সুখ-দুঃখের ধূসর আলোছায়ায় বেলা অবেলায় মহাপৃথিবীর তিমির নির্জনতায়- কবি জীবনানন্দ দাশ

এ কে এম রেজাউল করিম
এ কে এম রেজাউল করিম
31 মিনিটে পড়ুন

৫৫ বছর বেঁচেছিলেন জীবনানন্দ, হাতে গোনা কয়েকটি প্রবন্ধ বাদে (গ্রন্থকারে) প্রকাশিত তাঁর কবিতার সংখ্যা মাত্র ১৬২টি। তাঁর মৃত্যুর পর, তুতেন খামেনের গুপ্তধনের মতো কালো ট্রাঙ্কের ভেতরে থেকে বেরিয়েছে অজস্র নক্ষত্ররাজি।

এখন তাঁর যে রচনা সমুদ্র আমরা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি, এর আনুমানিক পরিসংখ্যান: কবিতাই প্রায় ৩০০০, গল্প অন্তত ১২০টি, উপন্যাস ২০টি, প্রবন্ধ ৮০টি; এছাড়াও রয়েছে কয়েক খণ্ডে প্রকাশিত হওয়ার পরেও অগ্রন্থিত দিনলিপি এবং লিটারারি নোটস। ২০২০ সালের শেষে এসেও তাঁর অপ্রকাশিত কবিতা ও ডায়েরির ভাণ্ডার শেষ হয়ে যায়নি। এই সমস্ত রচনাই জীবনানন্দ ট্রাঙ্কের ভেতরে লুকিয়ে রেখেছিলেন।

ব্যক্তি জীবনানন্দ দাশের মতো কবি জীবনানন্দ দাশও এক রহস্যময় চরিত্র। আরো রহস্য ভারাতুর তাঁর জীবিতবস্থায় অপ্রকাশিত ডায়েরির হাজার হাজার পৃষ্ঠা।

কবি ও গবেষক গৌতম মিত্র ‘পাণ্ডুলিপি থেকে ডায়েরি: জীবনানন্দের খোঁজে’ নাম ধরে নিষ্ঠা ও পরিশ্রমে জীবনানন্দর ডায়েরির ভেতর-বাহিরের রহস্য উদঘাটন করে চলেছেন নিপুণ দক্ষতায়, বহুদিন ধরে। তারই প্রামাণ্য উপস্থাপন এই বইটি। একই নামে প্রথম খণ্ড আগেই বেরিয়েছে, এটি দ্বিতীয় খণ্ড।

এই বইতে গৌতম মিত্র জীবনানন্দকে লেখক হিসেবে এনসাইক্লোপেডিয়ার সঙ্গে তুলনা করেছেন, কিন্তু এটাও বলে দিয়েছেন, তাঁকে বোঝা এত সহজ নয়। কবিতা-গল্প-উপন্যাসের চরিত্রের মতো জীবনানন্দ নিজেকেও কাঁটাছেড়া করেন। স্ত্রী-পুত্র-কন্যা এমনকি নিজেকেও তিনি ছাড় দেন না এবং বলাই বাহল্য, জীবনানন্দ দাশের লেখাপত্র প্লেটে সাজিয়ে দেওয়া কোনো জিনিসও নয়। তাঁকে বুঝতে হলে ভাবতে হয়। দু কদম হেঁটে একটু মাথা খাটাতে হয়। মাথা খাটাতে গিয়ে ঘামও ঝরতে পারে, কিন্তু ভাবা শেষ হয় না।

পাণ্ডুলিপি থেকে ডায়েরি: জীবনানন্দের খোঁজে’ পড়তে পড়তে মুগ্ধ ও বিস্মিত হয়ে চলি, কত কী নিয়ে ভেবেছেন জীবনানন্দ দাশ নামের মানুষটি। কত রকম জীবন তিনি যাপন করেছেন এবং কতভাবে জীবনকে দেখেছেন। সংসারের প্রয়োজন মেটাতে কতভাবে চেষ্টা করেছেন, তারচেয়েও বিপুলভাবে প্রাণান্ত হয়েছেন লেখা নিয়ে।

সারাজীবন লেখা লেখা লেখা করে যাওয়া আর জীবনে নানাভাবে ব্যর্থ ব্যক্তি জীবনানন্দ আত্মহত্যার কথা ভেবেছেন, বারবার। কিন্তু এত এত লেখার গতি না করে কীভাবে তিনি আত্মহত্যা করবেন? সে জন্য তিনি মরতেও পারছেন না। এমন নানা টুকরো বিষয় ও ভাবনা, ডায়েরির পাণ্ডুলিপি অবলম্বনে লিপিবদ্ধ করেছেন গৌতম মিত্র।

বইটি গবেষণাধর্মী হলেও এর ধাত বা ভঙ্গিটি টীকাজর্জর গবেষকের মতো নয়। পাঠকের হয়ে গৌতম মিত্র নিজেই বইটির একটি সুলভ পঠন-প্রক্রিয়া বা উপায় যেন বাতলে দিয়েছেন। জীবনানন্দ দাশের কবিতা থেকে ডায়েরি এবং ব্যক্তিজীবনের নানা বিষয় ও ভাবনাকে টুকরো শিরোনাম দিয়ে ছোট ছোট গদ্যের শরীরে সেঁটে দিয়েছেন।

এক এক লেখার আয়তন দেড় পৃষ্ঠা, কখনো দুই তিন ও সাড়ে তিন পৃষ্ঠা। পাঁচ পৃষ্ঠা। ফলে পড়তে কোনো একঘেয়েমী আসে না। বিষয়ের ভেতরে ঢুকতে বেগ পেতে হয় না। কিন্তু পড়তে পড়তে হৃদয় জর্জর হয়। আর্ত ও আকুল হয়। এক একটি রচনা পড়াশেষে থম ধরে বসে থাকতে হয়।

৩৩৮ পৃষ্ঠার বইটি একদিনেই পড়ে শেষ করা সম্ভব। কিন্তু এর ভেতরের আলোছায়া, অন্ধকার, হাহাকার, পৃথক শিরোনামে লিখে ওঠা জীবনানন্দ-বিষয়ে পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ এবং বিভিন্ন কোণ থেকে জীবনানন্দর ব্যক্তি ও কবিজীবনের আধো-অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসা প্রায় অসম্ভব।

ভূমিকা বাদে এই বইতে মোট লেখার সংখ্যা ৭১টি। লেখাগুলোর ভরকেন্দ্র ও অভিমুখ জীবনানন্দ। ভূমিকা থেকে শুরু করে প্রতিটি লেখার বিষয় ও ভাবনা স্বতন্ত্র, কিন্তু সব মিলিয়ে ব্যক্তি ও কবি-গল্পকার-ঔপন্যাসিক-ভবুক-দার্শনিক জীবনানন্দ দাশের উপর আলো ফেলেছেন গৌতম মিত্র।

‘পাণ্ডুলিপি থেকে ডায়েরি
জীবনানন্দের খোঁজে’ বইতে টুকরো পরিসরে ছোট ছোট লেখায় জীবনানন্দ-বিষয়ক এত অজস্র ভাবনা ও চিন্তাসূত্র একত্রিত করেছেন, কিছু কিছু উল্লেখ না করাটা অন্যায় হবে।

