একটি পুতুল বিয়ে (১ম অংশ)

মুর্শিদা খাতুন
মুর্শিদা খাতুন
23 মিনিটে পড়ুন

এটা কোন শিল্পীর তুলিতে আঁকা পুতুল নয়। কোন কুমোরের হাতে তৈরি নয়। নয় কোন শিশুর খেলনা। এটা বিধাতার নিপুণ হাতের সৃষ্টি সুন্দর-কোমল চাঁদের জোছনার মত ঝলমলে মুখখানি দেখলেই যেন সবার মায়া লেগে যায় মনে। গোলাপ ফুলের পাপড়ির মত নরম তাঁর হৃদয় খানি।

কোন ঈর্ষা জন্ম নেয় না, যে হৃদয়ে শুধু ভালবাসা উজাড় করে দেওয়ার মন-মানসিকতা। সে যে আর কেউ নয়, সে হচ্ছে একটা পুতুল। রক্তে-মাংসে গড়া পুতুল। বাড়ন্ত বয়স, উৎফুল্ল মন, বনে বাদাড়ে ঘুড়ে বেড়াতো, কখনও লুকোচুরি, গোল্লাছুট, কানামাছি, কখনও খাড়া দুপুরে পুকুরে ঝাপ, কখনো বা আবার ঘরে বসে পুতুলের বিয়ে- বিয়ে খেলতো পুতুল মেয়েটা। এভাবেই হেসে খেলে দিন কেটে যেতে লাগলো। হঠাৎ একদিন পুতুলের মা পুতুলকে বলল, “পুতুলরে তোর বাবা তোকে বিয়ে দেবার জন্য একটা পাত্র ঠিক করেছে।”

পুতুল মায়ের কথা না বুঝে হাসলো, বলল তাই নাকি? পুতুল বুঝতেই পারল না যে, তাঁর মা তাকে কি বলছেন? পুতুল মেয়েটা শুধু নিজের খেলার পুতুল বিয়ে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়ল। বন্ধু-বান্ধবীদের দাওয়াত করল। বলল, কালকে আমার পুতুলের বিয়ে। তোরা সবাই আমার পুতুলে বিয়েতে আসবি অবশ্যই। তোরা আসলে আমি খুব খুশি হব। পুতুলের বিয়ে উপলক্ষ্যে সে নতুন জামা-কাপড় তৈরি করলো, কচুরি ফুল, লতা-পাতা ছিড়ে এনে পুতুলের ঘর সাজালো। মহা-ধুমধাম করে পুতুলের বিয়ে দিবে সে। বয়স তখন মাত্র এগারো বছর।

গ্রামের বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করে পুতুল মেয়েটা। বিদ্যালয়ে যাওয়ার পথে তাঁর বান্ধবীরা হাসি -ঠাট্টা করতে লাগলো। বললো হ্যারে পুতুল, তোর বাবা নাকি তোকে বিয়ে দেবার জন্য একটা পাত্র ঠিক করেছেন? পুতুল মন খারাপ করে বললো, আমি জানি না। তবে আমার মা একথা আমাকে বলেছেন। কয়েক দিন পর হঠাৎ করে সত্যিকারের পুতুলকে বিয়ে দেবার জন্য মহা-ধুমধাম করে পুতুলের বিয়ে দিয়ে পরের বাড়ী পাঠানোর ব্যবস্থা করছেন তাঁর বাবা। তার বাবা শুধু একটা নামে শিক্ষিত মানুষই ছিলেন। প্রকৃত শিক্ষার যে গুণ থাকা দরকার তার কোনটাই তাঁর মধ্যে ছিল না।

পুতুলের বাবার তো টাকা পয়সার অভাব ছিল না। সে ছিল আশে-পাশের আট-দশটা গ্রামের মধ্যে একজন নাম করা ধনী ব্যক্তি এবং স্বচ্ছল গৃহস্থ। তাকে আশে-পাশের আট-দশটা গ্রামের লোক এক নামে চিনতো এবং জানতো। সে ছিল একজন পাঠশালার প্রধান শিক্ষক। তাঁর মেয়ে পুতুলের বিয়ের কথা শুনে কয়েকজন জ্ঞানী লোক বিয়ে না দেবার জন্য তাকে বললেন কিন্তু নাছোর বান্দা কারো কোন নিষেধই শুনলেন না। জোর করে মেয়েকে বিয়ে দিয়ে পরের বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন।

