নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী ও কবি

ড. সৌমিত্র কুমার চৌধুরী
ড. সৌমিত্র কুমার চৌধুরী
21 মিনিটে পড়ুন
স্যার রোনাল্ড রস। ছবি: সংগৃহীত।

স্যার রোনাল্ড রস—ডাক্তার এবং বিশ্ববিখ্যাত বৈজ্ঞানিক। ম্যালেরিয়া সংক্রান্ত গবেষণায় সাফল্যের কারনে তাঁর নোবেল প্রাপ্তি (১৯০৩)। মশার দংশন যে ম্যালেরিয়া রোগের কারণ, সুনির্দিষ্ট ভাবে বললে ম্যালেরিয়া পরজীবীর বাহক (vector) যে আনোফেসিল মশা, এই তথ্য ডাক্তার রোনাল্ড রস প্রমাণ করলেন।

নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী ও কবি

ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে ফৌজি ডাক্তার হিসাবে কর্মরত অবস্থায় (১৮৮১-১৮৯৯) রোনাল্ড রস গবেষণার মূল কাজ সম্পন্ন করেন। গভীর অধ্যয়ন নিষ্ঠা প্রচণ্ড পরিশ্রম এবং প্রতিনিয়ত কঠিন চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করে সাফল্য অর্জন করতে হয়েছে তাঁকে। তৎকালীন ভারতের বিভিন্ন যায়গায় যেমন মাদ্রাজ, বার্মা, বেলুচিস্তান, আন্দামান, ব্যাঙ্গালোর, কলকাতা, সেকেন্দ্রাবাদে কাজ করতে হয়েছে। সাফল্য-ব্যর্থতার বন্ধুর পন্থা পেড়িয়ে একদিন হাতে-কলমে প্রমাণ করলেন যে ম্যালেরিয়া রোগের কারণ মানুষের রক্তে এক কোষী পরজীবীর (প্লাসমোডিয়াম) উপস্থিতি। মশার শরীরে থাকা এই পরজীবী-জীবাণু মানুষের শরীরে ঢুকে যায় দংশনের ফলে। যুগান্তকারী আবিষ্কারটি সমাপন করলেন কলকাতা শহরে (২০-২১ অগাস্ট ১৮৯৭)।

নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী ও কবি
স্যার রোনাল্ড রস।

রোগের রাজা (king of diseases) ম্যালেরিয়া। হাজার বছরের পরিচিত রোগ কিন্তু কারণ অজানা। অজানা বিষয়টিকে আবিষ্কার করলেন ডাক্তার রস। ভয়ঙ্কর প্রাণঘাতী রো প্রতিহত করবার উপায় জানলো বিশ্ববাসী। শুধু ভারত ভূখণ্ডেই উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি (১৮৫০) বছরে দশ লক্ষ রুগীর মৃত্যু ঘটত। আর রোগ মহামারীর আকার নিলে মৃত্যু ঘটতো এর আড়াই গুণ। এই আবিষ্কারের ফলে উপকৃত হোল পৃথিবীর কোটি কোটী রোগাক্রান্ত মানুষ।

ম্যালেরিয়া বিষয়ক বিশ্বজয়ী কর্ম ছাড়াও বিজ্ঞানের অন্য বিভাগে উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন স্যার রোনাল্ড রস। অঙ্ক শাস্ত্র এবং জনস্বাস্থ্যের কাজেও মূল্যবান অবদান রেখেছেন। রোগের ব্যাপ্তি, কারণ ও প্রসার (Epidemiology) বিষয়ে তাঁর তৈরি মডেল অধুনা বিশ্বও অনুসরণ করে।

বহুমুখী প্রতিভা রোনাল্ডের। বিজ্ঞান-কর্মকাণ্ড ছাড়াও বহু কবিতা, উপন্যাস এবং নাটক লিখেছেন। ছবি এঁকেছেন। বেহালায় নতুন সুর বেঁধেছেন। একাধারে বৈজ্ঞানিক নাট্যকার এবং কবি!‘–এই আবিষ্কার কর্তা চিকিৎসক বা বৈজ্ঞানিকের অতিরিক্ত কিছু। তিনি ছিলেন যোদ্ধা সঙ্গীতজ্ঞ অঙ্কবিদ এবং নাট্যকার। কিন্তু বিজ্ঞান বিষয়ক কাজ এবং জনস্বাস্থ্য-কর্মকাণ্ডে ঢাকা পড়ে গেছে তাঁর শিল্প সম্ভার’, লিখছেন তৎকালীন এক বিখ্যাত ইংরেজ বৈজ্ঞানিক [Ronald Ross and his Swiss romance, L. J. Bruce-Chwatt, Acta Tropica 34, 287-291, 1977]।

ডাক্তার রসের বহু সাহিত্য কর্ম এখনও অপ্রকাশিত। প্রকাশিত রচনায়, বিশেষত কবিতায় তাঁর জীবন চর্চা, বৈজ্ঞানিক সাফল্য-ব্যার্থতা ও জীবন যুদ্ধে বিপর্যস্ত মানসিক অবস্থার ছবি ফুটে উঠেছে। কেমন ছিল তাঁর কবিতার মান?

