, বিধি, বিধু, বিশল্যকরণী, বিশ্বপা, বিশ্বপাতা, বিশ্ববিধাতা, বিষ্টু, বিষ্ণুপদী, বিসা, বুদ্ধ, বৃত্রঘ্ন, বৃত্রহা, বৃত্রারি, বৃষ্ণি, বেদাশ্রয়, বৈকুণ্ঠনাথ, বৈকুণ্ঠপতি, ব্রহ্মনাভ, ভরত, ভারতীগোঁসাই, ভর্তা, ভুবনেশ্বর, ভূতভাবন, ভূপ, ভূপতি, ভূপাল, ভূস্বামী, ভৃগুপতি, ভৃগুরাজ, মঘবন, মঘবা, মঘবান, মঞ্জুঘোষ, মঞ্জুশ্রী, মৎস্যরাজ, মৎস্যাবতার, মদ, মনেরমানুষ, মনোচোর, মনোরায়২, মনোহর, মনোহরা, মন্মথবন্ধু, ময়স্ক, মরি, মরী, মহাভিক্ষু, মহারজত, মহারত্ন, মহৌষধ, মাধুকী, মানুষ, মানুষ্য, মেঘবাহন, মৈত্রেয়, যজ্ঞপতি, যজ্ঞপুরুষ, যজ্ঞেশ্বর, যাজ্ঞিকান্ন, যামিনীনাথ, যামিনীপতি, যামিনীভূষণ, যোগিশ্বর, রঘুকুলতিলক, রঘুকুলপতি, রঘুনন্দন, রঘুপতি, রঘুবর, রঘুমণি, রঘুশ্রেষ্ঠ, রজত, রমাপতি, রসোত্তর, রাই২, রাকাপতি, রাঘব, রাজজল, রাজপ্রসাদ, রাজরাজেশ্বর, রাজাধিরাজ, রাজানুকম্পা, রাজানুগ্রহ, রাজ্যেশ্বর, রাত্রিমণি, রায়, লক্ষ্মীকান্ত, লক্ষ্মীপতি, শক্র, শঙ্খচক্রগদাপদ্মধারী, চীনন্দন, শচীপতি, শচীবিলাস, শরণ্য, শশধর, শশবিন্দু, শশভৃৎ, শশলক্ষণ, শশলাঞ্ছন, শশী, শাক্য, শাস্তা, শীতাংশু, শীল, শুক্ল, শুভ্র, শুভ্রকেশ, শ্রীনিবাস, শ্রীপতি, শ্রীবৎসলাঞ্ছন, শ্রীহরি, শ্বেত, শ্বেতকি, শ্বেতজটা, শ্বেতবসন, সংরক্ষক, সর্বগুণনিধি, সর্বগুণাধার, সর্বময়, সহস্র নয়ন, সহস্রপাদ, সহস্র লোচন, সহস্রাক্ষ, সাকার, সাদা, সাদাঈশ্বর, সারবস্তু, সীতাপতি, সুধা, সুধাংশু, সুধাকর, সুধানিধি, সুধাবর্ষী, সুধাবাস, সুধাময়, সুধামাখা, সুবর্ণপদ্ম, সুরপতি, সোমক, সোমরাজ, সোয়ামি, সৌদামিনি, স্পর্শমণি, স্বরূপমণি, স্বর্ণমৃগ, স্বামী, হবি, হবিষ্য, হবিষ্যান্ন, হবিষ্যি, হরচূড়ামণি, হরিণ, হরিণাংক, হর্যশ্ব, হিমকর, হিরণ্য, হৃৎপদ্ম, হৃদিপদ্ম, হৃষীকেশ, হেম, হেমচন্দ্র, হেমপুষ্প ও হৈম।

