অন্তরাল-প্রতিমা

নবনীতা বসুহক
নবনীতা বসুহক
8 মিনিটে পড়ুন
ছবি সংগৃহীত।

অনেকদিন পর প্রীতি এসেচে বৌঠানের কাচে। একসময় ছোট্ট প্রীতির নৃত্যগুরুর গুরু। দয়ার শরীর।কঠিন ব্যক্তিত্ব। রথীদাদার কাচে গেচিল প্রীতি স্বামী প্রাণতোষের সঙ্গে রানিক্ষেতে।তিনি বলেছেন, বৌঠানের খবর নিস।

তাই আসা। বৌঠান আজ কত গল্প করলেন। শিল্পীমন ভালবাসার কাঙাল। এইটুকু বার্তা যেন প্রবাহিত করল ভেতরকে। বৌঠান মেলে দিল, খুলে দিল, অন্তর প্রকাশিত বৃত্তের বাইরে বেরিয়ে।

এক

বৌমা তুমি চলে যাও নিচে।
তা কী করে হবে বাবামশাই? একন মেয়েদের আমার কাচে আসার সময়।
কেন?
ওদের সাথে বাটিকের কাজ করব যে।
পরে কোরো। তোমাকে দেকলে নাচের মেয়েদের ভরসা জাগে।
ঘাসের চটি পা দিয়ে প্রতিমা দেবী নামেন বিচিত্রা বাড়ির নিচে। গৌরীরা নাচের রিহার্সালে এসে গেচে। নন্দলাল কাকাবাবুর মেয়ে। মেয়েদের কলকাকলি শোনা যাচ্চে।
শান্তিনিকেতন একন সার্থক শিক্ষাকেন্দ্র হয়ে উঠেচে। রবীন্দ্রনাথ ভাবেন। শুধু তো তিনি নন, আরো বহু মানুষ ছিলেন যাঁদের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সহযোগিতায়, উৎসাহে, পরিশ্রমে শান্তিনিকেতন গড়ে উঠেছে।বৌমা তো এদেরই একজন।
উপর থেকে দেখলেন রবীন্দ্রনাথ।
কেমন একটু তালে ভুল করল যেন মেয়েরা। বৌমা কী দেকলেন না?
ঘরে আসতেই বললেন সেকতা। প্রতিমা দেবী বললেন,
আজ তো প্রথম দিন। ঠিক হয়ে যাবে রিহার্সাল করে।
দেকো। তাই যেন হয়।
বাবামশাই একটা কথা বলব?
বল।
ভাল নৃত্যনাট্য লিখুন । যেখানে নাচ থাকবে মুখ্য।শান্তিনিকেতনে মেয়েদের নাচ শেকাবার ব্যবস্থা আরো ভাল করে করা যায় তাহলে!
কী করতে বলচ বৌমা?
বাঙালিদের ভিতরে নাচ শেখাবার খুব একটা ব্যবস্থা নেই। সেই কবে আপনার ‘বাল্মীকিপ্রতিভা এবং ‘মায়ার খেলা’য় যৎসামান্য নাচ ছিল। কিন্তু ভেবে দেকলাম বাবামশাই ‘পূজারিনী’ কবিতা নৃত্যনাট্যরূপ হলে ভাল হয়।
আচ্চা। ভেবে দেকি।

দুই

ক’দিন পর রবীন্দ্রনাথ লিকলেন শ্রীমতী। অপূর্ব হল সে নাচ। গৌরী করল অভিনয়।নন্দলাল কাকাবাবুর মেয়ে।
প্রতিমা দেবীকে বললেন রবীন্দ্রনাথ,
বৌমা, মঞ্চে নিজে উপস্থিত হও না কেন? সবসময় কেবলই অন্তরালে থাকো। এটা আমার ভাল লাগে না।
ভাবলেন নিচু মুকে প্রতিমাদেবী। বললেন,
বিয়ের অল্প পরে শান্তিনিকেতনে মেয়েদের প্রথম অভিনয় ‘লক্ষ্মীর পরীক্ষা’তে ক্ষীরির চরিত্রে তো অভিনয় করেছিলাম।
কিন্তু একন তো করনা আর।
আর হয়ে ওঠে না। ওদের শেকাতেই ভাল লাগে।
আর কী ভাল লাগে আমি জানি গো জানি মেয়ে।একা মনে ছবি আঁকতে।
আর একটা জিনিস ভাল লাগে মা এর।
বনমালী যথারীতি ঝাড়পোঁচ করচে। সেই বলল। রবীন্দ্রনাথ বলেন , কী?
আপনি কী খাবেন সেদিকে নজরদারি।রবীন্দ্রনাথ বল্লেন,
ওরে সে কী পেটের খিদে। মনের খিদে ও মেটায় বৌমা। আমার ভেতর যে নাটক ছিল তা ওর শিল্পরসে চান করে নাচ মিশিয়ে দিল রে বনমালী। তা বৌমা, নৃত্যনাট্য জিনিসটা তোমার উৎসাহেই হল। আমি নিজেও ‘চিত্রাঙ্গদা’ বা ‘পরিশোধ’ নিয়ে নৃত্যনাট্য রচনার পরিকল্পনা করিনি।
কী যে বলেন বাবামশাই?
বৌমা, তুমিই নৃত্যনাট্যের খসড়া নিয়ে এলে। আরো তৈরি করলে আমাকে।
বনমালী বলল, কী ভেড়। সুরুল থিকে লোক এয়েছিল। আমার বোনের সব কুটুম। ওর নাতিটা তো কেবল নাচচে, হিদয় আমার নাচেরে। আচ্ছা কত্তা, এসব লিকে তোমার কোনও আনন্দ হয়?
অত বুঝিনা।
মা। আমার নাতিটাকে লে আসব। তুমি একটু নাচ শিকিও তো ।
প্রতিমা দেবী কখনও নাচ শেকেননি। তিনি বর্ষামঙ্গলে দু-একটি নাচে রূপ দেওয়ার পর জন্মদিনে মেয়েদের দিয়ে সেটি অভিনয় করাবেন মনস্থ করলেন। শান্তিনিকেতন যেন নৃত্যের নতুন দিশা দেখাচ্চে।সমালোচনাও হচ্চে।
বলেন, বেশ তো।

