সমুদ্র দর্শনে আরও একবার (পর্ব ১২)

কামরুল হাসান
কামরুল হাসান
8 মিনিটে পড়ুন
বনকুটির

কাল রাতে যতবার ঘুম ভেঙেছে কানে এসেছে গান, রাতের প্রহর কতটা ঠাহর করতে পারিনি। তন্দ্রাজড়িত কানে গান ভারি মধু ঢেলে দেয়। ভোরবেলা যখন জেগে উঠেছি তখনো গান গাইছিলেন তিন শিল্পী – রশিদ খান, জাহান এ বি ও শাফায়াত জামিল দিদার। এই তিন গায়কের সাথে যুক্ত হয়েছেন অকেশনাল সিঙ্গার জাহেদ সরওয়ার। চারজন মিলে মোট ৬৭টি গান নাকি গেয়েছেন, সারারাত ঘুমাননি একবিন্দু, বনভূমি ও জাগ্রত কানগুলো, এমনকি তন্দ্রাজড়িত কানগুলো, ভরে দিয়েছেন সুরে ও কথায়। আহা, রাতভর গান শোনার একটি সুবর্ণ সুযোগ হারালাম ক্লান্তি ও ঘুমের কারণে। বয়সও একটি বড় কারণ। উঠে দেখি প্যাকিং চলছে, অনেকেই ব্যাকপ্যাক নিয়ে প্রস্তত। মোমবাতিগুলো নিভে গেছে, অর্ধভুক্ত কেকটিও উধাও। রাতেও দেখেছি, ভোরের আলোয় দেখলাম এই বনকুটিরের গায়ে লেখা Sabela Foundation। সাইয়্যিদ মঞ্জু বলেছিল প্রভাতে একজন আসবে, যার কাছে জানা যাবে এই কুটিরের ইতিহাস। তার নাম গিয়াসউদ্দিন. সাবেলা ফাউন্ডেশন তাকে কটেজটির কেয়ারটেকার হিসেবে রেখেছে। এখন যিনি আছেন তিনি গিয়াসউদ্দিনের ভাই। বাড়িটা নোংরা হয়ে আছে উচ্ছিষ্টে। চিন্তা নেই, ইনি ও তার ছেলে মিলে পরিস্কার করে নিবে। সাইয়্যিদ মঞ্জু ব্যবস্থা করে রেখেছে সবকিছু।

সমুদ্র তীরে কবি ও শিল্পীগণ সমুদ্র দর্শনে আরও একবার (পর্ব ১২)
সমুদ্র তীরে কবি ও শিল্পীগণ

বাইরে এসে বনকুটিরটিকে প্রকাশিতরূপে দেখা গেল। বেশ বড় একটি দালান, তার চাল টিনের। দেয়ালের রঙ সবুজ, চালের রঙ লাল। সবুজ ঝাউবীথির ভেতর লালসবুজ দালানটি চমৎকার লাগলো। স্মৃতি ধরে রাখার জন্য আমরা বাড়িটিকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে দলবদ্ধ ছবি তুলি। দেখলাম ঝাউবনটি বেশ ফাঁকা ফাঁকা, ঘন সন্নিবদ্ধ নয়। রাতে তারা আঁধারের পোষাক গায়ে স্ফীত হয়ে ছিল, এখন সুঠামদেহী। সমুদ্র সৈকতে এসে দূরে তীরে ভিড়ানো তরল জ্বালানিবাহী দুটি হুবহু এক কমলা সাদা জাহাজ পরিস্ফুট দেখা গেল। আরও দূরে, রাতে চিনতে পারিনি, একই সারিতে নৌবাহিনীর তিনটি গানবোট জলসীমা প্রহরায়। তাদের রঙ হলুদ। প্রভাত আলো পরিস্ফুট করে তুলেছে সবকিছু- সমুদ্র, সৈকত, ঝাউবন। বড় লাল কাঁকড়া নয়, ছোট সাদা কাঁকড়া শিশু মানুষের সাড়া পেয়ে ঢুকে যাচ্ছিল বালুর ভেতরে তৈরি গর্তে। প্রভাত সমুদ্রে সেই সন্ধ্যারাতের মতো জোয়ার, মাঝে ভাটার একটি অধ্যায় গেছে বুঝতে পারি। জাহাজ ও সমুদ্রের ছবি তুলতে গিয়ে আমি একটু পিছিয়ে পড়েছিলাম। আমাকে সঙ্গ দেয় কবি সাইয়্যিদ মঞ্জু।

