‘মহাশূন্যে জুরান’ পর্ব – চার

সিদ্ধার্থ সিংহ
সিদ্ধার্থ সিংহ
15 মিনিটে পড়ুন

অসহ্য এক কান্নায় ডুকরে উঠতেই জুরানের শরীরটা বুঝি থরথর করে কেঁপে উঠেছিল। আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শরীরটাও হয়তো একটু সঙ্কুচিত আর প্রসারিত হচ্ছিল, তাই তাকে ধরে রাখার আঁটোসাঁটো ভাবটা যাতে ইলাস্টিকের মতো তার শরীরে চেপে না-বসে, দম নেওয়ার জন্য তাকে যাতে হাঁসফাঁস করতে না-হয়, তার জন্য মোড়কটা বোধহয় নিজেকে একটু শিথিল করেছিল। আর তাতেই কী ভাবে যেন মোড়কের তলা দিয়ে সুড়ুৎ করে গলে জুরান পড়তে লাগল একেবারে নীচে। সোজা নীচে।
পড়ছে তো পড়ছেই। পড়ছে তো পড়ছেই। পড়ছে তো পড়ছেই। মাটি ছুঁতে যখন আর কয়েক মুহূর্ত বাকি, ঠিক তখনই সাঁ… আ… আ… আ… করে এসে কে যেন তাকে একেবারে চিলের মতো ছোঁ মেরে তুলে নিল।
কে! কে তুলল তাকে! এ দিকে ও দিকে তাকাল জুরান। না। আশপাশে কেউ নেই। তাকে কেউ হাত ধরে টেনেও তুলছে না। কোলপাঁজা করে তো নয়ই। জাল ফেলে মাছ তোলার মতো কেউ তাকে কোনও কিছু করে তুলে নিয়ে যাচ্ছে না তো! সন্দেহ হতেই, নিজের শরীরটাকে একবার ভাল করে দেখল সে। না। তাও নয়। আলোর কোনও রশ্মিও তাকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে না। তার মানে গত কাল টিভিতে দেখা স্পাইডারম্যান নয়, তাকে বাঁচিয়েছে, ছোটবেলায় যার ভক্ত ছিল সে, যাকে নকল করে উপর দিকে হাত তুলে সে বনবন করে ঘুরত, সে-ই শক্তিমান। কিংবা তার এখনকার সব চেয়ে প্রিয় চরিত্র— সুপারম্যান। না হলে কে বাঁচাল তাকে? কে?
সে যে-ই হোক না কেন, নিশ্চিত মৃত্যুর দোরগোড়া থেকে যে তাকে বাঁচাল, আর যা-ই হোক, সে নিশ্চয়ই তার কোনও ক্ষতি করবে না। এতক্ষণ ধরে তার ভিতরে যা হচ্ছিল, একমাত্র সে-ই জানে। তাই মৃত্যুর আতঙ্ক কেটে যেতেই ভয়ে এতক্ষণ সিঁটিয়ে থাকা শরীরটাকে আলতো করে ছেড়ে দিল সে। আর যার উপর ভরসা করে শরীরটা ছেড়ে দিল, সেটা তখন চোখের পলকে এক চিলতে সাদা ধবধবে মেঘ হয়ে তাকে দু’হাতে আগলে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে লাগল মহাশূন্যের অলিগলি, তস্যগলি দিয়ে এক অচেনা-অজানা জায়গায়।
জায়গাটা ভারী অদ্ভুত। এত রাতেও চারিদিকে ফটফট করছে মিষ্টি আলো। আলো! না, জ্যোত্‌স্না! এত অঢেল জ্যোত্‌স্না যখন, তখন নিশ্চয়ই চাঁদের খুব কাছাকাছি চলে এসেছে সে! হতেই পারে! তা না হলে, এখানে এত জ্যোত্‌স্না এল কী করে! আশপাশে তাকাল সে। যত দূরে চোখ গেল, দেখল চার পাশে শুধু পেঁজা পেঁজা তুলোর মতো মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে।
যে মেঘটার উপরে সে বসে আছে, সেখানে ছোট-বড় বিভিন্ন মাপের কত কিছু ছড়ানো-ছেটানো। অথচ এত দিন ধরে সে যত রকমের আদল দেখেছে, তার সঙ্গে এগুলোর কোনও মিল নেই। বোঝাও যাচ্ছে না এগুলো কী! রংগুলিও কেমন যেন! যেহেতু সে ছবি আঁকে, সে জানে, সাতটি রংই শুধু নয়, সেই রংগুলি কম-বেশি করে মিশিয়ে-মিশিয়েও কিছুতেই এই শেড তৈরি করা যাবে না। তাই সে নিজের মনেই বিড়বিড় করে বলল, এ কোথায় এলাম রে বাবা!