এম.এ-তে সেকেন্ড ক্লাস পাওয়ায় জীবনে কতভাবে জীবনানন্দ সাফার করেছেন, তা ব্যক্তি পরিসরে এমনকি লেখায় কোথায় কোথায় সে-প্রসঙ্গে সূত্র এসেছে, তার উল্লেখ আছে; তাঁর গল্প-উপন্যাসের চরিত্র নিয়ে ভাবনা, ১৯৩০ থেকে ১৯৩৫ পর্বের বেকারজীবনের শূন্যতা ও হাকাকার কীভাবে কোথায় মিশেছে, সন্তানের কুৎসিত মুখ নিয়ে ভাবনা, তাঁর পূর্বপুরুষ নিয়ে মিথ ও রূপসী বাংলার হয়ে ওঠার সূত্র, কবিতা ও গল্পে নরকের কথা কতবার কীভাবে বলছেন, জীবনানন্দর প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রেম কখন কীভাবে হয়ে উঠলো, লাবণ্যর যে ৭ জন প্রেমিক ছিল তাদের নাম, কাকাত বোন শোভনা কীভাবে ‘ওয়াই’ হয়ে উঠলো এবং সারাজীবনের ভাবনা ও লেখার প্রেরণা হলো, সেনেট হলে কবিতা পাঠের ঘটনা, এত উপন্যাস লিখেও প্রকাশ না করার নেপথ্যে কী ছিল, জীবনানন্দর রচনার সারকথা, তিনি কীভাবে লিখতেন, তাঁর পড়াশোনা ও ভাবনাবিশ্ব, স্ত্রীর লাবণ্যর সঙ্গে সম্পর্ক, পরকীয়া ও হস্তমৈথুন, তাঁর প্রেম-কাম-মৃত্যুচিন্তা প্রভৃতি বিষয় নিয়ে জীবনানন্দ কীভাবে ভেবেছেন, এসবের উপর নিজস্ব বিশ্লেষণ, তুলনা-প্রতিতুলনা ও আলো ফেলেছেন। জীবনানন্দর প্রথম ও শেষ লেখার প্রামাণ্য হদিসও দিয়েছেন গৌতম।
একমুখী দৃষ্টিভঙি নয়, জীবনানন্দর ডায়েরিকে ঘিরে বহুকৌণিক চোখ ও মনের অনুসন্ধিৎসার সারাৎসার ধরা পড়েছে ‘পাণ্ডুলিপি থেকে ডায়েরি: জীবনানন্দের খোঁজে’ বইতে।

বইয়ের লেখক কবি বলেই হয়ত এর ভাষাও লাবণ্যময়। ছোট ও তীব্র বাক্য, তীর্যক পর্যবেক্ষণ এতে প্রতফলিত হয়েছে। ফলে বইটি জীবনানন্দ-বিষয়ে একটি সাধারণ বই না হয়ে বিশেষ একটি বই ও অন্যান্য অনুরূপ গ্রন্থ সম্পর্কে এটি এক উৎসমুখ হয়ে উঠেছে। এই বইয়ের সূত্র ধরে জীবনানন্দর কবিতা-গল্প-উপন্যাস পাঠের সূত্রও পাঠক খুঁজে পাবেন। একই সঙ্গে জীবনানন্দ-বিষয়ে অন্যান্য গ্রন্থ পাঠের তারতম্য ধরতে পারবেন।

দু’একটি বানান বিভ্রাট (‘দাশ’ কয়েকবার হয়েছে দাস, যেমন পৃ. ২৪৬) ও মুদ্রণ প্রমাদ (‘সর্বানন্দ ভবন’ হয়েছে সদানন্দ ভবন, পৃ. ২০৭) বাদে এবং বইয়ে সন্নিবেশিত তথ্য আগু পিছুতে গরমিল (জীবনানন্দের পূর্বপুরুষের একজনকে তুলে নিয়ে যায় পরীরা, সকালে তাকে পাওয়া যায় ধানক্ষেতে। এই ঘটনা তো প্রথম খণ্ডে থাকবার কথা ) ছাড়া জীবনানন্দ-বিষয়ে এ এক অনন্য গ্রন্থ। যে গ্রন্থের লাবণ্য ও শিল্পমাধুরীর জন্য গৌতম মিত্রর আন্তরিক শুভেচ্ছা, ভালোবাসা ও অভিনন্দন প্রাপ্য।

দুই
‘পাণ্ডুলিপি থেকে ডায়েরি: জীবনানন্দের খোঁজে’, গৌতম মিত্র; ঋত প্রকাশন, কলকাতা; প্রথম প্রকাশ : জানুয়ারি ২০২০, মূল্য : ৪২৫ রুপি।

দিনলিপি লিখার অভ্যাস ছিল কবির। ১৯২৫ খ্রিঃ হতে বাঁধানো এক্সারসাইজ খাতায় নিজের জীবনে টুকরো টুকরো কথা,স্মৃতিকে কাগজে লিপিবদ্ধ করেছিলেন যা তিনি লিটারেরি নোটস নামে অভিহিত করেছিলেন।
মোট ৫৬ টি খাতায় দিন তারিখ অনুসারে কথাগুলো তিনি লিখতেন। জীবনানন্দ গবেষক ভূমেন্দ্র গুহের কাছে এসব সংরক্ষিত ছিল তাঁর মৃত্যুর আগে, একটা সময় কলকাতার জাতীয় গ্রন্থাগারেও এইসব সৃষ্টিশীল লেখা সংরক্ষিত ছিল।

এই নোটস খাতার মোট পৃষ্ঠা সংখ্যা ৪,২৭২ এবং মোট শব্দসংখ্যা ৬,৬২,১৬০ এর কাছাকাছি। জীবনানন্দের লেখা বরাবরই ছিল রহস্যের জালে আবর্তিত ঠিক তেমনি তাঁর এই লিটারেরি নোটস।
কবিতায় যেমন রহস্যময় ঠিক তেমনি তাঁর কথাসাহিত্য। সম্পূর্ণ নতুন এক ভিন্নময় জগত সৃষ্টি করেছিলেন তিনি নিপুনভাবে। উপন্যাসে তিনি তুলে ধরেছেন মানবতার কথা, সমাজের কথা, মানুষের অধিকারের কথা, প্রকৃতির কথা, স্রোতের বিপরীতে চলার কথা।

প্রথম চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ ভাষা নিয়ে জবরদস্তির যে অভিযোগ করেন, সে বিষয়ে জীবনানন্দ নিজের একটি ব্যাখ্যা দেয়ার প্রয়োজনবোধ করেন। তিনি লেখেন, ‘কবি কখনো আকাশের সপ্তর্ষিকে আলিঙ্গন করবার জন্য উৎসাহে উন্মুখ হয়ে ওঠেন, পাতালের অন্ধকারে বিষজর্জর হয়ে কখনো তিনি ঘুরতে থাকেন। বীঠোফেনের কোনো কোনো সিম্ফনি বা সোনাটা ভেতর অশান্তি রয়েছে, আগুন ছড়িয়ে পড়ছে, কিন্তু আজও তা টিকে আছে। চিরকালই থাকবে তাতে সত্যিকার সৃষ্টির প্রেরণা ও মর্যাদা ছিল বলে।’

