গল্প: সে অনেক দিন আগে

ড. সৌমিত্র কুমার চৌধুরী
ড. সৌমিত্র কুমার চৌধুরী
17 মিনিটে পড়ুন

লেখক: ন্যানদিন গরডিমার
অনুবাদ: সৌমিত্র কুমার চৌধুরী

ছোটদের জন্য একটা লেখা দিতে হবে, চিঠিতে অনুরোধ জানালেন একজন। শিশুদের একটা গল্প সংকলন বেরোবে। তাতে আমার লেখাও রাখতে চান। পত্রপাঠ জানিয়ে দিলাম, আমিতো বাচ্চাদের জন্য লিখি না। উত্তরে তিনি লিখলেন, ‘বই মেলার আলোচনা চক্রে এক সাহিত্যিক তো বলেছেন, সব লেখকেরই উচিৎ শিশুদের জন্য অন্তত একটা গল্প লেখা!’
এবারেও ভদ্রলোকের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করবো। অভিমত জানাতে চিঠি লিখতে শুরু করেছিলাম গত রাত্তিরে। কিন্তু হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। বলা উচিৎ কে যেন আমার ঘুমটা ভাঙিয়ে দিল।
মনের অবচেতন প্রকোষ্ঠে কেউ যেন ডাক দিয়ে উঠল। ঘ্যাঁস্‌স ঘ্যাঁস্‌স। কেমন যেন একটা শব্দ! ঘরে কাঠের মেঝে। কেউ যেন মেঝের উপর দিয়ে একটার পর একটা ভারী জিনিস টেনে নিয়ে যাচ্ছে। ঘষ্টানির শব্দ। আওয়াজ গুলো ঢুকে ঢুকে কানের ফুটোটাই বড় করে দিল।
ওঃ, একটু পরে আবার সেই ঘ্যাঁস্‌স ঘ্যাঁস্‌স। পায়ের শব্দ এগিয়ে আসছে। এক ঘর থেকে আরেক ঘর পেরিয়ে আমার দরজায় এসে থামবে! বাড়িতে কোন চোরঘণ্টি লাগানো নেই যে শব্দ করে অন্য লোক ডাকবো। বালিশের নিচে কোন বন্দুকও রাখা নেই। অবশ্য এগুলো যাদের ঘরে থাকে তদেরও যে ভয় কিছু কম হয়, তা নয়। আমার বাড়িতে জানলায় ঠুনকো কাচ। মদের গ্লাসের মত একটু লাগলেই চুরচুর হয়ে যাবে। গত বছর এক বিধবা মহিলা দিন দুপুরে খুন হয়ে গেল। দুটো ব্লক পরের একটা বাড়িতে তিনি থাকতেন। তাঁর বাড়ির এক ঠিকা-কর্মীকে টাকা না-মিটিয়ে ছাঁটাই করে দিয়েছিলেন। রাগে লোকটি মহিলার পেটে ছুড়ি ঢুকিয়ে দিল। মার্ডার করবার আগে গলায় ফাঁস লাগিয়ে মেরে ফেলেছিল তাঁর পোষা কুকুরটাকে। হিংস্র কুকুর, দিন রাত মহিলাকে পাহারা দিয়ে রাখতো। তাঁর ছিল পুরনো ঘড়ির বিরাট সংগ্রহ। সেটা কুকুরের পাহারায় সুরক্ষিত থাকতো।
দরজার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। কেউ একজন এগিয়ে আসবে ধরে নিয়ে অন্ধকারে স্থির হয়ে শুয়ে রইলাম। ভয়ে ধক ধক করছিল বুক। হৃৎপিণ্ড লাফিয়ে ধাক্কা মারছিল বুকের খাঁচায়। কী অদ্ভুত শরীরের নিয়ম!। স্থির হয়ে বিশ্রাম নিতে নিতে চোখ বন্ধ করলাম। কিন্তু ঘুম এলে তো!
