নেহায়েত ভুল থেকেই সৃষ্টি নাটোরের কাঁচাগোল্লা মিষ্টি

মাহাবুব খন্দকার
মাহাবুব খন্দকার - নাটোর প্রতিনিধি
4 মিনিটে পড়ুন

কথিত আছে অর্ধবঙ্গেশ্বরী মহারানী ভবানীর শাসনামলে, একটি ভুল থেকে উৎপত্তি হয় এই কাঁচাগোল্লার। তৎকালীন সময়ে নাটোরের একমাত্র বাজার ছিল লালবাজার।সেই বাজারে সব ধরনের পণ্য ক্রয়-বিক্রয় হত।

আর এই লালবাজারে বেশ কয়েকটি মিষ্টির দোকানের মধ্যে একটি দোকান ছিল মধুসূদন পাল’এর। মধুসূদন পালের দোকান ছিল নাটোরের প্রসিদ্ধ মিষ্টির দোকান। তার দোকানে বেশ কয়েকটি বড় বড় চুলা ছিল।

মধুসূদন এসব চুলায় দেড় থেকে দুই মণ ছানা দিয়ে রসগোল্লা, পানতোয়া, চমচম, কালোজাম প্রভৃতি মিষ্টি তৈরি করতেন। দোকানে কাজ করতেন ১০-১৫ জন কর্মচারী। একদিন তার মিষ্টির দোকানের কারিগর আসেনি।

মধুসূদনের তো মাথায় হাত ! এত ছানা এখন কী হবে? এই চিন্তায় তিনি অস্থির। নষ্টের হাত থেকে রক্ষা পেতে ছানাতে তিনি চিনির রস ঢেলে জ্বাল দিয়ে নামিয়ে রাখেন। এরপর মুখে দিয়ে দেখা যায় ওই চিনি মেশানো ছানার দারুণ স্বাদ হয়েছে। নিতান্তই দায়ে পড়ে তৈরি হওয়া এই মিষ্টি।

নতুন মিষ্টির নাম কী রাখা হবে? এ নিয়ে শুরু হয় চিন্তাভাবনা। যেহেতু চিনির রসে ডোবানোর পূর্বে ছানাকে কিছুই করতে হয়নি অর্থাৎ কাঁচা ছানাই চিনির রসে ঢালা হয়েছে তাই তার নামকরণ হয় কাঁচাগোল্লা। নাটোরের কাঁচাগোল্লার কথা ইতিহাসে পাওয়া যায়।

সুপ্রাচীন কাল থেকে মিষ্টি রসিকদের রসনা তৃপ্ত করে আসছে এই মিষ্টি। ১৭৫৭ সাল থেকে এই মিষ্টি ব্যাপকভাবে পরিচিতি লাভ করে। কাঁচাগোল্লার স্বাদ রসগোল্লা, পানতোয়া, এমনকি অবাক সন্দেশকেও হার মানিয়ে দেয়। এর রয়েছে একটি মিষ্টি কাঁচা ছানার গন্ধ, যা অন্য কোনো মিষ্টিতে পাওয়া যায় না।

ধীরে ধীরে মিষ্টি রসিকরা এই মিষ্টির প্রতি আকৃষ্ট হতে থাকেন। তখন থেকে মধুসূদন নিয়মিতই এই মিষ্টি বানাতে থাকেন। কাঁচাগোল্লার সুখ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। কাঁচাগোল্লার চাহিদা বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে মধুসূদন পালের দোকানে প্রতিদিন তিন থেকে সাড়ে তিন মণ ছানার কাঁচাগোল্লা তৈরি হতে লাগল।

সে সময় ঢোল বাজিয়ে জানানো হতো কাঁচাগোল্লার কথা। তারপর আশেপাশের দোকানদাররাও তৈরি শুরু করলেন এই কাঁচাগোল্লার। ১৭৬০ সালে অর্ধবঙ্গেশ্বরী বাংলার দানশীলা শাসনকর্তা রানী ভবানীর রাজত্বকালে কাঁচাগোল্লার সুখ্যাতি দেশ-বিদেশে ছড়াতে থাকে।

সেই সময় নাটোরে মিষ্টির দোকান ছিল খুবই কম। এসব দোকানে বিখ্যাত কাঁচাগোল্লা ছাড়াও অবাক সন্দেশ, রাঘবশাহী, চমচম, রাজভোগ, রসমালাই, পানতোয়া, প্রভৃতি মিষ্টি ছিল অন্যতম। তবে এর মধ্যে সবার শীর্ষে উঠে আসে কাঁচাগোল্লা।

ফলে সে সময় রাজা-জমিদারদের মিষ্টিমুখ করতে ব্যবহৃত হতো এই বিখ্যাত কাঁচাগোল্লা। এমনকি বিলেতের রাজপরিবারেও এই কাঁচাগোল্লা যেত। আরো যেত ভারতবর্ষের সর্বত্র। রাজশাহী গেজেট পত্রিকাতেও কাঁচাগোল্লার সুখ্যাতির কথা বলা হয়েছে।

কলকাতার বিভিন্ন পত্র-পত্রিকাতে সেই সময় কাঁচাগোল্লার সুখ্যাতি নিয়ে লেখালেখি হয়েছে। কলকাতা এবং নাটোর শহর একই সময় প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় ও এই দুই শহরের ঘনিষ্ঠ সর্বক্ষণিক যোগাযোগ থাকায় ভারত, ইংল্যান্ডসহ তৎকালীন বিভিন্ন রাষ্ট্রে নাটোরের কাঁচাগোল্লার কথা ছড়িয়ে পড়ে।

এভাবেই কাঁচাগোল্লা পায় আন্তর্জাতিকতা। বর্তমানে নাটোর জেলার সকল মিষ্টান্ন ভান্ডার, হোটেল-রেস্তোরাঁ সহ ফুটপাতেও বিক্রি হয় ঐতিহ্যবাহী এই কাঁচাগোল্লা।এমনকি রাজধানীসহ দেশের অন্যান্য জেলাতেও ছড়িয়ে পড়েছে কাঁচাগোল্লা তৈরীর কারিগর।

খাঁটি দুধের ছানা ও চিনি কাঁচাগোল্লা তৈরির প্রধান উপাদান। ১ কেজি কাঁচাগোল্লা তৈরি করতে প্রায় ১ কেজি কাঁচা ছানা ও ৪০০ গ্রাম চিনির প্রয়োজন। কড়াইতে চিনিগুলো পানিসহ জ্বাল দিতে হয়। চিনি পরিষ্কার করতে সামান্য কাঁচা দুধ দিতে হয়। কড়াইয়ের গাদ ময়লা পরিষ্কার হয়ে গেলে কড়াইয়ে ছানা ঢেলে দিতে হয়।

এরপর জ্বাল এবং একই সঙ্গে কাঠের খড়া দিয়ে নাড়তে হয়। এভাবেই ৩০ থেকে ৪০ মিনিট ধারাবাহিকভাবে নাড়তে নাড়তেই পরিপূর্ণ কাঁচাগোল্লা তৈরি হয়ে যাবে। তবে এই নাড়াচাড়ার মধ্যেই রয়েছে শৈল্পিক কৌশল। মোটামুটি এই হচ্ছে ১ কেজি কাঁচাগোল্লার হিসাব।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
লেখক: মাহাবুব খন্দকার নাটোর প্রতিনিধি
সাংবাদিক এবং লেখক
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!