যে দিন পুতুলের বিয়ে দেওয়া হলো সেদিন সে ভাবলো যে তাঁর খেলনা পুতুল গুলো গোছানো আছে কিনা? সে চলে যাওয়ার সময় তাঁর মাকে বললো, মা আমার খেলনা গুলোকে যত্ন করে রেখে দিও। আমি যখন আবার ওখান থেকে ঘুরে আসবো তখন আমি খেলনা গুলো দিয়ে খেলবো। বুক ভরা ব্যথা নিয়ে মা বলল, পুতুলরে তুই কোথায় যাচ্ছিস? মায়ের প্রশ্নের জবাবে পুতুল বলল, মা আমি শ্বশুরবাড়ি চলে যাচ্ছি। মাকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে মাকে জড়িয়ে ধরে পুতুল কাঁদতে লাগলো। আর বললো মা আমাকে দোয়া করো।

পুতুল সত্যিকার অর্থে বুঝতেই পারল না যে সেদিন থেকে তাঁর না থাকে লুকোচুরি, কানামাছি, না থাকে কচুরিফুল, লতা-পাতা ছিড়ে এনে পুতুলের ঘর সাজানো আর পুতুলের বিয়ে। সে বুঝতেই পারলো না যে তাঁর বাবা তাঁকে পরের ঘরে দিতে চলেছে। পর কি? আপন কি? সে বুঝতে পারতো না, যে সে অন্য কারো বাড়ীর বউ। সে শুধু জানতো কয়েকদিন পরই সে ঘুরে আবার মারে কোলে ছুটে চলে আসবে। কোন প্রকার খেলা ধুল কিংবা খাড়া দুপুর ভরা পুকুরে ঝাপ কোন টাই তার আর সম্ভব হবে না। বেশ কিছুদিন পর যখণ পুতুল শ্বশুরবাড়ী ছেড়ে মায়ের কোলে ফিরে আসলো, সে আর তার শ্বশুরবাড়ী যেতে চাইল না। খুব কান্না করলো।

পুতুল বললো, মা আমি শুধু পুতুল বিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। আমার পুতুল কই? মা বলল, কলা গাছের খোলে বানানো বেলায় সেগুলো নদীর জলে ভাসিয়ে দিয়েছি। একথা শোনা মাত্রই পুতুলের সব খেলার স্বপ্ন তৎক্ষনাৎ ভেঙ্গে চুর্মার হয়ে গেল। অন্তর ফেটে কান্না আসতে লাগলো। তাঁর মা তাকে অনেক বুঝাতে চাইল কিন্তু কিছুতেই সে বুঝতে চাইলো না। সে শুধু তাঁর মাকে বলল, মা শ্বশুর বাড়ি মানে তো পরের বাড়ি। আর পরের বাড়ি মানে তো হায়নার থাবার মতো মনে হয় আমার। আমার খুব ভয় লাগে মা। আমি আর কোন দিনও শ্বশুরবাড়ি যাব না।

মা আমাকে শক্ত করে ধরে রেখো। আমাকে যেন কেউ তোমার বুক থেকে কেড়ে নিয়ে যেতে না পারে। মা বলল, আমিও তো পরের বাড়ি এসেছি। আমিও তো মা হয়েছি। তুইও একদিন আমার মত মা হবে, তখন সব ঠিক হয়ে যাবে। আর তোর ভয় করবে না। পুতুল মনে মনে ভাবলো আমি যদি সত্যিকারের পুতুল হয়ে যেতাম। তাহলে আমাকে কেউ আর জোড় করে কেড়ে নিতে পারত না। আমি পুতুল হলাম ঠিকই, কিন্তু রক্তে মাংসে গড়া পুতুল হলাম কেন?