বিদঘুটে আওয়াজ ভেসে আসছে। এমন শব্দ আগে কখনও মনোযোগ দিয়ে শুনিনি। ছোট্ট অস্পষ্ট ধ্বনি। শব্দটা কী রকম, কতটা ক্ষতি করতে পারে সে নিয়েও ভাবছিলাম। তবে বুঝতে পেরেছিলাম, তেমন ভয়ের মতো কিছু নয়। তবে হতেও তো পারে যে কোন সময়ে। বুঝতে পারছি ঘরের কাঠের মেঝেয় কোন মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে না। পুরনো মেঝের যেখানে চাপ পড়ছে তার কেন্দ্রস্থল থেকেই কড়কড় কড়কড় আওয়াজ উঠছে।
যে ঘরে ঘুমিয়ে ছিলাম সেটা তৈরি হয়েছিল এক গভীর খাদের মধ্যে। আমার বিছানার নিচে ঘরের মেঝে। তার অনেক নিচে মাটির অনেক গভীরে বাড়ির শক্ত ভিত; আর সোনার খনির ভিতর পায়ে চলা সরু পথ। সোনা খুঁড়তে খুঁড়তে পাহাড় ফাঁপা হয়ে গেছে। হাওয়া লাগলেই পুরো ঘরটা কেঁপে উঠে খানিক সরে যায়। অস্বস্তিকর টানা-পোড়েন সৃষ্টি হয় ঘর জুড়ে। ইট সিমেন্ট কাঠ আর কাচের মধ্যে। হৃৎপিণ্ড সশব্দে কেঁপে ওঠে। কাঠের জাইলোফনটা ঢেকে রাখবার সময় যেমন শব্দ হয় তেমন আওয়াজ ওঠে। ঘরে রাখা কাঠের জাইলফোনটা বানিয়েছিল চোপি আর সনিয়া। ওরা দু’জনেই পরিযায়ী খনি শ্রমিক। মোজাম্বিক থেকে এসেছিল। হয়ত সে সময় ওরা খাদের মধ্যেই ছিল। ভিতের যেখানে চাঙড় ভেঙে পড়ে সে সব আসলে অব্যবহৃত জায়গা। সেখানকার ফাঁপা নালী গুলো দিয়ে জল চুঁইয়ে পড়ে। সে জায়গাটাই আবার বিশাল সমাধিক্ষেত্র। বহু মানুষের দেহ চাপা পড়ে আছে ওখানে।
এখন এমন অবস্থা যে মনটাকে শরীর থেকে দূরে সরিয়ে রাখবো, তার উপায় নেই। অগত্যা নিজেকেই একটা গল্প শোনাতে শুরু করলাম। ঘুম পাড়ানি গল্প।
নগরী সংলগ্ন এক শহরতলি। সেখানে এক পরিবার সুখে বাস করত। স্বামী স্ত্রী আর তাদের একটি ছেলে। ছেলেটিকে খুব ভালবাসতেন তাঁরা। স্বামী স্ত্রীর মধ্যেও ছিল গভীর ভালোবাসা। তাদের ছিল একটা পোষা বিড়াল আর কুকুর। কুকুরটিকে খুব ভালবাসত বাড়ির ছেলেটি। পরিবারের ছিল মোটরগাড়ি আর একটা ক্যারাভ্যান। ছুটির দিনে সবাই বেড়িয়ে পড়ত ক্যারাভ্যান নিয়ে। আর তাদের ছিল একটা সুইমিং পুল। আশপাশের বাড়ির ছেলেমেয়েরা সুইমিং পুলে গিয়ে যাতে ডুবে না যায় তাই শক্ত বেড়া দিয়ে ঘেরা থাকতো ওটা। পরিবারে থাকতো খুব বিশ্বাসযোগ্য এক গৃহকর্মী। আর এক জন পরিশ্রমী মালী। প্রতিবেশীরা জানিয়েছিল মালী মানুষটা খুব ভালো।

গুছিয়ে সংসার করছিল স্বামী-স্ত্রী। এক সময় সুখ নেমে এল তাঁদের জীবনে। তখন তাদের আরেকটু সাবধান করে দিল বাড়ির বৃদ্ধা সদস্যা। ভদ্রলোকের মা। বললেন, ‘বাইরের ছেলেপুলেকে বাড়ির মধ্যে কিন্তু ঢোকাবে না তোমরা।’
