বিদ্রোহী: নজরুলের খণ্ড পরিচয়

ড. কাজী মোজাম্মেল হেসেন
ড. কাজী মোজাম্মেল হেসেন
16 মিনিটে পড়ুন

প্রাবন্ধিক, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, সাংবাদিক, সুরকার, গীতিকার, গায়ক, বাদক, অভিনেতা হিসেবে দক্ষতার পরিচয় দিলেও কবির খ্যাতিতে কাজী নজরুল ইসলাম একজন খ্যাতমান পুরুষ ছিলেন। তাঁর আগুনভরা আবেগময় কবিতার জন্য প্রথম থেকেই কবির নামের আদিতে ‘বিদ্রোহী’ ভূষণের সংযুক্তি ঘটেছিল । কালের বিবর্তনের পর এখনোও অনেকে কবির সেই ‘বিদ্রোহী’ ভূষণটি জরুরি মনে করেন। তবে অকারণে ভূষণটি যাতে নজরুলের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত না হয়, সেদিকে সকলের সজাগ দৃষ্টি প্রয়োজন।

খ্যাতির ভাগ্য বড়ই বিচিত্র- একবার কারো ভাগ্যে খ্যাতির তিলক জড়িয়ে গেলে, আজীবন তিনি সে খ্যাতির খ্যাতমান পুরুষে পরিণত হয়ে যান। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদের কারণে রবীন্দ্রনাথ হয়েছেন ‘মিসটিক’ কবি। ছন্দের কারসাজির শ্রেষ্ঠত্বের কারণে সতেন্দ্রনাথ দত্ত হয়েছেন ‘ছান্দসিক’ কবি। আগুনভরা জ্বালাময়ী কবিতার জন্য কাজী নজরুল ইসলাম হয়েছেন ‘বিদ্রোহী কবি।’ তবে ‘ভূষণ’ কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীর ভাগ্যে যেমনি সৌভাগ্যের তিলক পরিয়ে দেয়; তেমনি দুর্ভাগ্যও বয়ে আনে।

স্মরণযোগ্য- মিসটিক, ছান্দসিক, বিদ্রোহী যেমনি কোনো কবি-সাহিত্যিকের একমাত্র পরিচয় হতে পারে না; তেমনি বিদ্রোহও কবি কাজী নজরুল ইসলামের একমাত্র পরিচয় নয়; একটা খণ্ড পরিচয় মাত্র। বলতে দ্বিধা নেই- নজরুলের কবিতার প্রধান উপাদান বিদ্রোহ নয়; মানব প্রেম। তাঁর কবিতা খুঁটিয়ে দেখলে অনুধাবন করা যাবে, প্রেমই তাঁর শ্রেষ্ঠ সম্পদ- বিদ্রোহ খণ্ড পরিচয়।

নজরুল তাঁর তবিতায় কবিমানসের যে চিরন্তন কাকুতি-মিনতি, প্রেম-বিরহ, ব্যথা-বেদনার সার্থক করে তুলেছেন তার উপর ভিত্তি করে তাকে বিদ্রোহী বিশেষণে বিশেষিত না করে, শ্রেষ্ঠ প্রেমিক কবির সম্মানে সম্মানিত করা যায়। এ প্রসঙ্গে আজহারউদ্দীন খানেরা উক্তিটি তুলে ধরা হলো:

‘যুগের হুজুগে কবি’র পরও তিনি যে যুবতীদের কবি সে- বিষয়ে আমরা প্রায় ভুলতে বসেছি।১

টি এস ইলিয়েটের মতে, ‘প্রকৃত কবি বা শিল্পী হচ্ছেন তিনি যার ছবিতে ধরা পড়ে যুগপ্রতিচ্ছবি।’ নজরুল যখন বিংশ শতকের দ্বিতীয় দশকে প্রথম মহাযুদ্ধের অভিজ্ঞতা নিয়ে দেশে পা রাখেন, তখন ভারত ছিল পরাধীন রাষ্ট্র। ফলে নজরুল একটা পরাধীন জাতির কাছ থেকে শেকল ভাঙার মন্ত্রে উদ্বোধিত হবেন- এটাই স্বাভাবিক। মানবিক, আত্মিক অথবা প্রাকৃতিক প্রেমবোধ সে মুহূর্তে তার কাছ থেকে আশা করা অসম্ভব ছিল। সভা-সমিতি অথবা পত্র-পত্রিকায় কবির সে মুহুর্তের জ্বালাময়ী কবিতা, পাঠককে এতই উত্তেজিত করে তুলেছিল যে কবিকে তখন বিদ্রোহীর শিখরে উপস্থাপন না করে উপায় ছিল না।

