সাত বার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরেই লটারির প্রথম পুরস্কার ৭৪,৭২,৪৭,০০০,০০ টাকা

সিদ্ধার্থ সিংহ
সিদ্ধার্থ সিংহ
6 মিনিটে পড়ুন
ফ্রেন সিলাক।

ট্রেনে চেপে তিনি যাচ্ছিলেন সারায়েভো থেকে ডুবরোভনিকে। হঠাৎই ট্রেনটি লাইনচ্যুত হয়ে বরফে ঢাকা এক নদীর উপরে গিয়ে ছিটকে পড়ল। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হল ১৭ জনের। ভাগ্যের জোরে কোনও রকমে বেঁচে ফিরলেন ফ্রেন সিলাক।

সেই দুর্ঘটনায় তাঁর শুধুমাত্র একটি হাত ভাঙে আর হাইপোথার্মিয়া ছাড়া তাঁর আর তেমন কিছুই হয়নি। ঘটনাটি ঘটেছিল ১৯৬২ সালে। নির্ঘাত মৃত্যুর মুখ থেকে এটাই তাঁর প্রথম ফিরে আসা।

পরের দুর্ঘটনাটি ঘটে ঠিক এক বছরের মাথায়। ১৯৬৩ সালে। ৩২ বছর বয়সী এই ক্রোয়েশিয়ান ভদ্রলোকের কাছে খবর আসে তাঁর মা খুব অসুস্থ। য়াগরিব থেকে রিজেকাগামী বিমানে করে মায়ের কাছে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। প্রথম ফ্লাইটে সিট না পাওয়ায় মায়ের অসুস্থতার কথা বলে বিমান সেবিকার পাশে বসে যাওয়ার বিশেষ অনুমতি আদায় করেন তিনি।

সব ঠিকঠাকই ছিল। বিপত্তি বাধল ল্যান্ডিংয়ের ঠিক আগের মুহূর্তে।‌‌ কী হয়েছিল সে দিন, তিনি সেটা নিজের মুখেই বলেছেন— আমি আর এক বিমান সেবিকা পাশাপাশি বসে চা পান করতে করতে গল্প করছিলাম।

হঠাৎই, বলা নেই কওয়া নেই, কী ভাবে যেন প্লেনের দরজা খুলে গেল। আর তার পরমুহূর্তেই দেখলাম, আমার পাশে বসা সেই বিমান সেবিকা বিমানের বাইরে মহাশূন্যে ভাসছে। তার পর কী করে যেন আমিও কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম খোলা আকাশে! আমরা দু’জন ছিটকে বেরিয়ে আসার পরেই বিমানটিতে বিস্ফোরণ ঘটে গেল। অন্য এক বিমান সেবিকা, দু’জন বিমান চালক-সহ মোট ২০ জন যাত্রী মারা যান সে দিন। ভাগ্যক্রমে সেখান থেকেও বেঁচে ফিরলেন তিনি।

আসলে খোলা আকাশে ভাসতে ভাসতে তিনি গিয়ে পড়েছিলেন এক খড়ের গাদার উপরে। কাজেই এত বড় একটি দুর্ঘটনার মুখোমুখি হয়েও নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এলেন তিনি। একটু আধটু কাঁটা-ছেঁড়া ছাড়া বলতে গেলে প্রায় কিছুই হয়নি তাঁর!