সৈকত ধরে হাঁটা সমুদ্র দর্শনে আরও একবার (পর্ব ১২)
সৈকত ধরে হাঁটা

আমরা হাঁটি আর কথা বলি। কাল সন্ধ্যা রাতে মহেশখালীর এক কবির কথা হচ্ছিল যে চায়নি এ অনুষ্ঠানটি হোক, আমন্ত্রণ জানানো সত্ত্বেও যে এই উৎসবে যোগ দেয়নি। সে অনেক নেতিবাচক কথা বলেছে, তবু দেখলাম এই তরুণ কবিরা তার প্রতি মায়াশীল। এক পর্যায়ে আমি বল্লাম, ‘তাকে উপেক্ষা করাই শ্রেয়। সে থাকুক তার পরিমণ্ডলে।’ একথা এখন দিব্যলোকের মতো স্পষ্ট যে মহেশখালীর কবিকুলে সে নিঃসঙ্গ। আজ ভোরে মঞ্জুকে কাছে পেয়ে জানতে চাইলাম এর পশ্চাৎ ঘটনা, কেননা মঞ্জুর সাথেই সে কবির মূল বিরোধ। মঞ্জু যা জানাল, তা হলো মহেশখালী উপজেলা লাইব্রেরির সাধারণ সম্পাদক পদে প্রার্থী হয়েছিল সেই কবি। আরেক প্রার্থী ছিল সঙ্গীত শিল্পী শাফায়াত জামিল দিদার। দুজনেই চাইছিল কবিকুল তাদের সমর্থন দিক। তুলনামূলক বিচারে জনপ্রিয় ছিল দিদার, তার জেতার সম্ভাবনাই বেশি; তাই মঞ্জু ও অন্যান্য কবি শিল্পীরা দিদারকে সমর্থন জানায়। কবিরা চায়নি ভোট ভাগ হয়ে শিল্প ঘরাণার বাইরে কেউ সাধারণ সম্পাদক হোক। নির্বাচনে জিতেছিল দিদারই, সে পেয়েছিল সর্বোচ্চ ৮৯ ভোট, আর সেই কবি পেয়েছিল ২৭ ভোট। পরাজয়টা মেনে নিতে পারেনি সেই কবি। মঞ্জুর প্রতি সে থেকেই তার রাগ।

আমরা হাঁটি আর চোখ ভরে বঙ্গোপসাগরের রূপ দেখি। প্রভাত আলোয় সে স্নিগ্ধ। আমি মঞ্জুকে জিজ্ঞেস করি এই যে ২৪ ঘণ্টায় চারবার জোয়ার-ভাঁটা হয়, এটা কি সবসময় একই সময়ে হয়? মঞ্জু উত্তর দিল, ‘না’। চান্দ্র মাসের তারিখের সাথে সময় পাল্টে যায়। যেমন চান্দ্র মাসের ১ তারিখে জোয়ার যদি হয় দুপুর বারোটায়, ২ তারিখে তা হবে দুপুর সাড়ে বারোটায়। এভাবে পেছাতে থাকবে। ভাবি, সেটাই তো স্বাভাবিক, সমুদ্রে জোয়ার-ভাঁটা তো চাঁদের অভিকর্ষ শক্তির টানেই হয়। মঞ্জু মোবাইল থেকে তার লেখা দুটি গান আমাকে শুনতে দেয়। প্রথম গানটি পরিবেশ ধ্বংসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী- ‘নদী হত্যার পর নগরায়নের/কী সুন্দর ছবি আঁকে কফিনের উপর।’ আমার মনে পড়ল কাল সন্ধ্যা রাতে সোনাদিয়ায় গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণে কবি হাফিজ রশিদ খানের আপত্তির কথা।’ দ্বিতীয় গানটি প্রেমের, তাতে এ নিসর্গের ছায়াপাত। ‘ঢেউ আসে তীর ছুঁয়ে যায়/আসনি তুমি/দেখি কত মুখ পাই না কোন সুখ/ধূসর সৈকতে বিরহ ভায়োলিন বাজে।’ দুটি গানেরই সুর দিয়েছেন রশিদ খান আর কণ্ঠ দিয়েছেন বিজয় মামুন।

