‘বিজয়িনী নাই তব ভয়’- প্রসঙ্গ লীলা নাগ

কৃষ্ণা গুহ রায়
কৃষ্ণা গুহ রায়
6 মিনিটে পড়ুন

লীলা নাগ (১৯০০-১৯৭০) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী, পূর্ব বাংলার নারী শিক্ষা ও নারী আন্দোলনের পথিকৃৎ। আসামের গোয়ালপাড়ায় ১৯০০ সালের ২১ অক্টোবর জন্মগ্রহণকারী লীলা নাগ ছিলেন একজন বেসামরিক কর্মকর্তার কন্যা এবং তাঁর পরিবারবর্গ ছিলেন সিলেটের এক সংস্কৃতিমনা ও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্য। কলকাতার বেথুন কলেজ থেকে তিনি ইংরেজিতে অনার্সসহ স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন এবং তাঁর শিক্ষাগত সাফল্যের জন্য (তিনি পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করেন) তাঁকে ‘পদ্মাবতী’ স্বর্ণপদক প্রদান করা হয়। তাঁর বাবাকে ঢাকায় বদলি করা হলে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং ১৯২৩ সালে ইংরেজিতে এম.এ ডিগ্রি অর্জন করেন।

লীলা নাগ একজন সক্রিয় বিপ্লবী ও আন্দোলনকারী। তিনি শিক্ষা-সংক্রান্ত সংস্কারক হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। ছাত্রাবস্থায়ই তিনি এই সকল সংগঠনের কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়েন। নারীদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকারের ব্যাপারে জনমত গড়ে তুলতে ‘ নিখিল বঙ্গ নারী ভোটাধিকার সমিতি’র যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে লীলা নাগ বিভিন্ন জনসভার আয়োজন করেন। ১৯২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে নারীশিক্ষা প্রসারের মূল উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি ‘দীপালি সঙ্ঘ’ নামে নারীদের একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। দীপালি সঙ্ঘের সাহায্য নিয়ে তিনি “দীপালি স্কুল” নামে একটি স্কুল ও অন্য বারোটি ফ্রি প্রাইমারি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি নারীশিক্ষা মন্দির ও শিক্ষাভবন নামে পরিচিত অন্য দুটি স্কুলও প্রতিষ্ঠা করেন। মুসলমান নারীদের শিক্ষায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ঢাকায় তাঁর প্রতিষ্ঠিত একটি স্কুল পরবর্তীকালে কামরুন্নেসা গার্লস স্কুল হিসেবে পরিচিত হয়।

লীলা নাগ যখন ঢাকা কলেজে পড়তেন। তার এক ক্লাস উপরের ছাত্র ছিলেন সাহিত্যিক কাজী মোতাহার হোসেন। লীলা নাগ সম্পর্কে তিনি তার স্মৃতিকথা নামক প্রবন্ধ সংকলনে লেখেন, “এঁর মত সমাজ-সেবিকা ও মর্যাদাময়ী নারী আর দেখি নাই। এঁর থিওরী হল, নারীদেরও উপার্জনশীলা হতে হবে, নইলে কখনো তারা পুরুষের কাছে মর্যাদা পাবে না। তাই তিনি মেয়েদের রুমাল, টেবলক্লথ প্রভৃতির উপর সুন্দর নক্সা এঁকে বিক্রয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন। এই সব বিক্রি করে তিনি মেয়েদের একটা উপার্জনের পন্থা উন্মুক্ত করে দেন৷”

১৯২৫ সালে শ্রীসঙ্ঘ নামে অভিহিত একটি বিপ্লবী দলের তিনি সদস্য হন। ছাত্রীদের জন্য তিনি ঢাকাভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন এবং আসাম ও বাংলার অনেক স্থানে এর শাখা প্রসারিত করেন। ছাত্রীদের সুবিধার জন্য তিনি কলকাতায় একটি মহিলা হোস্টেল প্রতিষ্ঠা করেন। ঢাকায় গোপন বিপ্লবী দলের (এগুলির মধ্যে অনুশীলন সমিতি ও যুগান্তর সুবিদিত) সদস্য হিসেবে লীলা তাদের সাহায্য করতেন এবং এই দলসমূহ বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের, বিশেষত নারী বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে সংযোগকারী হিসেবে কাজ করতেন। প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের মত সুপরিচিত নারী বিপ্লবীদের প্রেরণার উৎস হিসেবে তিনি প্রভাব রেখেছেন।