ছেলেবেলা থেকেই নজরুল ছিলেন একটু দুরন্ত প্রকৃতির। কখনো তিনি অন্যায়ের নিকট মাথা নত করেননি। অচলায়তনকে বারবার তিনি ভাঙতে চেয়েছেন। প্রচলিত সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তিনি সর্বদা সোচ্চার ও প্রতিবাদমুখর ছিলেন। যার সবগুলো লক্ষণই ছিল বিদ্রোহের। তাই বলে নজরুলের একমাত্র পরিচয় বিদ্রোহী: তা মেনে নিলে কবিমানসের প্রতি অবিচার করা হবে। বিদ্রোহ ছিল তাঁর খণ্ড পরিচয়। যুগের প্রভাবে তিনি বিদ্রোহী হলেও প্রেমিক কবি হিসেবে তিনি সকলের মন জয় করেছেন। আজও সংখ্যার দিক থেকে তাঁর বিদ্রোহী কবিতার চেয়ে প্রেমের কবিতার সংখ্যা বেশি। পাঠকচিত্তে তিনি আজ প্রেমের কবির হিসেবে অধিক আলোড়িত।

অনেকে তাঁকে ‘প্রেম-বিদ্রোহের’ কবি হিসেবে দাঁড় করাতে চেষ্টা করলেও প্রেম-বিদ্রোহ একত্রে একজন প্রকৃত যোদ্ধার ক্ষেত্রে একেবারেই বেমানান। তবে প্রকৃত যোদ্ধারাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রেমিক- যার প্রমাণ পৃথিবীর মহাকাব্যে বিদ্যমান। তবে একথাও সত্য যে, তীক্ষ্ণতা যত সহজে মানব মনে সাড়া জাগায়; স্নিগ্ধতা মানবমনে সে ভাব জাগাতে সময় নেয় অনেক। ফলে নজরুল কাব্যে বিপ্লব-বিদ্রোহাত্মক রূপ যত সহজে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে, তত সহজে প্রেমের লাবণ্য-মাধূর্য বিস্তার করেনি। তবে সময়ের বিবর্তনে নজরুল আজ আমাদের প্রেমের কবি, প্রেমিক কবি, সাম্যের কবি, দারিদ্র্যের কবি, জাতীয় কবি হলেও- খণ্ডিত আকারে তিনি বিদ্রোহের কবিও বটে।

মানব-মানবীর হৃদয়ের গভীরতম অনুভূতিই প্রেম। নর-নারীর পরস্পর আকর্ষণও প্রেম। প্রেমের মধ্য দিয়ে জীবনের গভীরতম অনুভূতি প্রকাশ পায়। প্রেম কখনো একা চলে না। সঙ্গে নিয়ে চলে দুঃখ-বিরহ-বেদনা। নজরুলের সৃষ্টিজীবনে এর ব্যতিক্রম দেখা যায়না। কবি-শিল্পী-সাহিত্যিকের শিল্প উপকরণের প্রধান কাঁচামাল প্রেম। সৃষ্টিশীল কর্মপ্রেরণার যোগানদাতাও প্রেম। নজররুল কাব্যে প্রেমের কমতি নেই। নজরুলের কবিমানসের বিরাট এক অংশ জুড়ে রয়েছে ব্যক্তিপ্রেম। তাঁর সৃষ্টির প্রধান কাঁচামালও মানবীয় প্রেম: যা ব্যবহার করে তিনি রচনা করেছেন তাঁর অমর কাব্য।