পরিবারটি সব দিক দিয়েই সুরক্ষিত। মেডিক্যাল বেনিফিট সোসাইটিতে সকলের নাম নথিভুক্ত। কুকুরটির লাইসেন্স, বাড়ির ইন্সিওরেন্স সবই করানো হয়েছিল। আগুন বন্যা চুরি জাতীয় কিছু ঘটলে ক্ষতিপূরণ দেবে বীমা কোম্পানি। স্থানীয় প্রতিবেশী পর্যবেক্ষণ সমিতির সদস্য হয়ে বাড়ির দরজায় লাগানোর একটা ফলক জোগাড় করেছিল তারা। ফলকে মুখোশ আঁটা মালিকের ছবি। আর বড় বড় লেখা, ‘সাবধান! বাইরের লোকের প্রবেশ নিষেধ।’ ছবিতে মালিকের মুখ মুখোশে ঢাকা। তাই বোঝা যাচ্ছে না, তিনি কালো চামড়ার মানুষ না সাদা। বরং প্রমাণিত হচ্ছে যে বাড়ির মালিক বর্ণ-বিদ্বেষী নন। 
বাড়ির সব রকম সুরক্ষা তো করাই ছিল। তবে শহরে দাঙ্গা হলে তার কোন দায় নেয় না বীমা কোম্পানি। দাঙ্গার দরুন বাড়ি গাড়ি সুইমিং পুল ধ্বংস হলে কোন ক্ষতি পূরণ মিলবে না। ইন্সিওরেন্স কোম্পানির তেমনই শর্ত। দাঙ্গা হ’ত। তবে ঘটত শহরের বাইরেই। সেখানে যারা বাস করত তাদের গায়ের রঙ অন্য রকম। শহরতলিতে তাদের প্রবেশের অনুমতিই ছিল না। ঢুকতে পারত শুধুমাত্র বিশ্বস্ত পরিচারিকা আর বাগানের মালিরাই। তাই এই অঞ্চলে জীবনের কোন ভয় নেই। এমনই বলেছিলেন ভদ্রলোক তাঁর স্ত্রীকে। 

স্ত্রীর কিন্তু ভয় কাটেনি। তাঁর মনে হত যে-কোন দিন ওই জাতীয় লোকেরা রাস্তায় এসে বাড়িতে লাগানো ‘সাবধান! ...প্রবেশ নিষেধ’ ফলকটি ছিঁড়ে ফেলবে। তারপর বাড়ির সদর দরজা ভেঙে  হুড়মুড় করে ঢুকে পড়বে। ‘আরে ভয় পেয়ো না’, স্বামী ভদ্রলোক বলেছিলেন, ‘দেশে পুলিশ আছে, সেনাবাহিনী আছে। টিয়ার গ্যাস বন্দুক চালিয়ে নিমেষে দাঙ্গাকারিদের হটিয়ে দেবে।’

স্ত্রীকে ভালোবাসতেন খুব। তাই দাঙ্গা যখন বাঁধল চোখের সামনে দেখলেন বাড়ি গাড়ি জ্বালছে, দূর থেকে ধেয়ে আসছে ইট। তিনি ব্যবস্থা নিতে দেরি করলেন না। বললেন ‘আচ্ছা আমি ইলেকট্রনিক   গেট লাগিয়ে দিচ্ছি। ওর উপরেই বসানো থাকবে বোর্ডটা ‘সাবধান, কেউ ঢুকবে না’। কেউ ভিতরে আসতে চাইলে তাকে গেটে লাগানো একটা সুইচ টিপে কথা বলতে হবে। রিসিভারের মধ্য দিয়ে তার গলার আওয়াজ পৌঁছে যাবে বাড়ির ভিতর।’

দারুণ যন্ত্র তো! সেনাদের হাতে-থাকা ওয়াকি টকির মত। বাড়ির বচ্চা ছেলেটার খুব পছন্দ হল। ওটা দিয়ে বন্ধুদের সাথে চোর-পুলিশ খেলা শুরু করল। 

এক সময় দাঙ্গা থেমে গেল। কিন্তু শহরতলীতে চুরি-ডাকাতি বেড়ে গেল খুব। কাছেই এক বাড়ির পরিচারিকাকে হাত-পা বেঁধে আলমারিতে ঢুকিয়ে লুট-তরাজ চালিয়েছিল গুণ্ডারা। বাড়ির মালিক বাইরে ছিলেন তখন। খবরটা শুনে এই বাড়ির পরিচারিকা মহা দুশ্চিন্তায় পরে গেল। তার জিম্মায় বাড়ি গাড়ি যাবতীয় সম্পত্তি ছেড়ে দিয়ে তো সবাই বাইরে চলে যায়। পরিচারিকা তখন বাড়ির মালিককে জুতসই একটা বুদ্ধি দিল। বলল, ‘দরজায় চোর-ঘণ্টি লাগানোর ব্যবস্থা করুন। বাড়ির দরজা জানলায় লাগানো থাকবে ঘণ্টা। বাইরের লোক কেউ এলেই ঘণ্টা বাজিয়ে পাড়া-প্রতিবেশীদের সতর্ক করে দেবে।’ 