১৯২৭-২৮ সালের বিক্ষুব্ধ বছরগুলিতে, যখন নারীরা শারীরিক আক্রমণের লক্ষ্যে পরিণত হয়, তখন লীলা নাগ মহিলা আত্মরক্ষা ফান্ড নামে একটি ফান্ড গঠন করেন, যা ছিল এই অঞ্চলে প্রথম মার্শাল পদ্ধতিতে আত্মরক্ষামূলক দলের একটি। সাধারণ জনতার পর্যায়ে নারী শিক্ষা বিস্তারের জন্য তিনি গণ শিক্ষা পরিষদ নামে পরিচিত একটি প্রতিষ্ঠানও গঠন করেন।

লীলা অন্য যে কারণে বিখ্যাত তা হল নারীদের বিচার্য বিষয়াবলিতে নিবেদিত প্রভাবশালী সাময়িক পত্রিকা ‘ জয়শ্রী’ র সম্পাদক হিসেবে তাঁর সাহিত্যিক কার্যক্রম। নারীদের দ্বারা স্বতন্ত্র্যভাবে পরিচালিত এই সাময়িক পত্রিকাটি নারী কর্তৃক লিখিত নিবন্ধাবলি প্রকাশ করত।

কয়েকজন শিক্ষিত মহিলা ঢাকা শহরে বসে মহিলাদের একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশে উদ্যোগী হন লীলাবতী নাগের নেতৃত্বে। নাম বেছে দিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯৩১-এর মে মাসে ‘জয়শ্রী’ প্রকাশ পেল। প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন নন্দলাল বসু । নন্দলালের আঁকা ছবিও এখানে প্রকাশিত হয়েছে ‘চাই দই’। মহিলাদের কথা উল্লেখ করা হলেও পত্রিকা প্রকাশের আসল উদ্দেশ্য ছিল অন্য। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের পর বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের উপর রাজরোষ বেড়েই চলেছিল। সেই সময় বিপ্লবী সংগঠনকে আদর্শের পথে একনিষ্ঠ রাখতে, তার চারপাশে সহানুভূতি ও সহমর্মিতার পরিমণ্ডল সৃষ্টি করতেই ‘জয়শ্রী’র জন্ম। পত্রিকাটিকে আশীর্বাদ জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘বিজয়িনী নাই তব ভয়।’

আট দশক পেরিয়ে চলা এই পত্রিকা স্বাভাবিক ভাবেই ব্রিটিশ শাসকের রোষ এড়িয়ে যেতে পারেনি। তিন-তিন বার পত্রিকার প্রকাশ বন্ধ করা হয়। একই আদর্শ নিয়ে প্রকাশিত ‘যুগান্তর’ এবং ‘বন্দেমাতরম’ বহু কাল আগে বন্ধ হয়ে গেলেও ‘জয়শ্রী’ আজও প্রকাশিত হচ্ছে। হেমচন্দ্র ঘোষ, ভূপেন্দ্রকিশোর রক্ষিতরায়, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, বীণা ভৌমিক, কমলা দাশগুপ্ত, নলিনীকান্ত গুপ্ত, শান্তিসুধা ঘোষ-সহ বহু বিশিষ্ট বিপ্লবী এই পত্রিকায় স্মৃতিকাহিনি লিখেছেন। কালীচরণ ঘোষের বিখ্যাত বই জাগরণ ও বিস্ফোরণ ‘জয়শ্রী’তেই ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়। আবার রমেশচন্দ্র মজুমদার, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, বিনয় সরকার, প্রেমেন্দ্র মিত্র, জীবনানন্দ দাশের মতো অনেকেই এই পত্রিকার জন্য কলম ধরেছেন। রবীন্দ্রনাথের বেশ কয়েকটি কবিতা ‘জয়শ্রী’তে প্রকাশিত হয়। দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বরলিপি-সহ ‘সঙ্কোচের বিহ্বলতায়’ গানটিও এখানে ছাপা হয়। ‘জয়শ্রী’র সুবর্ণ জয়ন্তী সংখ্যাটি আজ সংগ্রাহকের সম্পদ। এ ছাড়া বহু বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করেছে ‘জয়শ্রী’। প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক লীলা নাগ (পরে রায়) প্রয়াত হওয়ার পর ১৯৭০ থেকে আমৃত্যু পত্রিকা সম্পাদনা করেন বিপ্লবী সুনীল দাস।

