শাহজাদপুর: হতদরিদ্র ইয়াছিনের বিচারের বাণী নিরবে নিভৃতে কাঁদছে!

শামছুর রহমান শিশির
শামছুর রহমান শিশির
6 মিনিটে পড়ুন

শাহজাদপুরে অবৈধ গ্রাম্য শালিশের বাদীকেই আড়াই লাখ টাকা জরিমানা!- ‘দরিদ্র গরুর বেপারী ইয়াছিন বহু কষ্টে তিলে তিলে দু’চার পয়সা জমা করে ১ লাখ ৭২ হাজার টাকা সঞ্চয় করে নিজ বসত ঘরের স্টিলের বাক্সে রেখেছিলেন। কিন্তু, স্বামী স্ত্রী মাঠে কাজ করতে গিয়ে বাড়ি জনশূন্য থাকায় সিন্দুক ভেঙ্গে ইয়াছিনের কষ্টার্জিত সেই অর্থ চুরি করে নিয়ে যায় চোর। বাড়ি ফিরে বাক্সে টাকা না দেখে বাকরূদ্ধ হয়ে পড়েন ইয়াছিন। বাড়িতে থাকায় ছোট্ট ছেলে আশিক (১২) তার চাচতো মামা দুলালকে এ সময় বাড়িতে খন্তা (শাবল) খুঁজতে দেখে ও ঘরে ঢুকে টাকার থলে গামছায় পেচিয়ে নিতে দেখে। পরে ইয়াছিন বাড়িতে এসে বাক্স ভাঙ্গা দেখে ছেলে আশিককে বাড়িতে কেউ এসেছিলো কি না? জিজ্ঞাসা করলে আশিক মামা দুলালের কথা বলে। এ সময় দুলাল ইয়াছিনের বাড়িতে এসে শান্তনা দিতে থাকলে ইয়াছিন দুলালের কাছে টাকা ফেরত চায় ও লাঠি দিয়ে পায়ে দু’টি আঘাত করে। পরে দুলালের বিরুদ্ধে ১ লাখ ৭২ হাজার টাকা চুরির অভিযোগ এনে ইয়াছিন গ্রাম প্রধানদের দ্বারস্থ হলে প্রধানবর্গ পুলিশকে না জানানোর শর্তে উপযুক্ত বিচারের আশ্বাস দেয়। সে মোতাবেক চুরি যাওয়া অর্থ বিষয়ক গ্রাম্য শালিশের বাদী ইয়াছিন উপস্থিত হলে প্রধানবর্গ চুরির বিচার না করে দুলালের পায়ে দু’টি আঘাত করার অপরাধে উল্টো ইয়াছিনের আড়াই লাখ টাকা জরিমানা করে। এ ঘটনায় চির অবহেলিত, চির পতিত, চির অপাংক্তেয় হৎদরিদ্র ইয়াছিন যার বুক ফাঁটলেও মুখ ফোটেনি! যার বিচারের বাণী নিরবে নিভৃতেই কাঁদছে ! সেই ইয়াছিনের চুরি যাওয়া টাকা উদ্ধারের বিচারের নামে প্রহসনের এ ঘটনাটি ঘটেছে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার কায়েমপুর ইউনিয়নের বনগ্রাম দক্ষিণপাড়া মহল্লায়।

মঙ্গলবার (১৪ জুন) বিকেলে উপজেলার কায়েমপুর ইউনিয়নের বনগ্রাম দক্ষিণপাড়া মহল্লা পরিদর্শনকালে ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ইয়াছিনের ৩য় শ্রেণি পড়–য়া ছেলে আশিক সাংবাদিকদের জানায়, ‘ঘটনার দিন বিকেলে দুলাল মামা বাড়িতে এসে খন্তা (শাবল) চাইতে চাইতে ঘরে ঢুকে বাক্সের ভেতর থেকে টাকার ব্যাগ গামছার নিচে লুকিয়ে চলে যায়।’

অপর প্রত্যক্ষদর্শী একই গ্রামের সাদেক প্রামানিকের স্ত্রী মুন্নি (২৬) সাংবাদিকদের জানান, ‘তিনি গোবর ভেঙ্গে বাড়ি ফিরছিলেন। এসময় ইয়াছিনের বাড়ি পৌঁছালে দেখতে পান, আশিক দুলালকে বলছে মামা খন্তা (শাবল) নিবেন না! দুলাল খন্তা (শাবল) লাগবে না বলে দ্রুত চলে চায়। এ সময় দুলালের গামছার নিচে হাতে কিছু লুকিয়ে নিয়ে যেতে দেখেছি।’

হৎদরিদ্র ইয়াছিন ও তার স্ত্রী কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘অনেক কষ্টের ১ লাখ ৭২ হাজার টাকা ও গহনা চুরি যাওয়ার বিচার চাই গ্রাম প্রধানদের কাছে। আমার টাকার বিচার না করে শত শত গ্রামবাসীর সামনে উল্টো আমাকেই ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করে ২০ দিনের সময় বেঁধে দিয়েছে। আমি প্রধানবর্গের নিকট ৩০ হাজার টাকা দিয়েছি। আইনের আশ্রয় নিতে চাইলেও প্রধানবর্গ আমাকে থানায় যেতে দেননি। গরীব অসহায়দের বিচার এমনই হয়! কার কাছে বিচার চাইবো। আল্লাহই এর বিচার করবেন!’