এটুকু বলা যায়, উন্নত মানের এবং তৎকালীন ইংরেজ কবিদের প্রশংসাধন্য কবিতা লিখেছিলেন রোনাল্ড রস। তাঁর জীবন, বিচিত্র অভিজ্ঞতা ও কর্মকাণ্ডের প্রেক্ষিতে তাঁর সাহিত্য কর্ম আলোচিত হওয়া উচিৎ।

শৈশবকাল থেকে প্রকৃতি এবং শিল্প সাহিত্যের প্রতি গভীর অনুরাগ ছিল তাঁর। জন্ম তৎকালীন উত্তর প্রদেশ, অধুনা উত্তরাখণ্ডের শৈলশহর আলমোড়ার (১৩ই মে ১৮৫৭) এক মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে। স্যার ক্যাম্পবেল ক্লে গ্র্যান্ট রস, ব্রিটিশ সেনাবাহিনির মেজর জেনারেল। তাঁর সন্তান স্যার রোনাল্ড রস।

প্রকৃতির অপার ঐশ্বর্যের মধ্যে শান্তির খোঁজে ক্যাম্বেল বাড়ি করেছেলিন আলমোড়ায়। অবশ্য আলমোড়া ছিল ব্রিটিশদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গ্রীষ্মাবাস। ছোট বেলায় আলমোড়া পাহাড়ের সৌন্দর্য নিবিড় ভাবে অনুভব করতেন রোনাল্ড, ক্যাম্বেল গ্র্যান্টের দশ সন্তানের জ্যেষ্ঠ পুত্র। পাইন দেবদারু ওক, অসংখ্য লতা ফুল অর্কিডে সাজানো আলমোড়া। এখানে রোনাল্ড যখন পৃথিবীর আলো দেখেলেন তখন ভারত অশান্ত। মঙ্গল পাণ্ডে কলকাতার কাছে ব্যারাকপুরে যুদ্ধের আগুন জালিয়ে দেবার পর অল্প সময়ে সারা ভারতে ব্যাপ্ত হ’ল সে আগুন (১৮৫৭)। কিন্তু আলমোড়ায় ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধ বা ‘সিপাহি বিদ্রোহের’ আঁচ লাগেনি। অপার সৌন্দর্য নিশ্চিন্ত শান্তিপূর্ণ জীবন আর ফুলের সমারোহে আলমোড়া ছিল স্বতন্ত্র।

আলমোড়ার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য গভীর রেখাপাত করেছিল রোনাল্ড রসের শিশু মনে। এ সম্পর্কে পরিণত বয়সে নিজেই বলেছেন, ‘..বরফে আচ্ছাদিত বিশাল হিমালয়ের চতু্র্দিক। অতুলনীয় দৃশ্য। পুষ্পিত রডোডেনড্রনের রঙিন সমারোহ। স্বপ্নময় ফার গাছের সারি..। মনকে কোন অতলে টেনে নিয়ে যেত। শৈশব কাল থেকেই আমি ওদের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতিয়ে নিয়ে ছিলাম’ [রসের রচনা-Memoirs]।

আলমোড়ায় রোনাল্ডের শিশু মনে প্রকৃতি প্রেমের উন্মেষ পরবর্তী জীবনে আরও সমৃদ্ধ হয়েছিল। সাত বছরের বালক রোনাল্ডকে আলমোড়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে ইংল্যান্ডে পড়াশুনা করতে পাঠালেন পিতা ক্যাম্বেল রস। আইট দ্বীপে (Isle of Wight) মামার বাড়ি। ওখানেই এক প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হলেন। মামার বাড়িতে সাহিত্য এবং ধর্মের প্রচুর বই। সব ধরণের বই-ই পড়তেন রস। অল্প বয়সেই সেক্সপিয়ার বা চ্যাপম্যানের কাব্যরস আস্বাদ করতে পারতেন তিনি। বই পড়া আর আটলান্টিকের উন্মুক্ত সমুদ্রতটে ঘুরে বেড়ানো। বিস্ময় ভাড়া চোখে দেখতেন অসংখ্য জলজ উদ্ভিদ সামুদ্রিক প্রাণী কীটপতঙ্গ, পাখি। এভাবেই অতিবাহিত হত শৈশব। প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ সাহিত্য প্রীতি গভীর কাব্য অনুরাগ তাকে জুগিয়েছিল ভবিষ্যৎ লড়াইয়ের প্রাণ শক্তি।

আইট দ্বীপে পড়াশোনার পর তিনি এলেন বড় শহর সাউথ হ্যাম্পটন। ওখানে সাহিত্যের পাশাপাশি প্রাণীবিজ্ঞানে আকৃষ্ট হলেন। বহু বিষয়েই অনুরাগ তাঁর। অঙ্কের প্রতিযোগতায় প্রথম হয়েছেন, ছবি আঁকায় তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু বাবা ক্যাম্পবেলের নির্দেশ- শিল্পী নয়, বিজ্ঞানি নয়, ডাক্তার হতেই হবে তার জ্যেষ্ঠ পুত্রকে।

