‘ঘোড়েল’ পর্ব – এক

মুসা আলি
মুসা আলি
18 মিনিটে পড়ুন

বাজারের মধ্যে পটলার চায়ের দোকানে বসে স্থানীয় রাজনীতির মেগা হিরো সুবিমল রায় একবার আড়চোখে তন্বি সুচরিতাকে ভালো করে দেখে নিলেন, একটু ভাবলেন। পাশে বসে রয়েছে মূল সাকরেদ জয়শংকর। সকলের কাছে জয় হিসেবেই পরিচিত, গরম চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে বলল, গুরু, মেয়েটাকে চেনেন?
—না রে, কে বল্ তো?
খুব হিলুবিলু জিনিস, শরীর নাচিয়ে মন ভোলানোর অদ্ভুত যন্তর।
চাপা রোষে খিঁচিয়ে উঠলেন সুবিমল— ভদ্র করে কথা বলতে পারিস না?
জয় মাথা নীচু করে চুপচাপ বসে থাকল। এতদিন পাশাপাশি চলতে চলতে গুরুর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়াগুলো তার মুখস্থ হয়ে গেছে। কোনো বিষয়ে একবার ফেটে পড়লে রায়বাবু কিছুতেই থামতে চান না, ভয়ানক বিপদজনক হয়ে ওঠেন অথচ ঠান্ডা হলেই তাঁর মধ্যে আরেকটা নতুন মানুষ দেখতে পাওয়া যায়। সেই সুবিমল একান্তই ক্ষমাশীল, ধৈর্য্যশীল, ঐকান্তিকভাবে সামাজিক। লাগিয়ে দেওয়ার মন্ত্রে যেন এতটুকু বিশ্বাস নেই কিন্তু মিলনের প্রশ্নে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। এ দৃষ্টান্ত জয়ের মুখস্থ হয়ে গেছে। সুবিমলের জীবনে রাগ দেখানো কিংবা সন্তুষ্টিতে গলে জল হয়ে যাওয়া— সবই তাঁর রাজনৈতিক জীবনের অঙ্গ। গ্রামীণ রাজনীতিতে টিকে থাকতে গেলে কীভাবে নরমে গরমে চলতে হয়, বিশেষ সন্ধিক্ষণে দুই বিপরীত মেরুকে মিশিয়ে দিতে হয়, তা সুবিমল ভালোভাবেই জানতেন। নিজের অভিজ্ঞতায় জয়ও তা জেনে ফেলেছে বলেই নিজেকে শুধরে নিতে কিংবা চুপ করে থেকে সুবিমলকে ঠান্ডা করতে তো তো করে বলল, গুরু, আমার উপর রাগ করলেন?
আর কোনোদিন এভাবে কটু মন্তব্য করবি না, আমার এলাকার মেয়ে, জানতে পারলে কী ভাবতে পারে, তা একবার ভেবে দেখেছিস? এখন কলেজে পড়ছে, আগামি দিনে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য নতুন শক্তি হয়ে উঠতে পারে। সেই দৃষ্টান্তের অভাবও নেই। তোর এ কটু মন্তব্য কানে গেলে আমাদের বিরোধী শক্তি ওকে গিলে নিতে চাইবে রে। ইস্যু তৈরি না করে ছাড়বে না। সেই সুযোগ দিতে যাবি কেন? নতুন টিম গড়ে তুলতে গেলে সুচরিতার মতো অনেক মেয়েকে দরকার। মনে রাখিস, সামনে যুব ব্রিগেড না থাকলে রাজনীতিতে সফল হওয়া যায় না।
