ছোট গল্প: নীল পাখিটা

উস্রি দে
উস্রি দে
10 মিনিটে পড়ুন
সাময়িকী আর্কাইভ

ডোর বেলটা বেজে উঠতেই গ্যাসের নবটা অফ করে ন্যাপকিনে হাত মুছে তড়িঘড়ি দরজার দিকে এগোল আভেরি। কিন্তু এরই মধ্যে উপমন্যুর গলার আওয়াজ আর টিটোর কলকলানি কানে পৌঁছেছে ওর। সামনে গিয়ে যা দেখল তাতে তো চক্ষুস্থির।
ড্রয়িং রুমের বেতের মোড়াটা টেনে নিয়ে দরজার কাছে রাখা, উপমন্যু ঘরের ভেতরে, টিটো বাবার কোলে।
“হাঁ করে দেখছ কি, টিটো বাবু কত্ত বড় হয়ে গেছে! হি হ্যাজ ওপেনড দ্য ডোর এপ্ল্যাইং হিজ উইট, আমেজিং!” বলেই ছেলেকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে লাগল উপমন্যু।
“ঠিক আছে, ওকে নামাও এবার। হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও তো। আজ একটা স্পেশাল ডিশ বানিয়েছি।“
“হ্যাঁ, এই যে যাচ্ছি”, ছেলেকে কোল থেকে নামাতেই টিটো বাবার জামাটা টানতে লাগল।
“কি হল টিটো, কি বলছ?”
“আমার বই?”
“ওহো, তাই তো, ঠিক মনে আছে!” অফিস ব্যাগ খুলে একটা প্যাকেট বের করল উপমন্যু। টিটো প্রায় ঝাঁপিয়ে চলে গেল তার বাপির কাছে। আভেরি টিটোকে টেনে আনতে চাইল-
“উঁহু, এখন বাপিকে ছেড়ে দাও টিটো, বাপি ফ্রেশ হয়ে নিক, পরে দেখাবে, বই তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না!”
কিন্তু টিটো নাছোড়বান্দা। ততক্ষণে প্যাকেট খুলে ফেলেছে উপমন্যু। ছেঁড়া কাগজের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারছে এক গুচ্ছ কমিকস, টিনটিন এর। চোখ দুটো চকচক করে উঠল টিটোর। আর আভেরির দু চোখের তারায় ঘনাল বিষণ্ণতার ছায়া।