পালনকর্তার চারিত্রিক পরিভাষা হচ্ছে ‘অগস্ত্য—-হেমাঙ্গ’। চারিত্রিক পরিভাষার মধ্যে রয়েছে আলোচ্য ‘লালন’ পরিভাষা। অর্থাৎ কথিত লালু, ললিত, ললিত নারায়ণ, ললিত নারায়ণ লালু ও লালন কর বা কবি লালন, ব্যক্তি লালন শ্বরবিজ্ঞানের ব্যৈক্তিক-বৈশিষ্ট্য সারণির পালনকর্তা পরিবারের চারিত্রিক পরিভাষা হতে নিজের ছদ্মনাম গ্রহণ করেছেন লালন। অতঃপর এর ওপর ব্যক্তিত্ব বা নরত্বারোপ (personification, anthropomorphism) করে পুরো লালন কাহিনী (Mythology) নির্মাণ করেছেন।
লালন উদ্ভবের রূপকথাটি হলো; সহযাত্রীদের সঙ্গে তীর্থদর্শনে গিয়ে কিশোর লালন একদা বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। চিকিৎসা করে সুস্থ করার কোন উপায় না দেখে সহযাত্রীরা তাকে ভেলাযোগে নদীতে ভাসিয়ে দেন। অতঃপর ভাসতে ভাসতে অজ্ঞান ও অসুস্থ অবস্থায় লালন বর্তমান কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়া ঘাটে উপনীত হন। মলম ও মতিজান দম্পতি তাকে নদীতে কুড়িয়ে লালনপালন করেন। লালন বড় হলে ঐ দম্পতি তার নিকট শিষ্যত্বগ্রহণ করেন। লালনের সহধর্মিনী ছিলেন বিশাখা মাতাজি। পালকপুত্র ছিলেন ভোলাই ও শীতল। পালককন্যা ছিলেন প্যারিন্নেছা। ঘোড়ার রাখাল বা লেখক ছিলেন মনির। এই ছিল তাঁর পরিবার।

জলে ভাসিয়ে দেওয়া, নদীতে ফেলে দেওয়া, বসন্ত রোগে আক্রান্ত হওয়া, বনবাসে প্রেরণ করা ও দ্বীপান্তরে প্রেরণ করা; এরূপ অসংখ্য রূপকথা (Mythology) সারাবিশ্বে বিভিন্ন পুরাণে ছড়িয়েছিঁটিয়ে আছে। পূর্বকালের সোনালী সভ্যতার পরেই পুরাণী সভ্যতার আবির্ভাব হয়। সোনালী সভ্যতা বলতে প্রাকৃতিক দ্রব্যাদি দ্বারা সংস্কৃতি ও উৎসব বুঝানো হয়েছে। অন্যদিকে পুরাণী সভ্যতা বলতে রূপকথা ও প্রতীকের মাধ্যমে আত্মদর্শন প্রচারকে বুঝানো হয়েছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে; পৌরাণিক দর্শনের কারণেই বিশ্বব্যাপী সাম্প্রদায়িক সভ্যতার উদ্ভব হয়েছে। এখন বিজ্ঞান, দর্শন ও প্রযুক্তি কেন্দ্রিক অসাম্প্রদায়িক তৃতীয় সভ্যতা গঠন করা একান্ত প্রয়োজন। ‘অসাম্প্রদায়িক তৃতীয় সভ্যতা’ বলতে বুঝানো হয়েছে; অসাম্প্রদায়িক আত্মদর্শনমূলক সমাজ ব্যবস্থা।

এবার বলা যায়; বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার ছেউড়িয়া গ্রামের সাধক লালন সাঁইজির ব্যাপারে যতটুকু জানা যায়; তার পুরোটাই রূপকথা বা পুরাণ (Mythology)। এটি নির্মিত চরিত্র। এখন পর্যন্ত কোন নির্ভরযোগ্য সূত্র দ্বারা লালন চরিত্র নির্মাতা ব্যক্তির পরিচয়-পরিচিতি পাওয়া যায়নি। একদিকে তখনকার হিতকরী ও প্রবাসী পত্রিকা; অন্যদিকে বসন্তকুমার, জসিমউদ্‌দীন, সুধীর চক্রবর্তী, মনসুরউদ্দীন, উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, মতিলাল দাস, আবু তালিব, আবুল আহসান চৌধুরী ও ফরহাদ মাজহার প্রমুখ লালন গবেষক; যে লালন নিয়ে গবেষণা করেছেন; তা বাংলা পুরাণের একটি চরিত্র মাত্র। অন্যদিকে সর্বকালের সর্ব শ্রেষ্ঠ লালন গবেষক বলন কাঁইজি; মহাত্মা লালন সাঁইজির ওপর অনেক গ্রন্থ লিখেছেন। তাঁর প্রতিটি লেখায় চার প্রকার লালনের সম্যক বিবরণ জানা যায়। বলন কাঁইজিই সর্ব প্রথম প্রমাণ করেন যে; লালন গবেষকদের গবেষণার উপাদানটি রূপকথা (Mythology)। তিনি আরো বলেন যে; কবি লালন (আলোচনার জন্য) নিজেই যে লালনকে খুঁজে বেড়িয়েছেন, কবি লালন রূপকথার মাধ্যমে যে লালনের প্রচার করেছেন; সে লালনের ধারেকাছেও যেতে পারেনি ওপরোক্ত গবেষকরা।