দ্বিজাতিতত্ত্ব কিংবা আরও পরিস্কার করে বললে ধর্ম, তথা মুসলান ও হিন্দুত্ববাদের ওপর ভর করে উনিশশো সাতচল্লিশে দেশ ভাগের বছর খানেক আগে ১৯৪৬ সালের ২ জুলাই বরিশালের সর্বানন্দ ভবন থেকে সুহৃদ প্রভাকর সেনকে ব্রজমোহন কলেজের তৎকালীন অধ্যাপক, কবি জীবনানন্দ দাশ যে নাতিদীর্ঘ চিঠি লেখেন, সেটিকে এ যাবত উদ্ধার হওয়া তাঁর চিঠিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করা যায়। কেননা, এই চিঠিখানা তাঁর ছোটখাট আত্মজীবনী—যেখানে তৎকালীন পূর্ববঙ্গের একটি মফস্বল শহরের একজন ইংরেজির অধ্যাপকের জন্ম-পরিচয় বয়ানের পাশাপাশি লেখক হিসেবে নিজের ব্যর্থতা, সীমাবদ্ধতা ও হতাশা স্পষ্ট। যদিও জীবনানন্দের জন্ম সাল ও তারিখ নিয়ে আজও যে কিছুটা বিভ্রান্তি রয়েছে, এই চিঠি সেই বিভ্রান্তি বা ধোঁয়াশা আরও বাড়িয়েছে।

প্রভাকর সেনকে লেখা এই চিঠিতে নিজের জন্মপরিচয়ে জীবনানন্দ লিখেছেন, ‘আমার জন্ম হয়েছিল বরিশালে ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে ফাল্গুন মাসে। পড়েছিলাম বিএম স্কুল ও বিএম কলেজ, প্রেসিডেন্সি কলেজ, ইউনিভার্সিটি ও কলেজে। শেষ পর্যন্ত আইন পরীক্ষা দেওয়া হয়নি। অধ্যাপনা করেছি কলকাতার সিটি কলেজ, দিল্লির এক কলেজ, বরিশাল বিএম কলেজে। আরও ২/৪ রকম কাজ করেছি ফাঁকে ফাঁকে। এখনও অধ্যাপনাই করতে হচ্ছে। কিন্তু মনে হয় এ পথে আর বেশিদিন থাকা ভালো না।’

এই চিঠি লেখার মাস দুই-তিন পরে পাকাপাকিভাবে কলকাতায় গিয়ে জীবনানন্দ প্রথমে যে চাকরিটা নেন, সেটি শিক্ষকতা ছিল না। বরং তিনি চাকরি নেন স্বরাজ নামে একটি পত্রিকার রবিবাসরীয় বা সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে। যদিও চাকরিটা বেশিদিন করতে পারেননি। ঘুরেফিরে আবার তাকে শিক্ষকতায়ই ফিরতে হয় এবং আমৃত্যু এই পেশাতেই ছিলেন।

যদিও শিক্ষকতার প্রতি তার একধরনের বিরক্তি বা খেদও যে ছিল, তা প্রভাকর সেনকে লেখা ওই চিঠিতে স্পষ্ট। তার ভাষায়, ‘যে জিনিস যাদের যেভাবে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে সবই অসাড়তার নামান্তর নয় কি?’ ফলে তিনি এই ‘অসাড়তা’ থেকে মুক্তি চেয়েছিলেন। কিন্তু মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাকে এই ‘অসাড়তা’র ভারই বহন করতে হয়েছে। যে কারণেই হয়তো ‘সৃষ্টির তীরে’ কবিতায় লিখেছিলেন, ‘মানুষের হাতে আজ মানুষ হতেছে নাজেহাল, পৃথিবীতে নেই কোনো বিশুদ্ধ চাকরি।’

জীবনানন্দের জন্মতারিখ নিয়ে কিছুটা বিভ্রান্তি এখনও রয়ে গেছে। বিশেষ করে তার জন্মতারিখটা ১৭ নাকি ১৮ ফেব্রুয়ারি—এ নিয়ে। প্রথম দিকে তার জীবনীকার ও গবেষকরা ১৮ ফেব্রুয়ারি উল্লেখ করলেও পরবর্তীকালে ১৭ ফেব্রুয়ারি মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। ১৮৯৯ নাকি ১৮৯৮—এ নিয়ে বিভ্রান্তি থাকলেও ১৮৯৯ সালের ব্যাপারে গবেষকরা পরবর্তীতে ঐক্যমতে পৌঁছান। এই বিভ্রান্তি এড়ানো যেতো, যদি জীবনানন্দ নিজে প্রভাকর সেনকে লেখা এই চিঠিতে তারিখটি উল্লেখ করতেন।

তিনি লিখেছেন, ১৮৯৯ সালের ফাল্গুন মাসে। অর্থাৎ সাল লিখেছেন ইংরেজিতে, কিন্তু মাস বাংলায়। যদিও ইংরেজি তারিখটি নিয়ে বিভ্রান্তি বা ভিন্নমত থাকলেও বাংলা তারিখের ব্যাপারে সবাই একমত, সেটি হলো ৬ ফাল্গুন ১৩০৫। সুতরাং জীবনানন্দের জন্ম তারিখের ক্ষেত্রে বাংলা সন ও তারিখ ব্যবহার করাই শ্রেয়।

বিখ্যাত লেখকদের ডায়েরি ও চিঠির প্রতি পাঠকের আলাদা আকর্ষণের বড় কারণ, এইসব ডায়েরি ও চিঠির মধ্য দিয়ে লেখকের ব্যক্তিসত্ত্বা, ব্যক্তিজীবন, ব্যক্তিগত আলাপচারিতা, জীবনবোধ ও ভাবনা—যেগুলো অনেক সময় তার কবিতা-গল্প-উপন্যাসে নাও আসতে পারে বা এলেও সেখানে বিমূর্ততা স্বাভাবিক, সেইসব বিষয় উঠে আসে। জীবনানন্দের চিঠিগুলোও আসলে তার আত্মজীবনীর খসড়া। এর মধ্য দিয়ে লেখক হিসেবে তার ভাবনা এবং ব্যক্তিজীবনের টানাপড়েনসমূহ জানা সম্ভব হয়।

এ যাবৎকাল তার যতগুলো চিঠি আবিষ্কৃত বা উদ্ধার হয়েছে, সংখ্যার বিচারে তা খুব বেশি নয়। আবার অনেককে চিঠি লেখার যে ফ্রিকোয়েন্সি, তাতে মনে হয় তিনি প্রচুর চিঠি লিখতেন।
ফলে এ ব্যাপারে এখন এই উপসংহারে পৌঁছানোই সঙ্গত যে, আবিষ্কৃত চিঠির বাইরেও আরও অজস্র চিঠি হারিয়ে গেছে। হয়তো জীবনানন্দ নিজে সংরক্ষণ করেননি। আবার যাদেরকে লিখেছেন তাদেরও অনেকে হারিয়েছেন। অনেকে হয়তো সংরক্ষণের প্রয়োজনই বোধ করেননি। কারণ জীবিতকালে জীবনানন্দ খুব বেশি খ্যাতিমান ছিলেন না।

জীবনানন্দের অন্যতম জীবনীকার প্রভাতকুমার দাস এ পর্যন্ত ১৩১টি চিঠি উদ্ধার করতে পেরেছেন, যার মধ্যে ১১৭টি জীবনানন্দ লিখেছেন এবং বাকি ১৪টি জীবনান্দকে লেখা। তবে পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলার খড়্গপুর কলেজে অধ্যাপনাকালীন কলেজের অধ্যক্ষ হিমাংশুভূষণ সরকার এবং সহকর্মী পুলিনবিহারী পালকে লেখা যে ৬টি পাওয়া গেছে, তার সবগুলো প্রভাতকুমারের বইয়ে (পত্রালাপ জীবনানন্দ দাশ, প্রকাশ: জানুয়ারি ২০১৭, এবং মুশায়েরা, কলকাতা) গ্রন্থভুক্ত হয়নি।

