উত্তরবঙ্গের পুরাকীর্তি

সাময়িকী আর্কাইভ
সাময়িকী আর্কাইভ
204 মিনিটে পড়ুন

উত্তরবঙ্গের পুরাকীর্তি

প্রত্নবিদ্যা

পুরাণে প্রতন-প্রত্ন পুরাতন-চিরন্তনাঃ।

আজ যাহা পুরাতন, একদিন তাহা নূতন ছিল। আজ যাহা নূতন, একদিন তাহা পুরাতন হইবে। তথাপি নূতন-পুরাতনের সম্বন্ধ-সূত্র বিচ্ছিন্ন হইবার নহে। সুতরাং পুরাতন যতই পুরাতন হউক না কেন, তাহার পরিচয় লাভের প্রয়োজন আছে। মানবমন শিক্ষায় ও সভ্যতায় যতই বিস্তৃতি লাভ করে, পুরাতনের পরিচয় লাভের জন্য ততই লালায়িত হইয়া থাকে। পুরা-প্রীতি,–যাহা চলিয়া গিয়াছে তাহার অনুসন্ধান-লালসা,–সভ্য মানবের পক্ষে স্বাভাবিক। কেহ জ্ঞানলাভের আশায়, কেহ কৌতূহল চরিতার্থ করিবার আকাঙ্ক্ষায়, কেহ বা কেবল পুরাতনের স্বপ্নমোহে, পুরাতনের পরিচয় লাভের চেষ্টা করিয়া থাকেন। অনেকে মনে করেন, –তাহা অতি সহজসাধ্য ব্যাপার। প্রকৃত প্রস্তাবে তাহা সহজসাধ্য বলিয়া কথিত হইতে পারে না।

সূচিপত্র
উত্তরবঙ্গের পুরাকীর্তিপ্রত্নবিদ্যাপুরাণে প্রতন-প্রত্ন পুরাতন-চিরন্তনাঃ।বঙ্গ-পরিচয়দেশের কথা ২উত্তরবঙ্গের পুরাতত্ত্ব সংগ্রহতথ্যসূত্রবাঙ্গালীর জীবন-বসন্তের স্মৃতি-নিদর্শনএবংশিলালিপিঅনুবাদটীকাতথ্যসূত্রপৌণ্ড্রবর্ধনের সংক্ষিপ্ত পুরাবৃত্ততথ্যসূত্রহজরত পাণ্ডুয়াবড় দরগালক্ষ্মণসেনী দালানশাহ জালালছোট দরগাবাদশাহী সনন্দবাদশাহী মসজেদপুরাতন স্মৃতিচিহ্নতথ্যসূত্রপাণ্ডুয়ার কীৰ্তিচিহ্নএকলক্ষিসাতাইশ ঘরাতথ্যসূত্রআদিনাগঠন কাহিনীগঠন কৌশলতথ্যসূত্রএকডালা দুর্গতথ্যসূত্রবরেন্দ্র-খনন-বিবরণভুমিকামাহি-সন্তোষের ধবংসাবশেষখনন–সূত্রপাতখনন-ব্যবস্থাখনন-কার্যপ্রণালীখনন-বিবরণমসজেদমসজেদ-প্রাঙ্গণ ও গোরস্থানপূর্বতন লোকালয়দরগাদুর্গা ও পুরাতন কূপহিন্দু-বৌদ্ধ স্মৃতিচিহ্ন১ শ্ৰীরাজপুরীয় লে২ ঋক শ্রীমবদেবঃপাষাণ–পরিচয়-স্থাপত্য-রীতিবাস্তুশাস্ত্রদ্বারদ্বার-শাখা ও উদুম্বরশ্রীমূৰ্ত্তি-প্রস্তরশিখর-প্রস্তরমন্দির-রহস্যমুসলমান-বিজয়খিলিজীগণের গৃহকলহমুসলমান-শাসকবার্বাকাবাদতথ্যসূত্র

যে বিদ্যার সাহায্যে পুরাতনের প্রকৃত পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যাইতে পারে, তাহার নাম প্রত্নবিদ্যা। অল্পকাল পূৰ্ব্বেও তাহা একটি উল্লেখযোগ্য বিদ্যা বলিয়া স্বীকৃত হইত না। যে কেহ, যে কোন ভাবে, তাহার আলোচনা করিত। এখন দিন ফিরিয়াছে; জ্ঞানানুরাগ বাড়িয়াছে; এখন আর যে কেহ যে কোন ভাবে পুরাতনের আলোচনা করিতে সাহস করে না; –এখন কোন কোন স্থানে তাহার যথাযোগ্য অধ্যয়ন-অধ্যাপনারও সূত্রপাত হইয়াছে। সভ্য-সমাজের সুধীবৃন্দ বুঝিয়াছেন, অধিকাংশ বিদ্যার আলোচ্য বিষয় বাহ্যবস্তু; কেবল প্রত্নবিদ্যারই আলোচ্য বিষয় পৃথক। বাহ্যবস্তুর সাহায্যে মানব-প্রকৃতির ও মানব-মনের ক্রমবিকাশের মূল সূত্রের অনুসন্ধান করাই তাহার প্রকৃত লক্ষ্য।

এক সময়ে এ বিষয়ে মতভেদ ছিল। আমাদের দেশে এখনও বিলক্ষণ মতভেদ আছে। এখনও আমাদের দেশে অনেক কৃতবিদ্যের নিকটেও প্রত্নবিদ্যা নিরবচ্ছিন্ন উপহাসের বিষয়;–কাহারও কাহারও নিকটে তাহা নিতান্ত খেয়াল বলিয়াই পরিচিত। তথাপি এই বিদ্যার অনুশীলনে পাশ্চাত্য সভ্য সমাজ অকাতরে অর্থব্যয় করিতেছে; যাহাদের সহিত আমাদের দেশের কিছুমাত্র সম্পর্ক নাই, তাহারাও আমাদের পুরাতত্ত্বানুসন্ধানে অগ্রসর হইতেছে। এই সকল দেখিয়া শুনিয়া, আমাদের দেশেও কেহ কেহ ইহার আলোচনায় হস্তক্ষেপ করিতেছেন। ইহাকে একটি শুভ লক্ষ্মণ বলিয়াই অভ্যর্থনা করিতে হইবে।

প্রথম উদ্যমে ভ্রম ত্রুটি অপরিহার্য–বাঙ্গালা লেখকগণের গ্রন্থে বা প্রবন্ধে তাহার পরিচয় পাইলে, তাহাকে তেমন দোষের কথা বলিয়া তিরস্কার করা চলে না। কারণ, প্রত্নবিদ্যার প্রকৃত লক্ষ্য কি, তাহার প্রকৃত অনুসন্ধান প্রণালীই বা কিরূপ, তদ্বিষয়ে আমাদের মাতৃভাষায় এ পর্যন্ত একখানি গ্রন্থও প্রকাশিত হয় নাই; অন্যান্য ভাষায় যাহা প্রকাশিত হইয়াছে, তাহাও সৰ্ব্বজন-পরিচিত হইতে পারে নাই। সুতরাং আমাদের দেশে প্রত্নবিদ্যার আলোচনায় কিছু কিঞ্চিৎ অনধিকার-চৰ্চ্চার আড়ম্বর উৎসাহ লাভ করিতেছে।

ইহা অসঙ্গত হইলেও, নূতন নহে। এক সময়ে পাশ্চাত্য সভ্য সমাজেও ইহার পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছিল। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই তদ্দেশে অনধিকারচর্চা নিবারণের এক অব্যর্থ উপায় আবিষ্কৃত হইয়াছে। সে উপায় সহজ এবং প্রত্যক্ষ ফলপ্রদ। প্রত্নবিদ্যার লক্ষ্য কি, তাহার অনুসন্ধান-পদ্ধতিই বা কিরূপ, তদ্বিষয়ে পুনঃ পুনঃ আলোচনা করাই সেই সহজ উপায়। যাঁহারা সেই উপায় অবলম্বন করিয়া কৃতকাৰ্য্য হইয়াছেন, তাঁহাদের মধ্যে অধ্যাপক ফ্লিণ্ডার্স পেট্রির নাম উল্লেখযোগ্য। তিনি দীর্ঘকাল মিশরে প্রত্নতত্ত্বানুসন্ধানে ব্যাপৃত থাকিয়া এক্ষণে লণ্ডন-বিশ্ববিদ্যালয়ে মিশরতত্ত্বের অধ্যাপনা করিতেছেন। তাঁহার গ্রন্থ* ইংরাজী ভাষায় লিখিত এবং সুলভ হইলেও, আমাদের দেশে সৰ্ব্বজন-পরিচিত হইতে পারে নাই।

এই গ্রন্থের প্রথমেই অধিকার-বিচারের কথা। সকল বিদ্যার অনুশীলনেই অধিকারী-অনধিকারী আছে; কেবল প্রত্নবিদ্যার অনুশীলনেই তাহা নাই এরূপ তর্ক আদৌ উত্থাপিত হইতে পারে না। কিন্তু আমাদের দেশে তাহাই উত্থাপিত হইয়া থাকে। তাহার প্রভাবে যে কেহ লিখিতেছেন,–যাহা ইচ্ছা লিখিতেছেন, অনেক স্থলে নিতান্ত নির্লজ্জের মত লিখিতেছেন! তথাপি তাহা অল্প কথা। শিক্ষার ত্রুটি সারিয়া লওয়া যায়। চরিত্রের ত্রুটি থাকিলে, সহজে সারিয়া লওয়া যায় না। তজ্জন্যই অধ্যাপক পেট্রি অধিকার বিচারে হস্তক্ষেপ করিয়া, চরিত্র-বিচারকেই সৰ্ব্বাগ্রে স্থান দান করিয়াছেন।

সকলের নিকট সমান সত্যনিষ্ঠার আশা করা চলে না। যাহারা করতালিলোলুপ, তাহারা অতি সহজে সত্যনিষ্ঠা হইতে বিচ্যুত হইয়া পড়িতে পারে। যাহারা জীবিকা-লোলুপ, তাহারাও সকল সময়ে, সমান ভাবে সত্যের মর্যাদা রক্ষা করিতে পারে না। ইহা বুঝাইবার জন্য অধ্যাপক পেট্রি লিখিয়াছেন :

সকল বিষয়েই কর্মিগণের মধ্যে একটি মজ্জাগত পার্থক্য দেখিতে পাওয়া যায়। কেহ জীবিকা-লোলুপ,–বাঁচিবার জন্যই কৰ্ম্ম করিতে বাধ্য। কেহ কৰ্ম্ম-লোলুপ, –কৰ্ম্ম করিবার জন্যই জীবন ধারণ করে। প্রথম শ্রেণীর লোকের উদ্দেশ্য পেশাদারী; দ্বিতীয় শ্রেণীর লোকের লক্ষ্য জ্ঞানলাভ বা সৌন্দৰ্য-সম্ভোগ। যে সকল যুবক ব্রাণ্ডি-সোডা পান করে, মনিবকে ঠকাইয়া মিথ্যা খরচ লিখিয়া হিসাবের ফর্দ রচনা করে, অথবা যাহারা কেবল উপাধির দোহাই দিয়া কিম্বা ঐশ্বর্য্যের আস্ফালনে আপন আপন অহমিকার কিম্বা স্বার্থের চরিতার্থতা সাধন করিতে চায়, তাহারা যেন প্রত্নবিদ্যার অনুশীলনক্ষেত্র হইতে দূরে থাকে।

অধ্যাপক-প্রবরের এই উক্তি যতই কঠোর হউক, ইহা শিক্ষাপ্রদ। একে অনুসন্ধানকারীর সংখ্যা অল্প; তাহাতে আবার পেশাদারের সংখ্যাই অধিক। যাহারা পেশাদার নয়, তাহাদের মধ্যেও অনেকে আপন অহমিকার অথবা স্বার্থের চরিতার্থতা সাধনের জন্যই অধিক লালায়িত। এই সকল কারণে, প্রত্নবিদ্যার অনুশীলনে অপরিহার্য অন্তরায়ের অভাব নাই, যাহারা বেতন লইয়া কাজ করে, অথবা দেশের লোকের নিকট চাঁদা কুড়াইয়া কাজ চালায়, তাহাদিগের পক্ষে মনিবের মনোরঞ্জনের লালসা, আত্মপ্রাধান্য সংস্থাপনের লালসা, এবং যে কোনও উপায়ে আত্মপক্ষ সমর্থনের লালসা বড় স্বাভাবিক। তাহারা বিজ্ঞাপন চায়, চাটুকার চায়, যশের ডঙ্কা বাজাইবার জন্য লোক ভাড়া করে; যাহারা একটু চতুর, তাহারা চেলা সংগ্রহ করিয়া, তাহার সাহায্যে আপন অভিমত প্রচারিত করিতে থাকে। এই সকল লোক চাকরী বা ব্যবসায়টা বজায় রাখিবার জন্যই প্রাণপণ করে। ভুল করিলে, ভুল স্বীকার করে না; ভুল দেখাইয়া দিলে, কৃতজ্ঞ না হইয়া, উত্যক্ত হইয়া উঠে। প্রত্নবিদ্যার যাহা হয় হউক, আপন পদমর্যাদা রক্ষা পাইলেই ইহারা কৃত কৃতার্থ হয়; এবং সেই উদ্দেশ্য সাধন করিবার জন্য ভুল করিলেও, বিজ্ঞতার আড়ম্বরে ভুলগুলিকে চাপা দিয়া রাখিতে চায়।

প্রত্নবিদ্যার অনুশীলন বড় ব্যয়সাধ্য। অনেক সময়ে প্রচুর অর্থ ব্যয় করিয়াও ফল হয় না। তথাপি কেবল অর্থের বলে সকল বিষয়ে ফললাভ করিবার আশা নাই, মনস্বিতাই প্রধান অবলম্বন। অনেকে ইহা বিস্মৃত হইয়া, অর্থবলে গ্রন্থ লিখাইয়া লইতে গিয়া কিরূপ গ্রন্থ লাভ করিয়া থাকেন, তাহা আমাদের দেশেও নিতান্ত অপরিচিত নাই।

অনেক শাস্ত্রে অধিকার না থাকিলে, প্রত্নবিদ্যার অনুশীলনে অধিকার লাভ করা যায় না। কিন্তু সকল শাস্ত্রের উপর অভিজ্ঞতার মৰ্য্যাদাই সর্বাপেক্ষা অধিক। যাহাদের অভিজ্ঞতা নাই, তাহারা অভিজ্ঞতা লাভের চেষ্টা করিতে পারে, কিন্তু অভিজ্ঞতা লাভ করিবার পূৰ্ব্বে শিখাইতে বসিলেই, তাহারা পদে পদে ভ্রমপ্রমাদে বিজড়িত হইয়া যাইবে। গৃহে বসিয়া, পুস্তকালয়ে যাতায়াত করিয়া, অথবা অভিজ্ঞগণের সহিত কথাবার্তা কহিয়া, এই অভিজ্ঞতা লাভ করা যায় না। অনুসন্ধানক্ষেত্রে পুনঃপুনঃ পরিভ্রমণ ও পরিদর্শন না করিলে, অভিজ্ঞতা লাভ করা অসম্ভব। অভিজ্ঞতার প্রসাদে দৃষ্টিশক্তি নিপুণতা লাভ করে। অনভিজ্ঞের এবং অভিজ্ঞের পরিদর্শনের মধ্যে পার্থক্য কত অধিক;–পদে পদে তাহার পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়। অধ্যাপক পেট্রি তাহার অনেক উদাহরণ উদ্ধৃত করিয়াছেন।

অভিজ্ঞতা কেবল পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা নয়। ইতিহাসেও অভিজ্ঞতা থাকা আবশ্যক। সাধারণভাবে ইতিহাস পাঠ করিয়া, পরীক্ষোত্তীর্ণ হইয়া, উপাধি লাভ করিলেও কিছু হয় না। অভিজ্ঞের দৃষ্টিতে ইতিহাস অধ্যয়ন করা কর্তব্য। না করিলে, অনেক আবিষ্কৃত তথ্যের প্রকৃত মৰ্ম্ম অপরিজ্ঞাত বা অনাদৃত থাকিয়া যাইতে পারে; অনেক ভ্রান্ত সিদ্ধান্তও প্রকৃত সিদ্ধান্ত বলিয়া গৃহীত হইবার আশঙ্কা থাকে।

অভিজ্ঞতা চাই, নানা শাস্ত্রে অধিকারও চাই। উভয়ের সম্মিলিত শক্তিতেই অনুসন্ধানকারী প্রকৃত সত্য আবিষ্কৃত করিবার আশা করিতে পারেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের দেশে অনভিজ্ঞের সংখ্যাই অধিক। এক হিসাবে সকলেই অনভিজ্ঞ;–কেহ অধিক, কেহ বা অল্প। প্রত্নবিদ্যার যে কোনও বিভাগের আলোচনা করিলেই প্রতি পদে তাহার পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়। সম্প্রতি নবাবিষ্কৃত তন্ত্রশাসনের পাঠোদ্ধার উপলক্ষে তাহা অতিমাত্রায় পরিস্ফুট হইয়া উঠিয়াছে।

সংস্কৃত ভাষায় রচিত যে সকল পুরাতন লিপি আবিষ্কৃত হইয়াছে ও হইতেছে, তাহার আলোচনা করিবামাত্র দেখিতে পাওয়া যায়, এ পর্যন্ত আমাদের দেশের লোকের ব্যক্তিগত চেষ্টায় অল্প লিপিই বিশুদ্ধ ভাবে পঠিত বা ব্যাখ্যাত হইয়াছে। আমাদের দেশের লিপি, আমাদের দেশের ভাষায় রচিত, আমাদের দেশের অক্ষরেই ক্ষোদিত; অথচ বিদেশের লোকেই তাহার পাঠোদ্ধারে ও ব্যাখ্যাকার্য্যে সমধিক সাফল্যলাভ করিয়াছেন ও করিতেছেন! প্রথমে ইহা একটি অনির্বচনীয় ব্যাপার বলিয়াই বোধ হয়। কিন্তু প্রাচীন লিপিতত্ত্বের সম্যক আলোচনা করিলেই জানিতে পারা যায়, আমাদের এরূপ দুর্গতির প্রকৃত কারণ আমাদের মধ্যেই নিহিত রহিয়াছে।

যিনি সংস্কৃত ভাষা জানেন না, জানিবার জন্যও চেষ্টা করেন না, তিনি অক্ষর পাঠে কথঞ্চিৎ শিক্ষালাভ করিলেও, পাঠোদ্ধারে সম্যক কৃতকাৰ্য্য হইতে পারেন না। যিনি সংস্কৃত ভাষায় ব্যুৎপন্ন, অথচ অক্ষরপাঠে অনভ্যস্ত, তিনি ব্যাখ্যাসৌকর্যের লালসায় মনঃকল্পিত পাঠ যোজনা করিতে প্রবৃত্ত হন। ইহা ছাড়া আরও একটি কারণ আছে। তাহা আরও প্রবল কারণ। আমরা সকলেই অল্পাধিক মাত্রায় চিরাগত সংস্কারের পক্ষপাতী, জনশ্রুতির ক্রীতদাস; বংশমর্যাদার ও সম্প্রদায়-মৰ্য্যাদার পৃষ্ঠপোষক। প্রাচীন লিপি হইতে আমাদের সংস্কারের অনুরূপ অর্থের সন্ধান করা আমাদের পক্ষে স্বাভাবিক। প্রাচীন লিপিতে কি আছে, নির্লিপ্ত ভাবে তাহার অনুসন্ধান না করিয়া, আমরা তাহাকে ঘুরাইয়া ফিরাইয়া মনের মত করিয়া বুঝিয়া লইবার জন্যই কষ্টকল্পনার শরণাপন্ন হইয়া পড়ি। পাশ্চাত্য পণ্ডিতবর্গ এই সকল সংস্কারের অতীত। তজ্জন্য তাঁহারা অবিচলিত সত্যনিষ্ঠা রক্ষা করিতে পারেন; নির্লিপ্ত ভাবে পাঠোদ্ধার করিয়া ব্যাখ্যাসাধন করিতে চেষ্টা করেন; তাঁহাদের ভ্রমপ্রমাদ ঘটিলেও, তাহার সঙ্গে অন্য কিছুরই সম্পর্ক থাকে না;–এম স্বীকার করিতেও ইতস্ততঃ ঘটে না।

প্রাচীন লিপিগুলি সকল সময়ে সম্পূর্ণ অক্ষুণ্ণ অবস্থায় প্রাপ্ত হওয়া যায় না। কখন কখন কালপ্রভাবে অনেক অক্ষর বিলুপ্ত হইবার পর, তাহা আমাদের হস্তগত হয়। এই সকল লিপিতে অনেক সমসাময়িক ব্যক্তির বা ঘটনার ইঙ্গিতমাত্রই ব্যক্ত হয়। সুতরাং লিপিকাল স্থির করিতে না পারিলে, যাহা লিখিত আছে, কেবল তাহারই সাহায্যে সকল তথ্য অবগত হইবার উপায় থাকে না। কিন্তু লিপিকাল স্থির করিবার অন্তরায়ের অভাব নাই। অনেক লিপিতেই কোনরূপ সুপরিচিত বা প্রচলিত সম্বৎসরের উল্লেখ থাকে না। কোন কোন লিপিতে রচনাকাল-বিজ্ঞাপক কোন কথাই দেখিতে পাওয়া যায় না; কোন কোন লিপিতে তাক্কালিক রাজার রাজ্যাব্দ মাত্র উৎকীর্ণ থাকে। এরূপ অবস্থায় লিপিপ্রণালীর সাহায্যেই রচনাকাল নির্ণীত হইতে পারে, অন্য উপায় দেখিতে পাওয়া যায় না। তাহা লিপিতত্ত্বের সর্বাপেক্ষা কঠিন সমস্যা। বহুসংখ্যক প্রাচীন লিপির অক্ষর বিন্যাস-প্রণালীর সমালোচনা করিয়া কোন যুগে অক্ষরের এবং মাত্রার আকার কিরূপ ছিল, তাহা স্থির করিয়া লইয়া, তাহারই সাহায্যে লিপিকাল নির্ণয় করিতে হয়। নিতান্ত শিক্ষানবীশের পক্ষে এই কাৰ্য্যে সাফল্য লাভ করা কিরূপ অসম্ভব ব্যাপার, তাহা সহজেই বুঝিতে পারা যায়। যে দুইচারিজন বাঙ্গালী ইহাতে কিয়ৎপরিমাণে অভিজ্ঞতা লাভ করিয়াছেন, তাঁহারা তাঁহাদের অভিজ্ঞতালব্ধ লিপিপাঠবিদ্যাকে কৃপণের ধনের ন্যায় লুকাইয়া রাখেন; দেশের লোককে তদ্বিষয়ে শিক্ষালাভ করিবার সুযোগ প্রদান করেন না! লিপিকরের ব্যক্তিগত লিখনভঙ্গীর প্রভাবে এবং যে প্রদেশে লিপি উৎকীর্ণ হইয়াছিল সেই প্রদেশের প্রচলিত লিপিভঙ্গীর প্রভাবে, একই যুগের লিপিতেও সকল সময়ে সকল স্থানে একরূপ অক্ষরের বা মাত্রার পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায় না। সুতরাং প্রাচীন লিপিপাঠে সাফল্য লাভ করা যে কত কঠিন, তাহা সহজেই বুঝিতে পারা যায়।

প্রাচীন লিপির ন্যায় প্রাচীন মুদ্রা, প্রাচীন দেব-মূৰ্ত্তি, প্রাচীন স্থাপত্যের ধবংসাবশেষ এবং প্রাচীন গ্রন্থাদি হইতেও পুরাকালের বিবিধ বিষয়ের পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়। আমাদের দেশের অধিকাংশ লেখকের নিকটেই মুদ্ৰাতত্ত্ব অপরিজ্ঞাত। তদ্বিষয়ে এখনও আমাদের ভাষায় একখানি গ্রন্থও লিখিত হয় নাই। এ পর্যন্ত যে সকল প্রাচীন মুদ্রা আবিষ্কৃত ও সংগৃহীত হইয়াছে, তাহা পুনঃপুনঃ পরিদর্শন করিবার সুযোগ অনেকের পক্ষেই নিতান্ত দুর্লভ। এরূপ অবস্থায় যাহা হইবার তাহাই হয়, অনভিজ্ঞের হাতে পড়িয়া প্রাচীন মুদ্রা নানা অদ্ভুত সিদ্ধান্ত প্রচারিত করে। প্রাচীন দেব মূৰ্ত্তি লইয়া যাঁহারা সচিত্র প্রবন্ধ লিখিয়া থাকেন, তাঁহারা দুই শ্রেণীতে বিভক্ত, তাহার এক শ্ৰেণী আবার শিল্পসৌন্দর্য্যের উপাসক। দেবমূৰ্ত্তির আলোচনা-বিজ্ঞাপক যে কোনও প্রবন্ধ পাঠ করিলেই বুঝিতে পারা যায়, বিষয়টি যতই মনোজ্ঞ হউক না কেন, তাহার আলোচনা এখনও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে আরোহণ করিতে পারে নাই;–এখনও কল্পনা জল্পনাই প্রাধান্য রক্ষা করিতেছে। সময়ে সময়ে দেবমূর্তির আলোচনায় যে সকল অদ্ভুত সিদ্ধান্ত প্রচারিত হইয়া থাকে, এবং তাহা লইয়া যে সকল বাদ প্রতিবাদের সূত্রপাত হয়, তাহা হইতে অন্তঃসারশূন্য বাঁচালতারই পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়। স্থাপত্যের নিদর্শনগুলির আলোচনা আবার ইহা অপেক্ষাও হাস্যাস্পদ।

আমাদের ইতিহাস নাই। কিন্তু ইতিহাসের অনেক উপাদান ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত ভাবে পড়িয়া রহিয়াছে। তাহার সঙ্কলন ও সমালোচনা করিতে না পারিলে, আমরা উপকার লাভ করিতে পারিব না। তাহাতে সাফল্য লাভ করিতে হইলে, অনধিকার চৰ্চ্চাকে নিরস্ত করা কর্তব্য। পাশ্চাত্য সভ্য সমাজে সে কর্তব্য পালিত হইয়া থাকে। সেখানে যে কোন গ্রন্থ প্রশংসা লাভ করে না। কিন্তু আমাদের দেশে যে কোনও গ্রন্থই প্রশংসা লাভ করে;–যাঁহারা কৃতবিদ্য বলিয়া লব্ধপ্রতিষ্ঠ, তাঁহারাও যে কোনও গ্রন্থেরই ভূমিকা লিখিয়া দেন; পত্র সম্পাদকগণের প্রবন্ধদৈন্যে যে কোনও প্রবন্ধই আগ্রহের সহিত মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয় এবং যে কোনও গ্রন্থের উপর অবলীলাক্রমে পরিষদের মোহর মুদ্রিত হইয়া যায়! এই সকল অত্যাচারে প্রত্ন বিদ্যা নিতান্ত উপহাসের বিষয় বলিয়াই প্রতিভাত হইয়া পড়িতেছে!

কাহাকে মুখ্য প্রমাণ বলিয়া স্বীকার করিতে হইবে, তদ্বিষয়েও আমাদের দেশে মত ভেদের অভাব নাই। যে দেশ ন্যায় শাস্ত্রের পর্যাপ্ত আলোচনার জন্য প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিল, সেই দেশে প্রত্নবিদ্যার আলোচনায় যে সকল বিষয় মুখ্য প্রমাণরূপে উপস্থাপিত হইয়া থাকে, তাহাতে বিস্ময় উপস্থিত হয় না, লজ্জা উপস্থিত হয়। প্রত্নবিদ্যার আলোচনায় এখন আর অন্য কোনও সভ্য দেশে মূর্খতা অতদূর আড়ম্বর প্রকাশ করিতে সাহস করে না। সুতরাং যাহা আমাদের দোষ বলিয়া ধরা পড়িবে, তাহা চিরাভ্যস্ত বা চিরপ্রিয় হইলেও, তাহাকে সৰ্ব্বপ্রযত্নে পরিত্যাগ করিতে হইবে। নচেৎ আমাদের হাতে পড়িয়া প্রত্নবিদ্যা মৰ্য্যাদা লাভ করিতে পারিবে না।

প্রত্নবিদ্যার অনুশীলনে সাফল্য লাভ করিতে হইলে, আমদিগকেও বিবিধ বিদ্যায় পারদর্শী হইয়া, স্বদেশের সর্বত্র তথ্যানুসন্ধানে ব্যাপৃত হইতে হইবে; ন্যায়নিষ্ঠ বিচারপতির ন্যায় প্রমাণ পৰ্যালোচনায় সত্য নির্ণয় করিতে হইবে, এবং যাহা সত্য বলিয়া স্থিরীকৃত হইবে, তাহার উপরেই ইতিহাসের ভিত্তি সংস্থাপিত করিতে হইবে। একের পক্ষে এতগুলি বিদ্যা অধিগত করা অসম্ভব হইলেও, অনেকের সমবেত চেষ্টায় তাহা সম্ভব হইতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশে এখনও প্রত্নবিদ্যানুশীলনে সমবেত চেষ্টার অধিক উদাহরণ প্রাপ্ত হওয়া যাইতেছে না। সমবেত চেষ্টায় সত্য নির্ণয়ে অগ্রসর হইলে, ব্যক্তিগত যশোলিঙ্গাকে বিসর্জন দিতে হয়;–কে কতটুকু সত্য নির্ণয় করিলেন, কে তজ্জন্য কতদূর পরিশ্রম স্বীকার করিলেন, তাহা বিস্মৃত হইতে হয়;–সকলের সমবেত শক্তিতে আলোচনা যতদূর অগ্রসর হইতে পারে, তাহারই পরিচয় প্রদান করিতে হয়। যাঁহারা প্রত্নবিদ্যার কোন কোন বিভাগে কিছু কিছু অভিজ্ঞতা লাভ করিয়াছেন, তাঁহারা সমবেত শক্তিতে তথ্যালোচনায় অগ্রসর হইতেছেন না; যাঁহারা প্রত্নবিদ্যার ক্ষেত্রে প্রথম পদার্পণ করিয়াছেন, তাঁহারাও বিচ্ছিন্ন ভাবেই অন্ধকারে পথ খুঁজিয়া পরিশ্রান্ত হইতেছেন, এবং অনেক সময়ে কল্পনাকে সত্যের আলোক বলিয়া তাহারই অনুসরণ করিতে গিয়া পথভ্রষ্ট হইতেছেন!

বাঙ্গালীর অতীত কাহিনী নিরবচ্ছিন্ন অন্ধকারময় বলিয়া ধরিয়া লইয়া, যাঁহারা বাঙ্গালা দেশের প্রত্নতত্ত্বের অনুসন্ধানে বীতস্পৃহ হইয়া রহিয়াছেন, তাঁহারা যৎসামান্য ক্লেশ স্বীকার করিলেই দেখিতে পাইবেন,–বাঙ্গালীর ইতিহাসেও গৌরব-যুগের অভাব ছিল না। তাহার কথা বিস্মৃতি সাগরে নিমগ্ন হইলেও, একেবারে অতল তলে চিরবিলুপ্ত হইয়া যায় নাই। এখনও বাঙ্গালীর ইতিহাসের অনেক বিবরণ সঙ্কলিত হইবার আশা আছে। বৈজ্ঞানিক প্রণালীতে তথ্যানুসন্ধানে প্রবৃত্ত না হইলে, সে আশা কদাপি সফল হইবে না। তাহার জন্যই সমবেত তথ্যানুসন্ধান-চেষ্টা আবশ্যক।

সাহিত্য, পৌষ, ১৩১৯

* Methods and Aims in Archeology by W. M. Flinders Petrie, D.C.L. L.L.D. Ph. D. & C. [Macmillan & Co. (1904)].

বঙ্গ-পরিচয়

বঙ্গভূমি তাহার বিচিত্র পুরাতত্ত্বের অভ্রান্ত নির্দশনগুলি বুকের মধ্যে ঢাকিয়া রাখিয়া, সৰ্ব্বাঙ্গে এক আধুনিকতার আবরণ বিস্তৃত করিয়া দিয়াছে। সেই আবরণ ভেদ করিয়া, সেকালের বঙ্গভূমির প্রকৃত পরিচয় লাভ করিতে না পারিলে, তাহার ইতিহাস সংকলিত হইবার আশা নাই।

বঙ্গভূমির সঙ্গে ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের সংস্রব যতই অধিক হউক না কেন, তাহার সহিত ভারতবর্ষের বাহিরের নানা দিগেশের সংস্রব নিতান্ত অল্প বলিয়া উড়াইয়া দিবার উপায় নাই। বরং ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল অপেক্ষা বঙ্গভূমির সহিত প্রাচ্য ও উদীচ্য ভূখণ্ডের সংস্রব কোনও কোনও বিষয়ে অপেক্ষাকৃত অধিক ছিল বলিয়াই প্রতিভাত হয়। সুতরাং একমাত্র বঙ্গভূমির সুপরিচিত চতুঃসীমার মধ্যে কোটরাবদ্ধ থাকিয়া, বঙ্গভূমির বিচিত্র ইতিহাসের উপকরণ সংকলনে কৃতকাৰ্য্য হইবার সম্ভাবনা নাই।

স্বাতন্ত্রলিপসা যেন অনাদিকাল হইতে বঙ্গভূমির ইতিহাসের মূলসূত্র নির্দিষ্ট করিয়া আসিয়াছে। আৰ্য্যাবৰ্ত্তের স্থিতিশীল বিধিব্যবস্থা–তজ্জন্যই বঙ্গভূমিতে আসিয়া, গতিশীল হইয়া, স্থান কাল পাত্রের প্রয়োজন অনুসারে নানারূপ পরিবর্তনের অধীন হইয়া পড়িতে বাধ্য হইয়াছে। ভাবের ও কর্মের সমন্বয়সাধনই তাহার উদ্দেশ্য। এই সমন্বয়সাধনের প্রয়োজন যতই অনুভূত হইয়াছে, ততই জাতি, ধর্ম ও লোকাঁচার তদুপযোগী প্রকৃতি-পরিবর্তন করিতে বাধ্য হইয়াছে।

এখানে ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্য-শূদ্ৰাত্মক চাতুব্বর্ণের শাস্ত্রনির্দিষ্ট সুপরিচিত “স্বধর্ম” কোনও কালেই যে যথাশাস্ত্র প্রতিপালিত হইয়াছে, সেরূপ প্রমাণ প্রাপ্ত হইবার উপায় নাই। প্রয়োজন উপস্থিত হইলে, বঙ্গভূমির আর্য্য-সমাজ অনাৰ্য্যসমাজকেও যথাসাধ্য আত্মসাৎ করিতে ত্রুটী করে নাই।

এখানে মানুষ অপেক্ষা মাটীর প্রভাব কিছু অধিক। এখন ভারতবর্ষের বিভিন্নধর্মাবলম্বী, বিভিন্নভাষাভাষী ঔপনিবেশকগণ বিদেশে গিয়া যেমন ভাষা ও ধৰ্ম্মের পার্থক্য সত্ত্বেও, এক পরিবারের ন্যায় এক সুখ দুঃখ ভোগ করিতে করিতে, নানা বিষয়ে এক স্বতন্ত্র শ্রেণীর সমাজ গঠনে ব্যাপৃত হইয়াছেন, সেকালে যাঁহারা আৰ্য্যাবৰ্ত্ত হইতে বঙ্গভূমিতে উপনিবেশ সংস্থাপিত করিতে আসিয়াছিলেন, তাঁহাদের অবস্থাও সেইরূপ হইয়াছিল বলিয়া মনে হয়। তাঁহারা বঙ্গদেশে আসিবার সময়ে যাহা ছিলেন, আসিবার পরে তাহা থাকিতে পারেন নাই। বাঙ্গালার মাটী ও বাঙ্গালার জল তাঁহাদিগকে বাঙ্গালী করিয়া তুলিতে না তুলিতে, তাঁহারা আর্য্য অনাৰ্য্য-সংকুল এক নতুন দেশের নূতন সমাজ গঠিত করিয়া তুলিয়াছিলেন। বাঙ্গালীর ইতিহাস তাহারই ইতিহাস; বাঙ্গালার ইতিহাস সেই সমাজের কর্মভূমির ইতিহাস।

এই স্বাতলোলুপ প্রাচ্য সমাজকে পুনঃপুনঃ আর্যাবর্তের আদিসমাজের সংকীর্ণ গণ্ডীর মধ্যে টানিয়া আনিবার আয়োজনে ত্রুটী হয় নাই; কিন্তু মাটীর গুণে সে আয়োজন পুনঃপুনঃ ব্যর্থ হইয়া গিয়াছে। যাহারা এ দেশের জনসাধারণ, তাহারা যেমন স্বতন্ত্র, সেইরূপ স্বতন্ত্রই রহিয়া গিয়াছে; বরং যাঁহারা তাহাদিগকে পরতন্ত্র করিয়া আৰ্য্যাচারী করিবার আয়োজনে ব্যাপৃত হইয়াছিলেন, তাঁহারও নানা বিষয়ে আদিসমাজের বিধিব্যবস্থা পরিবর্তিত করিয়া, স্বতন্ত্র হইয়া উঠিতে বাধ্য হইয়াছিলেন।

এইরূপে ধীরে ধীরে বহুযুগের ভাবকৰ্ম্মের বিচিত্র সমন্বয়সাধনের-প্রবল প্রভাবে যে দেশের লোক প্রাচ্য ভারতে এক নবরাজ্য-সংস্থাপনে ব্যাপৃত ছিল, কেবল পুরাতন শাস্ত্রবচন ধরিয়া তাহাদের ইতিহাস-সংকলনে কৃতকাৰ্য্য হইবার সম্ভাবনা নাই। শাস্ত্রবচন যখন সমুদ্রযাত্রার প্রবল প্রতিবাদ-প্রচারে সম্পূর্ণ অবসরশূন্য, তখন বাঙ্গালী সমুদ্রপথে নানা দিগদেশে দ্বীপোপদ্বীপে বাণিজ্যের বিজয়-বৈজয়ন্তীহস্তে প্রধাবিত। শাস্ত্রবচন যখন পুরাতন ব্রাহ্মণ্য গৌরবের অকৃত্রিম নিদানস্বরূপ যাগ যজ্ঞাদির মাহাত্ম-কীৰ্ত্তনে গলদঘর্ম, বাঙ্গালী তখন আৰ্য অনার্যের সমন্বয় সাধনোপযোগী বিবিধ মূর্তিপূজার আড়ম্বর প্রচারে ঢক্কানিনাদ করিতে ব্যতিব্যস্ত।

বাঙ্গালীর আচার ব্যবহার ও শিক্ষা দীক্ষা লোকতত্ত্বের সকল স্তরেই স্বাতন্ত্রের ছায়ামূৰ্ত্তি অঙ্কিত করিয়া রাখিয়াছে। বাঙ্গালীকে জানিতে হইলে, গ্রন্থকীট হইলেই, সকল তত্ত্ব-জানিয়া চরিতার্থ হইবার সম্ভাবনা নাই। বাঙ্গালীকে জানিতে হইলে, গ্রন্থ ছাড়িয়া, লোক-তত্ত্বের মূল তথ্যের অনুসন্ধানে ব্যাপৃত হইতে হইবে। তাহার মধ্যেই বাঙ্গালীর ইতিহাসের অকৃত্রিম উপকরণ প্রচ্ছন্ন হইয়া রহিয়াছে। সে উপকরণ দূরে নহে,–নিকটে। তাহা সংকলিত করিবার জন্য যথাযযাগ্য চেষ্টা এখনও ভাল করিয়া আত্মপ্রকাশ করিতে পারে নাই।

পরম্পরাগত চিরসংস্কার যেমন নানা তত্ত্বের সন্ধান প্রদান করিয়া থাকে, আবার সেইরূপ তাহা অনেক বিষয়ে সত্যানুসন্ধানের প্রবল অন্তরায়রূপেও দণ্ডায়মান হইয়া থাকে। বঙ্গভূমিকে আৰ্য্যাবৰ্ত্ত ও বঙ্গসমাজকে আৰ্যসমাজ বলিয়া প্রতিপন্ন করিবার উপযোগী দুই চারিটি বচন সংগৃহীত করা কঠিন নহে; পরম্পরাগত চিরসংস্কারও তাহার পক্ষ সমর্থন করিতে পারে। কিন্তু বঙ্গভূমি আৰ্য্যাবৰ্ত্ত ও বঙ্গসমাজ আৰ্যসমাজ হইলেও, তাহা স্বতন্ত্র দেশ ও স্বতন্ত্র সমাজ রূপেই ইতিহাসে আত্মকাহিনী অভিব্যক্ত করিয়া গিয়াছে;–কোনও কালেই অন্ধবৎ সম্পূর্ণরূপে আৰ্যসমাজের পদাঙ্ক অনুসরণ করে নাই।

যাঁহারা প্রাচ্য ভূখণ্ডে আৰ্যপ্রভাবক্ষেত্র বিস্তৃত করিতে আসিয়াছিলেন, তাঁহারা সংখ্যায় অধিক ছিলেন না। এ দেশে আসিয়া “শনকৈস্তু ক্ৰিয়ালোপাৎ” তাঁহারা “ব্রাত্য” হইয়া পড়িয়াছিলেন। কেহ কেহ আর্যভাষার বিশুদ্ধি-রক্ষায় কথঞ্চিৎ কৃতকার্য হইয়াছিলেন; কেহ কেহ আবার “ম্লেচ্ছবাচঃ” বলিয়াও পরিচিত হইয়াছিলেন। এইরূপ হইবার সম্ভাবনাই স্বাভাবিক। আৰ্য অনার্য্যের প্রথম সংঘর্ষকালে প্রাচ্য ভারতে এইরূপে যে বিচিত্র সংমিশ্রণের সূত্রপাত হইয়াছিল, তাহা হইতেই কালক্রমে সমন্বয়সাধনের প্রয়োজন অনুভূত হইয়া থাকিবে। সেই প্রয়োজন হইতে পৃথক ভাষা–পৃথক আচার ব্যবহার। বহুসংখ্যক অনার্য্যের মধ্যে অল্পসংখ্যক আৰ্যবীরের পক্ষে জ্ঞানবলে, কৌশলবলে যন্ত্রবলে, বা সুপরিচালিত বাহুবলে বিজয় রাজ্য সংস্থাপিত করা সম্ভব হইলেও, বিজিত সমাজের ভাষা ও আচার ব্যবহার সম্পূর্ণরূপে পরাভূত ও পরিবর্তিত করা সম্ভব হইতে পারে না। বরং সেরূপ ক্ষেত্রে বিজেতার পক্ষে আপন ভাষা ও আচার ব্যবহারের পূর্ধ্বতন বিশুদ্ধি রক্ষা করাই অসম্ভব হইয়া পড়ে। যে পরিমাণ নবরাজ্য সুগঠিত করিবার জন্য ভাষা ও লোক-ব্যবহারের পরিবর্তন সাধিত করিবার প্রয়োজন উপস্থিত হয়, সেই পরিমাণে পরিবর্তনের স্রোত প্রবাহিত হয়। বাঙ্গালীর লোক-ব্যবহার এই সকল পরিবর্তনের প্রভাবে ধীরে ধীরে গঠিত হইয়া উঠিয়াছে। তাহার আরম্ভ কোন পুরাতন যুগে, তাহার সীমানানির্দেশের সম্ভাবনা নাই। আর্যাবর্তের আৰ্যসমাজের কেন্দ্রস্থলে তাহার মূল প্রস্রবণ নিহিত হইলেও, বাঙ্গালার সমতল ক্ষেত্রে তাহার সহিত নানা নদ নদীর সলিলসম্ভার মিলিত হইয়া তাহাকে কূলপ্লাবিনী প্রবল বন্যার ন্যায় শক্তিশালী করিয়া তুলিয়াছে। ভাগীরথীকে বুঝিতে হইলে, কেবল গঙ্গোত্রীর ক্ষীণ ধারা ধরিয়া সকল তথ্য লাভ করিবার আশা নাই। বাঙ্গালীকে জানিতে হইলেও, কেবল আৰ্য্যাবর্তের আৰ্যসমাজ ধরিয়া সকল কথা জানিয়া শেষ করিবার সম্ভাবনা নাই।

সাহিত্য, বৈশাখ, ১৩১৭

দেশের কথা ২

সকল দেশেই স্থাপত্যের ও ভাস্কর্যের পুরাতন নিদর্শন ইতিহাসের প্রকৃষ্ট উপাদান বলিয়া সুপরিচিত। আমাদের দেশেও এই শ্রেণীর ইতিহাসের উপাদানের অসদ্ভাব ছিল না। কিন্তু তাহার অধিকাংশই এখন ধবংসস্তূপে সমাধি-নিহিত। তন্মধ্যে কত যুগের কত পুরাকীর্তির নিদর্শন গুপ্তভাবে অবস্থিতি করিতেছে, কেহ তাহার সংখ্যা নির্দেশ করিতে পারেন নাই। এ পর্যন্ত অতি অল্প স্থানেই যথাযোগ্য খনন কাৰ্য্য আরব্ধ হইয়াছে। সুতরাং যাহা ভূপৃষ্ঠে দণ্ডায়মান নাই, তাহা যে কখনও ছিল না, এরূপ তর্ক আমাদের ন্যায় পুরাতন সভ্যদেশের পক্ষে সমীচীন সিদ্ধান্ত বলিয়া গৃহীত হইতে পারে না। কিন্তু কেহ কেহ এরূপ অসমীচীন সিদ্ধান্তের উপর অত্যধিক আস্থা স্থাপন করিয়াই বলিয়া থাকেন,–বঙ্গভূমির নদীমাতৃক সমতলক্ষেত্রের অধিবাসিগণ কোনরূপে পর্ণকুটীর বাঁধিয়াই বাস করিত, তাহাদের দেশে স্থাপত্যবিদ্যা বিকশিত হইবার অবসর লাভ করে নাই বলিয়াই অতি পুরাতন অট্টালিকাদির নিদর্শন দেখিতে পাওয়া যায় না।

বাঙ্গালা দেশের যে সকল স্থান সত্য সত্যই অতি পুরাতন বলিয়া স্পর্ধা করিতে পারে, সেই সকল স্থানেই অতি পুরাতন স্থাপত্য নিদর্শনের সন্ধান করা কর্তব্য। কিন্তু কাল প্রভাবে সেরূপ স্থান এখন সভ্যতার আধুনিক কেন্দ্র হইতে বহু দূরে অবস্থিত; কোনও কোনও স্থান অরণ্যভূমিতে পর্যবসিত। তাহার মধ্যে পুরাকীর্তির নিদর্শনের অনুসন্ধান করিবার জন্য যথাযযাগ্য আয়োজন করিতে পারিলে, এখনও অনেক রহস্য উদঘাটিত হইতে পারে।

বঙ্গভূমির সমতলক্ষেত্রে সহজে প্রস্তর সংগ্রহ করিবার উপায় নাই বলিয়া এ দেশের অধিবাসিগণ যে প্রস্তরনির্মিত অট্টালিকা রচনায় অনভিজ্ঞ ছিল, এরূপ সিদ্ধান্তে আস্থা স্থাপন করিতে সাহস হয় না। বঙ্গভূমির প্রত্যন্ত প্রদেশে পৰ্বতমালার অভাব নাই। সেই সকল পৰ্বতমালা হইতে নানা নদনদী প্রসূত হইয়া বঙ্গভূমিকে উৰ্ব্বরা করিয়া রাখিয়াছে। নদপ্রবাহের অনুসরণ করিয়া পৰ্বতমালা হইতে শিলা সংগ্রহ করা এ দেশের অধিবাসিগণের পক্ষে, আয়াসসাধ্য হইলেও, অসম্ভব ছিল না। সত্য সত্যই যে এই রূপে অনেক প্রাসাদশিলা সংগৃহীত হইত, তাহার অভ্রান্ত নিদর্শন অদ্যাপি বর্তমান আছে।

কোন পুরাতন যুগে বঙ্গভূমিতে প্রস্তরনির্মিত অট্টালিকা-রচনার আয়োজন আরব্ধ হইয়াছিল, এখন আর তাহার পরিচয় লাভের সম্ভাবনা নাই। তাহার যৎকিঞ্চিৎ আভাস লাভ করিতে হইলে, কোন পুরাতন যুগে এ দেশে সভ্যতা-বিস্তারের সূত্রপাত হইয়াছিল, তাহারই অনুসন্ধান করিতে হইবে। বর্তমান যুগে কেবল অর্থবল থাকিলেই প্রস্তুনির্মিত অট্টালিকা গঠিত হইতে পারে। সে কালের অবস্থা এরূপ ছিল না। যে সকল পৰ্বত হইতে শিলা সংগ্রহ করিতে হইত, যে নদীপ্রবাহ অবলম্বন করিয়া তাহা স্বদেশে আনয়ন করিতে হইত, তাহার উপর অপ্রতিহত আধিপত্য রক্ষা করিতে না পারিলে, সমতলক্ষেত্রনিবাসী বাঙ্গালীর পক্ষে শিলাসঞ্চয় করিবার সম্ভাবনা ঘটিত না। সুতরাং বঙ্গভূমিতে শিলানিৰ্মিত পুরাতন প্রাসাদাবলীর যে সকল নিদর্শন দেখিতে পাওয়া যায়, তাহা কেবল বাঙ্গালীর শিল্পকৌশলের পরিচয় প্রদান করিয়াই নিরস্ত হয় না, বাঙ্গালীর অপ্রতিহত বাহুবলের ও শাসন কৌশলেরও পরিচয় প্রদান করে। যে যুগে এই বাহুবল ও শাসন-কৌশল যে পরিমাণে প্রবল ছিল, সেই যুগে সেই পরিমাণে বঙ্গদেশে শিলানিৰ্মিত প্রাসাদাবলী গঠিত হইবার সুযোগ ঘটিয়াছিল। সুতরাং কোন কোন যুগে এরূপ রচনারীতি প্রবর্তিত হইয়াছিল, তাহা জানিতে হইলে বিবিধ শাসন-যুগের ইতিহাসেরও যথাযোগ্য অনুসন্ধান করিতে হইবে।

যে সকল প্রাসাদশিলা এখন ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্তভাবে বর্তমান থাকিয়া পুরাকীর্তির সাক্ষ্য দান করিতেছে, তাহাদের প্রকৃতি-বিচার আরব্ধ হয় নাই। সকল শিলা এক প্রকৃতির নহে,–কোনও শিলা রক্তাভ, কোনও শিলা ধূসর, কোনও শিলা সুচিক্কণ কৃষ্ণবর্ণাত্মক। সকল শিলার উদ্ভবক্ষেত্রও এক স্থানে অবস্থিত ছিল না;–কোনও শিলা হিমালয় হইতে, কোনও শিলা বিন্ধ্যাচল হইতে সংগৃহীত। সকল শ্রেণীর শিলা একই স্থানে দেখিতে পাওয়া যায় না;–কোনও স্থলে এক শ্রেণীর, কোনও স্থলে বা অন্য শ্রেণীর শিলার আতিশয্য দেখিতে পাওয়া যায়।

