ডাঙ্গায় নৌকা বাইচ এবং চাঁদের আলোয় পদ্মাসেতু দর্শন…

অপূর্ব দাস
অপূর্ব দাস
5 মিনিটে পড়ুন
ডাঙ্গায় নৌকা বাইচ, সাতক্ষীরা। ছবি: সংগৃহীত।

গতকাল ফেসবুকে একটা ভিডিও দেখলাম, সাতক্ষীরাতে ডাঙ্গায় নৌকা বাইচ হচ্ছে! আর আজ প্রথম আলোর একটা শিরোনাম হল, চাঁদের আলোয় পদ্মা সেতু দেখতে ভিড়, মেলার আমেজ! এই দুইটা বিষয়ের মধ্যে আমি একটা মিল খুঁজে পাচ্ছি, এখানে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের একটা চিত্র কল্পনা করা যায়! বাংলাদেশ একটা নদীমাতৃক দেশ, এখন বর্ষাকাল! নদী নালা, জলে টই-টুইম্বুর থাকার কথা! নৌকা বাইচ কেন ডাঙ্গাতে হবে? হতে পারে এটা গ্রামীণ সংস্কৃতির একটা অভিনব উদ্ভাবন, মানুষকে আনন্দ দানের একটা কৌশল! কিন্তু আমরা যেভাবে নদীকে হত্যা করছি, হয়ত অচিরেই আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে নৌকা বাইচ কি সেটা বোঝাবার জন্য, স্থলভূমিতেই অভিনয় করে দেখাতে হবে, যে এটাকেই নৌকা বাইচ বলে কিংবা এভাবেই এক সময় আমাদের দেশে নৌকা বাইচ হত! যেমন, কৃষির সাথে সম্পর্কহীন, কৃষকের প্রতি বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা এমনকি সহানুভুতিহীন সৌখিন মানুষের ঘরের দেওয়ালে মাথায় মাথাল, কাঁধে লাঙ্গল কৃষকের বাঁধায় করা পেইন্টিং শোভা পায়! চাঁদের আলোয়, মানুষ নৌকায় করে ঘুরতে বের হত চাঁদনী রাতে জলের শোভা উপভোগ করার জন্য! আর আজ মানুষ বের হয়েছেন, মেলা বসেছে নদীর উপর সেতু দেখার জন্য! হয়ত আগামী দিনে মানুষকে সেতু দেখেই কল্পনা করে নিতে হবে, এখানে এই সেতুর নীচে কত বড় নদী ছিল! আমরা তো চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি, যমুনার দশা! সেতুর দুই পাশে কিভাবে চর পড়ে নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে! আমরা হাওড়ের মধ্য দিয়ে রাস্তা নির্মাণ করার পর, অনুধাবন করছি কাজটা কত বড় অদূরদর্শী হয়েছে!

উন্নয়ন আমাদের জীবনের জন্য প্রয়োজন! কিন্তু সেই উন্নয়ন হতে হবে প্রাণ-প্রকৃতিকে কেন্দ্রে রেখে! উন্নয়নের জোয়ারে ভাসতে গিয়ে আমরা হারিয়েছি আমাদের হারজারো জাতের দেশীয় ধানের প্রজাতি! আমরা হারিয়েছি, আমাদের শত জাতের দেশীয় মাছ! আমরা হারাতে বসেছি, প্রাণিকুলের অনেক প্রজাতি! এগুলির তাতক্ষণিক প্রভাব আমরা হয়ত, সেভাবে অনুভব করছি না কিংবা সেই প্রভাবের সাথে আমরা ইতোমধ্যে অভ্যস্থ হয়েচ গেছি! কিন্তু আমরা যেভাবে নদীকে, দখল, দূষণ এবং কথিত উন্নয়নের নামে আমরা হত্যা করছি, তার পরিণতি তো আমরা সিলেট, সুনামগঞ্জে দেখলাম! আমরা প্রতিবছর দেখছি, কিন্তু শিক্ষা কি নিচ্ছি! আমরা নাকি শিক্ষা-দীক্ষায়ও এগিয়ে যাচ্ছি! শিক্ষাক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেড়েছে, উপর কাঠামোর দৃশ্যমান উন্নয়ন হচ্ছে সে ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নাই! কিন্তু ভেতর কাঠামো যে দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে, সেটাও অস্বীকার করবার অবকাশ নাই! ধান ভানতে শিবের গীত মনে হতে পারে! শুরু করেছিলাম নৌকা বাইচ, নদী এবং পদ্মাসেতু নিয়ে! সেখান থেকে কেন আবার শিক্ষার প্রসঙ্গ আসল! আসল এই কারণে, পড়া মানে কি শুধু বই পড়া? মানুষকে পড়তে শিখতে হয়, প্রাণ-প্রকৃতিকে পাঠ করা শিখতে হয়! না হলে তো নদী মরবেই! আমরা নিজদের উৎপাদিত যে ধানের চাল খেয়ে অল্প কিছু বীজ রেখে দিতাম পরবর্তীতে আবারও জমিতে ছিটানোর জন্য, চারা উৎপাদনের জন্য! ইতোমধ্যে আমরা সেগুলি হারিয়ে, প্রত্যেক মৌসুমে দারস্থ হই বহুজাতিক বীজ কোম্পানীর কাছে! আমরা দেশীয় জাতের মাছের প্রজাতি হারিয়ে দারস্থ হচ্ছি পাংগাশ আর থাই মাগুরের!