প্রস্তাবটা মনে ধরল মালকিনের। পরিচারিকার কথা মত বসানো হল দামী অ্যালার্ম সিস্টেম। ঘরের প্রত্যেক দরজা জানলায় বসানো হল অ্যালার্ম বার। যে বাড়িতে মানুষগুলো এত দিন সুখে কাটাচ্ছিলেন, তারা এবার বাইরের আকাশ গাছপালা দেখতে লাগলেন বিপদ যন্ত্রের ভিতর থেকে। বাড়ির ছোট-ছেলেটির প্রিয় বেড়ালটা যখন ফ্যানের উপরে লাগানো আলোর দিকে তাকিয়ে নিজের বিছানার কাছে উঠে যেত। গোটা বাড়ি জুড়ে বেজে উঠত বিপদ ঘণ্টির জোরাল শব্দ। 
শব্দ ঘণ্টির আওয়াজে মনে হত অন্য বাড়িতে বিপদ ঘণ্টা বাজছে। আসলে পোষা বেড়াল বা ইঁদুরের পায়ে লেগে ঘণ্টি বেজে উঠেছে। এই রকম শব্দ লোকালয়ের মানুষদের ডাক দেবার বদলে বাগানের এদিকওদিকে ছড়িয়ে থাকা প্রাণীদের এক জায়গায় ডেকে আনতো। ব্যাঙের ঘ্যাক ঘ্যাক, ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক এই সব শুনতেই লোকে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল। 

ইনসিওরেন্সের আওতায় আছে জেনে অনুপ্রবেশকারীরা শব্দ-ঘণ্টি লাগানো ঘরগুলোতে ঢুকে লুটপাট করবার জন্য মুখিয়ে থাকতো। হাই-ফাই সরঞ্জাম টেলিভিশনসেট ক্যাসেটপ্লেয়ার ক্যামেরা রেডিও গয়না পোশাক সব কিছু চুরি করে নিয়ে যেত। কখনও কখনও আবার খিদের চোটে ফ্রিজের সমস্ত খাবার সাবার করে দিত। ক্যাবিনেটে রাখা দামি হুইস্কির বোতল ফাঁকা করে দিত। ইনসিওরেন্স কোম্পানি মদের ক্ষতিপূরণ দেয় না। তার উপর দামি মদের কদর বুঝবার মত ক্ষমতা লুটেরা গুলোর নেই। 

এরপর খারাপ সময় শুরু হল। ঝাঁকে ঝাঁকে বেকার মানুষ কাজের খোঁজে শহরতলিতে আশ্রয় নিতে লাগল। বাগানে মালীর কাজ বা ঘরের অন্য কোন ফরমায়েসি কাজ খুঁজতো ওরা। ওদের বিশ্বাস করতনা কেউ। বিশ্বাসযোগ্যতা না-থাকলেও ছোট খাট কাজ পেয়ে যেত। ছাদে রঙ করা বা বাগানের আগছা পরিষ্কার করবার কাজ। কিন্তু সেই ভদ্রলোক আর তাঁর স্ত্রী খুবই সাবধানে থাকতো। কখনোই কোন কাজে ওই লোকদের বাড়ির ভেতর ডাকতো না। লোকগুলো মদ খেয়ে বোতল রাস্তায় ফেলে পথ ঘাট নোংরা করতো। কেউ কেউ আবার ভিক্ষা করত। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করত কখন বৈদ্যুতিন গেট খুলে বাড়ির মালিক গাড়ি হাঁকিয়ে রাস্তায় বেরোবেন। লোকগুলো রাস্তার ড্রেনের ধারে পা তুলে বসে থাকতো। ওখানে সবুজ জাফরান গাছের ভিতর দিয়ে তৈরি হয়েছে সুন্দর পথ। এই লোকগুলো সব কিছু নষ্ট করে দিচ্ছিল। কখনও কখনও দুপুরের কাঠফাটা রোদে বাড়ির গেটের সামনে শুয়ে থাকতো। ভদ্রলোকের স্ত্রী কখনোই অভুক্ত মানুষ দেখতে পারতেন না। তাই বাইরে ক্ষুদার্ত মানুষদের কাছে পরিচারিকার হাত দিয়ে রুটি, চা পাঠিয়ে দিতেন। কিন্তু পরিচারিকা বলতেন, ‘লোকগুলো একেকটা লোফার, গুন্ডা। কোন্‌ দিন বাড়িতে ঢুকে আমাকে বন্দী করে সব কিছু লুটে নিয়ে যাবে।’ ভদ্রলোক পরিচারিকার কথায় সায় দিয়ে স্ত্রীকে বলতেন, ‘ও ঠিক বলেছে। তুমি শুধু ওই লোকগুলোকে চা-রুটি খাইয়ে উৎসাহ যোগাচ্ছ। লোকগুলো নির্ঘাত চুরি-ডাকাতির সুযোগ খুঁজছে।’
ভদ্রলোক ছেলের ট্রাইসাইকেলটা প্রতিদিন রাতে বাগান থেকে তুলে এনে ঘরে রাখা শুরু করলেন। যদিও বাড়িটি সুরক্ষিত, একবার তালা বন্ধ করলে কেউ ভেতরে ঢুকতে পারবে না। চেষ্টা করলেই চোর ঘন্টি বেজে উঠবে। তা সত্বেও বৈইদ্যুতিন গেট টপকে কেউ তো বাগানে ঢুকে পড়তে পারে। 
ভদ্রলোকের মত শুনে স্ত্রী বললেন, তোমার কথাই ঠিক। তাহলে বাড়ির প্রাচীর আরও উঁচু করা উচিৎ। ভদ্রলোকের মা, সেই জ্ঞানী বৃদ্ধা, প্রাচীর উঁচু করবার জন্য দরকারি ইটের দাম দিয়ে দিলেন। পুত্র এবং পুত্রবধূকে এটাই তার ক্রিসমাসের উপহার। নাতীকে ক্রিসমাসের উপহার হিসাবে দিলেন নভশ্চরের পোশাক আর একটা বই, রূপকথার গল্প। 
এলাকায় প্রত্যেক দিনই লুট তরাজের ঘটনা কানে আসছিল। প্রকাশ্য দিবালোকে কিম্বা গভীর রাতে কখনও বা ভোর বেলায় ঘটছিল ভয়ঙ্কর সব ডাকাতি। এমন কি গ্রীষ্মকালের সুন্দর গোধুলি মুহূর্তে বাড়ির লোক খাবার ঘরে বসেছেন, তখন উপর তলার শোবার ঘরে সব কিছু চুরি গেল। 
সদ্য ঘটে যাওয়া এক ডাকাতির ঘটনা নিয়ে ভদ্রলোক স্ত্রীর সঙ্গে গুরুগম্ভীর আলোচনা করছিলেন। তখনই নজরে এল বাড়ির পোষা বেড়ালটার কান্ড। কেমন অবলীলায় সাত ফুট উঁচু দেওয়াল টপকে বাগানে ঢুকে পড়ছে। সামনের পা দুটো বাড়িয়ে থাবা গুলো কাজে লাগিয়ে খাড়া উপর থেকে নিচে ঝাঁপ মারল। বেতের মত লেজটা আগে আছড়ে পড়ল বাগানের মাটিতে। 
রঙ করা দেওয়াল জুড়ে বেড়ালের পায়ের ছোপ। বাইরের দেওয়ালে লাল মাটির দাগ। জুতোরই দাগ ওগুলো। ছেঁড়া ফাটা রানিং শু’র। বেকার ভবঘুরেদের পায়ে ওরকম জুতোই দেখা যায়। ওদের মতলব কখনোই ভালো হতে পারে না। 
বিকেল স্ত্রী, ছেলে ও পোষ্যদের নিয়ে ভদ্রলোক পাড়ায় হাঁটতে বেরোলেন। কোন প্রতিবেশীর বাড়িতে সুন্দর গোলাপ ফুটেছে। কোন বাড়িতে অপূর্ব সবুজ লন। দেখেই সঙ্গে সঙ্গেই তারিফ করছেন তিনি। সুরক্ষার অনেক রকম কায়দা কাজে লাগিয়েই করা হয়েছে এগুলো। কোথাও উঁচু প্রাচীর। অনেক জায়গায় জাল লাগানো হয়েছে। কোথাও বহু ধরনের দামী যন্ত্রপাতি। কোথাও আবার কম খরচের সুরক্ষা ব্যবস্থা। প্রাচীরের উপর সিমেন্টের ঢালায়ের উপর কাচের টুকরো বসানো। কোন বাড়িতে আবার লাগানো হয়েছে লোহার গ্রিল, মাথার