অনুগত শিষ্যের মতো জয় শুধু হুঁ বলে চুপ করে থাকল। সাম্প্রতিক সময়ে সে এই অভ্যেসটুকু বেশ মুখস্থ করে ফেলেছে। সুবিমল রায়ের সঙ্গে চলতে চলতে বুঝেছে, প্রতিকূল সময়ে গুরুর সামনে মৌন হয়ে না থাকলে ভবিষ্যতে নিজেকে বড়ো করে তোলা সম্ভব নয়। এভাবেই কঠোর অনুশীলনে নিজেকে খাঁটি যন্ত্রে পরিণত করতে পেরেছে সে। আরেকটা কঠিন বাস্তবতা নিজস্ব অধ্যবসায়ে বেশ রপ্ত করে নিতে পেরেছে। গুরুকে ঠিকমত জাপটে ধরতে না পারলে স্থানীয় রাজনীতিতে কিছুতেই মাথা তুলে দাঁড়ানো সম্ভব নয়। একেবারে অজ গ্রাম থেকে উঠে আসা জয় ব্যক্তিগত প্রয়োজনে গুরুভজনা ভালোমতোই শিখে ফেলেছিল। চরম অপছন্দের হলেও কেবল মাত্র নিজের স্বার্থের কথা মাথায় রেখে কিছুতেই গুরুর বিরুদ্ধে মুখ খুলত না। সব খারাপ দিকগুলোকে চেপে রেখে কেবলমাত্র গুরুর ভালো দিকগুলোকে নিয়ে বাজার গরম করে বুঝিয়ে দিত, সে খাঁটি ভাবশিষ্য হয়ে উঠতে পেরেছে।
সেই জটিল প্রক্রিয়ার মধ্যে চলতে চলতে জয় নিজেকে অনেকখানি পোক্ত করে তুলতে পেরেছিল। যদিও একটা চাপা খেদ সর্বদা তার মনের তলানিতে মন্দগতির বলের মতো গড়িয়ে গড়িয়ে চলত। অনেকবার ভেবেছে, এ নিয়ে তত চিন্তা করা ঠিক নয় কিন্তু নিত্য নতুন পরিস্থিতি জয়ের সেই ভাবনাকে জটিলতর করে তুলেছে। কেন তাকে আজও ব্লক লেবেল কমিটিতে রাখা হয় নি, তা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারে নি সে। সুবিমলের হয়ে অঞ্চলে অঞ্চলে যোগসূত্র রক্ষায় সেই প্রধানতম সহায়। হঠাৎ কোনো আন্দোলন সামনে এলে সুবিমল রায় কাছে ডেকে বলতেন, তোকেই নেতৃত্ব দিতে হবে। সব ক্ষেত্রেই বিশেষ সফলতাও রয়েছে। জয়ের স্থির বিশ্বাস, রায়বাবুর একটু নেকনজরে থাকলেই তার সব ইচ্ছা সহজে পুরণ হয়ে যেতে পারে কিন্তু সেই সৌভাগ্য নানা চেষ্টার পরেও লাভ করতে পারেনি। এতদিন লেপ্টে থেকেও সুবিমল রায়কে সে ঠিকমতো বুঝতেই পারল না।
কেমন যেন ধোঁয়াশার মধ্যে দিন পার করতে হচ্ছে তাকে। নানা মানুষের বিচিত্র অনুভূতি নিয়ে সুবিমল রায়ের রাজনৈতিক খেলার আসর জমে উঠলেও তাঁর ভিতরের অনুভূতিটুকু আজও ধরতেই পারল না সে। এক অদ্ভুত প্রচ্ছন্ন মানুষ এই রায়বাবু। কথায় বিচিত্র গোলকধাধা তৈরি করতে পারেন, তবুও জয় জাপটে ধরে আছে সুবিমলকে। স্থির বিশ্বাস, রায়বাবুকে একদিন গলতেই হবে। গুরু ধরে বৈতরণী পার হওয়া ছাড়া তো জয়ের জীবনে দ্বিতীয় বিকল্প নেই।
তীব্র অনুশোচনায় ডুবে যেতে বাধ্য হল জয়। সত্যিই তো, দোকানে বসে মেয়েটিকে নিয়ে এভাবে কটু মন্তব্য করে সে ঠিক কাজ করে নি। কেউ না জানুক চা দোকানদার দিব্যি শুনে ফেলেছে। পাঁচকান করে দিতেই পারে। তাতে শুধু নিজের সুনাম নষ্ট হবে না, মানুষের চোখে গুরুর গুরুত্ব কমে যেতে পারে। রাজনীতির নিজস্ব শিষ্টাচার রয়েছে, যে কোনো মূল্যে তা মেনে চলা চাই চাই।
এটা নিয়ে জয়ের মনে আর কোনো সংশয় থাকল না। তাকিয়েই বুঝতে পারল, সুবিমল রায় তার মানসিক অবস্থান ঠিকমতো বুঝতে পেরেছেন। একটু পরে তা টেরও পেল। জয়ের কাঁধে হাত রেখে চাপা স্বরে সুবিমল বললেন, রাগ করলি আমার উপর?
