‘চন্দন রোশনি’ পর্ব – তিন

মোহিত কামাল
মোহিত কামাল
6 মিনিটে পড়ুন

পর্ব – তিন: কাঁকড়ার চোখে এলইডি স্ক্রিন

অর্ণব আবিষ্কার করল প্রায় একশ আট ফুট লম্বা এক নীল তিমির কংকাল। কংকালের পেটের ভেতর থেকে উপরের দিকে উঠে গেছে আনুমানিক পঁচিশ ফুট লম্বা এক সিঁড়ি। সিঁড়ির ধাপ বেয়ে ও উপরের দিকে উঠতে চাইল। প্রথমে ভেবেছিল সিঁড়ি ভার বহন করতে পারবে না। উঠবে কী উঠবে না দ্বিধায় ভুগে উঠতে লাগল উপরে। না, ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়ল না কঙ্কালের হাড়গোড়। প্রতিটি ধাপে পা ফেলে উপরের ধাপে হাত দিয়ে চেপে ধরে ও উঠতে লাগল ওপরে। কংকালের পেটের ভেতর থেকে বাইরে আসার সময় একটুও ভয় পেল না অর্ণব। বাইরে আসার সফলতায় আনন্দও পেল না মনে।
আনন্দ-ভয় টের না পেয়ে ও দেখল নীল পানির জগৎ- স্রোতহীন স্থির পানির জগতে চারপাশে প্রবালের মতো ঝাঁক। আর গভীর জলের তলে ধূসর সবুজের এক প্রাণিজগৎ। প্রবালসৃদশ এই ঝাঁককে জীবন্ত পাথর মনে হলো।
বোঝার সুযোগ ঘটল যখন ও দেখল একটা নাম না-জানা ছোট মাছ লেজ নাড়তে নাড়তে সতর্ক দৃষ্টিতে এগোতে গিয়ে ভিড়ল প্রবালসম স্তূপের পাশে। আচমকা স্তূপের দেহের মধ্য থেকে লতার মতো অসংখ্য প্রবাল-আঙুল ছড়িয়ে গেল মাছটির চারপাশে। ফেনার মতো আঠাল পদার্থ ছড়িয়ে গেল মাছটির চারপাশে। সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ হয়ে গেল মাছটির নড়াচড়া। ধীরে ধীরে জীবন্ত মাছটি নিথর হয়ে ঢুকে গেল প্রবাল-দেহের ভেতর।
দৃশ্যটি দেখেও চমকে উঠল না অর্ণব। তবে মাছটির চোখের ভাষা পড়তে পেরেছিল। মনে হচ্ছিল একবার করুণ চোখে সেটি চেয়েছিল তার চোখের দিকে। চোখের উজ্জ্বল আলো ক্রমশ ম্লান হয়ে যখন আঁধার হয়ে গেল- বুঝতে পারছিল উদ্ধারের জন্য আকুল আবেদন জানিয়েছিল নাম না-জানা অচেনা মাছটি। বিপদগ্রস্ত মাছের করুণ মিনতি টের পেয়েও উদ্ধারের কোনো প্রণোদনা টের পায়নি অর্ণব। কেবল তাকিয়েছিল পাথরের মতো। তবে নিজেকে পাথর হিসেবে আবিষ্কার করতে পারল না। পাথরের অস্তিত্ব আছে কিনা দেহের অণুতে, অণুর ভেতর চলমান রাসায়নিক কারখানায় বিক্রিয়া ঘটছে কিনা, কিছুই টের পেল না অর্ণব। ফুসফুসের ভেতর বাতাস ঢোকা এবং বেরুনোর কোনো অনুভবও টের পাচ্ছে না- হৃৎপিণ্ডের অনবরত গেয়ে যাওয়া লাপডাপ শব্দেরও অস্তিত্ব খুঁজে পাচ্ছে না ও।
বাস্তবের মায়াময় গিঁট খুলে কোনো স্বপ্নসাগরে ঢুকে গেছে নিজে―এমনটিই ভাবল ও। ওর আরও মনে হলো আলো ঝলমলে সত্যের ভাঙা স্রোতে ভেসে পালিয়ে এসেছে নীলসমুদ্রের তলদেশে, অন্য জগতে।