এই সকল কারণে তথ্যানুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইয়া সহসা কোনরূপ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতে সাহস হয় না। প্রত্যেক স্থানের প্রত্যেক শ্রেণীর শিলার যথাযোগ্য অনুসন্ধান কাৰ্য্য সুসম্পন্ন না হইলে, বিচার কার্য্য আরব্ধ হইতে পারে না। এই আয়াসসাধ্য বিচার কার্যে লিপ্ত হইবার উপযোগী সহিষ্ণুতা না থাকিলে, পদে পদে অপসিদ্ধান্ত দ্বারা পরিশ্রান্ত হইবার আশঙ্কা দূরীভূত হইতে পারে না।

বাঙ্গালার এই সকল প্রাসাদশিলার পর্যবেক্ষণ কার্য্যে যে সকল সাহিত্যিক ব্যাপৃত হইয়াছেন, তাঁহাদের অধ্যবসায় সৰ্ব্বথা প্রশংসাৰ্হ হইলেও, তাঁহাদিগের সম্মুখে বাধা বিপত্তির অভাব নাই। বাঙ্গালার যাহা কিছু নিদর্শন দেখিতে পাইবার সম্ভাবনা আছে, তাহা সমস্তই পরানুকরণলব্ধ,–এইরূপ এক প্রচলিত সংস্কার তথ্যানুসন্ধানের প্রধান অন্তরায় হইয়া দাঁড়াইয়াছে।

তাহার কারণ-পরম্পরার অভাব নাই। ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশে এতদ্বিষয়ে এ পর্যন্ত যাহা কিছু তথ্যানুসন্ধানের আয়োজন হইয়াছে, বাঙ্গালা দেশে এখনও ততটুকু আয়োজনেরও সূত্রপাত হয় নাই। ইহাতে লোকে অন্যান্য প্রদেশে যাহা দেখিয়াছে, তাহাকেই আদর্শ বলিয়া ধরিয়া রখিয়াছে, এবং বঙ্গদেশে যাহা কিছু দেখিতে পাইতেছে, তাহাকে পূৰ্ব্ব-পরিচিত আদর্শের অনুকরণমাত্র মনে করিতে দ্বিধা বোধ করিতেছে না। এইরূপে মগধের ও উৎকলের স্থাপত্য ও ভাস্কৰ্য্য এক অনির্বচনীয় মৰ্য্যাদা লাভ করিয়াছে, এবং বাঙ্গালার স্থাপত্য ও ভাস্কর্য অবলীলাক্রমে তাহারই অনুকরণলব্ধ বলিয়া কথিত হইয়া আসিতেছে।

প্রকৃতপক্ষে বাঙ্গালার স্থাপত্যের ও ভাস্কর্যের মধ্যে বাঙ্গালীর গৌরবের নিদর্শন প্রচ্ছন্নভাবেই বৰ্ত্তমান রহিয়াছে; সমুচিত সমালোচনার অভাবে তাহার প্রকৃতি কিরূপ, তাহা এখনও নির্ণীত হইতে পারে নাই।

যে চতুঃসীমার মধ্যে বাঙ্গালাদেশ অবস্থিত আছে, তাহাই চিরকাল বাঙ্গালীর লীলাক্ষেত্র রূপে সীমাবদ্ধ থাকা সত্য হইলে, বাঙ্গালার অবস্থা স্বতন্ত্র হইত। বাঙ্গালীর বাহুবল ও শাসন-কৌশল চিরকাল বাঙ্গালা দেশের চতুঃসীমার মধ্যে সীমানিবদ্ধ ছিল না;–সময়ে সময়ে আৰ্য্যাবৰ্ত্তের অধিকাংশ স্থানে ব্যাপ্ত হইয়া পড়িয়াছিল। সুতরাং বাঙ্গালীর রচনা-প্রতিভার পরিচয় লাভ করিতে হইলে, বাঙ্গালা দেশের সুপরিচিত চতুঃসীমার বাহিরেও তথ্যানুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইতে হইবে।

একটি মন্দির বা অট্টালিকা কেবল উপাদান-বস্তুর উচ্চপমাত্র নহে,–তাহা দেশ-কাল-পাত্রোচিত ভাবের অভিব্যক্তি বলিয়াই কথিত হইতে পারে। তাহার সন্ধান লাভ করিতে না পারিলে, রচনা-কৌশলের প্রকৃত মৰ্য্যাদা নির্ণয় করিবার উপায় আবিষ্কৃত হইতে পারে না।

এক সময়ে বাঙ্গালা দেশে শিলানিৰ্ম্মিত প্রাসাদের সংখ্যা নিতান্ত অল্প ছিল না। ইষ্টকালয়ের অংশবিশেষ শিলা দ্বারা সুদৃঢ় করিবারও একটি নির্দিষ্ট প্রথা প্রচলিত হইয়াছিল। যে দেশে শিলা নাই, সে দেশে এইরূপে শিলার ব্যবহার কি কারণে প্রাধান্য লাভ করিল, তাহা অবশ্যই সমধিক কৌতূহলের বিষয়।

এই কৌতূহল চরিতার্থ করিবার জন্য তথ্যানুসন্ধানে ব্যাপৃত হইলে, বাঙ্গালীর ইতিহাসের প্রকৃত মৰ্য্যাদার সন্ধান লাভ করিতে পারা যায়। বাঙ্গালী পুরাকালে একটি সম্মানিত মহাশক্তিরূপেই ভারতবর্ষে সুপরিচিত ছিল। সকল বিষয়েই সেই মহাশক্তি নানা স্বাতন্ত্রের পরিচয় প্রদান করিয়াছে, এবং অল্প বিষয়েই অন্ধভাবে পরানুকরণ লইয়া পরিতৃপ্ত থাকিতে সম্মত হইয়াছে।

এখন ভারতবর্ষের মধ্যে বাঙ্গালীর স্বাতন্ত্র যেমন জগদ্বিখ্যাত, পুরাকালেও সেইরূপ ছিল। আর্যাবর্তের অন্যান্য প্রদেশের লোকে যাহাতে হস্তক্ষেপ করিতে সাহস করে নাই, এমন অনেক বিষয়ে বাঙ্গালী সগৌরবে অগ্রসর হইয়া পুরাকালে অতুল কীর্তিতে জন্মভূমির মুখ উজ্জল করিয়া রাখিয়াছিল। কোন কোন বিষয়ের এখনও প্রমাণ সংগ্রহ করিবার সম্ভাবনা আছে, তাহা এখনও আলোচিত হইতেছে না। তাহার প্রধান কারণ এই যে, এখনও ইতিহাসের আলোচনা প্রকৃত মৰ্য্যাদা লাভ করিতে সমর্থ হয় নাই। এখনও অনেকে তাহাকে অকারণ সময়-ক্ষয়ের ব্যসনমাত্র বলিয়াই তাহার প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করিয়া থাকেন।

সাহিত্য, জৈষ্ঠ্য, ১৩১৮

উত্তরবঙ্গের পুরাতত্ত্ব সংগ্রহ

রাজসাহী, মালদহ, দিনাজপুর, জলপাইগুড়ী, রঙ্গপুর, বগুড়া এবং পাবনা জেলা লইয়া আধুনিক “রাজসাহী-বিভাগ” গঠিত। তাহাই “উত্তর-বঙ্গ” নামে কথিত হইয়া থাকে। তাহার কিয়দংশ মিথিলার, কিয়দংশ বরেন্দ্রের এবং কিয়দংশ কমতাবিহারের পুরাতন রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তাহা এক সময়ে পৌণ্ড বর্ধনভুক্তি নামেও উল্লিখিত হইত।

এই বিস্তীর্ণ ভূভাগে যে সকল হিন্দু-বৌদ্ধ কীৰ্তিচিহ্ন বৰ্তমান ছিল, এখনও স্থানে স্থানে তাহার ধবংসাবশেষ দেখিতে পাওয়া যায়। সেই সকল পুরাতন ইষ্টক প্রস্তরগঠিত অট্টালিকা হইতে উপকরণ সংগ্রহ করিয়াই অধিকাংশ মুসলমান মসজেদ নির্মিত হইয়া থাকিবে। ইহা কেবল অনুমানের উপর নির্ভর করে না। এখনও কোন কোন মসজেদে তাহার প্রত্যক্ষ প্রমাণ প্রাপ্ত হওয়া যায়। কোন কোন মসজেদ তাহার পুরাতন দেবস্থানের উপরেই নির্মিত হইয়াছিল। তাহারও নানা নিদর্শন বর্তমান আছে। এ সকল কথা মুসলমান-লিখিত ইতিহাসে গৌরবের সঙ্গেই উল্লিখিত হইয়াছে। যে সকল ইংরাজ-রাজপুরুষ পুরাকীর্তির তথ্যানুসন্ধান করিয়া গিয়াছেন, তাঁহারা সকলেই এ কথা মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করিয়া গিয়াছেন।

এই সকল কারণে, উত্তর বঙ্গের অধিকাংশ স্থানেই হিন্দুবৌদ্ধকীৰ্ত্তি অক্ষত অবস্থায় প্রাপ্ত হইবার সম্ভাবনা নাই। তোরণ, স্তম্ভ এবং প্রস্তুরমূৰ্ত্তির ধবংসাবশেষ মাত্রই দেখিতে পাওয়া যায়। এ পর্যন্ত তাহার বিস্তৃত বিবরণ সংকলনের জন্য কোনরূপ ধারাবাহিক আয়োজন আরব্ধ হয় নাই।

হিন্দুবৌদ্ধ-শাসন সময়ের যে সকল কীৰ্তিচিহ্ন অপেক্ষাকৃত অক্ষতকলেবরে স্বস্থানে বর্তমান আছে, তাহা কেবল দীর্ঘিকা এবং সরোবর। তাহাদের পুরাতন নাম এখনও জনসমাজে প্রচলিত আছে। তন্মধে মালদহের “সাগর দীঘি’, এবং দিনাজপুরের “মহীপাল দীঘি” সাহিত্য সমাজে সুপরিচিত।

উত্তরবঙ্গে এরূপ পুরাতন দীঘি সরোবরের অভাব নাই। কোন কোন সরোবরের সোপানাবলীর ধবংসাবশেষ বৰ্তমান আছে; কিন্তু অধিকাংশ সরোবরেই তাহার চিহ্ন পৰ্য্যন্ত বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে। এই সকল সরোবর উত্তর দক্ষিণে দীর্ঘ;–তাহাই হিন্দুবৌদ্ধ-শাসনকালের পরিচয় বিজ্ঞাপক বলিয়া ঐতিহাসিক-সমাজে সুপরিচিত।

সরোবরতীরে দেবায়তন নির্মাণ করিবার প্রথা ছিল, তজ্জন্য সেকালের অধিকাংশ সরোবর তীরেই দেবায়তন দেখিতে পাওয়া যাইত। এখন তাহা বৰ্ত্তমান নাই। কেবল কোন কোন সরোবর তীরে মুসলমান-মসজেদের ধবংসাবশেষ দেখিতে পাওয়া যায়। তাহা যে পুরাতন দেবায়তনের ইষ্টকপ্রস্তর লইয়াই গঠিত হইয়াছিল, দুই একস্থলে তাহার নিদর্শনও অদ্যাপি দেদীপ্যমান!

উত্তরবঙ্গের কোন কোন স্থানে এইরূপ পুরাতন সরোবর বর্তমান আছে, জনসমাজে তাহা কোন নামে সুপরিচিত, তাহার সহিত কাহার পুণ্যস্মৃতি জড়িত হইয়া রহিয়াছে,সকল স্থলে তাহার বিবরণ সংকলন করিবার উপায় না থাকিলেও, অনেক স্থলে এখনও কিছু কিছু পূৰ্ব্ববিবরণ সংকলিত হইতে পারে।

উত্তরবঙ্গে এই সকল দীঘি-সরোবরের আধিক্য দেখিয়া মনে হয়, মুসলমান শাসন সময়ে নূতন করিয়া সরোবর খনন করাইবার অধিক প্রয়োজন উপস্থিত হয় নাই। এই সকল পুরাতন সরোবর জননিবাসপূর্ণ গ্রাম নগরেই খনিত হইয়াছিল। যেখানেই এরূপ দীঘি সরোবর দেখিতে পাওয়া যায়, তাহার নিকটই–অনেক দূর পৰ্য্যন্ত–পুরাতন গ্রাম নগর বর্তমান থাকিবার পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়। তাহার অনেক স্থল এখন নিবিড় বনে আচ্ছন্ন হইয়া পড়িয়াছে, সেখানে আর জনসমাজের বসতি বৰ্ত্তমান নাই। কেবল সাঁওতালগণ সম্প্রতি বনভূমি পরিষ্কৃত করিয়া, কৃষিকার্যের সূত্রপাত করিতে প্রবৃত্ত হইয়াছে। এই সকল স্থানের জনশ্রুতি পৰ্যন্ত বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে।

তথাপি পুরাতন দীঘি-সরোবরের অনুসন্ধানকার্য্যে প্রবৃত্ত হইলে, সকল শ্রম একেবারে ব্যর্থ হইবার আশঙ্কা নাই। তাহাতে আর কিছু না হউক, পুরাতন গ্রামনগরের অবস্থান সম্বন্ধে অনেক তথ্য লাভ করা যাইতে পারিবে। ইউরোপের কোন কোন স্থান কালক্রমে সমুদ্রগর্ভে এবং ভূগর্ভে নিহিত হইয়া পড়িয়াছিল। তাহার বিলুপ্ত তথ্য আবিষ্কৃত করিবার জন্য এখনও লোকে কত আয়াত স্বীকার করিয়া থাকে। আমাদিগের আবাসস্থলের নিকটে যে সকল পুরাতন গ্রাম নগর এখন বিজন বনভূমিতে পরিণত হইয়াছে, তাহার তথ্যানুসন্ধান করা অপেক্ষাকৃত সহজ ব্যাপার বলিয়াই স্বীকার করিতে হইবে। তথাপি তাহার জন্য যথাযোগ্য আগ্রহ উপস্থিত হইয়াছে বলিয়া বোধ হয় না!

গ্রামনগরের শোভা সম্পাদনের জন্যই এই সকল দীঘি, সরোবর খনিত হইত না। ইহা হইতেই সেকালের বাঙ্গালী স্বাস্থ্য এবং শক্তি লাভ করিত। কেবল কৃষিক্ষেত্রে জল সেচন করিবার উদ্দেশ্যেও অধিক সরোবর খনিত হইত না। নদীবহুল উত্তরবঙ্গের অধিকাংশ স্থানেই বর্ষাকালের প্রবলপ্লাবন নৈসর্গিক নিয়মে ভূমির উর্বরতা সাধন করিত। স্নান তর্পণ এবং পিপাসা শান্তির জন্যই দীঘি সরোবর খনিত হইত। উত্তরবঙ্গের সকল নদনদীর অবস্থাই একরূপ;–তাহা কেবল হিমালয়ের পাদোদক বহন করিবার জন্যই সমুদ্রাভিমুখে ধাবমান! তাহার জলের উপর নির্ভর করিয়া, উত্তরবঙ্গের লোকে স্বাস্থ্য রক্ষা করিতে পারিত না বলিয়াই, দীঘি সরোবর খনন করিতে বাধ্য হইয়া থাকিবে। এখনও উত্তর বঙ্গের অনেক স্থানে নদনদীর জল ব্যবহৃত হয় না। কিন্তু এখন আর সেকালের মত সুবিস্তৃত সরোবর খনিত হইতেছে না।

গৌড়েশ্বরগণ এবং তাঁহাদিগের রাজ্যরক্ষক রাজন্যবর্গ উত্তরবঙ্গের নানা স্থানে যে সকল দুর্গ নির্মাণ করিয়াছিলেন, তাহার অনেক দুর্গ এখনও স্বস্থানে বর্তমান আছে। তাহাদের মৃৎপ্রাচীরের উপরে বৃক্ষলতা অঙ্গবিস্তার করিয়াছে;-পরিখার জল শুষ্ক অথবা শৈবালাকীর্ণ হইয়াছে,–স্থানে স্থানে আধুনিক হলকর্ষণ প্রভাবে দুর্গ প্রাচীরের কিয়দংশ সমতলক্ষেত্রে পরিণত হইতেছে!

কোন কোন দুর্গাভ্যন্তরে এখনও পুরাতন অট্টালিকাদির ধবংসাবশেষ বৰ্ত্তমান আছে; এবং তাহার সহিত কোন না কোনরূপ গ্রাম্য জনশ্রুতি জড়িত হইয়া রহিয়াছে। দুর্গরক্ষার জন্য দুর্গের বাইরে অনেকদূর পর্যন্ত ‘জাঙ্গাল” নামক মৃৎপ্রাচীর গঠিত হইত। কোন কোন স্থানে তাহারও যথেষ্ট নিদর্শন প্রাপ্ত হওয়া যায়। এই সকল “জাঙ্গাল” নানা প্রয়োজন সিদ্ধ করিত শত্রুসেনার আক্রমণবেগ প্রতিহত করিত,জলপ্লাবন হইতে দুর্গমূল রক্ষা করিত,–একস্থান হইতে অন্য স্থানে যাতায়াতের রাজপথ রূপেও ব্যবহৃত হইত। দুর্গের জন্য স্থান নির্বাচনের এবং ‘জাঙ্গালের” জন্য দিঙনির্ণয়ের প্রতি লক্ষ্য করিলে, এখনও সেকালের সামরিক প্রতিভার পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়।

উত্তরবঙ্গের কোন স্থানে কোন পুরাতন দুর্গের ধবংসাবশেষ বৰ্ত্তমান আছে, তাহার তালিকা সংগ্রহ করিযা মাত্র দেখা যাইবে,–এক সময়ে এদেশের অধিবাসিবর্গ আত্মরক্ষার জন্য কিরূপ সামরিক আয়োজন করিতে বাধ্য হইত। তাহার কারণপরম্পরার অভাব ছিল না। উত্তরে পার্বত্য রাজ্য, পূৰ্ব্বে কামরূপের অধিকার, পশ্চিমে মিথিলার পুরাতন জনপদ বর্তমান থাকায়, প্রায় সকল দিক হইতেই উত্তরবঙ্গ পুনঃপুনঃ আক্রান্ত হইত। সুতরাং আত্মরক্ষার জন্যই দুর্গ রচনার প্রয়োজন উপস্থিত হইত।

যাহারা এইরূপে নিয়ত বাহুবলে ‘আত্মরক্ষা করিতে বাধ্য হইত, তাহারা রণভীরু বা কাপুরুষ বলিয়া নিন্দিত হইতে পারে না। যাহারা এই সকল দুর্গপ্রাচীর রচনা করিয়াছিল; তাহারা বাহুবলে মুসলমানের গতিরোধ করিতেও ত্রুটি করে নাই। উত্তর বঙ্গের রাজন্যবর্গ তাহাতে কতদূর কৃতকার্য হইয়াছিলেন, অধ্যাপক ব্লকম্যান তাহার পরিচয় লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন। মুসলমান লিখিত ইতিহাসেও দেখিতে পাওয়া যায়, বক্তিয়ার খিলিজি এবং তাঁহার দিগ্বিজয়ী অনুচরবর্গ লক্ষ্মণাবতীর রাজধানী ছাড়িয়া, উত্তর বঙ্গের সেনানিবাসে,–দেবকোটেই,– অবস্থান করিতে বাধ্য হইতেন! অষ্টাদশ অশ্বারোহীর অলৌকিক দিগ্বিজয় কাহিনীর সহিত ইহার সামঞ্জস্য দেখিতে পাওয়া যায় না।

যাঁহারা ইতিহাসের অস্পষ্ট ছায়া অবলম্বন করিয়া উপাখ্যান নাটকাদি রচনা করিয়া থাকেন, তাঁহারা উত্তর বঙ্গের সকল স্থানেই তাহার পর্যাপ্ত আখ্যানবস্তু লাভ করিতে পারেন। তাঁহাদের চেষ্টা সে পথে ধাবিত হইলে, উত্তর বঙ্গের অনেক পুরাতন দুর্গ বীরবিক্রমের লীলাভূমি বলিয়া জনসমাজে সুপরিচিত হইতে পারিবে।

উত্তরবঙ্গ চিরবিপ্লবের লীলানিকেতন বলিয়া প্রসিদ্ধ। একসময়ে পার্বত্য হুনজাতি উত্তর বঙ্গের উপর আপতিত হইয়া অনেক অনর্থ উৎপন্ন করিত। পালবংশীয় এবং সেনবংশীয় নরপালগণের শাসন সময়েও তাহার কিছু কিছু পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়। কলিঙ্গ-সমর, কাশী-সমর, কামরূপ-সমর উত্তরবঙ্গের পুরাতন ইতিহাসের বিচিত্র বীরত্বকাহিনীতে পূর্ণ হইয়া রহিয়াছে। কখন হিন্দু-বৌদ্ধ-সংঘর্ষ, কখন হিন্দু-মুসলমান সংঘর্ষ উত্তরবঙ্গের পুরা কাহিনীকে রুধিরাক্ত করিয়া রাখিয়াছে! তথ্যানুসন্ধানের অভাবে তাহার সকল কথাই ক্রমে ক্রমে জনসমাজ হইতে বিলুপ্ত হইয়া পড়িতেছে।

এই সকল রাষ্ট্রবিপ্লবে উপর্যুপরি বিপর্যস্ত হইয়া, মুসলমান শাসনকালের অবসান সময়েও, উত্তরবঙ্গের নানা স্থানে যে সকল পুরাতন বৌদ্ধকীৰ্ত্তি অপেক্ষাকৃত অক্ষত কলেবরে স্বস্থানে বর্তমান ছিল, তাহার কথা বিশেষভাবে আলোচিত হইবার যোগ্য। তাহার যথাযোগ্য আলোচনার অভাবে নানা ভ্রান্ত সিদ্ধান্ত প্রচারিত হইবার সুযোগলাভ করিতেছে!

মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহাশয় এসিয়াটিক সোসাইটির প্রসিদ্ধ পত্রিকায় লিখিয়াছেন,–”ভারতবর্ষের অন্যান্য স্থানে বৌদ্ধ ধর্মের ভাগ্যে যাহা ঘটুক না কেন, ভারতবর্ষের পূর্বাংশে বৌদ্ধধর্মকে বড়ই নিদারুণ নির্যাতন সহ্য করিতে হইয়াছিল। এমন কি,–এতদূরও বলা যাইতে পারে,–প্রাচ্যভারত হইতে বৌদ্ধধৰ্ম্ম অগ্নি এবং তরবারি বলেই তাড়িত হইয়া গিয়াছিল!”৬

উত্তরবঙ্গের ইতিহাস এই সিদ্ধান্তের সমর্থন করিতে পারে না। ইহাই প্রকৃত তথ্য হইলে, উত্তরবঙ্গে কোনরূপ অক্ষত বৌদ্ধকীৰ্ত্তি বর্তমান থাকিতে পারিত না। পাল নরপালগণের শাসন সময়ে বৈদিকাঁচারপরায়ণ ব্রাহ্মণগণ প্রধানামাত্যের পদে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন; হিন্দু ধর্মের পুনঃ সংস্থাপনপরায়ণ সেননরপালগণের সময়ে বৌদ্ধ পুরুষোত্তম দেব রাজসভায় সমাদর লাভ করিতেন। লক্ষ্মণসেন দেবের তাম্রশাসনে যে সকল ভূমির চতুঃসীমা উল্লিখিত আছে, তাহার পার্শ্বেই বৌদ্ধবিহার বর্তমান থাকিবার কথাও উল্লিখিত আছে। ইহা কখনও সম্ভব হইতে পারিত না।১০

উত্তরবঙ্গের নানাস্থানের অক্ষত বৌদ্ধমূৰ্ত্তি, প্রস্তরচৈত্য, সাধনগুহা “অগ্নি এবং তরবারি” গ্রয়োগের আখ্যায়িকাকে অলীক বলিয়াই প্রতিপন্ন করিতে পারে। অল্পকাল পূৰ্ব্বেও দিনাজপুরের অন্তর্গত পত্নীতলা থানার অধিকার মধ্যে এই শ্রেণীর একটি প্রস্তরচৈত্য বৰ্তমান ছিল। দিনাজপুরের ভূতপূৰ্ব্ব কালেকটার মিষ্টার ওয়েষ্টমেকট তাহা স্থানান্তরিত করিয়া লইয়া গিয়াছেন। তাহার চিত্রপটের প্রতি দৃষ্টিপাত করিযা মাত্র দেখিতে পাওয়া যাইবে,–”অগ্নি বা তরবারি” তাহাকে স্পর্শ করিবার জন্য একবারও চেষ্টা করে নাই; কোনও আকস্মিক কারণে চৈত্যচূড়া ভাঙ্গিয়া গিয়া থাকিবে, কিন্তু বুদ্ধমূর্তি অক্ষুণ্ণ রহিয়া গিয়াছে এরূপ একটি মাত্র প্রত্যক্ষ প্রমাণ অনেক জল্পনা কল্পনা অপেক্ষা অধিক বিশ্বাসযোগ্য বলিয়া স্বীকৃত হইতে পারে। উত্তরবঙ্গে এরূপ বৌদ্ধচৈত্যের অভাব ছিল না; –যাহা বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে, তাহা যে ‘অগ্নি বা তরবারি” বলে বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে, এরূপ অনুমানের অবতারণা করিবার উপযুক্ত প্রমাণ অদ্যাপি প্রাপ্ত হওয়া যায় নাই যাহা বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে, তাহা রাষ্ট্রবিপ্লবের অপরিহার্য্য পরিণাম বলিয়াই উল্লিখিত হইতে পারে।

বৌদ্ধধর্মের আবির্ভাবকালে যে সংঘর্ষ প্রবল হইয়া উঠিয়াছিল, তাহা শীঘ্রই সামঞ্জস্যসাধনে শান্তি সংস্থাপিত করিয়াছিল। তাহার পর ভগবান বুদ্ধ নারায়ণের অবতাররূপে হিন্দুসমাজেও পূজা প্রাপ্ত হইয়াছেন। বৌদ্ধবিহার শিক্ষা এবং সদাচারের বিশ্রামভূমি বলিয়া পরিচিত ছিল; বৌদ্ধচৈত্য জনসমাজের নিকট সমাদরের সামগ্রী বলিয়া বিবেচিত হইত; বৌদ্ধমূৰ্ত্তি শ্ৰীমন্নারায়ণ মূৰ্ত্তি বলিয়াই হিন্দুসমাজের নমস্য হইয়া উঠিয়াছিল। সুতরাং উত্তরকালের হিন্দু-সমাজের পক্ষে বৌদ্ধাচার তাড়িত করিবার জন্য উত্তরবঙ্গে “অগ্নি বা তরবারি” প্রয়োগের কারণ উপস্থিত হইতে পারে নাই। উত্তরবঙ্গের কোন স্থানেই তাহার জনশ্রুতি পৰ্য্যন্ত বৰ্ত্তমান নাই। বরং সমন্বয় সংস্থাপনের কিছু কিছু পরিচয় অদ্যাপি প্রাপ্ত হওয়া যায়।

বগুড়া জেলার অন্তর্গত বেল আমলা নামক গ্রাম হইতে সম্প্রতি এইরূপ পরিচয় আবিষ্কৃত হইয়াছে। বগুড়ার ডেপুটী কালেক্টার চিরস্নেহাস্পদ শ্রীমান রাজেন্দ্রলাল আচাৰ্য্য বি, এ, তৎসম্বন্ধে একটি সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধ উত্তরবঙ্গ সাহিত্য সম্মিলনের (রঙ্গপুরের) প্রথম অধিবেশন পঠিত হইবার জন্য প্রেরণ করিয়াছিলেন।

বেল আমলা একটি পুরাতন গ্রাম। তথায় কতকগুলি পুরাতন দেবমন্দির বর্তমান আছে। তাহা সমধিক পুরাতন না হইলেও, অনুসন্ধানের যোগ্য বলিয়া, শ্রীমান রাজেন্দ্রলাল তথায় উপনীত হইয়া, গ্রামের মধ্যে একটি পুরাতন চতুর্ভুজা মূৰ্ত্তির সন্ধান লাভ করেন। এই মূর্তি কোনও পুরাতন মন্দির হইতে আনীত হইয়া, গ্রামের মধ্যে রক্ষিত হইয়াছিল। মূর্তিটি প্রস্তরগঠিত; তাহার পাদদেশে পুরাতন অক্ষরের একটি খোদিত লিপি বর্তমান আছে। যতদূর পাঠ করিতে পারা যায়, তাহাতে বোধ হয়–”রাজ্ঞী শ্রীগীতা তারা” লিখিত আছে। হিন্দুদিগের তারামূৰ্ত্তির সহিত এই মূৰ্ত্তির কিছুমাত্র সাদৃশ্য নাই। ইহা বৌদ্ধ তারামূৰ্ত্তি। তাহাকে কখন “অগ্নি বা তরবারি” স্পর্শ করে নাই। গ্রামের নিকটে একটি পুরাতন মন্দির ছিল বলিয়া এখনও জনশ্রুতি বর্তমান আছে। তাহার চিহ্নমাত্রও বর্তমান নাই। কবে কিরূপ ঘটনাসূত্রে সে মন্দির বিলোপ প্রাপ্ত হইয়াছিল, তাহারও তথ্যলাভের আশা নাই। যেখানে মন্দির ছিল, সেখানে এখনও ইষ্টকপ্রস্তরের সমাবেশ দেখিতে পাওয়া যায়। তথায় অনুসন্ধানকার্যে নিযুক্ত হইয়া, শ্রীমান রাজেন্দ্রলাল একখানি খোদিত প্রস্তর প্রাপ্ত হইয়াছেন। তাহা প্রায় সমচতুষ্কোণ;–তাহার উভয় পৃষ্ঠেই নানামূৰ্ত্তি খোদিত আছে।

একপৃষ্ঠে কতকগুলি ক্ষুদ্র বৃহৎ প্রকোষ্ঠ অঙ্কিত আছে। তাহার প্রধান প্রকোষ্ঠে একটি যোগাসনে উপবিষ্ট, চতুর্ভুজ মূৰ্ত্তি;–উপরের দুই হস্তে গদাপদ্ম, নীচের দুই হস্ত জানুবিন্যস্ত,–দেখিবা মাত্র বুঝিতে পারা যায়, বুদ্ধ মূর্তির সহিত দুইটি অতিরিক্ত হস্তযোজনা করিয়া, তাহাকে শ্ৰীমন্নারায়ণ মূর্তিতে পরিবর্তিত করা হইয়াছে! শ্রীমূর্তির পদতলের প্রকোষ্ঠে যে সকল বিচিত্র কারুকার্য খোদিত ছিল, তাহারই অংশবিশেষ পরিবর্তিত করিয়া, একটি গরুড় মূর্তির আভাস প্রদান করিবার চেষ্টা করা হইয়াছে। কিন্তু উভয় পার্শ্বের শীর্ষদেশের প্রকোষ্ঠগুলির অন্যান্য খেদিত মূৰ্ত্তির কোনরূপ পরিবর্তনের চেষ্টা করা হয় নাই। তাহাতেই এই প্রস্তর ফলকের বৌদ্ধকীৰ্ত্তি সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হইতে পারে নাই। শ্রীমূৰ্ত্তির শীর্ষদেশে আর একটি যোগাসনে উপবিষ্ট দ্বিভুজ মূর্তি; দুই দিক হইতে দুইটি হস্তি তাহার মস্তকে জলসেক করিতেছে। ঠিক এইরূপ একটি চিত্র সাঁচি স্কুপের পূৰ্ব্বদ্বারে সংযুক্ত আছে। সুতরাং ইহা যে বৌদ্ধ যুগের কীৰ্তিচিহ্ন, তাহাতে সংশয় নাই। তাহাকে সমন্বয়যুগে নারায়ণবিগ্রহের সহিত সামঞ্জস্য রক্ষার্থ যথাসাধ্য রূপান্তরিত করা হইয়াছে। অপর পৃষ্ঠায় একটি দশদল পদ্ম;–তাহার প্রতি দলে বিষুর দশাবতারের এক একটি চিত্র খোদিত করা হইয়াছে। প্রথমে মৎস্য, তাহার পর যথাক্রমে কল্কি পর্যন্ত অন্যান্য অবতার। নৃসিংহ হিরণ্য কশিপুর উদর বিদীর্ণ করিতেছেন;-বামন ছত্ৰমস্তকে দণ্ডায়মান;-কুঠারহস্তে পরশুরাম; সংগ্রামোচিত পদবিন্যাসে রামচন্দ্র;–হলফলকধারী বলরাম;–যোগীবর বুদ্ধ;–অশ্বারোহী কল্কিদেব–সকলেই যথাযোগ্য আয়ুধাদিতে শোভা পাইতেছেন!

উভয় পৃষ্ঠের শিল্পকৌশলের তুলনা করিলে দেখিতে পাওয়া যায়, দশাবতার অঙ্কনের শিল্পকৌশল অপেক্ষাকৃত নিকৃষ্ট; বুদ্ধমূর্তির সহিত যে দুই খানি অতিরিক্ত হস্ত সংযুক্ত হইয়াছে তাহার শিল্পকৌশলও তদ্রূপ। ইহাতে ধৰ্ম্মসমন্বয়ের সুস্পষ্ট পরিচয় অভি ব্যক্ত হইয়া রহিয়াছে। পালনরপালগণের শাসন সময়ে ধর্মসমন্বয়ে সাধিত হইবার প্রমাণ পরম্পরার অভাব নাই। তাঁহারা মহাভারত পাঠ করাইয়া ব্রাহ্মণদের দক্ষিণা দান করিতেন; মহা সামন্তাধিপতির আবেদনে শ্ৰীমন্নারায়ণ বিগ্রহের স্থাপনার জন্য ভূমিদান করিতেন; এইরূপ নানা প্রমাণ তাম্রশাসনে প্রাপ্ত হওয়া যায়। ইহার সহিত ‘অগ্নি এবং তরবারির” আখ্যায়িকার সামঞ্জস্য নাই!

দিনাজপুরের অন্তর্গত একটি স্থান এখনও “যোগীগুফা” নামে কথিত হইয়া থাকে। সংস্কৃত ‘গুহা”, পালি “কুভা,” উত্তর বঙ্গে ‘গুফা” নামে পরিচিত ছিল। “যোগী গুফা” একটি দর্শনীয় স্থান। সেখানে এখনও অর্চনার অভাব উপস্থিত হয় নাই। সেখানেও বুদ্ধমূৰ্ত্তি নারায়ণ “চতুর্ভুজ” রূপে পরিবর্তিত হইয়াছে। মায়াদেবীর মূর্তি বর্তমান আছে। ভূগর্ভনিহিত “যোগীগুফার” এই সকল অক্ষত বৌদ্ধমূর্তি দর্শন করিয়া, মিষ্টার ওয়েষ্টমেকট তাহার সাক্ষ্যদান করিয়া গিয়াছেন।১২ সেখানেও “অগ্নি এবং তরবারি” প্রয়োগের পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায় না। খেতলাল নামক স্থানে, থানার নিকটে, মায়াদেবীর মূর্ত্তির এবং অন্যান্য বৌদ্ধমূর্তির নিদর্শন প্রাপ্ত হওয়া যায়। লোকে এখনও তাহার অর্চনা করিয়া থাকে।

উত্তরবঙ্গের অনেক স্থান “পাহাড়পুর” নামে কথিত। রাজসাহীর উত্তরাংশে একটি “পাহাড়পুর” নামক স্থানে এখনও প্রায় একশত ফুট উচ্চ একটি বৌদ্ধস্তূপ বর্তমান আছে। মিষ্টার বুকানন হামিলটন এই স্তূপ পরিদর্শন করিয়া, বহুকাল পূৰ্ব্বে তাহার সন্ধান প্রদান করিয়া গিয়াছেন। কিন্তু এ পর্যন্ত তাহার যথাযোগ্য অনুসন্ধান কাৰ্য্য আরব্ধ হয় নাই।১৩

উত্তরবঙ্গের হিন্দুদিগের দ্বারা বিবিধ বৌদ্ধকীৰ্ত্তি প্রকারান্তরে সুরক্ষিত হইবারই পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়;–’অগ্নি বা তরবারি” প্রয়োগে কোনও কীর্তি বিনষ্ট হইবার প্রমাণ প্রাপ্ত হওয়া যায় না।

আমাদের লিখিত ইতিহাস বর্তমান না থাকায়, ইতিহাস রচনার ব্যস্ততা আমাদিগকে তথ্যনির্ণয়ের জন্য অবসর দান করিতে সম্মত হইতেছে না! তাহাতেই আমরা একদেশমাত্ৰ পৰ্যালোচনা করিয়া যে কোনও সিদ্ধান্ত ঐতিহাসিক তথ্যরূপে প্রচারিত করিতেছি! উত্তরবঙ্গের বিবিধ পুরাকীৰ্ত্তির যথাযযাগ্য তথ্যানুসন্ধান ও সমালোচনা সমাপ্ত হইবার পূৰ্ব্বে, বঙ্গভূমির প্রকৃত পুরাবৃত্ত সংকলিত হইতে পারে না। কিন্তু সময় নষ্ট করিয়া, পরিশ্রম স্বীকার করিয়া, অস্বাস্থ্যকর উত্তরবঙ্গের নিবিড় অরণ্যপথে ভ্রমণক্লেশ সহ্য করিয়া, নিপুণভাবে তথ্যাবিষ্কারের জন্য এখনও অধিক লেখক অগ্রসর হন নাই। যাঁহারা ইহাতে প্রবৃত্ত হইবেন, তাঁহারাই নানা বিস্ময় বিজড়িত পুরাতত্ত্বের সন্ধান লাভ করিয়া, কৃতার্থ হইতে পারিবেন।

প্রবাসী, কার্তিক, ১৩১৫

তথ্যসূত্র

১ মহারাজ তোডরমল্লের “জমা তুমারী”-তে সমগ্র বঙ্গদেশ ১৯ সরকারে বিভক্ত হইয়াছিল। তদনুসারে সরকার লক্ষ্মণাবতী, সরকার তাজপুর, সরকার পাঞ্জরা, সরকার ঘোড়াঘাট, সরকার বার্বাকাবাদ, এবং সরকার বাজুহা মধ্যে উত্তরবঙ্গ অবস্থিত।

২ গৌড়ের ধবংসাবশেষের মধ্যে যে সকল পুরাত্ন দীঘি সরোবর দেখিতে পাওয়া যায়, তাহার বর্ণনা করিবার সময়ে মিষ্টার রাভেনশ এই কথাই পুনঃ পুনঃ লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন।

৩ মালদহের “হোমদীঘি” এবং দিনাজপুরের ‘তৰ্পণ দীঘি” ইহার বিশিষ্ট উদাহরণস্বরূপে উল্লিখিত হইতে পারে।

৪ বগুড়ার নিকটবর্তী “মহাস্থান গড়” ইহার বিশিষ্ট নিদর্শনরূপে উল্লিখিত হইতে পারে। তথায় এখনও ‘জাঙ্গাল” বৰ্তমান আছে।

৫ The Rajahs of Northern Bengal were powerful enough to preserve a semi-independence in spite of the numerous invasions from the time of Bakhtiyar Khilji, when Devkote, near Dinajpur, was looked upon as the most important military station towards the North-Prof. Blochmann.

৬ Whatever might have been the fate of Buddhism in other parts of India, in the provinces of Eastern India, it had to suffer serious persecution; nay, it may be said, that Buddhism was expelled from Eastern India by fire and sword.–J.A.S.B. vol. LXIV p.55.

৭ কেবল উত্তরবঙ্গে কেন, প্রশান্ত মহাসাগরের প্রাচ্য দ্বীপপুঞ্জেও বৌদ্ধকীৰ্ত্তির পার্শ্বদেশেই শৈবকীর্তি,–উভয় কীৰ্ত্তিই অক্ষতকলেবরে বর্তমান।

৮ ভট্টগুরবের গরুড় স্তম্ভলিপিতে ইহার অভ্রান্ত প্রমাণ বর্তমান আছে।

৯ লক্ষ্মণসেন দেবের আজ্ঞায় বৌদ্ধ পুরুষোত্তম দেব পণিনীর লৌকিক সূত্রের “ভাষাবৃত্তি” রচনা করিয়াছিলেন; তাহার পঠন পাঠন অল্পদিন পূর্বেও উত্তরবঙ্গে প্রচলিত ছিল।

১০ গৌড়েশ্বর লক্ষ্মণসেন দেবের বিজয় রাজ্যের সপ্তমবর্ষের তৃতীয় ভাদ্রদিনে যে তাম্রশাসন প্রদত্ত হইয়াছিল, তাহা দিনাজপুরের তর্পণদীঘির নিকট অবস্থিত হইয়াছিল। মিস্টার ওয়েস্টমেকট কর্তৃক তাহা ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দের সোসাইটির পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তাহাতে “পূৰ্ব্বে বুদ্ধ বিহারী দেবতা” ইত্যাদি লিখিত আছে। মিষ্টার ওয়েস্টমেকট তাহার অনুবাদ উপলক্ষে লিখিয়া গিয়াছেন–bounded on the East by the eastern ail of the rent free aman and given to the god Buddha Bihari, which is sown with an arha of seed.

১১ এই প্রস্তরচৈত্যের পাদদেশের খোদিত লিপিতে বৌদ্ধবিজয় বিঘোষিত; তাহা অক্ষুণ্ণ অবস্থায় বর্তমান আছে।

১২ At the curious subterranean place of worship called Jogigupha, I saw stone carvings of undoubted Buddhist origin. On one slab, twenty one inches long, was carved Mayadevi, recumbent, with the baby by her side and attendants round her. With it was a slab, 40 inches long, with a relief of Narayana Chaturbhuj bearing the Shankha, gaga, lotus and the disc showing that the Buddhist carving had been preserved by the votaries of a later religion. The carvings were singularly perfect. In a field near the Thanah of khetlal,… I saw carvings corresponding curiosusly with those at Jogigupha. The carvings at Khetlal are four. They are set up in a field as objects of worship. –Westmacott.

১৩ পরম স্নেহাস্পদ শ্রীমান শ্রীরাম মৈত্রেয় আমার উপদেশে নানা ক্লেশে এই স্কুপের উপর আরোহণ করিয়াছিলেন। তিনি ইহার বিবরণ সংকলনের জন্য চেষ্টা করিতেছেন। এইরূপে এক একটি পুরাকীর্তির তথ্যানুসন্ধানের জন্য এক এক জন ভার গ্রহণ করিলে, সহজেই নানা তথ্য সংকলিত হইতে পারে।ক

বাঙ্গালীর জীবন-বসন্তের স্মৃতি-নিদর্শন

বাঙ্গালীর পূৰ্ব্ব কাহিনী বাঙ্গালীর নিকট অপরিচিত। তজ্জন্য বাঙ্গালী এখন সৰ্ব্বতোভাবে বহির্মুখ। আত্মপরিচয়হীন অর্বাচীন উচ্চশিক্ষার অলৌকিক আলোকপুলক তাহাকে বাস্তব অপেক্ষা অবাস্তবের অধিক পক্ষপাতী করিয়া তুলিয়াছে। তাহার নিকট স্বদেশের পুরাকীর্তির ধবংসাবশেষ-কাহিনী–”অরসিকে রহস্যনিবেদনম।” তথাপি তাহার মধ্যেই বাঙ্গালীর জাতীয়-জীবনের গৌরব যুগের প্রকৃত পরিচয় নিহিত হইয়া রহিয়াছে।

সে অনেক দিনের কথা। তখন বাঙ্গালী এক পরাক্রান্ত আত্ম-সাম্রাজ্যের অধীশ্বর ছিল। তাহাই তখন সমগ্র প্রাচ্য-ভূমণ্ডলে আত্মজ্ঞান-মন্দাকিনীর প্রধান প্রস্রবণ বলিয়া প্রতিষ্ঠালাভ করিয়াছিল। বাঙ্গালী কবি কলি-বাল্মীকি সন্ধ্যাকর নন্দী তাহার কেন্দ্রস্থল বরেন্দ্র-মণ্ডলকে “বসুধার শীর্ষস্থান” বলিয়া বর্ণনা করিয়া গিয়াছেন। তাহাকে কবিজন সুলভ অতিশয়োক্তি বলিয়া সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করা সহজ; কিন্তু বরেন্দ্র মণ্ডলের নানাস্থানে যে সকল পুরাকীর্তির ধবংসাবশেষ পড়িয়া রহিয়াছে, তাহা কবি-কল্পনা নহে, প্রত্যক্ষ সত্য;–যেমন সত্য, সেইরূপ বিস্ময়াবহ। পাহাড়পুরের ধবংসাবশেষ তাহার একটি উল্লেখযোগ্য নিদর্শন। এই ‘আগুন ভরা ফাগুন মাসের বসন্ত-সমাগমে” সেখানে পদার্পণ করিতে পারিলে, বাঙ্গালীর জীবন-বসন্তের পরিচয়লাভের সম্ভাবনা আছে। তাহা এখন রচনা লালিত্যহীন ধবংসাবশেষ হইলেও, তাহার সর্বাঙ্গে এক প্রবল পুরুষকার জড়িত হইয়া রহিয়াছে। তাহা কোনও ক্ষণজন্মা মহাপুরুষের ব্যক্তিগত পুরুষকার নহে; বংশপরম্পরাগত জাতীয় অধ্যবসায়পূর্ণ অসামান্য আত্মচেষ্টার অনির্বচনীয় সাফল্য নির্দশন।

শতবর্ষ পূৰ্ব্বে বুকানন-হামিলটন তাহাকে একটি উল্লেখযোগ্য কীৰ্তিচিহ্ন বলিয়া বর্ণনা করিয়া গিয়াছিলেন। প্রায় অর্ধশতাব্দী পূৰ্ব্বে ওয়েষ্টমেকট তাহার খনন কার্য্যের ব্যবস্থা করিবার জন্য পরামর্শ দান করিয়াছিলেন। বাঙ্গালী তৎপ্রতি কর্ণপাত না করিলেও, তাহার অব্যবহিত পরবর্তীকালে কানিংহাম খননকার্য্যের ব্যবস্থা করিতে আসিয়া, বাঙ্গালী ভূস্বামীর নিকট বাধা প্রাপ্ত হইয়া, ক্ষুণ্ণ হৃদয়ে প্রত্যাবর্তন করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতির সদস্যগণ রহস্যোদঘাটনের আশায় একাধিকবার নানাভাবে এই স্থানের পৰ্যবেক্ষণ করিয়াছেন। তথাপি এখনও খননকার্য্যের সূত্রপাত হয় নাই। কারণ, এই বিস্ময়াবহ ধবংসাবশেষ এত বৃহৎ যে, ইহার খনন-কাৰ্য্য অনায়াস সাধ্য বলিয়া কথিত হইতে পারে না। বাঙ্গালা দেশের অন্য কোনও স্থানে এরূপ সুবৃহৎ ধবংসাবশেষ এ পর্যন্ত দেখিতে পাওয়া যায় নাই। এই কারণে ইহা অনন্য সাধারণ। ইহা বহুদূর হইতে পাহাড়ের ন্যায় প্রতিভাত হয়। তজ্জন্যই স্থানের নাম পাহাড়পুর বলিয়া খ্যাতি লাভ করিয়াছে। বরেন্দ্র-মণ্ডলের আরও অনেক স্থান এইরূপ কারণে পাহাড়পুরে নামে পরিচিত। কিন্তু ইহার তুলনায় অন্যান্য পাহাড়পুর অকিঞ্চিৎকর। বহুশতাব্দীর অযত্নসম্ভূত বৃক্ষলতা অবলীলাক্রমে বৃদ্ধিলাভ করিয়া, ইহাকে পাহাড়ের মতই দুর্গম করিয়া রাখিয়াছিল। ১৮৮০ খৃষ্টাব্দে কানিংহামের পরিদর্শন কালে কয়েকটি সরোবর ভিন্ন অন্য স্থান নিবিড় বনে সমাচ্ছন্ন ছিল, প্রাঙ্গণ-মধ্যস্থ বনপাদপগুলি এরূপ বৃহৎ ও ঘনসন্নিবিষ্ট ছিল যে, মানবের পক্ষে তন্মধ্যে প্রবেশলাভের উপায় ছিল না। সম্প্রতি স্থানে স্থানে হলকর্ষণের সূত্রপাত হইয়াছে, কিন্তু প্রাঙ্গণ-মধ্যস্থ মূল অট্টালিকার ধবংসাবশেষ এখনও বিলক্ষণ জঙ্গলাকীর্ণ।

এখানে যাহা ছিল, তাহা আর সে ভাবে বৰ্ত্তমান নাই। তথাপি তাহার ধবংসাবশেষ দর্শনীয় হইয়া রহিয়াছে। এখানে কি ছিল, এবং তাহা কাহার কীর্তি ঘোষণা করিত, তাহার প্রকৃত জনশ্রুতি পৰ্যন্ত বিপর্যস্ত হইয়া গিয়াছে! শতবর্ষ পূৰ্ব্বে যে জনশ্রুতি প্রচলিত ছিল, তাহা ইহাকে “গোপাল-চিতার ভিটা” বলিয়া বিঘোষিত করিত। বুকানন-হামিলটন তাহাই শ্রবণ করিয়াছিলেন। পুরাতন অধিবাসিবর্গের তিরোধানের সঙ্গে সঙ্গে, কিছু দিনের জন্য লোকালয় বিজন বনে পরিণত হইয়াছিল। এখন যাহারা বসতি সংস্থাপিত করিয়াছে, তাহারা নবাগত। তাহাদিগের নিকট এই ধবংসাবশেষ “মৈদল রাজার বাড়ী” বলিয়া পরিচিত। তিনি সত্যপীরের জন্মদাতা বলিয়া কথিত হইয়া আসিতেছেন। এই জনশ্রুতি যে ঐতিহাসিক কালের পরিচয় প্রদান করে, তাহা মুসলমান-শাসনকাল। ধবংসাবশেষটি তাহার বহু পূৰ্ব্ববর্তী কালের স্মৃতিচিহ্ন; তাহা অনায়াসেই বুঝিতে পারা যায়। ইহার চতুর্দিকে পরিখা-চিহ্ন বৰ্ত্তমান না থাকায়, ইহাকে রাজবাড়ী বা রাজদুর্গ বলিয়া অনুমান করা অসঙ্গত। ইহা বরং ধর্মসংক্রান্ত আরাধ্য স্থান বলিয়াই প্রতিভাত হয়। ইংরাজ-রাজপুরুষগণ সেইভাবেই ইহার পরিচয় প্রদান করিয়া গিয়াছেন;-বাহ্যদৃশ্যও তাহারই পক্ষ সমর্থন করে। এই সকল কারণে, আধুনিক জনশ্রুতিকে কাল্পনিক বলিয়া প্রত্যাখ্যান করা যাইতে পারে। কিন্তু শতবর্ষ পূৰ্ব্বে যে জনশ্রুতি প্রচলিত ছিল, তাহাও কাল্পনিক কিনা, তাহার মীমাংসা করা সহজ নহে। বাহ্যদৃশ্য তাহার প্রতিকূল বলিয়া কথিত হইতে পারে না। সে জনশ্রুতি একালের পক্ষে কিঞ্চিৎ অনন্যসাধারণ বলিয়া প্রতিভাত হইলেও, সেকালের পক্ষে কিছুমাত্র বিস্ময়াবহ হইতে পারে না। সেকালের চিতার উপর চৈত্য নির্মাণের প্রথা সৰ্ব্বত্র সুপরিচিত ছিল। এখনও দুই এক স্থান হইতে সে প্রথা সম্পূর্ণরূপে তিরোহিত হয়। নাই।

পাহাড়পুরের চারিক্রোশ মাত্র দূরে আর একটি “ভিটা” দেখিতে পাওয়া যায়। তথায় এখনও প্রতি বর্ষের বৈশাখ মাসের শুক্লা দশমী তিথিতে দেবপাল রাজার নামে পূজা হইয়া থাকে। কানিংহামের নিকট লোকে “দেবপাল রাজাকা ছত্রী” বলিয়া এই স্থানের পরিচয় প্রদান করিয়াছিল। তজ্জন্য তিনি তাহাকে দেবপালদেবের চৈত্যাবশেষ, বলিয়াই বর্ণনা করিয়া গিয়াছেন।

“গোপাল চিতার ভিটা” এইরূপ আর একটি চৈত্যাবশেষ হইলে, ইহাকেও বৌদ্ধকীৰ্ত্তির ধবংসাবশেষ বলিয়া গ্রহণ করিতে হয়। কেবল তাহাই নহে,–ইহাকে পাল-রাজবংশের প্রথম রাজা গোপালদেবের ভস্মাধারপূর্ণ চৈত্যাবশেষ বলিয়া মনে করিবার সম্ভাবনা অধিক হইয়া পড়ে। প্রকৃতিপুঞ্জ “মাৎস্য-ন্যায়” নামক অরাজকতা দূরীকরণের উদ্দেশ্যে গোপালদেবকে রাজপদে নির্বাচিত করিয়াছিল। তাঁহার পুত্র ধর্মপালদেবের খালিমপুরে আবিষ্কৃত তাম্রশাসনে ইহার স্পষ্ট প্রমাণ প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে। একথা এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যগ্রন্থেও সন্নিবিষ্ট হইয়াছে। গোপাল ও তাহার বংশধরগণ বৌদ্ধধর্মাবলম্বী ছিলেন। তাঁহারাই মধ্যযুগে বৌদ্ধধর্মের প্রধান আশ্রয়স্থল ছিলেন; সে কথা তিববতীর গ্রন্থে সুপরিচিত। নারায়ণপালদেবের সময় হইতে মদনপালদেবের সময় পর্যন্ত পালরাজগণের যে সকল তাম্রশাসন এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হইয়াছে, তাহার প্রত্যেক শাসনের প্রথম শ্লোকে গোপালদেব দ্বিতীয় “দশবল লোকনাথ” বলিয়া উল্লিখিত। রাজকবি তাঁহার সহিত ভগবান বুদ্ধদেবের তুলনাকে সৰ্বাংশে সফল করিবার অভিপ্রায়ে, শ্লিষ্ট কবিতার অবতারণা করিয়াছিলেন;–তাহার এক অর্থ ভগবান লোকনাথকে, অন্য অর্থ গোপালদেবকে সূচিত করিতে পারে। যথা,

মৈত্রী স্কারুণ্যরত্ন-প্রমুদিতহৃদয়ঃ প্রেয়সীং সন্দধানঃ

সম্যক-সম্বোধিবিদ্যা-সরিদমলজল-ক্ষালিতাজ্ঞানপঙ্কঃ।

জিত্বা যঃ কামকারি প্রভবভিভবং শাশ্বতীং প্রাপ শান্তিং

স শ্রীমাল্লোকনাথো জয়তি দশবলোইন্যশ্চ গোপালদেবঃ।

“যিনি কারুণ্যরত্ন-প্রমুদিত হৃদয়ে মৈত্রীকে প্রিয়তমারূপে ধারণ করিয়াছিলেন, –যিনি তত্ত্বজ্ঞান-তরঙ্গিণীর সুবিমল সলিলধারায় অজ্ঞানপঙ্ক প্রক্ষালিত করিয়াছিলেন, তিনি কামক [কামদেব] অরির [পরাক্রমসজ্ঞাত] আক্রমণ পরাভূত করিয়া শাশ্বতী শান্তি লাভ করিয়াছিলেন,–সেই শ্রীমান দশবল লোকনাথের জয় হউক।

এবং

“যিনি করুণারত্নেদ্ভাসিত-বক্ষে [প্রজাবর্গের] মিত্ৰতা ধারণ করিয়া,–সম্যক সম্বোধ-প্রদায়িনী জ্ঞানতরঙ্গিণীর সুবিমল সলিলধারায় [লোক সমাজের] অজ্ঞান-পঙ্ক প্রক্ষালিত করিয়া,–[দুৰ্ব্বলের প্রতি অত্যাচারপরায়ণ স্বেচ্ছাচারী] কাম-কারিগণের [পরাক্রমসজ্ঞাত-মাৎস্যন্যায়ের] আক্রমণ পরাভূত করিয়া [রাজ্য মধ্যে] চিরশান্তি সংস্থাপিত করিয়াছিলেন, সেই শ্রীমান গোপালদেব নামক অপর [রাজাধিরাজ] লোকনাথেরও জয় হউক।

গোপালদেবের পুণ্যস্মৃতিকে চিরস্মরণীয় করিবার অভিপ্রায়ে, তাঁহার বংশধরগণ রাজশাসন-লিপিতে এই শ্লোক সন্নিবিষ্ট করাইয়াছিলেন। গোপালদেবের পুত্র ধর্মপালদেব সমগ্র আর্যাবর্তে আত্মপ্রভাব সুবিস্তৃত করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। তিনি কি পিতার চিতাভস্ম সংরক্ষণের যথাযোগ্য আয়োজন করিয়াছিলেন না? “গোপাল-চিতার ভিটা” কি তাহারই ধবংসাবশেষ হইতে পারে? এই প্রশ্ন বহুপূৰ্বেই উত্থাপিত হইতে পারিত। কিন্তু পাহাড়পুরের ধবংসাবশেষ আদৌ একটি বৌদ্ধ-কীৰ্ত্তির নিদর্শন কি না, তাহা লইয়াই তর্ক-বিতর্ক প্রচলিত হইয়াছিল।

ধবংসাবশেষের বাহ্যদৃশ্য ধরিয়াই তর্ক-বিতর্কের সূত্রপাত হয়। বুকানন হামিলটন তাহার যেরূপ বর্ণনা লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছিলেন, তাহাতে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মভাবে মাপকাঠি ব্যবহৃত হইবার পরিচয় প্রাপ্ত না হইয়া, কানিংহাম তাহার যথাযোগ্য মর্যাদা রক্ষা করেন নাই। তাঁহার নিজের গ্রন্থে মাপকাঠির সাহায্যে আয়তনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম পরিচয় প্রকাশিত হইলেও, তাঁহার সহিত বুকানন হামিলটনের মূল বর্ণনার অধিক পার্থক্য দেখিতে পাওয়া যায় না। কিন্তু উভয়ের সিদ্ধান্তের মধ্যে আকাশ পাতাল প্রভেদ!

