কবি ভাস্কর বাগচীর ছ‘টি কবিতা

ভাস্কর বাগচী
ভাস্কর বাগচী
6 মিনিটে পড়ুন

দিনান্ত

দিনান্তের মধুর যামিনীর কোলে
মাথা রেখে এবারে মত শরত নিরঞ্জিত,
শিউলীফোঁটা কমে এসেছে,
বাবুদের ছাদের ঝুলন্ত বাগানে
কিংবা প্রশস্ত উদ্যানে শোভা বর্ধন করছে,
কচমচ, লিলি, চন্দ্রমল্লি্কা, আগুণ গাঁদা
আরো কত বাহারী ফুল!
বছরের উজ্বলতম ভানুর আলোয়
ঘুম ভেঙ্গেছে হেমন্তের,
সকালের হিমেল হাওয়ায় উতল হয়ে উঠে
শামল নবঘন শষ্যালয়,
হটাৎ দমকা হাওয়া মনে করিয়ে দিয়ে যায়
সৈই খেজুরের রসের ঝুলন্ত হাড়ীতে
পাটকাঠি ডুবিয়ে চুরি করে খাওয়ার কথা!
কোজাগরী পূর্নিমায় পরদিন
থেকে চলতো নারায়ণলীলা!
পক্ষকাল বাদেই দীপাবলীতে
শ্যামার গুনগানে আর প্রদীপে আলোয় আলোয়
মুখরিত চারিদিক মনে হত
বাঙালপাড়া বুঝি উৎসবে উৎসবে পাগলাপাড়া!
প্রজন্মা ভারী গলায় বলেছিল আচ্ছা সখা,
সারা বছর এমন কেন থাকেনা?
বলেছিলাম দূর আজগুবি সব কথা তোরলো সখী!
প্রজন্মা আর এখানে থাকে না ওরা ওপাড়ে চলে গেছে!
কোথায় থাকে কে জানে?
কিন্তু আজের হেমন্ত গুলি সৈই হৈমন্তিক সরলতা
নাড়া দিয়ে বলে যায়; বাবু,
সেই কি ভাল ছিলনা আজ যা নাই!

সেই চঞ্চল বেলা

প্রতিমাগুলোতে তুলির শেষ আঁচড় পড়ছে!
ঘরামি নতুন কাঁচা বাঁশ দিয়ে মণ্ডপ তৈরীতে শশব্যস্ত!
দুর্গাপুজার দিনগুলি কিভাবে কাটবে!
কল্পনা বিলাসী চিন্তায় মগ্ন থাকতাম!
সজ্জাকর নবনতুন নকশায় মণ্ডপগুলোকে
শৈল্পকতার নান্দনিক সৌন্দর্যে ভরিয়ে দিত!
আজ ধনাঢ্য বন্দনার প্রশশ্তি প্রিয় যুগে ঐ সব
আবেগ গুলি হয়ে পড়ছে বিরলপ্রজ!
কার জামা কি রং,
নতুন বেল্ট হয়েছে কিনা এসব
সারহীন সরল সরল আড্ডালাপ ছেড়ে,
কখন যে, আমিই দায়িত্ব পরায়ন হয়ে গেছি!
তার হিসাব করে সময় মিলাতে পারিনি।
মহালয়ার সকালে গরম গরম খেচুরির স্বাদ
মনকে আজও আন্দোলিত করে।
পুজা আসছে, পুজা আসছে এমন দিনগুলির
ভিতরই বোধ হয় আনন্দরা লুকায়িত থাকতো।
তবুও বছরে পর বছর পুজা আসে,
নব নবীনকে স্বাগত জানাতে! নতুন স্মৃতি!
আর নতুন ঘটনার জন্ম দিতে!…