প্রশ্ন জাগছে মনে। প্রশ্নের আড়ালে কোনো অনুভব-অনুভূতি জাগছে না। প্রশ্নের মালা গেঁথে কংকালের সিঁড়ির শেষ ধাপ পেরিয়ে উঠে এলো ভাঙা দালানের বিশাল পিলারের মতো তিমির পিঠের শিরদাঁড়ার ওপর। ধীর পায়ে হেঁটে হেঁটে এগোতে লাগল মাটির সঙ্গে মেশানো লেজ বেয়ে। মাটিতে পা দিয়ে চমকে উঠল ও। ঝুরঝুর করে সরে যাচ্ছে পানির তলে সাজানো সাদামাটির ঢেউ, সমুদ্র ঢেউয়ের আদলে মাটির ঢেউয়ের মধ্যেও রয়েছে সুশৃঙ্খল সারি। নিচু থেকে উঁচু ঢেউ এগিয়ে গেছে সামনের ঢেউ খেলানো পাহাড়ের দিকে। পাহাড়গুলো পাউডারের জমাট অস্তিত্বের মতো শক্ত মনে হলেও পা বসে যাচ্ছে মাটির ঢেউয়ের তটে। কোনো কোনো ঢেউয়ের মাটি লাল, কোনো কোনোটি গোলাপি, বেগুনি আর সাদা ঢেউয়ের পাহাড়ও রয়েছে সামনে। বেগুনি পাহাড়ের সবুজ প্রাণিজ উদ্ভিদের আড়ালে তেলাপিয়া মাছের আকৃতির দুটো মাছ পেটের সঙ্গে পেট লাগিয়ে আটকে আছে একের মধ্যে অন্যে। নারী মাছটির কানের পাশে দুলছে লেজের মতো লাল পাখনা। আর পুরুষ মাছটির কানের পাখনা ধূসর। একবারও নড়ছে না। স্থির হয়ে তাকিয়ে আছে। গোল চোখের ভেতর কালো মণির বদলে রয়েছে লাল মণি। লালের মধ্যে গোলাকারে বসে আছে সাদা টিপ। লাল আর সাদার বিকিরণে থমকে গেল অর্ণব। স্থির চোখে তাকিয়ে রইল ও। মনের তারে বেজে উঠল- জৈবিক ক্রিয়া সব ক্ষেত্রে একই রকম। সৃষ্টির অপূর্ব সুন্দর এ শৈল্পিক কাজটিকে অশ্লীল বলে কেন মানুষ- বুঝতে পারল না অর্ণব। তবে মনে কোনো বিস্ময় জাগল না, আনন্দও না। ও কেবলই দেখেই যাচ্ছে রোবটের মতো- এ-ই যা।
বর্ণিল অথচ ঢেউ খেলানো পাহাড় বেয়ে হাঁটতে গিয়ে পায়ের দিকে চোখ গেল তার। একটা লাল কাঁকড়া তার অসংখ্য পায়ের অগ্রভাগের কাঁচির মতো দু ফালি ধারাল দাঁত দিয়ে খামচে ধরেছে অর্ণবের পায়ের পাতার উপরের ত্বক। ব্যথা পাওয়ার কথা, রক্ত ঝরার কথা, এমন আক্রমণে পা ঝাটকা দিয়ে কাঁকড়াটিকে ছুড়ে মারার কথা। তেমন স্বাভাবিক কোনো আচরণই করল না ও। কেবল তাকাল মার্বেলের মতো ঘূর্ণায়মান কাঁকড়ার লালচোখা-মণির দিকে। মনে হলো কিছু বলতে চায় অদ্ভুত কাঁকড়াটি। কী কথা বলবে ওটা? মনে প্রশ্ন জাগলেও জিজ্ঞাসু শব্দ বেরুল না অর্ণবের কণ্ঠ থেকে। মনে হলো ও হারিয়ে ফেলেছে মুখের ভাষা। অনুভব-অনুভূতির কেন্দ্রে ছোট-বড় কোনো ঢেউ টের পাচ্ছে না ও। পায়ে কামড় দিয়ে কী কথা জানান দিতে চায় কাঁকড়াটি? প্রশ্নভরা চোখে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল ও। খুব কাছ থেকে এবার তাকাল কাঁকড়ার চোখের লাল মণির দিকে। বিস্ময়ে নড়ল না, অনুভূতির ঢেউ উঠল না মনে- কেবল নিথর চোখে তাকিয়ে রইল অর্ণব। কাঁকড়ার চোখকে আর চোখ মনে হলো না। এক বড় এলইডি স্ক্রিনে ও এখন দেখতে পেল অনন্য এক জগৎ। কখনও এমন জগতে পরিভ্রমণ করেছে, বিচরণ করেছে, কাটিয়েছে আনন্দময় কিংবা নিরাপত্তাহীন সময়- মনে পড়ল না ওর।
উদিত ভাবনা কোনো বিক্রিয়া ঘটাল না মস্তিষ্কে- নাড়া খেল না মন, কেবল তাকিয়ে রইল থ্রিজি এলইডি স্ক্রিনের দিকে…