বরফের মতো গলতে শুরু করল জয়। রায়বাবু তার জীবনে সকালে গা-সওয়া রোদের মতো। একটু আগে তার মধ্যে যে তীব্র অনুশোচনা ও বিরাগ দেখা দিয়েছিল তা রায়বাবুর বরফ গলানো তাপে ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেল। মুখ নীচু করে বলল, কী যে বলেন গুরু, আমি আপনার উপর রাগ করতে পারি?
সুবিমল বুঝলেন, জয় সাগ্রহে তাঁর ভিতরের ভাবনা ধরে ফেলেছে। রাজনীতিতে এটুকু ধরে রাখতে পারলে নেতৃত্বের মধ্যে ন্যায়-অন্যায়বোধ না থাকলেও চলে। চারপাশের লোককে অন্ধভাবে অনুসরণ করানোই শেষ কথা। সুবিমল সেই সন্তুষ্টি নিয়ে জয়ের দিকে দুচোখ তুলে তাকিয়ে থাকলেন। অনুগত ভাবশিষ্যের সব রাগ অনুরাগ ঝরে পড়তে লাগল শ্রাবণের বৃষ্টি হয়ে, জয় একবার মুখ তুলে গুরুকে ভালো করে দেখে নিল। সুবিমল তাকে ঠিকমতো বুঝতে পেরেছেন বলেই বেশ ভালো লাগছিল। এ তল্লাটে নেতৃত্বের মনের চলাচলের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে চলতে পারলে অনুসরণকারীর জীবনে আর কোনো বাধাই থাকে না। সুবিমল জয়ের ডান হাত চেপে ধরে বললেন, একটা অসাধ্য সাধন করতে পারবি?
কাজটা কী বলুন?
সুচরিতাকে কী আমাদের সংগঠনে টেনে আনা সম্ভব?
গুরু যা হিলুবিলু জিনিস, প্রদীপের সঙ্গে শুধু শুধু সময় নষ্ট করে।
সুবিমল না হেসে পারলেন না— আগে কখনো দেখেছিস মেয়েটাকে?
অনেকবার দেখেছি।
গম্ভীর হলেন সুবিমল। সুন্দরবনের খোলা মাঠে রাজনীতি করতে করতে জীবনের নঞর্থক দিকগুলো মুখস্থ করে ফেলেছিলেন। এ নিয়ে তাঁর মধ্যে নতুন আয়না তৈরি হয়েছিল। তাহলে কী জয় সুচরিতার প্রতি মনে মনে দুর্বলতা পোষণ করে? সুযোগ পায় নি বলেই কী এভাবে প্রদীপের গায়ে ঠেস দিয়ে কথা বলছে?
তবুও ভাবলেন, জয়ের উপর এভাবে সন্দেহ করা ঠিক হবে না। তাঁর প্রিয় সাকরেদ, অনেক বিষয়ে একাই সামলে নিতে পারে। পরম সৌভাগ্য, জয়ের মতো একজন অন্ধ অনুসরণকারীকে কাছে পেয়েছেন। তাই ভিতরের বাঁকা প্রসঙ্গ চেপে রেখে বললেন, হ্যাঁরে জয়, কেবল পিছনের দিকটাকে বড়ো করে দেখবি? মেয়েটা কার সঙ্গে কেন চলাফেরা করে, তা জেনে আমাদের লাভ কী? এ কৌতূহল বড়ো করে তুলে আমরা ওর চলাফেরার স্বাধীনতায় বাধা দিতে পারি না। রাজনীতি নিয়ে এঅঞ্চলে অনেকদিন পড়ে আছিস। অপছন্দের লোকজন বেশি হলে তাদেরকে বাদ দিয়ে কী রাজনীতি চালানো সম্ভব? সম্ভাবনার এ শিল্পকে সাথর্ক করে তুলতে মানুষের বিপুল সমর্থন প্রয়োজন। যে কোনো মূল্যে তা লাভ করতে হবে। সুচরিতা দলে এলে এলাকার মহিলা সংগঠন কতটা শ্রীবৃদ্ধি লাভ করতে পারে, সেটাই মূল কথা।
গুরু, যা বলবেন তাই করব কিন্তু আমি মিথ্যে বলি নে।