যে-ই তার এটা মনে হয়েছে, অমনি কে যেন সঙ্গে সঙ্গে তার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিল— তোমাকে অন্য কোথাও আনিনি। তুমি এই মহাশূন্যেই আছ।
— মহাশূন্যে! মানে! তার মানে আমি পৃথিবীতে নেই? সেটা কী করে হয়! শুধু পৃথিবীতে নয়, আমাদের দেশেই তো কত রকমের ভাষা। এক জায়গার ভাষা আর এক জায়গার লোক বুঝতে পারে না। আর এটা যদি পৃথিবীর মধ্যেই না-হয়, তা হলে তুমি আমার ভাষা বুঝছ কী করে? আর সেই ভাষায় কথাই বা বলছ কী করে?
— কারণ, আমার কাছে ভাষা কোনও সমস্যা নয়। আমাকে যে-ভাষাতেই যে-কেউ যাই বলুক না কেন, সেটা যখন আমার কান ভেদ করে মরমে পৌঁছবে, তখন সেটা আমার ভাষায় ভাষান্তর হয়েই পৌঁছবে। ঠিক সেই একই ভাবে, আমি যা বলব এবং যাকে বলব, তার কাছে সেটা তার ভাষাতেই রূপান্তর হয়ে পৌঁছবে। তাই আমি আমার ভাষাতে কথা বললেও তোমার মনে হচ্ছে, আমি বুঝি তোমার ভাষাতেই কথা বলছি। আসলে তুমি এত দিন যার উপরে ছিলে, তোমাদের ওই পৃথিবী যার মধ্যে ভেসে আছে, তুমি কিন্তু সেই মহাশূনেই আছ।
— তুমি কে?
— আমি সময়।
— সময় মানে?
— সময় মানে সময়। টাইম। এই মহাশূন্যে যা যা ঘটে, সব কিছুই আগে থেকে ঠিক করা থাকে। ঠিক করা আছে আমরা কে কখন কোন গ্রহে যাব, তাও।
— তার মানে?
— মানে, আমরা হলাম এক-একটা সময়-কণা। ঠিক আছে, তোমাকে একটু সহজ করে বোঝাই। পর পর পুঁতি গেঁথে যেমন মালা হয়, তেমনি আমাদের মতো সময়-কণা পর পর সারি বেঁধে দাঁড়ালে হয়— সময়। আমরা প্রত্যেকেই আলাদা আলাদা। কিন্তু প্রত্যেকের সঙ্গেই প্রত্যেকের একটা গভীর যোগসূত্র আছে। যেমন ধরো… তোমাদের হিসেব অনুযায়ী, তোমাদের পৃথিবীতে এখন একবিংশ শতাব্দী চলছে। সেই হিসেব অনুযায়ী আমি হলাম স্ত্রিংশত্তম শতাব্দী। অর্থাৎ তিন হাজার তিনশো বছর। মানে, তোমাদের ওখানে পৌঁছতে আমার এখনও এক হাজার দুশো বছর বাকি। এই যে চার পাশে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘকে ভেসে বেড়াতে দেখছ, এরা কিন্তু কেউই মেঘ নয়, সবাই-ই আমার মতো এক-একটা সময়-কণা। কেউ আমার আগে যাবে। কেউ বা পরে। কিন্তু আমরা প্রত্যেকেই কখনও না-কখনও বিভিন্ন গ্রহ-নক্ষত্রে যেমন যাব, তেমনি তোমাদের পৃথিবীতেও যাব।
— যাবেই যখন, তা হলে এখন যাচ্ছ না কেন?