নজরুলের ‘দুর্গমগিরি কান্তার মরু’ ‘চল চল চল’ অথবা ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ কবিতা পাঠে কাপুরুষের রক্তেও আগুন ধরে যায়। আবার তাঁর ‘সমর্পণ বিজয়িনী’, ‘কবি-রানি,’ ‘নিশিতপ্রতিম,’ ‘আল্তা-স্মৃতি,’ ‘পূজারিণী,’ ‘চৈতিহাওয়া,’ প্রভৃতি কবিতার চরণ বীর যোদ্ধার হৃদয়ও বিরহ-বেদনায় ব্যথাতুর হয়ে ওঠে; হৃদয়বীণার তারে বেজে ওঠে প্রেমের ঝংকার।

শিল্পী-কবি-সাহিত্যিকের ললাটে খ্যাতির লেবেল এঁটে দেয়া আমাদের সুপ্রাচীন প্রথা। ‘বিদ্রোহী’ কবিতা (ডিসেম্বর ১৯২১) সিলমোহর ব্যবহার করে কাজী নজরুল ইসলাম হয়েছেন ‘বিদ্রোহী কবি’। কিন্তু একবারও কি আমরা ভেবে দেখেছি- বিদ্রোহ নজরুলের মূল সুর নয়। কবির প্রেমের কবিতার আবেগ-অবেদনে বিদ্রোহী কবিতার চেয়ে অনেক বেশি নৈপুণ্যেতার পরিচয় বহন করে। তাঁর ‘বিদ্রোহী’ কবিতার প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে বুঝা যাবে- ‘বিদ্রেহী’ কবিতায় যতই বিদ্রোহের সুর বাজিয়ে তোলার চেষ্টা করা হোক না কেন; শেষ পর্যন্ত সেখানে বিরহী-মর্মবেদনার সুরই প্রধান হয়ে ধরা পড়ে।

তবে, এক বুক তৃষ্ণা নিয়ে ছন্নছাড়া-বাঁধন হারার কবি ঘর বাঁধার যে স্বপ্ন দেখেছিলেন; অপ্রত্যাশিতভাবে কবির সে স্বপ্নবাসর ভেঙে যাওয়ায়- প্রথামবস্থায় কবির বেদনার অগ্নিস্ফুলিঙ্গের প্রকাশ ঘটে বিদ্রোহী কবিতায় নিম্নোক্ত চরণে:
আমি অভিমানী চির-ক্ষুব্ধ হিয়ার কাতরতা, ব্যথা সুনিবিড়,
চিতচুম্বন-চোর কম্পন আমি থর-থর-থর প্রথম পরশ কুমারীর।
(‘অগ্নি-বীণা: বিদ্রোহী)

নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় যে বিদ্রোহ নেই: প্রেমের আহাজারিতে ভরপুর তার জ্জ্বলন্ত প্রমাণও রয়েছে একই কবিতায়। এইভাবে কবির প্রেমাবেগের অমর সৃষ্টি ‘পূজারিণী’ কবিতা। ‘বিজয়িনী’ কবিতায়ও রয়েছে কবির প্রিয়তমাকে ‘জীবনের আশাহত ক্লান্ত-শুষ্ক বিদগ্ধ পুলিনে’ কাছে পাওয়ার কাকুতি-মিনতি। ‘পূজারিণী’ কবিকে ভালোবেসে ঋণী করেছেন। ‘পূজারিণী’ ‘আপনারে দাহ করি মোর বুকে জ্বালায়াছো আলো’- যা কবির অনবদ্য প্রেমের স্বীকারোক্তি।

একইভাবে দিনান্তে বসে দূর-দূরান্তের স্মৃতিচারণ করে কবি ‘পূজারিণী’কে করেছেন পূজা ঋণী। প্রেমিক কবির ব্যক্তিমানসের এহেন উক্তি, কী-করে বিদ্রোহ বাসা বাঁধতে পারে তা নিয়ে ভাবা প্রয়োজন। তবে নজরুল যে প্রেমের কবি এবং বিদ্রোহ যে তাঁর খ- পরিচয়- তার অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে কবির সৃষ্টিসম্ভারে।