সুবিমল বেশ শব্দ করে হাসলেন, নিশ্চিত হয়ে গেলেন জয়ের অবচেতন মনে পছন্দের সুচরিতাকে কাছে না পাওয়ার হতাশা নিয়ে। সেও চাচ্ছে প্রদীপের মতো সুচরিতার ছায়ায় চলতে কিন্তু বঞ্চিত বলেই এভাবে তার ভিতরের বিতৃষ্ণা প্রকাশ পেল। কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না প্রদীপের জয়যাত্রাকে। জীবনের এ অনুসঙ্গ হজম করা সত্যি কঠিন। অবচেতন মনের দুর্বলতায় ভোগে না, এমন মানুষ এ পৃথিবীতে নেই। ব্যর্থ জয় সেই পংতিতে ঢুকে পড়েছে মাত্র।
সুচরিতার মতো তন্বি মেয়ের প্রতি জয়শংকরের দুর্বলতা বড়ো বেশি স্বাভাবিক। কোমল শরীরের ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে যৌবনের বন্যা, টানা টানা দুচোখে আকর্ষণের অদ্ভুত আগুন। মুখের অবয়বের দুর্বলতা সেই আগুনকে দ্বিগুণ করে তোলে। ছ্যাকা লাগার ভয় থাকলেও এ আগুনে মন পোড়াতে বেশ লাগে। কচি কলাপাতা রঙের শাড়ি পড়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটলে মনে হয়, কোনো নর্তকী চলেছে হেলেদুলে। সমগ্র অঙ্গভঙ্গিতে অপূর্ব শিল্পকলার প্রকাশ। কথায় কথায় সাদা দাঁতের ফাঁক গলে হাসির ফোয়ারা বের হয়ে আসে। তখন অবিকল সুচিত্রা সেন বলে মনে হয়। আকর্ষণের আর এক কেন্দ্রবিন্দু। মাথায় এক রাশ চুল, সামনে চেপে রেখে চলতে থাকলে তার রোমান্টিক মুখশ্রীতে প্রদীপের মানসিক অবসন্নতা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে বার বার। উদ্দীপনার অনুষঙ্গ মানুষের জীবনে এমনিই।
প্রদীপ বসে বসে ভাবছে কেমন করে কলেজ জীবনে দু-জনের মন দেওয়া নেওয়া শুরু হয়েছিল। স্মৃতির সরণি বেয়ে নানা চিত্রহারে উদ্বেলিত হচ্ছে সে। শনিবার দুটোয় ছুটি হতেই দোতলার করিডরে আনমনে দাঁড়িয়ে ছিল প্রদীপ। পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে তার মধ্যে হেলদোল শুরু হয়ে গেছে। ভালো ফলাফল করতে না পারলে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ আশা করা যায় না। মধ্যবিত্তদের জীবনে সেরা ফলই সেরা পাওনা। এর বাইরে দ্বিতীয় পথ নেই। সুচরিতা তার সামনে এসে দাঁড়ালো।
কিছু বলবে?
বাংলা নোটের খাতাটা একদিনের জন্য দেবে?
প্রদীপ মনের পুলকে ভাসল। কী জবাব দেবে ভেবে পেল না। আনমনে আড়চোখে একবার নীল আকাশটা দেখে নিল। চাপা স্বরে বলল, নিশ্চয় দেব, ক’দিন আসতে পারো নি শুনি?
বেশ কয়েকদিন। মায়ের অসুস্থতা, অন্য কারণও ছিল, সেজন্যেই….। ভাবছি,খাতাটা পেলে নোটগুলো তুলে নিতে পারতুম।
কবে ফেরত দেবে বলো?
আবার কবে কেন, একদিন পরেই।
ভুল হিসেব দিলে সুচরিতা।
কী ভুল বললাম?
সোমবার কলেজ ছুটি।
সরি সরি, একদম ভুলে গিয়েছি।
আরও ভুল আছে।
কী রকম?