কানিংহাম লিখিয়া গিয়াছেন,–”এই বৃহৎ ধবংসস্তূপ একটি বৃহৎ প্রাঙ্গণের মধ্যস্থলে দণ্ডায়মান রহিয়াছে। প্রাঙ্গণের বহির্ভাগে ১৫০০ ফুট দীর্ঘ পার্শ্ববিশিষ্ট একটি চতুর্ভুজক্ষেত্ৰ-বেষ্টনী দেখিতে পাওয়া যায়;– তাহা বিপুলায়তন মৃৎপ্রাচীরে গঠিত হইয়াছিল। তাহার পূর্বদিকের বিস্তার ১৫০ ফুট,–অন্যান্য দিকের বিস্তার ১০০ ফুটের অধিক হইবে না। এই প্রাঙ্গণের মধ্যস্থলে অবস্থিত ধবংসাবশেষটির উচ্চতা ১০০-১৫০ ফুট হইতে পারে বলিয়া বুকানন-হামিলটন অনুমান করিয়ছিলেন। কানিংহাম মাপিয়া ঠিক করিয়া গিয়াছেন, প্রকৃত উচ্চতা ৮০ ফুট মাত্র। তিনি ইষ্টকের আয়তন ধরিয়া গণনা করিয়া লিখিয়া গিয়াছেন,–অট্টালিকাটি যখন অক্ষত কলেবরে দণ্ডায়মান ছিল, তখন তাহার উচ্চতা ঠিক ১০০ ফুট ছিল। তাহা যেরূপ বৃহৎ সেইরূপ সুন্দর ছিল। কারণ,–তাহার বহির্ভাগ কারুকার্যখচিত ইষ্টকসজ্জায় সুসজ্জিত ছিল। তাহার প্রমাণরূপে কানিংহাম একখানি ইষ্টকচিত্রও মুদ্রিত করিয়া গিয়াছেন।

বুকানন হামিলটন এই অত্যুচ্চ বাহ্যদৃশ্য দেখিয়া, ইহাকে হিন্দু-দেবমন্দিরের ধবংসাবশেষ বলিয়া মনে করিতে পারেন নাই; এবং কেন পারেন নাই, তাহার কারণ বুঝাইয়া দিয়া গিয়াছেন। তাহা সকলের নিকটই যুক্তিসঙ্গত বলিয়া প্রতিভাত হইবার যোগ্য। হিন্দু-দেবমন্দিরের অভ্যন্তরে “গর্ভ” নামক কক্ষ দেখিতে পাওয়া যায়। হিন্দু-দেবমন্দির ধবংসপ্রাপ্ত হইলে ভিতরে ভাঙ্গিয়া পড়ে; বাহিরে অধিক উচ্চতা রক্ষা করিতে পারে না। সুতরাং পাহাড়পুরের প্রাঙ্গণ-মধ্যস্থ ধবংসাবশেষের অত্যধিক উচ্চতাই তাহাকে গর্ভশূন্য বৌদ্ধস্তূপের ধবংসাবশেষ বলিয়া প্রতিভাত করে। ধবংসাবশেষের যে অংশ প্রাচীর-সংলগ্ন, তাহা অতি বিস্তৃত, অথচ বিস্তৃতির অনুপাতে উচ্চতা রক্ষা করিতে পারে নাই। তজ্জন্য তাহা প্রাচীর-সংলগ্ন কক্ষসমূহের ধবংসাবশেষ বলিয়াই প্রতিভাত হয়। বোধ হয় এই কারণে ওয়েষ্টমেকট তাহাকে ভিক্ষুগণের আবাস-কক্ষের ধবংসাবশেষ বলিয়া অনুমান করিয়াছিলেন। এ সকল কথার যথাযোগ্য আলোচনা না করিয়া, কানিংহাম পাহাড়পুরের ধবংসাবশেষকে “ব্রাহ্মণ্য দেবালয়ের “ধবংসাবশেষ বলিয়া সিদ্ধান্ত করিয়াছিলেন। তিনি যে সকল কারুকার্যখচিত ইষ্টকখণ্ড কুড়াইয়া পাইয়াছিলেন, তাহার একখণ্ডে একটি কৃশোদরী কালী-মূৰ্ত্তি অঙ্কিত ছিল মনে করিয়া, তাহার উপর নির্ভর করিয়াই, এরূপ সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছিলেন। এরূপ একখণ্ড ইষ্টক প্রাপ্ত হইয়া থাকিলে, তাহার চিত্র মুদ্রিত করাই কৰ্ত্তব্য ছিল। কিন্তু তাহাও নিতান্ত অপ্রচুর প্রমাণ বলিয়া বিবেচিত হইত। এই সকল কারণে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতায় কানিংহামের এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করিয়া, পাহাড়পুরের ধবংসাবশেষকে বৌদ্ধ-কীৰ্ত্তির ধবংসাবশেষ বলিয়া ব্যক্ত করিতে বাধ্য হইয়াছিলাম। ইহা যে সত্যসত্যই বৌদ্ধ-কীৰ্ত্তির ধবংসাবশেষ, এতদিন পরে তাহার সংশয়শূন্য শিলালিপি আবিষ্কৃত হইয়াছে।

পাহাড়পুরের ধবংসাবশেষ হইতে ইষ্টক আহরণ করিবার চেষ্টা প্রচলিত হইয়াছে। বরেন্দ্রমণ্ডলের অনেক স্থানেই পুরাতন ইষ্টক আহরণের পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়। উত্তরবঙ্গ রেলপথ প্রস্তুত হইবার সময়ে, অনেক স্থান হইতে ইষ্টক আহৃত হইয়াছিল। রেলওয়ের সাহেবগণ পাহাড়পুরেও পদার্পণ করিয়াছিলেন। পাহাড়পুরের ধবংসস্তূপ যে গর্ভহীন ইষ্টকস্তূপ, তাঁহারা কানিংহামক সে সমাচার প্রদান করিয়াছিলেন। কেবল তাহাই নহে; কানিংহামের আগমনের কয়েক বৎসর পূৰ্ব্বে ঘনশ্যাম নামক এক ব্যক্তি স্থূপের খননকার্য্যে প্রবৃত্ত হইয়াছিল। তাহাতেও ধবংসাবশেষটি গর্ভশূন্য ইষ্টকস্তূপ বলিয়াই প্রতিভাত হইয়াছিল। ঘনশ্যাম যেস্থান খনন করিয়াছিল, তথায় ইষ্টকরাশির মধ্যে একখণ্ড সুবৃহৎ প্রস্তরের কিয়দংশ বাহির হইয়া পড়িয়াছিল। তাহার পূর্বেও কতকগুলি প্রস্তরনিৰ্মিত দ্বার-শাখা বাহির হইয়াছিল। সুতরাং ধবংসাবশেষ-নিহিত অট্টালিকাটি যে ইস্তক-প্রস্তরে নির্মিত হইয়াছিল, তাহার প্রমাণ প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছিল। কিন্তু কানিংহাম যাহাকে মৃৎপ্রাচীর বলিয়া বর্ণনা করিয়া গিয়াছেন, তাহার অভ্যন্তরেও কোনরূপ প্রস্তর বা কক্ষ নিহিত আছে কি না, পূর্বে তাহার কোনও পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায় নাই। প্রাচীরের ধবংসাবশেষ পৰ্যবেক্ষণ করিলে, কোন কোন স্থানে ইষ্টকনিৰ্মিত ভিত্তির ধবংসাবশেষ বর্তমান থাকা সম্ভব বলিয়া বোধ হইত। সম্প্রতি ইষ্টক-প্রাচীরের সন্ধান প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে। গ্রামের লোকে তাহা হইতে ইচ্ছামত ইষ্টক সংগ্রহ করিতেছে। প্রাঙ্গণমধ্যস্থ মূল অট্টালিকার ধবংসাবশেষ হইতে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে, চারি পাঁচ রশি ব্যবধানে অবস্থিত প্রাচীর হইতে এইরূপে ইষ্টক আহরণের চেষ্টা করিতে গিয়া, পাহাড়পুর নিবাসী সমীর সোণার একটি প্রস্তর-স্তম্ভের কিয়দংশ প্রাপ্ত হয়। উহা একটি অষ্টকোণ সমন্বিত “বজ্র” শ্রেণীর স্তম্ভের অগ্রভাগ। তাহাতে চারি পংক্তি ক্ষোদিত লিপি দেখিতে পাওয়া গিয়াছিল। বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতির সদস্য শ্ৰীমান শ্রীরাম মৈত্রেয় তাহার সন্ধান লাভ করিয়া, লিপিযুক্ত স্তম্ভাংশটি সমিতির সংগ্রহালয়ে পাঠাইয়া দিয়াছেন। তাহাই পাহাড়পুরের ধবংসাবশেষকে বৌদ্ধকীৰ্ত্তির নিদর্শন বলিয়া পরিচয় প্রদান করিয়াছে। যথা,

শিলালিপি

১ ওঁ রত্নত্রয়-প্রমোদেন। ২ সত্বানাং হিত কাংক্ষয়। ৩ শ্ৰীদশবলগর্ভেন। স্ত ৪ ম্ভোয়ঙ্কারিতে বরঃ।

অনুবাদ

ত্রিরত্নের [ধৰ্ম্ম-বুদ্ধ-সঙেঘর] প্রমোদসাধনার্থ, জীবসমূহের কল্যাণাকাঙ্ক্ষায়, শ্রীদশবলগর্ভ নামক ব্যক্তি কর্তৃক এই উৎকৃষ্ট স্তম্ভ নির্মাণ করান হইয়াছে।

টীকা

শিল্পী এই অনুষ্ঠুভের প্রত্যেক চরণের শেষে বিরাম চিহ্ন ক্ষোদিত করিয়াছিলেন। দশবল শব্দটি প্রথমে ‘দসবল’-রূপে ক্ষোদিত হইয়া, পরে সংশোধিত হইয়াছিল বলিয়া প্রতিভাত হয়। “প্যাগ-সাম-জন-জঙ্গ” নামক তিববতীয় গ্রন্থে বৌদ্ধগণের নামের মধ্যে দশবলী, কমলগর্ভ, পদ্মগর্ভ, আনন্দগর্ভ প্রভৃতি নামের পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়। লিপি-প্রণালী দেখিয়া, ইহাকে খৃষ্টীয় একাদশ শতাব্দীর লিপি বলিয়া অনুমান করিতে পারা যায়।

এই স্তম্ভ-লিপি নিতান্ত সংক্ষিপ্ত হইলেও, উপাদেয় ঐতিহাসিক তথ্যের আধার। ইহাতে কোনও অট্টালিকা নির্মিত হইবার পরিচয় উল্লিখিত হয় নাই, কেবল একটি প্রস্তর-স্তম্ভ নির্মিত হইবার কথাই ক্ষোদিত রহিয়াছে। তাহাতে বুঝিতে পারা যায়,–দানপতি দশবলগর্ভ পুণ্যস্থানের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের অভিপ্রায়ে সৰ্ব্বসত্ব হিতাকাঙ্ক্ষা-প্রণোদিত হৃদয়ে এই প্রস্তর-স্তম্ভটি উৎসর্গ করিয়াছিলেন। যে পুণ্যস্থানে এ পূণ্যকর্ম সম্পাদিত হইয়াছিল, তথায় পূৰ্ব্ব হইতেই অট্টালিকাদি বর্তমান না থাকিলে, এরূপ স্তম্ভোৎসর্গ-ব্যাপার সুসঙ্গত বলিয়া প্রতিভাত হইতে পারে না। সুতরাং খৃষ্টীয় একাদশ শতাব্দীর পূৰ্ব্ব হইতেই পাহাড়পুরে অট্টালিকাদি নির্মিত হইয়া থাকিতে পারে।

রত্নত্রয়ের প্রমোদ-বিধানার্থ এই প্রস্তর-স্তম্ভটি উৎসর্গীকৃত হইয়াছিল। ইহা সাধারণভাবে বৌদ্ধধর্মানুরাগের পরিচয় প্রদান করিতেছে। বিশেষভাবে বিচার করিয়া দেখিলে, ইহাকে একটি ত্রিরত্ন-মন্দিরে ব্যবহৃত হইবার উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত প্রস্তর-স্তম্ভ বলিয়াও অনুমান করা যাইতে পারে। কিন্তু এই প্রস্তরস্তম্ভের আবিষ্কার স্থানের খননকার্য সুসম্পন্ন না হইলে ইহার প্রকৃত তথ্য প্রকাশিত হইতে পারে না। তথাপি ইহাকে আপাততঃ কেবল বৌদ্ধধর্মানুরাগ-সূচক সাধারণ ভাবের স্তম্ভলিপি বলিয়া গ্রহণ করিলেও, ইহার সাহায্যে সেকালের লোকসমাজের আশা আকাঙ্ক্ষার আভাস প্রাপ্ত হওয়া যায়; এবং তাহার সহিত একালের লোকসমাজের আশা-আকাঙ্ক্ষার পার্থক্য বিচার করিবারও সন্ধান প্রাপ্ত হওয়া যায়।

যে ধর্মবিশ্বাস বা লোকব্যবহার এই শ্রেণীর দান-কর্মের উৎসাহদান করিত, তাহা সৰ্ব্বসত্ব-হিতাকাঙ্ক্ষাকেই দানের সৰ্ব্বপ্রধান লক্ষ্য করিবার উপদেশ দান করিত। ইহাতে যেরূপ শিক্ষা-দীক্ষার পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়, তাহা বহির্মুখী নহে, –অন্তর্মুখী;–তাহার নিকট আত্মসম্ভোগ অপেক্ষা আত্মত্যাগ অধিক আদরণীয়, –আত্মহিতাকাঙ্ক্ষা অপেক্ষা সৰ্ব্বসত্ব-হিতাকাঙ্ক্ষা অধিক প্রার্থনীয় ছিল। তাহার মর্মে মর্মে যে মর্মবাণী কলগুঞ্জনে আত্মপ্রকাশ করিত, তাহা পরকে আপন করিতে চাহিত,–আপনকে পর করিয়া তুলিত না,–যেন দিগন্ত-সম্প্রসারিত বাহুযুগলের আকুল আবেষ্টনের মধ্যে বিশ্ব-সংসারকে টানিয়া আনিবার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করিত। তাহার জন্যই ধর্মভেদ, জাতিভেদ, অবস্থাভেদ, অভ্যুদয় লাভের অন্তরায় না হইয়া, বাঙ্গালীকে দীর্ঘকালস্থায়ী বিপুল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা-সাধনের শক্তিদান করিয়াছিল। সে সাম্রাজ্য-কাহিনী আত্মজয়-কাহিনী। তাহার জনশ্রুতি পৰ্য্যন্ত বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছিল। আধুনিক তথ্যানুসন্ধানের ফলে তাহার যাহা কিছু পরিচয় প্রকাশিত হইতেছে, তাহাতে এই এক তথ্যই নানাভাবে পরিস্ফুট হইয়া উঠিতেছে। সে বিপুল সাম্রাজ্যের শৌর্য-বীৰ্য্য-ঐশ্বৰ্য্য মানব-চরিত্রকে দানব-চরিত্রে পরিণত করিয়া ধবংসলীলার প্রশ্রয়দান করিত না;–গঠন-প্রতিভার উন্মেষসাধনে মানব চরিত্রকে দেব-চরিত্রে সমুন্নত করিয়া, অজ্ঞানকে জ্ঞান দান করিত, মুমূর্যকে সঞ্জীবিত করিয়া তুলিত, সবলের প্রবল পীড়ন হইতে দুৰ্বলকে রক্ষা করিবার জন্য আত্ম বিসৰ্জন করিত। যেখানে দুষ্ট-দলনের জন্য মমতাশূন্য বাহুবল প্রযুক্ত হইত, সেখানেও ব্যবহারগুণে অল্পদিনের মধ্যে পরাজিত শত্ৰু অন্তরঙ্গ মিত্রপদবী লাভ করিতে পারিত।

যেখানে এই স্তম্ভলিপি আবিষ্কৃত হইয়াছে, তাহা রাজসাহী জেলার বদলগাছি থানার অন্তর্গত, উত্তরবঙ্গ রেলপথের জামালগঞ্জ অথবা আক্কেলপুর ষ্টেশনের তিন মাইল মাত্র দূরে অবস্থিত। এই অঞ্চলটি এখনও পাল-রাজগণের শাসন সময়ের বিবিধ কীর্তি-চিহ্নের ধবংসাবশেষে, খচিত হইয়া রহিয়াছে। ইহার আট ক্রোশ দূরে ভট্টগুরবের গরুড়-স্তম্ভ স্বস্থানে প্রতিষ্ঠিত আছে। বৌদ্ধ রাজবংশের ব্রাহ্মণ-মন্ত্রিবংশ কিরূপ মন্ত্রণাশক্তি-প্রভাবে বাঙ্গালীর জীবন-বসন্তে সাম্রাজ্য বিস্তারের সহায়তা-সাধন করিয়াছিল, ইহাতে তাহার গৌরব-গাথা ক্ষোদিত হইয়া রহিয়াছে। এরূপ বিপুল সাম্রাজ্যের শিক্ষা কেন্দ্র জগদ্দল-মহাবিহারের নাম পুনরায় বাঙ্গালীর নিকট সুপরিচিত হইয়াছে। এই মহাবিহার ব্যতীত বরেন্দ্রমণ্ডলে আরও বহুসংখ্যক বিহার লোকশিক্ষার অধিষ্ঠান বলিয়া পরিচিত ছিল। তাহার অনেকগুলির ধবংসাবশেষ বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতির অনুসন্ধান-চেষ্টায় ক্রমে ক্রমে আবিষ্কৃত হইতেছে। পাহাড়পুরের আড়াই ক্রোশ দক্ষিণে এইরূপ একটি বিহারের ধবংসাবশেষ আবিষ্কৃত হইয়াছে; তাহা এখনও “হলুদ-বিহার” নামে পরিচিত। পাহাড়পুরের আধুনিক নিরক্ষর অধিবাসিবর্গের বিশ্বাস, সত্যপীরের অভিশাপে পাহাড়পুরের উচ্চস্তূপের উন্নত মস্তকটি উড়িয়া গিয়া হলুদ-বিহারে পতিত হইয়াছিল। উভয় স্থানের মধ্যে এক সময়ে যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল, এই জনশ্রুতি তাহারই আভাস প্রদান করে। ইহার মধ্যে অনেক ঐতিহাসিক তথ্য নিহিত হইয়া রহিয়াছে। খনন-কাৰ্য্য সুসম্পন্ন না হইলে, তাহার পূর্ণ পরিচয় উদ্ভাসিত হইতে পারে না। তখন হয়ত পাহাড়পুরের অজ্ঞাত অখ্যাত অপরিচিত ধবংসাবশেষ একটি চৈত্য-সংযুক্ত সঙঘারাম বলিয়াই প্রকাশিত হইয়া পড়িবে; এবং একালের বাঙ্গালীর নিকট সেকালের বাঙ্গালীর বিজয়-গৌরব বিঘোষিত করিতে পারিবে।

এই বহুবিস্ময়পূর্ণ ধবংসাবশেষের খনন-কাৰ্য্য পুরাতন বরেন্দ্র-মণ্ডলের প্রধান স্মৃতিচিহ্ন উদঘাটিত করিতে পারিলে, আত্মবিস্তৃত বাঙ্গালী বিস্মিত নেত্রে চাহিয়া দেখিবে–তাহা বৃহৎ এবং সুন্দর–সৌন্দৰ্য্যগাম্ভীর্য্যের অপূৰ্ব্ব সংমিশ্রণ–বাঙ্গালীর জীবন-বসন্তের সংশয়হীন সুকুমার স্মৃতি-নিদর্শন।

মানসী ও মর্মবাণী, ফাল্গুন, ১৩২৩

তথ্যসূত্র

১ Eastern India, Vol. II, p. 669.

২ J.A.S.B, 1875, p. 191.

৩ On the low ground inside the enclosure the jungle was to high and so dense, that it was quite impenetrable to a man,–Cunningham’s Archaeological Survey Report, Vol. XV p. 118.

8 The name given to it by the people in Raja Deva Palka Chhatri, which is the usual term for a Mausoleum built over the ashes of a penson of consequence. I think, therefore, that this must be the place when Raja Deva Pala died, and where his body wa burned.–Ibid, p. 121.

৫ গৌড়-লেখমালা ১১-১৭ পৃষ্ঠা।

৬ গৌড়-লেখমালা ৫৬-৬২ পৃষ্ঠা।

৭ The great mound stands in the middle of a large enclosure, about 1500 feet square outside, formed by a massive embankment, about 150 feet broad on the East side, and not more than 100 feet on the other sides, — Cunningham’s A.S.R. Vol. XV, p. 118.

৮ The temple was therfore an exceptionally large one, and, to judge from the quantity of carved and ornamented bricks, must have been a very fine one. –Ibid, p. 120.

৯ পুরপ্রাচীরের কোণগুলির নিকট শতবর্ষ পূৰ্ব্বে বুকানন ইষ্টকালয়ের চিহ্ন দেখিয়া গিয়েছিলেন। এইরূপ একটি কোণ হইতেই প্রস্তুত-স্তম্ভ বাহির হইয়াছে, তাহা ঐ কোণের কোনও ইষ্টকোলয়ের অংশ বলিয়াই বোধ হয়।

পৌণ্ড্রবর্ধনের সংক্ষিপ্ত পুরাবৃত্ত

পৌণ্ড্রবর্ধনের ধবংসাবশেষ পরিদর্শন করিতে হইলে, পুরাতন ইতিহাসের সন্ধান লইতে হয়। সে ইতিহাস এখনও সুচারুরূপে সংকলিত হয় নাই। কোন পুরাকালে পৌণ্ড্রবর্ধনে রাজধানী সংস্থাপিত হইয়াছিল, তাহার জনশ্রুতি পৰ্যন্ত বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে। পুরাতন সংস্কৃত সাহিত্যে পৌণ্ড্রবর্ধনের উল্লেখ দেখিয়া মনে হয়,–স্মরণাতীত পুরাকাল হইতে পৌণ্ড্রবর্ধন ভারতবিখ্যাত রাজনগর বলিয়া সৰ্ব্বত্র সুপরিচিত ছিল। তথায় এক সময়ে ক্রিয়াকলাপের প্রাধান্য দেখিতে পাওয়া যাইত; তাহার পর বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাবে সকল স্থানই “ধর্ম–সংঘ-বুদ্ধ” মন্ত্রে অনুপ্রাণিত হইয়া উঠিয়াছিল। এই প্রদেশ এক সময়ে জ্ঞানালোচনার জন্য প্রসিদ্ধি লাভ করিয়া সুধীসমাজেও সুপরিচিত হইয়া উঠিয়াছি। বৌদ্ধমতানুরক্ত পাল নরপালগণ পৌণ্ড্রবর্ধনের নানা স্থানে রাজনগর ও রাজদুর্গ প্রতিষ্ঠিত করিয়া রাজ্যশাসনে ব্যাপৃত হইয়াছিলেন। তাহাদের রাজ্য কালক্রমে সেনরাজগণের করতলগত হইবার পর, তাহা আবার মুসলমানের অধীন হইয়া পড়ে। কি হিন্দু, কি বৌদ্ধ, কি মুসলমান,–সকলেই এখন ক্রীড়াপটে বিরাজ করিতেছেন। এখন তাঁহাদের বীরবিক্রমের লীলাভূমি অরণ্যমাত্ৰে পৰ্য্যবসিত হইয়াছে।

বক্তিয়ার খিলিজি এবং তাঁহার অব্যবহিত পরবর্তী মুসলমান ভূপতিবর্গ পৌণ্ড্রবর্ধনে পদার্পণ করিয়াছিলেন বলিয়া বোধ হয় না। তাঁহারা রাজ্যজয়েই ব্যাপৃত ছিলেন, সুতরাং পুনর্ভবাতীরে দেবকোটের সেনানিবাসেই তাঁহাদের প্রকৃত রাজধানী প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। তাহার পর গৌড়,– তাহার পর পাণ্ডুয়া,–তাহার পর আবার গৌড় রাজধানী রূপে ব্যবহৃত হইয়াছিল।

বরেন্দ্রমণ্ডলের অত্যল্প স্থানেই বক্তিয়ার খিলিজি অধিকার বিস্তার করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। নবাধিকৃত রাজ্য মধ্যে শাসন-সংস্থাপনের সুব্যবস্থা করিবার পূৰ্ব্বেই বক্তিয়ার খিলিজি তিববত-বহির্গত হইয়াছিলেন। বর্ধনকোট হইতে দশ দিবস উত্তরাস্যে করতোয়াতীর অবলম্বন করিয়া অগ্রসর হইবার পর বক্তিয়ার একটি প্রস্তরনির্মিত সেতু দেখিতে পাইয়া করতোয়া উত্তীর্ণ হইয়া পর্বতারোহণে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন। অধিকদূর আরোহণ করিবার পূৰ্বেই তাঁহাকে পরাভূত হইয়া সেতুর নিকট প্রত্যাবর্তন করিতে হইয়াছিল। সেখানে আসিয়া দেখিলেন,–সেতু ভাঙ্গিয়া ফেলিয়া, দেশের লোকে তাঁহার প্রত্যাবর্তনের পথ অবরুদ্ধ করিবার আয়োজন করিতেছে। তিনি একশত মাত্র অনুচর সমভিব্যাহারে সন্তরণে নদী পার হইয়া ভগ্নমনোরথে দেবকোটে প্রত্যাবর্তন করিতে না করিতে নির্দয়রূপে নিহত হইয়াছিলেন। তাঁহার প্রধান সেনাপতি মহম্মদ শেরাণ তখন রাজ্যজয়ে ব্যাপৃত। ছিলেন। তিনি দেবকোটে আসিয়া সিংহাসনে আরোহণ করিলেন। হত্যাকারী দিল্লীতে উপনীত হইয়া বাদশাহী সনন্দ লইয়া দেবকোট আক্রমণ করায়, পুনরায় গৃহকলহের সূত্রপাত হইয়াছিল। তাহাতে শেরাণ নিহত হইলে, আলি মাইন খিলিজি সিংহাসনে আরোহণ করিয়া, সুলতান আলাউদ্দীন নাম গ্রহণ করিয়াছিলেন। দুই বৎসরের মধ্যেই তাঁহার অত্যাচার অবিচারে লোকসমাজ ব্যতিব্যস্ত হইয়া উঠিল। তখন হাসামুদ্দীন তাঁহাকে পদচ্যুত ও নিহত করিয়া সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি ঘিয়াসুদ্দীন নাম গ্রহণ করিয়া দেবকোট হইতে গৌড় নগরে রাজধানী স্থানান্তরিত করিয়াছিলেন। গৌড়ের সুবৃহৎ মৃৎপ্রাচীর তাঁহারই কীৰ্তিচিহ্ন বলিয়া কথিত হইয়া আসিতেছে।

১২২৭ খ্রিস্টাব্দে দিল্লীশ্বর আলতমাস তদীয় পুত্র শাহজাদা নসিরুদ্দীনকে গৌড় আক্রমণে নিযুক্ত করেন। তিনি ঘিয়াসুদ্দীনকে যুদ্ধে নিহত করিয়া, গৌড়ীয় সিংহাসন অধিকার করিয়াছিলেন। তাঁহার পরলোকগমনে আবার খিলিজি সামন্তগণ গৃহকলহে লিপ্ত হইয়াছিলেন। আলাউদ্দীন দৌলত শাহ সিংহাসনে উপবেশন করিতে না করিতে, দিল্লীর ফৌজ আসিয়া তাঁহাকে পরাভূত করিল। এবং আলাউদ্দীন জানি নামক এক ব্যক্তিকে রাজপ্রতিনিধি পদে প্রতিষ্ঠিত করিয়া দিল। জানি বর্ষ চতুষ্টয় রাজ্যভোগ করিয়া পরলোক গমন করিলে, সইফউদ্দীন আইবক ১২৩৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সিংহাসন অধিকার করিয়াছিলেন।

সইফউদ্দীনের পর তুঘান খাঁ। সম্রাট আলতামস তাঁহাকেই সিংহাসন দান করেন। আলতামস-দুহিতা সুলতানা রিজিয়া তাহাই স্থির রাখিয়াছিলেন। এই সময়ে (১২৪৪ খ্রিস্টাব্দে) উড়িষ্যাধিপতি গৌড়দুর্গ আক্রমণ করায়, দুর্গতির একশেষ উপস্থিত হইয়াছিল। গৌড়াধিপতি দুর্গ রক্ষার সম্ভাবনা দেখিতে না পাইয়া, দিল্লীশ্বরের শরণাগত হইয়াছিলেন। দিল্লীশ্বরের সেনাপতি তৈমুর খাঁ আসিবার পূৰ্ব্বেই উড়িষ্যাধিপতি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। তখন তুঘানকে সিংহাসনচ্যুত করিয়া, স্বয়ং বাদশাহী করিবার আশায়, তৈমুর খাঁ দুর্গাবরোধ করেন। তুঘান পরাভূত হইয়া পলায়ন করায়, তৈমুর খাঁ সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন। কিন্তু দুই বৎসরের মধ্যেই তৈমুর খাঁর মৃত্যু সংঘটিত হয়। তাহার পর দ্বাদশবর্ষব্যাপী গৃহকলহে গৌড়রাজ্য বিপর্যস্ত হইয়াছিল। মঘিসুদ্দীন সুলতান হইয়াছিলেন। তিনি আসাম জয় করিতে গিয়া, কামরূপে পঞ্চত্বলাভ করিলেন। ইজুদ্দীন বলবন সিংহাসনে আরোহণ করিলে, আবার নতুন বিপ্লব উপস্থিত হইল। তখন পর্যন্ত লক্ষ্মণ সেনের বংশধরগণ পূৰ্ব্ববঙ্গের স্বাধীনতা রক্ষা করিতেছিলেন। বলবন পূৰ্ব্ববঙ্গ আক্রমণ করিতে প্রবৃত্ত হইলে, আরসালান খাঁ গৌড়নগর আক্রমণ করিয়াছিলেন।

১২৬৫ হইতে ১২৮৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এইরূপে গৌড়নগর নানা বিপ্লবে বিপর্যস্ত হয়। অবশেষে দিল্লীশ্বরের পুত্র নসিরুদ্দীন বোঘরা খাঁ গৌড়ের সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি ১২৯১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজ্যশাসন করিয়া পরলোকগমন করিলে, তাঁহার পুত্র রুকনুদ্দীন সিংহাসনে আরোহণ করেন।

রুকনুদ্দীন বঙ্গদেশের প্রথম স্বাধীন সুলতান বলিয়া পরিচিত। তিনি কাই কায়ুস নামে ইতিহাসে উল্লিখিত। তাঁহার পর তাঁহার ভ্রাতা ফিরোজ শাহ সিংহাসনে আরোহণ করিয়া, ১৩১৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজ্যশাসন করিয়াছিলেন। ফিরোজ শাহর পর তাঁহার পুত্র বোঘরা খাঁ সিংহাসনে আরোহণ করেন। এই সময়ে আবার গৃহকলহ প্রবল হইয়া উঠিয়াছিল। বোঘরা খাঁকে পরাভূত করিয়া, তাঁহার ভ্রাতা বাহাদুর শাহ সিংহাসন গ্রহণ করিলে, দিল্লীশ্বর মহম্মদ তোগলক শাহ গৌড়রাজ্য আক্রমণ করেন। এইরূপে বাহাদুর শাহ পদচ্যুত হইলে, নাসিরুদ্দীন সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন।

১৩২৬ খ্রিস্টাব্দে নাসিরুদ্দীনের মৃত্যু হয়। তখন দিল্লীর রাজপ্রতিনিধি কাদির খাঁ শাসনকর্তা নিযুক্ত হইয়াছিলেন। এই সময়ে পূৰ্ব্ববঙ্গে মুসলমান-শাসন প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। সুবর্ণগ্রামে বহরাম খাঁ রাজত্ব করিতেন। তাঁহার মৃত্যু হইলে, ফকর উদ্দীন সুবর্ণগ্রামের সিংহাসন অধিকার করিয়া, গৌড়দুর্গ আক্রমণ করেন, এবং কাদির খাঁকে নিহত করেন। কাদির খাঁর সেনাপতি আলি মোবারক বাহুবলে ফকর উদ্দীনকে পরাভূত করিয়া, আলিশাহ নামে সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন।

১৩৮৬ খ্রিস্টাব্দে হাজি ইলিয়াস আসিয়া আলি মোবারককে নিহত করিয়া, স্বয়ং সামসুদ্দীন ইলিয়াস নামে সিংহাসনে আরোহণ করেন। উপর্যুপরি রাষ্ট্রবিপ্লবে গৌড় বিধবস্ত হইয়া গিয়াছিল। তজ্জন্য সামসুদ্দীন ইলিয়াস, গৌড় পরিত্যাগ করিয়া পাণ্ডুয়ায় রাজধানী প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন। ১৩৫৮ খ্রিস্টাব্দ দিল্লীশ্বর ইহার সহিত সন্ধি সংস্থাপিত করিয়া, ইহাকে স্বাধীন ভূপতি বলিয়া স্বীকার করিয়াছিলেন। ইহারই পুত্রের নাম শেকর শাহ। তিনি সিংহাসনে আরোহণ করিবার পর “আদিনা” নামক ভুবনবিখ্যাত বিচিত্র মন্দির নির্মাণে হস্তক্ষেপ করিয়া, তাহা সমাপ্ত হইবার পূর্বেই, নিহত হইয়াছিলেন। সে কাহিনী–কলঙ্ককাহিনী। পিতাকে নিহত করিয়া পুত্র সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন। পুত্রের নাম ঘিয়াসুদ্দীন। তিনি নুরকুতব আলমের সহাধ্যায়ী ছিলেন। পিতৃহন্তার নিধনকাহিনী ইতিহাসে উল্লিখিত আছে। ভাতুড়িয়ার জমিদার গণেশ এই সময়ে বাইজিদ শাহ নামক একজনকে সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত করেন; পরে নিজেই ১৪০৪ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন। গণেশের শাসন সময়ে পাণ্ডুয়া আবার দেবমন্দিরে সুশোভিত হইয়া উঠিয়াছিল। রাভেনশা লিখিয়া গিয়াছেন–’গণেশ দশ বৎসর হিন্দু-মুসলমানের প্রিয়পাত্র হইয়া রাজ্যশাসন করিয়াছিলেন।”

গণেশের পুত্রের নাম জাঠমল বা যদু। তিনি মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করিয়া, জালালুদ্দীন নামে সিংহাসনে আরোহণ করেন। এবং ১৪১৪ খ্রিস্টাব্দ হইতে ১৪৩৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজ্য-শাসন করিয়া পরলোকগমন করেন। ইহার শাসন-সময় পাণ্ডুয়ার অভ্যুদয়যুগ। রাজধানী গৌড়নগরে স্থানান্তরিত হইলেও, পাণ্ডুয়া একেবারে পরিত্যক্ত হয় নাই। জালালুদ্দীনের পুত্র আহমদশাহ সিংহাসনে আরোহণ করিয়া, নৃশংস নরপতি বলিয়া পরিচিত হইয়াছিলেন। তাঁহার ভৃত্যবর্গ তাঁহাকে ১৪৪২ খ্রিস্টাব্দে নিহত করিলে, ইলিয়াস শাহের বংশধর নাসিরুদ্দীন মহম্মদ শাহ সিংহাসনে আরোহণ করেন। ইহার সময়ে গৌড়-নগর আবার সমৃদ্ধশালী হইয়া উঠিয়াছিল।

১৪৬০ খ্রিস্টাব্দে মহম্মদ শাহের পুত্র বাৰ্ব্বাক শাহ সিংহাসনে আরোহণ করিয়া, চতুর্দশ বর্ষ কাল নিরুদ্বেগে রাজ্যশাসন করিয়াছিলেন। কিন্তু ইহার শাসন সময়েই ধবংসবীজ সংগৃহীত হয়। ইনি সেনাদলে ৮০০০ হাবসী ক্রীতদাসকে স্থানান করিয়াছিলেন। বাব্বাক শাহের পুত্র ইউসুফ শাহ সাত বৎসর রাজ্যভোগ করিয়া, ১৪৮১ খ্রিস্টাব্দে পরলোকগত হইলে, তাঁহার খুল্লতাত ফতে শাহ হাবসী ক্রীতদাসদিগের প্রভুত্বে ব্যতিব্যস্ত হইয়া পড়িয়াছিলেন। তাহাদিগকে দমন করিতে গিয়া সৰ্ব্বনাশ উপস্থিত হইল। তাহারা পাইক সেনাদলের সহিত যোগদান করিয়া, ১৪৮৭ খ্রিস্টাব্দে প্রভুহত্যা করিয়া, বারিক নামক খোঁজাকে সুলতান শাহজাদা নামে সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত করিয়া দিল;-বাঙ্গালার সিংহাসনে এইরূপে এক নপুংসক সমাসীন হইল! তাহাকে অধিকদিন রাজ্যাভিনয় করিতে হইল না। হাবসী সেনাপতি মালিক ইন্দিল ইহাকে নিহত করিয়া, সইফ উদ্দীন ফিরোজ শাহ নামে সিংহাসনে আরোহণ করিলেন। ইহার মিনার অদ্যাপি “ফিরোজ মিনার’ নামে বর্তমান আছে।

ফিরোজ শাহের পর নসিরুদ্দীন মহম্মদ শাহ। তিনি ভাল করিয়া সিংহাসনে উপবেশন করিতে না করিতেই, হাবসী সেনা কর্তৃক নিহত হন। আবার একজন হাবসী মজফফর শাহ নামে সিংহাসন অধিকার করেন। গৌড়ের সিংহাসন যখন এইরূপে হাবসী ক্রীতদাসদিগের ক্রীড়াকন্দুকে পরিণত হইয়াছিল, সেই সময়ে হোসেন শাহ উজিরি করিতেন। তিনি ১৪৯৪ খ্রিস্টাব্দে যুদ্ধ ঘোষণা করিয়া, মজফফর শাহকে পরাভূত ও নিহত করিয়া, সিংহাসনে আরোহণ করিলেন। গৌড় আবার শান্তমূর্তি ধারণ করিল। হোসেন শাহ হাবসী সেনাদলকে ও পাইকগণকে নির্বাসিত করিয়া, শান্তি সংস্থাপিত করিয়াছিলেন।

হোসেন শাহের শাসনযুগ গৌড়ীয় ইতিহাসের কল্যাণযুগ। এই যুগে মহাপ্রভু শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য গৌড়ে পদার্পণ করিয়াছিলেন, এবং সেই সূত্রে হোসেন শাহের প্রধান মন্ত্রী রূপসনাতন সংসার ত্যাগ করিয়াছিলেন। হোসেন শাহের বিদ্যানুরাগ প্রবল ছিল। বঙ্গসাহিত্যও তাঁহার নিকট সমুচিত উৎসাহ লাভ করিয়াছিল। তাঁহার পুত্র নসরৎ শাহ পিতার ন্যায় লোকরঞ্জন করিতেন। কিন্তু তিনি পাণিপথের মোগলপাঠানের তুমুল কলহে লোদীপক্ষ অবলম্বন করায়, বাবার তাঁহার উচ্ছেদ সাধনের জন্য কৃতসংকল্প হন। নসরৎ শাহ অনন্যোপায় হইয়া বশ্যতা স্বীকার করিয়া আত্মরক্ষা করিয়াছিলেন। কিন্তু তাঁহার খোঁজাগণ তাঁহাকে নিহত করিয়া, তাঁহার পুত্র ফিরোজ শাহকে সিংহাসন দান করিয়াছিল। ফিরোজের খুল্লতাত মামুদ শাহ তাঁহাকে নিহত করিয়া সিংহাসনে আরোহণ করেন। তাঁহাকে অধিক দিন রাজ্যভোগ করিতে হইল না। বিহারাধিপতি সের আফগান ১৫৩৭ খ্রিস্টাব্দে গৌড় নগর অবরোধ করিয়া, তাঁহাকে বিধবস্ত করিয়া ফেলিলেন। সন্ধি হইলেও, রাজশ্রী বিনষ্ট হইয়া গেল;-মামুদ ভগ্ন-মনোরথে প্রাণত্যাগ করিলেন! সদুল্ল্যাপুরে ইহার সমাধি দেখিতে পাওয়া যায়। সেই শেষ। তাহার পর গৌড় একটি প্রাদেশিক রাজ্যে পরিণত হইয়া, দিল্লীশ্বরের অধীন হইয়া পড়ে। সেই অবস্থায় ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আকবর শাহের প্রতিনিধি মনায়েম খাঁর শাসন সময়ে গৌড়নগর মহামারীতে জনশূন্য হইয়া, ক্রমে বিজন বনে পরিণত হইয়াছে।

প্রবাসী, অগ্রহায়ণ, ১৩১৪

তথ্যসূত্র

১ He reigned for 10 years, making Pandua his capital, and his popularity with his Mahomedan subjects shows him to have been a sensible and tolerant ruler.–Ravenshaw’s Gour.p.99

২ The Portuguese, as we are told by Faria Y Souza, sent on this occasion nine ships to Mahmud’s assistance, but they did not reach Gour till after the City’s surrender.–Ravenshaw’s Gour, p. 101 note.

৩ From its sack by Sher Khan’s officers, in 1537, and from its depopulation by the plague in 1575, it never subsequently recovered–I bid, p. 102.

৪ ক্রমে যে সকল ঐতিহাসিক তথ্য আবিষ্কৃত হইতেছে, তাহাতে গৌড়ের ইতিহাস নূতন করিয়া লিখিবার প্রয়োজন উপস্থিত হইয়াছে। ধবংসাবশেষ দর্শন করিবার সময়ে বিশেষ তর্ক-বিতর্কের প্রতি কর্ণপাত করিবার প্রয়োজন হয় না। সুতরাং ধবংসাবশেষ বর্ণনা করিবার সময়ে সংক্ষিপ্তভাবে প্রচলিত কাহিনী বিবৃত হইল। বিশেষ কাহিনী “গৌড়কাহিনী” নামে স্বতন্ত্রভাবে লিখিত হইতেছে।

হজরত পাণ্ডুয়া

পুরাতন পৌণ্ড্রবর্ধন এখন “পাণ্ডুয়া” নামে পরিচিত। মালদহের লোকে তাহাকে আরও সংক্ষিপ্ত করিয়া লইয়া “পরুয়া” নামে অভিহিত করিতেছে! হুগলী জেলায় পাণ্ডুয়া নামে আর একটি পুরাতন স্থান দেখিতে পাওয়া যায়। তাহার সহিত পার্থক্য রক্ষাৰ্থ গ্রন্থকারগণ মালদহের পাণ্ডুয়াকে “হজরত পাণ্ডুয়া” নামে অভিহিত করিয়া থাকেন।

ইলাহি বকসের হস্তলিখিত ইতিহাসে পাণ্ডুয়ার বিবিধ বিবরণ সন্নিবিষ্ট রহিয়াছে। তিনি লিখিয়া গিয়াছেন,–”পুরাকালে পাণ্ডুয়া একটি বৃহৎ নগর বলিয়া সুপরিচিত ছিল। তাহা ইংরাজবাজার হইতে দ্বাদশ মাইল উত্তরে অবস্থিত। তথায় এক সময়ে বহু লোকের বসতি দেখিতে পাওয়া যাইত। সামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহের সিংহাসনারোহণের সময় হইতে রাজা কংসের (গণেশের) রাজ্যাধিকারের শেষ পৰ্য্যন্ত অর্ধশতাব্দীকাল ছয়জন গৌড়ীয় বাদশাহ পাণ্ডুয়ার রাজধানীতে বাস করিয়া গিয়াছেন। হিজরী ৭৯৫ সালে (১৩৯২ খৃষ্টাব্দে) কংসপুত্র জালালুদ্দীন গৌড়ে রাজধানী স্থানান্তরিত করিয়াছিলেন।”

পৌণ্ড্রবর্ধনের পুরাতন রাজধানীতে হিন্দু এবং বৌদ্ধমন্দিরের অভাব ছিল না। তাহার কথা হিয়াঙ্গথসাঙ্গের ভ্রমণকাহিনীতে এবং “রাজতরঙ্গিণী”তে উল্লিখিত আছে। ইলাহিবকস লিখিয়া গিয়াছেন,–”কংস সিংহাসনে আরোহণ করিলে, পাণ্ডুয়া আবার দেবমন্দিরে পূর্ণ হইয়া উঠিয়াছিল। এই সকল হিন্দু এবং বৌদ্ধমন্দির হইতে ইষ্টক প্রস্তর ভাঙ্গিয়া আনিয়া মুসলমানগণ তাঁহাদিগের সমাধিমন্দিরাদি গঠিত না করিলে, পৌণ্ড্রবর্ধনে এখনও অনেক হিন্দু ও বৌদ্ধমন্দির বর্তমান থাকিতে পারিত!