জীবনানন্দের পত্রপ্রাপকদের মধ্যে আছেন তাঁর মা কুসুমকুমারি দাশ, মেয়ে মঞ্জুশ্রী দাশ, বোন সুচরিতা দাশ, ভাই অশোকানন্দের স্ত্রী নলিনী চক্রবর্তী, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনানন্দের আবিষ্কারক বুদ্ধদেব বসু, সুহৃদ সঞ্জয় ভট্টাচার্য, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় প্রমূখ। মাকে লেখা মাত্র দুটি চিঠির হদিস পাওয়া যায়। যেগুলো লিখেছিলেন কলকাতার হার্ডিঞ্জ হোস্টেলে থাকার সময়। অর্থাৎ যখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন পড়তেন।

কলকাতা সিটি কলেজে শিক্ষকতার সময় এই কলেজের কাছেই ১৮/২/এ বেচ্যু চ্যাটার্জি স্ট্রিটের যে বাড়িতে কিছুদিন ভাড়া ছিলেন, সেখানে বসে লেখা একটি চিঠির সন্ধান পাওয়া যায়, যেটি লিখেছিলেন সুহৃদ অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তকে, ১৯২৬ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। এই চিঠিতে অচিন্ত্যকে ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করলেও পরবর্তীকালে সম্বোধনটি ‘তুমি’তে নেমে আসে।

কবিতার মতো চিঠি লেখার ব্যাপারেও তিনি খুব সাবধানী বা খুঁতখুতে ছিলেন। যে কারণে ছোট বড় সব চিঠিরই খসড়া করে নিতেন। পরে ফাইনাল করে পাঠাতেন। উদ্ধারকৃত বা আবিষ্কৃত চিঠিগুলোর বেশ কয়েকটা এরকম খসড়া। অর্থাৎ শেষতক জীবনানন্দ হয়তো চিঠিগুলো পোস্ট করেননি।

বেশির ভাগ চিঠি তিনি লিখতেন সংক্ষিপ্ত, পোস্টকার্ডে, এবং সাধারণত প্রাপ্ত পত্রের উত্তর হিসেবে। আবার সেসব চিঠির ভেতরে নিজের মানসিক পরিস্থিতি, কর্মহীন বেকার জীবনের গ্লানি, নতুন কাজের সন্ধানে প্রিয়জনের কাছে বুদ্ধিপরামর্শ চাওয়া, কখনো মান-অভিমানের প্রসঙ্গও ছিল।

‘ময়ূখ’ জীবনানন্দ স্মৃতি সংখ্যায় সঞ্জয় ভট্টাচার্য লিখেছেন, ‘চিঠিপত্রে অত্যন্ত অন্তরঙ্গ ছিলেন তিনি (জীবনানন্দ দাশ)। তাঁর চিঠি পেলে মনে হত, সব সময় তিনি কবিতার কথা ভাবেন। এমন তো কেউ ভাবে না—রবীন্দ্রনাথেরও অন্যান্য ভাবনা আছে—কিন্তু কবিতার দুর্ভাবনা ছাড়া কি এই ব্যক্তিটির (জীবনানন্দ) ভাববার মতো আর কিছু নেই।

ভাবতাম, জীবনানন্দের চিঠি পড়তে পড়তে। কাব্যময় চিঠি নয়—কবিতা বস্তুটির জন্যে চিন্তা আর উৎকণ্ঠা থাকত তাঁরই চিঠিতে।’ ফয়জুল লতিফ চৌধুরীর ভাষায় (জীবনানন্দ দাশের চিঠিপত্র, ফেব্রুয়ারি ২০১৫, অন্যপ্রকাশ), ‘জীবনানন্দের চিঠিগুলিতে একজন আত্মবিশ্বাসী, সৌজনস্যসুন্দর এবং অকপট ব্যক্তিত্বের পরিচয় পাওয়া যায়, যিনি মানবিক সম্পর্কের ব্যাপারে আন্তরিক, যার সংযম ও পরিমিতিবোধ অগাধ, যার বিনয় অবিচল।’

এসব চিঠিতে জীবনানন্দের জন্মশহর বরিশাল সম্পর্কে তার আবেগ এবং কখনো কখনো কিছুটা বিরক্তির কথাও ফুটে ওঠে। ১৯৩৭ সালের ২ জুলাই প্রমথ চৌধুরীকে লেখা চিঠিতে বলছেন, ‘কলকাতায় থাকলে পাঁচ মিনিটে যে জিনিস পাওয়া যেত এখানে (বরিশাল) তা পেতে এক সপ্তাহেরও বেশি লেগে গেল।

মফস্বলের এই শহরগুলো এখনও নানা দিক দিয়ে Intellectually backward হয়ে আছে। এখানে Culture জিনিসটা একরকম নেই বল্লেই হয়। সাহিত্যসৃষ্টি তো দূরের কথা, সাহিত্যচর্চাও খুব কম লোকই করে। সেই জন্যেই কলকাতায় কোনো কাজ নিয়ে চলে যেতে ইচ্ছে করে, এই আবহাওয়ার ভিতর মন আর টিকে থাকতেই চায় না।’ তিনি বিশ্বাস করতেন, কলকাতার অলিগলি মানুষের শ্বাসরোধ করে বটে, কিন্তু কলকাতার ব্যবহারিক জীবনে একটা প্রান্তরের মত মুক্তি পাওয়া যায়; এখন যখন জীবনে কর্মবহুলতার ঢের প্রয়োজন, কলকাতার এই স্বচ্ছন্দ পটভূমির থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা চলে না আর।

চাকরি-বাকরি বিশেষ করে শিক্ষকতা নিয়েও তার যে অসন্তুষ্টি ছিল, সেটিও ফুটে ওঠে তার কোনো কোনো চিঠিতে। বরিশাল থেকে ১৯৪২ সালের ৩১ অক্টোবর নলিনী চক্রবর্তীকে লেখা চিঠিতে তিনি লিখছেন, ‘অধ্যাপনা জিনিষটা কোনো দিনই আমার তেমন ভালো লাগেনি। যে সব জিনিষ যাদের কাছে যে রকমভাবে শিক্ষা দেয়া হচ্ছে, তাতে আমার বিশেষ আস্থা নেই। এই কাজে মন তেমন লাগে না, তবু সময় বিশেষে অন্য কোনো কোনো প্রেরণার চেয়ে বেশী জাগে তা স্বীকার করি।’

তবে শুধু ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের গল্পই নয়, এসব চিঠিতে কখনো কখনো নিজের জীবনবোধ ও সাহিত্যসম্পর্কিত আলোচনাও তিনি করেছেন। বরিশালের সর্বানন্দ ভবন থেকে ১৯৪৩ সালের ৩০ অক্টোবর সিগনেট প্রেসের মালিক দিলীপকুমার গুপ্তকে লেখা চিঠিতে বলছেন, ‘আমাদের এই পৃথিবীর ভিতরেই আরো অনেক পৃথিবী রয়েছে যেন; সাধারণ চোখ দিয়ে স্বভাবত তা খুঁজে পাওয়া যাবে এমন নয়; থাকে তা সৃষ্টিপরায়ণ মানসের ভিতর; এরাই আমাদের দেখান।’

কবিতা সম্পর্কেও নিজের ভাবনা ফুটে ওঠে ১৯৪৫ সালের ২৬ ডিসেম্বর প্রভাকর সেনকে লেখা এক চিঠিতে—’ভালো কবিতা লেখা অল্প কয়েক মুহূর্তের ব্যাপার নয়; কবিতাটিকে প্রকৃতিস্থ করে তুলতে সময় লাগে। কোনো কোনো সময় কাঠামোটি, এমন কি প্রায় সম্পূর্ণ কবিতাটিও খুব তাড়াতাড়ি সৃষ্টিলোকী হয়ে ওঠে। কিন্তু তারপর—প্রথম লিখবার সময় যেমন ছিল তার চেয়ে বেশি স্পষ্টভাবে—চারদিককার প্রতিবেশচেতনা নিয়ে শুদ্ধ তর্কের আবির্ভাবে কবিতাটি আরো সত্য হয়ে উঠতে চায়।’