শারদীয়া

বাঙালির হৃদয় মৃদঙ্গ ঢাক-কাসোর এর অমিয় ধ্বনি,
সাথে শরতের নীলাম্বরী মেঘের অনন্য প্রাকৃতিক প্রচ্ছদ
আর শিউলির মন আনচান করা কাচা সুগন্ধিত মৃদুল সমিরণে
ধরাতল হয়ে যায় উৎসবলোক!
শারদচারিণী উমা আদি মন্ত্রের আকুল ডাকে
কৈলাশ থেকে নেমে আসেন গাঙ্গেয় তটে।
যুগে যুগে গাঙ্গঋক থেকে বাঙালি হয়ে ওঠা
পুরবাসী নিজেদের হারিয়ে ফেলে,
দেবী পক্ষের অপ্রাকৃত মাদকতায়!
নিস্ব থেকে ধনাঢ্য শারদীয়া উৎসব
মহিমায় সকলে হয়ে উঠেন সর্বজনীন!
বোধন থেকে মহা সন্ধির মাঙ্গলিক
ক্রীয়ার অপার করুণার আকুতিতে,
সদাপ্রসন্না প্রসন্নময়ী হয়ে বসুন্ধরাকে করেন সুনির্মল।
দশমীর করুণ সুরের বিদায় মন্ত্রে,
সজল নয়নে তিনি হাসিমুখে ছিন্ন বস্ত্রের
আচল ছোঁয়া অভয় আশ্বাস দেন।
আমি তো সকল মায়ের মাঝে
বিরাজিতা তোদের মা, মা দূর্গা!
চিরকালের দূর্গতি নাশিনী।

ভাদ্রের শেষে!

স্বর্গীয় শিল্পীর আরাধনার মধ্যে ভাদ্রের শেষ হয়!
হটাৎ আশ্বিন, কাশ, খন্ড মেঘগুলি খুশির
জোয়ারে সবাইকে ভাসিয়ে দেয়!
পাড়ায় পাড়ায় চলে বাঁশ দড়ি থান কাপড় দিয়ে
কৃত্রিম মন্ডব তৈরী!
ভাস্করগন চিন্ময়ীকে মায়াময় মৃন্ময়ী করতে
রঙতুলির শেষ আঁচার আঁকতে ভীষন ব্যস্ত!
আমি আর প্রতিমা রোজ সকালে
নলীনি স্যারের কাছে পড়তে যেতাম,
পথে পালবাড়ী কিংবা মণ্ডপের ভিতর
ভাস্করদের প্রতিমাগুলো দেখতাম,
কি আসাধারন ভাবে একটু একটু করে
তা মুর্ত হয়ে উঠছে বাঙালীর দূর্গা, লক্ষী, সরস্বতী, কার্ত্তিকে…..
প্রতিমাকে একদিন বলেছিলাম,
তোর মুখটা দূর্গার মতো! প্রতিমা হেসে বলেছিল,
তোর মুখটা শিবের মতো!
সে কথায় লাজুক আমি লজ্বায় বাকরুদ্ধ!
শরতের বাতাসে কেমন যেন!
একটা উৎসব উৎসব গন্ধ থাকে,
সজ্জাশিল্পীদের রাতের মনমুগ্ধ অবাক করা
আলোক সজ্জা! দেখতে রিক্সা চড়ে আমি
আর প্রতিমা যখন প্যন্ডেলে প্যন্ডলে ঘুরে
বেড়াতাম মনে হত আমার মত সুখী আর কে আছে?
বাতাস প্রতিমার শ্যম্পু করা এলোচুল
আমার মুখের উপর আচমকা ঝাপটা দিয়ে যেত!
তখন শরীর মনে এক স্বর্গীয় শিহরণ বহে যেত!
প্রতিমা বলেছিল এমন করে আমি তোর সাথে
সারা জীবন ঘুরতে চাই!
আমি ভীরুতাচ্ছিল্যে বলে ছিলাম দুর পাগলী!
তোর যত আজগুবি কথা, তা হয় নাকি?
কোথায় তুই আর কোথায় আমি!
এসব আপার্থিব সুখগুলি আজ ভীষন মুল্যবান মনে হয়,
সে সময়ের ভীরু তাচ্ছল্য আজ আমাকে অশ্রুবাস্পরুদ্ধ
অসহায় করে শারদ উৎসবের দিনগুলোতে,
মন নিজেই নিজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে বলে,
ফিরিয়ে দাও! আমার সেইসব সরল দিনগুলি,
ফিরে আয় প্রতিমা! চল,
সারা জীবন শরতের বাতাসে ভেসে বেড়াই!

