জাপানিরা বিধ্বংসী বোমা ফেলেছিল টালা ট্যাঙ্কে

সিদ্ধার্থ সিংহ
সিদ্ধার্থ সিংহ
5 মিনিটে পড়ুন

শুধু পশ্চিমবঙ্গের নয়, বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ খাবার জলের ট্যাঙ্ক হল কলকাতার টালা ট্যাঙ্ক। এক টানা ১০০ বছরেরও বেশি দিন ধরে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে কলকাতার মানুষকে পরিশুদ্ধ খাবার জল সরবরাহ করছে এই ট্যাঙ্ক।

যে বিশেষ গ্রেডের লোহার চাদর দিয়ে টাইটানিক জাহাজ তৈরি হয়েছিল, এটা তৈরি হয়েছে সেই গ্যালভানাইজড দিয়ে। এই ট্যাঙ্ক তৈরি করার জন্য সেই আমলে প্রায় ৮৫০০ টন লোহা সুদূর ম্যাঞ্চেস্টার থেকে জাহাজে করে আনা হয়েছিল।

ধীরে ধীরে কলকাতা যখন শহরে পরিণত হচ্ছিল, তখন নাগরিক পরিষেবা বাড়ানোই ছিল ব্রিটিশদের একমাত্র লক্ষ্য। আর সেই পরিষেবার মধ্যে অন্যতম ছিল পানীয় জল। এর জন্য কয়েকটি পুকুরও কাটা হয়। হেঁদুয়া, ওয়েলিংটন স্কোয়ার, ভবানীপুরেও। সেই সব পুকুর থেকে সে সময় জল সরবরাহ করা হত। কিন্তু শহর যখন ক্রমশ বাড়তে শুরু করল, তখন জলের প্রয়োজনটাও বাড়ল।

তত্‍কালীন পুর ইঞ্জিনিয়র মিস্টার ডেভেরাল একটি ট্যাঙ্ক ( রিজার্ভার) তৈরির প্রস্তাব দেন। প্রস্তাবটি তৈরি করেছিলেন তাঁর সহকারি মিস্টার পিয়ার্স। প্রস্তাবের সঙ্গে সহমত হয় বেঙ্গল গভর্নমেন্টও।

১৯০১ সালের সেই প্রস্তাবটি কর্পোরেশন গ্রহণ করে ১৯০২ সালে। এর ঠিক এক বছর পরে এই প্রস্তাবের সামান্য অদলবদল করেন পৌরসভার নয়া নিযুক্ত ইঞ্জিনিয়র ডব্লু বি ম্যাকক্যাবে।
তাতে প্রস্তাবিত অর্থের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৬৯ লক্ষ ১৭ হাজার ৮৭৪ টাকা। এবং এটা করলে যে আরও উন্নত জল পরিষেবা সম্ভব হবে, তাতে সম্পূর্ণ সম্মতি দেয় পৌরসভা।
কিন্তু কোথায় বসানো হবে এত বড় ওভারহেড ট্যাঙ্ক? এর জন্য তো প্রচুর জায়গার দরকার। তখন বেছে নেওয়া হয় টালা অঞ্চলটাকে। আজ টালা ট্যাঙ্ক যেখানে অবস্থিত, ‌তখন সেখানে ছিল বেশ কয়েকটি পুকুর । ঠিক হয়, পুকুর বুজিয়ে গড়ে তোলা হবে বিশ্বের সর্ববৃহত্‍ ওভারহেড রিজর্ভার।

১৯০৯ সালের ১৮ নভেম্বর টালা ট্যাঙ্ক নির্মাণের উদ্বোধন করেন বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার এডওয়ার্ড বেকার। প্রথমেই শুরু হয় পুকুর বোজানো। পুকুরগুলোকে জলশূন্য করা হয়। তার পর চার দিকে শাল-বল্লার খুঁটি দিয়ে ২০-২৫ ফুট পাইল করে খোয়া দিয়ে ভর্তি করা হয়। ভারী স্টিম রোলার দিয়ে সমান করে তার ওপর খোয়া দিয়ে ৯ ইঞ্চি পুরু আরও একটি স্তর তৈরি করা হয়। এর পর আড়াই ফুট পুরু কংক্রিট সিমেন্টের ওপর ফ্ল্যাট স্টিল টাঁই-এর সঙ্গে বোল্ড স্টিল জয়েন্টের ওপর ২১৫টি লোহার স্তম্ভ দাঁড় করানো হয়।

এই ফাউন্ডেশনের কাজটির দায়িত্ব নেয় টি সি মুখার্জি অ্যান্ড কোম্পানি। কংক্রিট ফাউন্ডেশনের কাজটি নেয় স্যার রাজেন্দ্রলাল মুখার্জির মার্টিন অ্যান্ড কোম্পানিতে। বাকি কাজের দায়িত্ব নেয় লিডসের ক্লেটন কোম্পানি।