তিন

প্রায় চোদ্দ বছর পরিশ্রমের পর প্রতিমা দেবী রাবীন্দ্রিক গীতিনাট্যের স্থায়ী রূপ তৈরি করলেন ‘চিত্রাঙ্গদা’য়। নিউ অ্যাম্পায়ার থিয়েটারে অভিনয় হল।অনেক দারুণ বললেও, মনে মানতে পারেনি অনেকেই মেয়েদের নৃত্যভঙ্গিমা, সামনে আসাটা।সালটা তখন ছিল ছত্রিশ সাল।শান্তিনিকেতনের আয়তন বাড়চে। টাকা জোগাড়ের এক নতুন দিশা পেলেন বাবামশাই। আগে অবশ্য একত্রিশে হয়েচিল ‘শাপমোচন।’ বাবামশাই এর সত্তর বছরের জন্মদিনের রচনাই তো নয়; বরং শান্তিনিকেতনের ছাত্রছাত্রীদের আশ্রমের বাইরে প্রদর্শন করা প্রথম পরিবেশনা শাপমোচন। ‘শাপমোচন’ নিয়ে তাঁরা ঘুরেচেন লক্ষ্নৌ, বোম্বে, শ্রীলঙ্কায়। এই পরিবেশনায় শুধু যে, আশ্রমের তখনকার অবস্থার কথা সবার সামনে তুলে ধরেচে যেমন,তেমন আশ্রমটি চালিয়ে যাবার জন্য অর্থ সংস্থানের সুযোগও তৈরি করেচিল।’চিত্রাঙ্গদা’র নাচের বৈশিষ্ট্যগুলি আরো স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছিল আটতিরিশে ‘চণ্ডালিকা’তে। তকন বাবামশাই নৃত্যনাট্য সৃজনে রৌদ্ররূপে।
কী করচিলে। এত দেরি বৌমা?
বনমালী আসে নি আপনার কাচে?
তবু তুমি নিজে এলে— আমার ভাল লাগে বৌমা।আসলে তোমার স্পর্শে নৃত্য যেন ছবি হয়ে ওঠে আমার কাচে।আর নৃত্য তো প্রকাশের সব থেকে বড় মাধ্যম।
থামলেন রবীন্দ্রনাথ। কাল রাতে শিশুর মত বুকে হাত দিয়েছিলেন প্রতিমাদিবীর। সে স্পর্শ যেন তার মেয়ে নন্দিতার মত।
রবীন্দ্রনাথ বললেন,
বুঝেচি, তুমি অন্তরালে থেকে নাটকের পোশাক পরিচ্ছদ সাজ প্রভৃতির দিকে নজর রাখ। কী করে আরো ভাল করে নৃত্যনাট্য ফোটে, সেকতা ভাব। বৌমা তোমার শিল্পীমন মঞ্চ-সজ্জাতেও এনেচে বৈচিত্র্য। বাটিকের চাদর একন ছড়াচ্চে, অথচ তোমার মনে আচে বৌমা, জাভা থেকে আভরা এ শিল্প নিয়ে আসি।
প্রতিমাদেবী চুপ করে শান্তিনিকেতনের সন্ধে দেকচেন। বাইরের কেউ না থাকলে বাবামশাই নানান গল্প করেন। বলেন,
শান্তিনিকেতনের ঐতিহ্য বজায় রাকচ নৃত্যনাট্যে- এই তো পরম পাওয়া।
আমার ইচ্চে গল্পগুচ্ছের ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ ও ‘দালিয়া’ আর কথা ও কাহিনি-র ‘সামান্য ক্ষতি’ ট্যাবলো ধরনের মূকাভিনয় আকারে রূপায়িত করা যদি যায়।
একতা তো ভাবিনি। পরীক্ষা করে দেকতে পার।
প্রতিমা দেবী প্রতি অনুষ্ঠানশেষে ভাবেন, শান্তিনিকেতন-নৃত্যে কোন বিশেষ প্রকারের নৃত্যশৈলীর আঙ্গিককে গ্রহণ না করেও; মিশ্র তাল ও ভঙ্গির সংমিশ্রনে কী করে বৈচিত্র্য আনা যায়। ভাবেন সার্থক ভাবে সঙ্গীতের ভিত্তির উপর দাঁড় করানো যায় কীভাবে মুদ্রাবিভঙ্গে।