এভাবে কয়েকদিন যেতে যেতেই পুতুলের শ্বশুরবাড়ি থেকে লোক হাজির পুতুলকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। এ খবর শুনে পুতুল আড়ালে লুকিয়ে থাকলো, কেউ যেন দেখতে না পায়। অনেক খোঁজা-খুঁজি পর পুতুলকে ধরে এনে আবারও জোর করে শ্বশুর বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হলো। শ্বশুর বাড়ী যাওয়ার সময় ছোট-ছোট ভাই বোনদের বলল, আমি তো তোদের সাথে খেলতে, পড়তে ঘুরে বেড়াতে চাই। ছোট ভাই-বোনরা বলল, তাহলে বুবু তুমি বিয়ে করলে কেন?
প্রশ্নের জবাবে পুতুল বলল, আমি আগে বুঝতাম নাকি যে, শ্বশুর বাড়ি হয় পুশুর বাড়ির মত। আমি যদি আগে বুঝতাম তাহলে বিয়েই করতাম না। আমি মনে করেছিলাম যে, শ্বশুরবাড়ি মানে আমি যেমন পুতুল বিয়ে দিয়ে পুতুলকে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখি ঠিক তেমন। ওখানে আমাকে কেউ আদর করে না, ভালবাসে না, সবাই শুধু শাসন কর। বিয়ে মানে আমি পুতুল বিয়ে মনে করেছিলাম। ওখানে আমার কোন স্বাধীনতা নেই। আমার তোদের ছেড়ে যেতে মোটেও ইচ্ছে করছে না। ছোট ভাই-বোনদের সাথে মনের যত কথা আছে সে বলছে।

এমন সময় তাঁর মা বলল, তুমি আজকে ওখানে যাও। না গেলে তোমার বাবার মান থাকবে না। তোমার বাবা রাগ করবেন। শুধু আজকের দিনটা থাকবে, আগামী কালকেই তোমাকে তোমার বাবা নিয়ে আসবে। এই বলে পুতুলকে বুঝিয়ে শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হল। দিন যায়, রাত যায়, সপ্তাহ যায়, মাস যায় এভাবে বেশ কয়েক মাস পর পুতুলের বাবা পুতুলকে দেখতে তার শ্বশুরবাড়ি গেল। ওখানে গিয়ে পুতুলের বাবা দেখলো পুতুলের মুখো কোন হাসি নেই। চাঁদের জোছনার মতো মুখখানি অমাবস্যার চাঁদের মতো কালো হয়ে আছে। পুতুলের বাবা পুতুলকে নিয়ে নিজের বাড়িতে আসলো। মায়ের কাছে পুতুল কিছুদিন থাকার পর আবার শ্বশুর বাড়ি চলে গেল। সেই সাথে পুতুলের মুখের কথাও আগের চেয়ে অনেক কমে গেল। খুব প্রয়োজন ছাড়া কারো সাথে সে আর বেশি কথা বলে না। এভাবেই দিন কেটে যেতে লাগলো।

বছর দুই যেতে না যেতেই সে সন্তান -সম্ভাবা হয়ে গেল। যখনই এ খবর তার স্বামীর কানো পৌঁছাল সঙ্গে সঙ্গে তাঁর স্বামীর চরিত্র ফুটে উঠলো দানবের মতো হয়ে। বউ দেখে তাঁর পছন্দ হয়নি। সেই মানুষ রূপী পশুটাকে নাকি তাঁর বাবা জোর করে বিয়ে দিয়েছে। তাই সে তাঁর সন্তান চায় না। তাই সে গ্রামের ডাক্তারের মাধ্যমে সন্তান মেরে ফেলার আদেশ দেয়। তাঁর আদেশ মতো ডাক্তার পুতুরের পেটের ৭ মাসের বাচ্চাকে মেরে ফেলার ঔষধ দিলেন। তাঁর বাচ্চা পেটের ভেতরে মরে যাওয়ার ফলে পুতুল মেয়েটার শারীরিক অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেল। পেটের সেই বাচ্চাকে ডাক্তার ভালোভাবে ডেলিভারি করতে না পারায় ডাক্তার বাধ্য হয়ে বাচ্চার হাত কেটে বাচ্চাকে পেট থেকে বের করলো।