অনেকটা বাধ্য হয়েই ডাক্তারি পড়া। সাউথ হ্যাম্পটন শহরের নিবিড় বনভূমি নদী পাহাড় আদিগন্ত মাঠ এবং প্রিয় মানুষজনের সান্নিধ্য ছেড়ে শিল্পী হবার বাসনা ত্যাগ করে এক বুক দুঃখ নিয়ে মহানগরী লন্ডনে এলেন ডাক্তারি পড়তে। তখন বয়স ষোল (১৮৭৩ সালের শেষে)। ভালো কলেজে ঠাঁই হবার যোগ্যতা নেই জেনে অগত্যা ভর্তি হলেন সাধারণ মানের সেন্ট বার্থোলোমিউ মেডিক্যাল কলেজে (১৮৭৪ সালে)। বয়স তখন সতের।

কিশোরের পড়ায় মন নেই। অন্য ছাত্ররা শরীরতত্ব আর ওষুধ বিজ্ঞানের পাঠ মুখস্থ করছেন, আর রোনাল্ড ব্যস্ত সাহিত্য চর্চায়। রসের কথায় ‘অনেক রাত অবধি ছেলেরা করত ডাক্তারি পড়া, আমি করতাম আধুনিক ইংরাজি সাহিত্য-চর্চা [Memoirs]’। প্রানের টানে কখনও বেহালায় সুর তোলা, ছবি আঁকা, লন্ডনের সংগ্রহ শালায় বিখ্যাত চিত্রকরদের প্রদর্শনী দেখে বেড়ানো এসবই চলছে। ডাক্তারি পড়াশোনায় প্রবল অমনোযোগ।

নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী ও কবি

সস্ত্রীক স্যার রোনাল্ড রস, কলকাতা গবেষণাগারের কর্মীবৃন্দ–মহম্মদ বক্স ও অন্যান্য

ছ-বছর পড়াশুনা করেও তিনি পুরো ডাক্তার হতে পারেননি। প্রথম বার অকৃতকার্য, দ্বিতীয় বার পরীক্ষা দিয়ে এম আর সি এস (Member of royal college of surgeon)-এর শল্য চিকিৎসায় পাশ করলেন বটে কিন্তু মেডিসিনের পরীক্ষায় ফেল। ওষুধ বিজ্ঞানের সহজতর বিষয়, সোসাইটি ফর অ্যাপোথাকারির পরীক্ষা, তাতেও অনুত্তীর্ণ। (সোসাইটি অফ অ্যাপোথাকারিস ১৮১৫ সাল থেকে ডাক্তারদের ওষুধ প্রয়োগের লাইসেন্স প্রদান করতো)। ওষুধ বিজ্ঞানের পরীক্ষায় ফেল, তাই হাফ ডাক্তার হলেন। অতএব ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল সারভিস (আইএমএস) পরীক্ষায় বসবার যোগ্যতা হারালেন। অগত্যা কী আর করা! তৎকালের নিয়ম অনুযায়ী যাত্রীবাহী জাহাজে ডাক্তার হওয়া ছাড়া অন্য উপায় রইল না। সেখানেও সহযে কাজ জোটেনি। অনেক চেষ্টার পর ইংল্যান্ড-নিউইয়র্ক ফেরি জাহাজে কাজ পেলেন।

জাহাজে একঘেয়ে কাজ। সেখানেই রুগী দেখার পাশাপাশি উপন্যাস লেখা শুরু করলেন। নাম ‘দি এমিগ্রান্টস’। এক বছর চাকরি করে কিছু টাকা জমিয়ে লন্ডনে ফিরে এলেন। অনেক হিসেব কষে মেডিসিনের পরীক্ষা না-দিয়ে বসলেন সহজতর পরীক্ষায়। সোসাইটি অফ অ্যাপোথাকারিস-এর ডিপ্লোমা। পাশ করলেন এবং মিললো দুটি সার্টিফিকেট (এম আর সি এস এবং মেম্বার অফ সোসাইটি অফ অ্যাপোথাকারিস)। এবার ন্যুনতম যোগ্যাতা নিয়ে বসলেন ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল সার্ভিস (আই এম এস) পরীক্ষায়।

ইংরাজ জামানায় খাস ইংরাজ, সাদা রং। স্মার্ট যুবক। কথা-বার্তায় চৌখশ। জাহাজে রোগী দেখার অভিজ্ঞতা। বাবা ইন্ডিয়ান আর্মির অফিসার (সদ্য অবসর প্রাপ্ত)। এহেন যার বায়োডাটা সেই রোনাল্ড রস যে আই এম এসের ডাক্তার হবেন তা নিশ্চিত।

চাকরি হল কিন্তু তিনি অতি সাধারন। বাইশ জনের মধ্যে স্থান হল সতের নম্বরে। আর এই কারণে কম সম্মানীয় মাদ্রাস সার্ভিসের জন্য তিনি নির্বাচিত হলেন (অন্য দুটি—বাংলা এবং বম্বে প্রেসিডেন্সি)। এর পর প্রথা মাফিক প্রশিক্ষণ শিবির। গেলেন নে্টলে শহরের আর্মি মেডিক্যাল স্কুলে। ভারত ভূখণ্ডে কাজ করবেন তাই গ্রীষ্ম প্রধান দেশ বা ক্রান্তীয় জলবায়ু অঞ্চলের (tropical) রোগ সম্পর্কে জ্ঞান আবশ্যিক। কলেরা ম্যালেরিয়া এ সব রোগেই কাহিল ভারত এবং ভারতে বসবাসকারী রাজ-সম্প্রদায়। এদের চিকিৎসা করতে ফৌজি ডাক্তার হয়ে ইংল্যান্ড থেকে সোজা ভারতে এলেন রস (১৮৮১)।