“ডেলিশাস! নাঃ আভেরি, তোমার প্রিপারেশন রিয়ালি একসেলেনট! কোথায় লাগে মেইন ল্যান্ড চায়না!”
“যাঃ, এটা বাড়াবাড়ি!”
“নট অ্যাট অল হানি, বরং বলতে পারো কমই বলা হল।”
“বাপি, আজ রাতে ডিনারের পর আমায় টিনটিন পড়ে শোনাবে কিন্তু, প্রমিস?”
“আচ্ছা, সে হবে খন, এখন তো বই নিয়ে বোসো, কি কি হোম ওয়ার্ক আছে দেখি, করতে হবে তো, নাকি?” টিটোকে কাছে টেনে নিতে নিতে বলে আভেরি। টিটো কিন্তু ওর হাত ছাড়িয়ে বাবার গা ঘেঁষে বসে। আভেরির বুকটা কি এক অজানা ব্যথায় টনটন করে ওঠে। কমিকস এর পোকা হয়ে উঠেছে এই একরত্তি ছেলেটা। আর সবই সেই বিদেশী গল্প। অবশ্য বাচ্চাটাকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। উপমন্যুই ছেলের টেস্ট তৈরি করে দিয়েছে অনেক ছোট থেকে, ইংরেজি কমিকস এনে ঘর বোঝাই করে। আভেরি কিছু বলতে গেলেই শুনতে হয়েছে
“টিটো কে স্মার্ট গাই হতে হবে, সামনে যা দিন আসছে, ওকে তো কমপিট করতে হবে সবার সাথে, এটা বোঝ না?”
“তা বলে নিজের ভাষার এত সম্পদ – রবীন্দ্রনাথ, সুকুমার রায়, বিভূতিভূষণ কিছুই জানবে না ও!” পাল্টা যুক্তি সাজায় আভেরি।
“রাখো তোমার ওসব বস্তাপচা ট্র্যাশ লেখা! ওগুলোর কোন ভ্যালু নেই আজকের দুনিয়ায়। আর তাছাড়া ইংলিশ তো মাস্ট, শিখতেই হবে ভাল করে, নয়তো রেপুটেড স্কুলে এডমিশন হবে কি করে টিটোর?”
আর কথা বাড়ায় না আভেরি। উপমন্যু ছোট থেকেই কার্শিয়ং কনভেন্ট এ থেকে পড়াশুনো করেছে। পরবর্তীতে আই আই টি হোস্টেল এ। কেমন যেন ছিন্নমূল লাগে আভেরির। এমনকি নিজের বাবা মায়ের সাথে সম্পর্কের মধ্যেও কোথায় একটা পোশাকি ভদ্রতা লুকিয়ে থাকে উপমন্যুর ব্যবহারে। অবাক লাগে, খুব অবাক লাগে আভেরির। আসলে ওর নিজের বাড়ির আবহ টাই যে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরণের। আভেরির বাবা ইংরেজির অধ্যাপক ছিলেন ঠিকই, তবে বাংলা সাহিত্যেও ছিল অগাধ জ্ঞান। মা রবীন্দ্রসংগীতের একজন বিশিষ্ট শিল্পী। ভাই আর ও ছোট থেকেই একটা ক্লাসিক্যাল বাতাবরন এর মধ্যে মানুষ হয়েছে। মনে আছে, ছুটির দিনে ওদের সকাল শুরুই হত বাবার দৃপ্ত কণ্ঠের আবৃত্তি দিয়ে “আজি এ প্রভাতে রবির কর, কেমনে পশিল প্রানের পর” ভাবলে আজও রোমাঞ্চ হয়। আবৃত্তি শেষ হতে না হতেই ওদিকে হারমনিয়ামে গান ধরতেন মা – “এদিন আজি কোন ঘরে গো খুলে দিল দ্বার, আজি প্রাতে সূর্য ওঠা, সফল হল কার।“ আবার কখনও কখনও– বাবা একটা দুটো বিরল শব্দ দিয়ে মা কে বলতেন এমন গান গাইতে, যে গানের কথায় ওই শব্দগুলো রয়েছে। বেশির ভাগটাই মা পেরে যেতেন। কোন কোন সময় আটকে গেলেই বাবা মিটিমিটি হাসতেন। মা কপট রাগ দেখিয়ে উঠে যেতেন। খুব মজার ছিল সেসব দিন, আনন্দে ভরপুর। কোন কোন দিন, বাবা ওয়ার্ডসওয়রথ থেকে উদ্ধৃতি দিতেন – “ My heart leaps up when I behold a rainbow in the sky “ তুলনা টানতেন রবীন্দ্র ভাবনার সাথে “হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে ময়ুরের মত নাচেরে।” বলতেন, ভাষা শিক্ষা অসম্পূর্ণ থেকে যায় ধ্রুপদী সাহিত্য পাঠ না করলে। আর আমাদের বাংলায় এত এত মনি মুক্তো ছড়ানো, যে শুধু কুড়িয়ে নেওয়ার অপেক্ষা! আর উপমন্যু সেই চিরন্তন সাহিত্যকেই অস্বীকার করে! আঘাত লাগে, মনের তারে কোথায় যেন বেসুরো বাজে। খুব ঠুনকো আর সস্তা মনে হয় উপমন্যুর এই শো অফ।