পুতুল মেয়েটা অজ্ঞান হয়ে পড়ে রইল মরা মানুষের মতো। ডাক্তার সুস্থ হওয়ার জন্য ইনজেকশন ও স্যালাইন হাতে পুষ করলেন এবং বললেন যে, রোগীকে বেড রেষ্ট এ থাকতে হবে। তখন পুতুলের বাবা-মাকে খবর দেওয়া হলো। খবর পেয়ে পুতুলের বাবা মা পাগলের মতো ছুটে এসে পুতুলকে তাঁদের বাড়িতে নিয়ে গেলেন এবং সেবা যত্ন করে মেয়েকে সুস্থ করে তুললেন। পুতুলের মা-বাবা ঠিক করলেন যে, মেয়েকে আর শ্বশুর বাড়ি পাঠাবেন না।

সুস্থ হবার কথা শুনে পুতুলের শ্বশুর দেখতে আসলো এবং নিয়ে যাওয়া কথা বলে গেল। তাঁর বাবা- মা রাজি না থাকা সত্তেও, তাঁকে আমার শ্বশুর এসে অনেক বুঝিয়ে নিয়ে গেল। পুতুলের শ্বশুর পুতুলকে খুব ভালবাসতো, স্নেহ করতো তাই সে তাঁর কথা রাখতে বাধ্য হলো। তাঁর শ্বশুর বাড়ি গিয়ে তার আগের চেয়ে ভালোই লাগলো। তাঁর স্বামী তাকে আগের চেয়ে অনেক যত্ন নিতে থাকে তাঁর সবকিছু খুব খেয়াল করে। এভাবে এক বছর পরই আবার পুতুল সন্তান সম্ভাবা হলো। এ খবর শুনে তার শ্বশুর বাড়ির সবাই খুব খুশি হলো এবং তাঁকে অনেক যত্ন করতে লাগলো। এভাবে দিন ভালো ভাবেই কাটতে লাগল। পুতুলের স্বামী পুতুলের কোন কিছুতেই কোন কমিতি রাখেনি। যেমন- ভালো ভাবে খাবার, পোষাক, ঔষধ পত্র এবং অন্যান্য জিনিস পত্রের। এরপর ভালো একটা খবর শুনে পুতুলের তো আর আনন্দ শেষ হয় না। সু-সংবাদ হলো পুতুলের স্বামীর একটি সরকারি চাকরি হয়ে গেল।

এখন সে ব্যবসা ছেড়ে চাকরিতে চলে গেল এবং বাড়ির সবাইকে বলে গেল তাঁর স্ত্রী সন্তান সম্ভাবা তাই যেন সবাই তাঁর স্ত্রী দিকে খেয়াল রাখেন। এরপর দুই-তিন মাস পর পুতুলের বাবা এসে পুতুলকে নিয়ে গেল তাঁর বাবার বাড়িতে। কারণ গ্রামের ডাক্তার পুতুলের চেক আপ করে পুতুলের ডেলিভারির তারিখটা বলে দিল। নিদিষ্ট সময়ে তাঁর কোল আলো করে জন্ম নিল একটা ফুট ফুটে চাঁদের মতো পুত্র সন্তান।

পুত্র সন্তান জন্মের খবর শুনে পুতুলের স্বামী খুব খুশি হলেন এবং নবজাতক পুত্র ও স্ত্রীর জন্য অনেক উপহার, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে পাঠিয়ে দিলেন। তাঁর শিশু বাচ্চার বয়স যখন চার মাস তখন তাঁর স্বামী যেখানে চাকুরী করতেন সেখানে তাঁদের বাসায় নিয়ে গেলেন। এভাবে খুব সুখে-শান্তিতে তাঁদের জীবন কাটতে লাগল। এভাবে দুই বছর যেতে না যেতেই পুতুলের শ্বাশুরী ও জায়েরা তাঁর সুখ-শান্তি কেড়ে নেওয়ার জন্য গভীর ষড়যন্ত্র শুরু করে।

পুতুলকে শ্বশুর বাড়ি চলে যেতে বাধ্য হল। তাঁর বাচ্চাটা গ্রামে চলে আসাতে শরীর খুব একটা ভালা থাকে না। তাই বাচ্চাট কান্না করে ফলে পুতুল সংসারের কাজ গুলো ভালভাবে করতে পারে না। এতে শ্বাশুরী গাল মন্দ করে জাগুলো তাঁর সাথে হিংসা করে এবং তাঁর সাথে ঝগড়া করে। পুতুলের স্বামী মাঝে মাঝে চাকরি ছুটি পেয়ে চলে আসে গ্রামের বাড়িতে স্ত্রী এবং বাচ্চাটাকে দেখতে, এভাবে কয়েক বছর পার হয়ে গেল।