এখন আর পাণ্ডুয়ার সে পুরাতন সৌভাগ্যগৰ্ব্ব বৰ্ত্তমান নাই,–চারিদিকে বিজন। বন,–তাহার মধ্যে মুসলমান কীৰ্ত্তির কতিপয় ধবংসাবশেষ,–তাহাই এখন পাণ্ডুয়ার একমাত্র দৃশ্য। তাহাতেও কত ভাগ্যবিপর্যয় সংঘটিত হইয়াছে। যে সকল স্বাধীন ভূপতি “গৌড়-বাদশাহ” নামে পাণ্ডুয়ায় রাজশক্তি প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন, একালের অধিবাসীগণের নিকট তাঁহাদের নাম পর্যন্ত অপরিচিত হইয়া উঠিয়াছে। তাঁহাদের আশ্রয়ে থাকিয়া যে সকল মুসলমান সাধুপুরুষ ধর্ম বিস্তার করিতেন, তাঁহাদিগের কথাই পাণ্ডুয়ার আধুনিক অধিবাসিগণের নিকট প্রাতঃস্মরণীয় হইয়া রহিয়াছে। সুতরাং পাণ্ডুয়ার পুরাকীর্তির উল্লেখ করিতে হইলে, সর্বাগ্রে তাঁহাদের কথারই উল্লেখ করিতে হয়।

পাণ্ডুয়ার ধবংসাবশেষের মধ্যে বড় দরগা’ এবং ‘ছোট দরগা’ নামক দুইটি দরগা দেখিতে পাওয়া যায়। “বড় দরগা” মকদুম শাহ জালালের এবং “ছোট দরগা” নুর কুতব আলমের নামে পরিচিত হইয়া রহিয়ছে। উভয় দরগাই ভূসম্পত্তির অধিকার প্রাপ্ত হইয়া অদ্যাপি আত্মরক্ষা করিয়া আসিতেছে। “বড় দরগার” ভূসম্পত্তি “বাইশ হাজারী” এবং “ছোট দরগার ভূসম্পত্তি “ষস হাজারী” নামে কথিত হইয়া থাকে। রাজপথপার্শ্বে যে তোরণদ্বার দেখিতে পাওয়া যায়, তাহার ভিতর দিয়া কিয়দূর অগ্রসর হইলে, উভয় দরগা দৃষ্টি পথে পতিত হয়।

বড় দরগা

“বড় দরগা” নামক স্থানে অনেকগুলি অট্টালিকা বর্তমান আছে। সকলগুলিই অপেক্ষাকৃত আধুনিক বলিয়া বোধ হয়। মকদুম শাহ জালালের বাসের জন্য হিজরী ৭৪২ সালে (১৩৪১ খৃষ্টাব্দে) সুলতান আলি মুবারক এক অট্টালিকা নির্মিত করিয়া দিয়াছিলেন। সে পুরাতন অট্টালিকা এক্ষণে দেখিতে পাওয়া যায় না। গোলাম হোসেন “রিয়াজ-উস-সলাতিন” রচনা করিবার সময়েও তাহার কিছু কিছু ধবংসাবশেষ দর্শন করিয়াছিলেন। ইলাহি বকস লিখিয়া গিয়াছেন,–”তাঁহার সময়ে সে পুরাতন অট্টালিকার চিহ্ন মাত্রও বর্তমান ছিল না।”৩ নিরক্ষর মুসলমানগণ তাহা স্বীকার করিতে অসম্মত। তাহারা বর্তমান অট্টালিকাকেই পুরাতন অট্টালিকা বলিয়া বিশ্বাস করিয়া আসিতেছে। তাহাদিগের বিশেষ অপরাধ নাই। যে অট্টালিকাটি এক্ষণে শাহ জালালের নিবাসস্থান বলিয়া দর্শিত হইয়া থাকে, তাহার রচনাকাল ১৬৬৪ খৃষ্টাব্দ। শাহ নিয়ামতুল্লা নামক মোতওয়াল্লি কর্তৃক তাহা নির্মিত হইয়াছিল। কিন্তু প্রস্তরফলকে লিখিত আছে,–শাহ নিয়ামতুল্লা পুরাতন অট্টালিকার জীর্ণ সংস্কার সাধিত করিয়াছিলেন। ইহা সত্য হইলে, নিরক্ষর লোকের আর অপরাধ কী? কিন্তু ইহার সহিত গোলাম হোসেন এবং ইলাহি বকসের উক্তির সামঞ্জস্য রক্ষিত হয় না। শাহ নিয়ামতুল্লা কি নূতন অট্টালিকা নির্মিত করিয়া, তাহাকে মিথ্যা করিয়া “জীর্ণসংস্কার” বলিয়া প্রস্তর ফলকে লিখিয়া গিয়াছেন? বৰ্তমান অট্টালিকা পুরাতন অট্টালিকা হইলে, গোলাম হোসেন ও ইলাহিবক্স মিথ্যা করিয়া পুরাতন অট্টালিকা লুপ্ত হইবার কথা লিখিয়া গিয়াছেন? ইহা একটি ঐতিহাসিক কৌতূহলের ব্যাপার হইয়া রহিয়াছে! প্রকৃত ব্যাপার এই সকল তর্ক বিতর্কে আচ্ছন্ন হইয়া পড়িয়াছে। শাহ জালাল যখন পৌণ্ড্রবর্ধনে উপনীত হইয়াছিলেন, তখন কোনো নির্দিষ্ট বাসস্থান বর্তমান ছিল না। তিনি সে কালের মুসলমান সাধুপুরুষের সুপরিচিত ব্যবহার অনুসারে কোনও ধবংসাবশিষ্ট পুরাতন মন্দিরে আশ্রয় গ্রহণ করিয়া থাকিবেন। তাহাই সেকালে তাঁহার আদিবাসস্থান বলিয়া পরিচিত ছিল। গোলাম হাসেন তাহার কিছু কিছু চিহ্ন দর্শন করিয়াছিলেন, ইলাহিবক্সের সময়ে তাহা সম্পূর্ণরূপে লুপ্ত হইয়া গিয়াছিল। পরে শাহ জালালের প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠা লাভ করিলে, সুলতান আলি মুবারক তাঁহার জন্য এক নূতন অট্টালিকা নির্মিত করিয়া দিয়াছিলেন। শাহ নিয়ামতুল্লা তাহারই জীর্ণসংস্কার সাধিত করিয়া থাকিবেন। “বড় দারগার” ইষ্টক প্রস্তরে হিন্দু ও বৌদ্ধ মন্দিরের ধবংসাবশেষ লুক্কায়িত হইয়া রহিয়াছে। তাহার প্রতি লক্ষ্য করিলে, এই সিদ্ধান্তকেই প্রকৃত সিদ্ধান্ত বলিয়া স্বীকার করিতে হয়। নচেৎ শাহ নিয়ামতুল্লা অথবা গোলাম হোসেন, এতদুভয়ের মধ্যে একজনকে না একজনকে মিথ্যাবাদী হইতে হয়! এই সকল কারণে, শাহ জালালের “বড় দরগাকে” একটি পুরাতন হিন্দু বা বৌদ্ধ মন্দিরের অবস্থানভূমি বলিয়াই ব্যক্ত করিতে হয়।

লক্ষ্মণসেনী দালান

বড় দরগার অট্টালিকাদির মধ্যে একটি অট্টালিকা “লক্ষ্মণসেনী দালান” নামে পরিচিত। তাহা একটি সরোবরতীরে প্রতিষ্ঠিত। রাভেনশা ইহার উল্লেখ করেন নাই। কিন্তু ইলাহিবক্স ইহার উল্লেখ করিয়া গিয়াছেন। ইহা একটি পুরাতন অট্টালিকা। প্রস্তরফলকে দেখিতে পাওয়া যায়,–”বিকল রাজের পুত্র রামরাম কর্তৃক মহম্মদ আলি নামক অধ্যক্ষের আদেশে বাঙ্গালা ১১১৯ সালে এই পুরাতন অট্টালিকার জীর্ণসংস্কার সুসম্পাদিত হইয়াছিল।” ইহা “লক্ষ্মণসেনী দালান” নামে কথিত হইতেছে কেন, কেন তাহার সন্ধান প্রদান করিতে পারে না। ইলাহিবক্সের সময়ে কেহ সেরূপ সন্ধান প্রদান করিলে, তাহা তিনি লিপিবদ্ধ করিতে ত্রুটি করিতেন না। বহুকাল পূৰ্ব্বে তাহার সমস্ত জনশ্রুতি বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে, কেবল সেই পুরাতন নাম এখনও লোকসমাজ হইতে বিলুপ্ত হইতে পারে নাই। এই অট্টালিকাপ্রকৃত প্রস্তাবে লক্ষ্মণসেনের অট্টালিকা হইলে, মুসলমানগণ ইহাকে না ভাঙ্গিয়া যত্নপূৰ্ব্বক জীর্ণসংস্কার করিয়া রক্ষা করিবার চেষ্টা করিয়া আসিয়াছেন কেন, তাহাও অল্প কৌতূহলের বিষয় নহে। এই কৌতূহল এক্ষণে চরিতার্থ করিবার উপায় নাই। “লক্ষ্মণসেনী দালানের” প্রস্তরফলকে প্রসঙ্গক্রমে একটি ঐতিহাসিক তথ্য চিরস্মরণীয় হইয়া রহিয়াছে। গৌড়ীয় অট্টালিকার গঠনপ্রতিভা কাহার গৌরব ঘোষণা করিতেছে, ইহাতে তাহার একটি আনুসঙ্গিক প্রমাণ ব্যক্ত হইয়া রহিয়াছে। যে সকল মুসলমান নরপতি এই প্রদেশে অট্টালিকা নিৰ্মাণ করিয়া গিয়াছেন, তাঁহাদের জন্মভূমি কখনও অট্টালিকা নির্মাণের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল না। তাঁহারা এদেশে আসিয়া বহুসংখ্যক দেবমন্দির দর্শন করিয়া মসজেদ নির্মাণের জন্য ব্যস্ত হইয়া উঠিলে, মন্দির ভাঙ্গিয়া মসজেদ রচনার উপকরণ সংগৃহীত করিয়াছিলেন। সে কথা সমস্ত মুসলমান লিখিত ইতিহাসেই স্পষ্টাক্ষরে লিখিত আছে। উপকরণ সংগ্রহ করা বিশেষ আয়াসসাধ্য ব্যাপার বলিয়া উল্লিখিত হইতে পারে না,যে কেহ লৌহদণ্ডাঘাতে তাহা সম্পন্ন করিতে সমর্থ হইয়াছিল। কিন্তু সেই উপকরণ লইয়া মসজেদ নির্মাণ করিতে রাজের সহায়তা আবশ্যক। তাহারা হিন্দু না মুসলমান? গৌড়ীয় ধবংসাবশেষের মধ্যে এখনও যে সকল গঠনপ্রতিভার পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়, তাহাতে হিন্দু-গঠন-প্রতিভাই সুস্পষ্ট অভিব্যক্ত হইয়া রহিয়াছে। দেখিবামাত্র মনে হয়, মন্দিরগুলি যেন সহসা মসজেদরূপে যথাসম্ভব আকৃতি পরিবর্তন করিয়াছে! “বড় দরগার” অট্টালিকার মধ্যে “লক্ষ্মণসেনী দালান” এইরূপে যে কৌতূহলের উদ্রেক করিয়া আসিতেছে, তাহা আর একটি কারণে আরও কৌতূহলপূর্ণ হইয়া রহিয়াছে। এখানে একখানি তালপত্রের পুরাতন পুস্তক রক্ষিত হইয়া আসিতেছে। নিরক্ষর মুসলমানগণ তাহাকে শাহ জালালের পুস্তক বলিয়া অর্চনা করিয়া থাকে,–সহসা কোন হিন্দুকে তাহা স্পর্শ করিতেও অনুমতি প্রদান করে না। এই পুস্তক কিরূপে এখানে আসিল, কি জন্যই বা শাহ জালালের দ্রব্যজাতের সঙ্গে পরম সমাদরে সুরক্ষিত হইতেছে, তাহার কোনও তথ্যাবিষ্কারের সম্ভাবনা নাই। ইলাহিবক্স ইহাকে একখানি “নাগরী” পুস্তক বলিয়া ব্যক্ত করিয়া গিয়াছেন। পুস্তকখানি “নাগরী” নহে, “সংস্কৃত”, ইহা সেকালের প্রচলিত অক্ষরে লিখিত। বহু পুরাতন বলিয়া তালপত্রগুলি পরস্পরের সহিত এরূপ দৃঢ়সংবদ্ধ হইয়া গিয়াছে যে, খুলিতে গেলে ছিঁড়িয়া যায়। বিভারিজ সাহেব লিখিয়া গিয়াছেন, –এই গ্রন্থ “হলায়ুধ-বিরচিত” বলিয়া স্বর্গীয় উমেশচন্দ্র বটব্যাল মহাশয় ব্যক্ত করিয়া গিয়াছেন। একটি শ্লোকের পাঠোদ্ধার সাধিত হইয়াছে। তাহাতে একজন পাল নরপালের পরলোক গমনের কথা লিখিত আছে। এই গ্রন্থ একখানি ঐতিহাসিক গ্রন্থ বলিয়া অনুমিত হইয়া আসিতেছে। ইহা কি মহা ধর্মাধিকার মহামহোপাধ্যায় হলায়ুধের স্বহস্তলিখিত বঙ্গদেশের পুরাতন ঐতিহাসিক কাহিনী?

শাহ জালাল

শাহ জালালের সম্পূর্ণ নাম ‘মকদুম শাহ জালালুদ্দীন তবরিজি”। তিনি একজন ইতিহাস বিখ্যাত সাধু পুরুষ। তাঁহার কথা বহুগ্রন্থে উল্লিখিত হইয়া, অদ্যাপি মুসলমান সমাজে সুপরিচিত হইয়া রহিয়াছে। তাঁহার জীবনকাহিনী বিবিধ অলৌকিক কাহিনীর আধার। তাঁহার গুরুভক্তি এতদূর প্রবল ছিল যে, তাঁহার বর্ষীয়ান গুরু মক্কাযাত্রা করিলে, তিনি একটি চুল্লী মস্তকে বহন করিয়া রন্ধন করিতে করিতে অনুগমন করিতেন;- বৃদ্ধ পথশ্রান্ত হইবামাত্র, তাঁহাকে খাদ্যদানে সঞ্জীবিত করিয়া তুলিতেন। “বড় দরগার” অভ্যন্তরে এখনও একটি “তন্দুর” দেখিতে পাওয়া যায়। নিরক্ষর মুসলমান বলিয়া থাকে,–শাহ জালাল সেই সুবৃহৎ “তন্দুরকেই” মস্তকে বহন করিয়া গুরুশুশ্রূষা করিতেন! ইলাহি বক্স ভক্ত মুসলমানের ন্যায় ইহার উল্লেখ করিয়া, সত্যনিষ্ঠ ঐতিহাসিকের ন্যায় লিখিয়া গিয়াছেন,–”ঈশ্বর জানেন, এই কাহিনী কতদূর সত্য!”

এক সময়ে সমুদ্রযাত্রা প্রভাবে বঙ্গদেশের নাম পৃথিবীর নানা দিগ্নেশে সুপরিচিত হইয়া উঠিয়াছিল। তজ্জন্য মুসলমানগণ আরবসাগরে ও পারস্যোসাগরে পোতারোহণ করিয়া বঙ্গদেশে উপনীত হইতেন। এইরূপে বক্তিয়ার খিলিজির বহুপূৰ্ব্ব হইতেই বঙ্গদেশে মুসলমানদিগের গতিবিধি প্রবর্তিত হইয়াছিল। তখন তাঁহারা বণিক,–বাণিজ্য লোভে এ দেশে পদার্পণ করিয়া দেশীয় রাজশক্তির অনুগত হইয়াই সৰ্ব্বত্র বিচরণ করিতেন। এ দেশে মুসলমানশাসন প্রবর্তিত হইবার পরে ক্রমে ক্রমে অনেকে এ দেশে আসিয়া বাস করিতে আরম্ভ করেন। শাহ জালাল কোন সময়ে, কোন স্থানে, দেহত্যাগ করিয়াছিলেন, তদবিষয়ে মতভেদের অভাব নাই। কিন্তু তিনি যে সত্য সত্যই পাণ্ডুয়ার “বড় দরগায় বাস করিতেন, তাহাতে মতভেদ দেখিতে পাওয়া যায় না। ইলাহি বক্স লিখিয়া গিয়াছেন, –”পারস্যদেশের অন্তর্গত তবরিজ নগরে শাহ জালালের জন্ম হয়। তিনি ভারতবর্ষে উপনীত হইয়া কিছুদিন দিল্লীনগরীতেও বাস করিয়ছিলেন। কিন্তু তথায় তাঁহার শত্রুদল তাঁহাকে লোকসমাজে অপদস্থ করিবার জন্য তাঁহার বিরুদ্ধে একটি কুৎসিৎ অভিযোগের সৃষ্টি করিয়াছিল। বিচারকালে অভিযোগকারী নিজমুখে সকল কথা ব্যক্ত করায়, সাধুপুরুষের চরিত্রগৌরব রক্ষা প্রাপ্ত হইয়াছিল। ইহাতে অতিমাত্র অসন্তুষ্ট হইয়া, শাহ জালাল দিল্লী পরিত্যাগ করিয়া পাণ্ডুয়ায় উপনীত হইয়াছিলেন। এখানে অল্পদিনের মধ্যেই তাঁহার প্রতিপত্তি এতদুর প্রতিষ্ঠালাভ করিয়াছিল যে, তিনি “বাইশ হাজারী” নামক ভূসম্পত্তির অধিকারী হইয়াছিলেন। ইলাহি বক্স লিখিয়া গিয়াছেন,–বঙ্গদেশের “দেওমহল” নামক বন্দরে শাহ জালালের সমাধি বর্তমান আছে। সাহেবেরা ইহাতে আস্থা স্থাপন না করিয়া, মালদ্বীপ নামক দ্বীপপুঞ্জে শাহ জালালের দেহান্তর সংঘটিত হইবার কথা ব্যক্ত করিয়া থাকেন। তাঁহারা বলেন, পৌণ্ড্রবর্ধনের “বড় দরগার” অভ্যন্তরে শাহ জালালের যে সমাধিমন্দির বর্তমান আছে, তাহা জাল সমাধিস্থান,–প্রকৃত সমাধিস্থান ভারতসাগর বেষ্টিত মালদ্বীপে। ইহার প্রধান প্রমাণ–মালদ্বীপের জনশ্রুতি। সে দেশের লোকে তবরিজ নিবাসী কোনও সাধুপুরুষ কর্তৃক মুসলমান ধর্মে দীক্ষিত হয়। তাঁহার সমাধিস্থান অদ্যাপি পীরস্থানরূপে পূজিত হইয়া থাকে। এই প্রমাণ নিঃসংশয়ে গ্রহণ করা কঠিন। শ্রীহট্টেও শাহ জালাল নামক এক মুসলমান সাধুপুরুষের সমাধিস্থান দেখিতে পাওয়া যায়। বিখ্যাত মুসলমান পৰ্যটক ইবন বতুতা তাঁহার আশ্রমে আতিথ্য লাভ করিয়াছিলেন। শ্রীহট্টের শাহ জালাল ভিন্ন ব্যক্তি। সেইরূপ মালদ্বীপের তবরিজিও ভিন্ন ব্যক্তি হওয়া বিচিত্র নহে। কেবল এরূপ নামসাদৃশ্যের উপর নির্ভর করিয়াই, ইলাহিবক্সের উক্তিকে সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করিতে সাহস হয় না। তাঁহার কথা সত্য হইলে, এদেশের চিতাভস্মাচ্ছন্ন পুরাতন ইতিহাস কিয়ৎ পরিমাণে উদ্ভাসিত হইয়া উঠিতে পারে। যেখানে শাহজালাল বাসস্থান গ্রহণ করিয়া দেহত্যাগ করিয়াছিলেন, তাহার নাম– দেবমহল। তথায় গোলাম হোসেনের সময়েও পুরাতন ধবংসাবশেষ বর্তমান ছিল। এখনও “লক্ষ্মণসেনী দালান” জীর্ণসংস্কার প্রভাবে আত্মরক্ষা করিতেছে। দরগার দ্রব্যজাতের মধ্যে একখানি পুরাতন জরাজীর্ণ সংস্কৃত পুস্তকও বর্তমান আছে। এই সকল বিষয়ের একত্র বিচার করিতে বসিলে, শাহ জালালের সমাধিস্থানকে একটি পুরাতন দেবস্থান বলিয়াই স্বীকার করিতে হয়। এক সময়ে শাহজালালের স্মৃতিসমাদর রক্ষাৰ্থ নবাব সিরাজদ্দৌলা “বড় দরগার” সাধনস্থান রৌপ্যনির্মিত “রেলিং” দিয়া ঘিরিয়া দিয়াছিলেন। তাহা কে অপহরণ করিয়া লইয়া গিয়াছে; কেবল তাহার কথা এখনও সিরাজদ্দৌলার সাধুভক্তির পরিচয় প্রদান করিতেছে। এই হতভাগ্য তরুণযুবক যে সকল অলীক কলঙ্কে কলঙ্কিত, সাধুপুরুষের অবমাননাও তাহার মধ্যে একটি। প্রকৃত পক্ষে সিরাজদ্দৌলা যে সাধুভক্ত ছিলেন, পাণ্ডুয়ার “বড় দরগায়” সে কথা এখনও উল্লিখিত হইয়া থাকে।

ছোট দরগা

“ছোট দরগায়” যে সকল অট্টালিকা বর্তমান আছে, তাহা “বড় দরগার” অট্টালিকা অপেক্ষা অধিক সুদৃশ্য। “ছোট দরগা” নুর কুতব আলম নামক সম্ভ্রান্ত সাধুপুরুষের সমাধিস্থান। অট্টালিকাগুলি অপেক্ষাকৃত আধুনিক, তাহাতে অনেক পুরাতন বিলুপ্ত অট্টালিকার ফলকলিপি সংযুক্ত আছে। “মিঠা তালাও” নামক একটি ক্ষুদ্র সরোবর “ছোট দরগার” দৃশ্যশোভা উদ্ভাসিত করিয়া রাখিয়াছে। মীরকাসিম এই দরগায় তাম্রনিৰ্মিত জয়ডঙ্কা উপঢৌকন প্রদান করিয়াছিলেন। তাহা আর এখন ব্যবহৃত হয় না।

নুর কুতব সম্ৰান্তবংশে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। লক্ষ্মণাবতীর ধবংসাবশেষের মধ্যে সাহারদীঘির অনতিদূরে মকদুম আখি সিরাজউদ্দীন নামক যে সাধুপুরুষের সমাধি মন্দির দেখিতে পাওয়া যায়, তাঁহার জনৈক প্রিয় শিষ্যের নাম–সেখ আলা-উল-হক। তিনি লাহোর নিবাসী ধনাঢ্য মুসলমানের পুত্র, পিতার সহিত এ দেশে আগমন করিয়াছিলেন। পিতা গৌড়ীয় বাদশাহের কোষাধ্যক্ষ ছিলেন, পুত্র সাধুপুরুষের শিষ্যত্ব গ্রহণ করিয়া “ফকির” হইয়াছিলেন। তিনি অকাতরে অর্থব্যয় করিয়া অতিথিসেবা করিতনে। ইহাতে বাদশাহের সন্দেহ হয়–হয় ত কোষাধ্যক্ষ পুত্রকে রাজকোষ হইতে অর্থদান করিয়া থাকেন। সন্দেহে পড়িয়া আলা-উল-হক সুবর্ণগ্রামে নির্বাসিত হইয়াছিলেন। কিন্তু সেখানেও তাঁহার অর্থব্যয়ের অবধি ছিল না। কিছু দিন পরে বাদশাহ তাঁহার ভ্রম বুঝিতে পারিয়া ফকিরকে মার্জনা করিলে আলা-উল-হক পুনরায় পাণ্ডুয়ায় আসিয়া বাস করিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন। ১৩৮৪ খৃষ্টাব্দে পাণ্ডুয়া নগরেই তাঁহার দেহান্তর সংঘটিত হয়। তথায় তাঁহার সমাধিমন্দির বর্তমান আছে। তাঁহার পুত্র নুর কুতব গদী অধিকার করিয়া ১৪১৫ খৃষ্টাব্দে লোকান্তর গমন করেন।

বাদশাহী সনন্দ

“ছোটো দরগার” ভূসম্পত্তির “এক বাদশাহী সনন্দ” অদ্যাপি বর্তমান আছে। তাহা সম্রাট শাহ জাঁহার রাজ্যাব্দের দ্বাবিংশ বর্ষের (সুলতান সুজাখাঁর স্বাক্ষরযুক্ত) ভূমিদান পত্র। ইহার পূর্বে যে দানপত্র ছিল, তাহা নষ্ট হইয়া গিয়াছে। হোসেন শাহের “ছোট দরগায়” ভূমিদান করিবার কথা শুনিতে পাওয়া যায়। তাহার কোনও দানপত্র বর্তমান নাই। সুজা খাঁ রাজমহলের রাজধানীতে বাস করিতেন। তাঁহার হস্তাক্ষর পাণ্ডুয়ার ছোটদরগার “বাদশাহী সনন্দে” রাজপ্রতিনিধির স্বাক্ষর বলিয়া কথিত।

বাদশাহী মসজেদ

নুর কুতব আলমের সমাধির নিকটে যে মসজেদ দেখিতে পাওয়া যায়, তাহা পরবর্তী সময়ে বাদশাহ ইউসফ শাহ কর্তৃক নির্মিত হইয়াছিল। প্রস্তরফলকে তাঁহার নাম উল্লিখিত আছে। নুর কুতবের সমাধির সম্মুখেই তাঁহার পিতার সমাধি। তাহার দ্বারদেশে যে প্রস্তর ফলক সংযুক্ত আছে, তাহাতে প্রথমে কোরাণ হইতে শ্লোক উদ্ধৃত–তাহার পর আলা-উল-হকের দেহত্যাগের বিবরণ। তিনি বাদশাহ আবুল মোজাফফর মাহামুদ শাহের শাসনসময়ে পরলোক গমন করেন। এই প্রস্তর ফলকে আলা-উল-হকের নাম উল্লিখিত নাই, কেবল সাধুপুরুষ বলিয়াই উল্লেখ আছে। তজ্জন্য নানা তর্ক বিতর্ক প্রচলিত হইয়াছে। ছোটদরগার সহিত বাদশাহদিগের বিশেষ সংশ্রব ছিল। যে রাষ্ট্রবিপ্লবে মুসলমানের সিংহাসনে ভাতুড়িয়ার জমিদার গণেশ বাদশাহ হইয়া উপবেশন করিয়াছিলেন, তাহাতে ছোটো দরগার সংশ্রব ছিল।

পুরাতন স্মৃতিচিহ্ন

ছোট দরগার পুরাতন অট্টালিকার ধবংসাবশেষের মধ্যে সুবৃহৎ স্তম্ভের ও মকরের আকৃতিযুক্ত জলনির্গমনের মুরির পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়। একটি স্তম্ভের পাদপীঠ চারিহস্ত ব্যাসবিশিষ্ট,–যে অট্টালিকার তাহা ব্যবহৃত হইয়াছিল, তাহা কিরূপ বৃহৎ ছিল, তাহা সহজেই অনুমিত হইতে পারে। ছোট দরগায় এরূপ বৃহৎ অট্টালিকা নির্মিত হইবার পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায় না। তাহাতে মকরের মুখ ব্যবহৃত হইবারও সম্ভাবনা ছিল না। বনাভ্যন্তরে এই সকল পুরাতন প্রস্তুরশিল্পের ধবংসাবশেষ দর্শন করিলে মনে হয়–ইহা অতি পুরাতন হিন্দু বা বৌদ্ধমন্দিরের ধবংসাবশেষ। তাহার যে সকল উপকরণ মসজেদ নির্মাণের উপযোগী বলিয়া বিবেচিত হইয়াছিল, তাহাই মুসলমান কর্তৃক রূপান্তরিত হইয়াছিল;–যাহা উপযোগী বলিয়া বিবেচিত হয় নাই, তাহা অদ্যাপি পড়িয়া রহিয়াছে। নিকটে যে সকল পুরাতন সরোবর দেখিতে পাওয়া যায়, তাহাতে মনে হয়–এক সময়ে পৌণ্ড্রবর্ধনের এই অংশ জনকোলাহলে পরিপূর্ণ ছিল। এখন সকল স্থানই নীরব। কেবল মেলা উপলক্ষে বৎসরের মধ্যে কখন কখন মুসলমান তীর্থযাত্রীর সমাগম বশত পাণ্ডুয়ার বনভূমি কিয়ৎকালের জন্য মুখরিত হইয়া থাকে।

প্রবাসী, মাঘ, ১৩১৪

তথ্যসূত্র

১ Pandua was large city in golden times, and is situated twelve miles north of Angrezabad. It used to be well-peopled, and from the begining of the reign of Shamsuddin Ilyas Shah to the end of the reign of Rajah Kans, six kings ruled there for the period of fifty-two years. In 795 A. H. (1393) Jalaluddin, the son of Rajah Kans, removed the seat of sovereignty to Gour.–Khursidjahannamah, as published in J.A. S.B. (795.)

২ Ghulam Husain, writing in 1788, speaks of there still being traces of the building.-H. Beveridge.

৩ It is now so destroyed that no trace of it remains. — Khursidjahannamah.

8 This is the building of the holy Shah Jalal, the holy Shah Niamutulla repairedit. –Translationoftheinscription.

পাণ্ডুয়ার কীৰ্তিচিহ্ন

আদিনার গঠন-সৌন্দর্য্যে পাণ্ডুয়ার অন্যান্য কীৰ্তিচিহ্ন নিষ্প্রভ হইয়া রহিয়াছে। আদিনা না থাকিলে, সে সকল কীৰ্তিচিহ্ন সমধিক গৌরব লাভ করিতে পারিত। যে সকল হিন্দু ও বৌদ্ধমন্দির বিলুপ্ত করিয়া শেরশাহ আদিনা রচনায় ব্যাপৃত হইয়াছিলেন, তাহা অক্ষতশরীরে বর্তমান থাকিলে, আদিনা নিষ্প্রভ হইয়া পড়িত কি না, তাহা কে বলিতে পারে? আদিনার জন্যই পাণ্ডুয়া দেবমন্দিরশূন্য হইয়া পড়িয়াছিল। রাজা গণেশের শাসন-সময়ে পাণ্ডুয়া আবার দেবমন্দিরে অলংকৃত হইয়া উঠিতেছিল।

গণেশের শাসন সময়ের দুই শ্রেণীর ইতিহাস প্রচলিত আছে। এক শ্রেণীর ইতিহাসে–গণেশ হিন্দু মুসলমানের প্রিয়পাত্র,পরম ন্যায়পরায়ণ–প্রজাপালক পুণ্যশ্লোক নরপতি বলিয়া প্রশংসিত। আর এক শ্রেণীর ইতিহাসে–গণেশ মুসলমানবিদ্বেষী–অত্যাচারপরায়ণ–প্রজাপীড়ক রাজ্যাপহারক বলিয়া নিন্দিত। কিন্তু উভয় শ্রেণীর ইতিহাসেই–গণেশ হিন্দুধর্মানুরক্ত–দেবমন্দির নির্মাণকারক বলিয়া পরিকীর্তিত। সে সকল দেবমন্দির দীর্ঘকাল আত্মরক্ষা করিতে পারে নাই বলিয়া, তাহার চিহ্ন মাত্রও বর্তমান নাই। গণেশের পর তাঁহার পুত্র মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করিয়া, সুলতান জালালুদ্দীর নামে সিংহাসন আরোহণ করায়, মন্দির ভাঙ্গিয়া মসজেদ রচনার পুরাতন প্রবৃত্তি পুনরায় প্রবল হইয়া উঠিয়াছিল। তাহাতেই গণেশ নির্মিত দেবমন্দির বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে! গৌড়ীয় সাম্রাজ্যে যে সকল হিন্দু এবং বৌদ্ধ নরপতি সিংহাসনে উপবেশন করিয়া গিয়াছেন, তাহারা সকলেই শাসনপত্রে লিখিয়া দিতেন

“নহি পুরুষৈঃ পরকীৰ্ত্তয়ো বিলোপ্যাঃ।”

পরকীৰ্ত্তি বিনষ্ট করা মহাপাপ বলিয়া লোক সমাজেও সুপরিচিত ছিল। মুসলমান-শাসন সময়ে এই নীতি মৰ্য্যাদা লাভ করিতে পারে না। তাহাতেই পরকীৰ্ত্তি বিলুপ্ত করিয়া, বাদশাহগণ আত্মকীর্তি প্রতিষ্ঠিত করিয়া গিয়াছেন। রাজা গণেশ সিংহাসনে আরোহণ করিয়া মুসলমান নীতির অনুসরণ করিলে, আদিনা চূর্ণ বিচূর্ণ হইতে বিলম্ব ঘটিত না। তিনি পরকীৰ্ত্তি বিলুপ্ত না করিয়া, হিন্দুনীতিরই মৰ্য্যাদা রক্ষা করিয়া গিয়াছিলেন। কিন্তু তাঁহার পুত্র মুসলমানধৰ্ম্মের সঙ্গে মুসলমাননীতি গ্রহণ করায়, পুনরায় পরকীর্তিলোপের আগ্রহ উপস্থিত হইয়াছিল। একটি মন্দিরে তাহার পরিচয় অদ্যাপি দেদীপ্যমান রহিয়াছে। তাহা একটি সমাধি মন্দির বলিয়া পরিচিত। গোলাম হোসেন লিখিয়া গিয়াছেন,–তাহাতে সুলতান জালালুদ্দীনের, তাঁহার স্ত্রীর এবং পুত্রের মৃতদেহ সমাধিনিহিত হইয়াছিল। অদ্যাপি সে তিনটি সমাধি বর্তমান আছে। মন্দির জরাজীর্ণ হইয়া পড়িয়াছিল,–গম্বুজের উপর অশ্বথবৃক্ষ সমুদ্ভূত হইয়া তাহাকে নিরতিশয় বিপর্যস্ত করিয়া তুলিয়াছিল;–এখন তাহা সমূলে উৎপাটিত হইয়াছে, যথাযোগ্য জীর্ণসংস্কারও সাধিত হইতেছে। এই সমাধিমন্দিরের ইষ্টক প্রস্তরের সহিত বাঙ্গালার পুরাকাহিনী জড়িত হইয়া রহিয়াছে। ইহার নাম একলক্ষি।

একলক্ষি

এরূপ নাম প্রচলিত হইল কেন, কেহ তাহার রহস্যোদঘাটন করিতে পারেন নাই। এই নাম কি পুরাকালপ্রচলিত প্রকৃত পরিচয় বিজ্ঞাপক নাম? গোলাম হোসেনের সময়ে এই নাম প্রচলিত থাকিলে, তিনি ইহার উল্লেখ করিতে বিস্মৃত হইয়াছিলেন কেন? ইলাহিবকসের হস্তলিখিত ইতিহাসে এই নাম উল্লিখিত আছে। তবে কি এই নাম গোলাম হোসেনের পরে এবং ইলাহিবকসের পূৰ্ব্বে কোনও সময়ে সহসা প্রচলিত হইয়াছে? মুসলমান-সমাধিমন্দিরের হিন্দু নাম স্বতই এই সকল কৌতূহলের উদ্রেক করিয়া থাকে। কুতবশাহী মসজেদের উত্তর পূৰ্ব্বে– প্রচলিত রাজপথের অনতিদূরে–একলক্ষি অবস্থিত। রাভেনশা ইহাকে ৮০ ফিট আয়তনের সমচতুষ্কোণ মন্দির বলিয়া বর্ণনা করিয়া গিয়াছেন। ইলাহিবকসের হস্তলিখিত ইতিহাসে একলক্ষি ৫০ হাত দীর্ঘ, ৪৬ হাত প্রস্থ, ২৭ হাত উচ্চ বলিয়া বর্ণিত। কাহার বর্ণনা প্রকৃত তাহা পৰ্যটক মাত্রেই পরীক্ষা করিয়া দেখিতে পারেন।

এত বড় সমাধিমন্দিরের উপর একটি মাত্র গম্বুজ। তাহাই একলক্ষির গঠন কৌশলের প্রধান উল্লেখযোগ্য বিষয়। এই মন্দিরের আর একটি বিশেষত্ব আছে। ইহাতে কোন ফলকলিপি দেখিতে পাওয়া যায় না,–কখন কোন ফলকলিপি সংযুক্ত হইয়াছিল বলিয়াও বোধ হয় না। অনাবৃত হয়ঁতলে যে তিনটি সমাধি দেখিতে পাওয়া যায়, তাহাতেও কোন ফলকলিপি সংযুক্ত হয় নাই। একটি সমাধি সৰ্ব্বাপেক্ষা উচ্চ,–তাহা সকলের পশ্চিমে অবস্থিত। ইলাহিবকস লিখিয়া গিয়াছেন :

পশ্চিমপার্শ্বের সমাধি সুলতান জালালুদ্দীনের, পূৰ্ব্বপার্শ্বের সমাধি তাঁহার পুত্র সুলতান আহম্মদশাহের এবং মধ্যস্থলের সমাধি তাঁহার স্ত্রীর বলিয়া অনুমিত হয়।

এরূপ অনুমানের কারণ কি, ইলাহিবকস তদ্বিষয়ে আর কিছু লিপিবদ্ধ করেন নাই।

একলক্ষি দেবমন্দির না সমাধিমন্দির, তদ্বিষয়ে সংশয় উপস্থিত হইবার কারণ পরম্পরার অভাব নাই। গম্বুজ না থাকিলে, ইহার অন্যান্য গঠন কৌশল দেখিয়া, ইহাকে সমাধি-মন্দির বলিতে সাহস হইত না। চারিদিকে চারিটি প্রবেশ দ্বার; অট্টালিকার অনুপাতে সকল দ্বারই নিতান্ত ক্ষুদ্রায়তন। যে দ্বারটি দক্ষিণদিকে অবস্থিত, তাহাই প্রধান দ্বার। তাহা প্রস্তরময়। উপরের চৌকাঠের মধ্যস্থলে এক দেবমূৰ্ত্তি! তাহার নাক মুখ ভাঙ্গিয়া গিয়াছে। তাহার প্রতি লক্ষ্য করিয়া, ইলাহিবকস লিখিয়া গিয়াছেন, “এই দ্বার কোনও দেবমন্দির হইতে সংগৃহীত হইয়া থাকিবে।” কেবল দ্বার কেন,–একলক্ষির সব্বাঙ্গেই দেবমন্দিরের নিদর্শন দেখিতে পাওয়া যায়। কি অবস্থান, কি গঠন-পারিপাট্য, সৰ্বাংশেই একলক্ষি দেবমন্দিরের কথা স্মরণ করাইয়া দেয়। রাভেনশা তাহার প্রতি লক্ষ্য করিয়াছিলেন। কিন্তু তিনি ইহাকে ঘিয়াসুদ্দীনের সমাধিমন্দির বলিয়া বর্ণনা করিয়া গিয়াছেন। কাহার নিকট এরূপ কথা জ্ঞাত হইয়াছিলেন, রাভেনশা তাহার উল্লেখ করেন নাই। অন্যের কথা দূরে থাকুক, তাঁহার টীকাকারও ইহাতে আস্থা স্থাপন করেন নাই।৬

একলক্ষি বিশেষ ভাবে পৰ্যবেক্ষণ করিবার যোগ্য। কিন্তু আদিনা দর্শনের ঔৎসুক্যে পৰ্য্যটকেরা আত্মহারা হইয়া, দূর হইতে একলক্ষির প্রতি কটাক্ষপাত করিয়াই প্রত্যাবর্তন করিয়া থাকেন। জেনারেল কনিংহাম ইহাকে “বাঙ্গালী পাঠানস্থাপত্যের” উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত বলিয়া বর্ণনা করিয়া গিয়াছেন। গম্বুজের সম্বন্ধে সে কথা সৰ্ব্বাংশে সুসঙ্গত বলিয়া স্বীকার করিতে পারা যায়। অন্যান্য অংশের সম্বন্ধে সে কথা স্বীকার করিতে সাহস হয় না। একলক্ষি ইষ্টকগঠিত, মধ্যে মধ্যে প্রস্তরের সমাবেশ। ইষ্টকগুলি কারুকার্যখচিত। তাহাতে দেবমন্দিরের উপযোগী রচনাকৌশল অভিব্যক্ত। যে সময়ে এই মন্দির রচিত হয়, তখন হিন্দু মুসলমান মিলিয়া বাঙ্গালী জাতিতে পরিণত হইতেছিল। তখনকার শিক্ষা ও শিল্প উভয় সম্প্রদায়ে সমবেত প্রতিভায় উজ্জ্বল হইয়া উঠিতেছিল। সুতরাং একলক্ষিকে “বাঙ্গালী পাঠান-স্থাপত্যে” দৃষ্টান্ত না বলিয়া, “বাঙ্গালীর স্থাপত্য প্রতিভার” দৃষ্টান্ত বলিলেই সুসঙ্গত হয়। কারণ,

এই বিচিত্র মন্দিরে হিন্দুমুসলমানের স্থাপত্যপ্রতিভা সমভাবে দেদীপ্যমান। এখানে যাঁহারা চিরনিদ্রায় অভিভূত হইয়া রহিয়াছেন,–তাঁহাদের অবস্থাও সেইরূপ,– জাতিতে হিন্দু ধর্মে মুসলমান।

সাতাইশ ঘরা

আদিনার পূর্বাংশে বহুদূর পর্যন্ত রাজনগর প্রতিষ্ঠিত ছিল। তথায় এখনও অনেক সুবৃহৎ সরোবর দেখিতে পাওয়া যায়। আদিনার অর্ধক্রোশ পূৰ্ব্বে নিবিড় বনের অন্তরালে একটি সরোবর এবং তাহার তীরে দুর্গাকার স্থানে রাজপ্রাসাদের ভগ্নাবশেষ দেখিতে পাওয়া যায়। এই স্থান এখন “সাতাইশ ঘরা” নামে পরিচিত। সামসুদ্দীন ইলিয়াস পাণ্ডুয়ায় রাজধানী সংস্থাপিত করিয়া, এই স্থানেই বাস করিয়াছিলেন বলিয়া জনশ্রুতি প্রচলিত রহিয়াছে। এখানে ব্যাঘ্ৰভীতি এরূপ প্রবল ছিল যে, অধিকাংশ পর্যটক এখানে পদার্পণ করিতেন না। রাভেনশা এখানে পদার্পণ করিয়াছিলেন কিনা, তাহাতে সন্দেহ হয়। তাঁহার গ্রন্থে “সাতাইশ ঘরার” কোন চিত্র মুদ্রিত নাই। যে সংক্ষিপ্ত বিবরণ প্রদত্ত হইয়াছে, তাহাও জনশ্রুতি মূলক। সরোবরটি উত্তরদক্ষিণে দীর্ঘ। রাভেনশা লিখিয়া গিয়াছেন,–”তাহা মধ্যম পাণ্ডবের কীৰ্তিচিহ্ন বলিয়া পরিচিত।” সে যাহা হউক, সরোবরটি হিন্দুকীর্তি। তাহার পার্শ্বে যে রাজদুর্গ বৰ্তমান ছিল; তাহা প্রায় চিহ্নহীন হইয়া উঠিয়াছে। কোন পরিখা নাই,–প্রাচীরের আভাস মাত্র দেখিতে পাওয়া যায়। ইহাই যে পুরাতন রাজপ্রাসাদ, সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। এখানে একটি স্নানাগার দেখিতে পাওয়া যায়। তাহাও ধবংসদশায় নিপতিত হইয়াছে। ইলাহিবকস লিখিয়া গিয়াছেন,–এই স্নানাগার সামুদ্দীন ইলিয়াসের কীৰ্ত্তি চিহ্ন। দিল্লীর ইতিহাসবিখ্যাত “সামসী স্নানাগারের আদর্শে সামসুদ্দীন ইলিয়াস পান্ডুয়ায় স্নানাগার নির্মাণ করায়, দিল্লীশ্বর ফিরোজ শাহ ক্রোধান্ধ হইয়া পাণ্ডুয়া অবরোধ করিয়াছিলেন। গোলাম হোসেন এইরূপ লিখিয়া গিয়াছেন। সাতাইশ ঘরার স্নানাগারের কথা এইরূপে ইতিহাসে স্থান লাভ করিয়া চিরস্মরণীয় হইয়া রহিয়াছে। গোলাম হোসেনের কথা সত্য হইলে, একটি স্নানাগারের জন্য কি অনর্থই না উৎপন্ন হইয়াছিল! ফিরোজ শাহ দুই লক্ষ পদাতিক, যষ্টিসহস্র অশ্বারোহী লইয়া সহস্র পোতারোহণে পাণ্ডুয়ায় উপনীত হইয়া নগর অবরোধ করিয়াছিলেন। একদিনের যুদ্ধে একলক্ষ সেনা কালকবলে পতিত হইয়াছিল! এই সকল কারণে সাতাইশঘরার স্মৃতি নরশোণিত স্রোতে নিমগ্ন হইয়া রহিয়াছে। যাঁহারা পাণ্ডুয়ায় রাজধানী প্রতিষ্ঠিত রাখিয়াছিলেন, তাঁহারা সকলেই এই পুরাতন রাজপ্রাসাদে বাস করিতেন বলিয়া বোধ হয়। নিকটে বা দূরে অন্য কোনও রাজপ্রাসাদ থাকিলে, তাহার জনশ্রুতি বর্তমান থাকিত। “সাতাইশ ঘরা” এখন ধীরে ধীরে লোকলোচনের অন্তর্হিত হইতেছে,–যাহা আছে তাহারও জীর্ণসংস্কারের চেষ্টা হইতেছে না। গৌড়ের ন্যায় পাণ্ডুয়া ইংরাজরাজের কৃপা কটাক্ষে সুসংস্কৃত হইতেছে। কিন্তু কি গৌড়ে, কি পাণ্ডুয়ায়,–কোন স্থলেই রাজপ্রাসাদের জীর্ণসংস্কারের আয়োজন দেখিতেছি না! ইতিহাসের নিকট মসজেদ অপেক্ষা রাজপ্রাসাদের মূল্য অধিক। তাহার সহিত পুরাকাহিনীর প্রধান সংশ্রব। তাহা ধীরে ধীরে ধবংসপ্রাপ্ত হইলে, ইতিহাস সংকলন করা কঠিন হইয়া উঠিবে।

স্নানাগারটি সরোবরের পার্শ্বদেশেই অবস্থিত ছিল। এখন তাহার পূর্বাবস্থা বর্তমান নাই। ইলাহিবকস লিখিয়া গিয়াছেন,–”এই সরোবর নাসির শাহের সরোবর বলিয়া পরিচিত।”১০ উত্তরকালে গণেশের পুত্র পৌত্রের প্রভাবে ইলিয়াস বংশীয় নাসিরুদ্দীন শাহ সিংহাসনে আরোহণ করিবার কথা ইতিহাসে দেখিতে পাওয়া যায়। কিন্তু ইতিহাসে ইহাও দেখিতে পাওয়া যায়,–নাসীরুদ্দীন সিংহাসনে আরোহণ করিয়া, রাজধানী গৌড়নগরে স্থানান্তরিত করিয়াছিলেন। পাণ্ডুয়ায় নাসিরুদ্দীনের কীৰ্তিচিহ্ন দেখিতে পাওয়া যায় না। তাঁহার সিংহাসনারোহণের পূৰ্ব্ব হইতে সরোবর না থাকিলে, তাহার পার্শ্বে তাঁহার পূর্ব পুরুষের স্নানাগার নিৰ্ম্মিত হইত না। সরোবরের আকার ও স্নানাগারের সান্নিধ্য ইহাকে পুরাতন সরোবর বলিয়াই ঘোষিত করিতেছে। নাসিরুদ্দীনের নামে তাঁহা কথিত হইয়া থাকিলেও, তাহা যে নাসিরুদ্দীনের কীৰ্ত্তি, এরূপ অনুমান ভিত্তিহীন বলিয়াই বোধ হয়।১১

পাণ্ডুয়ায় আর একটি সুপরিচিত দৃশ্যের নাম “সোনা মসজেদ।” কিন্তু পাণ্ডুয়ার সোনা মসজেদ গঠন-গৌরবে গৌড়ের সোনা মসজেদের সমকক্ষ বলিয়া স্পর্ধা প্রকাশ করিতে পারে না। তথাপি তাহা পাণ্ডুয়ার একটি উল্লেখযোগ্য দৃশ্য বলিয়া উল্লিখিত হইতে পারে। তাহা আয়তনে ক্ষুদ্র হইলেও, গঠনপারিপাট্যে সুন্দর বলিয়া কথিত হইবার যোগ্য।

এক সময়ে প্রস্তরগঠিত অট্টালিকার প্রাধান্য ছিল বলিয়া বোধ হয়। তাহার পর প্রস্তরের সঙ্গে ইষ্টক সংযোগে অট্টালিকা নির্মিত হইতে আরম্ভ করে। গৌড় এবং পাণ্ডুয়ার অধিকাংশ অট্টালিকায় তাহারই নির্দশন প্রাপ্ত হওয়া যায়। এ বিষয়ে পাণ্ডুয়ার সোনা মসজেদ অনন্যসাধারণ বলিয়া উল্লিখিত হইতে পারে। ইহার আদ্যন্ত প্রস্তরগঠিত।১২

কুতবশাহী অট্টালিকার উত্তরে এই ক্ষুদ্র মসজেদ অবস্থিত। ইহার পূৰ্ব্বদিকে একটি প্রাঙ্গণ। প্রাঙ্গণের পূর্বে একটি সুদৃঢ় তোরণদ্বার। তাহা অদ্যাপি দেখিতে পাওয়া যায়। মসজেদের মধ্যে একটি সুদৃশ্য উপাসনাবেদী বর্তমান আছে। প্রস্তরফলকে লিখিত আছে,–”হিজরী ৯৯০ সালে মহম্মদ অল খলিদির পুত্র মকদুম শেখ নামক সাধুপুরুষ কর্তৃক এই কুতবশাহী মসজেদ নির্মিত হইয়াছিল।”১৩ হিজরী ৯৯৩ সালে (১৫৮৫ খ্রিস্টাব্দে) তোরণ দ্বার নির্মিত হইবার কথা আর একখানি প্রস্তর ফলকে লিখিত আছে। মেজর ফ্রাঙ্কলিন হিজরী ৮৮৫ সালে এই মসজেদ সুলতান বাৰ্ব্বক শাহের পুত্র সুলতান ইউসফ শাহ কর্তৃক নির্মিত হইবার কথা একখানি প্রস্তরফলকে পাঠ করিয়া গিয়াছিলেন। সে ফলক দেখিতে পাওয়া যায় না। বর্তমান ফলকে ইহা “কুতবশাহী” বলিয়া উল্লিখিত আছে; তোরণ দ্বারের ফলকলিপিতে মকদুম শেখ আপনাকে কুতব শাহর দাসানুদাস বলিয়া বর্ণনা করিয়া গিয়াছেন। এই সকল কারণে মনে হয়,–এই মসজেদ পুরাতন; মকদুম শাহ তাহা পুনর্গঠিত করিয়া, তোরণদ্বার নির্মিত করিয়া থাকিবেন।

মকদুম শেখের নাম মালদহ অঞ্চলে “রাজা বিয়াবাণী” নামে পরিচিত। ইলাহিবক্স তাঁহার সুপরিচিত নামেরই উল্লেখ করিয়া গিয়াছেন। এই সাধুপুরুষ “অরণ্যের সম্রাট” বলিয়া কথিত হইতেন। জনসমাজে তাঁহার সম্মান প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছিল। দিল্লীশ্বর ফিরোজ শাহ যখন পাণ্ডুয়া অবরোধ করেন, সেই সময়ে (১৩৫৩ খৃষ্টাব্দে) এই সাধুপুরুষের দেহান্তর সংঘটিত হয়। গৌড়েশ্বর তখন শক্রবেষ্টিত একডালা দুর্গে পিঞ্জরাবদ্ধ বর্ণশার্দুলের ন্যায় গতিহীন। তাঁহার ফকিরের বেশ ধারণ করিয়া নগর হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া, মকদুম শেখের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগদান করিবার কথা গোলাম হোসেনের ইতিহাসে লিখিত আছে। কোথায় এই অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সধিত হইয়াছিল,–কোথায় এই সাধু-পুরুষের মৃতদেহ সমাধিনিহিত হইয়াছিল, তাহা বাঙ্গালার ইতিহাসের একটি জ্ঞাতব্য কথা। এই সময়ে গৌড়েশ্বর একডালা দুর্গে অবরুদ্ধ ছিলেন। তিনি তথা হইতেই গোপনে ছদ্মবেশে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগদান করিয়াছিলেন, এবং দিল্লীশ্বর সংবাদ পাইবার পূৰ্বেই ছদ্মবেশে দুর্গমধ্যে প্রত্যাবর্তন করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। এই কাহিনী পাঠ করিলে, একডালা দুর্গকে পাণ্ডুয়ার নিকটবর্তী বলিয়াই স্বীকার করিতে হয়। কিন্তু একডালার দুর্গ কোথায় ছিল, তাহা লইয়া তর্ক বিতর্কের সূত্রপাত হইয়াছে। কেহ তাহাকে দিনাজপুরে, কেহ বা সুবর্ণগ্রামের নিকটে আবিষ্কৃত করিয়াছেন বলিয়া কোলাহল করিতেছেন! ইলাহিবক্সের হস্তলিখিত ইতিহাসে ইহার রহস্য উদঘাটিত হইবার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু তিনি লিখিবেন বলিয়া লিখিয়া যাইতে পারেন নাই, তাহার জন্য গ্রন্থমধ্যে অলিখিত পৃষ্ঠা পড়িয়া রহিয়াছে। তিনি কেবল এই পৰ্য্যন্তই লিখিয়া গিয়াছেন,–”যেখানে মকদুম শেখের সমাধি, তাহা সাধুপুরুষদিগের সাধারণ সমাধি স্থান বলিয়া পৃথক ভাবে নির্দিষ্ট ছিল। সে মহল্লার মাম– দেবটোলা।” এই স্থান কোথায় ছিল, কেহ তাহার সন্ধান প্রদান করিতে পারে না। যেখানেই হউক, তাহা যে পাণ্ডুয়ার নিকটবর্তী, ইলাহিবক্সের লিখনভঙ্গী তাহা সুব্যক্ত করিয়া রাখিয়াছে!