— আগে যাওয়া যাবে না। যার যখন যাওয়ার কথা, সে কেবল তখনই যেতে পারবে। তার আগে নয়। বিশাল লম্বা লাইন আছে যে। হাজার চেষ্টা করলেও কেউ আগে যেতে পারবে না। কেউ কাউকে লাইনের মধ্যে ঢুকতেও দেবে না। আবার যার যখন সময় হবে, তাকে কেউ আটকেও রাখতে পারবে না। আবার সময় হলেও, কেউ যে নিজের ইচ্ছে মতো হুট করে সেখানে গিয়ে হামলে পড়বে, তাও হবে না।
— কেন?
— কারণ, আমরা তো এক-একটা ক্ষণ। তাই আগের ক্ষণ না যাওয়া অবধি পরের ক্ষণ কিছুতেই যেতে পারে না। এটাই নিয়ম। এই নিয়ম কেউ লঙ্ঘন করতে পারে না। আসলে আমরা লাইন দিয়ে প্রতি মুহূর্তে একের পর এক ছুটে যাচ্ছি। আমরা যে যখন যেখানে যাই, সেখানে গিয়ে এক-একটা ঘটনা ঘটাই। হয় তাদের এক ধাপ এগিয়ে দিই। নয়তো এক ধাপ পিছিয়ে দিই। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে একই সঙ্গে দুটোই ঘটাই। একটার সঙ্গে আর একটা অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িয়ে থাকে। কেউ বুঝতে পারে, কেউ পারে না। যেমন ধরো, আমার মতোই একটা ক্ষণ যখন তোমাদের পৃথিবীতে গিয়ে পৌঁছল, তখন তোমরা তার হাত ধরে শিকার করতে শিখলে। শিকারের সঙ্গে সঙ্গে একই সঙ্গে শিখলে হত্যা করা। তার পরে যখন আর একটা সময় তোমাদের ওখানে গেল, তোমরা আগুন জ্বালাতে শিখলে। কিন্তু জানতেও পারলে না, আগুন জ্বালানোর সঙ্গে সঙ্গে ওই পৃথিবীটাকে তোমরা কত কালো ধোঁয়ায় ঢেকে দিতে লাগলে। কতটা কলুসিত করে দিতে লাগলে। কতটা দূষণে-দূষণে ভরিয়ে দিতে লাগলে চারিদিক। নিজেদের অজান্তে নিজেরাই নিজেদের মৃত্যুর পথ তৈরি করতে লাগলে।
তার পর আর একটা সময় যখন তোমাদের গ্রহে গেল, সে তোমাদের শূন্য ব্যবহার করতে শেখাল। পৃথিবীর মানুষকে এক ধাক্কায় প্রায় কয়েক ক্রোশ এগিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে তোমাদের এতটাই হিসেবি করে তুলল যে, নিজের আখের গোছানো ছাড়া মানুষ সব ভুলে গেল। এগোবার সঙ্গে সঙ্গে মানুষকে মানবিক ভাবে পিছিয়ে দিল সহস্র যোজন।