মাদ্রাজ স্টেশন হাস্পাতালে প্রথম পোস্টিং। তেইশের তরতাজা যুবক। অবিবাহিত। ইংরাজের নীল রক্ত ধমনিতে। ভারতে জন্ম কিন্তু নিজেকে দারিদ্র, রোগ-জর্জর ভারত বাসীর সাথে একাত্ম ভাবতে পারেন না। চারদিকে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত মানুষ। রুগ্ন শরীর, স্ফীত উদর, রক্তহীনতা, অতি দুর্বলতা। যখন তখন জ্বরের কাঁপুনি। মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ছে লাখো লাখো মানুষ। এসব দেখে অজস্র ভাবনা ঘুরপাক খায় রোনাল্ডের মনে। কখনো কবিতা লিখছেন, ছবি আঁকছেন বা অঙ্ক কষছেন। কাজের ফাঁকে উপন্যাসও লিখছেন। আর ভাবছেন ম্যালেরিয়া নিয়ে কিছু কি করা যায়! ডাক্তার হিসাবে মানুষের রোগ মুক্তির প্রয়াস তো তার অন্যতম কর্তব্য। ভারতে কর্মরত অনেক ব্রিটিশ ডাক্তারের মত তিনিও ম্যালেরিয়া মুক্তির উপায় নিয়ে অধ্যয়ন ও ভাবনা শুরু করলেন।

ম্যালেরিয়া (ম্যাল মানে খারাপ, এয়ার মানে বাতাস) মানব ইতিহাসে অতি পুরাতন এক ব্যাধি। ভূমধ্য সাগরের উপকূল থেকে ভারত ও চীন দেশ জুড়ে ছিল এর বিস্তার। বহু প্রাচীন সভ্যতা এই রোগের করাল দাপটে ধ্বংসের মুখে। গ্রীক ঐতিহাসিক হেরাডোটাস (৪৮৪-৪৮৫ খৃষ্ট পুর্বাব্দ) মিশর থেকে জেনে এসেছিলেন ম্যালেরিয়া সম্পর্কে ওদের ব্যবহারিক জ্ঞান। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে উনি বলেলেন, ম্যালেরিয়ার আক্রমণ প্রতিহত করতে হলে মশার কামড় থেকে বাঁচতে হবে। তাই মশারি খাটিয়ে ঘুমানো অতি আবশ্যিক কাজ। পরবর্তী কালে আরও বহু জ্ঞান আয়ত্তে এলেও, ম্যালেরিয়ার উৎপত্তি বিষয়ে অজ্ঞ ছিল দুনিয়া। মশার দংশনই ম্যালেরিয়া রোগের কারণ এ তত্ত্ব বহু আলোচিত হোলেও এর সপক্ষে তথ্য-নির্ভর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা প্রতিষ্ঠিত হয়নি।

তখন উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি। বিজ্ঞানের অনুন্নত প্রেক্ষাপট। জীবাণু (Germs)। কীট পতঙ্গ, পরজীবী (parasites) সম্পর্কে মানুষের অতি সীমিত জ্ঞান। সবেমাত্র বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। কাজের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি অবশ্য আগেই স্থাপন করে দিয়েছিলেন ডাচ বিজ্ঞানি অ্যান্টনি লিউয়েনহুক (১৬৩২-১৭২৩)। কাচ ঘসে লেন্স বানিয়ে অণুবীক্ষণ যন্ত্র বা মাইক্রোস্কোপ তৈরি করেছেন। গোচরে এনেছেন অদৃশ্য সুক্ষ অসংখ্য বস্তু। ব্রিটিশ বিজ্ঞানি রবার্ট হুক (১৬৩৫-১৭০৩) অণুবীক্ষণ যন্ত্রের উন্নতি ঘটিয়ে এক মহা সত্য আবিষ্কার করলেন। হাতে কলমে দেখিয়ে দিলেন, উদ্ভিদ শরীর—কর্ক বা সোলা অসংখ্য কোষ (cell) দিয়ে তৈরি। এই ভিত্তি ভূমি থেকেই শুরু হোল জীব বিজ্ঞানের বহুমুখী যাত্রা।

অণুবীক্ষণ যন্ত্রের উপর নির্ভর করে জার্মান ডাক্তার তথা পরজীবী বিজ্ঞানের জনক রবার্ট হেইনরিখ হেরম্যান কখ (১৮৪৩-১৯১০) এনথ্রাক্স রোগের কারণ আবিস্কার করলেন (১৮৭৬)। কয়েক বছর পরই টিউবারকিউলোসিস (১৮৮২) এবং কলেরা রোগের জীবাণু আবিস্কার (১৮৮৩) করে ফেললেন। প্রসঙ্গ ক্রমে, টিউবারকিউলোসিস সংক্রান্ত গবেষণার জন্য উনি নোবেল পান ১৯০৫ সালে।

নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী ও কবি
স্যার রোনাল্ড রস স্মৃতিসৌধ, এস এস কে এম হাসপাতাল, কলকাতা।