রাত এখন গভীর। সন্ধ্যেয় ঝড় বাদল হওয়াতে এখন ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। বেড রুম এর মৃদু নিলাভ আলোয় আভেরি উঠে বসে সস্নেহে চাদরটা টেনে দিল টিটোর গায়ে। কপালের চুলগুলো আলতো হাতে সরাতে সরাতে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে কী এক মমতায় বুকের ভেতরে ব্যথা করে ওঠে আভেরির। মনে পড়ে যায়, মফস্বলের ছোট্ট একতলা বাড়ি। গরমের দিনে লোডশেডিং এর রাতে ছাদের মধ্যে মাদুর পেতে বাবার পাশটিতে শুয়ে আকাশের তারাদের চিনতে শেখা। আর ……আর গল্প শোনা – রূপকথার! একের পর এক – ঠাকুরমার ঝুলি। এক একদিন বাবার চোখ লেগে আসে ঘুমে, ওদিকে রাজপুত্র রাজকন্যারা তখন ভীষণ ভাবে উপস্থিত ছোট্ট আভেরির কল্পনায়। তার আর তর সয় না। “বল না বাপি, ও বাপি, তারপর? তারপর কী হল?” বাবা কোনমতে অর্ধনিমীলিত চোখে “তারপর? তারপর তো নীল পাখিটা উড়তে উড়তে………।” টিটো কোনও দিন জানবে না ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমীর কথা, লালকমল নীলকমলেরা যুদ্ধ করবে না রাক্ষসীদের সাথে টিটোর কল্পলোকে। নীল পাখিটা ডানা ভেঙে পড়ে আছে যে! একটা দীর্ঘশ্বাস চাপে আভেরি।

দুপুর বেলাটা বেশ নিঝুম থাকে চারপাশ। শহরের এদিকটায়, রাজারহাটের এই হাউজিং কমপ্লেক্স টা এমনিতে বেশ খোলামেলা। সাত তলার ব্যালকনি থেকে যতদূর চোখ যায় ধু ধু প্রান্তর, সবুজের শ্যামলিমা, আর মাঝে মাঝে এক একটা নির্মীয়মাণ স্পর্ধিত আবাসন আকাশের নীলে থাবা বসাচ্ছে। বড় দৃষ্টিকটু লাগে আনন্দরূপের চোখে ওই নান্দনিক ছন্দপতন! আসানসোলে নিজের ছোট্ট বাড়ির চারদিকে পাঁচিল ঘেরা এক চিলতে জায়গাতেও কিছু ফুলের গাছ আছে, পরিচর্যাও করা হত, তবে আত্রেয়ী চলে যাওয়ার পর থেকে আর সেভাবে……। মেয়ে জামাইয়ের এই সাত তলা ফ্ল্যাটে এসে প্রথম প্রথম কেমন যেন হাঁপিয়ে উঠতেন আনন্দরূপ। মাটির স্পর্শের জন্য কাতর হতো মন। সকাল সন্ধ্যে বেড়িয়ে পড়তেন, খানিকটা হেঁটে আসতেন। এখন অবশ্য অনেকটাই মানিয়ে নিয়েছেন নিজেকে। উপমন্যুর অফিস থেকে ছ মাসের জন্য ওকে সুইতজারল্যান্ড পাঠানোর প্রেক্ষিতেই আনন্দরূপের এখানে আসার সিদ্ধান্ত। নার্সারি ছেড়ে এ বছর ই টিটো বাবুর বড় স্কুলে এডমিশন। টিটো বাবু যে এখন ফোর প্লাস! একা আভেরির পক্ষে সবটা সামলানো বেশ মুশকিল উপমন্যুর অনুপস্থিতিতে। তাই সবদিক বিবেচনা করেই এই ব্যবস্থা। আভেরির ভাই আরাধ্য চাকরি সূত্রে পুনে তে। ওর স্ত্রীও চাকরি করছে ওখানে। আসানসোলে আনন্দরূপ একদম একা। আভেরি তাই একরকম জোর করেই বাবাকে আনিয়েছে এখানে। মাও দুবছর হল চলে গেছেন। বাবার আর কিসের পিছুটান!