ঠিক এই ভাবেই, আমার মতোই এক সময়-কণা তোমাদের গ্রহে পা রেখেই, তোমারা যাতে পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরি করতে পারো, সে জন্য তোমাদের উপহার দিল— ডিনামাইট। পরে তোমরা সেটাকেই যুদ্ধের সময় মানুষ খতম করার জন্য মারণাস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা শুরু করলে। ঠিক তেমনি, তার পর যখন আরও একটা সময়-কণা তোমাদের পৃথিবীতে হাজির হল, সে তোমাদের জানিয়ে দিল, গাছেদেরও প্রাণ আছে।
— গাছেদের প্রাণ আছে! তোমরা কোথায়? সেটা তো জগদীশচন্দ্র বসু আবিষ্কার করেছেন। আমি পড়েছি। আমাদের বিজ্ঞান বইতে আছে। জুরান প্রতিবাদ করে উঠল।
সময়-কণা বলল, আরে বাবা, সে কি আমি জানি না? আমি বলছি, কে আবিষ্কার করল, সেটা বড় কথা নয়। কোন সময়ে আবিষ্কার হল সেটাই বড় কথা। সময়টাই আসল। তার আগে কি ও রকম কোনও বিজ্ঞানী পৃথিবীতে জন্মাননি? না, গাছেদের প্রাণ আছে, এটা কারও মাথায় আসেনি? এসেছে। আর এসেছে দেখেই তো হাজার হাজার বছর আগে থেকেই তোমাদের বিভিন্ন পুরাণে, লোককথায় বারবার গাছেদের নানান কীর্তিকলাপের কথা উঠে এসেছে। মহাকাব্যে আছে, মিথ্যে সাক্ষী দেওয়ার জন্য তুলসী গাছকে অভিশাপ দেওয়া হয়েছিল, কুকুর তার গায়ে হিসি করবে।
পুরাণে আছে, মৃত দেহ পোড়ানোর সময় যে-ধোঁয়া আর ছাই ওড়ে, মৃত মানুষের প্রাণ তার সঙ্গেই উড়ে গিয়ে ধানখেতের মাথায় ঠাঁই নেয়। আর তোমরা তো জানোই, ধান থেকে চাল হয়। আর সেই চাল রান্না করে ভাত হয়। সেই ভাত খাওয়ার ফলেই মায়েদের কোল আলো করে ফের জন্ম নেয় সেই প্রাণ।
এত কিছুর পরেও কেউই কিন্তু জোর দিয়ে বলতে পারেনি, গাছেদের প্রাণ আছে। ফলে কে আবিষ্কার করল, সেটা বড় কথা নয়। কথা হচ্ছে, ওই সময়েই ওই কথাটা তোমাদের ওখানকার লোকেদের জানার কথা ছিল, তাই তখন জেনেছ। সুতরাং সময়টাই হল আসল। সময় না হলে কিচ্ছু হয় না। কিচ্ছু না।
অবাক হয়ে গেল জুরান, তাই?
— হ্যাঁ, তাই।
— তা হলে তুমি যখন পৃথিবীতে যাবে, তখন তুমি পৃথিবীর মানুষকে কী শেখাবে?
— আমি শেখাব, হাজার হাজার বছর বেঁচে থাকার কৌশল।
— হাজার হাজার বছর! সেটা আবার হয় নাকি?
— কেন হবে না? এই মহাশূন্যে কিছুই অসম্ভব নয়। শুধু সময়ের অপেক্ষা। আজ যেটা অসম্ভব-অবান্তর, কাল যখন আর একটা সময় গিয়ে হাজির হবে, তখন সেটাই খুব স্বাভাবিক এবং সহজ ব্যাপার হয়ে যাবে।
— কিন্তু কী করে?