একসময় নানা কারণে জন্মস্থান বরিশাল ছাড়ার জন্য ব্যাকুল হলেও শেষদিকে এসে সেই প্রিয় মাতৃভূমিতে ফেরার তাড়নাও যে তার মধ্যে তীব্র হয়, সেটিও বিভিন্ন চিঠিপত্রে স্পষ্ট। তিনি যখন (১৯৪৬) শেষবারের মতো বরিশাল ছেড়ে কলকাতায় যান, তখন পর্যন্ত দেশভাগ হয়নি। ফলে পাসপোর্ট ভিসারও প্রয়োজন হয়নি। কিন্তু ১৯৪৭-এ দেশভাগের পরে তিনি আর তৎকালীন পূর্ববাংলায় ফিরে আসেননি।
এ প্রসঙ্গে মৃত্যুর আগের বছর ১৯৫৩ সালের ২৩ এপ্রিল কায়সুল হককে লেখা এক চিঠিতে নিজের সেই ব্যাকুলতার কথা জানান—’আমি বড্ড অলস, শরীরও অসুস্থ, মনও নানা কারণে ভেঙে পড়ছে। পূর্ব
পাকিস্থান নিজের জন্মস্থান; সেখানে যেতে আমি অনেকদিন থেকেই ব্যাকুল; কিন্তু পাসপোর্ট ইত্যাদি কবে যোগাড় করে উঠতে পারব বলতে পারছি না।’

খড়্গপুর কলেজে অধ্যাপনার পাঁচ মাস সময়কালে কলেজের অধ্যক্ষ হিমাংশুভূষণ সরকারকে ইংরেজিতে পাঁচটি এবং সহকর্মী পুলিনবিহারী পালকে লেখা জীবনানন্দের ছয়টি চিঠি উদ্ধার করা গেছে। এই কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন খড়্গপুর নিবাসী জীবনানন্দ গবেষক কামরুজ্জামান।

তার গবেষণা বলছে, কলেজে যোগদানের আগে জীবনানন্দ সচক্ষে এখানের পরিবেশ দেখা এবং সহকর্মীদের সাথে পরিচত হতে আসেন। এ সময় অধ্যক্ষ হিমাংশুভূষণ অন্য সহকর্মীদের সাথে জীবনানন্দকে পরিচয় করিয়ে দেন। শুধু তাই নয়, কলকাতায় ফেরার পথে কবিকে স্টেশন পর্যন্ত এগিয়ে দেন স্বয়ং অধ্যক্ষ। স্টেশন থেকে কলেজ পর্যন্ত যেতে রেলের কর্মশালা, চারপাশে লাল মাটির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা রুক্ষ সবুজ বনানী দেখে কবি মুগ্ধ হয়েছিলেন।

জীবনানন্দ দাশ খড়্গপুর কলেজের অধ্যক্ষকে প্রথম চিঠি লেখেন ১৯৫০ সালের ৪ আগস্ট কলেজে যোগদানের সম্মতি জানিয়ে। এর ২০ দিন পর বিস্তারিতভাবে আরেকটি চিঠি লেখেন অধ্যক্ষকে। তৃতীয় চিঠিটি লিখেছিলেন ওই বছরের ৫ ডিসেম্বর।

কলকাতায় ছুটিতে গিয়ে স্ত্রীর অসুস্থতার খবর জানিয়ে যেখানে লিখেছেন, চিকিৎসক পরামর্শ দিয়েছেন এই শীতে যেন তাকে (স্ত্রী) নিয়ে কোথাও না যান। কেননা এতে হাঁপানি আরও বেড়ে যেতে পারে। ফলে আগামী বসন্ত অথবা গ্রীষ্মের আগে পরিবার নিয়ে খড়্গপুরে আসার সম্ভাবনাও তিনি বাতিল করে দেন।

পরিবারসহ থাকার জন্য খড়্গপুরে যে বাসাটি দেখেছিলেন, সেটি প্রয়োজন নেই বলেও অধ্যক্ষকে জানান। ১৯৫১ সালের ১৩ জানুয়ারি অধ্যক্ষকে লেখা আরেকটি চিঠিতে নিজের অসুস্থতা ও চিকিৎসার কথা জানিয়ে আরও কিছুদিন ছুটিতে থাকার আবেদন করেন।

অধ্যক্ষকে লেখা পঞ্চম চিঠিটি বেশ দীর্ঘ এবং সেখানে ব্যক্তিগত নানা প্রসঙ্গ এসেছে। ১৯৫১ সালের ১১ মার্চ ১৮৩ ল্যান্সডাউন রোডের ঠিকানা থেকে লেখা ওই চিঠিতে জীবনানন্দ নিজের শারীরিক অসুস্থতার বিবরণ দেন এবং এই অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির জন্য দুঃখপ্রকাশ করেন। তবে এই অসুস্থতার কারণে যাতে ক্লাস ও পরীক্ষা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে বিষয়ে নিজের পরিকল্পনার কথাও উল্লেখ করেন।

এই চিঠির অর্ধ মাস পরে জীবনানন্দ চিঠি লেখেন খড়্গপুরের সহকর্মী পুলিনবিহারী পালকে, কলেজের চাকরি চলে যাওয়ার দুদিন আগেই যেখানে তার আর্থিক দুরবস্থা ও মানসিক বিপর্যয়ের বিস্তারিত তুলে ধরেন।

১৯৫১ সালের ৩১ মার্চ লেখা ওই চিঠিতে তিনি জানান, খড়গপুর কলেজ থেকে ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে মাত্র তিরিশ টাকা পেয়েছিলেন। কিন্তু ফেব্রুয়ারি মাসে যে কাজ করলেন, সেই টাকা এখনও পাননি। ফলে বিগত দিনের পাওনাটা না পেলে এই দুর্দিনে টিকে থাকা মুশকিল। আগস্ট মাসে দিল্লি কলেজের পাকা কাজ ও কলকাতার নানা সুযোগ সম্ভাবনা ছেড়ে দিয়ে খড়গপুর কলেজের চাকরি ভালো ও স্থায়ী—এই পূর্ণ বিশ্বাসে তিনি যে এখানে যোগ দিয়েছিলেন, সে কথাও মনে করিয়ে দেন পুলিন বিহারীকে। কলেজের বোর্ডিংয়ে নিজের লেপ, তোষক, জামা-কাপড়, বই ইত্যাদি ঘরে বন্ধ করে রেখে এসেছেন উল্লেখ করে জানতে চান, সব ঠিক আছে কি না? গ্রীষ্মের ছুটি কবে আরম্ভ হবে সে কথাও জানতে চান। সবশেষে অবিলম্বে এই চিঠির জবাব পাওয়ার প্রত্যাশার কথাও উল্লেখ করেন। কিন্তু এই চিঠি লেখার দুদিন পরেই ২ এপ্রিল কলেজ পরিচালন সমিতির সভা হয় যেখানে মূল আলোচ্য বিষয় ছিল জীবনানন্দের দীর্ঘ অনুপস্থিতি।