আমি যা বলছি, সেটাকে অনেকের কাছে আবেগী বক্তব্য মনে হতে পারে! অনেকেই যুক্তি দেখাবেন, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার সাথে তাল মেলাতে গেলে এগুলি ছাড়া উপায় কি? উপায় তো আছেই, কিন্তু সেই উপায়ের জন্য সবচেয়ে জরুরী হল আলাপ! মানুষকে, প্রাণ-প্রকৃতিকে, নদীকে পড়তে পারা! সেই পাঠ যে সব আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই হতে হবে এমন কথা নাই! সব পাঠ কথিত প্রতিষ্ঠানে সম্ভবও নয়! আমাদের যে লোকজ্ঞান, প্রাণ-প্রকৃতি সাথে বসবাসকারী মানুষ, নদী-পাড়ের মানুষ, নদীর বুকের মাঝি, কৃষক সকলের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান এবং আমাদের সত্যিকারের পণ্ডিত ব্যক্তিদের ভাবনার সমন্বয়ে হয়ত আমরা আমাদের নদীগুলিকে রক্ষা করতে পারতাম! নদীতেই হাজার বছর ধরে নৌকা বাইচ হত! আমরা প্রয়োজনে ব্রিজ বানাতাম কিন্তু নদীকে মৃত্যুর  মুখে ঠেলে দিয়ে নয়! দুর্ভাগ্য হল আমাদের শিক্ষার সাথে, এদেশের প্রাণ-প্রকৃতির কোনো আত্মিক সম্পর্ক নাই! আমরা সেই ছোটবেলা থেকে পড়ে আসছি, নদীমাতৃক বাংলাদেশ, কিন্তু আজও উপলব্ধিতে আনতে পারি নাই এই বাক্যের অন্তর্নিহিত অর্থ! আমরা পড়েছি, নদী-নালা নাকি জালের মত, আমাদের দেশটাকে জড়িয়ে রেখেছে! সত্যিই তো একদিন তাই ছিল! আর আজ আমরা হঠাতই আমাদের বাড়িঘর তলিয়ে যেতে দেখি, ভেসে যেতে দেখি! কিন্তু সেই পানিকে বুকে ধারণ করবার নদী-নালাকে আর দেখেতে পাই না বেশিরভাগ অঞ্চলে! প্রচন্ড খরায় যখন মাঠ-ঘাট, খা খা করে মাঠে চরে বেড়ানো গরু যে কোথাও গিয়ে তার ত্রিস্না মেটাবে এমন জলাশয়ের দেখা মেলে না!

আমরা যদি এখনই সজাগ না হই! প্রাণ-প্রক্রিতি, নদীর সাথে আত্মিক সম্পর্কযুক্ত প্রজন্ম গড়ে তুলতে না পারি! বাংলাদশ অচিরেই এমন এক ব্রিজের দেশ হবে, এখানে চাঁদের আলোতে ব্রিজের নীচের বালুকেই রুপালি জলাধারা হিসাবে কল্পনা করতে হবে! মাইমের মাধ্যমে আমাদেকে নৌকা বাইচের দৃশ্য পরবর্তী প্রজন্মকে দেখাতে হবে! আমরা সেই দিন দেখতে চাই?

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
তিনি একজন মানবাধিকার কর্মী। জন্ম এবং বেড়ে ওঠা যশোর জেলায়। লেখাপড়া সম্পন্ন করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। মানবাধিকার, নারীর মানবাধিকার, জেন্ডার এবং নারীর ভূমির অধিকার নিয়ে তিনি কাজ করেছেন একাধিক জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সংগঠনে। এছাড়াও যুক্ত আছেন লেখালেখি এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথেও। কর্মসূত্রে বর্তমানে বসবাস করছেন ঢাকাতে!
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!