রাজ্যবিস্তারের সঙ্গে ধৰ্ম্মবিস্তার করা মুসলমানদিগের প্রচলিত রীতি বলিয়া সুপরিচিত। তজ্জন্য প্রাচীন দেব মন্দিরের সান্নিধ্যে মসজেদ বা সমাধিমন্দির রচনা করাও সেকালে একটি প্রচলিত রীতি হইয়া উঠিয়াছিল। দেবটোলায় সাধুপুরুষদিগের সমাধিস্থান নির্দিষ্ট থাকিবার কথা পাঠ করিলে, তাহারই প্রমাণ প্রাপ্ত হওয়া যায়। পাণ্ডুয়ার নিকটবর্তী স্থান সমূহের পুরাতন নাম কিরূপ ছিল, কেহ তাহার তথ্যাবিষ্কারে কৃতকাৰ্য্য হইলে, দৃশ্যমান অট্টালিকাদির ইষ্টক প্রস্তর মুখরিত হইয়া উঠিবে–তাহারা বিবিধ বিলুপ্ত কাহিনীর সন্ধান প্রদান করিবে,–যাহা নাই, তাহার কথায়, যাহা আছে, তাহাকে হয় ত নিষ্প্রভ করিয়া ফেলিবে! ভবিষ্যতের পৰ্যটকগণ কেবল কৌতূহল চরিতার্থের জন্য শ্রম স্বীকার না করিয়া, এই সকল বিষয়ের তথ্যানুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইলে, প্রবন্ধরচনার সকল প্রয়াস চরিতার্থ হইবে। ইতি।

প্রবাসী, বৈশাখ, ১৩১৫

তথ্যসূত্র

১ To this day a large tower exists over his mausoleum at Panduah. The graves of his wife and son lie by the side of his mausoleum.– Riaz-us Salateen, p. 118.

২ রাভেনশার গ্রন্থে একলক্ষির যে চিত্র আছে, তাহাতে ইলাহিবকসের বর্ণনাই প্রমাণীকৃত হইয়া রহিয়াছে।

৩ I imagine that the western tomb, which is the highest, is that of Sultan Jalaluddin, that the one to the East is that of his son Sultan Ahmed Shah, and that the middle one is the tomb of his wife. –Khushid-jahannamah.

8 It appears from this that the lintel must have belonged to some idol temple, Ibid.

৫ It is beleived to contain the remains of Sultan Ghyasuddin, his wife, and his daughter-in-law. This tomb is a remarkable instance of the use of Hindu materials in the erection of a Muhammedan Mausoleum, for both door posts and lintels are covered with Hindu carvings.– Ravenshaw’s Gour, p. 58.

৬ This can hardly be other that the “domed tomb” referred to in the Riaz-us-Salateen as that of Jalaluddin Abul Muzaffar Muhammad Shah. See Blochmann’s contributions. J.A. S. B. Vol. X LII. Part. I. p. 267.

৭ General Cunningham cites this tomb as “one of the finest specimens of the Bengali Pathan tomb.” –Archaeological Survey Report, Vol. III. p. 11.

৮ The tank has its greatest length north and south, and tradition declares it to have been the work of Arjun of the race of Pandu. — Ravenshaw’s Gour, p. 67.

৯ It is said that at that time Sulan Shamsuddin built a bath, similar to the Shamsi-bath of Delhi. Sultan Firuz Shah, who was furious with anger. against Shamsuddin in the year 754 A. H., set out for Lakhanauti, and after forced marches, reached close to the city of Panduah, which was then the metropolis of Bengal, — Rias-us-Salateen, p. 100.

১০ Ilahibux notices the beautiful tank of Sataisghara, and says, it is known by the name of Nasir Shah’s tank.-H. Beveridge

১১ If it was he, who made the tank, then the probability is increased that the baths were made by his ancestor, for he would naturally revert to the palace of his forefathers. freiste T62695 ag tro o apat বলিয়াই বোধ হয়। কারণ, নাসিরুদ্দীন পাণ্ডুয়ার রাজপ্রাসাদে বাস করেন নাই, এবং প্রথমে স্নানাগার পরে সবোবর–ইহাও অসঙ্গতকথা।

১২ North of Qutabs’ house stands a small but beautiful Mosque, called the Sona Musjid, or Golden Mosque, built throughout of horneblende. — Ravenshaw’s Gour, p. 56.

১৩ The foundation of this mosque was; laid by the Honourable and Venerable Mukhadum Shaikh, son of Mahammad Al-Khalidi, honoured in all places, polestar of the pole-stars, and source of rectitude. May God extend the shadow of his property. This mosque is the Qutabshahi and its date is “Mukhdum Ubed Raji, A. H. 990.”—ফলকলিপির অনুবাদ

আদিনা

পাণ্ডুয়ার পুরাতন কীৰ্তিচিহ্নের মধ্যে “ছোট দরগা” এবং “বড় দরগা” মুসলমানসমাজে পুণ্যতীর্থরূপে ব্যবহৃত হইয়া আসিতেছে বলিয়া, তথায় পুরাকাল হইতে বর্তমান সময় পর্যন্ত, কখনও লোকসমাগমের সম্পূর্ণ অভাব উপস্থিত হইতে পারে নাই। পাণ্ডুয়ার অন্যান্য কীৰ্তিচিহ্নের–সোনা মসজেদের, একলক্ষির, আদিনার এবং সাতাইশঘরার কথা স্বতন্ত্র। দীর্ঘকাল লোকসমাগম প্রচলিত না থাকায়, এই সকল পুরাতন অট্টালিকা নিবিড় অরণ্যে আচ্ছন্ন হইয়া পড়িয়াছিল। অল্পদিন পূৰ্ব্বেও সে অরণ্যে ব্যাঘ্ৰভীতি এরূপ প্রবল ছিল যে, বিশেষভাবে আত্মরক্ষার ব্যবস্থা না করিয়া, কোনও পৰ্যটক তথায় গমন করিতে সাহসী হইতেন না। সকল অট্টালিকাই ভগ্নদশায় পতিত হইয়াছিল; তাহার উপর কত বৃক্ষলতা অঙ্গ বিস্তার করিয়া, গঠনসৌন্দৰ্য্য আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিয়াছিল! কিন্তু তাহাতে এক নূতন শোভা বিকশিত হইয়া উঠিয়াছিল। বনান্তরাল হইতে যাহা কিছু দেখিতে পাওয়া যাইত, তা বিস্ময়বিজড়িত স্বপ্নালোকের ন্যায় প্রতিভাত হইত। বনের পর বন,–নির্জন, নীরব, শ্বাপদসঙ্কুল, –তাহার মধ্যে এরূপ অজ্ঞাতপূৰ্ব্ব দর্শনমোহ এক অনিৰ্ব্বচনীয় ভাবে হৃদয় মন পরিপূর্ণ করিয়া দিত! এখন আর সেদিন নাই। এখন পাণ্ডুয়ার বিজন বনের মধ্যে ডাকবাংলা,–পুরাতন অট্টালিকার অঙ্গে জীর্ণসংস্কার, বনভুমির ভিতর দিয়া রাজপথ! তথাপি পাণ্ডুয়া সম্পূর্ণরূপে আতঙ্কশূন্য হইয়াছে বলিয়া বোধ হয় না। জল এখনও বিষাক্ত,–বায়ু এখনও অস্বাস্থ্যকর। কীৰ্তিচিহ্নের মধ্যে প্রধান কীৰ্তিচিহ্ন আদিনা। তাহার জন্য কত পৰ্যটক পৌণ্ড্রবর্ধনে পদার্পণ করিয়া থাকেন! আদিনা ভুবনবিখ্যাত হইবার যোগ্য; এত বড়ো, অথচ এমন সুন্দর, মুসলমান মসজেদ আর কোথায় দেখিতে পাওয়া যাইবে? ইহাই আদিনার প্রধান গৌরবের কথা। তাহা বৃহৎ এবং সুন্দর। এখন একাংশের উপর অল্প কয়েকটি গম্বুজ বর্তমান আছে; অন্যান্য গম্বুজ, খিলান, স্তম্ভ এবং ভিত্তি ভাঙ্গিয়া পড়িয়া গিয়াছে! তথাপি আদিনা বঙ্গদেশের এক অতুলনীয় অট্টালিকা। যাহা আছে, তাহাই যথেষ্ট। তাহার প্রতি দৃষ্টিপাত করিলে, গঠনপ্রতিভার পরিচয় গ্রহণের জন্য কৌতূহল প্রবল হইয়া উঠে। গঠন প্রতিভার কথা চিন্তা করিবার পূৰ্ব্বে, গঠনকাহিনীর আলোচনা করা কর্তব্য। সে কাহিনী এখনও সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হয় নাই।

গঠন কাহিনী

বরেন্দ্রমণ্ডল বহুবিপ্লবের লীলাভূমি। মুসলমানাধিকার প্রবর্তিত হইবার সময়েও তাহা বহুবিপ্লবে বিপর্যস্ত হইয়াছিল। মুসলমানগণ সহসা সকল স্থান অধিকার করিতে পারেন নাই। তাহার জন্য দীর্ঘকাল যুদ্ধ কলহ,–দীর্ঘকাল রক্তপাত, দীর্ঘকাল জয়পরাজয় সংঘটিত হইয়াছিল। এই প্রদেশ বহুসংখ্যক সামন্ত নরপতির অধীন ছিল; স্থানে স্থানে তাঁহাদের রাজধানী এবং রাজদুর্গের ভগ্নাবশেষ পড়িয়া রহিয়াছে। তাঁহারা ভারতবর্ষের চিরপ্রচলিত সামন্ত প্রথার মর্যাদা রক্ষা করিয়া গৌড়েশ্বরকে রাজচক্রবর্তী বলিয়া স্বীকার করিতেন, কিন্তু স্বরাজ্যে স্বতন্ত্র শাসনক্ষমতার পরিচালনা করিতেন। গৌড়েশ্বরের রাজধানী মুসলমানের নিকট পরাভূত হইলেও, এই সকল সামন্ত নরপতি সহসা পরাভব স্বীকার করেন নাই। তাঁহারা স্বাধীনতারক্ষার্থ যথাসাধ্য চেষ্টা করিয়াছিলেন এবং মুসলমানশাসনের প্রথমযুগে অনেক দিন পর্যন্ত স্বাধীনতা রক্ষা করিতে কৃতকার্য হইয়াছিলেন। তাঁহাদের নাম গোত্র বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে, তজ্জন্য বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকে তাঁহাদের আত্মরক্ষার কথা স্থানলাভ করে নাই। কিন্তু অনুসন্ধাননিপুণ ইংরাজলেখকেরা তাঁহাদের আত্মরক্ষাকাহিনী সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করিতে পারেন নাই। এই সকল কারণে, বক্তিয়ার খিলিজি এদেশে আসিয়া, যাহা পাইয়াছিলেন তাহা লইয়াই রাজ্যগঠনে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন। তাহা বড় অধিক নহে; পুনর্ভাবাতীরে দেবকোট নামক একটি পুরাতন দুর্গের নিকটবর্তী কয়েকটি মাত্র পরগণা। তজ্জন্য দেবকোটের মুসলমানশিবির এদেশের প্রথম মুসলমান রাজধানী হইয়া উঠিয়াছিল। তাহার পর গৌড়, এবং তাহার পর পাণ্ডুয়া মুসলমান রাজধানীরূপে পরিচিত হইয়া উঠিয়াছিল। এই সকল কারণে পৌণ্ড্রবর্ধনে সহসা কোনও পরিবর্তন সাধিত হয় নাই,–তথায় অনেক দিন পর্যন্ত হিন্দু ও বৌদ্ধ কীৰ্ত্তি বৰ্তমান ছিল। সামসুদ্দীন ইলিয়াস পাণ্ডুয়ায় রাজধানী স্থানান্তরিত করিবার সময় হইতে পুরাতন কীৰ্তিচিহ্ন বিলুপ্ত হইতে আরম্ভ করে। তিনিও পাণ্ডুয়ার অধিক পরিবর্তন সাধিত করিবার অবসরপ্রাপ্ত হইয়াছিলেন বলিয়া বোধ হয় না। তাঁহাকে পূৰ্ব্ববঙ্গ জয় করিতে হইয়াছিল,–দিল্লীশ্বর ফিরোজশাহের আক্রমণ হইতে পাণ্ডুয়া রক্ষা করিয়া, সন্ধি সংস্থাপিত করিতে হইয়াছিল। এই সকল যুদ্ধ কলহে বিপর্যস্ত হইয়া সামসুদ্দীন ১৩৫৮ খৃষ্টাব্দে পরলোক গমন করেন। তাঁহার পুত্র শেকন্দর শাহের দীর্ঘ শাসন সময়েই পাণ্ডুয়ার সবিশেষ পরিবর্তনের সূত্রপাত হয়।

সেকন্দর শাহ মন্দির ভাঙ্গিয়া মসজেদ রচনায় প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন। ইহা সে কালের মুসলমান বাদশাহগণের সাধারণ প্রবৃত্তি বলিয়া উল্লিখিত হইতে পারে। বক্তিয়ার খিলিজি ইহার পথপ্রদর্শক বলিয়া উল্লিখিত। মুসলমান লিখিত ইতিহাসে তাহা সগৌরবে কীৰ্ত্তিত হইয়াছে। আদিনার ইষ্টকপ্রস্তর পরীক্ষা করিয়া দেখিলে, তাহা যে পুরাতন হিন্দু বা বৌদ্ধ মন্দিরের ইষ্টক প্রস্তর তাহাতে সংশয় উপস্থিত হয় না। কেহ কেহ বলিয়া গিয়াছেন,–আদিনা যে ভূমিখণ্ডের উপর নির্মিত হইয়াছিল, তাহা একটি দেবমন্দিরের স্থান বলিয়া সুপরিচিত ছিল। শেকন্দর শাহের আদেশে তাহাই মসজেদরূপে পরিবর্তিত হইয়াছিল। মধ্যস্থলে এক বিস্তীর্ণ প্রাঙ্গন,–তাহা উত্তর দক্ষিণে দীর্ঘ! তাহার চতুর্দিকে প্রকোষ্ঠের পর প্রকোষ্ঠ, তাহাই এখন ‘আদিনা” নামে সুপরিচিত। বহুসংখ্যক প্রস্তর স্তম্ভের উপর বহুসংখ্যক খিলান,–তাহার উপর বহু সংখ্যক গম্বুজ,–দেখিবামাত্র মনে হয়, বহুকালের চেষ্টায় স্তম্ভবহুল দেবমন্দির মসজেদরূপে পরিবর্তিত হইয়াছিল। শেকন্দর ইহাকে সমাপ্ত করিয়া যাইতে পারেন নাই। তাঁহার প্রিয়পুত্র ঘিয়াসুদ্দীন বিদ্রোহী হইয়া পিতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করিয়াছিলেন। সেই যুদ্ধে বৃদ্ধ শেকর শাহের মৃত্যু সংঘটিত হয়। আদিনার গঠন কাহিনীর সঙ্গে এই অকীৰ্ত্তিকর সমর কাহিনী চিরসংযুক্ত হইয়া রহিয়াছে। গঠন কালে যে সকল হিন্দু বা বৌদ্ধ মূর্তি ব্যবহৃত হয় নাই, তাহা অনেকদিন পর্যন্ত ইতস্ততঃ পড়িয়াছিল। অনেকে তাহা দর্শন করিয়া গিয়াছেন। আদিনা ভাঙ্গিয়া পড়িবার পর কোন কোন প্রস্তরমূর্তি বাহির হইয়া পড়িয়াছিল। তাহাও অনেকে দর্শন করিয়া গিয়াছেন। এখন তাহার অধিকাংশই স্থানান্তরিত হইয়াছে; যাহা দেখিবার সম্ভাবনা ছিল, তাহাও জীর্ণসংস্কার কালে পুনরায় ভিত্তিমধ্যে প্রোথিত হইয়া পড়িতেছে।

গঠন কৌশল

গঠন কৌশলের প্রধান উল্লেখযোগ্য বিষয় অত্যাশ্চর্য্য গঠন-সামঞ্জস্য। তাহার জন্যই আদিনা বৃহৎ এবং সুন্দর। বাহিরের সৌন্দৰ্য্য অপেক্ষা ভিতরের সৌন্দৰ্য্যই অধিক। বাহিরে বৃহত্ত্বে সৌন্দর্য পরাভূত; ভিতরে সৌন্দর্য্যে বৃহত্ব পরাভূত। আদিনা উত্তর দক্ষিণে ৫০০ ফুট, পূৰ্ব্ব পশ্চিমে ৩০০ ফুট;–এত বড় বলিয়াই ইহার সমগ্র অবয়বের ফটোগ্রাফ গৃহীত হইতে পারে নাই। এত বড় মসজেদের একটিমাত্র প্রবেশদ্বার, তাহা পশ্চিম দিকে অবস্থিত, আয়তনে নিতান্ত খুদ্র। তাহা সহসা দৃষ্টিপথে পতিত হয় না। এই ক্ষুদ্র দ্বারের উপরে একখানি প্রস্তর ফলক; তাহাতে লিখিত আছে :

হিজরী ৭৭০ সালের ৬ রজব তারিখে (১৩৬৯ খৃষ্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারী দিবসে) লিখিত হইল যে, বাদশাহ ইলিয়াসের পুত্র পরম ন্যায়পরায়ণ বাদশাহ শেকন্দর শাহ কর্তৃক এই মসজেদ নির্মাণের আদেশ প্রদত্ত হইয়াছিল।

গোলাম হোসেন যখন ‘রিয়াজ-উস-সলাতিন” রচনা করেন, তখনও আদিনার ভগ্নদশা। তিনি লিখিয়া গিয়াছেন,–হিজরী ৭৬৬ সালে আদিনা নির্মিত হইতে আরম্ভ করে : কিন্তু শেকন্দর শাহের মৃত্যু সংঘটিত হইলে, আদিনা অসমাপ্ত থাকিয়া যায়। আদিনা কোন সময়ে নির্মিত হইতে আরম্ভ করে, দ্বারফলকে তাহা স্পষ্টাক্ষরে লিখিত নাই। তাহাতে লিখিত আছে,–সেকন্দর শাহ আদিনা নির্মাণের আদেশ দিয়াছিলেন, এবং সে কথা হিজরী ৭৭০ সালের ৬ রজব তারিখে খোদিত করাইয়াছিলেন। সুতরাং দ্বার ফলকের তারিখকে নির্মাণারম্ভের তারিখ বলিতে সাহস হয় না। গোলাম হোসেন হিজরী ৭৬৬ সালকে নির্মাণারম্ভের তারিখ বলিয়া ঘোষণা করায়, তাহাই বিশ্বাসযোগ্য বলিয়া স্বীকার করিতে হয়। কিন্তু তিনি এই তারিখের সন্ধান কোথায় পাইয়াছিলেন, তাহার উল্লেখ করেন নাই। গোলাম হোসেনের এই উক্তি সত্য হইলে, হিজরী ৭৬৬ সাল হইতে শেকদার শাহের মৃত্যু পৰ্য্যন্ত ২৫ বৎসরে আদিনার অর্ধেক গঠনকার্য সম্পন্ন হইয়াছিল! ফ্রাঙ্কলিন লিখিয়া গিয়াছেন–আদিনায় ২৬০ স্তম্ভ ছিল।

অভ্যন্তরের দৃশ্যাবলীর মধ্যে পশ্চিম প্রকোষ্ঠের উত্তরাংশের “বাদশাহের তখত,” নামক ৮০ ফুট দীর্ঘ, ৪০ ফুট প্রস্থ, ১২ ফুট উচ্চ প্রস্তরনির্মিত উপাসনামঞ্চ, –তাহার সম্মুখস্থিত ভিত্তিগাত্রে কৃষ্ণমৰ্ম্মরের উপর বিচিত্র কারুকার্য্য, তখতের দক্ষিণে, পশ্চিমভিত্তিসংলগ্ন উপাসনাবেদী ও তাহার সোপানাবলী, বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

কি ইষ্টক, কি প্রস্তর, সমস্তই কারুকার্য খচিত। দেখিলে, দেখিবার আকাঙ্ক্ষা পরিতৃপ্ত হয় না। প্রস্তর খোদিত শতদল দেখিলে, বৌদ্ধশিল্পের কথা স্মরণ পথে উদিত হইয়া থাকে। দুই স্থানে দুইটি পুরাতন চিতা ভস্মাধারের বিচিত্র প্রতিকৃতি! মুসলমান মসজেদের তাহার প্রয়োজনাভাব,–বোধ হয় কেবল সুন্দর বলিয়াই তাহা অন্যান্য কারুকার্যের সঙ্গে মসজেদে স্থান প্রাপ্ত হইয়াছে।

আদিনার অসমাপ্ত সৌন্দৰ্য্য গাম্ভীর্য এমন ধবংশদশায় পতিত হইয়াও বিস্ময় উৎপাদন করিতে নিরস্ত হয় নাই। তাহার একমাত্র কারণ এই যে, আদিনার সকল শোভাই অনন্য-সাধারণ। গৌড় এবং পাণ্ডুয়ায় সুদৃশ্য অট্টালিকার অভাব নাই; কিন্তু তাহার একটিও আদিনার সমকক্ষ বলিয়া স্পর্ধা প্রকাশ করিতে পারে না। কৃষ্ণমৰ্ম্মরের মসৃণ ফলকে এরূপ সূক্ষাতিসুক্ষ্ম কারুকাৰ্য্য অন্য স্থানে দেখিতে পাওয়া যায় না।

এই অনন্যসাধারণ গঠন-কৌশলের মূলে কাহার অনন্য সাধারণ গঠন প্রতিভা বর্তমান ছিল, এত কালের পর তাহার পরিচয় প্রাপ্ত হইবার উপায় নাই। প্রাচ্য শিল্পী আত্মঘোষণা না করিয়া শিল্পগৌরব ঘোষণার জন্যই সমধিক আগ্রহ প্রকাশ করিতেন। ভারতবর্ষে কত বিচিত্র মন্দির পড়িয়া রহিয়াছে। তাহাতে কাহার গঠন প্রতিভা বিকশিত হইয়া রহিয়াছে, কেহ তাহার সন্ধান প্রদান করিতে পারে না। ইহাই প্রাচ্য প্রবৃত্তির সাধারণ লক্ষণ;–আদিনাতেও সে লক্ষণ দেদীপ্যমান।

আদিনার কারুকার্য সৰ্বাংশেই উপাসনালয়ের উপযোগী। তাহার উপর ভক্তিবিশ্বাসবিজ্ঞাপক কোরাণ-শ্লোক উৎকীর্ণ। তাহা পাঠ করিবার পূৰ্ব্বে, এতবড় মসজেদের একটিমাত্র ক্ষুদ্র প্রবেশদ্বারের তাৎপৰ্য্য হৃদয়ঙ্গম হয় না। কিন্তু যখন উপাসনাবেদীর সম্মুখীন হইয়া দেখিতে পাওয়া যায়, বড় বড় অক্ষরে লিখিত রহিয়াছে, “হে বিশ্বাসী! মস্তক অবনত কর–পতিত হও–আরাধনা কর,”– তখন মনে হয়, প্রবেশকালে উপাসকের মন অবনত করিবার জন্যই প্রবেশদ্বার এরূপ ক্ষুদ্রায়তন গ্রহণ করিয়া থাকিবে। তাহাতে রচনা কৌশলও সার্থক হইয়া রহিয়াছে। অভ্যন্তরে কোন স্বপ্নলোক কুহক বিস্তার করিয়া রাখিয়াছে, বাহির হইতে তাহার কিছুমাত্র দৃষ্টিপথে পতিত হয় না। প্রবেশ করিবামাত্র বাহিরের সহিত ভিতরের পার্থক্য সহসা আত্মপ্রকাশ করিয়া, অজ্ঞাতসারে দর্শকচিত্ত অভিভূত করিয়া দেয়। এই সকল কারণে, আদিনাকে ইষ্টকপ্রস্তরের ভগ্নস্তূপ বলিয়া বর্ণনা করিলে, তাহার অবমাননা করা হয়। আদিনা একখানি সুলিখিত মহাকাব্য।

প্রবাসী, চৈত্র, ১৩১৪

তথ্যসূত্র

১ প্রথম যখন আদিনা দর্শন করি, তখন রাজপথ নির্মিত হইলেও বৃক্ষলতা দূরীকৃত হয় নাই, কোনোরূপ জীর্ণ সংস্কারের চেষ্টা প্রবর্তিত হয় নাই। তখনও শ্বাপদশঙ্কা প্রবল ছিল; হস্তীপৃষ্ঠে গমন করিতে হইত। এখন গোশকট, অশ্বশকট চলাচল করিতে পারে; যানবাহনের অপ্রতুল হইলে, পদব্রজে গমন করিবারও অসুবিধা নাই।

২ The Rajas of Northern Bengal were powerful enough to preserve a semi-independence in spite of the numerous invasions from the time of Bakhtyar Khiligi when Devkot, near Dinajpur, was looked upon as the most important military station towards the North. H. Blockmann’s Geography and History of Bengal.

৩ In one of its corners stands a beautifully carved pulpit, below the steps of which a large slab of stone, now fallen, bears the features of a Hindu God on its reverse side,– Ravenshaw’s Gour, p. 64.

৪ ইলাহিবকস এতৎ প্রসঙ্গে লিখিয়া গিয়াছেন,–It is worth observing that in front of the Chaukath of the Adina mosque, there was a broken and polished idol, and that there were other idols lying about, and that under the steps near the pulpit, there was another broken idol. So it appears, that in fact, this mosque was originally an idol-temp.

৫ এই প্রস্তর ফলকের সাল ও তারিখ সম্বন্ধে তর্ক বিতর্ক প্রচলিত আছে। এস্থলে গোলাম হোসেনের মত গ্রহণ করাই সঙ্গত বোধ হয়।

৬ And in the year 766 A. H. he built the Adina Mosque; but before he could finish it, death overtook him, and the building remained half finished, –The Riaz-us-Salatin, p.-105.

৭ A mere description must fall short in attempting to delineate the features of this magnificient pile. It requires the pencil of the artist– Major Francklin.

৮ Among other decorations, its western compartment contains a most extraordinary piece of sculpture resembling a funeral urn of an antique fashion, the only thing of its kind I have ever beheld in any part of Asia. Another urn, nearly resembling this, is to be seen on the front of the Killah-Major Francklin.

একডালা দুর্গ

যে যুগ বাঙ্গালা ইতিহাসের “স্বাধীন পাঠান শাসন-যুগ” নামে কথিত হইয়া আসিতেছে, তাহার অনেক ঐতিহাসিক তথ্য এখনও তমসাচ্ছন্ন হইয়া রহিয়াছে। তজ্জন্য কত কাল্পনিক কাহিনী ইতিহাস বলিয়া পরিচিত হইতেছে, তাহার আলোচনা করিতে বসিলে, বিস্ময়ে অভিভূত হইতে হয়।

বঙ্গভূমি রত্নপ্রসবিনী বলিয়া জগদ্বিখ্যাত ছিল। তাহার জন্যই বক্তিয়ার খিলিজি এদেশে খিলিজিদিগের উপনিবেশ সংস্থাপনের আয়োজন করিয়াছিলেন। তাঁহার চেষ্টা স্বাধীন চেষ্টা। তাহা দিল্লীর বাদশাহের দিগ্বিজয় বলিয়া কথিত হইতে পারে না। শিষ্টাচার রক্ষার্থ বক্তিয়ার খিলিজি সময়ে সময়ে দিল্লীর বাদশাহের নিকট উপঢৌকন প্রেরণ করিলেও তাঁহাকে লক্ষণাবতীরাজ্যের রাজচক্রবর্তী বলিয়া স্বীকার করিতেন কি না, তাহাতে সংশয়ের অভাব নাই। কিন্তু বক্তিয়ার খিলিজির আকস্মিক অকাল মৃত্যুর অব্যবহিত পরে খিলিজিদিগের মধ্যে প্রাধান্য লাভের জন্য যে গৃহকলহের সূত্রপাত হয়, তাহাতেই দিল্লীর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠালাভ করে। স্বার্থান্ধ হইয়া কেহ কেহ দিল্লীর বাদশাহের শরণাপন্ন হইয়া, তাঁহার প্রতিনিধিরূপে লক্ষণাবতীরাজ্যে প্রতিষ্টালাভের চেষ্টা করেন। প্রজা সাদারণ,–কি হিন্দু, কি মুসলমান,–তাহাতে সম্মত ছিল বলিয়া বোধ হয় না। তখন এ দেশে সামন্তপ্রথা পূর্ণমাত্রায় বর্তমান ছিল। সামন্তগণ স্বাধীন নরপতির ন্যায় স্বাধিকার মধ্যে স্বাধীন ভাবেই শাসনক্ষমতা পরিচালিত করিতেন। বক্তিয়ার খিলিজি সেই সামন্তপ্রথা অক্ষুণ্ণ রাখিয়া কোন কোন স্থলে হিন্দুসামন্তের পরিবর্তে মুসলমান জায়গীরদার সংস্থাপিত করিয়াছিলেন। তিনি সকল স্থান জয় করিতে না পারিয়া, যতদূর জয় করিতে পারিয়াছিলেন, তাহা লইয়াই রাজ্য গঠনে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন। উত্তর বঙ্গের সামন্তগণ স্বাতন্ত্রপ্রিয় ছিলেন,–তাঁহারা শক্তিশালী বলিয়াও পরিচিত ছিলেন। বক্তিয়ার খিলিজির সময় হইতে তাঁহারা পুনঃপুনঃ আক্ৰমণবেগ সহ্য করিয়া প্রকারান্তরে স্বাধীন ভাবেই রাজ্য শাসন করিতেন। তাঁহাদের জন্যই বক্তিয়ার খিলিজিকে নিয়ত দেবকোটের সেনানিবাসে কাল যাপন করিতে হইত। এই স্বাতন্ত্রলিপ্সা হিন্দু সামন্তগণের ন্যায় মুসলমান জায়গীরদারগণকেও অনুপ্রাণিত করিয়া তুলিয়াছিল। তাঁহারা লক্ষণাবতীরাজ্যের সুলতান হইবার জন্য চেষ্টা করিলেও, দিল্লীর বাদশাহের অধীন বলিয়া পরিচয় দিতে স্বীকৃত হইতেন না। কালে হিন্দুমুসলমানের মধ্যে স্বার্থসমন্বয় সংস্থাপিত হইলে, এই স্বাতলিঙ্গা প্রবল হইয়া উঠিয়াছিল। তখন গৌড়ীয় সাম্রাজ্যের স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য বাঙ্গালী মাত্রেই বদ্ধপরিকর হইয়াছিলেন। অবশেষে ১৩৫৩ খ্রিস্টাব্দে হাজি সামসুদ্দীন ইলিয়াসের চেষ্টায় গৌড়ীয় সাম্রাজ্য সম্পূর্ণরূপে স্বাধীনতা লাভ করে। তাহা সহজে সাধিত হয় নাই। দিল্লীশ্বর ফিরোজ শাহ পাণ্ডুয়ার রাজধানী আক্রমণ করিয়া, হাজি ইলিয়াসের পুত্রকে কারারুদ্ধ করিয়াছিলেন;–হাজি ইলিয়াসকে একডালার দুর্গে অবরুদ্ধ করিয়া রাখিয়াছিলেন;–অবশেষে একডালার নিকটবর্তী উন্মুক্ত প্রান্তরে এক লক্ষ বাঙ্গালী হিন্দু মুসলমান জীবন বিসর্জন করিতে বাধ্য হইয়াছিল।

একডালার যুদ্ধক্ষেত্র বাঙ্গালী হিন্দু মুসলমানের চিরস্মরণীয় বিজয় ক্ষেত্র। বাঙ্গালী মাত্রেই স্বাধীন পাঠান শাসনের কথা অবগত আছেন, কোন কোন গৌড়ীয় বাদশাহের নাম এখনও অনেকের নিকট সুপরিচিত। কিন্তু যে বিজয়ক্ষেত্রে এই স্বাধীন শাসন প্রতিষ্ঠালাভ করিয়াছিল, তাহার নাম পৰ্য্যন্ত বাঙ্গালীর নিকট অপরিচিত হইয়া উঠিয়াছে!

একডালা-দুর্গ কোথায় ছিল, বাঙ্গালী তাহার তথ্য নির্ণয়ের জন্য যথাযযাগ্য আগ্রহ প্রকাশিত করে নাই। ইংরাজ লেখকগণ তাহাতে প্রবৃত্ত হইয়া, নানা তর্ক বিতর্কের অবতারণা করিয়া গিয়াছেন। তাহা যেরূপ বিস্ময়াবহ, সেইরূপ হাস্যোদ্দীপক! অথচ তাহাই ঐতিহাসিক তথ্য বলিয়া পরিচিত হইয়া রহিয়াছে।

দিনাজপুরের কালেকটর মিষ্টার ওয়েষ্টমেকট লিখিয়াছিলেন–একডালা দিনাজপুর জেলায় অবস্থিত।

উত্তরবঙ্গের অনেক স্থানেই পুরাতন সামন্তগণের এবং জায়গীরদারগণের রাজদুর্গের ভগ্নাবশেষ পড়িয়া রহিয়াছে। তাহারই একটি স্থান লক্ষ্য করিয়া,–সে স্থান স্বয়ং পরিদর্শন না করিয়াই–মিষ্টার ওয়েষ্টমেট একডালা দুর্গের স্থান নির্ণয় করিয়া গিয়াছিলেন। তাহাই কিছু দিন পর্যন্ত একডালা দুর্গের প্রকৃত স্থান বলিয়া ইংরাজ লেখক-সমাজে সমাদর লাভ করিয়াছিল।

প্রসিদ্ধ মুদ্ৰাতত্ত্ববিৎ মিষ্টার টমাস পুনর্ভবানদীতীরবর্তী জগদলা নামক স্থানকে একডালা বলিয়া ইঙ্গিত করিয়া যে তর্কবিতর্কের সূত্রপাত করিয়া যান, অধ্যাপক ব্লকম্যান তাহার অলীকত্ব প্রতিপাদিত করিয়া লিখিয়াছিলেন,–একডালা দুর্গ পাণ্ডুয়ার নিকটবর্তী বলিয়া মুসলমানলিখিত ইতিহাসে সুস্পষ্ট উল্লিখিত থাকিলেও, অদ্যাপি তাহার স্থান নির্ণয়ে সংশয় রহিয়া গিয়াছে। অতঃপর মিষ্টার ওয়েষ্টমেকট পাণ্ডুয়ার ২৩ মাইল দূরে একডালার স্থান নির্ণয় করায়, ইংরাজলেখকগণ তাহাকেই প্রকৃত স্থান বলিয়া মনে করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। পরে মিষ্টার বিভারিজ এসিয়াটিক সোসাইটির পত্রিকার তাহার প্রতিবাদ করিয়া লিখিয়া গিয়াছেন, একডালা ঢাকাজেলার অন্তর্গত।এ পর্যন্ত ইহার অধিক আর কোনও আলোচনা মুদ্রিত হয় নাই। কিরূপ প্রমাণের উপর নির্ভর করিয়া মিষ্টার বিভারিজ এই সিদ্ধান্ত প্রচারিত করিয়া গিয়াছেন, তাহার সারমর্ম নিয়ে প্রদত্ত হইল। বলা বাহুল্য, একডালাদুর্গ পাণ্ডুয়ার নিকটবর্তী বলিয়া মুসলমান লিখিত ইতিহাসে যে উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়, তাহার সহিত মিষ্টার বিভারিজের সিদ্ধান্তের সামঞ্জস্য রক্ষা করা অসম্ভব। তিনি নিজেও তাহা লক্ষ্য করিয়াছিলেন। কিন্তু তিনি বলেন,–এ বিষয়ের প্রথম লেখক দিল্লী নিবাসী জিয়াউদ্দীন বারণী; তিনি বঙ্গদেশে আসিয়াছিলেন বলিয়া বোধ হয় না; বৃদ্ধ বয়সে দিল্লীতে বসিয়া ইতিহাস লিখিতে গিয়া বারণী ভ্ৰম প্ৰমাদে পতিত হইয়া থাকিবেন।এরূপ অনুমানের আশ্রয় গ্রহণ করিলে, মিষ্টার বিভারিজের সকল তর্কই বারণীর এক কথায় খণ্ডিত হইয়া যায়!

মিষ্টার বিভারিজ যেরূপ তর্কপ্রণালীর অবতারণা করিয়া গিয়াছেন তাহা হাস্যোদ্দীপক। তিনি বলেন :

ঢাকার উত্তর-উত্তর-পূৰ্ব্বকোণে ২৫ মাইল দূরে নদীতীরে একডালা নামে একটি স্থান রেনেলের মানচিত্রে অঙ্কিত দেখিতে পাওয়া যায়। তাহার একদিকে নদী, অপর দিকে ভাওয়ালের জঙ্গল। এই প্রাকৃতিক সংস্থান ইতিহাস বর্ণিত একডালার প্রাকৃতিক সংস্থানের অনুরূপ। ইহার ৮ মাইল দূরে দুরদুড়িয়া নামক স্থানে দুর্গটি সংস্থাপিত ছিল বলিয়া বোধ হয়।

এখানেও মিষ্টার বিভারিজের অনুমান অসঙ্গত হইয়া পড়িতেছে। কারণ মুসলমান। লিখিত ইতিহাসে একডালা গ্রামেই দুর্গ থাকা দেখিতে পাওয়া যায়। মিষ্টার বিভারিজের একডালা এবং দুরদুড়িয়ার মধ্যস্থলে নদীস্রোত;–একপারে একডালা, অপর পারে দুরদুড়িয়া। হাজি ইলিয়াসের পাণ্ডুয়া পরিত্যাগ করিয়া, নদী পার হইয়া একডালাদুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করিবার কথা মুসলমান লিখিত ইতিহাসে দেখিতে পাওয়া যায়। মিষ্টার বিভারিজ এস্থলে যে প্রমাণের অবতারণা করিয়াছেন, তাহা এইরূপ :–”ডাক্তার টেলর ঢাকাবিবরণী নামক যে গ্রন্থ রচনা করিয়া গিয়াছেন, তাহা দুষ্প্রাপ্য হইয়া উঠিয়াছে। সেই গ্রন্থে একডালার বিশেষ বিবরণ সন্নিবিষ্ট আছে।”

ডাক্তার টেলর লিখিয়া গিয়াছেন,–’একডালার অপর পারে দুরদুড়িয়া নামক। স্থানে একটি পুরাতন দুর্গের ভগ্নাবশেষ দেখিতে পাওয়া যায়। একডালার নিকটেও একটি পুরাতন রাজবাটীর ধবংসাবশেষ বৰ্ত্তমান। লোকে বলে,–তাহা বুনিয়া রাজাদিগের রাজবাটী ছিল; তাঁহারাই দুর্গ নির্মাণ করিয়াছিলেন। দুর্গটি এখন রাণীবাড়ি নামে পরিচিত, এক সময়ে রাণী ভবানীর অধিকারভুক্ত ছিল। বোধ হয় এই দুর্গেই হাজি সামসুদ্দীনের ইলিয়াস ১৩৫৩ খৃষ্টাব্দে দিল্লীশ্বর ফিরোজশাহ কর্তৃক অবরুদ্ধ হইয়া থাকিবেন। তৎকালে সামসুদ্দীনের একবার ছদ্মবেশে দুর্গত্যাগ করিয়া “রাজা বিয়াবাণী” নামক মুসলমান সাধুপুরুষের অন্তেষ্টিক্রিয়ায় যোগদান করিবার কথা মুসলমান লিখিত ইতিহাসে উল্লিখিত আছে। ইহাতে বোধ হয় রাজা বিয়াবাণী রাণী ভবানীর বংশধর হইবেন।”

মিষ্টার বিভারিজ যাঁহার কথার উপর নির্ভর করিয়াছেন, তাঁহার কথা কিরূপ হাস্যোদ্দীপক তাহা বাঙ্গালী মাত্রেই হৃদয়ঙ্গম করিতে পারিবেন। মিষ্টার বিভারিজ আবার তাহাকে অধিক হাস্যোদ্দীপক করিয়া লিখিয়া গিয়াছেন,–”ডাক্তার টেলরের এই উক্তি বড়ই সারগর্ভ,-মুসলমান সাধুর নাম রাজা হইতে পারে না, –তিনি পূৰ্ব্বে হিন্দু ছিলেন বলিয়াই বোধ হয়,–বিয়ারাণী এবং রাণী ভবানী হয়ত একই শব্দ!”৭

“বিয়াবাণী” একটি পারসিক শব্দ; তাহার অর্থ–আরণ্যক। যে সাধুপুরুষ মালদহ প্রদেশে “রাজা বিয়াবাণী” নামে কথিত হইতেন, তিনি লোকালয় ছাড়িয়া নিয়ত অরণ্য মধ্যেই বাস করিতেন। তজ্জন্য লোকে তাঁহাকে অরণ্যের রাজা (রাজা বিয়াবাণী) বলিত। অদ্যাপি তাঁহার সম্বন্ধে কত অলৌকিক জনশ্রুতি প্রচলিত আছে। মালদহের ইতিহাসলেখক গোলাম হোসেন এবং ইলাহিবকস উভয়েই তাঁহার কথার উল্লেখ করিয়া গিয়াছেন। তিনি কোন স্থানে বাস করিতেন, তাহার বিস্তৃত বিবরণ লিপিবদ্ধ করিবার জন্য ইলাহিবকস স্বরচিত হস্তলিখিত পারস্যভাষানিবদ্ধ “খুরশেদজাঁহানামা” নামক ইতিহাসে অলিখিত স্থান রাখিয়া গিয়াছেন। তিনি “রাজা বিয়াবাণীকে” মালদহনিবাসী বলিয়াই বর্ণনা করিয়া গিয়াছেন। পাণ্ডুয়ার নিকটবর্তী স্থানে একালের ন্যায় সেকালেও অরণ্যের অভাব ছিল না। লোকালয় ত্যাগ করিয়াছিলেন বলিয়া, “রাজা বিয়ারাণী’র সমাধিক্ষেত্রের কোনও সমাধিমন্দির নির্মিত হয় নাই। তাহাতেই যে স্থান লুপ্ত হইয়া গিয়াছে। কিন্তু তাহাকে পূর্ববঙ্গে নির্দেশ করিবার কারণ নাই। খৃষ্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীতে রাণী ভবানী বৰ্ত্তমান থাকিতে পারেন না; উনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভেই তিনি স্বর্গারোহণ করেন। মিষ্টার বিভারিজ বা ডাক্তার টেলর তাহার প্রতি লক্ষ্য করিলেও, এই সকল হাস্যোদ্দীপক তর্ক এসিয়াটিক সোসাইটির পত্রিকায় স্থান লাভ করিতে পারিত না।

একডালা কোথায় ছিল? সমসাময়িক মুসলমান লেখকের কতাই তাহার বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ। সে প্রমাণের অভাব নাই। সকলেই লিখিয়া গিয়াছেন,–তাহা পাণ্ডুয়ার নিকটে–নদীপারে–মহাবনের নিকটে। কেহ কেহ লিখিয়া গিয়াছেন, ফিরোজশাহ দুর্গজয়ের অসমর্থ হইয়া, গঙ্গাতীরে শিবিরসন্নবেশ করিয়াছিলেন; তাঁহার সেনাদল মশকদংশনে বিব্রত হইয়াছিল। উত্তরকালে গৌড়েশ্বরে হোসেনশাহের একডালা দুর্গে বাস করিবার কথাও লিখিত আছে। তৎকালে তিনি বর্ষে বর্ষে একডালা হ’তে পাওয়ায় আসিয়া নুর কুতব নামক স্বনামখ্যাত সাধুপুরুষের সমাধিক্ষেত্রে সম্মান প্রদর্শন করিতেন।

এই সকল বিবরণ পাঠ করিয়াও, মিষ্টার বিভারিজ ভ্রম পরিহারের চেষ্টা না করিয়া, লিখিয়া গিয়াছেন :

ইহা সকল কথাই পূর্ববঙ্গের পক্ষে প্রযুক্ত হইতে পারে। ফিরোজশাহ গঙ্গাতীরে শিবিরসন্নিবেশ করিয়াছিলেন। গঙ্গা না বলিয়া বুড়ীগঙ্গা বলিলেই হইল। ঢাকার অন্তর্গত একডালার নিকটেও এক মুসলমান সাধুর সমাধিমন্দির আছে; তাহাই হয়ত নুর কুতবের সমাধিমন্দির। হোসেনশাহ অনেক সময়ে পূৰ্ব্ববঙ্গেও বাস করিতেন; তদ্দেশে তাঁহার নির্মিত মসজেদ অদ্যাপি দেদীপ্যমান। গৌড়েশ্বরগণ যে বিপদে পড়িলে পূৰ্ব্ববঙ্গে পলায়ন করিয়া আশ্রয় গ্রহণ করিতেন, লক্ষ্মণ সেনের আমল হইতেই তাহার পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়। মশকদংশনের কথা ঢাকার পক্ষেই সৰ্ব্বতোভাবে সুসঙ্গত।

বলা বাহুল্য এরূপ তর্কপ্রণালী কেবল এদেশের ঐতিহাসিক তথ্যালোচনায় এবং বিচারশালায় সময়ে সময়ে ইংরাজেরাই অবলম্বন করিয়া থাকেন। ১৩৫৩ খৃষ্টাব্দে পূর্ববঙ্গ কাহার অধিকারভুক্ত ছিল, মিষ্টার বিভারিজ তৎপ্রতি একবারও দৃষ্টিপাত করেন নাই। ফিরোজশাহ পরাভূত হইয়া দিল্লীতে প্রত্যাবর্তন করিবার পরে পূৰ্ব্ববঙ্গ হাজি সামসুদ্দীনের করতলগত হয়। তৎপূৰ্ব্বে তাঁহার পক্ষে পূর্ববঙ্গে আশ্রয় গ্রহণ করিবার আদৌ সম্ভাবনা ছিল না। নুর কুতব একজন সুবিখ্যাত সাধুপুরুষ, তাঁহার সমাধিমন্দির পাণ্ডুয়া নগরেই অবস্থিত;–জিজ্ঞাসা করিলে যে কোনও বাঙ্গালী মুসলমান মিষ্টার বিভারিজকে তাহা বলিয়া দিতে পারিতেন।

একডালা যে পাণ্ডুয়ার নিকটে, নদীর অপর পারে তাহাতে সন্দেহ নাই। এখানে একবার বাঙ্গালী হিন্দু মুসলমান অসাধারণ আত্মত্যাগে স্বদেশের স্বাধীনতা লাভ করিয়াছিল। এখানেই আবার হিন্দু মুসলমানের চির প্রিয়পাত্র হোসেন শাহের রাজধানী ছিল,–এখানেই পুণ্যশ্লোক রূপসনাতন, সাকর মল্লিক এবং দবিরখাস রূপে বাদশাহের প্রধান পার্শ্বচর হইয়া রাজকার্য পৰ্যালোচনা করিতেন;–এখানেই বঙ্গসাহিত্য মুসলমান বাদশাহের নিকট উৎসাহ লাভ করিয়াছিল। সুতরাং বঙ্গসাহিত্যের পক্ষে একডালার স্থাননির্ণয়ে আগ্রহ প্রকাশিত হওয়া সৰ্ব্বতোভাবে বাঞ্ছনীয়।

যাঁহারা ইংরাজ লেখকগণের পদাঙ্কানুসরণ না করিয়া, স্বাধীনভাবে গৌড়মণ্ডল পরিদর্শন করিতে প্রবৃত্ত হইবেন, তাঁহারা সহজেই একডালার স্থান নির্ণয় করিতে পারিবেন। রাভেনসার গ্রন্থে তাহার উল্লেখ না থাকায়, কেহ তৎপ্রতি দৃষ্টিপাত করেন না। কিন্তু গৌড় পরিদর্শকগণ অনেকেই দেখিয়াছেন,–সাগরদীঘির অনতিদূরে এক দুর্গাকার বিজন বন পড়িয়া রহিয়াছে। তাহার একদিকের পরিখা এবং মৃৎপ্রাচীর এখনও বৰ্ত্তমান আছে। তাহাই একডালাদুর্গের পুরাতন স্থান, এখন জনসমাজের নিকট অপরিচিত হইয়া পড়িয়াছে!