মঙ্গলবার শুরু হবে কলেজের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, চলবে টানা দু’দিন।
প্রথা অনুসারে প্রিন্সিপালের নিজস্ব উদ্যোগে পরের দিন কলেজ ছুটি থাকে। তুমি নাকি দু’তিনটে ইভেন্টে নাম দিয়েছ, কেমন প্রস্তুতি নিয়েছ বলবে? অন্তত হাততালি দিয়ে তো সমর্থন করতে পারি। কলেজ জীবনের শেষ বছর, জিততে পারলে সেই স্মারক মনের গভীরে জমে থাকবে দীর্ঘদিন। স্মৃতির অঞ্জলি এমনিই।
সুচরিতা নতুন টেনশন অনুভব করল, খেলার সময় নোটগুলো কমপ্লিট করে খাতা ফেরত দেওয়া সম্ভব নয়, তা একবার ভেবে নিল। প্রদীপকে উদ্দেশ্য করে বলল, তাহলে আজ আর খাতাটা নেব না। তোমার পড়াশোনার ক্ষতি হোক, তা চাই না।
নোটগুলো তোমাকে লিখে দিতে পারি একটাই শর্তে।
কী বলো শুনি।
কলেজ প্রতিযোগিতায় সব ইভেন্টে জিতে চ্যাম্পিয়ন হতে হবে।
সুচরিতার মুখে সলজ্জ হাসি। তার সাফল্য নিয়ে প্রদীপ এভাবেই ভাবতে পারছে? ভাবালুতায় ভেসে থাকল সুচরিতা, কিন্তু বাইরে তা এতটুকু প্রকাশ করল না। এত বড়ো সাফল্য পাওয়া তার পক্ষে কী সম্ভব? প্রদীপের শর্ত পুরণের সামর্থ তার আছে কিনা, তা নিয়ে নিশ্চিত হতে পারল না। অন্যান্য প্রতিযোগী কতটা প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে নামবে, তার উপর অনেকখানি নির্ভর করছে, তবুও প্রদীপের কথায় প্রচ্ছন্ন গর্ব অনুভব করল সুচরিতা। বুঝল সহপাঠীর দাবি শুধুমাত্র বন্ধুসুলভ নয়, আরও অনেক কিছু। ঘুরিয়ে প্রশ্ন করল প্রদীপকে, তোমার কী মনে হয় তিনটে ইভেন্টে আমিই প্রথম হতে পারি?
সব সৈনিক যুদ্ধজয়ের আগাম স্বপ্ন দেখে। সেটাই জিতে যাওয়ার শ্রেষ্ঠতম মোটিভেশন। এ ভাবনা যত গভীর হয়, সাফল্য তত কাছে আসে। আমিও ঘুরিয়ে প্রশ্ন করতে পারি, জয়ের অগ্রিম ইচ্ছাকে এভাবে ছোটো করে দেখছ কেন?
খুব চাপে আছি প্রদীপ। নাম নথিভুক্ত করার পর থেকেই সেই চাপ আরও বাড়ছে, জানি না কী হবে।
এভাবে ভাবতে নেই সুচরিতা। চাপ ভাবলে চাপ, তা উতরে যেতে পারলেই জয়লাভ সহজ হয়ে ওঠে। একটা সত্যি জেনে রাখো, শুধু খেলার মাঠে নয়, জীবনের সব ক্ষেত্রে রয়েছে একই চাপের খেলা। সহে নিতে পারলে জিতে যাওয়া সহজ হয়, না পারলে পরাজয় আর হতাশার অতলে তলিয়ে যাওয়া ছাড়া পথ থাকে না। প্রতিযোগিতা শেষ হলে আমার মন্তব্য মিলিয়ে নিও, সব কটা ইভেন্টে তুমিই জিতে যাবে।
জ্যোতিষী হতে পারলে তোমার সাফল্য কেউ ঠেকাতে পারবে না।
জ্যোতিষী তত্ত্বে বিশ্বাস করি না সুচরিতা, শুধু জানি, আত্মশক্তিতে যে কোনো মানুষ জিতে যেতে পারে। এতে কোনো কল্পনা নেই বরং বাস্তব জয়ের স্বপ্ন আছে যা সম্বল করে মানুষ নতুন নতুন জয়লাভকে সম্ভব করে তোলে। সামান্য মাকড়সা জাল বিস্তার করে পরাভূত ব্রুসকে জিতিয়ে দিতে পেরেছিল, তাহলে তুমি ভয় পাচ্ছ কেন বাস্তব প্রতিযোগিতায় জিতে যাওয়া নিয়ে?
মিথ্যে বাহবায় ভেসে লাভ কী?