কাছটা বল্লমের মত সুচলো। অনেকে আবার জেলখানার গঠন শৈলীর সাথে স্পেন দেশের গ্রাম্য বাড়ির নান্দনিকতা মিলিয়ে দিতে চেষ্টা করেছেন লম্বা বল্লমের গায়ে গোলাপি রঙ মাখিয়ে। কেউ আবার হালফ্যাশনের সিমেন্টের ছাই দানির সৌন্দর্য ফুটিয়েছেন বারো ইঞ্চি বল্লমের সাথে সফেদ রঙের বজ্রের মত পাখানায়ালা আঁকাবাঁকা রেখা দিয়ে। কয়েকটি বাড়িতে আবার বাইরের দেওয়ালে সুদৃশ্য ফলক। যে কোম্পানি কাজটি করেছে তার নাম, ফোন নম্বর লেখা।  
হাঁটতে হাঁটতে ছেলেটি কুকুর নিয়ে খানিক এগিয়ে গেল। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বাড়ি গুলোতে লাগানো সুরক্ষা ব্যাবস্থা নিয়ে আলোচনা চলতে লাগল। প্রত্যেকটি ব্যবস্থারই গুনাগুন বিচার করতে লাগলেন তাঁরা। 
সপ্তাহ ধরে চলল আলোচনা। শেষমেস নিজেদের উপযোগী জোরদার একটা সুরক্ষা ব্যবস্থা বেছে নিলেন। দারুণ এক উপায়, যদিও দেখতে তেমন সুন্দর নয়। তবে খুব কাজের। অনেকটা কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের কায়দা। অনাবশ্যক অলংকার নেই কোথাও। কতটা কার্যকরী তাকালেই বোঝা যাবে।
দেওয়ালের ঘিরে লাগানো হবে কয়েক রাউন্ড ধাতুর তার। মজবুত শক্ত চকচকে। তারের মাঝে মাঝে লাগানো থাকবে খাঁজকাটা ধারাল ব্লেড। একে টপকে বাড়ির ভিতর ঢোকা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। তারের ফাঁক দিয়ে এগোতে চেষ্টা করলেই কাঁটার মাঝখানে আটকে যাবে। বিষাক্ত দাঁত কামড় বসাবে । রক্তাক্ত হয়ে যাবে শরীর। যতই বেরোবার চেষ্টা করবে, দাঁত আরও চেপে বসবে। গায়ের চামড়া ফালা ফালা হয়ে কেটে যাবে। স্ত্রী ভয়ে কেঁপে উঠলেন। দেখে ভদ্রলোক বললেন, ‘ঠিকই, বাড়িতে ঢুকবার কথা কারুর মাথায় এলে দু’বার ভাবতে হবে তাকে। যে ঢুকতে চাইবে তাকে গেটে লাগানো নির্দেশ মানতেই হবে। গেটের ফলকে ঝুলবে নির্দেশ আর কোম্পানির নামঃ ‘ড্রাগন দাঁত, আপনার বাড়ির সর্বাঙ্গীণ সুরক্ষায়।’   
পরদিন বেশ কয়েকজন লোক কাজ করতে বাড়িতে হাজির। যে বাড়িতে দীর্ঘদিন ধরে স্ত্রী, পুত্র এবং পোষ্যদের নিয়ে আনন্দে বসবাস করছিলেন ভদ্রলোক সেই বাড়ির বাগানের চার দিক জুড়ে ক্ষুর লাগানো ধাতব তার বসানো হল। সূর্যালোকে ঝলমল করে উঠল ধাতুর তার থেকে বেড়িয়ে আসা ধারাল ব্লেড গুলো। দেখে শুনে ভদ্রলোক বললেন, ‘কিছু মনে ক’র না। তেমন টেঁকসই হল না কিন্তু। জল বাতাস লেগে তার গুলো খারাপ হয়ে যাবে।’স্ত্রী বললেন, ‘মোটেই না। স্টিলের তৈরি জিনিষ। আদৌ মর্চে পড়বে না। কোম্পানি গ্যারান্টি দিয়ে বলেছে।’