নজরুল প্রেমিক কবি, প্রেম-প্রতিমার কবি- যার প্রমাণ মেলে তাঁর ‘বিজয়িনী’ কবিতায়। বিজয়িনী (প্রমীলা) কবির কাঙ্ক্ষিত মানবিক প্রেমের এক জীবন্ত প্রতিমা। এক সময়ের কবির সেই পূজারিণী, বিজয়িনী হয়ে ধরা দেয় তাঁর ‘দোলন-চাঁপা’ কাব্যে। প্রেমাম্পদার প্রেমে আত্মসমর্পণ করে কবি বিজয়ীর উল্লাসে উচ্চারণ করেন:
হে মোর রাণী! তোমার কাছে হারমানি আজ শেষে।
আমার বিজয় কেতন-লুটায় তোমার চরণ-তলে এসে।
‘ছায়ানট’ : বিজয়িনী)

অর্থাৎ এক সময়ের বিজয়ী বীর তার প্রেম-প্রতিমার চরণ তলে নিজকে লুটিয়ে দিয়ে আত্মসমর্পণ করা কী কখনও তাঁর পক্ষে শোভা পায়? একইভাবে ‘অনামিকা’ ‘কবিপ্রিয়া,’ কবির কাছে ধরা দিয়ে কবিকে ‘বিজয়িনী’ করে তোলে। কবি নিজেও তাঁর ‘চপল সারথির’ কাছে নিজকে সমর্পণ করে। তবে ভাগ্যের নির্মম পরিহাস- ‘গোপন প্রিয়া’র ছলাকলা কবির নিকট ধরা পড়ায় ‘গোপন প্রিয়’ ‘ফুলকুমারী’ হয়ে ধরা দিলেও ফল হয় উল্টো; ‘বিজয়িনী’ ‘কবিপ্রিয়া’, ‘মানস-বধূ’ কবিকে ‘অভিশাপ’ দিয়ে উচ্চারণ করেন:
যেদিন আমি হারিয়ে যাব, বুঝবে সেদিন বুঝবে!
অস্তপারের সন্ধ্যাতারায় আমার খবর পুছবে-
বুঝবে সেদিন বুঝবে।
(দোলন-চাঁপা : অভিশাপ)

প্রেমিক কবির এ অভিশাপ ক্ষণস্থায়ী হলেও পরক্ষণেই ‘চিরন্তনী-প্রিয়া’, ‘মানস-বধূ’ কবিকে হৃদমাঝারে আমন্ত্রণ জানিয়ে লেখেন:
এস এস এস আমার চির পুরানো।
বুকজুড়ে আজ বসবে এস হৃদয়-জুড়ানো!
আমার চির পুরানো!
(‘ছায়ানট’ : চিরন্তনী-প্রিয়া)

এর পরেও নজরুলকে বিদ্রেহী কবি বলা কতটুকু সমীচীন হবে ভেবে দেখা প্রয়োজন। তবে সময়ের প্রয়োজনে ক্ষণিকের তরে নজরুল ‘বিদ্রোহী বীর খ্যাতির তিলক ধারণ করলেও, তা স্থায়ী হয়নি।

নজরুলের কবিতা খুঁজলে বিদ্রোহাত্মক শব্দের চেয়ে বেশি পাওয়া যাবে প্রেমপ্রতিমার চিত্রকল্প। পাওয়া যাবে ব্যথা-বেদনার আকুতি: ‘মোরা আর জনমের হংসমিথুন ছিলেম’: ‘মোদের দুই জনের জনম জনম ভরে কাঁদতে হবে গো’ ইত্যাদি। তবে বিদ্রোহী কবির এহেনো বিরহ-যাতনার মানোদ্বন্দ্বে ‘নিশিত-প্রিতম’ হতবাক না হয়ে পারেনা। ‘চপলসাথী’র ‘প্রণয়-নিবেদন’-এর পর ‘বিদায়-বেলা’য়, ‘কবি-প্রিয়া’কে কবি ‘বিরহ-কাতর’ হয়ে অনুরোধ জানান; ‘আজও তবে হেসে যাও, আজ বিদায়ের দিনে কেঁদোনা’- যা কবির প্রেমচেতনার বাস্তবার উদাহরণ। ‘দোলন-চাঁপা’, ‘ছায়ানট’, ‘সিন্ধু-হিন্দোল’ কাব্যে প্রেমিক কবি তাঁর কাব্যমানসীকে কাছে পেয়েও বার বার হারিয়েছেন। তবে বার বার কবি তাকে আবিষ্কারের প্রয়াস চালিয়েছেন ‘চক্রবাক’ কাব্যের ‘এ মোর অহঙ্কার’ কবিতায় এভাবে:
‘তোমায় আমি করব সৃজন-এ মোর অহঙ্কার।’
(‘চক্রবাক’ : এ মোর অহঙ্কার)