পুতুল বয়সেও ছোট এবং সাংসারিক কাজকর্মেও অদক্ষ তাই তাকে শ্বাশুরী তার সাংসারটা পৃথক করে দেয়। পুতুল তাঁর সংসার নতুন করে সাজালো এবং তাঁর স্বামীও তাকে সংসার সুন্দর করে সাজাতে সাহায্য করে। এতে পুতুলের সংসারটা অনেক সুন্দর হয়। এটা দেখে জাগুলো এবং শ্বাশুরী খুব হিংসা করে। তাঁর সংসার ভাঙ্গার ষড়যন্ত্র করে।

পুতুলের কোল আলো করে আরেকটা কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। পুতুলের একটা পুত্র ও একটা কন্যা নিয়ে ছোট সংসারটাতে যেন সুখ ধরে না। এটা দেখে হিংসুটেদের হিংসা ও যেন আর ফুরায় না। তাঁর শ্বশুরী এবং জায়েরা তাকে খুব নির্যাতন করতে থাকে। তার নামে মিথ্যা দূর্নাম রটাতে থাকে এবং তাঁর সম্পর্কে তাঁর স্বামীর নিকট খারাপ খারাপ মন্তব্য করে। পুতুলের স্বামী যখন বউ এবং বাচ্চাদের দেখতে আসতো ঠিক তখনই তাঁর শত্রু এবং জায়েরা তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ দিতে থাকে।

এ ভাবে বেশ কয়েক মাস চলে। তারপর পুতুলের বাচ্চারাও বেশ বড় হয়ে উঠে হেসে খেলে তাঁর ছোট সংসারটা যেন ফুলের বাগানের মতো সুন্দর হাসি-খুশিতে ভরপুর হতে থাকে। কোন কিছুর অভাব নেই পুতুলের সংসারে যেন পুতুল স্বর্গের সুখ সবটুকুই পেয়েছে। বাড়ির আঙিনায় হাঁস-মুরগী, গোয়ালে গরু-ছাগল, গোলাভরা ধান, পুকুরে মাছ, ঘরের পাশে ফুল, ফল ও সবজির বাগান। ঘরের কোটায়, কোটায় বিভিন্ন রকমের বাচ্চাদের চাটনী, খাবারে ভরপুর। এটা দেখে পুতুলের মাও খুব খুশি হলো। এভাবে তার এই স্বর্গীয় সুখ বেশিদিন চিরস্থায়ী হয় না।

ওদিকে তাঁর শাশুড়ি ও জায়েরা গভীর ষড়যন্ত্রের ফাঁদ পেতে বসে থাকে। তাঁর স্বামী যেখানে চাকরী করে সেখানে তাঁর কানে পৌঁছে দেয় সব রকমের মিথ্যা বানোয়াট খারাপ খারাপ ঘটনা। এ কাজ আরো সহজ হয় জায়ের ভাই তাঁর স্বামীর সাথে রাস্তায় দেখা হয় তখন। পুতুলের স্বামীও সেটা শোনার পর বিশ্বাস করতে পারে না। বেশ কিছুদিন বার বার তাঁর বিরুদ্ধে আরো লোক প্রেরণ করে তাঁর জায়েরা। তাঁর গ্রামের কোন এক মুরব্বী লোকও তাঁর স্ত্রীর ব্যাপারে খারাপ মন্তব্য করতে থাকে। এটা শোনার পর সে তাঁর স্ত্রী সম্পর্কে খারাপ ধারণা করে এবং তাঁকে অবিশ্বাস করে। এমনকি তার সন্তানদেরও সে ভুলে যায়। সে তো এটাই আশা করেছিল।