চার

..প্রতিমা নাকি অন্তরালে থাকে! বাবামশাই এ কতা বলতেন প্রায়। একন বাবামশাই নেই। কিন্তু
প্রতিমা প্রাণ পেয়ে ছড়িয়ে আচে ‘কল্পিতাদেবী’ ছদ্মনামে প্রবাসী পত্রিকাতে প্রতিমার অনেক কবিতা। বাবামশাই কল্পিতাদেবী ছদ্মনামটি ঠিক করে দিয়েচিলেন। কখনো বাবামশাই কবিতা লিকলেই সংশোধন করেও দিতেন। তাঁর গদ্য রচনা অনেকের মনে হত লিপিকা মত। হয়তো বাবামশাই-এর প্রভাব।স্বপ্নবিলাসী পড়ে বাবামশাই তো ভীষণ মুগ্ধ হয়ে গেছিলেন। লেকেন মন্দিরার উক্তি। সেসব মনে পড়লে মৃদু হাসি আসে প্রতিমাদেবীর।

রথীন্দ্রনাথও শান্তিনিকেতনে নেই। থাকেন না আর। পড়ে আচে তাঁর স্মৃতি। মীরাকে নিয়ে সুখী সে নিশ্চয়। কীভাবে সব ছেড়ে চলে যেতে পারলেন? এদিকে বাবামশাই তাকে তৈরি করেচেন। শিল্পীসত্তাকে টেনে বার করে এনেচেন ভেতর থেকে। কী করলেন সারাজীবন ভাবতে গিয়ে বিচার করেন প্রতিমা- নির্বাণ এ বাবামশাইয়ের জীবনের শেষ বছরের ঘটনার বর্ণনা থাকল। স্মৃতিচিত্র বইটিতে অবনীন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্রনাথের কথা লিকলেন। সঙ্গে বাড়ির মেয়েদের কথা এবং উৎসবের কথা- যা মনে এসেচে, লিখেচেন। নৃত্য বইটিতে শান্তিনিকেতনের নৃত্যধারার বিষয়ে লিখেচেন। ‘চিত্রলেখা’ নামে কবিতা এবং কথিকার সংকলন বের হবে হয়তো।

প্রতিমা দেবী শান্তিনিকেতনে নারীশিক্ষা এবং নারীকল্যাণের দিকেও নজর রাখচেন। আর কী। জীবন যে ছোট। কাজ করে যেতে হবে ক্রমশ। মেয়েদের নিয়ে ‘আলাপিনী সমিতি’ গঠন করেচেন। এই সমিতিতে অভিনয় এবং গান হয় । কিচুদিন হল আশ্রম থেকে মেয়েরা গ্রামে গিয়ে সেকানের অশিক্ষিতা মেয়েদের স্বাস্থ্যকর খাবার তৈরি, শরীরের যত্ন, হাতের কাজ শেখাচ্চেন। তাঁর পরামর্শ নিতে আসে তারা…

পাঁচ

কেউই আসেনি বাবামশাই।
আসেনি? প্রীতি?
আপনি শুধু তাড়া দেন, এদিকে যে আপনার বেলের শরবৎ করে দিয়েচি, আপনি একনো খান নি!
তুমি বলচ বৌমা, ওরা সব আসবে!
আসবে। শান্তিনিকেতনে মেয়েদের এই নাচ নিয়ে কতজন কত কথা বলচে। সঙ্কোচ করচে মেয়েরা।
প্রীতি আসে রোজ?
সে ভারি দুষ্টুমি করে। আপনি বনমালীকে দিয়ে ডেকে পাঠাবেন আজ। কাল সে আসেনি।
ঘাড় ঘুরিয়ে বনমালীকে ডাকলেন রবীন্দ্রনাথ। সে তকন অনেকটা দূর। গামচা কাঁদে ঝাড়পোঁচ করচে।
প্রতিমা দেবী কাচে গিয়ে ডাকতে সে এল। বলল, বলেন কত্তা?
তুই একনি গিয়ে প্রীতিকে ডেকে আন। আমার বিচিত্রার নিচে।
বনমালী জোর করে নিয়ে আসে প্রীতিকে—
—– সেই প্রীতি একন কত বড়। একটা খবর নিয়ে এসেছে রথীদাদার।
ট্যাঙ্ক খুলে একটা স্কার্ফ বার করে দেকান তাকে প্রতিমা দেবী।
প্রীতি নাড়েচাড়ে।
বলে, এটা দিয়েই তোমার গলা বন্ধ হয়ে আচেন রথীদাদা।
একন নাচ করিস?
করি। তুমি যে বলেছিলে সব জড়তা দূর হয়ে যায়। তাই নাচ থেকে গেল গো বৌঠান।#

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
১ টি মন্তব্য

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!