খুব মনে পড়ে!

খুব মনে পড়ে মহালয়ার অরুণাদয়ের কথা,
শরৎ সদ্য ভোরের আলো তাতে মেশানো
থাকত শিউলী আর শারদ উৎসবের গন্ধ!
নব যৌবনের প্রথম প্রেমের অস্হিরতা
কি ভীষণ পাগল করে দিত আমাকে!
আছা! চন্দনা কি আজও শিশির ভেজা শিউলী কুড়ায়!
তার ইষ্টদেবের জন্য মালা গাঁথে?
চিত্রায় মালার ভেলা ভাসায়!
কার্ত্তিক মাসে বৈষ্টম কবিদের সোনার গৌরাঙ্গ
আমার নেচে নেচে যায়রে গানটা আমাকে
আনমনা করে দিত বার বার,
ঈদের দিনে শামীমের মায়ের হাতে
পলান্ন আজও আড়াল থেকে উদ্ভান্ত করে দেয়,
বিজয়া দশমীতে ভুইয়াবাড়ি বসাকবাড়ির
গুড়ের মুরকি, চিনির নাড়্‌ রাতে রায় বাড়ির
আম জলপাই তৈলে আমন ধানের মাখানো
মুড়ি কারাকারি করে খাওয়া আর
হয়তো কোনদিন হবেনা!
তবুও বেঁচে থাকতে হবে এসব স্মৃতির সাথে,
চন্দনার সাধনা সফল হয়নি,
কি তাকে বলতে চেয়েছিলাম ভয়ে ভয়ে
আজ কাল করে আর বলাই হয়নি……,
তবুও এগিয়ে গেছে জীবন নতুন আমি আর চন্দনাদের জন্য।

শৈশব

চার আনা দামের লেমনচুস,
দশ পয়সা দামের সাদা বরফে কত
অকৃত্রিম ছিল আমাদের শৈশব!
গোলাছুট, হাডুডু, বদন, ডাংগুলি,
সাতগুটি, মারবেল,
লুকোচুরি খেলার নির্বাণ নির্ভার দিনগুলি
আমাকে বোকা বানিয়ে কোথায় হারিয়ে গেলে?
লাইলনের সুতায় বোনা টিয়া রং এর একটা স্কুল বাগে
থাকতো মদন মোহন তর্কালংকারের শিশুশিক্ষা,
আমার বাংলা বই, পাথরের শ্লেট,
অ এ অজগর আসছে তেরে/ আমটি আমি খাব পেড়ে!
সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি,
আমি যেন সারাদিন ভাল হয়ে চলি,
সত্যই আজ ভাল হয়ে চলছি?
বানিজ্যিক যুগের দ্রুত অর্থ উপার্জনের
যন্ত্র হবার শিক্ষা আজ আমার প্রজন্মের জন্য!
আজ দোকানে দোকানে ফেরি হচ্ছে শিক্ষা!
মদন বাবু আমরা ভাল হতে চাই,
মুখস্তে নয় মনে প্রাণে,
গুরুজন হিসাবে আমাদের ভাল হবার আরেকটা মন্ত্র দিন!
আমাদের প্রজন্ম না জাগলে কেমন করে রাত পোহাবে?
সকাল হবে! ওরাই তো এদেশের জন্য হাসি মুখে চুপিচুপি
জন্মকে ধন্য করে দিয়েছিল প্রাণ! ওরা জাগলেই
একমাত্র পূর্ণ হতে পারে বাংলার মাটি, জল, বায়ু ফুলফল।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

বিষয়:
এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!