ব্যক্তি লালন একজন আত্মগোপনকারী সাধক। তিনিই লালন চরিত্রের প্রকৃত রূপকার। তিনিই আলোচ্য লালন চরিত্র রূপায়ণ করেছেন। যেভাবে বাল্মীকি রূপায়ণ করেছেন রাম চরিত্র। জসিমউদ্দিন করেছেন মদনকুমার ও হুমায়ন আহমদ করেছেন বাকের ও হিমু চরিত্র। মুহাম্মদ যেমন কুরানের কেন্দ্রিয় চরিত্র; লালনও তেমন লালন বাণীর কেন্দ্রিয় চরিত্র। কালে কালে ‘রাম’ যেমন ভগবান শ্রীরামচন্দ্র-এ পরিণত হয়েছেন; মুহাম্মদ যেমন হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এ পরিণত হয়েছেন; তেমনি লালনও মহাত্মা লালন সাঁইজিতে পরিণত হয়েছেন।

পরিশেষে বলা যায়; পুরাণ (Myth), পৌরাণিক সাহিত্য (Mythology), রূপক সাহিত্য (Fabulous literature) ও রূপকথা (Fairytale) ইত্যাদি দ্বারা রূপক পরিভাষার মূলক উদ্ঘাটন করা যায়। কিন্তু পুরাণ নির্মাতা বা পৌরাণিক সাহিত্যিককে কোনক্রমেই চিহ্নিত করা যায় না। যেমন; রামায়ণ পাঠ করে রাম চরিত্রের মূলক বের করা সম্ভব; কিন্তু রামায়ণ রচয়িতা বাল্মীকির সন্ধান করা সম্ভবপর নয়। যেমন; রাম পরিভাষাটির আত্মতাত্ত্বিক মূলক হচ্ছে; জীবের পালনকর্তা বিষ্ণু বা সাঁই। বিষ্ণু বা সাঁই হচ্ছে মানবদেহে প্রাপ্ত মিষ্টজল। অনুরূপভাবে কুরান পাঠ করে মুহাম্মদ চরিত্রের মূলক বের করা যায়; কিন্তু কুরানের সংকলক বা কুরানের লেখক অথবা আংশিক রচয়িতাদের বের করা যায় না। যেমন; মুহাম্মদ পরিভাষাটির আত্মতাত্ত্বিক মূলক হচ্ছে; জীবের পালনকর্তা রব বা সাঁই। রব বা সাঁই হচ্ছে মানবদেহে প্রাপ্ত মিষ্টজল। উল্লেখ্য যে; রামায়ণে বর্ণিত রাম এবং কুরানে বর্ণিত মুহাম্মদ একই সত্তা। তা হলো মানবদেহে প্রাপ্ত মিষ্টজল। তেমনি বলা যেতে পারে; লালন বাণী গবেষণা করে; লালন চরিত্রের মূলক উপাস্য লালনকে চিহ্নিত করা যায়; তবে লালন চরিত্রের নির্মাতা ব্যক্তি-লালনকে চিহ্নিত করা যায় না। যেমন; লালন রূপক পরিভাষাটির আত্মতাত্ত্বিক মূলক হচ্ছে; জীবের পালনকর্তা। বাংলা পুরাণে তাঁকে বলা হয় সাঁই। সাঁই হচ্ছে মানবদেহে প্রাপ্ত মিষ্টজল। এবার বলা যায়; রামায়ণে বর্ণিত রাম, কুরানে বর্ণিত মুহাম্মদ ও লালনে বর্ণিত লালন একই সত্তা। তা হলো মানবদেহে প্রাপ্ত মিষ্টজল।

চলবে…

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
অনুসরণ করুন:
মিথলজি গবেষক
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!