আবিস্কার এবং জ্ঞানের এই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে আশা-নিরাশার দ্বন্দে ভারত ভূখণ্ডে তোলপাড় হচ্ছে ডাক্তার রসের হৃদয়। শল্য চিকিৎসা এবং ওষুধ প্রয়োগবিধি সম্পর্কে অবগত হোলেও বিজ্ঞান গবেষণায় অজ্ঞ তিনি। অণুবীক্ষণ যন্ত্রের ব্যবহার, কীটপতঙ্গ (Entemology) পরজীবী ইত্যাদি সম্পর্কে আদৌ ওয়াকিবহাল নন। তবুও ম্যালেরিয়া-গবেষণার প্রবল বাসনা উঁকি দেয় মনে।

ভারতে এক বছর কাজের অভিজ্ঞতা। চারদিকে শুধু বিপন্ন অসহায় ম্যালেরিয়া আক্রান্ত রোগী। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু মিছিল দেখে বাইশের উচ্চাকাঙ্ক্ষী যুবক– কবি ও চিকিৎসক, বুক ভাঙা যন্ত্রণায় পীড়িত। মাথায় কেবলি ঘুরপাক খায় ভাবনা—প্রাণঘাতী ম্যালেরিয়া নির্মূলের উপায় কী? এ সময়ের মনোভাব কবিতায় ব্যাক্ত করছেন ডাক্তার রস।

“এক্ষণে, হে নিসর্গ দেবী পূর্ণ করে দাও আর্তি মম
কেবলই চিন্তা আর ভাবনায় পিষ্ট, ধীর অতি ধীর আমার পদক্ষেপ
অশক্ত হাতে কেবলি লিপি বদ্ধ করি পেয়েছি যা সাক্ষাতে
অতি দূরের কোন অস্পষ্ট আলোয় যদি ঝলসে উঠে উত্তর
রিক্ত মুখে কেবলি ব্যাকুল প্রশ্ন, আরোগ্যের উপায় কি নেই?
জানাই, নেই, উত্তর অধরা আজও, শুধু ফিরি নিয়মের অন্বেষনে।
হে প্রভু ব্যক্ত কর অতি গুঢ় রহস্য তব
দৃশ্যাতিত ক্ষুদ্র সেই বস্তু, কোটি প্রাণের ঘাতক।”

ভারতে কয়েক বছর চাকরি করে প্রয়োজনীয় বহু কিছু কাজ শিখতে ইংল্যান্ডে গেলেন রোনাল্ড (১৮৮৮)। ম্যালেরিয়া ছাড়াও বহুবিধ ভাবনা-চিন্তা মাথায়। রয়্যাল কলেজ অফ ফিজিসিয়ানস এবং রয়্যাল কলেজ অফ মেডিসিন থেকে জনসাস্থ্য বিষয়ে ডিপ্লোমা পরীক্ষায় সফল হলেন। এছাড়াও জীবাণু বিজ্ঞানে (Bacteriology) পাঠ নিলেন অধ্যাপক ক্লেইনের (Prof. E E klein) কাছে। বহু অধ্যয়ন ও ট্রেনিঙ সাঙ্গ করে বিয়ে করলেন ডাক্তার রস। স্ত্রীর নাম রোশা বেসি ব্লক্সম্যান। বিয়ের পরের বছর (১৮৮৯) ভারতে ফিরে এলেন।

ছোট হাসপাতালে স্টাফ-সার্জেন তিনি। চাকরিতে সন্তুষ্ট নন। বহু অধ্যয়নেও আবিষ্কারের কোন দিকনির্দেশ মিলছে না। কেবলই ব্যর্থতা। প্রবল হতাশায় বার বার চাকরিতে ইস্তফা দেবার কথা ভাবছেন। পথের সন্ধান পেতে আবার ইংল্যান্ড গেলেন রোনাল্ড (১৮৯৪); দেখা করলেন ট্রপিক্যাল রোগের স্বনামধ্যন্য বৈজ্ঞানিক ডাক্তার প্যাট্রিক ম্যানসনের সঙ্গে। ড. ম্যানসনের অভিমত, ‘ভারতবর্ষই ম্যালেরিয়া-সংক্রান্ত গবেষণার উৎকৃষ্ট স্থান। মশার কামড়ই ম্যালেরিয়ার কারণ। তবে আমি জানি না এর প্রমাণ-নির্ভর তথ্য কী ভাবে আবিস্কার হবে’ [Memoirs]।

কী ভাবে আবিস্কার হবে রোনাল্ডও জানেন না। তবে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন, সাফল্য আসুক কিংবা ব্যর্থতা, ম্যেলেরিয়ার কারণ অনুসন্ধানই তাঁর জীবনব্রত। ডঃ ম্যানসন দীর্ঘ সময় ধরে রোনাল্ড রসকে গবেষণায় পরিচালিত করেছেন। উৎসাহ এবং সাহস জুগিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে (ডঃ রস ও ডঃ ম্যানসন) ১৮৯৫ থেকে ১৮৯৯ অবধি বহু পত্র (১৭৩) বিনিময় হয়। বিজ্ঞানের ইতিহাসে অতি মূল্যবান দলিল।