জেলেরা চিংড়ির পোনা বাছাই করছে সমুদ্র দর্শনে আরও একবার (পর্ব ১২)
জেলেরা চিংড়ির পোনা বাছাই করছে

জেলেরা সমুদ্র পাড়ে চিংড়ির পোনা ধরছিল। নারী ও শিশুদেরও দেখা গেল পোনা সংগ্রহে রত। আমি মঞ্জুকে জিজ্ঞেস করি, সোনাদিয়া দ্বীপের মানুষদের প্রধান জীবিকা এই মাছ ধরা, তাই না? এ ছাড়া আর কী হতে পারে? আমাকে অবাক করে দিয়ে মঞ্জু জানাল, ভৌগলিক কারণে তাদের অনেকের পেশা ছিল জলদস্যুতা। শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম। ওই যে মাঝে মাঝে পত্রিকায় দেখি মাছধরার ট্রলারে ডাকাতি, জেলেদের হত্যা করে ট্রলার ও মাছ লুট, সেসব মনে ভেসে উঠল। এই নিরীহ দর্শন মানুষেরা তবে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে? কথাশিল্পী খোকন কায়সার যে নাগু মেম্বারের বাড়িতে আতিথ্য নিত, কয়েক বছর আগে তাকে হত্যা করে জলদস্যুরা। হতে পারে সেটা কোনো আভ্যন্তরীণ বিরোধ, তবে জলদস্যুরা কত ভয়ঙ্কর এসব ঘটনা তার সাক্ষ্য দেয়। অনেক পর্যটক তাই ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সোনাদিয়ায় আসে না, লুটপাট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় থাকে। এখানে আসতে হলে দলবল ছাড়ি একা নয়, দল নিয়ে আসতে হবে।

এই যেমন আমরা ১২জন, এ মুহূর্তে অবশ্য আমি ও মঞ্জু দুজন, বাকি সবাই এতটা সমুখে যে বাঁকের আড়ালে তারা হারিয়ে গেছে। কেবল আমাদের অনেক পেছনে রুদ্র সাহাদাৎকে দেখা গেল প্রকৃতির টানে বা প্রকৃতির ডাকে পিছিয়ে পড়েছে। সৈকতের কোনো কোনো জায়গায় বালুর উপরে মরা ঝাউগাছের কাণ্ড, গুড়ি ও শেকড় দেখলাম অনেক। মঞ্জু বল্ল, এখানে ঝাউবন ছিল, সমুদ্র গ্রাস করে নিয়েছে। হতে পারে রাক্ষুসে সমুদ্র বা দৈত্যমানুষ উপড়ে নিয়েছে। বনকুটিরের চারপাশে ঝাউবনের ঘনত্ব কমে যাওয়া দেখে আমার এ সন্দেহ জেগেছিল। সমুদ্র সেখানে এখনো পৌঁছেনি। সমুদ্র হাঁয়ের কাছে এই দ্বীপ, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও নিম্নচাপের কাছে অসহায়, মানুষকে সুরক্ষা দেয় ঝাউবন, বাতাস আটকে রাখে, অথচ তারা ঝাউবন ধ্বংস করে। প্রাণদায়ী অক্সিজেন দেয় জেনেও আমরা যেভাবে গাছ কর্তন করি। আমরা এক ধরনের গুল্ম দেখি। মঞ্জু বলে, ওই যে গান আছে না, ‘নিম তিতা, নিশিন্দা তিতা’, এটা হলো সেই নিশিন্দা গুল্ম। নিশিন্দা বালু ধরে রাখে, ঝাউগাছ কিন্তু বালু সরিয়ে দেয়, ফলে তার পতন ঘটে। ঝাউয়ের শেকড় তবে তার ‘Achilles Heel’।

পশ্চিমপাড়ায় এসে বিরতি সমুদ্র দর্শনে আরও একবার (পর্ব ১২)
পশ্চিমপাড়ায় এসে বিরতি