মায়ের সঙ্গে সে দিন খুব স্বাভাবিক ভাবেই দেখা করতে পেরেছিলেন ১৯২৯ সালের ১৪ জুন জন্মানো এই সংগীত শিক্ষক।

তার পরের দুর্ঘটনাটি ঘটে ১৯৬৬ সালে। মাইক্রোবাসে করে কোথায় যেন যাচ্ছিলেন। বাসটি দ্রুতগতিতে যেতে যেতে হঠাৎই ব্রেক ফেল করে আছড়ে পড়ে পাশের একটি নদীতে।
ফ্রেনের চার সহযাত্রী প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মারা যান। ওই বাস থেকে একমাত্র তিনিই দিব্যি সাঁতার কেটে পাড়ে উঠে আসেন। এ বারও একদম অক্ষত অবস্থায়।

240738472 384968559736468 7530852672152215275 n সাত বার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরেই লটারির প্রথম পুরস্কার ৭৪,৭২,৪৭,০০০,০০ টাকা
সাত বার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরেই লটারির প্রথম পুরস্কার ৭৪,৭২,৪৭,০০০,০০ টাকা 39

এর পর ১৯৭০ এবং ১৯৭৩ সালে প্রায় একই রকম দুটি দুর্ঘটনার মুখোমুখি হন তিনি। প্রথম বার গাড়িতে দাউ দাউ করে আগুন ধরে যাওয়ার পরেও একদম সুস্থ অবস্থায় গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন তিনি।

আর দ্বিতীয় বার পেট্রোল পাম্প থেকে তেল নেওয়ার সময় আচমকাই পাম্পের মধ্যে বিকট বিস্ফোরণ ঘটে। আশপাশের কয়েকটি গাড়ি-সহ তাঁর গাড়িতেও আগুন লেগে যায়। তিনি তখন গাড়ির মধ্যেই ছিলেন। ফলে তড়িঘড়ি করে বেরোতে গিয়ে তাঁর মাথার বেশির ভাগ চুল পুড়ে যায় ঠিকই, কিন্তু সেই আগুন মারাত্মক কোনও ক্ষতি করতে পারেনি তাঁর।

এই ভাবে বারবার দুর্ঘটনার কবলে পড়ার জন্য তাঁর বন্ধুরা তাঁর সঙ্গে গাড়িতে ওঠা বন্ধ করে দেন। তাঁকে এড়িয়ে চলতে থাকেন। অনেকেই মনে করতে থাকেন, তিনি ভীষণ অপয়া।
ফ্রেনের এক প্রতিবেশী তো সরাসরিই বলে ফেললেন, আমার কানে যদি আসে উনি কোনও ফ্লাইট বা ট্রেনের টিকেট বুক করেছেন, তা হলে সহযাত্রী হওয়া তো দূরের কথা, সেই সপ্তাহে আমি আর ঘর থেকেই বেরোই না!

এর পর প্রায় ২২ বছর এই রকম আর কোনও বড় দুর্ঘটনার মুখোমুখি হতে হয়নি তাঁকে। খুব সুন্দর ভাবেই নির্বঘ্নে কাটিয়ে দিচ্ছিলেন জীবন।
কিন্তু যাঁর পায়ে পায়ে বিপদ, তিনি দুর্ঘটনা এড়াবেন কী করে!

১৯৯৫ সালে য়াগরিবের রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলেন তিনি। আচমকা ছুটে আসা একটি সিটি বাস তাঁকে দুম করে সজোরে ধাক্কা মারে। তিনি ছিটকে পড়েন দশ হাত দূরে। কিন্তু ওই পর্যন্তই। হাতে-পায়ে সামান্য কিছু ছড়েটড়ে গেলেও মারাত্মক কিছু হয়নি।

পরের বছর, অর্থাৎ ১৯৯৬ সালে উঁচু এক পাহাড়ি রাস্তা দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিলেন ফ্রেন। এমন সময় আকস্মিক ভাবে সামনে এসে পড়া ছুটন্ত এক ট্রাকের ধাক্কায় গাড়ি-সহ প্রায় ৩০০ ফুট গভীর খাদে পড়ে যান তিনি।

অনেকটা হিন্দি সিনেমার মতোই গাড়ি থেকে ছিটকে এক গাছের মগডালে আটকে যান এবং কয়েক জন পথচারীর তৎপরতায় সে বারও বহাল তবিয়তে বাড়ি ফিরে আসেন তিনি।
এই প্রথম গাছের ডালে ঝুলন্ত অবস্থায় গভীর খাদে পড়ে যাওয়া গাড়িটির চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখে তিনি একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন।