বিশ্বের বৃহত্তম এই ওভারহেড ট্যাঙ্কটি রয়েছে মাটি থেকে ১১০ ফুট উঁচুতে। মানে প্রায় ১০ তলা বাড়ির সমান উঁচুতে। সল্টলেক স্টেডিয়ামের মাপ হল ২৮০ ফুট বাই ২৮০ ফুট। সেখানে টালা ট্যাঙ্কের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের মাপ— ৩২১ ফুট বাই ৩২১ ফুট! অর্থাৎ বিবেকানন্দ যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনের থেকেও এই জলাধার অনেক অনেক বড়।

গভীরতা ১৬ ফুট। অর্থাৎ একটি দোতলা বাড়ির সমান। আর পুরো লোহার খাঁচাটির ওজন ৮ হাজার ৫০০ টন। অবশ্য ট্যাঙ্কে যে পাইপ দিয়ে জল ঢোকে এবং বেরোয় সেই পাইপের ওজন ধরেই।

এই ট্যাঙ্কে জলধরার ক্ষমতা ৯ লক্ষ গ্যালন। যে পরিমাণ জল এখানে‌ ধরে তার ওজন ৪০ হাজার টন।

১৯১১ সালের ১২ জানুয়ারি কাজ শেষ হয় এবং সে বছরেরই ১৬ মে থেকে এই টালা ট্যাঙ্ক চালু করা হয়। ট্যাঙ্কটি তৈরি করতে শেষ পর্যন্ত খরচ হয়েছিল ২২ লক্ষ ২৫ হাজার ৪১ টাকা।
ট্যাঙ্কটি চারটি কম্পার্টমেন্টে বিভক্ত, যাতে জল সরবরাহ বন্ধ না রেখেই এক বা একাধিক কম্পার্টমেন্ট পরিষ্কার বা সারাই করা যেতে পারে।

শোনা যায়, প্রথম দিকে নাকি এই ট্যাঙ্কের জল খেতে চাননি শহরবাসীরা। কারণ, তখন ধারনা ছিল গঙ্গার জল‌ তো পবিত্র। সেই জল মেশিন ও পাইপের ভিতর দিয়ে আসার ফলে তার পবিত্রতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে! তাই প্রায় পাঁচ বছর টালা ট্যাঙ্কের জল ব্রাত্যের তালিকায় ছিল। ব্রিটিশরা অবশ্য শেষ পর্যন্ত বোঝাতে পেরেছিল যে, টালা ট্যাঙ্কের জল ব্যবহার না করে কোনও উপায় নেই। সেই দিন থেকে আজও টালা ট্যাঙ্কের জল সত্যিই প্রাণবিন্দুসম!

এই দেশের শত্রুদের সব সময়ই নজর ছিল এই টালা ট্যাঙ্কের উপরে। তাঁরা মনে করতেন, একবার এটা ধ্বংস করতে পারলেই পানীয় জলের অভাবে কলকাতা ছেড়ে পালাতে বাধ্য হবে এই শহরের নাগরিকেরা। তাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় উড়ে এসে টালা ট্যাঙ্কে বোমা ফেলেছিল জাপানিরা। কিন্তু এই ট্যাঙ্কটি এতটাই মজবুত করে তৈরি করা হয়েছিল যে, সেই বিধ্বংসী বোমাতেও টালা ট্যাঙ্ক ধ্বংস হয়নি। তবে হ্যাঁ, তাতে ৯টা ফুটো হয়েছিল‌ ঠিকই।

শুধু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়েই নয়, ১৯৬২ ও ১৯৭১ সালের যুদ্ধেও চিন এবং পাকিস্তানের টার্গেট ছিল টালা ট্যাঙ্ক।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
২০২০ সালে 'সাহিত্য সম্রাট' উপাধিতে সম্মানিত এবং ২০১২ সালে 'বঙ্গ শিরোমণি' সম্মানে ভূষিত সিদ্ধার্থ সিংহের জন্ম কলকাতায়। আনন্দবাজার পত্রিকার পশ্চিমবঙ্গ শিশু সাহিত্য সংসদ পুরস্কার, স্বর্ণকলম পুরস্কার, সময়ের শব্দ আন্তরিক কলম, শান্তিরত্ন পুরস্কার, কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত পুরস্কার, কাঞ্চন সাহিত্য পুরস্কার, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা লোক সাহিত্য পুরস্কার, প্রসাদ পুরস্কার, সামসুল হক পুরস্কার, সুচিত্রা ভট্টাচার্য স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার, অণু সাহিত্য পুরস্কার, কাস্তেকবি দিনেশ দাস স্মৃতি পুরস্কার, শিলালিপি সাহিত্য পুরস্কার, চেখ সাহিত্য পুরস্কার, মায়া সেন স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার ছাড়াও ছোট-বড় অজস্র পুরস্কার ও সম্মাননা। পেয়েছেন ১৪০৬ সালের 'শ্রেষ্ঠ কবি' এবং ১৪১৮ সালের 'শ্রেষ্ঠ গল্পকার'-এর শিরোপা সহ অসংখ্য পুরস্কার। এছাড়াও আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত তাঁর 'পঞ্চাশটি গল্প' গ্রন্থটির জন্য তাঁর নাম সম্প্রতি 'সৃজনী ভারত সাহিত্য পুরস্কার' প্রাপক হিসেবে ঘোষিত হয়েছে।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!