ওদিকে পুতুলের স্বামী যে বাসায় ভাড়া থাকতো তাঁর পাশে তাঁর এক অফিস সহকর্মীর বোন বেড়াতে আসে এবং পুতুলের স্বামীর সাথে আলাপ হয়। যত দিন যায় পুতুলের স্বামী মদপান করে আর পুতুলকে ভুলে গিয়ে আবার নতুন করে সংসার গড়ার পরিকল্পনা করে। সেই মহিলার সাথে পুতুলের স্বামী ফষ্টি নষ্টি করে এবং তাঁকে নিয়ে বেড়াতে যায় । তাঁর সাথে পুতুলের স্বামীর একটা আলাদা সম্পর্ক তৈরি হয় এবং তাঁকে বিয়ে করে। যে মহিলা পুতুলের স্বামীকে বিয়ে করলো সে কিন্তু পুতুলের সাম্পর্কে সব কথাই জানতো। পুতুলের বাচ্চাদের ব্যাপারে ও জানতো। এমনকি পুতুলের স্বামী যে আবার দ্বিতীয় বিয়ে করেছে একথা তাঁর শাশুরী, জায়েরা এবং তাঁর ননদ-নন্দাই ও জানতো।

জেনে শুনে সবাই চুপ করে থাকলো ওদিকে নিষ্পাপ পুতুল ও তাঁর সন্তানেরা বুঝতেই পারলো না যে তাঁদের জীবনে কালবৈশাখী ঝড় শুরু হয়ে গেছে। ১ বছর পর যখন পুতুলের স্বামী গ্রামে আসলো তখন পুতুল লক্ষ্য করল তাঁর স্বামী আর আগের মতো নেই। তাঁর এবং তাঁর বাচ্চাদের নাম ও নেয় না। সরাসরি তাঁর মায়ের ঘরে উঠে যায় ওখানেই থাকে এবং খাওয়া দাওয়া শুরু করে। ছোট ছোট বাচ্চারা বড় আশা নিয়ে বসে থাকে কখন বাবা আসবে আদর করে কোলে তুলে নেবে। বাবা আদর করে চুমু দিয়ে চকলেটের প্যাকেট টা হাতে তুলে দিবে, সে আসাতেই থাকে বাচ্চা দুটো। পরদিন যখন বাবা দেখা করতে আসলোই না তখন ছেলে বাবাকে বাবা বলে ডাকলো বললো,“বাবা আপনি খাবেন চলেন”। ছেলের জবাবে বাবা বললো,“ আমাকে বাবা বলো না, “আমি তোমার আংকেল।” ছেলে খুব বুদ্ধিমান তাই কিছু না বলে চলে গেল। ছেলে এটা বুঝতে পারলো যে তার বাবা আংকেল মানে বহুদূর চলে গেছে।

মরে গেলে যেমন মানুষ আর কোন দিন চলে আসে না, ঠিক তেমনি তাঁর বাবার দেহটা এখানে আছে ঠিকই কিন্তু তাঁর আত্মাটা দেহ থেকে অনেক দূরে চলে গেছে। খুব দ্রুত চলে গেল এবং মাকে এ কথাটা বলল, বুদ্ধিমান ছেলের বুদ্ধিমতী মা এ কথাটার মানেটা আগেই বুঝতে পেরেছিল। এভাবে ২ বছর পার হয়ে গেলো পুতুলের স্বামী আর আসে না। কোন কিছু দেওয়া তো দূরের কথা কোন খোজ খবরই নেয় না। যতদিন যায় পুতুলের মন এবং শরীর দুটোই খারাপ অবস্থা ধারণ করে। পুতুলের মেয়েটার বয়স যখন তিন তাঁর ছেলের বয়স আট বছর। মেয়েটা তো ভালো মন্দ বুঝতে শেখেনি। কিন্তু ছেলেটা খুব বুদ্ধিমান ছিলো সব কিছু বুঝতে পারতো। তাঁর বাবা যখন তাঁদের বাড়িতে আসতো তখন রান্না করা খাবার এবং সংসারের যাবতীয় জিনিস পত্র বাইরে ছিটকে ফেলে দিতো এবং ভাংচুর করতো।

এটা দেখে ছেলের বুক ধরফড় করতো থাকতো এবং ভয়ে থাকতো তাঁর বাবা তাকে না আছাড় মেরে ফেলে দেয়। এদিকে পুতুল এই রকম অশান্তি দেখে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকতো। এই দুরবস্থা প্রতি মাসেই হতে প্রায় এক বছর চলতে থাকে। মাঝে মাঝে পুতুল নিশ্চুপ হয়ে থাকে এবং মনে মনে ভাবে এইতো জীবন। জীবন মানে বেঁচে থেকে মরন যন্ত্রণা ভোগ করা। এই ভোগটা না জানি কতকাল আমাকে সহ্য করতে হবে। এভাবে আর জীবন চলে না। পুতুল ঠিকমতো খায় না। গোসল করে না, মন মরা হয়ে শুধু কি যেন চিন্তা করে।