লবণ সত্যাগ্রহের একজন সক্রিয় অংশগ্রহণকারী হিসেবে লীলা ঢাকা মহিলা সত্যাগ্রহ কমিটি গঠন করেন। শ্রীসঙ্ঘের প্রধান অনিল রায়ের গ্রেফতারের পর এই সংগঠনটির পরিচালনার দায়িত্ব লীলা নাগের উপর ন্যস্ত হয়। ১৯৩১ সালের ২০ ডিসেম্বর তাঁকে গ্রেফতার করে বিনা বিচারে কারাগারে প্রেরণ করা হয়।

১৯৩৯ সালে লীলা নাগ অনিল রায়কে বিয়ে করেন। এই দম্পতি নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর দলে যোগদান করে ফরওয়ার্ড ব্লক গঠন করেন। ১৯৪০ সালের জুলাই মাসে কলকাতার হলওয়েল মনুমেন্টের বাহ্যিক আকৃতি নষ্ট করার দায়ে লীলা নাগ ও অনিল রায়কে অভিযুক্ত করা হয় এবং পুনরায় তাঁদেরকে কারাদন্ড দেওয়া হয় এবং ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত আটক রাখা হয়। কারামুক্তির পর তাঁকে নেতাজীর দলের সাপ্তাহিক মুখপত্র ফরওয়ার্ড ব্লক-এর সম্পাদনার দায়িত্বভার গ্রহণ করতে হয়। পরবর্তীকালে ভারত ভাগ হবার পর তিনি পশ্চিম বাংলায় চলে আসেন এবং ভারতীয় জাতীয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন।

১৯৪৬ সালে তিনি বাংলা থেকে ভারতীয় গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং ভারতীয় শাসনতন্ত্রের খসড়া তৈরিতে অবদান রাখেন। ১৯৪৬ সালের কলকাতা দাঙ্গা ও নোয়াখালী দাঙ্গার পর তিনি নোয়াখালীতে দাঙ্গায় ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের ত্রাণকার্যে অংশগ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে ‘ন্যাশনাল সার্ভিস ইনস্টিটিউট’ নামক একটি জনকল্যাণমূলক সংগঠনও তিনি স্থাপন করেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি পরিপূর্ণ, সক্রিয় জীবনযাপন করেন।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

বিষয়:
এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
নিবাস -পশ্চিমবঙ্গ, ভারত ৷ সন্দেশ, নবকল্লোল, শুকতারা, বাংলাদেশের বিভিন্ন পত্রিকায় লেখা প্রকাশিত হয়েছে৷ কবিতা সঙ্কলন তিনটি, তার মধ্যে একটি বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত হয়েছে৷ বর্তমানে আমেরিকা, অষ্ট্রেলিয়া, কানাডা , বাংলাদেশ এবং ভারতের বিভিন্ন ওয়েবজিনে লেখার সঙ্গে যুক্ত৷ কলকাতা স্বপ্নরাগ পরিবার নামে একটি সাহিত্য, সংস্কৃতি, সমাজ সেবা মূলক প্রতিষ্ঠানের সম্পাদক৷
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!