প্রদীপ কথা না বাড়িয়ে গম্ভীর মুখে করিডর থেকে সিঁড়িপথে নামতে শুরু করল। মাঠের চারদিকে সারি সারি ঝাউগাছের ডগাগুলো মৃদু হাওয়ায় দুলছে। খেলার মাঠে চলে গেল। তার রোজকার রুটিন সন্ধে পর্যন্ত ক্রিকেট খেলে বাড়িতে ফিরে যাওয়া। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই কোনোদিন এর ব্যতিক্রম হয় নি।
সুচরিতা তখনও দোতলার করিডরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে, প্রদীপের জন্যে একটা অচেনা গর্ব বুকের গভীরে মোবাইল রিংটোনের মতো বেজে চলেছে। বাঙালিয়ানার ষোলোআনা নির্যাস নিয়েই যে প্রদীপের মন তৈরি হয়েছে, তা বেশ বুঝতে পারল সুচরিতা।
বিশ্বকাপ এলেই সেই ঘরানা নতুন করে সামনে চলে আসে। হাজার মাইল দূরে ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনার অবস্থান। বাঙালি রাত জেগে তাদের জেতাতে চায়, পূজো দেয়, মানত করে, আনন্দে শিহরিত হয়, পরাজয়ে মনের গ্লানিতে বিরহ-যন্ত্রণা অনুভব করে। পছন্দের জয়লাভে গর্বের শেষ থাকে না। প্রদীপ বর্মণ সেই বৈশিষ্ট্য সম্পূর্ণ আয়ত্ত করে ফেলেছে।
গর্বিত সুচরিতা পায়ে পায়ে নেমে এল গ্রাউণ্ড ফ্লোরে, প্রদীপের সামনে গিয়ে বলল, তাহলে এখন যাবে না?
ক্রিকেট খেলা শেষ করে ছ’টার ট্রেনে বাড়িতে ফিরব, তুমি কী এই ট্রেনেই…?
সুচরিতা সদর্থক মাথা নাড়ল।
প্রদীপের চাপা মন্তব্য, সব কটা ইভেন্টে প্রথম হলে খুশি হব।
অত বাড়তি প্রত্যাশা ভালো নয়।
প্রত্যাশা আছে বলেই এতগুলো ইভেন্টে নাম লেখাতে পেরেছ।
আমার মতো অনেকেই নিজেদের নাম তালিকাভুক্ত করেছে, তাদের মধ্যেও সেই প্রত্যাশা থাকতে পারে।
শুধু শুধু নিজের জয়লাভ নিয়ে এভাবে ভয় পাচ্ছ কেন?
খেলার আগে এত বড়ো ফল নিয়ে ভাবতে পারছি নে।
পারলেই আত্মবিশ্বাস বেড়ে আকাশের মতো উঁচু হয়ে উঠতে পারে, তাতেই জয়লাভ সম্ভব।
কোনো উত্তর দিল না সুচরিতা। দ্রুত হাঁটতে শুরু করল, ভিতরে ট্রেন ধরার উদ্বেলতা। যেতে যেতে ভাবল, যে কোনো মূল্যে জিতে প্রদীপের সব হিসেব মিলিয়ে দিতে হবে। প্লাটফর্মে ঢুকে হাতঘড়িতে চোখ রেখে দেখল, ট্রেন আসতে তখনও কয়েক মিনিট বাকি। নিজের ভাবনায় ডুবে থাকল সুচরিতা। যথেষ্ট কষ্ট করে তাকে পড়াশোনা চালাতে হয়। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা সুচরিতার একমাত্র সম্বল, সে সত্যি সত্যি সুন্দরী, বড়ো আয়নার সামনে দাঁড়ালে তা বেশ বুঝতে পারে। স্টেশনে ট্রেন ঢুকতে আর মাত্র মিনিট দুই বাকি। সুচরিতা বুঝতে পারল না, সুবিমল তার পিছনে দাঁড়িয়ে, দুচোখ বড়ো বড়ো করে তাকে গিলে খেতে ব্যস্ত।
ভিতরে ভিতরে কেমন যেন উত্তেজিত। পঞ্চাশ উর্দ্ধ রায়বাবু চাপা স্বরে ডাকলেন, সুচরি…।
শুনতেই পেল না সুচরিতা। নানা ঝক্কি নিয়ে তার জীবন, মথুরাপুরে নেমে ভ্যানে আরও কিছুটা পথ গেলেই তবে বাড়িতে পৌঁছাতে পারবে।
ট্রেন ঢোকার সময়েই জয়শংকর হন্তদন্ত পায়ে সুবিমলের পিছনে এসে বলল, কতক্ষণ আগে এসেছেন? দেখতে পাননি? ওই তো সেই হিলুবিলু জিনিস, আপনার সামনেই দাঁড়িয়ে।
ওর বাড়িতে একদিন যা না, আমার কথা মন খুলে বলতে পারিস। নেতৃত্ব পাওয়ার টোপ গিলবে না, সমাজে এমন কেউ নেই রে।
এত করে বলছেন যখন…।
তাহলে কবে যাচ্ছিস?