চলবে…

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
কথাসাহিত্যিক মোহিত কামালের জন্ম ১৯৬০ সালের ০২ জানুয়ারি চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলায়। তাঁর বাবার নাম আসাদুল হক এবং মায়ের নাম মাসুদা খাতুন। তাঁর শৈশব-কৈশোর কেটেছে আগ্রাবাদ, চট্টগ্রাম ও খালিশপুর, খুলনায়। বর্তমান নিবাস ধানমন্ডি, ঢাকা। স্ত্রী মাহফুজা আখতার মিলি, সন্তান মাহবুব ময়ূখ রিশাদ, পুত্রবধূ ইফফাত ইসলাম খান রুম্পা ও জিদনি ময়ূখ স্বচ্ছকে নিয়ে তাঁর সংসার। চার ভাই এক বোনের মধ্যে চতুর্থ সন্তান তিনি। তাঁর অ্যাফিডেভিট করা লেখক-নাম মোহিত কামাল। তিনি সম্পাদনা করছেন শুদ্ধ শব্দের নান্দনিক গৃহ, সাহিত্য-সংস্কৃতির মাসিক পত্রিকা শব্দঘর। তাঁর লেখালেখির মুখ্য বিষয় : উপন্যাস ও গল্প; শিশুসাহিত্য রচনার পাশাপাশি বিজ্ঞান বিষয়ে গবেষণাধর্মী রচনা। লেখকের উড়াল বালক কিশোর উপন্যাসটি স্কলাস্টিকা স্কুলের গ্রেড সেভেনের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে; ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্যও বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পাঠাভ্যাস উন্নয়ন কর্মসূচি (ঝঊছঅঊচ) কর্তৃকও নির্বাচিত হয়েছে। এ পর্যন্ত প্রকাশিত কথাসাহিত্য ৩৭ (উপন্যাস ২৪, গল্পগ্রন্থ ১৩)। এ ছাড়া কিশোর উপন্যাস (১১টি) ও অন্যান্য গ্রন্থ মিলে বইয়ের সংখ্যা ৫৫। জাতীয় পুরস্কার: কথাসাহিত্যে অবদান রাখার জন্য তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (২০১৮), অগ্রণী ব্যাংক-শিশু একাডেমি শিশুসাহিত্য পুরস্কার ১৪১৮ বঙ্গাব্দ (২০১২) অর্জন করেছেন। তাঁর ঝুলিতে রয়েছে অন্যান্য পুরস্কারও; হ্যাঁ (বিদ্যাপ্রকাশ, ২০২০) উপন্যাসটি পেয়েছে সমরেশ বসু সাহিত্য পুরস্কার (২০২০)। পথভ্রষ্ট ঘূর্ণির কৃষ্ণগহ্বর (বিদ্যাপ্রকাশ, ২০১৪) উপন্যাসটি পেয়েছে সিটি আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার (২০১৪)। সুখপাখি আগুনডানা (বিদ্যাপ্রকাশ, ২০০৮) উপন্যাসটি পেয়েছে এ-ওয়ান টেলিমিডিয়া স্বাধীনতা অ্যাওয়ার্ড ২০০৮ এবং বেগম রোকেয়া সম্মাননা পদক ২০০৮―সাপ্তাহিক দি নর্থ বেঙ্গল এক্সপ্রেস-প্রদত্ত। না (বিদ্যাপ্রকাশ, ২০০৯) উপন্যাসটি পেয়েছে স্বাধীনতা সংসদ নববর্ষ পুরস্কার ১৪১৫। চেনা বন্ধু অচেনা পথ (বিদ্যাপ্রকাশ, ২০১০) উপন্যাসটি পেয়েছে ময়মনসিংহ সংস্কৃতি পুরস্কার ১৪১৬। কিশোর উপন্যাস উড়াল বালক (রোদেলা প্রকাশনী, ২০১২; অনিন্দ্য প্রকাশ, ২০১৬) গ্রন্থটি ২০১২ সালে পেয়েছে এম নুরুল কাদের ফাউন্ডেশন শিশুসাহিত্য পুরস্কার (২০১২)। তিনি মনোচিকিৎসা বিদ্যার একজন অধ্যাপক, সাবেক পরিচালক জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ,ঢাকা
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!