সভায় ১৯৫০ সালের সেপ্টেম্বরে যোগদানের পর থেকে পরের বছর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিনি যেসব ছুটি নিয়েছেন তা নিয়ে আলোচনা হয়। এই ছুটির ফলে ক্লাসে ব্যাঘাত, কলেজের অর্থনৈতিক সংকট এবং শর্তসাপেক্ষে ইস্তফার বিষয়ে কবির চিঠিটিও বিবেচনায় নেয়া হয়। সব মিলিয়ে সভায় সর্বসম্মতভাবে জীবনানন্দের দীর্ঘ ছুটির আবেদনটি অগ্রাহ্য হয় এবং ইংরেজি বিভাগের দ্বিতীয় পদটি বিলুপ্ত করা হয়।
এরপর জীবনানন্দকে জানিয়ে দেয়া হয়-Your service is no longer required…এপ্রিল মাসের কোনো এক সময়ে তিনি শেষবারের মতো খড়্গপুরে আসেন এবং রুমের ভেতরে থাকা বিছানা, বইপত্র নিয়ে নিঃশব্দে চলে যান।

জীবনানন্দ বেঁচেছিলেন বাংলা সাহিত্যের দুই দিকপাল রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সময়ে। নজরুলের সঙ্গে তাঁর একবার কল্লোলের অফিসে দেখা হলেও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কোনোদিনই দেখা হয়নি বা জীবনানন্দ একই শহরে থাকলেও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে যাননি। তাঁর ভাষায়, ‘নিজের জীবনের তুচ্ছতা’ ও রবীন্দ্রনাথের ‘বিরাট প্রদীপ্তি’ দুজনের মধ্যে যে ব্যবধান রেখে গেছে—তিনি (জীবনানন্দ) তা লঙ্ঘন করতে পারেননি।

জীবনানন্দের যেসব চিঠি আবিষ্কৃত হয়েছে, তার মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে লেখা এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা চিঠিগুলো বিশেষভাবে উল্লেখ্য। বাংলা ১৩৩৫ সালের ৩ পৌষ ৬৬ হ্যারিসন রোডে বসে রবীন্দ্রনাথকে লেখা একটি চিঠি জীবনানন্দের মৃত্যুর পরে বেশ আলোচনার জন্ম দেয়।

কেননা চিঠিটি আবিষ্কৃত হলেও এটি রবীন্দ্রভবন সংগ্রহশালায় নেই। ফলে প্রভাতকুমার দাস ধারণা করছেন, ভুলে হয়তো চিঠিটি তিনি (জীবনানন্দ) ডাকে দেননি। তাছাড়া চিঠির পরিপাটি চেহারা দেখলে এই মন্তব্য বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়।

প্রথম কাব্যগ্রন্থ ঝরাপালকের একটি কপি জীবনানন্দ পাঠিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথকে। সেই বই পড়ে তিনি জীবনানন্দকে একটি ছোট চিঠি লিখেছিলেন। বাংলা ১৩৩৫ সালে লেখা ওই চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লেখেন—’তোমার কবিত্বশক্তি আছে তাতে সন্দেহ মাত্র নেই। কিন্তু ভাষা প্রভৃতি নিয়ে এত জবরদস্তি কর কেন বুঝতে পারি নে। কাব্যের মুদ্রাদোষটা ওস্তাদীকে পরিহাসিত করে।’

এরপর ধূসর পাণ্ডুলিপি পড়ে রবীন্দ্রনাথ আরেকটি চিঠি দেন মাত্র দুই লাইনে। শান্তিনিকেতন থেকে লেখা ওই চিঠিতে কবিগুরু লেখেন—’তোমার কবিতা পড়ে খুশি হয়েছি। তোমার লেখায় রস আছে, স্বকীয়তা আছে এবং তাকিয়ে দেখার আনন্দ আছে।’

প্রথম চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ ভাষা নিয়ে জবরদস্তির যে অভিযোগ করেন, সে বিষয়ে জীবনানন্দ নিজের একটি ব্যাখ্যা দেয়ার প্রয়োজনবোধ করেন। তিনি লেখেন, ‘কবি কখনো আকাশের সপ্তর্ষিকে আলিঙ্গন করবার জন্য উৎসাহে উন্মুখ হয়ে ওঠেন, পাতালের অন্ধকারে বিষজর্জর হয়ে কখনো তিনি ঘুরতে থাকেন। বীঠোফেনের কোনো কোনো সিম্ফনি বা সোনাটা ভেতর অশান্তি রয়েছে, আগুন ছড়িয়ে পড়ছে, কিন্তু আজও তা টিকে আছে। চিরকালই থাকবে তাতে সত্যিকার সৃষ্টির প্রেরণা ও মর্যাদা ছিল বলে।’

ধূসর পান্ডুলিপির তিমির হননের নির্জনতায় রূপসী বাংলার শুদ্ধতম কবি জীবনানন্দ দাশ। ইতিহাস ও সময় সচেতন এবং আধুনিক কাব্যশৈলীতে বৈচিত্রতার সৃষ্টিতে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী এক রহস্যময় অধ্যায়। কাব্যধারায় উপমা প্রয়োগে তাঁর দক্ষতা নৈপুণ্যে এককথায় তুলনাহীন।কবিতায় তিনি নাড়া দিয়েছেন মানুষের জীবনবোধ, প্রকৃতির রহস্যতা আর মানবপ্রেম।

বাংলা কাব্যধারায় আধুনিকতার জগতে নতুনত্ব সৃষ্টি করতে জীবনানন্দ দাশের আর্বিভাব হয় দীনেশ রঞ্জন দাস সম্পাদিত কল্লোল পত্রিকায় ১৩৩২ (১৯২৬) ফাল্গুন সংখ্যায় ‘নীলিমা’ কবিতাটি প্রকাশের মধ্য দিয়ে। জীবনানন্দ দাশের জীবদ্দশায় ৭টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল।

১৯২৭ সালে প্রকাশিত হওয়া ‘ঝরা পালক’ কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ। এ গ্রন্থটির প্রকাশক ছিলেন শ্রী সুধীরচন্দ্র সরকার। ‘ঝরা পালকে’ মোট পৃষ্ঠা ১০৩। ‘ঝরা পালক’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলোর কিছু ছিল নতুন আর অধিকাংশ ছিল বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পত্রিকায় (বঙ্গবাণী, কল্লোল, কালি কলম, বিজলি, প্রগতি) প্রকাশিত।

এই কাব্যগ্রন্থে মোট পঁয়ত্রিশটি কবিতা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। কবিতাগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- নীলিমা, দেশবন্ধু, বিবেকানন্দ, আমি সেই কবি, আলেয়া, ছায়া-প্রিয়া, কবি, সিন্ধু, হিন্দু-মুসলমান, ডাহুকী, মরুবালু, দক্ষিণা ইত্যাদি। জীবনানন্দ দাশের প্রথম কাব্যগ্রন্থে মোহিতলাল মজুমদার, কাজী নজরুল ইসলাম, সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের অদৃশ্য প্রভাব দেখা যায়।

দীর্ঘ বিরতির পর ১৯৩৬ সালে প্রকাশিত হয় কবির ২য় কাব্যগ্রন্থ ধূসর পাণ্ডুলিপি। জীবনানন্দ দাশ তাঁর এই কাব্যগ্রন্থটি বুদ্ধদেব বসুকে উৎসর্গ করেন। এই কাব্যগ্রন্থের প্রচ্ছদ শিল্পী ছিলেন অণিলকৃষ্ণ। এতে মোট বিশটি কবিতা ছিল।