হোসেন শাহ যে পথে একডালা হইতে পাণ্ডুয়া গমন করিতেন, সে পুরাতন রাজপথের চিহ্ন এখনও স্থানে স্থানে দেখিতে পাওয়া যায়;–তাহা বাদশাহী রাজপথের ন্যায় ইষ্টকমণ্ডিত ছিল। এই পথে অগ্রসর হইয়া যেখানে নদীপার হইতে হইত, সেখানে অল্পকাল পূৰ্ব্বেও লোকে সেতুর চিহ্ন দর্শন করিয়াছে বলিয়া এখনও গল্প করিয়া থাকে। একডালার অনতিদূরে নুরকুতবের পিতৃগুরু মকদুম আখি সিরাজুদ্দীন নামক সাধুপুরুষের পুরাতন সমাধিমন্দির। হোসেন শাহ তাহার একটি তোরণদ্বার নির্মিত করাইয়া দিয়াছিলেন। তাহাতে এখনও হোসেন শাহের কীৰ্ত্তি প্রস্তরফলকে খোদিত আছে। অল্পকাল পূৰ্ব্বে এই দুর্গাভ্যন্তরে কৃষকগণ পুরাতন রৌপ্যমুদ্রা প্রাপ্ত হইয়াছিল। তাহার একটি মুদ্রা মালদহ-ইংরেজাবাদের জমিদার শ্রীযুক্ত কৃষ্ণলাল চৌধুরী মহাশয়ের নিকটে দেখিতে পাওয়া যায়। সে মুদ্রা হাজি সামসুদ্দীন ইলিয়াসের মুদ্রা। এই সকল কারণে, পুরাতন লক্ষ্মণাবতী নগরের চতুঃসীমার মধ্যে সাগরদীঘির অনতিদূরবর্তী পুরাতন দুর্গস্থানকেই একডালা দুর্গ বলিয়া স্বীকার করিতে হয়। তাহার সহিত সমসাময়িক মুসলমান লেখকের সকল কথারই সামঞ্জস্য দেখিতে পাওয়া যায়। সম্প্রতি যাঁহারা একডালাকে বগুড়া জেলায় টানিয়া লইতে চাহিতেছেন, তাঁহারা এই সকল কথার আলোচনা করিলে আত্মভ্রম পরিহার করিতে পারিবেন।

প্রবাসী, অগ্রহায়ণ, ১৩১৫

তথ্যসূত্র

১ The Rajas of Northern Bengal were powerful enough to preserve a semi-independence, in spite of the numerous invasions from the time of Bakhtyar Khilji.– Professor Blochmann, J.A.S.B., 1873.

২ বারণী-বিরচিত ‘তারিখ-ই-ফিরোজশাহী” গ্রন্থে লিখিত আছে–Firuz Shah laid seige to the Fort of Ekdala for several days, and nothing decisive occurring, made a feint retreating movement westward seven kosh from Ekdala when Ilyas Shah, thinking Firuz Shah was retreating, came out of the fort Ekdala, advanced and attacked the Imperialists, who defeated and killed one lak of the Bengal army.

৩ J. A. S.B., Vol. XLIII, p. 244.

৪ J. A. S. B. Vol. LXIV, p. 227.

৫ The actual site of this fort is still a matter of doubt.–J.A.S.B. Vol. XLII, p 212.

৬ The only objection to the Dacca Ekdala is that Ziyah-uddin Barani speaks of Ekdala as being near Pandua. But he wrote in his old age at Delhi, and apparently he had never visited Bengal and had no local knowlege. বারণী সমসাময়িক ইতিহাস লেখক। তাঁহার ভ্রম হইয়া থাকিবে বলিয়া অনুমান করিবার কারণ নাই। তিনি লিখিয়া গিয়াছেন : Ekdala is the name of a muoza close to Pandua, on one side of it is a river, and on another a jungle. সামস-ই-সিরাজের ‘তারিখ ফিরোজ শাহী” গ্রন্থে দেখিতে পাওয়া যায় উত্তর কালে একডালা “আজাদপুর” নামেও কথিত হইয়াছিল।

৭ He then tells the story of Ilyas Shah’s coming out of the fort to attend the funeral of Rajah Biyabani, and suggests that this saint was a descendant of Rani Bhabani. This seems a valuable suggestion. The title of Rajah is a curious one for a Mahomedan saint, and in all probability points to the fact that he was a converted Hindu. Biyabani means wild or desert in Persian, but it closely resembles the name of the Rani, and it is likely that the two words are identical. — J.A. S.B. Vol. Lxiv., p. 228.

৮ Sultan Alauddin Husain Shah, girding up the waist of justice, unlike other kings of Bengal, removed his seat of Government to Ekdala, which adjoins the city of Gour. And excepting Husain Shah, no one amongst the kings of Bengal, made his seat of Government anywhere except at Pandua and the City of Gour. –Riaz-us-Salateen.

৯ And for the maintenance of the rest-house in connection with the eminent Saint Nur Qutub-ul-Alam, he endowed several villages, and every year from Ekdala, which was the seat of his Government, he used to come to Pandua, for pilgrimage to the bright shrine of the holy Saint. — Ibid.

বরেন্দ্র-খনন-বিবরণ

ভুমিকা

পুরাকালের পুণ্ডদেশ মধ্যযুগে বরেন্দ্রীমণ্ডল নামে খ্যাতিলাভ করিয়াছিল। সন্ধ্যাকর নন্দীর ‘রামচরিতম’ কাব্যে দেখিতে পাওয়া যায়,–পাল-সাম্রাজ্যভুক্ত অন্যান্য মণ্ডলের ন্যায় বরেন্দ্রীমণ্ডলও বহুসংখ্যক সামন্ত-চক্রে বিভক্ত ছিল। ইহাকে কাব্য কথা বলিয়া উপেক্ষা করা যায় না।–কারণ, খালিমপুরে আবিষ্কৃত ধর্মপালদেবের তাম্রশাসনে প্রসঙ্গক্রমে নারায়ণ বৰ্মা নামক এক মহাসামন্তাধিপতির উল্লেখ দেখিয়া বুঝিতে পারা যায়,–পাল-সাম্রাজ্যে সত্য সত্যই সামন্তপ্রথা প্রচলিত ছিল।

কালক্রমে সামন্তবর্গের নাম-গোত্র বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে; কিন্তু তাঁহাদিগের রাজধানীর ধবংসাবশেষ সম্পূর্ণরূপে বিলুপ্ত হইয়াছে বলিয়া বোধ হয় না। এখনও অনেক ধবংসাবশেষ “রাজবাড়ী” নামে কথিত হইয়া আসিতেছে, অনেক “রাজ বাড়ী”র প্রাকার-পরিখাবেষ্টিত রাজদুর্গের সীমাচিহ্ন দেখিতে পাওয়া যাইতেছে, অনেক সুবৃহৎ সরোবর পূৰ্ব্বসমৃদ্ধিসূচক পূৰ্তকৰ্ম্মনিষ্ঠার পরিচয় প্রদান করিতেছে, –এবং অসংখ্য স্তূপ অসংখ্য স্মৃতিচিহ্ন ভূগর্ভে নিহিত করিয়া রাখিয়াছে। খনন করাইতে পারিলে, এখনও পুরাকীৰ্ত্তির অনেক নির্দশন আবিষ্কৃত হইবার আশা করা যাইতে পারে। খননকার্য্যে হস্তক্ষেপ না করিলে, মুসলমান-শাসনের পূৰ্ব্ববর্তী কালের প্রকৃত ইতিহাসের উদ্ধার-সাধনের সম্ভাবনা দেখিতে পাওয়া যায় না।

মুসলমান-শাসনকালের প্রকৃত ইতিহাস সংকলিত করিবার জন্যও খনন-কাৰ্য্য আবশ্যক। মুসলমান-লিখিত ইতিহাস-গ্রন্থের সহিত সমসাময়িক ক্ষোদিত লিপির প্রবল পার্থক্য যতই আবিষ্কৃত হইতেছে, মুসলমান-লিখিত ইতিহাস গ্রন্থের পূৰ্ব্বমৰ্যাদা ততই ক্ষুণ্ণ হইয়া পড়িতেছে! এখন আর কেবল মুসলমান-লিখিত ইতিহাস-গ্রন্থ অবলম্বন করিয়া মুসলমান-শাসনসময়ের প্রকৃত ইতিহাস সংকলিত হইতে পারে না। তাহার জন্যও তথ্যানুসন্ধান আবশ্যক। তাহার পক্ষেও বরেন্দ্রীমণ্ডলকে প্রধান অনুসন্ধানক্ষেত্র বলিয়া স্বীকার করিতে হইবে;–কারণ, মুসলমান-শাসনের প্রথম আমলের অধিকাংশ প্রধান কীৰ্তিচিহ্ন বরেন্দ্রীমণ্ডলেই সংস্থাপিত হইয়াছিল।

পুরাকীর্তি-সংরক্ষণপরায়ণ সুসভ্য বৃটিশ-গবর্মেন্ট বরেন্দ্রীমণ্ডলের কোনও কোনও পুরাতন অট্টালিকার সংরক্ষণ-ব্যবস্থার সূত্রপাত করিয়া অকৃত্রিম কৃতজ্ঞতা ভাজন হইয়াছেন; কিন্তু বৃটিশ-গবর্মেন্ট বরেন্দ্রীমণ্ডলের কোনও স্থানেই খননকার্য্যে হস্তক্ষেপ করিবার জন্য অদ্যাপি আয়োজন করেন নাই। তথাপি কোনও ইংরাজ রাজপুরুষ খননকার্য্যের প্রয়োজন অস্বীকার করিতে পারেন নাই।

যাঁহারা বরেন্দ্রমণ্ডলের ধবংসাবশেষ পরিদর্শন করিয়াছেন, তাঁহারাই দেখিয়াছেন, –যেখানে পুরাতন মুসলমান-কীর্তিবিজ্ঞাপক মসজেদ বা দরগা বৰ্তমান আছে, সেইখানেই বা তাহার অনতিদূরে হিন্দু-কীৰ্ত্তির পুরাতন স্থান ও তাহার ধবংসাবশেষ বৰ্ত্তমান থাকিবার পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়। সুতরাং মুসলমানকীৰ্ত্তির ধবংসাবশেষ খনন করিলে, মুসলমানকীৰ্তিচিহ্নের সঙ্গে সঙ্গে মুসলমান শাসনের পূৰ্ব্ববর্তী কালেরও অনেক কীৰ্তিচিহ্ন আবিষ্কৃত হইবার সম্ভাবনা আছে। খনন কাৰ্যে হস্তক্ষেপ না করিলে, তাহার সন্ধানলাভের উপায় নাই।

এই কাৰ্যে অগ্রসর হইবার প্রয়োজন দিন দিন অধিক অনুভূত হইতেছে। পুরাতন স্তূপ হইতে লোকে ইচ্ছামত ইষ্টক-প্রস্তর সরাইয়া লইয়া যাইতেছে; নবাগত সাঁওতাল কৃষকগণ অনেক পুরাতন স্কুপকে সমভূমিতে পরিণত করিয়া শস্যক্ষেত্র প্রস্তুত করিতেছে;–এইরূপে ঐতিহাসিক অনুসন্ধানের অনেক উপাদেয় ক্ষেত্র দিন দিন বিপর্যস্ত হইয়া পড়িতেছে।

এরূপ সময়ে গবর্মেন্ট খননকার্যে অগ্রসর হইতে না পারিলে, দেশের লোকের খননকার্য্যের আয়োজন করা কর্তব্য। কিন্তু গবর্মেন্টের সহায়তা ভিন্ন দেশের লোকের চেষ্টায় খননকার্যে সম্পূর্ণ সফলকাম হইবার পক্ষে অন্তরায়ের অভাব নাই। ইহা যেমন বহুব্যয়সাধ্য, সেইরূপ অভিজ্ঞতাসাধ্য কঠিন ব্যাপার। অনুশীলনের অভাবে দেশের কৃতবিদ্যাগণ এরূপ কাৰ্যসম্পাদনের অনধিকারী হইয়া রহিয়াছেন। ভূস্বামিগণের অনুমতি ও উৎসাহ না পাইলে, শিক্ষিত-সমাজের সহানুভূতি আকর্ষণ করিতে না পারিলে, শ্ৰমসহিষু অধ্যবসায়শীল অনুসন্ধান-নিপুণ খননকাৰ্য-পরিচালকদক্ষ সেবকদল গঠিত করিতে না পারিলে, অর্থভাণ্ডার সংগৃহীত হইলেও, এরূপ কাৰ্য্যে সহসা সম্পূর্ণ সফলকাম হইবার আশা করা যাইতে পারে না।

এ বিষয়ে দেশের শিক্ষিত-সমাজের দৃষ্টিআকর্ষণের আশায় “বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মিলনে’র কলিকাতার অধিবেশনে পঠিত “উত্তরবঙ্গের” প্রত্নসম্পৎ’–শীর্ষক প্রবন্ধে কুমার শরকুমার রায় লিখিয়াছিলেন :

এই সমস্ত প্রাচীন নগরের যথাযোগ্য প্রত্নসম্পদের উদ্ধার করিতে হইলে, খনন কাৰ্য্যের আরম্ভ করিতে হইবে। প্রত্নসম্পদের উদ্ধারসাধন হইলেই, ইতিহাসের উদ্ধার হইবে। নচেৎ যে উপদান এ পর্যন্ত সংগৃহীত হইয়াছে, তদ্বারা প্রকৃত ইতিহাস লিখিত হইতে পারে না। তাহা লইয়া সন্তুষ্ট থাকিলে প্রকৃত ইতিহাসের উদ্ধার কোনও কালেই সম্পন্ন হইবে না। বাঙ্গালীকেই বাঙ্গালার ইতিহাসের উদ্ধার সাধন করিতে হইবে, এবং তাহাকেই কুদ্দালি-হস্তে ভূগর্ভে অবতরণ করিতে হইবে।

এই কথাগুলি সকল বাঙ্গালীরই প্রণিধানযোগ্য। ইহা কুমার শরৎকুমারের ব্যক্তিগত খেয়ালের কথা নহে;–ইহাই বৈজ্ঞানিক তথ্যানুসন্ধান-প্রণালীর যুক্তিযুক্ত কথা। বক্তৃতার উচ্ছ্বাসে “আত্মবিস্মৃত” বাঙ্গালীকে প্রবুদ্ধ করিবার উদ্দেশ্যে অনেকেই এই কথার অবতারণা করিয়া থাকেন। তথাপি ইহা এখনও কথার কথা হইয়া রহিয়াছে; এমন কি, যাঁহারা ইহার প্রধান প্রধান বক্তা, ইহা তাঁহাদিগকেও পথ প্রদর্শনের আয়োজন করিবার জন্য উৎসাহযুক্ত করিতে পারে নাই। তাঁহাদিগের দৃষ্টান্তের অনুকরণ না করিয়া, কুমার শরৎকুমার রায় খননকার্য্যের পথ প্রদর্শন করিবার জন্যই ধীরে ধীরে প্রস্তুত হইতেছিলেন! এবার সৌভাগ্যক্রমে বরেন্দ্রীমণ্ডলের একটি পুরাতন স্কুপের খননকার্য্যের সুযোগ উপস্থিত হইবামাত্র তিনি প্রভূত অর্থব্যয় করিয়া তাহা সম্পন্ন করিয়া আসিয়াছেন। ইহাই বাঙ্গালীর এ বিষয়ের সৰ্ব্বপ্রথম আত্মচেষ্টার নিদর্শন বলিয়া, ইহার একটি আনুপুৰ্ব্বিক বিবরণ লিপিবদ্ধ করা কর্তব্য।

মাহি-সন্তোষের ধবংসাবশেষ

১৯১১ খৃষ্টাব্দে দিনাজপুর জেলার বালুরঘাট মহকুমার সম্ভ্রান্ত অধিবাসিবর্গের আন্তরিক আমন্ত্রণে বরেন্দ্র-অনুসন্ধান-সমিতির কতিপয় সদস্য বালুরঘাট নিকটবর্তী কোনও কোনও ধবংসাবশেষ পৰ্যবেক্ষণ করিবার সময় বালুরঘাটের তিন মাইল দক্ষিণে অবস্থিত মাহি-সন্তোষ নামে সুপরিচিত পত্নীতলা থানার অন্তর্গত একটি পুরাতন স্থানের ধবংসাবশেষও পরিদর্শন করিয়া আসিয়াছিলেন। তৎকালে তথায় মৃৎপ্রাকার-পরিখা-বেষ্টিত একটি দুর্গাকার স্থান, ইষ্টক প্রাচীরবেষ্টিত একটি পুরাতন দরগা, ইষ্টক-প্রস্তর-পরিপূর্ণ একটি জঙ্গলাকীর্ণ স্তূপ, এবং অনেকগুলি পুরাতন সরোবর দেখিতে পাওয়া গিয়াছিল। দরগার প্রাচীরে ছোট বড় দুইখানি মুসলমান শিলালিপি সংযুক্ত ছিল; তাহার পাঠ ও ব্যাখ্যা অধ্যাপক ব্লকম্যান কর্তৃক পূর্বেই প্রকাশিত হইয়াছিল।

ইষ্টক-প্রস্তর-পরিপূর্ণ জঙ্গলাকীর্ণ স্থূপের সর্বোচ্চ স্থানে দুই তিনটি প্রস্তর স্তম্ভের অগ্রভাগমাত্র দেখিতে পাওয়া গিয়াছিল; এবং স্কুপের নানা স্থানে অনেক প্রস্তরখণ্ড অযত্ন-বিন্যস্ত অবস্থায় ইতস্ততঃ বৰ্তমান ছিল। প্রস্তরগুলি দেহমন্দিরের প্রস্তর বলিয়াই প্রতিভাত হইয়াছিল। তাহা অযত্নে অনাদরে বরেন্দ্রের জনহীন জঙ্গলমধ্যে পড়িয়া থাকায়, পুরাতত্ত্বানুসন্ধানকারিগণ তাহার পরিচয় লাভে বঞ্চিত ছিলেন। যে সকল ইংরাজ-রাজকর্মচারী মাহি-সন্তোষের ধবংসাবশেষের বর্ণনা লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন, তাঁহারা কেহই এ স্তূপের উল্লেখ করেন নাই। স্তূপ হইতে দুই একটি প্রস্তরস্তম্ভ উঠাইয়া আনিয়া, বরেন্দ্র অনুসন্ধান-সমিতির সংগ্রহালয়ে সুরক্ষিত করিতে পারিলে, কালে তাহার সাহায্যে ঐতিহাসিক তথ্যানুসন্ধানের পথ উন্মুক্ত হইতে পারিবে মনে করিয়া, স্তম্ভ তুলিয়া আনিবার জন্য ভূস্বামীগণের অনুমতি গ্রহণ করা হইয়াছিল। তৎকালে কুলী সংগ্রহ করিতে না পারিয়া, এবং কুলীগণ স্তম্ভ স্পর্শ করিতে ভীত ও অসম্মত হইতে পারে জানিয়া, বরেন্দ্র-অনুসন্ধান-সমিতির সদস্যগণ ভূস্বামিগণের অনুমতি প্রাপ্ত হইয়াও উপযুক্ত অবসরের অপেক্ষায় রিক্তহস্তে প্রত্যাবর্তন করিয়াছিলেন। সেই সময় হইতে মাহি-সন্তোষের ধবংসাবশেষের রহস্যোদঘাটনের জন্য তথ্যানুসন্ধানের সূত্রপাত হয়।

১৯১৬ খৃষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে আমার পক্ষে পুনরায় মাহি-সন্তোষের ধবংসাবশেষ-পরিদর্শনের সুযোগ উপস্থিত হইয়াছিল। ১৯শে নবেম্বর তারিখে বালুরঘাটের সবডিভিসন্যাল অফিসার শ্রীযুক্ত মৌলবী আবদুল আজিজ ও দিনাজপুরের স্বনামখ্যাত সরকারী উকীল শ্রীযুক্ত যতীন্দ্রনাথ সেন স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া আমার সহিত ধবংসাবশেষ দর্শন করিতে গমন করিয়াছিলেন। তখন দেখা গিয়াছিল, দরগার প্রাচীরসংলগ্ন ছোট শিলালিপিখানি বর্তমান নাই! কেবল বড় শিলালিপিখানি বর্তমান আছে; কিন্তু তাহাও ভূপতিত হইয়াছে। এই দুইখানি শিলালিপির বিবরণ অধ্যাপক ব্লকম্যানের প্রবন্ধের কৃপায় সুধীসমাজে সুপরিচিত; এবং এই দুইখানি শিলালিপির সহিত বাঙ্গালার ইতিহাসের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বর্তমান;–এই কথা বুঝাইয়া দিয়া, দরগার প্রাচীরের জীর্ণ-সংস্কার করাইতে ও যে শিলালিপি বৰ্ত্তমান আছে, তাহা প্রাচীরে পুঃনসংস্থাপিত করাইতে পরামর্শ দান করিয়া, সবডিভিসন্যাল অফিসার সাহেবের হস্তে কয়েকটি মুদ্র দিয়া, সৰ্বসাধারণের নিকট হইতে সংরক্ষণকার্যের জন্য চাঁদা-সংগ্রহের প্রস্তাব উপস্থিত করিয়াছিলাম।

খনন–সূত্রপাত

ঐতিহাসিক-সমাজে সুপরিচিত একখানি শিলালিপি হারাইয়া গিয়াছে; অপরখানি ভূপতিত অবস্থায় অপহৃত হইবার সুযোগদান করিতেছে;–এরূপ অবস্থায় স্কুপের স্তম্ভগুলিও অপহৃত হইতে পারে। তাহা হইলে, ঐতিহাসিক তথ্যানুসন্ধানের পথ চিরদিনের জন্য রূদ্ধ হইয়া পড়িবে। এইরূপ মনে হইয়াছিল বলিয়া, স্তূপ হইতে স্তম্ভ উঠাইয়া বরেন্দ্র-অনুসন্ধান-সমিতির সংগ্রহালয়ে লইয়া গিয়া তাহার সংরক্ষণের সুব্যবস্থা করিবার প্রয়োজন পূৰ্ব্বাপেক্ষা অধিক উপলব্ধি করিয়াছিলাম; এবং বালুরঘাট-নিবাসী বরেন্দ্র-অনুসন্ধান-সমিতির সদস্য স্নেহাস্পদ শ্রীমান দেবেন্দ্ৰগতি রায়ের উপর স্তম্ভ উত্তোলনের ভার ন্যস্ত করিয়া প্রত্যাবর্তন করিয়াছিলাম। অল্পদিনের মধ্যে সংবাদ পাওয়া গেল–দুইটি স্তম্ভে সংস্কৃত ক্ষোদিতলিপি দেখিতে পাওয়া গিয়াছে, এবং কোনও কোনও প্রস্তরফলকে দেবমূৰ্ত্তির ধবংসাবশেষ আবিষ্কৃত হইয়াছে। তখন বৈজ্ঞানিক প্রণালীতে স্তূপখননের যথাযোগ্য আয়োজন করিবার জন্য ভূস্বামিগণের লিখিত অনুমতি গ্রহণ করা হইল। এই স্তূপটি জমীদারগণের স্বত্বগত খাসপতিত স্থান বলিয়া সারভে সেটেলমেন্টের খতিয়ানে উল্লিখিত থাকায়, তাঁহাদিগের অনুমতি ও সহায়তা গ্রহণ করিয়া খনন কার্য্যের ব্যবস্থা করিবার প্রয়োজন অনুভূত হইয়াছিল।

বালুরঘাট মহকুমার সবডিভিসন্যাল অফিসার সাহেবের সহৃদয়তায়, ভূস্বামিগণের প্রতিনিধি শ্রীযুক্ত শেষপ্রকাশ সান্যাল ও শ্রীযুক্ত নলিনীকান্ত অধিকারী মহাশয়দ্বয়ের উৎসাহপূর্ণ সহায়তায়, এবং শ্রীমান দেবেন্দ্রগতির অক্লান্ত পরিশ্রমে, অল্পদিনের মধ্যেই ধবংসাবশেষের এক পার্শ্বে অনেকগুলি পটমণ্ডপ সংস্থাপিত হইল;-শ্ৰমসহিষু£ খননদক্ষ সাঁওতাল-মুণ্ডা-ঘাসী-রাজবংশী-জাতীয় কুলী সংগৃহীত হইল;–খনন কাৰ্য্য-পরিচালনার উপযুক্ত সমস্ত সরঞ্জাম পুঞ্জীভূত হইল; এবং কুমার শরৎকুমার রায় উপযুক্ত অর্থভাণ্ডার লইয়া সমিতির কতিপয় সদস্য সমভিব্যাহারে মাহি-সন্তোষ-যাত্রা’র জন্য প্রস্তুত হইলেন। এইরূপে বিগত বড়দিনের ছুটীতে শ্রীযুক্ত রমাপ্রসাদ চন্দ, অধ্যাপক উপেন্দ্রনাথ ঘোষাল, শ্রীমান বিমলাচরণ মৈত্রেয় ও আমি, কুমার শরকুমারের সঙ্গে উত্তরবঙ্গ-রেলপথের হিলি-ষ্টেশনে উপস্থিত হইয়া তথা হইতে কিয়দ্র গোযানে ও কিয়দ্র হস্তিপৃষ্ঠে অগ্রসর হইবার পর, ২৪শে ডিসেম্বর প্রাতঃকালে প্রায় দশক্রোশ-দূরবর্তী মাহি সন্তোষের ধবংসাবশেষে উপনীত হইলাম। অনুসন্ধান সমিতির সদস্য স্নেহাস্পদ শ্ৰীমান শ্রীরাম মৈত্রেয় বরেন্দ্রভূমির নানাস্থানের সহিত বাল্যকাল হইতে সুপরিচিত। তিনিও মাহি-সন্তোষে উপনীত হইয়াছিলেন। দিনাজপুরের উকীল উৎসাহশীল শ্রীমান জ্যোতিষচন্দ্র গুপ্ত বৈজ্ঞানিক খনন প্রণালী-পরিদর্শনের জন্য আমাদের সহিত মিলিত হইয়া দল পুষ্ট করিয়াছিলেন। বালুরঘাটের কতিপয় কর্মঠ ভদ্রসন্তান এবং পুলিস-ইনস্পেক্টর শ্রীযুক্ত রেবতীমোহন সেন প্রসন্নচিত্তে স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া সময়ে সময়ে আমাদের সহিত শারীরিক শ্রমস্বীকারে অগ্রসর হইয়াছিলেন।

খনন-ব্যবস্থা

আমাদের কাৰ্য্য নানা ভাগে বিভক্ত করিয়া লইতে হইয়াছিল। মাহি-সন্তোষ ও তাহার নিকটবর্তী অন্যান্য ধবংসাবশিষ্ট স্থান পরিদর্শন করা, সেই সকল স্থানসংক্রান্ত জনশ্রুতিমূলক পূৰ্ব্বপরিচয় সংগ্রহ করা, মাহি-সন্তোষের প্রধান ধবংসাবশিষ্ট স্থানগুলির প্লেনটেবল নক্সা প্রস্তুত করা, খননের পূর্বে ও পরে প্রয়োজনানুরূপ ফটোগ্রাফ গ্রহণ করা, ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত কারুকাৰ্যযুক্ত ইষ্টক প্রস্তরের ও খননলব্ধ অন্যান্য দ্রব্যের পরীক্ষা ও বাছাই করা, কোন স্থান হইতে কি ভাবে খননকার্য পরিচালিত করিতে হইবে, তাহা স্থির করিয়া খননকার্যের পৰ্যবেক্ষণ করা, এবং খননকারী কুলিদিগের হিসাব বিশুদ্ধভাবে লিপিবদ্ধ করিয়া, দিনান্তে তাহাদিগকে মজুরি দান করা;–এই সকল কাৰ্য যথাযোগ্যভাবে পরিচালিত হইতেছে কি না, তাহা সতর্কভাবে পরিদর্শন করিবারও ব্যবস্থা করা হইয়াছিল।

জনশূন্য গৃহশূন্য অস্বাস্থ্যপ্রদ ধবংসাবশেষের মধ্যে এতগুলি লোকের স্বাস্থ্য রক্ষার উপযোগী অবস্থানের ও অন্নপানের সুব্যবস্থা করা এবং গোমহিষ-হস্তী প্রভৃতি সহযাত্রী জীবের খোরাক সংগ্রহ করা সকল সময়ে সকল স্থানে সহজসাধ্য হয় না। এই কার্য্যের সুব্যবস্থার উপরে মূল কার্য্যের সফলতা সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করে বলিয়া, বিশেষ বিবেচনার সহিত ইহার বন্দোবস্ত করিতে হয়। কুমার শরৎকুমারের অভিজ্ঞ কর্মচারীর ও শ্রীমান দেবেন্দ্রগতির পরিচালনাধীন সারকুটিয়া ষ্টেটের কর্মচারিগণের অক্লান্ত চেষ্টায় এবং ধবংসাবশেষের নিকটবর্তী রাঙ্গামাটীর, ভাতশালার ও বালুরঘাটের আতিথ্য-পরায়ণ সজ্জনগণের পুনঃ পুনঃ উপঢৌকন প্রেরণে রসদবিভাগের ব্যবস্থা সৰ্ব্বাঙ্গসুন্দর হইয়াছিল।

খনন-কার্যপ্রণালী

সর্বাগ্রে স্কুপের দক্ষিণ পার্শ্ব হইতে একটি ফটোগ্রাফ তোলা হইয়াছিল। খনন কাৰ্য্য আরম্ভ হইবার পূৰ্ব্বে স্থূপের বাহ্যদৃশ্য কিরূপ ছিল, সেই চিত্রে তাহার পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যাইবে। স্কুপের এক পার্শ্বে একটি বেণুবংশবন বৃদ্ধিলাভ করিয়া, দক্ষিণপশ্চিম কোণ আচ্ছন্ন করিয়া রাখিয়াছিল। কন্টকাবৃত লতাগুল্মে ও বেতসপুঞ্জে অনেক স্থানই দুর্গম হইয়া পড়িয়াছিল। বহুস্থানে বিষধর বৃশ্চিক বর্তমান থাকায়, অসতর্ক ভাবে চলাচলের অন্তরায় উপস্থিত হইয়াছিল। সর্পের ও সর্পডিম্বের প্রাদূর্ভাব স্থানটিকে কিঞ্চিৎ ভয়াবহ করিয়া রাখিয়াছিল। অভিনব সাঁওতাল-বসতি সংস্থাপিত হইবার পূর্বে এখানকার ব্যাঘ্ৰভীতিও সুপরিচিত ছিল। অনেকগুলি বৃশ্চিক ধরিয়া শিশিবন্ধ করা হইয়াছিল; এবং দুই একটি সর্পকে মারিয়া ফেলিতে হইয়াছিল। পূর্বাহ্নে আট ঘটিকা হইতে মধ্যাহ্ন পৰ্য্যন্ত, এবং অপরাহ্ন দুই ঘটিকা হইতে সায়ংকাল পর্যন্ত সকল বিভাগের কাৰ্য্য পরিচালিত হইয়াছিল।

কোন কোন স্থান খনন করিতে হইবে, এবং কোন কোন স্থান খনন করিতে হইবে না, তাহা স্থির করাই বৈজ্ঞানিক খনন-প্রণালীর সৰ্ব্বপ্রথম কৰ্ত্তব্য। যে সকল স্থানে গাঁথুনী বৰ্ত্তমান আছে, এবং খননের পরেও সুরক্ষিত হইতে পারিবে, তাহা যাহাতে ধবংসপ্রাপ্ত না হয়, এবং অট্টালিকার যে সকল অংশ উদঘাটিত করিতে পারিলে, তাহার স্থাপত্য-ব্যবস্থা সুন্দররূপ উপলব্ধি করিতে পারা যাইবে, তাহা যাহাতে খননকার্য্যের অত্যাচারে বিনষ্ট বা ক্ষতিগ্রস্ত না হইতে পারে, তৎপ্রতি সতর্ক দৃষ্টি বর্তমান থাকা আবশ্যক। তাহার জন্য খুঁটাগাড়ি করিয়া, রশী বাঁধিয়া, খননযোগ্য স্থান সুনির্দিষ্ট করিয়া দিয়া, সদস্যগণকে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে কুলী খাটাইবার ভার প্রদান করা হইয়াছিল।

খনন-বিবরণ

স্তূপটি উত্তর-দক্ষিণে লম্বা ছিল। তাহার পশ্চিমাংশের শীর্ষদেশে সমব্যবধান বিন্যস্ত কয়টি প্রস্তরস্তম্ভের অগ্রভাগমাত্র দেখিতে পাওয়া যাইতেছিল। এই দুইটি বাহ্যদৃশ্যের জন্য স্কুপের পশ্চিম পার্শ্ব মসজেদের পশ্চিম দিকের দেয়ালের ধবংসাবশেষ বলিয়া প্রতিভাত হইয়াছিল। প্রথমে এই অংশের উভয় পার্শ্ব হইতে মাটী সরাইয়া ফেলিতে গিয়া, মসজেদের পশ্চিম-দেয়াল দেখিতে পাওয়া যায়; এবং তাহার ভিত্তির পরিসর জানিতে পারায়, অন্যান্য দিকের ভিত্তির স্থাননির্দেশের উপায় আবিষ্কৃত হয়। ক্রমে খনন-কাৰ্য্য যতই অগ্রসর হইতে লাগিল, মসজেদের ধবংসাবশিষ্ট অন্যান্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ততই প্রকাশিত হইয়া পড়িল।

অসংখ্য ইষ্টক-প্রস্তর ভাঙ্গিয়া স্কুপের সৃষ্টি করিয়াছিল। তাহা সরাইয়া বাহিরে আনয়ন করা সহজসাধ্য ছিল না। সেগুলি সরাইবার সময় দেখিতে পাওয়া গেল, –কত স্তম্ভ ভূপতিত রহিয়াছে, কত স্তম্ভশীর্ষ (বোধিকা) ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত হইয়া পড়িয়াছে, কত কারুকার্যখচিত শিলাফলক খণ্ডবিখণ্ড হইয়া গিয়াছে, এবং তাহাদের অযত্নবিন্যস্ত বিপুল কলেবরের পার্শ্বদেশ দিয়া কত বৃক্ষমূল ভুগর্ভে প্রবেশ লাভ করিয়াছে।

মসজেদ

মসজেদটি পূৰ্ব্বমুখে অবস্থিত ছিল। পূৰ্ব্বদিক হইতে পাঁচটি প্রবেশ দ্বার দিয়া উপাসকগণ তাহার মধ্যে প্রবেশ লাভ করিত। উত্তর এবং দক্ষিণ দিকে তিনটি করিয়া ছয়টি দ্বার-জানালা বৰ্ত্তমান ছিল। উত্তর দক্ষিণ ও পূর্বদিকে, দ্বারগুলির মধ্যবর্তী ভিত্তিগাত্রের বাহিরের দিকে কারুকার্যখচিত ইষ্টক-রচিত কুলুঙ্গী বৰ্ত্তমান ছিল। তাহার সকলগুলিই নষ্ট হইয়া গিয়াছে; দুই একটির যৎসামান্য চিহ্নমাত্র অবশিষ্ট রহিয়াছে, কিন্তু কারু-কাৰ্য্য-খচিত ইষ্টকগুলি বিক্ষিপ্ত হইয়া পড়িয়াছে। এই সকল ইষ্টকের কারুকার্য্যে গৌড়ের ধবংসাবশিষ্ট মসজেদ-সংলগ্ন ইষ্টকের কারু কাৰ্য্যের আভাস প্রাপ্ত হওয়া যায়। কুলুঙ্গীগুলি সুদৃশ্য করিবার জন্যই এই সকল ইষ্টক ব্যবহৃত হইয়াছিল। কিন্তু কুলুঙ্গীগুলি পূর্বাবস্থায় বর্তমান না থাকায় তাহার চিত্র সংগৃহীত হইতে পারে নাই; তদভাবে কারু-কাৰ্য্য-খচিত ইষ্টকের ফটোগ্রাফ গৃহীত হইয়াছে। পশ্চিম দিকের দেয়ালের পুৰ্ব্বপৃষ্ঠ বিশেষ যত্নের সহিত সুসজ্জিত হইয়াছিল; মসজেদে প্রবেশ করিলে, তাহাই সৰ্ব্বাগ্রে দৃষ্টি আকর্ষণ করিত। এই দেয়ালে সমব্যবধান বিন্যস্ত পাঁচটি অর্ধবৃত্তাকার প্রকোষ্ঠ (সেজদাগা) রচিত হইয়াছিল; এবং একটির সম্মুখে একটি বেদীও (মিম্বর) নির্মিত হইয়াছিল। এগুলি সুদৃঢ় প্রস্তরে রচিত হইলেও সম্পূর্ণভাবে আত্মরক্ষা করিতে পারে নাই। সকলগুলিরই শীর্ষদেশ ভাঙ্গিয়া পড়িয়া গিয়াছে; এবং মধ্যস্থলবর্তী সেজদাগার সকল প্রস্তরই খসিয়া গিয়াছে। এই শেষোক্ত স্থানটি কষ্টি প্রস্তরের দেবমূর্তি ভাঙ্গিয়া গঠিত হইয়াছিল। এক্ষণে কারুকার্যহীন প্রস্তরখণ্ড সাজাইয়া দিয়া এই স্থানটির শূন্য গর্ভ পূর্ণ করিয়া দেওয়া হইয়াছে।

যে সকল ইষ্টক-প্রস্তর ভাঙ্গিয়া পড়িয়া স্কুপে সৃষ্টি করিয়াছিল, তাহা সরাইয়া ফেলিবার পর, মসজেদের সম্পূর্ণ আয়তনের পরিমাণ প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে। বাহিরের আয়তন ৭৯ ফুট ৮ ইঞ্চি x ৫২ ফুট ৮ ইঞ্চি, এবং মসজেদের অভ্যন্তরের হয়ঁতলের আয়তন ৬৬ ফুট x ৩৯ ফুট থাকা দেখিতে পাওয়া গিয়াছে। হৰ্মতলে সমব্যবধান-বিন্যস্ত আটটি প্রস্তরস্তম্ভ সংস্থাপিত হইয়াছিল। স্তম্ভগুলি যথাস্থানে বর্তমান না থাকিলেও, তাহাদের পাদপীঠের চিহ্ন এখনও বিলুপ্ত হয় নাই। এই আটটি প্রস্তরস্তম্ভের উপর ভার বিন্যস্ত করিয়া, পঞ্চদশ-গম্বুজ-যুক্ত মসজেদ নির্মিত হইয়াছিল। গম্বুজগুলি ইষ্টকখণ্ডের সহিত চুন মিশ্রিত করিয়া নির্মাণ করা হইয়াছিল। তাহা সমস্তই ভূপতিত হইয়াছিল; কিন্তু স্থানে স্থানে জমাট-বাঁধা গম্বুজের অংশ মাটীর ভিতর মধ্যে হইতে বাহির হইয়াছিল। মসজেদটি যখন সৰ্বাবয়বসম্পন্ন ছিল, তখন ইহার চারি কোণে চারিটি মিনার উর্দ্ধে মস্তক উত্তোলন করিয়া ইহার শোভাবর্ধন করিত। মিনারগুলি বর্তমান নাই; কিন্তু তাহাদের চারিকোণের চারিটি ভিত্তিমূল খনন করিয়া বাহির করা হইয়াছে। ভিত্তিমূলের স্থাপত্য-ব্যবস্থা দেখিয়া বুঝিতে পারা যায়,–মিনারগুলি অষ্টকোণ-বিশিষ্ট ছিল। তাহার সাজসজ্জা কিরূপ ছিল, তাহার পরিচয় বিজ্ঞাপক কারু-কাৰ্য্য-খচিত দুই চারিখানি ইষ্টক ভিন্ন আর কিছু প্রাপ্ত হওয়া যায় নাই। ধবংসাবশেষ হইতে যে সকল ক্ষুদ্র ও বৃহৎ প্রস্তর বাহির হইয়াছে, তাহা সমস্তই হিন্দুর ও বৌদ্ধের মন্দির হইতে সমাহৃত হইয়াছিল বলিয়া পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে। যে সকল প্রস্তরনির্মিত দ্বারশাখা ও উদুম্বর ধবংসাবশেষের ভিতর হইতে বাহির হইয়াছে, তাহাদের আয়তন দেখিলে, তাহারা কিরূপ সুবৃহৎ দেবমন্দির হইতে সমাহৃত হইয়াছিল, তাহার কিছু কিছু আভাস প্রাপ্ত হওয়া যায়।

মসজেদ-প্রাঙ্গণ ও গোরস্থান

মসজেদের সম্মুখে প্রাচীরবেষ্টিত উত্তর দক্ষিণে লম্বা একটি বিস্তৃত প্রাঙ্গণ বৰ্ত্তমান ছিল। উত্তর দিকে তাহার প্রবেশদ্বার ও দক্ষিণ দিকে পুষ্করিণীর সোপান-সংলগ্ন আর একটি দ্বার বর্তমান ছিল বলিয়া বোধ হয়। প্রাচীরের, দ্বারের, ও সোপানের ইষ্টকগুলি অনেক দিন অপহৃত হইয়া গিয়াছে; তথাপি তাহাদের স্থান নির্দেশের উপযোগী কিছু কিছু ধবংসাবশে, এখনও দেখিতে পাওয়া যায়। মসজেদের উত্তরে একটি প্রাচীরবেষ্টিত ক্ষুদ্র প্রাঙ্গণের চিহ্ন ধরিয়া খনন করিতে আরম্ভ করায়, তন্মধ্যে একটি গোরস্থান আবিষ্কৃত হইয়াছে। যে কবরটি সর্বাপেক্ষা বৃহৎ, তাহা পূৰ্ব্ব পশ্চিমে লম্বা। তাহার পূর্বদিকের দেওয়ালের বহির্ভাগে একটি প্রদীপ জ্বালাইবার ক্ষুদ্র কুলুঙ্গী বাহির হইয়াছে। কুলুঙ্গীটী নিতান্ত ক্ষুদ্র হইলেও কৌতূহলপূর্ণ। ইহার খিলান বিপত্রের ন্যায় ত্রিপত্রাকার, হিন্দু স্থাপত্যের নিদর্শনসূচক। মুসলমান-শাসনের প্রথম আমলে এইরূপ খিলান অনেক দিন পর্যন্ত মুসলমানী স্থাপত্যেও ব্যবহৃত হইয়াছিল। ইহা কবরটির প্রাচীনত্বের পরিচয় প্রদান করিতেছে। এই স্থানের মাটী সরাইবার সময় অনেকগুলি মৃৎপ্রদীপ, একটি লৌহ নির্মিত বর্ষাফলক ও একটি তীরফলক প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে। গোরস্থানের সকল অংশ সম্পূর্ণরূপে খনন করিবার অবসর না থাকায়, অন্যান্য কবরগুলির আয়তন জানিতে পারা যায় নাই। কত কাল এই কবর ভূগর্ভে লুক্কায়িত আছে, কতকাল মৃতের প্রতি সম্মান-প্রদর্শনের জন্য এখানে কেহ সন্ধ্যাকালে প্রদীপ দিবার আয়োজন করে নাই, কেহ তাহার সন্ধান প্রদান করিতে পারে না। কবরগুলি যে কত প্রাচীন, ইষ্টক-বিন্যাস দেখিয়া তাহা কিয়ৎপরিমাণে অনুমান করা সম্ভব হইলেও, বিশুদ্ধভাবে সময় নিরূপণ করিবার উপযোগী নিদর্শন প্রাপ্ত হওয়া যায় নাই। বৃহৎ কবরটির উপরিভাগের ইষ্টক সমতল হইয়া গিয়াছে, তথাপি কবরটি এখনও সম্পূর্ণরূপে ধবংসপ্রাপ্ত হয় নাই।

পূর্বতন লোকালয়

পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা ইষ্টকনির্মিত একটি রাজপথের দক্ষিণে মসজেদটি নির্মিত হইয়াছিল। এই রাজপথ পূৰ্ব্বাস্যে অনেক দূর পর্যন্ত চলিয়া গিয়াছে। তাহার উভয় পার্শ্বে বহুসংখ্যক পুরাতন পুষ্করিণী বৰ্ত্তমান থাকিয়া, পুরাকালের জনাকীর্ণ লোকালয়ের সাক্ষ্যদান করিতেছে। অধিকাংশ পুষ্করিণী উত্তর-দক্ষিণে লম্বা, এবং একালের পুষ্করিণীর তুলনায় সুবৃহৎ বলিয়া কথিত হইবার যোগ্য। কোনও কোনও পুষ্করিণী এত পুরাতন যে, তাহার চারি দিকের পাহাড় সমতল হইয়া গিয়াছে; এবং তন্মধ্যস্থ গভীর জলাশয়টি নলবনে বা শস্যক্ষেত্রে পরিণত হইতে চলিয়াছে। উত্তর-দক্ষিণে লম্বা পুষ্করিণী হিন্দুকীৰ্ত্তি-বিজ্ঞাপক বলিয়াই ঐতিহাসিক-সমাজে সুপরিচিত। মহীপালদীঘি, তপনদীঘি, সাগরদীঘি প্রভৃতি সৰ্ব্বলোকবিদিত হিন্দুকীর্তির নিদর্শনগুলি উত্তরদক্ষিণে লম্বা। মাহি-সন্তোষের ধবংসাবশেষ-মধ্যস্থ উত্তরদক্ষিণে লম্বা সরোবরগুলি যে জনাকীর্ণ লোকালয়ের সাক্ষ্যদান করিতেছে, তাহা যে মুসলমান শাসনকালের পূর্ধ্ববর্তী লোকালয় ছিল, তাহা এইরূপে অনুমিত হইতে পারে। এই অনুমান অসঙ্গত বলিয়া বোধ হয় না। সরোবরগুলি পুরাতন সমৃদ্ধির পরিচয় প্রদান করিতেছে। যে লোকালয়ে এতগুলি পুরাতন সরোবর বিদ্যমান ছিল, তাহাতে দেবমন্দিরও বিদ্যমান ছিল বলিয়াই প্রতীয়মান হয়। স্থানে স্থানে দুই একটি স্তূপ এখনও দেখিতে পাওয়া যায়। কিন্তু মসজেদ রচিত হইবার পর, দেবমন্দিরের অবস্থান-ভূমিতে এখন আর প্রস্তর পড়িয়া থাকিবার আশা করিতে পারা যায় না। যাহা ছিল, তাহা নাই; এখন কেবল তাহার পরিচয় বিজ্ঞাপক আভাসমাত্রই প্রাপ্ত হওয়া যায়।

দরগা

দরগাটি এখনও সম্পূর্ণরূপে ধবংসাবশেষে পরিণত হয় নাই। এখনও লাখেরাজভোগী ফকীর-বংশধরগণ তাহার সেবক-রূপে বৰ্ত্তমান রহিয়াছে। এখনও হিন্দু-মুসলমান ভক্তিপূর্ণহৃদয়ে দরগায়ে আসিয়া “সিন্নি” দান করিয়া থাকেন। তথাপি দরগার পূৰ্ব্বাবস্থা বর্তমান নাই। যে অবস্থা বর্তমান আছে, তাহাও দিন দিন অধিক শোচনীয় হইয়া পড়িতেছে! ইহা এখনও পবিত্র ক্ষেত্ররূপে পূজিত হইতেছে বলিয়া, ইহার কোনও স্থান খনন করা হয় নাই। প্রস্তর-গঠিত চতুষ্কোণ একটি সুদৃঢ় চত্বরের উত্তরাংশে ইষ্টক প্রাচীরবেষ্টিত কবর বর্তমান আছে। একটি কবর হইলেও, তাহা মাই ও সন্তোষী নাম্নী মাতার ও কন্যার যুক্তকবর বলিয়া পূজিত হইতেছে। তাহার দক্ষিণে প্রাচীরবেষ্টিত আর একটি অংশ কতকগুলি কবরের চিহ্ন বর্তমান আছে। ইহার দক্ষিণে চত্বরের অবশিষ্ট অংশের পশ্চিম দিকে ইষ্টকগঠিত প্রাচীর (ইদগা) দেখিতে পাওয়া যায়। তাহার সম্মুখে ইদের সময় নমাজ হইয়া থাকে। অন্যান্য দিকে প্রাচীর বর্তমান নাই। এই দরগাটির প্রাঙ্গণে অনেকগুলি ইষ্টকালয়ের ভিত্তি-পীঠমাত্রই বৰ্ত্তমান আছে।

দুর্গা ও পুরাতন কূপ

দুর্গাকার স্থানটি এখনও “গড়” নামেই কথিত হইয়া আসিতেছে। ইহা কাহার গড়, বা কত দিনের গড়, সে বিষয়ে কেহ কোনরূপ উত্তর দান করিতে পারে না। ইহার চারি দিকে এখনও সুদৃঢ় মৃৎপ্রাচীর উচ্চাবস্থায় বর্তমান আছে। মৃৎপ্রাচীরের প্রত্যেক পার্শ্বের মধ্যভাগে দুর্গ-তোরণের অবস্থান-সূচক ব্যবধান দেখিতে পাওয়া যায়। এই মৃৎপ্রাচীরের বাহিরে চতুর্দিকে একটি অবিচ্ছিন্ন পরিখা; তাহার অনেক অংশ এখনও সলিলপূর্ণ। পশ্চিম দিকে প্রধান প্রবেশদ্বার অবস্থিত ছিল মনে করিয়া, তাহার আনুমানিক অবস্থান-ভূমি খনন করিতে গিয়া, ইষ্টক-নির্মিত প্রহরিকক্ষের ও দুর্গতোরণের ভিত্তিমূল আবিষ্কৃত হইয়াছে। এই স্থানে পরিখার কিয়দংশ পর্যন্ত একটি ইষ্টকনিৰ্মিত সরল পথ বাহির হইয়া গিয়াছে। তাহা দুর্গসেতুর আশ্রয়স্থান ছিল বলিয়াই প্রতিভাত হয়। এই স্থানের পরিখা বর্ষার পর অল্পদিনের মধ্যেই শুষ্ক হইয়া যায়। ইহার অপর তীর হইতে সরলভাবে পশ্চিম মুখে কিয়দূর অগ্রসর হইবার পর, একটি জঙ্গলাবৃত পুরাতন কূপ দেখিতে পাওয়া গিয়াছে। তাহার চারিদিকে মৃত্তিকা খনন করায়, কূপের ইষ্টক-বেষ্টনী বাহির হইয়া পড়িয়াছে। এই বেষ্টনীর পরিসর প্রায় ৭ ফুট। তাহার জন্যই কূপমধ্যস্থ যত্ন-বিন্যস্ত ইষ্টকরাশি এখনও স্বস্থানে বর্তমান থাকিয়া, কূপটিকে রক্ষা করিতে সমর্থ হইয়াছে। এই অঞ্চলটি অল্পদিন হইতে সাঁওতাল কৃষকগণের অধ্যবসায়বলে সর্ষপক্ষেত্রে পরিণত হইয়াছে। এই সকল ক্ষেত্র এখনও ইষ্টকখণ্ডে আচ্ছন্ন রহিয়াছে; কিন্তু এখানে ইষ্টকনিৰ্মিত কিরূপ অট্টালিকাদি বৰ্তমান ছিল, তাহার চিহ্ন পৰ্য্যন্ত বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে।

পশ্চিম দিকের দুর্গতেরণ দিয়া দুর্গে প্রবেশ করিলে, একটি বিস্তৃত ক্ষেত্রে উপনীত হইতে হয়। তাহা প্রায় সমতল। তাহার সম্মুখে একটি স্কুপ; তাহাই দুর্গমধ্যস্থ সর্বোচ্চ স্তূপ। পশ্চিম দুর্গ-তোরণের সমসূত্রে পূর্ব দিকে অগ্রসর হইলে, এই স্থূপের যে অংশে উপনীত হইতে হয়, তথায় অনেক দূর পর্যন্ত খনন করিয়া ইষ্টকের বা প্রস্তরের চিহ্ন প্রাপ্ত হওয়া যায় নাই। ইহাতে অনুমান হয়, এই সর্বোচ্চ পটী দুর্গমধ্যস্থ প্রধান তোরণের ধবংসাবশেষ,–ইহার ভিতর দিয়াই দুর্গাভ্যন্তরের প্রাসাদপ্রাঙ্গণে প্রবেশ করিতে হইত। মৃৎপ্রাচীর সুদৃঢ় হইলেও, কেবল মৃত্তিকা-সমষ্টিতে গঠিত হইয়াছিল কি না, তাঁহার পরীক্ষা করিবার জন্য এক স্থান খনন করিয়া দেখিতে পাওয়া গিয়াছে–তাহার অভ্যন্তরে ইষ্টক-প্রাচীর নিহিত রহিয়াছে। এখন এই দুর্গমধ্যে কেহ বাস করে না; এখানে এখনও কৃষিকার্যের সূত্রপাত হয় নাই। দরগার সেবকগণ বর্তমান থাকিলেও, তাঁহারা ভিন্ন গ্রামে বাস করেন,–দরগার প্রাঙ্গণমধ্যে বা নিকটে কেহ বাস করে না। যেখানে মসজেদ বাহির হইয়াছে, তাহার পূর্বে ও পশ্চিমে কৃষিকার্য্যের সূত্রপাত হইয়াছে; এবং তাহার কিয়দূর পূৰ্ব্বে ও দক্ষিণ-পূৰ্ব্বে সাঁওতাল, মুণ্ডা প্রভৃতি নবাগত কৃষকগণ কুটীর নির্মাণ করিয়াছে। তাহারাই এখন পরিত্যক্ত সমৃদ্ধিশূন্য ধবংসাবশিষ্ট পুরাতন জনাকীর্ণ বৃহৎ নগরের একমাত্র অধিবাসী। তাহাদের চেষ্টায় বন জঙ্গল পরিষ্কৃত হইতেছে; কিন্তু তাহাদের সেই চেষ্টাই পুরাকীর্তির চিহ্ন লোপ করিয়া, তথ্যানুসন্ধানের পথ অধিক দুর্গম করিয়া তুলিতেছে!