— যে পদ্ধতিতে এখন তোমাদের পৃথিবীতে ব্লাড ট্রান্সফিউশন হয়, একজনের কিডনি আর একজনের দেহে প্রতিস্থাপন করা হয়, ঠিক সেই ভাবেই একজনের আয়ু আর একজনের মধ্যে ভরে দেওয়া হবে। মনে রেখো, এক গ্রাম সোনার দাম তখন যত লক্ষ টাকাই হোক না কেন, শুধু দূর থেকে এক ঝলক দেখার জন্য অত্যন্ত সুরক্ষিত বলয়ে এক চিলতে সোনা, যতই জাদুঘরে রাখা হোক না কেন, তখন কিন্তু সোনা-দানা, হিরে-জহরত নয়, পৃথিবীতে সব চেয়ে মূল্যবান হয়ে উঠবে— আয়ু। তখন আয়ু কেনাবেচা হবে। যারা মনে করবে, অত বছর বেঁচে থেকে লাভ কি? যে ক’বছর বাঁচব, রাজার মতো বাঁচব। তারা তাদের জীবনের কিছুটা আয়ু নিলামে তুলে বিপুল দামে বিক্রি করে দেবে। আর যারা মনে করবে, যত কষ্টই হোক, একবার যখন পৃথিবীতে এসেছি, তখন যত দিন পারব, এই পৃথিবীতেই থাকব, চেটেপুটে এই পৃথিবীর আস্বাদ নেব এবং তাদের মধ্যে যাদের হাতে পর্যাপ্ত টাকা থাকবে, তারা ওদের কাছ থেকে যত দ্রুত সম্ভব সেটা কিনে নেবে। সে জন্য বিভিন্ন সংস্থা আয়ু-ব্যাঙ্কও তৈরি করবে।
— সেটা আবার কখনও হয় নাকি? লোকে বুঝবে কী করে কার আয়ু কতটা?
মুচকি হেসে সময়-কণা বলল, বোকার মতো কথা বোলো না তো। আজ থেকে এক হাজার বছর আগে গায়ে হাত দিয়ে লোকে বুঝতে পারত জ্বর হয়েছে। কিন্তু কতটা জ্বর হয়েছে, সেটা কি বুঝতে পারত?
— না।
— সেটা বোঝার জন্য পরে যেমন থার্মোমিটার আবিষ্কার হয়েছিল, তেমনই, আমি যাওয়ার অনেক আগেই, লোকের আয়ু মাপার যন্ত্র আবিষ্কার হয়ে যাবে।
— সে কী গো?
— হ্যাঁ।
জুরান বলল, তা হলে একই লোক বিভিন্ন লোকের কাছ থেকে দু’-চার বছর করে আয়ু কিনে-কিনে তো হাজার-হাজার বছর বেঁচে থাকতে পারবে, তাই না?
সময়-কণা তার কথায় সায় দিয়ে বলল, হ্যাঁ, তাই-ই তো।
— কিন্তু আশি-নব্বই বছর হলেই তো মানুষ কেমন অথর্বের মতো হয়ে যায়। জরাজীর্ণ হয়ে যায়। শরীরের চামড়া কুঁচকে যায়। শরীরের কলকব্জা বিকল হতে শুরু করে। অত বছর বাঁচলে তো তার অবস্থা মরার চেয়েও খারাপ হয়ে যাবে। তাই না?
— না। একেবারেই না। জাদুঘরে যেমন মৃত জীবজন্তুদের দেহ কেমিক্যাল দিয়ে যুগের পর যুগ ধরে একেবারে অবিকৃত করে রাখা হয়, তেমনি তত দিনে বাজারে এমন লোশন বেরিয়ে যাবে, যেটা মাখলে, যে যখন মাখবে, ঠিক সেই চেহারাটাকেই সে সারা জীবন ধরে অবিকল রাখতে পারবে। সুতরাং কেউ যদি তিরিশ বছর বয়সে ওই লোশন মাখে, আয়ু কিনে কিনে পাঁচ হাজার বছর বাঁচলেও সে কিন্তু একেবারে ইনট্যাক্ট ওই তিরিশ বছর বয়সের মতোই তরতাজা থাকবে।
জুরানের মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, কিন্তু মন?