ভদ্রমহিলা অপেক্ষা করছিলেন কখন ছেলে খেলতে বেরোবে। ছেলে বেরিয়ে যাবার পর বললেন, ‘আমার মনে হয় বেড়ালটা এবার জব্দ হবে।’ স্বামী বললেন, ‘চিন্তা ক’র না। বেড়াল সব সময় চারদিক দেখে নিয়েই ঝাঁপ দেয়।’ দেখা গেল সেই দিন থেকেই বিড়ালটা ছেলের বিছানাতেই ঘুমোচ্ছে। বাগানে যেত, সুরক্ষা বিধি ভাঙবার সামান্য চেষ্টাও করত না।   
একদিন রাতে ছেলেকে ঘুম পাড়াচ্ছিলেন মা। ওর ঠাকুমার কাছ থেকে ক্রিসমাসে উপহার পাওয়া রুপকথার বই থেকে গল্প পড়ে শোনাচ্ছিলেন। পরদিন বাচ্চা ছেলেটির মনে হল সে যেন ঠিক ঐ গল্পের রাজ কুমার। যে ঘন জঙ্গল দুর্ভেদ্য কাঁটাঝোপ পেরিয়ে রাজপ্রাসাদে ঢুকে ঘুমন্ত রাজকন্যাকে চুমু খেয়ে তার প্রাণ ফেরাবে। এই ভেবে বাড়ির বাগানের লম্বা মইটা দেওয়ালের কাছে টেনে নিয়ে এল। দুই তারের ফাঁক দিয়ে তার ছোট্ট শরীরটা ঠিক বের করে নিয়ে যেতে পারবে। কিন্তু শরীরটা ঢুকাতেই তার হাঁটু কামড়ে ধরল তারের ধারাল ব্লেড গুলো। তারপর হাতে, মুখে, মাথায়। যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল ছেলেটি। যতই বেরিয়ে আসতে চেষ্টা করছে, ধারাল ব্লেড গুলো ততই চেপে বসছে। ফালা ফালা করে দিচ্ছে ছোট্ট শরীর। তার বাবা-মা উত্তেজনায় চিৎকার করতে করতে বাগানে ছুটে এলেন। তখনই কোন কারণে, হয়ত বিড়ালের জন্যই, বাড়ির বিপদ-ঘণ্টি বেজে উঠল। প্রবল আর্তনাদ আর চিৎকারের মধ্যেই ঘণ্টার আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। তার মধ্যে কড়াত, প্লায়ার্স, চপার দিয়ে সুরক্ষার তার কেটে কেটে ছোট্ট ছেলেটির ক্ষতবিক্ষত দেহ বের করে আনা হচ্ছে। 
ভদ্রলোক, তাঁর স্ত্রী, বাড়ির বিকারগ্রস্ত পরিচারিকা, মালী সবাই কাঁদতে কাঁদতে ছেলেটির রক্তাক্ত দেহ বাড়ির ভিতর বয়ে নিয়ে গেল। 

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
ড.সৌমিত্র কুমার চৌধুরী, ভূতপূর্ব বিভাগীয় প্রধান ও এমেরিটাস মেডিক্যাল স্যায়েন্টিস্ট, চিত্তরঞ্জন জাতীয় কর্কট রোগ গবেষণা সংস্থাণ, কলকাতা-700 026. প্রকাশিত গ্রন্থ- বিজ্ঞানের জানা অজানা (কিশোর উপযোগী বিজ্ঞান), আমার বাগান (গল্পগ্রন্থ), এবং বিদেশী সংস্থায় গবেষণা গ্রন্থ: Anticancer Drugs-Nature synthesis and cell (Intech)। পুরষ্কার সমূহ: ‘যোগমায়া স্মৃতি পুরস্কার’ (২০১৫), জ্ঞান ও বিজ্ঞান পত্রিকায় বছরের শ্রেষ্ঠ রচনার জন্য। ‘চৌরঙ্গী নাথ’ পুরস্কার (২০১৮), শৈব ভারতী পত্রিকায় প্রকাশিত উপন্যাসের জন্য। গোপাল চন্দ্র ভট্টাচার্য স্মৃতি পুরষ্কার (2019), পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিজ্ঞান প্রযুক্তি ও জৈবপ্রযুক্তি দফতর থেকে), পঁচিশ বছরের অধিক কাল বাংলা ভাষায় জনপ্রিয় বিজ্ঞান রচনার জন্য)।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!