এটা দেখে পুতুলের ছেলে বলে, “মা তুমি চিন্তা করো না। আমি বড় হয়ে তোমার সব দুঃখ ভুলিয়ে দেব। তোমাকে আমি নতুন শাড়ি কিনে দেব। তোমার মাথার তেল, সাবান কিনে দেব তুমি আর কোন চিন্তা করোনা।” ছেলের কথা শুনে মায়ের সব দুঃখ দূর হয়ে যায়। মা আবার ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে সব দুঃখকে জয় করে বাঁচার শক্তি টুকো আবার ফিরে পায়। মা ভাবে হয়তো স্বামী দিয়ে সুখ হবে না, কিন্তু ছেলে দিয়ে হবে। এটা মনে মনে ভাবে আর দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

কিছুদিন ভালোভাবে ছেলে মেয়েকে নিয়ে সুখে কাটে আবার অভাব এসে ঘরের দরজায় যখন কড়ানারে তখন আবার পুতলের জীবনটা দূর্বিসহ হয়ে উঠে। পুতুল মনে দুঃখ কষ্ট চাপা রেখে নতুন উদ্যেমে শরীরের সবটুকো শক্তি দিয়ে সংসারের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। যেমন গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগী এবং জমি চাষ করতে। মাঝে মাঝে কাজ করতে করতে পুতুল শক্ত মন আবার নরম হয়ে হাত ফষকে কাজগুলো হাত থেকে মাটিতে পড়ে যায়। আবার ও হাতটা মুছে, চোখ দুটো মুছে কাজে লেগে পড়ে। এভাবে জীবনের সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকে পুতুল।

কিন্তু এই জীবনের প্রতিটি মুর্হূতে তাঁর শত্রুরা ছায়ার মতো লেগে থাকে। তাঁর শত্রুরা ভাবে এভাবে ছেলেটাকে কষ্ট করে মানুষ করতে পারলেই তো পুতুলের সব দুঃখ দূর হয়ে যাবে। কিন্তু তা হতে দেওয়া যাবে না। পুতুলের ঘর ভেঙেছি কিন্তু বাড়ি ছাড়া করতে পারিনি। এবার বাড়ি ছাড়া, ঘর ছাড়া করবো পুতুলকে। একদিন হঠাৎ করে পুতুল সন্ধ্যা বেলা মাথা ঘুরে পড়ে থাকে অজ্ঞান হয়ে। এ অবস্থায় পুতুলের ছেলে কোন কূল কিনারা খুজে পায় না। সে এদিক দৌড়ায় ও দিক দৌড়ায় কোথায় যাবে, কার কাছে যাবে ভেবে না পেয়ে চাচার কাছে যায় এবং বলে চাচা আমার মা ভীষণ অসুস্থ ডাক্তার ডাকতে হবে। চাচা তখন তার কথা শুনে ডাক্তার আনতে যায়। ডাক্তার এসে পুতুলের প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পর পুতুল একটু সুস্থ হয়।

ডাক্তার তাঁকে রেষ্টে থাকতে বলে চলে যায়। পরদিন সকালে পুতুলের মা মেয়ের অসুস্থতার খবর পেয়ে দেখতে আসে। নাতি-নাতনী তাঁর নানিকে দেখে খুব খুশি হয় এবং সব ঘটনা খুলে বলে। এভাবে প্রায় এক সপ্তাহ সে ওখানে মেয়ে ও নাতি নাতনির দেখাশুনা করার জন্য থেকে যায়। পুতুল একটু সুস্থ হলে পুতুলের মা মেয়েকে বলল, “মা রে তোমার দুটো চাঁদের মতো নিষ্পাপ সন্তান আল্লাহ দান করেছেন। ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে এবং ওদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তোমাকে বেঁচে থাকতে হবে। তোমার মনকে আরো শক্ত করতে হবে। তোমার মন খারাপ থাকলে ওরা যে কষ্ট পাবে।”