হাঁটছি তো হাঁটছি, বড় চর, সেটাও পশ্চিম পাড়া থেকে যেখানে যাব সেটাও পশ্চিম পাড়াই। এক ঘণ্টা হয়ে গেল। অনুমান করি দূরত্বটি ৪/৫ কিলোমিটার হবে। অবশেষে পৌঁছানো গেল গন্তব্যে। আমাদের অগ্রবর্তী বাহিনী, সংখ্যায় তারা নয়জন, দেখি এক মনোরম ছাউনির নিচে পেতে রাখা বিবিধ বেঞ্চিতে বিশ্রাম নিচ্ছেন। অবাক কাণ্ড, আমাদের থেকে অনেকখানি পিছিয়ে পড়া রুদ্র সাহাদাৎ প্রায় একই সময়ে পৌঁছাল। সে কি ঝাউবনের ভিতর দিয়ে দৌড়ে এলো? কথা ছিল আমরা পশ্চিম পাড়ায় এসে প্রভাতের প্রথম চায়ের পেয়ালায় ঠোঁট ছোয়াব। আশেপাশে কোনো চা-দোকান দেখলাম না। পেছনে ঝাউবনের ভেতর একটি ঘর আর সুন্দর আঙ্গিনা দেখা যাচ্ছিল। একজন স্থানীয় মহিলাকে দেখলাম। ‘চা কি পাওয়া যাবে?’ তাকে জিজ্ঞেস করি। সে মাথা দোলায়, ‘পাওয়া যাবে।’

(চলবে)

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
কামরুল হাসানের জন্ম ২২ ডিসেম্বর, ১৯৬১ সালে বাংলাদেশের শরীয়তপুর জেলায়। তিনি আশির দশকের কবি। প্রথম কাব্য ‘সহস্র কোকিলের গ্রীবা’ প্রকাশিত হয় ১৯৯১ সালে। এরপরে আরও ১১টি কাব্য প্রকাশ করেন। ২০১২ সালে প্রকাশিত হয় ‘নির্বাচিত কবিতা’। কবিতার পাশাপাশি গল্প ও কবিতা বিষয়ক প্রবন্ধ লেখেন এবং বিদেশি সাহিত্য থেকে অনুবাদ করেন। ২০০৫ সালে প্রকাশিত হয় একমাত্র গল্পগ্রন্থ ‘মধ্যবিত্ত বারান্দা ও অন্যান্য গল্প’। ২০১৬ সালে প্রকাশিত হয় প্রবন্ধের বই ‘প্রহরের প্রস্তাবনা’। ভ্রমণপিপাসু এ কবি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সুপ্রচুর ভ্রমণকাহিনী লিখছেন। এপর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে চারটি ভ্রমণকাহিনী। ছাত্রাবস্থায় তার কবিতা সাপ্তাহিক ‘দেশ’ ও ত্রৈমাসিক ‘জিজ্ঞাসা’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তার অনুদিত গ্রন্থের সংখ্যা দুই। ২০০৩ সালে সমীর রায়চৌধুরী ও তুষার গায়েনের সাথে সম্পাদনা করেন দুই বাংলার যৌথ সংকলন Post Modern Bangla Poetry 2003। তিনি বেশ কয়েকবার আমন্ত্রিত কবি হিসেবে দক্ষিণ এশীয় সাহিত্য উৎসবে যোগ দিয়েছেন। কবিতার জন্য পেয়েছেন ‘মৈনাক সন্মাননা স্মারক’ ও ‘কবিকুল, কক্সবাজার কবিতা সম্মাননা‘। ছাত্রজীবনে মেধাবী কামরুল হাসান ভারতের বিখ্যাত আইআইটি খড়গপুর থেকে প্রকৌশলবিদ্যায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। পরবর্তী পড়াশোনা ব্যবসায় প্রশাসনে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ থেকে এমবিএ ডিগ্রি অর্জন করেন। পেশাগত জীবনে বহুবার চাকরি বদল করেছেন। করপোরেট জগৎ থেকে শিক্ষকতায় যোগ দেন। গত ১৫ বছর ধরে পড়াচ্ছেন ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সটিতে। তিনি বিবাহিত ও চার সন্তানের জনক। সম্প্রতি তিনি মহেশখালির দক্ষিণে সোনাদিয়া দ্বীপে সেখানকার তরুণ কবিদের আমন্ত্রণে কবি হাফিজ রশিদ খানের জন্মদিন পালনে গিয়েছিলেন। সে ভ্রমণ অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা ‘সমুদ্রদর্শনে আরও একবার’।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!