একবার-দু’বার নয়, সাত-সাত বার মৃত্যুকে ফাঁকি দিয়ে ফের জীবনে ফিরে আসতে পেরেছেন যিনি, তিনি তো ভাগ্যবান বটেই। লটারির টিকিট কাটলে নিশ্চয়ই প্রথম পুরস্কার পেয়ে যাবেন।
হ্যাঁ, তাই-ই ঘটেছিল। ২০০৩ সালে তিনি একটি লটারির টিকিট কাটেন। এবং প্রথম পুরস্কারটি পেয়ে যান। এক লাখ মার্কিন ডলার। মানে ভারতীয় মুদ্রায় ৭৪,৭২,৪৭,০০০,০০ টাকা।

এই সব অবিশ্বাস্য ঘটনার জন্য ওখানকার সাংবাদিকদের ভোটে তিনি একই সঙ্গে একজন ‘ওয়ার্ল্ড’স লাকিয়েস্ট ম্যান’ এবং ‘ওয়ার্ল্ড’স আনলাকিয়েস্ট ম্যান’-এর খেতাব জেতেন। তবে তিনি নিজে বলেছেন, প্রতিটি মুদ্রার দুটি পিঠ থাকে। হয় আমি পৃথিবীর সব চেয়ে দুর্ভাগা ব্যক্তি, নয়তো সব চেয়ে ভাগ্যবান ব্যক্তি। অবশ্য নিজেকে দ্বিতীয়টি ভাবতেই আমি বেশি পছন্দ করি।
সাত-সাত বার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসে আর চার-চার বার ব্যর্থ বিবাহের আঘাত সহ্য করেও এখনও তিনি বহাল তবিয়তে আছেন।

লটারির সেই বিপুল অর্থের কিছুটা দিয়ে নিজের জন্মভূমি পেট্রিঞ্জায় একটি খুব সুন্দর চ্যাপেল বানিয়েছেন তিনি। এলাকার লোকের কাছে এখন তাঁর ডাকনাম হয়ে গেছে— মিস্টার লাকি।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
২০২০ সালে 'সাহিত্য সম্রাট' উপাধিতে সম্মানিত এবং ২০১২ সালে 'বঙ্গ শিরোমণি' সম্মানে ভূষিত সিদ্ধার্থ সিংহের জন্ম কলকাতায়। আনন্দবাজার পত্রিকার পশ্চিমবঙ্গ শিশু সাহিত্য সংসদ পুরস্কার, স্বর্ণকলম পুরস্কার, সময়ের শব্দ আন্তরিক কলম, শান্তিরত্ন পুরস্কার, কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত পুরস্কার, কাঞ্চন সাহিত্য পুরস্কার, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা লোক সাহিত্য পুরস্কার, প্রসাদ পুরস্কার, সামসুল হক পুরস্কার, সুচিত্রা ভট্টাচার্য স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার, অণু সাহিত্য পুরস্কার, কাস্তেকবি দিনেশ দাস স্মৃতি পুরস্কার, শিলালিপি সাহিত্য পুরস্কার, চেখ সাহিত্য পুরস্কার, মায়া সেন স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার ছাড়াও ছোট-বড় অজস্র পুরস্কার ও সম্মাননা। পেয়েছেন ১৪০৬ সালের 'শ্রেষ্ঠ কবি' এবং ১৪১৮ সালের 'শ্রেষ্ঠ গল্পকার'-এর শিরোপা সহ অসংখ্য পুরস্কার। এছাড়াও আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত তাঁর 'পঞ্চাশটি গল্প' গ্রন্থটির জন্য তাঁর নাম সম্প্রতি 'সৃজনী ভারত সাহিত্য পুরস্কার' প্রাপক হিসেবে ঘোষিত হয়েছে।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!