ভারতে ফিরে (মার্চ ১৮৯৫) ডাক্তার রস সেকেন্দ্রাবাদে কাজে যোগ দিলেন। কিন্তু ওখানে ম্যালেরিয়া গবেষণায় বাধা পড়ল। ব্যাঙ্গালোরে হঠাৎ মহামারীর আকার নিয়েছে অন্য ব্যাধি (কলেরা), তাই উপরওয়ালা নির্দেশে বদলি। ব্যাঙ্গালোরে থাকতে হ’ল প্রায় দু’বছর (১৮৯৫-১৮৯৭)। ওখান থেকে সেকেন্দ্রাবাদে ফিরে রুগী দেখার সঙ্গে সঙ্গে চলল ম্যালেরিয়া-গবেষণা। ভারতের তীব্র গরম, লু বইছে বাতাসে। কাজের অগ্রগতি ব্যাহত। তারমধ্যে উটিতে গিয়ে (১৮৯৭) ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হলেন রোনাল্ড। বন্ধ ঘরে মশারি খাটিয়েও তিনি ম্যালেরিয়ার কবলে পড়লেন। গবেষণা বন্ধ। তীব্র হতাশায় আচ্ছন্ন, যন্ত্রণায় দীর্ণ হয়ে কবিতা লিখলেনঃ

“কোন বেদনায় স্তব্ধ তুমি?/আজ কি শেষ বিচারের দিন?
রক্ত রাঙা আকাশ/পাহার ভাঙা রুক্ষ পথ।
আগুণ ঝরানো বাতাস/তপ্ত বালুকনায় পিষ্ট ধরিত্রী।
অনলে ঝলসানো ছিন্ন ভিন্ন/ দীর্ণ চরাচর।
ধরিত্রী আর স্বর্গের মহামিলন/ পথহারা তারকাদের/
স্বর্গে বসে কেবলি অশ্রু মোচন।”

পথের সন্ধানরত হতাশ কবি। সামনে বিষণ্ণ জগত, ‘ছিন্ন ভিন্ন দীর্ণ পৃথিবী’। তার মধ্যেই ম্যালেরিয়া গবেষণায় মনোনিবেশ করেছেন রোনাল্ড।

কিন্তু আবার কাজে বাধা পড়ল। বদলীর আদেশ নেমে এল। প্রথমে বম্বে পরে রাজস্থানে বদলী করা হল। কিন্তু সেই বছরেই তাঁকে কোলকাতায় প্রেসিডেন্সী জেনারেল হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয় (৭ই ফেব্রুয়ারী ১৮৯৭)। উদ্দেশ্য –ম্যলেরিয়া ও কালাজ্বর সম্পর্কে সমীক্ষা। কলকাতায় বসে (বর্তমানের শেঠ সুখলাল করনানি হাসপাতাল) অক্লান্ত গবেষণায় প্রমাণ করলেন যে ম্যালেরিয়ার কারণ মানুষের রক্তে এক কোষী পরজীবী প্লাসমোডিয়াম ফলসিপেরামের উপস্থিতি এবং অ্যানোফেলিস মশার দংশনে নিঃসৃত লালার মাধ্যমেই তা সঞ্চালিত হয়। ম্যালেরিয়া পরজীবী প্লাসমোডিয়ামের সম্পূর্ণ জীবনচক্র তিনি পরীক্ষায় প্রমাণ করলেন।

পরের ঘটনা স্থান পেয়েছে ইতিহাসে। হাজার বছর ধরে যে রোগের উৎপত্তি ছিল অজানা, রোনাল্ড রস তিন বছর অসাধ্য পরিশ্রম করে সমস্ত প্রতিকূলতা জয় করে মানব জাতিকে জানালেন একটি অতি প্রয়োজনীয় বৈজ্ঞানিক তথ্য। ড. ম্যানসন স্বপ্নেও ভাবেননি যে রোনাল্ড অসাধারন এক আবিষ্কার করে একদিন পৃথিবী বিখ্যাত হবেন। বৈজ্ঞানিক সত্য উদ্ঘাটিত হল কলকাতায় কাজ করে (২০-২১ অগাস্ট ১৮৯৭ সাল)। আবিষ্কারের দিনটিকে তিনি স্মরণীয় করে রেখেছিলেন কবিতার মাধ্যমে।

“আজ সেই অনিবার্য দিন
মুখ-ফেরানো ভগবান তুলে দিলেন হাতে
এতদিনে, অদ্ভুত বিস্ময়কর বস্তু এক;
বন্দি ঈশ্বর তব অমোঘ নির্দেশ
খুঁজে ফিরি গুপ্ত বানী
মেহনতি নিঃশ্বাস আর অশ্রু জলে।
দেখি তোমার ধূর্ত শয়তানের বীজ,
কোটি প্রাণ সংহারি যম।
অতি সামান্য এক দান তব
জানি লক্ষ প্রানের মহা অমৃত।
মৃত্যু, কোথা তব ভয়াল দংশন?
কবরের কোথায় বিজয় তোমার?”