পুতুলের মায়ের কথা শুনে পুতুল পিছন ফিরে না তাকিয়ে ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে মনকে শক্ত করার চেষ্টা করে কিন্তু মন সে আর বাধা মানে না, শক্ত থাকতে চায় না। তাঁর অন্তর যে ভেঙ্গে চুর্মার হয়ে গেছে। তাঁর স্বামী যে তার এবং সন্তানদের থেকে অনেক দূরে চলে গেছে সেটা সে স্পষ্ট করে বুঝে গেছে। পুতুলের মা বাড়িতে চলে যাওয়ার সময় তার শাশুড়ি বলল, আপনার মেয়েকে নিয়ে যান। আবার অসুস্থ হলে কিংবা কোন খারাপ কিছু হলে আমরা দায়ি থাকবো না। একথা শুনে পুতুলের মা মেয়ের কথা ভেবে মেয়েকে, নাতি-নাতনী সহ নিজের সাথে নিয়ে গেল।

পুতুল তাঁর বাবার বাড়িতে চলে গেল এবং বেশ কয়েকদিন ওখানে থাকলো। এরই মধ্যে পুতুলের স্বামী এসে ঘরের দরজায় বড় দুইটা তালা ঝুলিয়ে গেছে। পুতুল কিছু দিন পর বাচ্চাদের সাথে করে আবার যখন নিজের বাড়িতে আসলো, দেখলো তাঁর দরজায় যে তালা ঝুলিয়ে গেছে তাঁর ভিতর দিয়ে তার স্বামী আরো বড় দুইটা তালা ঝুলিয়ে গেছে। তাই সে ঘরের ভিতরে ঢুকতে পারল না। তাঁর শাশুড়িকে একথা জানাতেই তার শ্বাশুরী বলল, “তোমার তো এ বাড়ীতে থাকার কোন অধিকার নেই। আমার ছেলে তো তোমার সাথে সংসার করবে না। তুমি ফিরে যাও” তাঁর স্বামী তাঁকে ছেড়ে অনের দূরে চলে গেছে, এটা সে আগেই বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু তাঁকে যে সংসার ছেড়ে একেবারে চিরদিনের জন্য চলে যেতে হবে সেটা তাঁর ধারণা ছিলো না।

সে শুধু তাঁর সংসারের মায়ায় আবদ্ধ ছিলো। কত কষ্ট করে তিলে তিলে গুছিয়ে রেখেছে সংসারটাকে। অনেক যত্ন করে, পরিশ্রম করে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সংসারটাকে বড় করেছে সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছে। সংসারের মায়া সে ছাড়তে পারে না বারবার বাড়ির দিকে ঘরের দিকে তাঁর হাত দিয়ে লাগানো ফুল, ফল ও সবজির বাগানের দিকে তাকিয়ে থাকে আবাক চোখে। তাঁর ভরা সংসারটা ভরাই থাকলো শুধু থাকলো না পুতুল নামের মা ও তাঁর দুটো মিষ্টি সন্তানেরা। বড় এই বাড়ীতে সবার জায়গা হলো, শুধু একটু জায়গা হলো না পুতুল ও তাঁর দুটো মিষ্টি বাচ্চাদের।

পুতুল নিরুপায় হয়ে তার সন্তানদের বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে চলে গেল চিরদিনের জন্য ও বাড়ি ছেড়ে। তাঁর হৃদয়ে যে কাল-বৈশাখী ঝড় উঠেছিল সেই ঝড়ে তার সবকিছু এক নিমিষেই ভেঙ্গে চুর্মার হয়ে গেলো। সে নিঃস্তব্ধ হয়ে বোবার মতো কাউকে কিছু না বলে বাচ্চাদের নিয়ে চিরদিনের জন্য চলে গেল “শ্বশুরবাড়ী” নামক বাড়ি থেকে। এবার তাঁর নতুন বাড়ি বাপের বাড়িতে গিয়ে উঠলো এবং মায়ের সাথে বাচ্চাদের নিয়ে নতুন ভাবে জীবন চালাতে লাগলো।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
গৃহিণী এবং কর্মজীবি
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!