কাল পরশুর মধ্যে।
এখন কোথায় যাচ্ছিস?
পাশের ওষুধের দোকানে যাব, একটা ভিটামিন কিনতে হবে।
সুচরিতার জন্যে দুর্ভাবনায় ভিটামিন খেতে হচ্ছে না তো?
কী যে বলেন গুরু।
আমার সামনে দাঁড়িয়ে অথচ তুই আগেই দেখতে পেলি?
স্রেফ কাকতালীয়।
যে খায় চিনি তাকে জোগায় চিন্তামনি।
জয়ের মুখে এক চিলতে হাসি, গুটি গুটি পায়ে সামনে এগিয়ে চলল। সুবিমল বুঝতেই পারলেন না, সুচরিতা কখন ট্রেনে উঠে বসল। শরীরের যন্ত্রণায় ক্ষুধার্ত নেকড়ের মতো রায়বাবু ভিতরে ভিতরে কতটা অস্থির হয়ে উঠেছেন, তা জয়কে জানতেই দিলেন না। ট্রেন ছাড়ার সাইরেন রায়বাবুর বুকের যন্ত্রণাকে দ্বিগুণ করে তুলল। স্টেশন থেকে নেমে সামনের চা দোকানে ঢুকে বললেন, একটা চা দাও, সঙ্গে ক্রিমকেকার বিস্কুট দিও।
রায়দা, মিনিট দুই দেরি হবে।
তা হোক। সুবিমল আবার সুচরিতায় ডুবে গেলেন। ভারি তন্বি মেয়ে, হাসলে সুচিত্রা সেনকে টপকে যেতে পারে। সংগঠনে এলে কেবল ওর হাসি দেখে অনেকেই দলে যোগ দেবে।
দোকানদার গরম চা করে ক্রিমক্রেকার বিস্কুটসহ দিয়ে গেল একটু পরে। চুমুক দিতে দিতে সুবিমল আরও কত কী ভাবলেন, শেষ ভাবনা সুচরিতাকে নিয়েই, যে কোনো মূল্যে মেয়েটাকে সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত করতেই হবে।
পশ্চিমের পড়ন্ত সূর্য ঢলে পড়ল সামনের সবুজ মাঠে, তার অনন্য শোভায় মুগ্ধ সুবিমল। তখনও রায়বাবু ভিতরের ডাক উপেক্ষা করতে না পেরে কাকে যেন খুঁজে চলেছেন। সেই ভাবনায় ডুবে চা খাওয়া শেষ করার পরেই সামনের প্লেটে দুচোখ রেখে বুঝলেন, বিস্কুট খেতে ভুলে গেছেন, বিসদৃশ ঘটনায় নিজেই একটু হাসলেন, দোকানদারের মুখেও হাসির রেখা। রায়বাবু ভিতরে ভিতরে লজ্জিত। তবুও একটাই স্বস্তি, এতক্ষণ মনের গহনে একা একা যেভাবে বিচরণ করেছেন, বোবা নির্বোধ দোকানদারের পক্ষে তা বুঝে ওঠা সম্ভব হয় নি। নিজের মানসিক গর্তে নিজেই মজে থাকলেন।

চলবে…

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
লেখক: মুসা আলি
শিক্ষক জীবনের ৫৫ বছরে এসে সাহিত্যচর্চা শুরু। ইতিমধ্যে পঞ্চাশের বেশি উপন্যাসের মনসবদার। গল্প উপন্যাস লেখার ক্ষেত্রে দীর্ঘ জীবন পরিক্রমায় কঠোর বিশ্বাসী। এখন বিদগ্ধ পাঠক শুধুমাত্র কাহিনি বা চরিত্র খোঁজেন না বরং তার ভিতরে লেখক এর নিজস্ব গভীর মনন আবিষ্কার করতে চান। ঔপন্যাসিক মুসা আলি দীর্ঘ জীবন পরিক্রমার জাদুতে তার নিজস্ব মনন দিয়ে বাঙালি পাঠককে ঋদ্ধ ও সমৃদ্ধ করে তুলতে বদ্ধপরিকর।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!