কবিতা সমূহের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো নির্জন স্বাক্ষর, অনেক আকাশ, স্বপ্নের হাতে, অনেক আকাশ,পঁচিশ বছর পর, পাখিরা, বোধ, কার্তিক মাসের চাঁদ, মৃত্যুর আগে ইত্যাদি। ধূসর পাণ্ডুলিপি নামের মাঝে কবির কাব্য প্রতিভার চিত্র ফুটে ওঠে অপরূপভাবে। এই কাব্যগ্রন্থে তিনি তাঁর আপন কাব্যশৈলী আর কৌশলের প্রতিস্থাপন করেছেন নিপুণভাবে।

১৯৪২ সালে লেখেন বাংলা সাহিত্য প্রেমীদের আরাধ্য ‘বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থ। এটি তাঁর ৩য় কাব্যগ্রন্থ।একটি কবিতা দিয়ে যদি কোন কবিকে বিচার করা হয় তাহলে কবির ‘বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থের বনলতা সেন কবিতাটি সাহিত্যের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে তাঁর নাম লেখা থাকবে।

প্রথম সংস্করণের প্রচ্ছদ শিল্পী ছিলেন শম্ভু সাহা এবং সিগনেট থেকে প্রকাশিত ২য় সংস্করণের প্রকাশক ছিলেন দিলীপকুমার গুপ্ত ও প্রচ্ছদ আঁকেন সত্যজিৎ রায়। ঐ সময় বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থের মূল্য ছিল দুই টাকা মাত্র। মহাপৃথিবী কাব্যগ্রন্থটি জীবনানন্দের ৪র্থ কাব্যগ্রন্থ। প্রকাশক ছিলেন সত্যপ্রসন্ন ঘোষ আর এই গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৪৪ সালে। কবি এই কাব্যগ্রন্থটি উৎসর্গ করেন কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র ও সঞ্জয় ভট্রাচার্যকে।

‘মহাপৃথিবীর’ সবচেয়ে পাঠকপ্রিয় কবিতা হচ্ছে ‘আট বছর আগের একদিন’। সাতটি তারার তিমির জীবনানন্দ দাশের ৫ম কাব্যগ্রন্থ। ১৯৪৮ সালে কলকাতা হতে এই গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল। গুপ্ত রহমান এন্ড গুপ্ত প্রকাশনী থেকে আতাউর রহমান প্রকাশ করেন। এ কাব্যগ্রন্থের প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন সত্যজিৎ রায়। প্রথম প্রকাশের সময় বইটির মূল্য নির্ধারিত হয়েছিল আড়াই টাকা। বইটি উৎসর্গ করা হয় বাংলা সাহিত্যের আরেক বিখ্যাত কবি হুমায়ুন কবিরকে।

জীবনানন্দ দাশের কবিতা বরাবরই রহস্যময় এবং অনেকের কাছে দুর্বোধ্য। এই গ্রন্থটি প্রকাশিত হওয়ার পরপর সাহিত্য সমালোচক মহলে দুর্বোধ্যতার অভিযোগ উঠেছিল। কবি নিজেই ছিলেন নিজের বড় সমালোচক। সাড়ে আটশত’র বেশি কবিতা লিখলেও মাত্র ২৬২ টি কবিতা প্রকাশ করেন বিভিন্ন পত্র পত্রিকা, কাব্যগ্রন্থে।

কবির মৃত্যুর পরপরই জনপ্রিয়তা ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৯৫৭ সালে। কলকাতার সিগনেট পাবলিকেশন্স হতে প্রকাশিত হয় ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যগ্রন্থ। উল্লেখ্য যে কবি এই কাব্যগ্রন্থের প্রচ্ছদনাম নির্ধারণ করেছিলেন ‘বাংলার ত্রস্ত নীলিমা’ কিন্তু প্রকাশকালে এই গ্রন্থটির নাম রাখা হয় ‘রূপসী বাংলা’।

যে নামেই নামকরণ করা হোক জীবনানন্দ দাশের কবিতা পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে গিয়েছে বারবার। কবি ও গবেষক ভূমেন্দ্র গুহ এবং জীবনানন্দ দাশের ছোটবোন সুচরিতা দাশ এ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশে প্রধান ভূমিকা পালন করেন।

জীবদ্দশায় সাহিত্যজগতে কবি হিসেবে তাঁর একমাত্র পরিচয়। জীবন জীবিকার তাগিদে তিনি লিখেছিলেন প্রবন্ধ, সেগুলোও একসময় প্রকাশিত হয়েছিল। প্রবন্ধ গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘কবিতার কথা’, ‘কেন লিখি’। কবি নির্জনতায় ডুবে থাকতেন। এই নির্জনতা, এই নিরবতার মধ্যে থেকেও তিনি কিছু গল্প লিখে গিয়েছেন। তাঁর লেখা গল্পগুলোর মধ্যে অন্যতম ‘পাতা তরঙ্গের বাজনা’ ‘পালিয়ে যেতে’, ‘জামরুলতলা’, ‘কুয়াশার ভেতর মৃত্যুর সময়’, ‘রক্তমাংসহীন’ ইত্যাদি। জীবনানন্দ দাশ স্বভাবতই ছিলেন প্রচারবিমুখ,নির্জনতা প্রিয়।

জীবনানন্দ দাশের উপন্যাসগুলোর মধ্যে অন্যতম মাল্যবান (১৯৭৩), সতীর্থ (১৯৭৪), কল্যাণী (১৯৯৯),করুবাসনা,বিভা, নিরুপম যাত্রা, জলপাইহাঁটি, বাঁশমতির উপাখ্যান,জীবনপ্রণালী ইত্যাদি।

জনবিচ্ছিন্ন এই কবি স্বভাবতই পুরস্কার কিংবা স্বীকৃতি বিমুখ ছিলেন। ১৯৫২ সালে পরিবর্ধিত রূপে প্রকাশিত সিগনেট সংস্করণ ‘বনলতা সেন’ কাব্যগ্রন্থটি নিখিলবঙ্গ রবীন্দ্রসাহিত্য সম্মেলনে বাংলা ১৩৫৯- এর শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ হিসেবে পুরস্কৃত করা হয়। কবির মৃত্যুর পর ১৯৫৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা (১৯৫৪) সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন।

জীবন+আনন্দ মিলেই জীবনানন্দ মানে জীবনের আনন্দ কিন্তু বাস্তব প্রেক্ষাপটে তাঁর জীবন ছিল চরম হতাশায় পরিপূর্ণ অশ্রুজলের এক বৃহৎআধার। কলকাতা শহরের বালিগঞ্জে ট্রাম দুর্ঘটনায় তিনি আহত হন সেদিন ছিল ১৪ অক্টোবর, ১৯৫৪ সাল।

কবি গুরুতরভাবে আহত হন, ভেঙে যায় পাঁজরের হাড়সহ শরীরের বিভিন্ন অংশ। তিনি যখন কলকাতার সড়কে পড়েছিলেন তখন তাঁকে উদ্ধার করে এক চাওয়ালা যার নাম চুনীলাল। আহতাবস্থায় কবিকে ভর্তি করা হয় শম্ভূনাথ পন্ডিত হাসপাতালে। ভূমেন্দ্র গুহ, কবি সজনীকান্তি দাশসহ অনেক তরুণরা কবির চিকিৎসার চেষ্টা করেন।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় কবির সুচিকিৎসার নির্দেশ দিয়েছিলেন কিন্তু কোন লাভ হয়নি বরং ক্রমশহারে তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে। সেই সাথে কবি নিউমোনিয়া রোগে আক্রান্ত হলেন।