হিন্দু-বৌদ্ধ স্মৃতিচিহ্ন

এই খনন-কার্য্যে প্রবৃত্ত হইয়া ঐতিহাসিক তথ্যানুসন্ধারে উপযোগী যে সকল স্মৃতিচিহ্ন দেখিতে পাওয়া গিয়াছে, তন্মধ্যে স্তম্ভলিপি সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য। দুইটি স্তম্ভের উৰ্দ্ধভাগের কিঞ্চিৎ নিম্নে দুই পংক্তিতে একই লিপি ক্ষোদিত রহিয়াছে। তাহা এই :

১ শ্ৰীরাজপুরীয় লে

২ ঋক শ্রীমবদেবঃ

যে সকল দেবমূৰ্ত্তি আবিষ্কৃত হইয়াছে; তাহার একটিও অক্ষত অবস্থায় বর্তমান নাই। মূৰ্ত্তির বিপরীত পৃষ্ঠ মসৃণ করিয়া লইয়া, তাহাতে মুসলমানী কারুকার্য ক্ষোদিত করা হইয়াছিল। তাহাকে সম্মুখে স্থাপিত করিবার জন্য মূৰ্তিযুক্ত ক্ষোদিত করা হইয়াছিল। তাহাকে সম্মুখে স্থাপিত করিবার জন্য মূর্তিযুক্ত অপর পৃষ্ঠ ভিত্তির মধ্যে গাঁথিয়া ফেলা হইয়াছিল। সেই কাৰ্য্যের সুবিধাসাধনের জন্য মূৰ্ত্তিগুলির শিল্পোদ্ভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ছাঁটিয়া ফেলা হইয়াছিল। এইরূপে যাহা বিধবস্ত হইয়াছিল, তাহা কোন শ্ৰীমূৰ্ত্তির ভগ্নাবশেষ, এখনও তাহার কিছু কিছু আভাস প্রাপ্ত হওয়া যায়। এই সকল শ্ৰীমূৰ্ত্তির মধ্যে মহিষমর্দিনীর, বিষুZর এবং সূর্যের মূর্তি উল্লেখযোগ্য। ইহার একখানির পাদপীঠে দানপতির নাম ক্ষোদিত রহিয়াছে। মসজেদ-বিচ্যুত প্রস্তররাশির মধ্যে একটী গৌরীপট্ট ও দুইখানি বুদ্ধমূর্তিসংযুক্ত দ্বারফলকও বাহির হইয়া পড়িয়াছে। এই সকল প্রস্তর এক যুগের শিল্পরীতির পরিচয় প্রদান করে না; এক শ্রেণীর প্রস্তর-রূপেও প্রতিভাত হয় না। প্রস্তরগুলি যে নানা সময়ের হিন্দু ও বৌদ্ধ মন্দির হইতে সমাহৃত হইয়াছিল, এবং ঐ সকল মন্দির যে মসজেদের অবস্থান-ভূমির পার্শ্বে বা অনতিদূরেই বর্তমান ছিল, তাহাই যুক্তিসঙ্গত অনুমান বলিয়া প্রতীয়মান হয়। প্রস্তরগুলি বৃহদায়তন। এই সকল প্রস্তর নিকটে বা অনতিদূরে বর্তমান থাকিলে, মসজেদ-নির্মাতা প্রস্তর-আহরণের জন্য বহুদূরে হস্ত প্রসারণ করিবার প্রয়োজন অনুভব করিতেন না। প্রস্তরগুলি কত দূর হইতে, কোন পুরাকীর্তির অবস্থান ভূমি হইতে সমাহৃত হইয়াছিল, তাহা জানিবার জন্য স্বভাবতঃই কৌতূহল উপস্থিত হয়। এই কৌতূহল চরিতার্থ করিবার উপযোগী লিখিত প্রমাণ বর্তমান না থাকিলেও, একটি অবস্থা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তাহার তথ্যনির্ণয়ের উদ্দেশ্যে মাহি-সন্তোষের ধবংসাবশেষের মধ্যে ও তাহার অনতিদূরবর্তী অন্যান্য স্থানে পুরাতন স্থূপাদির নিদর্শন বর্তমান আছে কি না, তাহার অনুসন্ধান- কার্যের ব্যবস্থা করা হইয়াছিল। যেখানে ইষ্টকপ্রস্তর-পরিপূর্ণ ভগ্নস্তূপ এখনও বর্তমান আছে, তাহার অনুসন্ধান করিতে গিয়া দেখিতে পাওয়া গিয়াছে– দরগা হইতে দুই মাইল, চারি মাইল, আট মাইল, দশ মাইল দূরবর্তী অনেক স্থানই ইষ্টক-প্রস্তরপূর্ণ অনেক ধবংসাবশেষ এখনও বর্তমান আছে। কিন্তু দরগার চতুর্দিকের পুরাতন সরোবরগুলি মুসলমান-শাসনের পূৰ্ব্বকালবর্তী যে জনাকীর্ণ লোকালয়টির পূর্ধ্বতন সমৃদ্ধির পরিচয় প্রদান করিতেছে, কেবল তাহার চতুঃসীমার মধ্যেই এখন আর কোনও ইষ্টক প্রস্তর পরিপূর্ণ ভগ্নস্তূপ দেখিতে পাওয়া যায় না। ইহা ওয়েষ্টমেকটের অনুমানেরই পক্ষ সমর্থন করে। ইহার প্রতি দৃষ্টিপাত করিবামাত্র মনে হয়, দরগায় এবং মসজেদে যে সকল প্রস্তর ব্যবহৃত হইয়াছিল, তাহা বহুদূর হইতে আনীত হয় নাই,–তাহা একদিন এই স্থানে সুপ্রতিষ্ঠিত হিন্দুবৌদ্ধ দেবালয়ের অঙ্গপ্রত্যঙ্গরূপে হাতের কাছে বর্তমান ছিল। তজ্জন্য অল্পায়াসেই মসজেদ নির্মিত হইতে পারিয়াছিল।

যাহারা সমতল ভূমিতে বাস করিয়াও, বহুদূরবর্তী পৰ্বত-কন্দর প্রস্তর-ফলক কাটিয়া আনিয়া, তদ্বারা শিল্পসুষমাসংযুক্ত মন্দির-রচনার উপাদান প্রস্তুত করিয়াছিল, তাহাদের অধ্যবসায়, তাহাদের মহোচ্চ আদর্শ, তাহাদের সমুন্নত শিল্পরুচি ও তাহাদের সমুচিত সমৃদ্ধি এখন স্বল্পকাহিনীতে পর্যবসিত হইয়াছে। পরবর্তীকালে যাহারা সেই সকল প্রস্তর-ফলক হাতের কাছে প্রাপ্ত হইয়া তাহার সাহায্যে অপেক্ষাকৃত অল্পায়াসে হৰ্মনির্মাণে ব্যাপৃত হইয়াছিল, তাহাদের পরকীর্তিসংরক্ষণ পরান্মুখ অত্যুৎকৃট বীরদর্পের কথাও স্বপ্ন-কাহিনীতে পর্যবসিত হইয়াছে! এখন বরেন্দ্র এক মহাশ্মশানভূমিতে পরিণত হইয়াছে। সেই শ্মশানভূমির চিতাভস্ম হিন্দুর কীৰ্ত্তি ও মুসলমানের কীৰ্ত্তি সমানভাবেই আচ্ছন্ন করিয়া রাখিয়াছে! পুরাকালের বাঙ্গালার এবং বাঙ্গালীর সুখদুঃখের প্রকৃত পরিচয় লাভ করিতে হইলে, এই মহাশ্মশানের খননকার্যে হস্তক্ষেপ করিতে হইবে। একটি স্থানের খননকার্যে সমগ্র পূর্বপরিচয় উদঘাটিত হইবার আশা করা যাইতে পারে না। তাহার জন্য নানাস্থানে খননকার্য্যের সুব্যবস্থা করিতে হইবে; এবং দেশের লোককেই তাহার যথাযোগ্য আয়োজন করিতে হইবে। মাহি-সন্তোষের ধবংসাবশেষের মধ্যে যতটুকু খননকার্য সম্পাদিত হইতে পারিয়াছে, তাহা একটি স্থানের পক্ষেও পৰ্য্যাপ্ত বলিয়া কথিত হইতে পারে না। তথাপি তাহা বাঙ্গালার ইতিহাসের এক অন্ধকারাচ্ছন্ন পুরাতন কক্ষকে অভিনব আলোক-সম্পাতে উদ্ভাসিত করিয়া তুলিয়াছে। তাহাই কুমার শরকুমার প্রবর্তিত বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতি সম্পাদিত এই অপৰ্য্যাপ্ত খননকার্য্যের আশাতীত পুরস্কার। অতঃপর তাহারই আলোচনার প্রবৃত্ত হইব।

পাষাণ–পরিচয়-স্থাপত্য-রীতি

খৃষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর মধ্যভাগে চীনদেশের তীর্থযাত্রী ইয়নচুয়ঙ্গ আমাদের দেশে অনেক অট্টালিকা দেখিয়া গিয়াছিলেন। তাহার পর, পাল-সাম্রাজ্যের অভ্যুদয়ে, একটি দীর্ঘকালব্যাপী স্থাপত্য-প্রবণ গঠন-যুগের আবির্ভাব হইয়াছিল। সে যুগে “কুলভূধর-কক্ষতুল্য” অনেক অট্টালিকা নির্মিত হইয়াছিল। তাহার পরবর্তী ও মুসলমান শাসনের পূৰ্ব্ববর্তী সেন-রাজগণের শাসন-সময়েও অনেক অট্টালিকা নির্মিত হইয়াছিল। তাম্রশাসনে, শিলালিপিতে, সমসাময়িক গ্রন্থে ইহার কিছু কিছু সমাচার প্রাপ্ত হওয়া যায়। সে সকল অট্টালিকার একটিও এখন পূৰ্বাবস্থায় বর্তমান নাই; এখন কেবল অনেক অট্টালিকার ধবংসাবশিষ্ট ইষ্টক প্রস্তর অনেক স্থান আচ্ছন্ন করিয়া রাখিয়াছে।

এই সকল অট্টালিকা বর্তমান থাকিলে, বঙ্গভূমি কেবল “সুজলা সুফলা মলয়জ শীতলা শস্য-শ্যামলা’ বলিয়াই কীৰ্তিত হইত না। তাহা কাব্য-সৌন্দর্যের উপভোগ্য নিদর্শন, দেশের পক্ষে বিধাতার আশীৰ্বাদ-প্রসূত নৈসর্গিক সৌভাগ্য বিলাস;–কিন্তু মানব-চেষ্টার পরিচয়-বিজ্ঞাপক ঐতিহাসিক অবদান-নিদর্শন নহে। স্থাপত্য-কীৰ্ত্তি বৰ্ত্তমান থাকিলে, তাহা দেশের লোকের পুরুষকারের পরিচয় প্রদান করিতে পারিত। যে দেশ পৰ্ব্বতশূন্য নদীবহুল সমতল ক্ষেত্র, সে দেশের পাষাণ প্রাসাদ দেশের লোকের আত্মচেষ্টার অভ্রান্ত নিদর্শন বলিয়াই প্রতিভাত হইত। তাহা যখন বর্তমান নাই, তখন তাহার ধবংসাবশিষ্ট পাষাণ-খণ্ডও উপেক্ষণীয় নহে। তাহা যেমন পুরাতন শিল্প-সুষমার সুপ্তাবশিষ্ট শেষ নিদর্শন, সেইরূপ ইতিহাসের উদ্ধারসাধনের অপরিহার্য শেষ অবলম্বন।

যে বাহু এখন রোগাতুর বলিয়া অবসর হইয়া পড়িয়াছে, ইহাতে তাহার স্বাস্থ্যসুলভ অধ্যবসায়পূর্ণ অমিত বলের পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়;–যে চিত্ত এখন পূৰ্তকৰ্ম্মনিষ্ঠা বিস্তৃত হইয়া, দিন দিন অধিক আত্মম্ভরী হইয়া উঠিতেছে, ইহাতে তাহার স্বার্থসম্পর্কশূন্য অকাতর আত্মত্যাগের আভাস প্রাপ্ত হওয়া যায়;–যে কুশাগ্রবুদ্ধি এখন সংকীর্ণতার ক্ষুদ্র গণ্ডী ক্ষুদ্রতর করিয়া, মানব স্বভাবসুলভ উচ্চাকাঙ্ক্ষার শেষ নিঃশ্বাস চিররুদ্ধ করিবার আয়োজন করিতেছে, ইহাতে তাহার অসীম অভ্যুদয়লালসার স্বাভাবিক স্ফূৰ্ত্তির সন্ধান লাভ করা যায়।

বাঙ্গালীর পূৰ্ব্বকাহিনীকে রাজবংশের উত্থান-পতনের কাহিনীমাত্র মনে করিয়া, ইতিহাস-সঙ্কলনের আয়োজন করিতে হইলেও, এই সকল পাষাণ খণ্ডের প্রতি সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা প্রদর্শন করা যায় না;–বাঙ্গালীর সাৰ্বজনীন সুখ-দুঃখের,–আশা-আকাঙ্ক্ষার, শিক্ষা-দীক্ষার প্রকৃত ইতিহাস-সঙ্কলনের আয়োজন করিতে হইলে, ইহার প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করা অসম্ভব। সে কালের বাঙ্গালীর প্রকৃত পরিচয় লাভ করিতে হইলে, পাষাণ-পরিচয় উদঘাটিত করিবার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করিতে হইবে;–তাহা আধুনা বিস্মৃত, অপরিজ্ঞাত, উপেক্ষিত,–কিন্তু তাহা চিরস্মরণীয় হইবার উপযুক্ত।

উড়িষ্যার কথা পৃথক। তথায় এখনও অনেক অট্টালিকা অক্ষত-কলেবরে দণ্ডায়মান থাকিয়া, সেকালের নরসিংহগণের বিপুল অভ্যুদয়ের পরিচয়-প্রদানে তাহাদের জন্মভূমির মুখ উজ্জ্বল করিয়া রাখিয়াছে। উড়িষ্যার দুই চারিটি স্থানে যাহা দেখিতে পাওয়া যায়, বাঙ্গালার অনেক স্থানেই যে সেইরূপ অনেক অট্টালিকা দেখিতে পাওয়া যাইত, বরেন্দ্রভূমির অসংখ্য ভগ্নস্তূপ তাহার আভাস প্রদান করিতে পারে। এই সকল ভগ্নস্তূপের খননকার্য দূরে থাকুক, ইহাদের অবস্থান-বিবরণও সঙ্কলিত হয় নাই। কত অট্টালিকার ধবংসাবশেষ এখনও ভূগর্ভে নিহিত হইয়া রহিয়াছে, তাহার সংখ্যামাত্রও সম্পূর্ণরূপে নির্ণীত হইতে পারে নাই। বরেন্দ্রভূমির অধিবাসিবর্গের নিকট তাহার পুরাকীৰ্ত্তি-নিদর্শন এইরূপে অবিজ্ঞাত হইয়া রহিয়াছে;–মানবস্বভাবসুলভ কৌতূহল পৰ্য্যন্ত অবসন্ন হইয়া পড়িয়াছে।

এই সকল পুরাতন অট্টালিকার স্থাপত্য-রীতি কিরূপ ছিল, তাহা জানিবার প্রকৃষ্ট উপায় খনন-কাৰ্য। তাহাতে হস্তক্ষেপ করিবামাত্র বুঝিতে পারা যায়, সকল বিষয়ের মূলসূত্ৰ সমগ্ৰ আৰ্য্যাবৰ্ত্তেই একরূপ ছিল;-স্থাপত্যরীতির মূল সূত্রেও তাহার ব্যতিচার দেখিতে পাওয়া যাইত না। প্রদেশবিশেষের অট্টালিকার বাহ্য-বিকাশে শিল্প-প্রতিভার যাহা কিছু পার্থক্য লক্ষিত হইত; তাহাতে স্থাপত্য রীতির মূলসূত্র বিচ্ছিন্ন হইত না। সুতরাং সকল স্থানের প্রাদেশিক স্থাপত্য-রীতি একটি মূলরীতির শাখা বলিয়াই কথিত হইবার যোগ্য। গৌড়ীয় স্থাপত্য-রীতি সমগ্র আৰ্য্যাবৰ্ত্তব্যাপী মূল স্থাপত্য-রীতির এইরূপ একটি শাখা;–উৎকলের স্থাপত্যরীতিও এইরূপ একটি শাখামাত্র। তাহা প্রাচ্য ভারতের একটি বিশিষ্ট গঠন যুগের আবির্ভাবে পাল-সাম্রাজ্যের প্রভাব-ক্ষেত্রের মধ্যেই পুষ্টিলাভ করিয়াছিল, পূর্ধ্বতন গুহা-শিল্পের অবশ্যম্ভাবী ক্রমবিকাশরূপে ক্রমশঃ অভিব্যক্ত হয় নাই। গুহা-শিল্পের রচনা যুগের পরে, এবং মন্দির শিল্পের রচনা-যুগের পূৰ্ব্বে, প্রায় সহস্রাধিক বর্ষ অতীত হইয়া গিয়াছিল। এই দীর্ঘকালব্যাপী যুগ-ব্যবধান-মধ্যে উৎকলের কোনও স্থানে কোনও উল্লেখযোগ্য অট্টালিকা নির্মিত হইবার পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায় না। এখন যে সকল দেব মন্দির উড়িষ্যার অলঙ্কার, তাহা পাল সাম্রাজ্যের গঠন-যুগের নিদর্শন। তজ্জন্যই বরেন্দ্রভূমির ধবংসাবশেষনিহিত পাষাণখণ্ডের স্থাপত্য-রীতির সঙ্গে উড়িষ্যার স্থাপত্য-রীতির মূলপ্রকৃতিগত অপ্রচ্ছন্ন সাদৃশ্য বর্তমান থাকা দেখিতে পাওয়া যায়।

বাস্তুশাস্ত্র

যে শাস্ত্রে এই সকল পূর্ধ্বতন অট্টালিকার স্থাপত্য-রীতির ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যাইতে পারে, তাহার নাম বাস্তুশাস্ত্র। অনুশীলনের অভাবে তাহার অধ্যয়ন অধ্যাপনা বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে। এই শাস্ত্রের অসম্যক জ্ঞান লইয়া ধবংসাবশিষ্ট পাষাণখণ্ডের সম্যক পরিচয় প্রাপ্ত হইবার আশা করা যাইতে পারে না। এই কারণে আমাদের সাহিত্যে পুরাবস্তুতত্ত্ব এখনও সমুচিত সমাদর লাভ করিতে পারে নাই। পুরাবস্তু-সংগ্রহকারকগণ এখনও অনেকের নিকট “ভারবাহী” (!) বলিয়া উপহাস লাভ করিয়া থাকেন! আমাদের এই অজ্ঞতা-সুলভ উপহাস-স্পৃহা বিজ্ঞতার কঞ্চুকে আবৃত থাকিয়া, এখনও আমাদের রসসাহিত্যলোলুপ রচনা বিলাসকে রসসিক্ত করিয়া রাখিয়াছে! সুতরাং আমাদের সাহিত্যে ইষ্টক ইষ্টক, প্রস্তর প্রস্তর;-তাহার অভ্যন্তরে যে উন্মাদনা-পূর্ণ মানব-প্রাণের অনির্বচনীয় স্পন্দন অনুভূত হইতে পারে, তাহা অবিজ্ঞত, অবজ্ঞাত,ক্কচিৎ বা উপহসিত নগণ্য ব্যাপার!

মন্বত্রি-বিষ্ণু-হারীভাদি ধর্মশাস্ত্র-প্রযোজকগণের নাম বিলুপ্ত হয় নাই। কিন্তু বাস্তুশাস্ত্রোপদেশকগণের নাম অপরিচিত হইয়া পড়িয়াছে। এক সময়ে তাঁহাদিগের নামও সৰ্ব্বত্র সুপরিচিত ছিল। মৎস্যপুরাণে [২৫৩ অধ্যায়ে] তাহার পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়। যথা :

“ভৃগুরত্রিবশিষ্ঠশ্চ বিশ্বকর্মা ময় স্তথা। নারদো নগ্নজিচ্চৈব বিশালাক্ষঃ পুরন্দরঃ।। ব্রহ্মা কুমারো নন্দীশঃ শৌনকো গর্গ এব চ। বাসুদেবোহনিরুদ্ধশ্চ তথা শুক্ৰবৃহস্পতী। অষ্টাদশৈতে বিখ্যাতা বাস্তুশাস্ত্রোপদেশকাঃ।”

এক শ্রেণীর গ্রন্থে এই সকল বাস্তুশাস্ত্রোপদেশকের মধ্যে ব্রহ্মাই মূল উপদেশক বলিয়া কীৰ্ত্তিত হইতেন। তাঁহার কোনও গ্রন্থের সন্ধান লাভ করা যায় না। ব্রহ্মা হইতে মুনিপরম্পরাক্রমে বাস্তুজ্ঞান আগত হইয়াছিল বলিয়া, অনেক দিন পর্যন্ত একটি জনশ্রুতি প্রচলিত ছিল। বরাহমিহির [বৃহৎ সংহিতায় ৫২ অধ্যায়ে] তাহার উল্লেখ করিয়া গিয়াছেন। যথা :

“বাস্তুজ্ঞান মথাতঃ কমলভবা মুনিপরম্পরায়াতম।”

বরাহমিহিরের গ্রন্থে পুরাণোক্ত অষ্টাদশ বাস্তুশাস্ত্রোপদেশকদিগের মধ্যে গর্গের নাম বিশেষভাবে উল্লিখিত আছে। গর্গ যাহা লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছিলেন, বরাহ মিহিরের গ্রন্থে তাহাই সংক্ষিপ্তভাবে [সমাসাৎ] সঙ্কলিত হইয়াছিল। এই সংক্ষিপ্তসারের টীকাকার ভট্টোৎপল বশিষ্ট-ময়-নগ্নজিতের নামের উল্লেখ করিয়া গিয়াছেন। ইহারা পূর্বতন আচাৰ্য। ইহাদিগের সঙ্গে সঙ্গেই বাস্তুশাস্ত্রের আলোচনা নিরস্ত হয় নাই। রামরাজ-কৃত হিন্দু-স্থাপত্যবিদ্যার সুলিখিত নিবন্ধে আরও অনেক বাস্তুবিদ্যা-গ্রন্থের পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়। তন্মধ্যে মানসার, কশ্যপ, বৈখানস, সকলাধিকার, সনকুমার, সারস্বত্য ও পঞ্চরাত্র বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ইহার কোনও কোনও গ্রন্থের লুপ্তাবশিষ্ট পাণ্ডুলিপি এখনও দেখিতে পাওয়া যায়। এতদ্ব্যতীত পুরাণ-তন্ত্রাদিতেও বাস্তুবিদ্যার অনেক বিবরণ উল্লিখিত আছে।

বিশ্বকর্মার নাম জনশ্রুতিতে চিরস্মরণীয় হইয়া রহিয়াছে। তাঁহার পূজা এখনও বিলুপ্ত হইতে পারে নাই। যাহারা যে কোনরূপ শিল্পকর্মে জীবিকার্জন করে, তাহারা সকলেই নিতান্তপক্ষে বৎসরান্তে একবার বিশ্বকর্মার পূজা করিয়া থাকে। প্রতিষ্ঠাকাৰ্যে এখনও শিল্পীকে সাক্ষাৎ বিশ্বকর্মা মনে করিয়া সংবর্ধনা করিবার ব্যবস্থা প্রচলিত আছে। রামরাজ “বিশ্বকৰ্মীয়” নামক একখানি গ্রন্থের উল্লেখ করিয়া গিয়াছেন। উহা এখনও মুদ্রিত হয় নাই। কিন্তু “বিশ্বকৰ্ম্ম-প্রকাশ” নামক আর একখানি গ্রন্থ একাধিকবার মুদ্রিত হইয়াছে। বিশ্বকৰ্ম্মা কিরূপে বাস্তুজ্ঞান লাভ করিয়াছিলেন, এই গ্রন্থের আরম্ভে তাহা উল্লিখিত আছে। যথা :

“প্রবক্ষ্যামি মুনিশ্রেষ্ঠ শৃণুষেকামানসঃ।

যদুক্তং শম্ভুনা পূৰ্ব্বং বাস্তুশাস্ত্রং পুরাতনম।

পরাশরঃ প্রাহ বৃহদ্রথার বৃহদ্রথঃ প্রাহ চ বিশ্বকৰ্ম্মণে।

স বিশ্বকর্মা জগতাং হিতায় প্রোবাচ শাস্ত্রং বহুভেদযুক্তম।।

এই বর্ণনায় জানিতে পারা যায়, বিশ্বকৰ্মাও বাস্তুশাস্ত্রের উদ্ভাবয়িতা ছিলেন না। বাস্তুজ্ঞান প্রথমে শম্ভ কর্তৃক প্রচারিত হইয়াছিল। তাহার পর কালক্রমে পরাশর বৃহদ্রথকে, এবং বৃহদ্রথ বিশ্বকর্মাকে বাস্তুজ্ঞান দান করায়, বিশ্বকর্মা জগতের হিতসাধন-কামনায় বহুভেদযুক্ত বাস্তুশাস্ত্রের রচনা করিয়াছিলেন। পুরাতন স্থাপত্য কীৰ্ত্তির প্রকৃত পরিচয় লাভ করিতে হইলে, বাস্তুশাস্ত্রের সাহায্যে পাষাণ-পরিচয় উদঘাটিত করিবার চেষ্টা করা কর্তব্য। মাহিসন্তোষের ধবংসাবশেষ খননসময়ে সে বিষয়ে যথাসাধ্য চেষ্টা করা হইয়াছিল। সে চেষ্টা সৰ্ব্বতোভাবে সফল না হইলেও, তাহার আংশিক ফলও উল্লেখযোগ্য।

যে সকল পাষাণ আবিষ্কৃত হইয়াছে, তন্মধ্যে স্তম্ভগুলি অপেক্ষাকৃত অক্ষত কলেবরে অপরিবর্তিত অবস্থায় মসজেদ-নির্মাণে ব্যবহৃত হইয়াছিল;–অন্যান্য পাষাণ কাটিয়া ছাঁটিয়া মসজেদ-নির্মাণের উপযোগী করা হইয়াছিল বলিয়া তাহাদের পূর্বাবস্থা পরিবর্তিত হইয়া গিয়াছে। তজ্জন্য স্তম্ভের কথাই সর্বাগ্রে আলোচিত হইবার যোগ্য।

ভারতবর্ষের নানাস্থানে বহুসংখ্যক পাষাণ-স্তম্ভ আবিষ্কৃত হইয়াছে। এই সকল স্তম্ভ প্রধানতঃ দুই শ্রেণীতে বিভক্ত হইতে পারে;-কতকগুলি অট্টালিকার সহিত সম্পর্কশূন্য; কতকগুলি অট্টালিকার অঙ্গীভূত। যেগুলি অট্টালিকার অঙ্গীভূত, তাহাও দুই শ্রেণীতে বিভক্ত হইতে পারে;-কতকগুলি ভিত্তির সঙ্গে সম্পর্কশূন্য; কতকগুলি ভিত্তির অঙ্গীভূত।

অট্টালিকার সহিত সম্পর্কশূন্য পাষাণ-স্তম্ভ একটিমাত্রই এক স্থানে স্বতন্ত্রভাবে সংস্থাপিত হইবার উদ্দেশ্যে নির্মিত হইত। তাহার উপর অট্টালিকার কোনও অংশের ভার ন্যস্ত হইত না। অশোকস্তম্ভ, গরুড়স্তম্ভ, অরুণস্তম্ভ প্রভৃতি এই শ্রেণীর অন্তর্গত। ইহাদের পারিভাষিক নাম স্তম্ভ নহে,–”ধবজ”। হয়শীর্ষ-পঞ্চরাত্রে ‘একস্তম্ভো ধবজো জ্ঞেয়ঃ” বলিয়া তাহা উল্লিখিত আছে। এই সকল স্তম্ভ যতই বৃহৎ হউক, অখণ্ড প্রস্তরখণ্ডে নির্মিত হইত। গঠন-ব্যবস্থার মান-সামঞ্জস্যে এই শ্রেণীর স্তম্ভ শিল্প-সুষমার আধার বলিয়াই সুপরিচিত। ইহাতে সাজসজ্জার অধিক আড়ম্বর না থাকিলেও, ইহার গাম্ভীৰ্য্যই ইহাকে সৌন্দৰ্য্য দান করিত। সুনীলদিগ্বিলয় বিন্যস্ত প্রশান্ত প্রচ্ছদ-পটের সম্মুখভাগে দণ্ডায়মান থাকিয়া, এই শ্রেণীর সমুন্নত স্তম্ভগুলি সেকালের গৌরবস্তম্ভ-রূপেই প্রতিভাত হইত। মাহিসন্তোষের ধবংসাবশেষের মধ্যে এই শ্রেণীর একটি স্তম্ভও আবিষ্কৃত হয় নাই। যে সকল স্তম্ভ আবিষ্কৃত হইয়াছে, সেগুলি অট্টালিকার অঙ্গীভূত ছিল। তন্মধ্যে যেগুলি ভিত্তির সঙ্গে সম্পর্ক শূন্য ভাবে ব্যবহৃত হইবার উদ্দেশ্যে নির্মিত হইয়াছিল, সেগুলিও অখণ্ড প্রস্তর খণ্ডে নির্মিত। এই সকল স্তম্ভ নানা স্থান হইতে সংগৃহীত হইয়াছিল বলিয়া, উপাদানে, আয়তনে, শিল্প-রীতিতে পার্থক্য-পূর্ণ। ইহাদের আলোচনায় প্রবৃত্ত হইবার পূৰ্ব্বে, স্তম্ভব্যবহার-রীতির আলোচনা আবশ্যক।

সেকালের দেবালয়ের যে প্রকোষ্ঠে শ্রীমূৰ্ত্তি প্রতিষ্ঠাপিত হইত, তাহার পারিভাষিক নাম ‘গর্ভ। তাহার গঠন-ব্যবস্থা ভিত্তিমূলক ছিল; স্তম্ভ-মূলক ছিল না। তাহার সম্মুখে একটি ‘মুখ-মণ্ডপ’ থাকিত। তাহার পরে একটি মণ্ডপ’ বা ‘মহা-মণ্ডপ’ বা ‘নাট-মন্দির’ও গঠিত হইত। ইহাই পূর্ণাঙ্গ দেবালয়ের গঠন-ব্যবস্থা বলিয়া সুপরিচিত ছিল। ইহার প্রতি লক্ষ্য না করিয়া, কেবল ভিত্তিমূলক ‘গর্ভের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখিয়া, কোনও কোনও লেখক লিখিয়া গিয়াছেন,–আমাদের পুরাতন মন্দির-রচনায় স্তম্ভের ব্যবহার অপরিজ্ঞাত ছিল! বাস্তুশাস্ত্রে মণ্ডপ’ নির্মাণের যেরূপ ব্যবস্থা দেখিতে পাওয়া যায়, তাহাই ইহার পর্যাপ্ত প্রত্যুত্তর। এই কাৰ্য্যে যতগুলি স্তম্ভ ব্যবহৃত হইত, তাহার সংখ্যানুসারেই ‘মণ্ডপগুলি নানা নামে কথিত হইত। মৎস্যপুরাণে ইহার বিবরণ সন্নিবিষ্ট আছে।

মূল মন্দিরের উচ্চতা অপেক্ষা ‘মণ্ডপে’র উচ্চতা অল্প থাকিত বলিয়া, এবং মুখ মণ্ডপে’র উচ্চতা আরও অল্প থাকিত বলিয়া, স্তম্ভগুলির উচ্চতা অধিক হইত না। মাহিসন্তোষের ধবংসাবশেষের মধ্যে যে সকল স্তম্ভ আবিষ্কৃত হইয়াছে, তৎসমস্তই অল্পোচ্চ স্তম্ভ। এই সকল স্তম্ভ যে সকল মন্দির হইতে সমাহৃত হইয়াছিল, তাহাদের মুখমণ্ডপে’র ও মণ্ডপে’র সহিত ইহাদের সম্পর্ক ছিল। উড়িষ্যার প্রচলিত ভাষায় মুখমণ্ডপে’র নাম “জগমোহন”, ‘মণ্ডপে’র নাম “নাটমন্দির”। কেহ কেহ ইহাকে উড়িষ্যার প্রাদেশিক স্থাপত্য-রীতির নিদর্শন বলিয়াই ব্যক্ত করিয়া গিয়াছেন। এই সিদ্ধান্ত যে বিচারসহ নহে, মাহিসন্তোষের পাষাণস্তম্ভই তাহার প্রধান প্রমাণ। উড়িষ্যার ন্যায় বাঙ্গালার পুরাতন মন্দিরেও ‘জগমোহন’ ছিল,–’নাটমন্দির’ ছিল। উড়িষ্যার সকল মন্দিরে এই দুইটি অতিরিক্ত অঙ্গ দেখিতে পাওয়া যায় না;

–হয়ত বাঙ্গালার সকল মন্দিরেও দেখিতে পাওয়া যাইত না। কিন্তু মাহিসন্তোষের মসজেদ নির্মাণকালে যে সকল মন্দির হইতে পাষাণস্তম্ভ সমাহৃত হইয়াছিল, সেগুলি যে পূর্ণাঙ্গ মন্দির ছিল, তাহাতে সংশয় নাই। এরূপ পূর্ণাঙ্গ মন্দির অধিকব্যয়সাধ্য,–অধিক-সমৃদ্ধি-সূচক,–অধিক-শিল্পসুষমাযুক্ত।

যে সকল স্তম্ভ ভিত্তির সহিত সম্পর্কশূন্য, তাহা বাস্তুশাস্ত্রে “মহাস্তম্ভ” নামে উল্লিখিত। “মহাস্তম্ভ” পাঁচ শ্রেণীতে বিভক্ত। মৎস্যপুরাণে (২৫৫ অধ্যায়ে) “পঞ্চ মহাস্তম্ভে”র পরিচয়-সূচক এইরূপ বর্ণনা দেখিতে পাওয়া যায়;

“রুচক শ্চতুরঃ স্যান্ডু অষ্টাস্রো বজ্র উচ্যতে।

দ্বিবর্জঃ ষোড়শাস্ৰস্তু দ্বাত্রিংশাস্রঃ প্ৰলীনকঃ।

মধ্যপ্রদেশে ষঃ স্তম্ভো বৃত্তো বৃত্ত ইতি স্মৃতঃ।”

যে স্তম্ভ চতুষ্কোণ, তাহার নাম “রুচক”;–যে স্তম্ভ অষ্টকোণ সমন্বিত, তাহার নাম ‘বজ্র’;–যে স্তম্ভ ষোড়শ-কোণ-সমন্বিত, তাহার নাম ‘দ্বিবর্জ’;যে স্তম্ভ দ্বাত্রিংশৎকোণ-বিশিষ্ট, তাহার নাম প্ৰলীনক;–এবং যে স্তম্ভ বর্তুল, তাহার নাম ‘বৃত্ত’। ইহাই আৰ্য্যাবৰ্ত্ত-প্রচলিত বাস্তুশাস্ত্রোক্ত “পঞ্চ মহাশুন্তে”র শ্রেণী বিভাগ-সূচক পুরাতন কারিকা। অন্যবিধ সংজ্ঞারও ব্যবহার দেখিতে পাওয়া যায়। তদনুসারে ‘রুচকে’র নাম ‘ব্রহ্মকাণ্ড’;-’বজে’র নাম ‘বিষুঠকাণ্ড’;–’দ্বিবজ্রে’র নাম ‘রুদ্রকাণ্ড’। মাহিসন্তোষের ধবংসাবশেষমধ্যে যে সকল স্তম্ভ আবিষ্কৃত হইয়াছে, তন্মধ্যে কতকগুলি বর্জ-শ্রেণীর ও কতকগুলি দ্বিবর্জ-শ্রেণীর স্তম্ভ।

ভিত্তির অঙ্গীভূতভাবে ব্যবহৃত যে সকল স্তম্ভ আবিষ্কৃত হইয়াছে, তাহাদের আয়তন সৰ্ব্বাপেক্ষা ক্ষুদ্র। সেগুলি ‘সেজদাগা’র উভয় পার্শ্ব রক্ষার জন্য ভিত্তির অঙ্গরূপে, ব্যবহৃত হইয়াছিল। তন্মধ্যে অনেকগুলি কৃষ্ণ বর্ণের কঠিন প্রস্তরে নির্মিত,–তিন অংশে বিভক্ত,–প্রত্যেক অংশ লৌহকীলকযোগে দৃঢ়বদ্ধ। এই স্তম্ভগুলির গাত্রে শৃঙ্খলনিবদ্ধ দোদুল্যমান ঘন্টার কারুকার্য এবং শীর্ষদেশে সর্পফণার সুপরিস্ফুট আভাস দেখিয়া বুঝিয়ে পারা যায়, এগুলি কোনও শৈব মন্দির হইতে সমাহৃত হইয়াছিল। একটি গৌরীপট্ট আবিষ্কৃত হইয়া, এই সিদ্ধান্তের পক্ষ সমর্থন করিয়াছে।

যে স্তম্ভগুলি অপেক্ষাকৃত উচ্চ, তাহা অখণ্ড বালুকা-প্রস্তরে নির্মিত। তন্মধ্যে কেবল দুইটির গাত্রে একই লিপি ক্ষোদিত থাকা দেখিতে পাওয়া গিয়াছে। লিপিযুক্ত স্তম্ভ দুইটি মসজেদ-নির্মাণকালে ভিত্তির অঙ্গীভূতরূপে ব্যবহৃত হইয়া থাকিলেও, ভিত্তির সহিত সম্পর্ক-শূন্য মহাস্তম্ভরূপেই নির্মিত হইয়াছিল, এবং মন্দির-রচনায় সেই ভাবেই ব্যবহৃত হইয়াছিল। ইহাদের নিম্নভাগে–চতুর্থাংশের মধ্যে বাস্তুশাস্ত্র পুরাতন প্রথায় দ্বারপালের মূর্তি উৎকীর্ণ ছিল। সেই মূৰ্তিচিহ্ন যৎসামান্য বিকৃত করিয়া এবং লিপিযুক্ত অংশ ভিত্তিমধ্যে নিবিষ্ট করিয়া, মসজেদ নির্মাতা এই স্তম্ভয়কে মসজেদে লাগাইয়া দিয়াছিলেন। সুতরাং ইহাতে যে মূৰ্ত্তি বা লিপি উৎকীর্ণ ছিল, বাহির হইতে তাহা দেখিতে পাওয়া যাইত না। ইহার কারুকাৰ্যও ইহাকে শৈব-মন্দিরের স্তম্ভ বলিয়া প্রতিভাত করিতেছে। এই স্তম্ভ দুইটী মন্দিরে আরোহণ করিবার সোপান-শ্রেণীর উভয় পার্শ্বে সংস্থাপিত ছিল বলিয়াই বোধ হয়। লোকে মন্দিরসম্মুখবর্তী হইবামাত্র স্তম্ভলিপি দেখিতে পাইত। স্তম্ভলিপি সুস্পষ্ট; অক্ষরের আয়তন সুবৃহৎ। এই লিপি যে দানপতির কীর্তি ঘোষণা করিত, তাঁহার সম্বন্ধে পরিচয় প্রাপ্ত হইবার উপায় নাই। তাঁহার নামমাত্রই উল্লিখিত আছে;–তিনি “শ্রীরাজপুরীয় লেখক” ছিলেন। এই স্তম্ভলিপির অক্ষরত্বে ইহাকে খ্রীষ্টীয় দ্বাদশ শতাব্দীর সমকালবর্তী বলিয়া পরিচয় প্রদান করিতেছে। তকালে লেখক-শব্দ কায়স্থ-বাচক হইয়া পড়িয়াছিল। বরেন্দ্র-মণ্ডলের কায়স্থগণ তৎকালে উচ্চ রাজপদে আরূঢ় হইয়া, সমৃদ্ধিসম্পন্ন হইয়াছিলেন। এই লিপিসংযুক্ত স্তম্ভযুগল সেই সমৃদ্ধির পরিচয় প্রদান করিতেছে।

স্তম্ভের অবস্থান-ক্ষেত্র “পীঠিকা” নামে ও স্তম্ভোপরি সংস্থাপিত শীর্ষভাগ “বোধিকা” নামে কথিত হইত। এই দুইটি পৃথক প্রত্যঙ্গের মধ্যবর্তী অঙ্গটির নামই স্তম্ভ। মাহিসন্তোষের ধবংসাবশেষের মধ্যে অনেকগুলি “পীঠিকা” ও “বোধিকা” আবিষ্কৃত হইয়াছে। ‘বোধিকা’ স্তম্ভশীর্ষের সহিত লৌহকীলকযোগে সম্বন্ধ থাকিত; তাহার চিহ্ন এখনও দেদীপ্যমান রহিয়াছে। ‘পীঠিকা’র মধ্যস্থলে একটি চতুষ্কোণ ছিদ্রের মধ্যে স্তম্ভমূল প্রোথিত থাকিত। এরূপ চতুষ্কোণ-ছিদ্র-সংযুক্ত স্তম্ভ পীঠও আবিষ্কৃত হইয়াছে। মসজেদ যখন ভূপতিত হইয়াছিল, তখন অনেক স্তম্ভকেও ভূপাতিত করিয়াছিল; কোনও কোনও স্তম্ভ সেই আকস্মিক পতনবেগে খণ্ড খণ্ড হইয়া গিয়াছিল। তজ্জন্য মসজেদে ব্যবহৃত সকল স্তম্ভ অক্ষত অবস্থায় দেখিতে পাওয়া যায় নাই।

দ্বার

পাণ্ডুয়ার ভুবন-বিখ্যাত “আদিনা” মসজেদের প্রস্তরনির্মিত প্রবেশদ্বার একটি মন্দির-দ্বার। প্রথম আমলের অনেক মুসলমানী অট্টালিকার মন্দির-দ্বারই প্রবেশদ্বার-রূপে ব্যবহৃত হইয়াছিল। মন্দির-দ্বার যদৃচ্ছাক্রমে নির্মিত হইত না। তাহা বাস্তু-শাস্ত্র-নির্দিষ্ট পরিমাণ-অনুসারেই নির্মিত হইত। দ্বারের বিস্তারের সহিত উচ্চতার অনুপাত সুনির্দিষ্ট ছিল; তাহার সহিত মন্দিরের উচ্চতার অনুপাতও সুনির্দিষ্ট ছিল। মৎস্যপুরাণে (২৫৪ অধ্যায়ে) দ্বারের সাধারণ “মান” সংক্ষেপে কথিত হইয়াছে। যথা :

“গর্ভমানেন মানং তু সৰ্ব্ববাস্তুষু শষ্যতে।”

সকল বাস্তবেই “গর্ভে”র পরিমাণ অনুসারে দ্বারের পরিমাণ স্থিরীকৃত হইত। “বিস্তারার্ফং ভবেদগর্ভঃ” এই সূত্রে জানিতে পারা যায়, বাস্তবক্ষেত্রের যাহা বিস্তার, তাহার অর্ধই ‘গর্ভের পরিমাণ ছিল।

“গর্ভপাদেন বিস্তীর্ণং দ্বারং দ্বিগুণমায়তম।”

এই সূত্রে জানিতে পারা যায়, –”গর্ভে”র চতুর্থাংশের সমান করিয়াই দ্বার বিস্তার স্থির করিয়া লইতে হইত। এই বিস্তারের দ্বিগুণ দ্বারের উচ্চতা বলিয়া নির্দিষ্ট ছিল।

এরূপ অনুপাত-সম্পন্ন দ্বারগুলি মন্দিরের আয়তনের সঙ্গে রচনা-সামঞ্জস্য রক্ষা করিতে পারিত। কিন্তু সেই দ্বারকে মসজেদে ব্যবহার করায়, তাহা মসজেদের রচনা-সামঞ্জস্য রক্ষা করিতে পারিত না। তথাপি প্রথম আমলের মুসলমানী অট্টালিকার এই স্থাপত্য-গত অসামঞ্জস্যই রচনা-রীতিতে পরিণত হইয়া পড়িয়াছিল। অপেক্ষাকৃত উত্তর-কালের নিৰ্ম্মিত মাহিসন্তোষের মসজেদে এই রচনা রীতি অনুসৃত হইবার পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায় না। এখানে একটি মন্দিরদ্বারও মসজেদ-দ্বার-রূপে ব্যবহৃত হয় নাই। যে সকল মন্দির হইতে স্তম্ভাদি সমাগত হইয়াছিল, তাহার দ্বারগুলি কোথায় গেল,–প্রথমে এইরূপ একটি জিজ্ঞাসা মনের মধ্যে স্বতই উদিত হইয়াছিল। পরে খননকাৰ্য্য অগ্রসর হইবার সঙ্গে সঙ্গে দেখিতে পাওয়া গিয়াছে,–দ্বারগুলিও সমাহৃত হইয়াছিল, কিন্তু মসজেদের দ্বার-রূপে ব্যবহৃত হয় নাই। দ্বার-পাষাণকে খণ্ড খণ্ড করিয়া, খণ্ডগুলিকে কাটিয়া ছাঁটিয়া, মসজেদের ভিত্তিমধ্যে গাঁথিয়া ফেলা হইয়াছিল;–কোনও কোনও খণ্ডের বিপরীত পৃষ্ঠ মসৃণীকৃত করিয়া, তাহাতে মুসলমানী কারুকাৰ্যও ক্ষোদিত করা হইয়াছিল। মসজেদ-ভিত্তির যে সকল অংশ ধবসিয়া পড়িয়াছিল, তন্মধ্যে এইরূপে রূপান্তরিত দ্বার-পাষাণের নানা খণ্ড দেখিতে পাওয়া গিয়াছে। অনেক দ্বার পাষাণখণ্ড এখনও মসজেদের ধবংসাবশিষ্ট ভিত্তিমধ্যে গ্রোথিত হইয়া রহিয়াছে। একটি মন্দির-দ্বারও পূর্বাবস্থায় বর্তমান না থাকায়, তাহার রচনা-রীতির পূর্ণ পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায় নাই। তথাপি দ্বার-পাষাণখণ্ডে নানা রচনা-যুগের নিদর্শন দেখিতে পাওয়া গিয়াছে।

দ্বার-শাখা ও উদুম্বর

চারিখানি দারু-সংযোগে দারুময় দ্বার নির্মিত হয় বলিয়া, তাহা “চৌকাঠ” নামে কথিত হইয়া থাকে। প্রস্তরময় দ্বারও এইরূপে চারিখানি প্রস্তরেই নির্মিত হইত। যে দুইখানি প্রস্তুর প্রবেশপথের উভয় পার্শ্বে দণ্ডায়মান থাকিত, তাহার সাধারণ নাম “দ্বার-শাখা” বা “শাখা”;–যে দুইখানি প্রস্তর উর্দ্ধে ও নিম্নে বিন্যস্ত হইত, তাহার সাধারণ নাম “উদুম্বর” বা “উড়ম্বর’। এই চারিখণ্ড প্রস্তরের মধ্যে উদুম্বরদ্বয়ের দৈর্ঘ্য অপেক্ষা শাখাদ্বয়ের দৈর্ঘ্য অধিক হইলেও, সকল খণ্ডের বিস্তার ও বাহুল্য (বেধ) সমান ছিল। শাখার চতুর্থাংশ বিস্তারের, এবং উদুম্বরের চতুর্থাংশ “বাহুল্যে’র পরিমাণ নির্দেশ করিত। সুতরাং দ্বার-পাষাণচতুষ্টয়ের অংশমাত্র প্রাপ্ত হইলেও, তাহার বিস্তারের ও বাহুল্যের সাহায্যে পূর্ণাঙ্গ দ্বারের আয়তনের পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যাইতে পারে। কেবল তাহাই নহে,–দ্বারের উচ্চতার সহিত মন্দিরমধ্যস্থ শ্রীমূৰ্ত্তির আয়তন হইতে মন্দিরের, এবং দ্বারের আয়তন হইতে শ্রীমূৰ্ত্তির শাস্ত্র নির্দিষ্ট আয়তন আবিষ্কৃত হইতে পারে। এই উপায়ে মাহিসন্তোষের মসজেদে ব্যবহৃত দ্বারশাখার ও উদুম্বরের ভগ্নাংশ ধরিয়া, মন্দিরের ও শ্রীমূৰ্ত্তির আয়তনের আভাস প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে।