পেছন থেকে জামার হাতায় টান পড়তেই রেলিং এ ভর দিয়ে ঝুঁকে থাকা আনন্দরূপের শরীরটা আপনা থেকেই ঘুরে গেল।
“দাদাই, ঘরে চলো, গল্প শুনব তো!” মৃদু হেসে আনন্দরূপ টিটোকে কাছে টেনে নিলেন।
“কিন্তু তুমি তো একটু আগে স্কুল থেকে ফিরেছ। এখন খেয়ে দেয়ে বিশ্রাম নিতে হবে যে!”
“আমার খাওয়া হয়ে গেছে। এখন চলো তো, গল্প বলবে!”
“কি হল টিটো, দাদাই কে বিরক্ত করছ?” আভেরির আচমকা আবির্ভাব।
“না না, বিরক্ত করবে কেন, আমাদের টিটো বাবু কি দুষ্টু নাকি?”
“ না, এক্কেবারে গুড বয়!” ঠোঁটের ফাঁকে হাসল আভেরি।
“ বা রে, তুমি যে সেদিন টেস্ট নিলে, তাতে আমি তো সবই রাইট করেছি।”
“ হু, বুঝেছি। এডমিশন টেস্ট গুলোতেও সব পারতে হবে কিন্তু!”
“ হ্যাঁ হ্যাঁ, টিটো বাবু সবই পারবে। তুই এত টেনশন করিস না তো, বাচ্চাটাকেও নার্ভাস করে দিচ্ছিস।”
“চলো না দাদাই, ঘরে চলো”, আনন্দরূপের হাত ধরে টানতে থাকে টিটো।
“হ্যাঁ হ্যাঁ, চলো দাদা চলো”, বলতে বলতে ঘরের ভেতরে ঢুকে খাটে গিয়ে বসলেন আনন্দরূপ। নাতিকে কাছে পেয়ে মনটা ভরে গেছে ওঁর। আত্রেয়ীর অভাব বোধ টা আজ আর অত তীব্র নয়। মাথার বালিশটা টেনে নিলেন। পাশেই ছোট্ট বালিশ নিয়ে হাজির টিটো।
“হু, এবার বল”, উদগ্রীব টিটোর চোখ দুটো চকচক করছে গল্পের টানে।
“কোনটা যেন বলছিলাম কাল? চাঁদের পাহাড় থেকে পড়ছিলাম, তাই তো?”
“না না, ওটা তো শেষ হয়ে গেছে। আজকে রূপকথা শুনব তো!”
তিন মাসেই ‘আবোলতাবোল’, ‘শিশু’, ‘বুড়ো আংলা’, ‘চাঁদের পাহাড়’ – মোটামুটি এসবের সাথে পরিচয় হয়ে গেছে টিটোর। অদম্য কৌতূহলে গোগ্রাসে গেলে সে দাদাই এর বলা ছড়া গল্প সব। এই কদিনে টিনটিন, ফ্যানটম রা আর হানা দিতে পারেনি
টিটোর কল্পলোকে!
“রূপকথা! আচ্ছা, কোন কাহিনী টা শুনতে চাও ?”
“ওই যে, লালকমল আর নীলকমল, ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছে, যাচ্ছে তো যাচ্ছে, তারপর?”
“তারপর, রাজকন্যা তো সোনার পালঙ্কে ঘুমিয়ে আছে, এদিকে হয়েছে কি নীল পাখিটা উড়তে উড়তে……….”
ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে গল্পের রেশ টুকু কানে যেতেই বুক জুড়িয়ে যায় আভেরির। প্রানভরে শ্বাস নেয় ও। নীল পাখিটা তাহলে আজও ওড়ে, ডানা মেলে একই রকম ভাবে!

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
লেখক: উস্রি দে
নিবাস পশ্চিমবঙ্গ। দীর্ঘদিন ধরে লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত আছেন।
১ টি মন্তব্য

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!