সরেজমিন পরিদর্শনকালে এলাকাবাসী জানায়, মঙ্গলবার উপজেলার কায়েমপুর ইউনিয়নের বনগ্রাম ক্লাবে অনুষ্ঠিত গ্রাম্য শালিশ বৈঠকে স্থানীয় কায়েমপুর ইউপি সদস্য বাবলু , গ্রাম শালিশের সভাপতি শাহাদ মাষ্টার, রাজ্জাক সরকার, কামাল মাস্টার, কবীর সরকার, কালু প্রামাণিক, গোলামসহ গ্রাম প্রধানবর্গ চুরি যাওয়া টাকা উদ্ধারের বিচার না করে একরতফাভাবে বিচারপ্রার্থী ইয়াছিনকে দোষী করে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করে ৩০ হাজার টাকা আদায় করেছে যা রীতিমতো প্রহসনের বিচারই বটে!

মঙ্গলবার (১৪ জুন) বিকেলে দুলালের ব্যক্তিগত মোবাইল ফোনে তার বক্তব্য জানার জন্য ফোন করা হলে দুলালের ছেলে ইমরান ফোন রিসিভ করে সে বাড়ি গিয়ে তার বাবার সাথে সাংবাদিকদের কথা বলানোর আশ্বাস দিলেও আধাঘন্টা পরে আবারও দুলালের ফোন সে রিসিভ করে বাড়ি যেতে দেরী হবে বলে জানান। তার বাবাকে কোন হাসপাতালে নেয়া হয়েছিলো তিনি তাও জানেন না বলে সাংবাদিককের জানিয়েছেন।

গত সোমবার (১৩ জুন) রাতে সরেজমিন কাশিনাথপুর বাজার এলাকা পরিদর্শনকালে সাংবাদিকদের দেখে কায়েমপুর ইউনিয়ন যুবলীগ সভাপতি রুবেল দম্ভোক্তির সাথে বলেন, ‘ও! ইয়াছিন সাংবাদিক পাঠাইছে! তালি তো ওর ৫ লাখ টাকা জারিমান করা হবে!’ একই সময়ে কায়েমপুর ইউপি সদস্য বাবলু সাংবাদিকদের জানান, ‘দুলাল শালিশে বৈঠকে স্বাক্ষী প্রমাণে ঠেকে নাই! ইয়াছিন, তার ছেলে, ইউসুফ ও ইউসুফের ছেলে এ ৪ জন বিনা দোষে দুলালকে বেধড়ক পিটিয়ে আহত করায় এলাকার প্রধানবর্গের মধ্যে ঠান্ডু, সালাম, কবীর, জাহাঙ্গীর, সোবাহান প্রামাণিক, রাজ্জাকসহ ১১ সদস্যের রায় বোর্ড ইয়াছিনকে দোষী করে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করে।’ একজন ইউপি সদস্য’র গ্রাম্য শালিশে সর্বোচ্চ কত টাকা জরিমানা করার বিধান রয়েছে? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের সদুত্তর বাবলু মেম্বর না পেরে বলেন,‘এটা সামাজিকভাবে মিমাংসা করা হয়েছে!’

এ বিষয়ে কায়েমপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জিয়াউল আলম ঝুনুর কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন,‘শালিশ বৈঠকের বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না।’

বিজ্ঞজনের মতে, ‘একজন ইউপি চেয়ারম্যানের গ্রাম আদালতেও এত টাকা জরিমানা করার বিধান নাই। আর ইউপি সদস্য আরও অনেক কম টাকা জরিমানা করতে পারে। কায়েমপুরের বনগ্রামে অবৈধ গ্রাম্য শালিশে বিচারের নামে যে অবিচার হয়েছে হয়েছে তা রীতিমতো দেশে প্রচলিত আইন কানুন, রীতি নীতিতে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর শামিলের মতোই! এ অবৈধ গ্রাম্য শালিশের সাথে সম্পৃক্তদের আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে সুবিচার নিশ্চিত করতে হবে যাতে ভবিষ্যতে অবৈধ গ্রাম্য শালিশে ইয়াছিনের মতো বিচারপ্রার্থীকেই অভিযুক্ত করে আর কারও বিরুদ্ধে এমন অবিচার না হয়। বিষয়টি প্রশাসনের উর্ধতন কর্তৃপক্ষের খতিয়ে দেখা জরুরী।#

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!