২২ শে অক্টোবর, ১৯৫৪ সালের ১১ টা ৩৫ মিনিটে তাঁর করুণ মৃত্যু হয়, বাংলা সাহিত্য হারায় আশ্চর্য এক রহস্যময় কবিকে। গত ১০০ বছরে কলকাতায় ট্রাম দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা একটি, সেটি কবির ভাগ্যে লেখা ছিল।

কবির মৃত্যুর পর গুঞ্জন শুরু হলো এটি কি সত্যি দুর্ঘটনা নাকি আত্মহত্যা। আসলে সাহিত্য সৃষ্টিশীল ধারার মানুষ মারা গেলে প্রশ্ন ওঠে আসলেই কি তিনি মারা গেলেন নাকি আত্মহত্যা করলেন।
জীবনানন্দ দাশ বরাবর রহস্যময়তা আর নির্জনতায় ডুবে থাকতেন, হতাশা কাজ করতো তাঁর ভাবনা মাঝে। এসব কারণেই হয়তো অনেকে ভাবেন জীবনানন্দ দাশ ট্রাম দুর্ঘটনায় মারা যাননি বরং আত্মহত্যা করেছিলেন।

আব্দুল মান্নান সৈয়দ জীবনানন্দ দাশের প্রকাশিত- অপ্রকাশিত কবিতাসগ্র গ্রন্থে বলেন “ আমার মনে হয় জীবনানন্দ দাশ ঠিক ট্রাম দুর্ঘটনায় মারা যাননি। যদিও এই কথাটিই সর্বত্র বলা হয়ে থাকে এবং আমরা দেখেছি। তথাপি আমার ধারণা তিনি আত্মহত্যা করেছেন”।

মৃত্যু যার যেমন তেমনই হবে, এটি কারো পছন্দ- অপছন্দের বিষয় নয় বরং বিধাতার লিখন। পাঠক কিংবা বোদ্ধা যারা যাই বলুন না কেন তাঁর মৃত্যু যে একটা করুণ বিদায়, বাংলা সাহিত্যের জন্য বিরাট ক্ষতি।
অভাব-অনটন, দারিদ্র্য, হতাশা এবং সুন্দর জীবনের প্রত্যাশা নিয়ে জীবনানন্দ দাশ বেঁচেছিলেন তাঁর আপন মহাপৃথিবীর নির্জনতায়, মনুষ্য হৃদয়ের কষ্টের শুদ্ধতায় কিংবা জীবনের আলো আঁধারের ধূসরতায়।
জনসমাজ বিচ্ছিন্ন, মৌনতার শুদ্ধতায় এখনো রূপসী বাংলার ঘরে ঘরে চর্চা হয় জীবনানন্দ দাশের কবিতার শুদ্ধিতার, অপূর্ব পূর্ণতার। মানব হৃদয়ের আকুল বিরহ বিদ্রোহ, প্রিয়জনের টান- অনুভন এক নির্জনতার পূর্ণিমা আলোয় সিক্ত হয়ে ওঠে পঞ্চমীর চাঁদ।

বেঁচে যাওয়া সময়ের চেয়ে মৃত্যু পরবর্তী সময়ে আরো বেশি উদীপ্ত ও প্রাণবন্ত আমাদের অনুপস্থিত জীবনানন্দ দাশ আমাদের কাব্যভূবনে,আমাদের সাহিত্যাঙ্গণে। যে সাহিত্যাঙ্গণে এখনো তাঁর যাবতীয় সৃষ্টিকর্ম শুদ্ধতার প্রতীক হয়ে আছে মানব জীবনের সুখ-দুঃখের ধূসর আলোছায়ায় বেলা অবেলায় মহাপৃথিবীর তিমির নির্জনতায়।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম রেজাউল করিম ১৯৭৬ সালের ২২ ফেব্রুয়ারী ঝালকাঠি জেলার রাজাপুর উপজেলার সাতুরিয়া গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। কে এম আবদুল করিম এবং মিসেস ফাতেমা করিমের জেষ্ঠ্য সন্তান তিনি। তিনি যুক্তরাজ্যের বিশ্ববিখ্যাত ওয়েষ্টমিনষ্টার ইউনিভারসিটি থেকে জি.ডি.এল ডিগ্রী লাভ করেন। তিনি দেশে বিদেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে একাধিক ডিগ্রী সহ ট্রেনিং গ্রহন করেন। ছোটবেলা থেকেই রেজাউল করিম লেখালেখি ও গনমাধ্যমের সাথে জড়িত। ছাত্রজীবনে বরিশালের স্থানীয় পত্রিকা দৈনিক প্রবাসী দিয়ে সাংবাদিকতায় হাতে খড়ি দেন। এর পরে ঢাকায় ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০৩ সাল পযর্ন্ত মোহম্মদী নিউজ এজেন্সিতে তিনি কনিষ্ঠতম সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় তিনি ‘চ্যানেল আই’তে বিজনেস ফাইল এবং এটিএন বাংলায় অর্থনৈতিক পরিক্রমা নামে অনুষ্ঠান উপস্থপনা করতেন। এছাড়া দৈনিক প্রথম আলো, দৈনিক ভোরের কাগজ, দৈনিক যায়যায় দিন প্রতিদিন ও জনকন্ঠ পত্রিকাও তিনি লেখালেখি করতেন। বর্তমানে তিনি দৈনিক আমার দেশ (অন লাইন), দৈনিক দিনকাল সহ কয়েকটি অন লাইন মিডিয়ায় নিয়মিত কলাম লিখছেন এবং লন্ডনে কয়েকটি বাংলা টেলিভিশন চ্যানেলে ‘টক শে’ তে অংশ নিচ্ছেন। সেন্টার ফর হিউম্যান রাইটস এন্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট এব্ং ডেমোক্রেসি সেন্টারের সাবেক সেক্রেটারী জেনারেল হিসেবে তিনি জাতিসংঘের বেশ কয়েকটি আর্ন্তজাতিক সম্মেলন, বৈঠক ও আলোচনায় অংশগ্রহন করেন। যার মধ্যে ২০০০ সালে জার্মানির বার্লিনে আয়োজিত এসিসিয়েশন অব নিউজপেপারস ( ডব্লিউ.এ.এন) এবং এডিটরস এন্ড মার্কেটরস কনফারেন্স অন্যতম। এছাড়াও বিভিন্ন প্রোগ্রামে ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম রেজাউল করিম রাশিয়ার মস্কো, ইটালির রোম, স্পেনের মাদ্রিদ ও বার্সেলোনা, কানাডার টরেন্টো, থাইল্যান্ডের ব্যাংকক, ইটালির রোম, সিঙ্গাপুর, মালেয়শিয়ার কুয়ালালামপুর, আয়ারল্যান্ডের ডাবলিন, বেলজিয়ামের ব্রাসেলস এবং যুক্তরাজ্যের এডিনবার্গ সহ বিশ্বের বিভিন্ন শহর ভ্রমন করেছেন। বর্তমানে শিক্ষানুরাগী রেজাউল করিম তার নিজ গ্রাম সাতুরিয়ায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন ‘ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম রেজাউল করিম কারিগরি স্কুল এন্ড কলেজ’ এবং ‘শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হক রিসার্চ ইনষ্টিটিউট’। ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম রেজাউল করিম এক কন্যা সন্তানের জনক। তার স্ত্রী সাদিয়া করিম লন্ডনের একটি বহুজাতিক কোম্পনীতে কর্মরত। একমাত্র মেয়ে রুকাইয়া করিম।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!