গল্প: এক ফালি রোদ্দুর

উস্রি দে
উস্রি দে
4 মিনিটে পড়ুন

আজ একটু তাড়াতাড়িই সন্ধ্যে নেমে গেছে। আকাশে মেঘের ঘনঘটা। বাস থেকে নেমে বেশ কিছুটা পথ হেঁটে যেতে হবে। বাবার শরীরের যা অবস্থা। অসহায় আত্রেয়ী একটাও রিকশা দেখতে পেল না স্ট্যান্ডে। অগত্যা বাবার হাত টা শক্ত করে ধরে এগোতে লাগলো। হাসপাতালের রেডিওলজি ডিপার্টমেন্টে এত রোগীর ভিড়, ওখানেই খুব দেরী হয়ে গেল।
কিছুদূর হেঁটে চিত্তর চায়ের দোকানের কাছাকাছি আসতেই তীব্র শিসের শব্দ কানে এল। এতক্ষণ বাবার অসুস্থতার চিন্তাতেই মনটা আচ্ছন্ন ছিল আত্রেয়ীর। এবারে নজরে পড়ল ভিকি মস্তান তার স্যাঙ্গাতদের নিয়ে চায়ের দোকানের বেঞ্চ দখল করে বসে আছে। আত্রেয়ীই যে তাদের টার্গেট, অনুভব করতে পেরে ভেতরে ভেতরে শিউরে উঠল ও। এই অঞ্চলে ওরা ভাড়া এসেছে বেশিদিন হয় নি। আসা ইস্তক সবার কাছেই শুনেছে এই মস্তানের দল সম্পর্কে। যা খুশি করে বেড়ায় ওরা। ওদের বাধা দেওয়ার সাধ্য নেই কারোর।
টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হয়েছে ইতিমধ্যে। কাঁধের ব্যাগ থেকে ছাতাটা বের করতেও যেন হাত সরছে না আত্রেয়ীর। মনে হচ্ছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব রাস্তাটা যদি পার হয়ে যাওয়া যায়। রাস্তার লাইটগুলো জ্বলছে না। দোকানের টিমটিমে আলোয় কেমন একটা আলো আঁধারই মতন হয়ে আছে জায়গাটা। বাবাকে প্রায় জড়িয়ে ধরে দ্রুতপায়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল আত্রেয়ী। পেছন থেকে আওয়াজ আরও জোরদার হয়েছে। আত্রেয়ীর কানে এখন কিছুই ঢুকছে না, একটা ঘোরের মধ্যে এগোচ্ছে ও। হঠাত আত্রেয়ী দেখল আর এগোনো যাচ্ছে না। সামনে পেছনে দুপাশে লোক– নিঃশব্দে ঘিরে ফেলা হয়েছে ওদের। আতঙ্কে সারা শরীর অবশ হয়ে গেল ওর, চীৎকার করতে চাইছে, কিন্তু গলা দিয়ে স্বর বেরোচ্ছে না।
“বুড়োটাকে জায়গামত রেখে আসছি, গুরু। তুমি কচিটাকে ততক্ষন সাইজ কর, ”বলেই খিঃ খিঃ করে একটা কুৎসিত হাসি আত্রেয়ীর কানে যেন গরম সিসে ঢেলে দিল। কেউ একজন হ্যাঁচকা টানে বাবাকে ওর থেকে বিচ্ছিন্ন করল। বাবার আর্ত চীৎকার, যদিও অস্ফুট, শোনা গেল। ততক্ষনে ওর ওড়নাতেও পরেছে টান।
“কী করছেন কি আপনারা! ছেড়ে দিন! আমার বাবা অসুস্থ, ক্যান্সার পেশেন্ট!” নিজেকে মুক্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা করতে করতে আত্রেয়ীর গলা দিয়ে আর্তনাদ বেরোল – ‘আপনারা কি মানুষ!’
এদিকের রাস্তার পাশে লাহাদের অনেক পুরনো জায়গা জমি খালি পড়ে আছে, বিশাল আমবাগান- সব। স্ট্রিট ল্যাম্প জ্বলে না এদিকটায় কোনদিনই । তাহলে যে ভিকির দলের একশনের অসুবিধে! মনে মনে এতদিনের ঘটে যাওয়া দৈনন্দিনের ধর্ষণের খবর – নির্ভয়া, কামদুনি, কাটোয়া– সব কেমন আচ্ছন্ন করে ফেলেছে আত্রেয়ীর চেতনাকে। হঠাত একটা তীব্র আলোর ঝলকানি– চোখ ধাঁধীয়ে গেল আত্রেয়ীর। জোরালো টর্চের আলোয় স্পষ্ট দেখা গেল ভিকিকে। একদম ওর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। চোখগুলো লাল, চুল উস্কোখুস্ক, গালে কয়েকদিনের না কামানো দাড়ি। মুখ দিয়ে বিজাতীয় গন্ধ বেরোচ্ছে। থরথর করে কাঁপছে আত্রেয়ী , ওর দুহাত ধরে আছে দুজনে। এরমধ্যে একটা গলা শোনা গেল–
“গুরু”, একবার এদিকে দেখো তো, এ বুঢঢা শালা পটকে গেল নাকি!”
“বাবা!” একটা আর্ত স্বর বেরোল আত্রেয়ীর গলা চিরে, টর্চের আলো ঘুরে গিয়ে এবার বাবার মুখের ওপর। রাস্তার মধ্যে শুয়ে পড়েছে মানুষটা।
“একি! কী করেছিস!” একটা অদ্ভুত বিস্ময়সূচক আওয়াজ বেরোল ভিকির গলা চিরে। সঙ্গে সঙ্গে নিচু হয়ে প্রৌঢ়কে পাঁজাকোলা করে তুলে নিল ভিকি , ছুটতে লাগল পেছন দিকে, সঙ্গে চ্যালারাও। চিত্তর দোকানের বেঞ্চে শুইয়ে চোখে মুখে জল দিতেই মানুষটার জ্ঞান ফির। উদ্বিগ্ন আত্রেয়ীর দিকে নজর পড়তেই উঠে বসতে চেষ্টা করল দুর্বল মানুষটা।
“উঁহু, উঠবেন না স্যার। শুয়ে থাকুন। আমি গাড়ি ডাকতে পাঠিয়েছি, বাড়ি পৌঁছে দেবে।“
“স্যার!” আত্রেয়ী সুদ্ধ সব্বাই হাঁ!
“আর…আর স্যার, পারলে ক্ষমা করে দেবেন এই অপদার্থ বিক্রম সরকারকে।“
হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসলো ভিকি তার একদা ভীষণ প্রিয় কেদার স্যারের পায়ের কাছে, যিনি একদিন তাকে স্কুল থেকে রাস্টিকেট হওয়া থেকে বাঁচিয়ে পড়াশুনো চালিয়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। এলাকার ত্রাস ভিকি মস্তানের চোখ দুটো আজ বহুদিন বাদে জ্বালা করে উঠল।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
লেখক: উস্রি দে
নিবাস পশ্চিমবঙ্গ। দীর্ঘদিন ধরে লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত আছেন।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!