— মনও থাকবে ওই তিরিশ বছর বয়সের মতোই।
— কিন্তু কেউ অত বছর বাঁচলেও তার বউ, ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনি— তাদের যদি আয়ু কেনার সামর্থ না-থাকে, কিংবা তারা যদি আয়ু বিক্রি করার লোক না পায়, তা হলে তো তাকে একের পর এক তার প্রিয়জনদের মৃত্যু দেখতে হবে। কত কষ্ট বলুন তো। অত শোক সহ্য করা কি চাট্টিখানি ব্যাপার! শোকেই তো সে গুমরে গুমরে মরে যাবে।
তাচ্ছিল্যের স্বরে সময়-কণা বলল, শোক? ধ্যাত বাবা, তোমার তো কোনও ধারণাই নেই দেখছি। তার অনেক আগেই তো ছাঁটার চলন শুরু হয়ে যাবে।
— ছাঁটা! সেটা আবার কী?
— তুমি তো দেখছি কিছুই জানো না। ছাঁটা মানে, যারা তাদের জীবন থেকে শোক, দুঃখ, কষ্ট, প্রেম, লজ্জা, ক্ষোভ, অপমান, মান-অভিমানের মতো ছোট ছোট অণুভূতিগুলো ছেঁটে ফেলতে চায়, তত দিনে তো তার ব্যবস্থাও হয়ে যাবে। কয়েক মিনিটের ছোট্ট একটা অস্ত্রোপচার। অস্ত্রোপচার মানে রক্তারক্তি কাণ্ড নয়, সামান্য একটু অবশ করে, যেটা উপড়ে ফেলতে চায়, সেটাকে ছোট্ট একটা ছুরি দিয়ে বোধ থেকে চেঁছে-চেঁছে ফেলে দেওয়া। আর যারা ছুরি-চাকুকে ভয় পায়, তারা যেটা ছেঁটে ফেলতে চায়, তারা তার অ্যান্টি ডোজ— সেটা ফর টাইম বিইংও হতে পারে, নির্দিষ্ট কিছু দিনের জন্যও হতে পারে, আবার চিরস্থায়ীও হতে পারে। যে যেমনটা চায়, সেই মতো পাওয়ারের ডোজ খেয়ে নিলেই হল। তা হলেই একেবারে কেল্লা ফতে। সঙ্গে সঙ্গে সেই সব অনুভূতি একেবারে ভোঁ ভাঁ। সুতরাং ওই পদ্ধতিই তখন ব্যবহার করবে তারা। ফলে তাদের আর শোকতাপের কোনও হ্যাপাই থাকবে না।
সময়ের কথা শুনে অবাক বিস্ময়ে জুরান শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।

চলবে…

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
২০২০ সালে 'সাহিত্য সম্রাট' উপাধিতে সম্মানিত এবং ২০১২ সালে 'বঙ্গ শিরোমণি' সম্মানে ভূষিত সিদ্ধার্থ সিংহের জন্ম কলকাতায়। আনন্দবাজার পত্রিকার পশ্চিমবঙ্গ শিশু সাহিত্য সংসদ পুরস্কার, স্বর্ণকলম পুরস্কার, সময়ের শব্দ আন্তরিক কলম, শান্তিরত্ন পুরস্কার, কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত পুরস্কার, কাঞ্চন সাহিত্য পুরস্কার, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা লোক সাহিত্য পুরস্কার, প্রসাদ পুরস্কার, সামসুল হক পুরস্কার, সুচিত্রা ভট্টাচার্য স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার, অণু সাহিত্য পুরস্কার, কাস্তেকবি দিনেশ দাস স্মৃতি পুরস্কার, শিলালিপি সাহিত্য পুরস্কার, চেখ সাহিত্য পুরস্কার, মায়া সেন স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার ছাড়াও ছোট-বড় অজস্র পুরস্কার ও সম্মাননা। পেয়েছেন ১৪০৬ সালের 'শ্রেষ্ঠ কবি' এবং ১৪১৮ সালের 'শ্রেষ্ঠ গল্পকার'-এর শিরোপা সহ অসংখ্য পুরস্কার। এছাড়াও আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত তাঁর 'পঞ্চাশটি গল্প' গ্রন্থটির জন্য তাঁর নাম সম্প্রতি 'সৃজনী ভারত সাহিত্য পুরস্কার' প্রাপক হিসেবে ঘোষিত হয়েছে।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!