দ্বারশাখা কখনও কখনও একটিমাত্র শাখা-রূপে নির্মিত হইত। কিন্তু তাহা সচরাচর তিন শাখা হইতে নব-শাখা পৰ্যন্ত ভিন্ন ভিন্ন শাখার সমষ্টিরূপেই নির্মিত হইত। এই সকল শাখার কারুকার্য্য ও বিস্তার মন্দির-দ্বারকে সৌন্দর্য্যের সঙ্গে গাম্ভীর্য দান করিত। ঊর্ধ্বে সংস্থাপিত উদুম্বরের মধ্যস্থলে শ্রীমূৰ্ত্তি ক্ষোদিত করাইবার রীতি প্রচলিত হইয়াছিল। হয়শীষ-পঞ্চরাত্রে বিষ্ণুমন্দির-দ্বারের ঊৰ্দাবস্থিত উদুম্বরের মধ্যস্থলে দিগগজসমূহ কর্তৃক স্থাপ্যমানা লক্ষ্মীর শ্রীমূর্তি ক্ষোদিত করাইবার নির্দেশ দেখিতে পাওয়া যায়। যথা,

“তস্য মধ্যে স্থিতা দেবী সাক্ষাল্লক্ষ্মীঃ সুরেশ্বরী।

কৰ্ত্তব্যা দিগগজৈঃ সা তু স্নাপ্যমানা ঘটেন তু।”

বিষ্ণু-মন্দিরের ন্যায় বৌদ্ধমন্দিরেও উদুম্বরমধ্যে শ্রীমূৰ্ত্তি ক্ষোদিত করাইবার রীতি প্রচলিত হইয়াছিল। মসজেদের ধবংসাবশেষের মধ্যে বুদ্ধমূর্তি সংযুক্ত দুইখানি উদুস্বরের ভগ্নাংশ আবিষ্কৃত হইয়াছে। দুইখানিই বালুকা-প্রস্তরে নির্মিত; একখানিতে ধ্যানমুদ্রায়, অপরখানিতে ভূমিস্পর্শ-মুদ্রায় পদ্মাসনে উপবিষ্ট বুদ্ধমূর্তি ক্ষোদিত রহিয়াছে।

শ্রীমূৰ্ত্তি-প্রস্তর

যাহারা মসজেদ-নির্মাণের জন্য পাষাণ-সংগ্রহে ব্যাপ্ত হইয়াছিল, তাহারা শ্রীমূর্তিগুলিও পরিত্যাগ করে নাই; শ্রীমূর্তি-ফলকের বিপরীত পৃষ্ঠ মসৃণ করিয়া লইয়া, তাহাতে মুসলমানী কারুকার্য ক্ষোদিত করাইয়াছিল। এইরূপে ব্যবহৃত মহিষমর্দিনীর, বিযুঠুর, সূর্যের শ্রীমূৰ্ত্তির নানা অংশ মসজেদ হইতে ধবসিয়া পড়িয়া, তাহার পরিচয় প্রদান করিয়াছে। এই শ্রেণীর প্রস্তরগুলি অধিক মসৃণ বলিয়া, “সেজদাগা”-নির্মাণেই ব্যবহৃত হইয়াছিল; তাহার সম্মুখে দাঁড়াইয়া নমাজ করা হইত। মূর্তিগুলি দেখিতে পাওয়া যাইত না; কিন্তু মূৰ্ত্তিবিরোধিগণকে মূর্তির নিকটেই নতজানু হইতে হইত! দেব মন্দিরের অনায়াস-লব্ধ উপাদানে মসজেদ নির্মাণের ব্যস্ততা তৎকালে এরূপ অসঙ্গত ব্যবহারের প্রতি দৃষ্টিআকর্ষণ করিতে পারে নাই;–শিল্প-প্রয়োজনের নিকট মুসলমান ধৰ্ম্মের চিরবাঞ্ছিত সুদৃঢ় সংস্কার প্রকারান্তরে লাঞ্ছিত হইতে বাধ্য হইয়াছিল। শ্রীমূৰ্ত্তির ন্যায় তাহার আসন প্রস্তরও মসজেদ-নির্মাণে ব্যবহৃত হইয়াছিল। দুই একখানি বৃহদায়তনের আসন-প্রস্তুর বাহির হইয়া পড়িয়াছে। শ্রীমূৰ্ত্তির আয়তনের সঙ্গে আসন-প্রস্তরের আয়তনের অনুপাত নির্দিষ্ট ছিল। সেই অনুপাতের সাহায্যে বুঝিতে পারা যায়,–কোনও কোনও শ্রীমূৰ্ত্তি বিলক্ষণ বৃহদায়তন ছিল,–তাহা মসজেদ নির্মাণকালে নানা খণ্ডে বিভক্ত হইয়াছিল। মসজেদের ধবংসাবশিষ্ট ভিত্তিমধ্যে হয়ত এই সকল শ্ৰীমূৰ্ত্তির ভগ্নাংশ এখনও নিহিত হইয়া রহিয়াছে। মূর্তি-প্রস্তরকে মসজেদ-নির্মাণের উপযোগী করিবার জন্য নানা কৌশলের অবতারণা করিতে হইয়াছিল,–একখানি শ্ৰীমূৰ্ত্তির ধবংসাবশেষে তাহার পরিচয় সুব্যক্ত হইয়া রহিয়াছে।

শিখর-প্রস্তর

ইষ্টক-নির্মিত দেবমন্দিরেও পাষাণনির্মিত দ্বার বা স্তম্ভ ব্যবহৃত হইতে পারে। সুতরাং মাহিসন্তোষের ধবংসাবশেষমধ্যে আবিষ্কৃত পাষাণ-স্তম্ভ ও পাষাণ-দ্বার দেখিয়া, মন্দিরগুলি আদ্যন্ত পাষাণে গঠিত হইয়াছিল কি না, তাহার নিঃসন্দিগ্ধ পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায় না। কিন্তু যে বহুসংখ্যক ভিত্তিপ্রস্তর ও শিখর-প্রস্তর আবিষ্কৃত হইয়াছে, তাহাতে সকল সংশয় নিরস্ত হইয়া যায়। কারণ, প্রস্তরনির্মিত ভিত্তি ও শিখর কেবল প্রস্তরনির্মিত দেবালয়েই দেখিতে পাওয়া যায়। উড়িষ্যার বরেন্দ্রভূমিতেও যে প্রস্তরনির্মিত দেবালয় বর্তমান ছিল, মাহিসন্তোষের ধবংসাবশেষ এইরূপে তাহার পরিচয় প্রদান করিয়া, একটি বহুমূল্য ঐতিহাসিক তথ্যের সন্ধান প্রদান করিয়াছে।

দেবমন্দিরের ভিত্তির উপরিভাগে অবস্থিত অঙ্গের নাম–শিখর, বা বিমান। শিখরের উচ্চতা ভিত্তির উচ্চতার দ্বিগুণ বলিয়া বাস্তুশাস্ত্রে উল্লিখিত আছে। সুতরাং শিখর বা বিমান বহুসংখ্যক প্রস্তরখণ্ডে গঠিত হইত। তাহার ভিন্ন ভিন্ন প্রত্যঙ্গ ভিন্ন ভিন্ন নামে কথিত হইত। শিখর-রচনারীতির পার্থক্যে মন্দিরগুলি নানা শ্রেণীতে বিভক্ত হইত। যথা :

মেরু-মন্দর-কৈলাস-বিমানচ্ছন্দ-নন্দনাঃ।

সমুদগ-পদ্ম-গরুড়-নন্দিবর্ধন-কুঞ্জরাঃ।

গুহরাজে বৃষো হংসঃ সৰ্ব্বতোভদ্ৰকো ঘটঃ।

সিংহো বৃত্ত শ্চতুষ্কোণঃ ষোড়শাষ্টাশয়ঃ স্তথা।

ইত্যেতে বিংশতিঃ প্রোক্তাঃ প্রাসাদাঃ সংজ্ঞয়া ময়া।

যথোক্তানুক্রমেণৈব লক্ষণাবি বদাম্যতঃ।

বরাহমিহির এইরূপে মেরু-মন্দর-কৈলাসাদি বিংশতি বিভিন্ন শ্রেণীর মন্দিরের নাম লিপিবদ্ধ করিয়া, তাহাদের লক্ষণাদিরও উল্লেখ করিয়া গিয়াছেন। তাহাতে দেখিতে পাওয়া যায়, মেরু শ্রেণীর মন্দির ষটকোণবিশিষ্ট, চতুর্ঘার সমন্বিত, বিচিত্র-কুহর-যুক্ত দ্বাদশভূমি-সম্পন্ন হইত। যথা :

“তত্র ষড়স্রি-মেরু দ্বাদশভৌমো বিচিত্রকুহরশ্চ।

দ্বারৈ যুত শ্চতুর্ভি দ্বাত্রিংশদ্ধস্তবিস্তীর্ণঃ।”

টীকাকার “বিচিত্র” শব্দের “নানা প্রকার” অর্থ ধরিয়া, ব্যাখ্যা লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন। “কুহর” শব্দের অর্থ–বাতায়ন। মন্দির-শিখর ভিন্ন ভিন্ন “রথকে” বিভক্ত হইত; প্রত্যেক “রথক” অনেকগুলি ‘ভূমি’তে বিভক্ত হইত। এই সকল পারিভাষিক শব্দ এখন অপরিচিত হইয়া পড়িয়াছে। ইহার পরিচয়-প্রকাশের জন্য বিশ্বকর্মা কর্তৃক নির্দিষ্ট স্থাপত্য-ব্যবস্থার উল্লেখ করিয়া, কাশ্যপ একটি কবিতা রচনা করিয়াছিলেন। ভট্টোৎপল তাহা উদ্ধৃত করিয়া গিয়াছেন। যথা :

“ভূমিকা স্তত্ৰ কৰ্ত্তব্যা বিচিত্র-কুহরান্বিতাঃ।

দ্বাদশোপচ্যুপরিগা বক্তৃলাস্তৈঃ সমাযুতাঃ।”

ইহাতে বুঝিতে পারা যায়,–”কুহর’গুলির সহিত ভূমিকার সম্পর্ক ছিল; এবং “দ্বাদশ ভূমি” উপর্যুপরি বিন্যস্ত, দ্বাদশ স্তরে বিভক্ত, বর্তুলাবাসযুক্ত অণ্ডাকার প্রস্তরে নির্মিত হইত। মন্দর-শ্রেণীর মন্দিরে দশটি ভূমি, কৈলাস ও বিমান-শ্রেণীর মন্দিরে আটটি ভূমি, নন্দন-শ্রেণীর মন্দিরে ছয়টি ভূমি থাকিত। ভূমি-বিভাগ-সূচক বর্ভুলাভাসযুক্ত অনেকগুলি পাষাণখণ্ড মাহিসম্ভোষের মসজেদের ধবংসাবশেষমধ্যে আবিষ্কৃত হইয়াছে। শিখরের নানা অংশে নানা কারুকাৰ্য্যসমন্বিত প্রস্তরখণ্ড সন্নিবিষ্ট হইত। এই শ্রেণীরও অনেক পাষাণখণ্ড আবিষ্কৃত হইয়াছে। শিখরের নানা স্থানের অলঙ্করণ-কার্যে “কীৰ্ত্তিমুখ” ব্যবহৃত হইত। এইরূপ “কীৰ্ত্তিমুখে”র নানা ভগ্নাংশও আবিষ্কৃত হইয়াছে। সকল শিখর প্রস্তরগুলি প্রাপ্ত হইলে, এবং তাহা অপরিবর্তিত আকারে প্রাপ্ত হইলে, তাহার সাহায্যে শিখর-রচনা করিয়া, সেকালের বরেন্দ্রভূমির মন্দির শিখরের আদর্শ দেখাইয়া দিবার সুযোগ ঘটিতে পারিত। কিন্তু শিখর প্রস্তরগুলি মসজেদের ভিত্তিমধ্যে নিবদ্ধ হইবার সময়ে রূপান্তরিত হইয়াছিল; নানা স্থানে নানা ভাবে বিন্যস্ত হইয়াছিল; এবং এখনও এই শ্রেণীর অনেক পাষাণখণ্ড ধবংসাবশিষ্ট ভিত্তিমধ্যে প্রোথিত রহিয়াছে। তজ্জন্য সকল পাষাণখণ্ড যথাযোগ্যভাবে পরীক্ষিত হইতে পারে নাই। শিখরশীর্ষে যে “আমলক-শিলা” সুবিন্যস্ত হইয়া, মন্দিরের শোভাবর্ধন করিত, তাহাও নানা খণ্ডে বিভক্ত হইয়া, মসজেদের ভিত্তিগঠনে ব্যবহৃত হইয়াছিল। সুতরাং সমস্ত পাষাণখণ্ড সংগৃহীত হইতে পারিলেও, তাহাদের সাহায্যে পূর্ণাঙ্গ শিখর রচিত হইতে পারিত না। তথাপি এই সকল পাষাণখণ্ড বাস্তুশাস্ত্রসম্মত পুরাতন স্থাপত্যরীতির পরিচয় প্রদান করিয়া, একটি প্রণিধানযোগ্য ঐতিহাসিক তথ্য উদঘাটিত করিয়া দিয়াছে।

মন্দির-রহস্য

সেকালের দেবমন্দিরের গর্ভ-মধ্যস্থ ভিত্তিগাত্রে কারুকার্য্যের আতিশয্য দেখিতে পাওয়া যাইত না; অধিকাংশ গর্ভমধ্যে মসৃণ ভিত্তিমাত্রই নির্মিত হইত;–কেবল দুই চারিটি অতিব্যয়সাধ্য দেবমন্দিরের গর্ভভিত্তিগাত্রে কিছু কিছু কারুকার্য্য সংযুক্ত হইত। কিন্তু অধিকাংশ দেবালয়ের বহির্ভাগের আদ্যন্ত এরূপ কারুকার্য্য খচিত হইত যে, তাহা একালের কোনও কোনও পাশ্চাতঃ শিল্প-সমালোচকের বিচারে প্রয়োজনাতীত ব্যয়বাহুলের নিদর্শন বলিয়াই নিন্দিত হইয়াছে। মন্দিরগুলি এরূপ রীতিতে নির্মিত হইত কেন, তাহা এইরূপে বাদানুবাদের সৃষ্টি করিয়া দিয়াছে!

মন্দিরমধ্যস্থ শ্রীমূৰ্ত্তির সম্মুখীন হইবার পূৰ্ব্বে, মন্দির-প্রদক্ষিণের ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। তাহা এখনও একেবারে পরিত্যক্ত হয় নাই। প্রদক্ষিণ-কালে বহির্ভাগের বিচিত্র কারুকার্যে উপাসকের আগ্রহপূর্ণ সরল চিত্ত অলৌকিক ভক্তি-মাহাত্মে পরিপূর্ণ করিয়া, তাহাকে দেবদর্শনের অধিকারী করিয়া তুলিত; ভক্ত উপাসকের দৃষ্টিতে দেব-মন্দির দেবতারূপেই প্রতিভাত হইত। যে কারণেই হউক, দেবমন্দিরকে “দেবমূৰ্ত্তিভূত” বলিয়া দর্শন করিবার জন্য এখনও উপদেশ প্রদত্ত হইয়া থাকে। হয়শীর্ষ-পঞ্চরাত্রের এইরূপ উপদেশটি উল্লেখযোগ্য। যথা :

“শুকনাসা স্মৃতা নাসা বাহু ভদ্রকরৌ স্মৃতৌ।

শিরস্তম্ভং নিগদিতং কলসং মূদ্ধজং স্মৃতম।

কণ্ঠং কণ্ঠমিতি জ্ঞেয়ং স্কন্ধং বেদী নিগদ্যতে।

পায়ূপন্থে প্রণালে তু ত্বক সুধা পরিকীর্তিতা।

মুখং দ্বারং ভবেদস্য প্রতিমা জীব উচ্যতে।

তচ্ছক্তিং পিণ্ডিকাং বিদ্ধি প্রকৃতিঞ্চ তদাকৃতিম।

নিশ্চলত্বং তু গর্ভোবস্য অধিষ্ঠাতাস্য কেশবঃ।

এব মেষ হরিঃ সাক্ষ্যাৎ প্রাসাদত্বেন সংস্থিতঃ।”

শ্রীহরিই প্রাসাদ-রূপে বৰ্ত্তমান। প্রাসাদ-শিখরের “শুকনাসা” নামক প্রত্যঙ্গ তাঁহার নাসা,–’’ভদ্রকর” নামক প্রত্যঙ্গ তাঁহার বাহুযুগল,–’’অন্ত’ নামক প্রত্যঙ্গ তাঁহার মস্তক,–প্রাসাদশীর্ষাবস্থিত “কলস” তাঁহার কেশপাশ,–”কণ্ঠ” নামক প্রত্যঙ্গ তাঁহার কণ্ঠ,–”বেদী” তাঁহার স্কন্ধদেশ,–”প্রণাল” দ্বয় তাঁহার পায়ুপন্থ –”সুধা” (চূণ) তাঁহার ত্বক,–”দ্বার” তাঁহার মুখ,–গর্ভমধ্যস্থ “প্রতিমা” তাঁহার জীব,–প্রতিমার “পিণ্ডিকা” জীব-শক্তি, পিণ্ডিকার “আকৃতি” তাহার প্রকৃতি, –”গর্ভ” এই দেবায়তনরূপী দেবমূৰ্ত্তির নিশ্চলত্ব বিজ্ঞাপক,–ইহার “অধিষ্ঠাতা” স্বংয় কেশব। এইরূপে শ্রীহরিই স্বয়ং মন্দিররূপে বিরাজ করিয়া থাকেন।

বৈষ্ণব-তন্ত্রোক্ত এই বর্ণনা কবিজনসুলভ কল্পনামাত্র বলিয়া উপেক্ষিত হইতে পারে না। শাক্ত তন্ত্রেও দেব-মন্দির “দেবমূৰ্ত্তিভূত” বলিয়া সমাদৃত। দ্বার পুজাপদ্ধতিতে তাহার বিশদ পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়। তাহাতে দেবমন্দির দ্বারের অঙ্গ প্রত্যঙ্গের ও তন্নিহিত বিবিধ দ্বার-দেবতার পূজা করিবার ব্যবস্থা বিধিবদ্ধ আছে। ইহার মধ্যে কোনরূপ ঐতিহাসিক তথ্য নিহিত রহিয়াছে কি না, এখনও তাহার আলোচনার সূত্রপাত হয় নাই। চিরপুরাতন চৈত্য-পূজার সঙ্গে মূৰ্ত্তি-পূজা মিলিত হইয়া, এইরূপ ব্যবস্থা প্রচলিত করিয়াছে কি না, কেহ তাহার তথ্যানুসন্ধানের আয়োজন করিলে, মন্দির-রচনারীতির মূল রহস্য উদঘাটিত হইতে পারে।

এই সকল বর্ণনায় ও ব্যবস্থায় দেবমন্দিরের যে সকল অঙ্গ প্রত্যঙ্গের পারিভাষিক নাম জানিতে পারা যায়, সেই পারিভাষিক নামে সুপরিচিত অনেকগুলি পাষাণখণ্ড মাহিসন্তোষের ধ্বংসাবশেষখননে বাহির হইয়া পড়িয়াছে। কতকগুলি বিচ্ছিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বা তাহাদের অংশমাত্র দেখিয়া, জীব-দেহের রচনা-সৌন্দর্য্যের সম্পূর্ণ পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায় না। এই সকল পাষাণখণ্ড দেখিয়াও সেইরূপ ধবংসাবশিষ্ট দেবমন্দিরের রচনা-সৌন্দর্য্যের সম্পূর্ণ পরিচয় লাভ করা অসম্ভব। তথাপি খনন-কাৰ্য্য ইতিহাসের “জীর্ণোদ্ধার” নামে কথিত হইবার যোগ্য। শাস্ত্রে “জীর্ণোদ্ধারে’র দ্বিগুণ ফল উল্লিখিত আছে।

“পণ্ডিতং পতমানং তু তথাৰ্দ্ধ স্ফুটিতং নরঃ।

সমুক্বত্য হরের্ধাম দ্বিগুণং ফল মাপুয়াৎ।”

ইতিহাসে মাহিসন্তোষের স্থান-নাম রহস্য

ধবংসাবশেষমধ্যস্থ দরগাটি ‘মাহিসন্তোষের দরগা” নামেই সুপরিচিত। প্রকৃত নাম–”মাই-সন্তোষীর দরগা”;–জমিদারি কাগজে সেই নামই প্রচলিত আছে। প্রবাদ এই যে, এখানে এক মাতা (মাই) ও তাঁহাদের কন্যা (সন্তোষী) সমাধি নিহিত রহিয়াছেন; তাঁহারা মুসলমান-ধর্মাবলম্বিনী ছিলেন; সাধনায় সিদ্ধি লাভ করিয়া “পীর” হইয়াছিলেন।

বরেন্দ্রভূমির আরও দুই একটি স্থানে “মাই-সন্তোষী”র দরগা দেখিতে পাওয়া যায়। তজ্জন্য ইহা একটি সাম্প্রদায়িক নাম বলিয়া প্রতিভাত হয়। এই সম্প্রদায়ের সহিত মাতা-কন্যার পীরত্ব-লাভের সম্পর্ক থাকিতে পারে; কিন্তু তাঁহারা কোথায় সমাধি-নিহিত রহিয়াছেন, তাহা নিঃসন্দেহে নির্ণয় করা কঠিন। অন্যান্য স্থানের দরগা অপেক্ষা এই স্থানের দরগাটি অধিক প্রসিদ্ধি লাভ করায়, ইহাই সমাধি-স্থান বলিয়া পরিচিত হইয়াছে। কিন্তু এখানকার দুর্গ ও অন্যান্য কীর্তিচিহ্ন এই স্থানকে পীরের স্থান অপেক্ষা রাজনগরের স্থান বলিয়াই অধিক পরিচয় প্রদান করে। শতবর্ষপূর্বে তথ্যানুসন্ধানের অধিক সুযোগ বর্তমান ছিল। তৎকালে বুকানন হামিলটন মুসলমান পীরের সংস্কৃত নাম শ্রবণ করিয়া, বিস্ময় প্রকাশ করিয়াছেন; তথ্যানুসন্ধানের জন্য এখানে পদার্পণ করিতে পারেন নাই। তখন এ অঞ্চল বনানী অঞ্চলে অবগুণ্ঠিত ছিল।

দরগার নাম যাহাই হউক, মাহিসন্তোষ-নামে কোনও গ্রাম বা মৌজা দেখিতে পাওয়া যায় না। দরগাটি যে মৌজার অন্তর্গত, তাহা সন্তোষ-পরগণার চৌঘাট মৌজা; কিন্তু দরগা ও তাহার প্রাঙ্গন “কাঞ্চন-নগর” বলিয়া কথিত হইয়া থাকে। নিকটে কি দূরে কোনও মৌজা “কাঞ্চন-নগর” নামে কথিত হয় না। মাই-সন্তোষীর প্রবাদ হইতেই দরগার বর্তমান নাম প্রচলিত হইয়াছে বলিয়া বোধ হয়। স্থান জনসাধারণের নিকট “মাহিগঞ্জ” বলিয়াই সাধারণতঃ পরিচিত। কিন্তু জমিদারি কাগজে এই নাম দেখিতে পাওয়া যায় না।

পূর্বে আত্রেয়ী-তীরে “মাহিগঞ্জ” নামে একটি প্রসিদ্ধ বন্দর বর্তমান ছিল। তাহা অনেক দিন উঠিয়া গিয়াছে। তাহার স্থান এখন কৃষিক্ষেত্রে ও বিজনবনে পরিণত হইয়াছে; কিন্তু লোকে এখনও তাহার স্থান দেখাইয়া দিয়া থাকে। পাঁচ ছয় বৎসর হইতে দরগার প্রাঙ্গণে প্রতি সোমবারে একটি হাট বসিতেছে; তাহা “মাহিগঞ্জের হাট” বলিয়া কথিত হইতেছে। দরগাটি মাতা-কন্যার যুক্ত নামে পরিচিত; কিন্তু গল্পের সঙ্গে কন্যার নাম সংযুক্ত হয় নাই কেন, তাহা অপরিজ্ঞাত।

অধ্যাপক ব্লকম্যান লিখিয়া গিয়াছেন,–খ্রিস্টিয় পঞ্চদশ-ষোড়শ শতাব্দীর পূর্বে স্থানের নামের সঙ্গে পারসিক ভাষায় গঞ্জ-শব্দের সংযোগ দেখিতে পাওয়া যাইত না। সুতরাং ‘মাহিগঞ্জ” নামটি অপেক্ষাকৃত আধুনিক। কিন্তু সন্তোষ নামটিকে সেরূপ আধুনিক বলিবার উপায় নাই। মুসলমান-শাসন প্রচলিত হইবার পূর্বেও সন্তোষ নাম প্রচলিত ছিল। মুসলমান লিখিত প্রাচীনতম ইতিহাসে তবকাৎ-ই নাসিরী গ্রন্থে] তাহা উল্লিখিত আছে। তাহার সহিত মুসলমান-শাসনের প্রথম আমলে ইতিহাসের কথা জড়িত হইয়া রহিয়াছে।

মুসলমান-বিজয়

প্রচলিত ইতিহাসে বখতিয়ার খিলজির বঙ্গ-বিজয় যে ভাবে উল্লিখিত হইয়া আসিতেছে, তাহা কেবল আরব্যোপন্যাসের ন্যায় বিস্ময়াবহ নহে; অপিচ, অপরিহার্য কুজঝটিকাময়। তাহার কোনরূপ সমসাময়িক বিবরণ প্রাপ্ত হওয়া যায় না। প্রায় অর্ধ শতাব্দী পরবর্তীকালে মিনহাজ-ই-সিরাজ লোকমুখে গাল-গল্প শ্রবণ করিয়া [তবকাৎ-ই-নাসিরী গ্রন্থে] যে কাহিনী লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন, তাহাই সমসাময়িক কাহিনীর ন্যায় ব্যবহৃত হইতেছে। তাহাতে খিলিজী-বীর মহম্মদ-ই বখতিয়ার অর্থাৎ বখতিয়ারের পুত্র মহম্মদ বঙ্গ-বিজেতা বলিয়া উল্লিখিত। কিন্তু তিনি কোন পথে বাঙ্গালা দেশে উপনীত হইয়াছিলেন,–বাঙ্গালাদেশের কোন অংশে কত দূর পর্যন্ত অধিকার বিস্তৃত করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন,–অধিকৃত অংশের শাসন-প্রণালীই বা কিরূপ ছিল,–এ সকল বিষয়ের সম্যক পরিচয় প্রাপ্ত হইবার উপায় নাই।

আধুনিক তথ্যানুসন্ধান যত দূর অগ্রসর হইতে পারিয়াছে, তাহাতে বুঝিতে পারা যায়, মহম্মদ-ই-বখতিয়ার খিলিজীর বিজয়-ব্যাপার বাঙ্গালা দেশের একটি ক্ষুদ্র অংশেই সীমাবদ্ধ থাকিতে বাধ্য হইয়াছিল। তাহাকে “বঙ্গ-বিজয়” নামে অভিহিত করিলে, অত্যুক্তি হইয়া পড়ে। তখন কেন, তাহার পরেও অনেক দিন পর্যন্ত বাঙ্গালা দেশের অনেক স্থান স্বাধীনতা রক্ষা করিয়া, মুসলমান-শাসন-বিস্তারের গতিরোধ করিয়া রাখিয়াছিল। যে অংশে মুসলমান-অধিকার বিস্তৃতি লাভ করিয়াছিল, তাহাও আধুনিক হিসাবের অধিকৃত রাজ্য বলিয়া কথিত হইতে পারিত না;–তাহা আত্মীয়প্রতিপালনদক্ষ বলদৃপ্ত ভাগ্যান্বেষণকারীর অভিযানবিধবস্ত ধবংসাবশেষ বলিয়াই উল্লিখিত হইবার যোগ্য। মহম্মদ-ই-বখতিয়ার তাঁহার শাসন শৃঙ্খলা সুসংস্থাপিত করিবার পূর্বেই, তিববত-বিজয়ে ধাবমান হইয়াছিলেন। সে অভিযান-কাহিনী করুণ কাহিনী। তাহা ভগ্নহৃদয় ব্যর্থমনোরথ পলায়নপরায়ণ বীরবিক্রমের অচিন্তিতপূর্ব অকীর্তিকর পরিণাম। যিনি লোদিয়া বিধবস্ত করিয়াছিলেন,–লক্ষ্মণাবতী ধূলিসাৎ করিয়াছিলেন,–দেবীকোটে সেনানিবাস সংস্থাপিত করিয়াছিলেন, এবং তথা হইতে তিববত-বিজয়ের জন্য রণযাত্রা করিয়াছিলেন, তিনি দেবীকোটে প্রত্যাবর্তনের পরেই স্বজনহস্তে নিহত হইয়া, ইহলোক পরিত্যাগ করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। ইহাই তাঁহার তরুণ রাজ্য-লালসার করুণ কাহিনী। এই কাহিনীর সহিত কেবল উত্তরবঙ্গের কিয়দংশের সম্বন্ধেরই পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া যায়। সে পরিচয় যেরূপ সংক্ষিপ্ত, সেইরূপ অল্পকালস্থায়ী। তাহার গৌরবঘোষণার জন্য [তবকাৎ-ই-নাসিরী গ্রন্থে] নানা কথা উল্লিখিত থাকিলেও, তাহা সমসাময়িক অবস্থার সহিত সামঞ্জস্য রক্ষা করিতে অসমর্থ।

খিলিজীগণের গৃহকলহ

মহম্মদ-ই-বখতিয়ারের শোচনীয় পরিণাম খিলিজীগণের গৃহকলহের পরিণাম বলিয়াই উল্লিখিত হইবার যোগ্য। প্রথম ভাগ্যবিপর্যয়ের সঙ্গে সঙ্গেই তাহা প্রকাশিত হইয়া পড়িয়াছিল। অধিকৃত রাজ্য খিলিজী সহযোগিগণের মধ্যে জায়গীর রূপে বন্টন করিয়া দিয়া, মহম্মদ-ই-বখতিয়ার তাঁহাদের নায়করূপে দেবীকোটের সেনানিবাসে বাসস্থান সংস্থাপিত করিয়াছিলেন। এই স্থানটি দিনাজপুর জেলার গঙ্গারামপুর থানার অন্তর্গত,–পুরাতন বাণনগরের একাংশে অবস্থিত। ইহার নিকটবর্তী স্থানগুলি প্রধান প্রধান অনুচরগণের জায়গীর-রূপে নির্দিষ্ট হইয়াছিল। সকল জায়গীরের নাম ইতিহাসে স্থানলাভ করে নাই। যেগুলির নাম জানিতে পারা যায়, তন্মধ্যে একটির নাম ‘কাঙ্গার’। তাহা হাসামুদ্দীন খিলিজীর জায়গীর-রূপে নির্দিষ্ট হইয়াছিল।

রাজসাহী জেলার মান্দা থানার অন্তর্গত গাঙ্গোর নামক স্থান বহু পুরাতন কীর্তিচিহ্নে খচিত হইয়া রহিয়াছে। এই অঞ্চল হইতে অনেক হিন্দুবৌদ্ধ মূর্তি সংগৃহীত হইয়াছে; একখানি সংস্কৃত শিলালিপিও আবিষ্কৃত হইয়াছে। অধ্যাপক ব্লকম্যান অনেকগুলি হস্তলিখিত তবকাৎ-ই-নাসিরী গ্রন্থ পরীক্ষা করিয়া, কোনও কোনও গ্রন্থে হাসামুদ্দীনের জায়গীর গাঙ্গোর নামে উল্লিখিত,–দেখিতে পাইয়াছিলেন। দেবীকোটের দক্ষিণ-পূর্বাংশে অবস্থিত মসিদা ও সন্তোষ নামক আরও দুইটি স্থানের নাম উল্লিখিত আছে। মসিদা ও সন্তোষ নামক দুইটি পরগণা এখনও প্রচলিত আছে। সন্তোষের নাম মন্তোষ-রূপে মুদ্রিত হইয়াছে। অধ্যাপক ব্লকম্যান তাহাকে লিপিকরপ্রমাদের নিদর্শন বলিয়া ব্যক্ত করিয়া গিয়াছেন। খিলিজীগণের গৃহকলহের সঙ্গে গাঙ্গোর-মসিদা-সন্তোষ-দেবীকোট, এই চারিটি স্থানের নাম জড়িত হইয়া রহিয়াছে। ইহাই তৎকালে মুসলমানাধিকৃত বাঙ্গালাদেশের প্রধান স্থান বলিয়া পরিচিত হইয়াছিল; কিন্তু ইহার কোনও স্থানেই শাসনশৃঙ্খলা দৃঢ়ভাবে সংস্থাপিত হইবার অবসর পাইয়াছিল বলিয়া বোধ হয় না।

মহম্মদ-ই-বখতিয়ারের নিধনকর্তা আলিমর্দন খিলিজী দেবীকোট অধিকার করিয়া প্রাধান্যলাভের চেষ্টা করিতে গিয়া, সহসা কৃতকার্য হইতে পারেন নাই। তৎকালে মহম্মদ-ই-বখতিয়ারের বিশ্বস্ত পার্শ্বচর মহম্মদ-ই-সেরান উড়িষ্যার পথে যুদ্ধযাত্রায় বহির্গত হইয়াছিলেন বলিয়া, আলিমর্দনের পক্ষে দেবীকোট অধিকার করা সম্ভব হইয়াছিল। কিন্তু মহম্মদ-ই-সেরান গৃহকলহের সমাচার পাইবামাত্র দেবীকোটে উপনীত হইয়া, তাহার শাসনভার গ্রহণ করিয়াছিলেন;–তাঁহার আদেশে আলিমর্দন গাঙ্গোর দুর্গে কারারুদ্ধ হইয়াছিলেন। তিনি তথা হইতে পলায়ন করিয়া, দিল্লীশ্বরের শরণাগত হইয়া, তাঁহার অধীনতা-স্বীকারের অঙ্গীকারে, তাঁহার সেনা সাহায্যে দেবীকোট আক্রমণ করায়, যুদ্ধ বিগ্রহের সূত্রপাত হইয়াছিল। এই যুদ্ধবিগ্রহের আক্রমণ–আত্মরক্ষার নানা চেষ্টা অবশেষে আলিমর্দনকেই বিজয়দান করিয়াছিল। মুসলমান-লিখিত ইতিহাসে দেখিতে পাওয়া যায়, মহম্মদ-ই-সেরান নিহত হইয়া, সন্তোষ নামক স্থানে সমাধিনিহিত হইয়াছিলেন।

মাহিসন্তোষের দরগা সন্তোষ পরগনার অন্তর্গত। এই সমাচার পাইয়া, অধ্যাপক ব্লকম্যান লিখিয়া গিয়াছেন,–এই স্থান সেই সন্তোষ-নামক স্থান হইলে, এখানকার ধবংসাবশেষের মধ্যেই মহম্মদ-ই-সেরানের সমাধিস্থানের অনুসন্ধান করিতে হইবে। মাহিসন্তোষের ধবংসাবশেষের মধ্যে মহম্মদ-ই-সেরানের সমাধি বর্তমান থাকুক আর নাই থাকুক, এই স্থানের সঙ্গে মুসলমান-শাসনের প্রথম আমলের ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য সম্পর্ক সংস্থাপিত হইয়াছিল।

মুসলমান-শাসক

বাঙ্গালা দেশে মুসলমান-শাসনের আবির্ভাব বাঙ্গালীর পক্ষে অবশ্য-জ্ঞাতব্য ঐতিহাসিক ব্যাপার। তাহার সকল কথা এখনও যথোপযুক্তরূপে আলোচিত হইতে পারে নাই। কিছুদিন পূর্বে মুদ্রার ও শিলালিপির সাহায্যে তথ্যনির্ণয়ের জন্য যেরূপ প্রবল আগ্রহ প্রকাশিত হইয়াছিল, তাহা ক্রমে ক্রমে মন্দীভূত হইয়া পড়িয়াছে। তাহার পরে যে সকল শিলালিপি আবিষ্কৃত হইয়াছে, তাহা মুদ্রিত বা আলোচিত হইতেছে না।

বাঙ্গালা দেশের যে অংশে মুসলমান-শাসন প্রথমে প্রতিষ্ঠালাভ করিয়াছিল, তাহা অনেক দিন পর্যন্ত “লক্ষ্মণাবতী-দেবীকোট” নামে পরিচিত ছিল। তাহার সঙ্গে উত্তরবঙ্গের কিয়দংশের সাক্ষাৎসম্বন্ধ থাকিলেও, সমগ্র বাঙ্গালাদেশের সম্বন্ধ বর্তমান ছিল না। “লক্ষ্মণাবতী দেবীকোট” যে রাজ্যের পরিচয় প্রদান করিত, সে রাজ্য কাহার, তাহা লইয়া প্রথম হইতেই দিল্লীর সহিত তর্কবিতর্কের সূত্রপাত হইয়াছিল। এবং তাহা দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধকলহে পর্যবসিত হইয়াছিল। তদুপলক্ষে মুসলমান মুসলমানের কণ্ঠলগ্ন না হইয়া, পরস্পরের কণ্ঠচ্ছেদ করিয়াছিল। ধর্মে এক হইয়াও, বাঙ্গালার মুসলমান দিল্লীর মুসলমানের অধীনতা স্বীকার করিতে অসম্মত হইয়াছিল কেন, তাহার কারণ পরম্পরা প্রচলিত ইতিহাসে উল্লিখিত হয় নাই। তাহার আলোচনায় প্রবৃত্ত হইলে, স্বভাবতই মনে হয়,-ধর্ম অপেক্ষা স্বার্থ বড় হইয়া উঠিয়াছিল;–আত্মবোধ অপেক্ষা দেশাত্মবোধ অধিক প্রাধান্যলাভ করিয়াছিল;–বাঙ্গালার মুসলমান বাঙ্গালী হইয়া, বাঙ্গালীর স্বাতন্ত্র্যরক্ষার জন্য প্রাণপণ করিয়াছিল;–বাঙ্গালী মুসলমানের সঙ্গে বাঙ্গালী হিন্দুও যোগদান করিয়া, দিল্লীর আক্রমণ প্রতিহত করিবার জন্য প্রাণবিসর্জন করিয়াছিল। তাহাদের আত্মরক্ষার চেষ্টা প্রথমে বিফল হইয়া গিয়াছিল; দিল্লীশ্বরের প্রতিনিধি গৌড়ের সিংহাসনে প্রতিষ্ঠাপিত হইয়াছিল। কিন্তু তাহাতে স্বাতন্ত্র-লালসা বিলুপ্ত না হইয়া উত্তরোত্তর প্রবল হইয়া উঠিয়াছিল।

হাজি ইলিয়াস বাঙ্গালার প্রথম স্বাধীন সুলতান বলিয়া ইতিহাসে উল্লিখিত। তাঁহার পুত্র সেকেন্দার আদিনা মসজেদ রচনা করিতে গিয়া আপন নাম চিরস্মরণীয় করিয়া গিয়াছেন। তাঁহার পুত্র দ্বিতীয় ঘিয়াসুদ্দীনের স্মৃতিচিহ্ন সোনারগাঁয় বর্তমান আছে। তাহার পর রাষ্ট্রবিপ্লব সংঘটিত হইয়াছিল। তাহাতে হিন্দুরাজা গণেশ গৌড়ের সুলতান হইয়াছিলেন। তাঁহার পুত্র যদু মুসলমান হইয়া, জালালুদ্দীন নাম ধরিয়া, সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন। জালালুদ্দীনের পরে তাঁহার পুত্র রাজ্যভোগ করিলে, আবার ইলিয়াসের বংশধর নাসির শাহ সিংহাসন লাভ করিয়াছিলেন। এই সকল স্বাধীন সুলতানের শাসন-কালেই শাসনশৃঙ্খলা দৃঢ়বদ্ধ হইয়াছিল।

মুসলমান-শাসন, বিস্তৃত হইবার সময় হইতেই, তিনটি ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশে বিভক্ত হইয়া পড়িয়াছিল। লক্ষ্মণাবতী-দেবীকোট প্রথম প্রদেশ বলিয়া, সুলতানগণই সেই প্রদেশের শাসনকার্য পরিচালিত করিতেন। দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গে ও পূর্ববঙ্গে রাজপ্রতিনিধির শাসন প্রচলিত হইয়াছিল। তৎসূত্রে সপ্তগ্রাম ও সুবর্ণগ্রাম শাসনকেন্দ্রে পরিণত হইয়াছিল।

বার্বাকাবাদ

সুলতান নাসির শাহ ইতিহাসে প্রথম মামুদ শাহ নামে উল্লিখিত। তাঁহার পূর্ণনাম-নাসিরুদুনীয়া ওয়াদ্দীন আবুল মুজাফফর মামুদ শাহ। হিজরী ৮৪৬ হইতে ৮৬৪ পর্যন্ত তাঁহার শাসনকালের পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে। তাঁহার সময়ের একখানি ৮৬২ হিজরীর (১৪৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ ডিসেম্বরের) শিলালিপি গৌড়ের ধবংসাবশেষমধ্যস্থ কোতয়ালী দরজার সঙ্গে সংযুক্ত ছিল; তাহাতে একটি সেতুনির্মাণের পরিচয় উল্লিখিত আছে। ইহাই তাঁহার শাসন-সময়ের শেষ শিলালিপি বলিয়া পরিচিত। ৮৬০ হিজরীর একখানি শিলালিপি ত্রিবেণীতে আবিষ্কৃত হইয়াছিল। তাহাতে নাসির শাহের পুত্র বাব্বাক শাহ কর্তৃক একটি মসজেদ নির্মিত হইবার কথা উল্লিখিত আছে। এই শিলালিপিতে বার্বাক শাহ সুলতান-রূপে উল্লিখিত না থাকায়, এবং ইহা তাঁহার পিতার শাসনকালের মধ্যে সম্পাদিত হওয়ায়, অধ্যাপক ব্লকম্যান লিখিয়া গিয়াছেন–এই শিলালিপি-সম্পাদনকালে বার্বাক শাহ দক্ষিণ-পশ্চিমবঙ্গের শাসনকর্তা থাকাই প্রতিভাত হয়।

মুসলমান-শাসন বিস্তৃত হইবার পর, বাঙ্গালা দেশের যে সকল অংশ সাক্ষাৎ সম্বন্ধে মুসলমান কর্তৃক শাসিত হইয়াছিল, তথায় অনেক মসজেদ নির্মিত হইয়াছিল। শিলালিপিতে তাহার পরিচয় প্রকাশিত হইতেছে। এই সকল শিলালিপি ধরিয়া ইতিহাসের আলোচনায় প্রবৃত্ত হইলে মনে হয়,–বাঙ্গালার যে সকল অংশে শিলালিপি দেখিতে পাওয়া যায় না, তথায় সাক্ষাৎসম্বন্ধে মুসলমান-শাসন বিস্তৃত হইতে বিলম্ব ঘটিয়া থাকিবে। লক্ষ্মণাবতী-দেবীকোট অঞ্চলে ও সুবর্ণগ্রাম অঞ্চলেই অতি পুরাতন মুসলমান শিলালিপির সন্ধান প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে। দেবীকোটের পূর্বাঞ্চলে–আত্রেয়ী-করতোয়া-প্রবাহমধ্যস্থ বরেন্দ্র-মণ্ডলের কেন্দ্রস্থলে,–সেরূপ পুরাতন শিলালিপি দেখিতে পাওয়া যায় নাই। এই প্রদেশে সর্বপ্রথম মুসলমান শিলালিপি সুলতান বার্বাক শাহের শিলালিপি। ইহাতে অনুমান হয়,–খ্রিস্টিয় পঞ্চদশ শতাব্দীর মধ্যভাগের পূর্ব পর্যন্ত এই অঞ্চলটি সাক্ষাৎসম্বন্ধে মুসলমান শাসনের অধীন হয় নাই। এই অঞ্চলের হিন্দু রাজা গণেশের গৌড়ের সিংহাসনে আরোহণ করিবার বৃত্তান্ত ইহারই পক্ষ সমর্থন করে।

উত্তরবঙ্গে মুসলমান-শাসন বিস্তৃত হইবার কাহিনী এখনও পর্যাপ্তরূপে সঙ্কলিত হয় নাই। অধ্যাপক রকম্যান লিখিয়া গিয়াছেন,–উত্তরবঙ্গের রাজারা যথেষ্ট পরাক্রমশালী ছিলেন; তাঁহারা তজ্জন্যই পুনঃ পুনঃ মুসলমান-আক্রমণের বেগ সহ্য করিয়াও, অর্ধ-স্বাধীনতা উপভোগ করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। তিনি ইহার কোনরূপ প্রমাণের উল্লেখ করেন নাই। ইহা তাঁহার অনুমানমাত্র বলিয়াই প্রতিভাত হয়। কিন্তু আত্রেয়ী-করতোয়-মধ্যস্থ বরেন্দ্রমণ্ডলে পুরাতন মুসলমান শিলালিপির অভাব এই অনুমানের পক্ষ সমর্থন করিতে পারে। সুলতান বার্বাক শাহের শাসন সময়ের শিলালিপিই এই অঞ্চলের প্রথম মুসলমান শিলালিপি। সুলতান বার্বাক-শাহ এই অঞ্চলের নাম পরিবর্তিত করিয়া, ‘বার্বাকাবাদ’ নাম প্রচলিত করিয়াছিলেন। ইহাও প্রথম বিজয় ব্যাপারের আভাস প্রদান করিতে পারে।

সম্রাট আকবরের সময়েও এই অঞ্চলে সরকার বার্বাকাবাদ নামে উল্লিখিত হইত। ৩৮টি পরগনা সরকার বার্বাকাবাদের অন্তর্গত ছিল। তন্মধ্যে সন্তোষের নাম দেখিতে পাওয়া যায় না। মাহিসন্তোষের ধবংসাবশেষে মধ্যে যে দুইখানি শিলালিপি দেখিতে পাওয়া গিয়াছিল, তাহার একখানি ৮৬৫ হিজরীর (১৪৬০-৬১খ্রিস্টাব্দের) এবং একখানি ৮৭৬ হিজরীর (১৪৭১-৭২ খ্রিস্টাব্দের)। দুইখানি শিলালিপিতেই সুলতান বার্বাক শাহের উজীর উলুখ ইকরার খাঁ কর্তৃক মসজেদ নির্মিত হইবার কথা উল্লিখিত আছে।

মাহিসন্তোষের ধবংসাবশেষের মধ্যে যে পুরাতন দুর্গাদি দেখিতে পাওয়া যায়, তাহাই বার্বাকাবাদের রাজধানীর স্মৃতিচিহ্ন বলিয়া অনুমিত হয়। শিলালিপির পাঠ অধ্যাপক ব্লকম্যান কর্তৃক পূর্বেই প্রকাশিত হইয়াছিল। কিন্তু তাহা পুনরায় পরীক্ষিত হইতেছে। তাহার ফল প্রকাশিত হইলে, মাহিসন্তোষের ধবংসাবশেষের ঐতিহাসিক সম্পর্ক পুনরায় আলোচিত হইবে।

সাহিত্য, মাঘ, ফাল্গুন, চৈত্র, ১৩২৩

তথ্যসূত্র

১ গৌড়-লেখমালা ৯-২৮ পৃষ্ঠা।

কোন সময় হইতে “বরেন্দ্রী-মণ্ডল” নাম প্রচলিত হইয়াছিল, তাহার অধিক পরিচয় আবিষ্কৃত হয় নাই। সন্ধ্যাকর নন্দীর “রামচরিতম” কাব্যে এই নাম দেখিতে পাওয়া গিয়াছে। বৈদ্যদেবের তাম্রশাসনে (গৌড়-লেখমালা ১৩৩ পৃষ্ঠায়) “বরেন্দ্রী”-শব্দের উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়। উড়িষ্যার অন্তর্গত তালচীরে আবিষ্কৃত গয়াড়তুঙ্গ দেবের তাম্রশাসনে (J & P or A. S. B. New Series, Vol. X No 6, pp 291-295) “বরেন্দ্র-মণ্ডল” নাম দেখিতে পাওয়া গিয়াছে। তিববতীয় গ্রন্থে “বরেন্দ্রে”র নাম সুপরিচিত। ত্রিকাশেষ-নামক কোষগ্রন্থে দেখা যায়, –পুণ্ড্রদেশই “বরেন্দ্রী” নামে পরিচিত হইয়াছিল। যথা,”পুষ্প্রাঃ সুর্বরেন্দ্রী গৌড়নীবৃতি।”

২ দিনাজপুরের ভূতপূৰ্ব্ব কালেক্টর স্বনামখ্যাত ওয়েষ্টমেকট বরেন্দ্রমণ্ডলের নানা স্থল পরিদর্শন করিয়া স্পষ্টাক্ষরে লিখিয়া গিয়াছেন;–”I should like also to endeavour to trace the old towns especially those occupied by Muhammadan shrines as at Mahi Santosh; for I consider the selection of a site for a mosque by the early Muhammadaus to be an indication that on the spot they found plenty of material in Hindu buildings, or in, other words that the site had been occupied by extensive masonry buildings before the Muhammadan conquest.” — J.A. S. B 1875, p. 190.

৩ খননকার্য্যের প্রয়োজন বুঝাইবার জন্য দিনাজপুরের ভূতপূৰ্ব্ব কালেকটর ওয়েষ্টমেকট লিখিয়া গিয়াছেন,–”Besides the possibility of finding inscriptions, it would be interesting to discover the plan of those great buildings of which the granite cornices, mouldings, and pillars, and the delicately carved doorways have been spread far and wide through the neighbouriug districts, wherever materials were required for new erections.”–J. A. SB. 1875 p. 192.

৪ J. A. S. B. 1875, pp 290-291.

৫ The name Mahiganj can not be very old, though “Mahi” may be an allusion to Mahipal. All names ending with the Persian ganj are modern and I can not point to a single place ending in ganj that existed, or had received that name, before the 15th and 16th centuries.–J. A. S. B. 1875, p. 290.

অধ্যাপক ব্লকম্যান ইংরাজী রিপোর্টে মাহিগঞ্জেরে নাম দেখিয়া, তাহাকে মাহীগঞ্জ মনে করিয়া, মহীপালদেবের সঙ্গে তাহার সম্পর্ক থাকিলেও থাকিতে পারে বলিয়া যে মন্তব্য লিপিবদ্ধ করিয়াছিলেন, তাহাকে সিদ্ধান্তরূপে অবলম্বন করিয়া, কোনও কোনও বাঙ্গালী লেখক এখানে মহীপাল দেবের কীৰ্তিচিহ্ন দর্শন করিয়াছেন। দিনাজপুর জেলায় মহীপাল দেবের কীৰ্তিচিহ্নরূপে “মহীপাল-দীঘি” বর্তমান আছে; তাহার নাম মাহিপাল-দীঘি হয় নাই। সুতরাং মহীগঞ্জের নাম সেই জেলার লোকের নিকট মাহিগঞ্জে পরিণত হইবার সম্ভাবনা অল্প বলিয়াই বোধ হয়। মাই-গঞ্জ কালক্রমে মাহি-গঞ্জ হইয়া থাকিতে পারে; তাহা অপেক্ষাকৃত আধুনিক নামকরণ।

৬ The Rajahs of Northern Bengal were powerful to preserve a semi-independence inspite of the numerous invasions from Bakhtiyar-Khiliji.-J. A. S. B. 1873, p. 239.

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!