সেই বছরেই (অগাস্ট ২১, ১৯৮৭) বৈজ্ঞানিক কাজে সাফল্য লাভের পেছনে ঈশ্বরের করুণা ও আশীর্বাদ অনুভব করে দীর্ঘ কবিতা ‘পরবাস’ (Exile) লেখেন তিনি। ইংল্যান্ডের বিখ্যাত কবি ও উপন্যাসিক জন মেন্সফিল্ড [(১৮৭৮-১৯৬৭), সি ফিভার, সল্ট ওয়াটার ব্যালাড (সঙ্কলন) কবিতার স্রষ্টা। মিড নাইট ফক, বক্স অফ ডিলাইটস উপন্যাসের লেখক] রোনাল্ড রসের কবিতা- এক্সাইল (পরবাস) প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘এটি বর্তমান কালের সর্বোৎকৃষ্ট। অনবদ্য কবিতা, দেশ ব্যাপি প্রচলিত ভাবনার জগতে পরিবর্তন ঘটিয়ে দিতে পারে’। ‘পরবাস’ (Exile) কবিতার কিছু অংশঃ

“তব চরণতলে লুটিয়ে রই প্রভু,
তোমার কারণেই গর্বিত উর্ধে রাখি শীর;
অতি পরাক্রম ক্ষুদ্র এক অবয়বে
প্রকাশ করেছো মহান শক্তি তোমার।
তাই তোমারি নাম গাই
তোমাতেই ঢালি চিত্ত মোর।
যদিও নাছোড় এক যুদ্ধ করেছি আমি
বিজয় অর্জন তোমার আশীর্বাদেই।”

ম্যালেরিয়ার কারণ আবিস্কারের (১৯৮৭) পাঁচ বছর পরে উনি পেলেন নোবেল পুরস্কার (১৯০২)। দু’হাজার বছরের মানব মনের জিজ্ঞাসার উত্তর খুঁজে পেয়েছিলেন স্যার রোনাল্ড রস। রসের তিন বছরের শ্রমসাধ্য পরীক্ষায় নিশ্চিত ভাবে প্রমানিত হয় যে অ্যানোফেলিস মশার দংশন মানব শরীরে ম্যালেরিয়া সৃষ্টি করে।

চিকিৎসা বিজ্ঞানে দ্বিতীয় নোবেল পুরষ্কার তাঁর হাতে তুলে দেবার কারণ হিসাবে নোবেল কমিটির মতামত— ‘রোনাল্ডের কাজের দ্বারা প্রামানিত হয়েছে কী ভাবে এই রোগ প্রাণী দেহে প্রবেশ করে। তাঁর গবেষণা ভবিষ্যৎ সাফল্যের ভিত্তি এবং এতে রোগ প্রতিরোধের উপায় নির্দেশিত করেছে ( ‘.. for his work in malaria, by which he has shown how it enters the organism and thereby has laid the foundation for successful research on this disease and methods of combating it)।

প্রসঙ্গক্রমে দু’টি উল্লেখযোগ্য বিষয়, অগাস্ট ২০ দিনটি বিশ্ব ব্যাপি ম্যালেরিয়া দিবস হিসাবে পালিত হয় এবং রসের আবিস্কারের পরেও ম্যালেরিয়া সংক্রান্ত গবেষণার কাজে, নতুন তথ্য উদ্ঘাটনের জন্য অনেক বিজ্ঞানি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। মশক বাহিত রোগের গবেষণা এখনো অব্যাহত।

পরের ঘটনাবলীর সংক্ষিপ্ত বিবরণঃ উপরওয়ালার নির্দেশে আসামে বদলী হোয়ে কালাজ্বর গবেষণার কাজ শুরু করলেন লাবাক চা বাগানের হাসপাতালে। প্রসঙ্গক্রমে, ড. রসের ব্যবহৃত মাইক্রোস্কোপ, যন্ত্রপাতি, তাঁর আঁকা মশার স্কেচ এখনো সযত্নে রাখা আছে। [কালাজ্বর বিষয়ে রসের অনুমান সঠিক ছিল না। ওঁর মতে কালাজ্বরের কারণও এক ধরনের মশার দংশন। কিন্তু পরবর্তীকালে প্রমাণিত হয়য় যে কালাজ্বরের মূলে বেলেমাছির (Sand fly) দংশন এবং রোগীর রক্তে লিসম্যানিয়া (Leishmania) গোত্রের প্রটোজোয়ার উপস্থিতি]।

রোনাল্ড রস ইন্ডিয়ান মেডিকেল সার্ভিসে ইস্তফা দিয়ে (১৯৯৯ সাল) ইংল্যান্ডের লিভারপুলে স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিনে অধ্যাপনায় যোগ দেন। বিশ্বব্যাপী ম্যালেরিয়া প্রতিরোধ কর্মকাণ্ডে (আফ্রিকা, গ্রীস, মরিশাস, সুয়েজ ক্যানাল, সাইপ্রাস, ভারত, শ্রীলঙ্কায়) অংশ নেন। বহু সম্মানে ভূষিত হন স্যার রোনাল্ড রস। আজীবন ম্যালেরিয়া প্রতিরোধ ও প্রতিবিধানে বিশ্বব্যাপী নিরলস কাজ করে গেছেন তিনি। দুই পুত্র ও দুই কন্যার জনক স্যার রোনাল্ড রসের মৃত্যু হয় লন্ডনে (১৬/০৯/১৯৩২)। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এবং রসের নামাঙ্কিত সংস্থায় (Ross Institute of Tropical Hygiene, লন্ডন,পত্তন ১৯১৬) ম্যালেরিয়া সম্পর্কে গবেষণা এখনও অব্যাহত।

তাঁর রচিত কবিতা, উপন্যাসের সম্পূর্ণ বিবরণ লিপিবদ্ধ করার কাজ এখনও অসম্পূর্ণ। কবিতা সংকলনের নাম — সাইকোলজিস, পোয়েমস, ফেব্লস অ্যান্ড স্যাটায়ারস। বড় কবিতা গুলির নাম, ইন এক্সাইল (In Exile), দি চাইল্ড অফ ওসান (The Child of Ocean), দি স্পিরিট অফ স্টর্ম (The Spirit of Storm)।

অপেক্ষাকৃত ছোট কবিতার নাম ডেথ অফ পিস (death of peace), হাস পেরাস (Hesperus), সেক্সপেয়ার ১৯১৬, (Shakespeare 1916 )।

রোনাল্ড রসের আরেকটি কবিতার কথা অবশ্যই উল্লেখযোগ্য, কবিতার নাম-পিতা (Father)।

“তবে এস পুত্র সমীপে আমার;
সত্য সন্ধানী তোমার দু-চোখ নিয়ে।
স্মৃতির ভাণ্ডার তুলে দেব আমি,
এবং আমায় দেবে তুমি যৌবনের দীপ্তি।

রুপালী চাদরে আপাদমস্তক আচ্ছাদিত হ্রদ,
সমগ্র অস্তিত্ব জুড়ে তার আলোড়ন;
জ্ঞান-প্রজ্ঞায় তোমায় ভরিয়ে দেব আমি,
এবং আমায় দেবে তুমি শক্তি দুর্বার।

কুয়াশার ঘন আবরণে ডুবন্ত মাঠ-ঘাট,
পাহাড় থেকে আছড়ে নামে জলের ধারা;
অটুট ধৈর্যে তোমায় ভরিয়ে দেব আমি,
এবং আমায় দেবে তুমি যৌবনের গতি।

যখন আকাশে আগুণ, বিদ্যুতের ঘনঘটা,
ক্রোধে উন্মত্ত রুঢ় প্রকৃতির দুঃসহ তেজ;
সাক্ষাতে সব গ্রহণ করে নেবে শিক্ষা;
এবং আমায় দেবে তুমি পরিপূর্ণ হৃদয়।

কর্তব্যের দীক্ষা আমি দেবো তোমায়,
পাবে দৃষ্টি এবং জানবে কর্ম-কৌশল;
সস্মমানে কীর্তির জয়ধ্বজা উড়বে তোমার হাতে,
এবং আমায় দেবে তুমি বুকভরা আশ্বাস।

যখন নীবিড় তমসায় আবৃত মহা ব্যোম,
উর্ধে তারকা খচিত উজ্জ্বল মহাকাশ;
ঈশ্বরের আশীর্বাদে কর্তব্যে অবিচল থাকবে সদা;
এবং আমায় দেবে তুমি ভালোবাসার শিক্ষা।”

শিল্প, বিজ্ঞান চর্চা এবং চিকিৎসকের অদ্ভুত সমন্বয় স্যার রোনাল্ড রস। বিজ্ঞান ও কাব্যের (Art) মেলবন্ধন করে উনি বলছেন ‘বিজ্ঞান হচ্ছে মানব মনের অন্তর কলন (differential calculus) আর শিল্প মানব মনের সমাকলন (Integral calculus)। আলাদা ভাবে দুই বিষয়ই সুন্দর কিন্তু একত্রিত হলে সুন্দরতম।’

বহুমুখী প্রতিভা তবুও বিজ্ঞান চর্চার ইতিহাসে স্যার রোনাল্ড রস বহু বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। যেমন গবেষণার উপদেষ্টা ডাক্তার প্যাট্রিক ম্যানসনের সাথে বিরোধ, ইটালির বিজ্ঞানি ডাক্তার ব্যাতিস্তা গ্রাসির ম্যালেরিয়া প্যারাসাইট আবিস্কার সম্পর্কে বিরুপ মন্তব্য করা, তৎকালীন ভারতীয় কর্মী এবং সহ-গবেষকদের অবদানের কথা স্বীকার না করা। এ সব বিতর্ক বর্তমান আলোচনায় অপ্রাসঙ্গিক।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
ড.সৌমিত্র কুমার চৌধুরী, ভূতপূর্ব বিভাগীয় প্রধান ও এমেরিটাস মেডিক্যাল স্যায়েন্টিস্ট, চিত্তরঞ্জন জাতীয় কর্কট রোগ গবেষণা সংস্থাণ, কলকাতা-700 026. প্রকাশিত গ্রন্থ- বিজ্ঞানের জানা অজানা (কিশোর উপযোগী বিজ্ঞান), আমার বাগান (গল্পগ্রন্থ), এবং বিদেশী সংস্থায় গবেষণা গ্রন্থ: Anticancer Drugs-Nature synthesis and cell (Intech)। পুরষ্কার সমূহ: ‘যোগমায়া স্মৃতি পুরস্কার’ (২০১৫), জ্ঞান ও বিজ্ঞান পত্রিকায় বছরের শ্রেষ্ঠ রচনার জন্য। ‘চৌরঙ্গী নাথ’ পুরস্কার (২০১৮), শৈব ভারতী পত্রিকায় প্রকাশিত উপন্যাসের জন্য। গোপাল চন্দ্র ভট্টাচার্য স্মৃতি পুরষ্কার (2019), পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিজ্ঞান প্রযুক্তি ও জৈবপ্রযুক্তি দফতর থেকে), পঁচিশ বছরের অধিক কাল বাংলা ভাষায় জনপ্রিয় বিজ্ঞান রচনার জন্য)।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!