কবি নজরুল তাঁর হারানো প্রিয়াকে সৃজন করতে গিয়ে ‘তোমাকে পড়িছে মনে’ কবিতাটি লেখেন। একইভাবে কবি তাঁর পেছনে ফেলে আসা স্মৃতির প্রতি ফিরে তাকিয়ে ‘আজি নীপ বালিকার ভীরু শিহরণ’-এর কথা স্মরণ করেন। ‘হিংসাতুর’ প্রিয়াকে কবি প্রশ্ন করেন, ‘হিংসাই শুধু দেখেছ এ চোখে ? দেখ নাই আর কিছু।’ সকল লক্ষণই প্রেমের লক্ষণ। এরপরও কী নজরুল ‘বিদ্রোহী’ কবি; প্রেমের কবি নন?

প্রেয়সীকে ‘আড়াল’ করে কবি অপরাধ করলেন কি-না, অথবা তাকে আঘাত দিলেন কি-না, কিংবা কলঙ্কিত করলেন কি-না: ‘আমি কি এসেছি তব মন্দিরে দস্যু ভাঙ্গিয়া দুয়ার ?’ অথবা ‘আমি কি তোমার চন্দ্রের বুকে কালো কলঙ্ক-ছাপ?’ ইত্যাদি প্রশ্নের জবাবের অপেক্ষায় কবি অধিক আগ্রহে তাকিয়ে ছিলেন কবিপ্রিয়ার মুখপানে। তবে সৌভাগ্য- ‘অভিমানী’ ‘গোপন-প্রিয়া’ ‘মনের মানুষ’ কবিতায় কবিকে বরণ করে নেয়ায়; কবিমনের সকল সন্দেহ, সকল প্রশ্নের অবসান ঘটিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে কবি রূপান্তরিত হয়ে যান প্রেমীক কবি রূপে।
বিপরীতে নজরুল তার ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় আইন অমান্যকারী এক বিদ্রোহী বীর সেজে সদম্ভে উচ্চারণ করেন:
‘খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া
উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ব-বিধাত্রির!’

একই কবিতায় ‘অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল’ কবি, বিদোহী সেজে উচ্চারণ করেন;
‘ …আমি চিরদুর্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস,
মহা-প্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস
আমি মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বির,
আমি দুর্বার,
আমি ভেঙ্গে করি সব চুরমান!
আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল!
আমি দ’লে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃ্খংল!
আমি মানিনা কোনো আইন,…
পুনরায় তিনি একই কবিতায় উচ্চারণ করেণ:
‘…আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান-বুকে এঁকে দেই পদ-চিহ্ন,
আমি স্রষ্টা সূদন, শোক-তাপ-হানা খেয়ালী বিধির বক্ষ করিব ভিন্ন!
আমি চির-বিদোহী বীর’- (বিদ্রোহী)

এত বিদ্রোহ, এত মহা-প্রলয়ের পরও কবি নজরুল কী-করে ‘আলতা-স্মৃতি’তে বিভোর হয়ে পড়েন। ‘পথহারা’ ‘অনাদৃতা’ ‘মানস বধু’র ‘আশা’য় ‘নিশি ভোর হোল জাগিয়া’ অথবা ‘বিদায় বেলা’ ‘প্রিয়ার দেওয়া শরাব’ পান করে বিদ্রোহী কবিহৃদয় ব্যথিত-উদ্বেলিত হয়ে ওঠে! এর পরও কী ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় বিদ্রেহের স্বাদ মেলে? ফলে নিশ্চিত করে বলা যায়- ‘বিদ্রোহী’ নজরুলের চিরন্তন পরিচয় নয়; খণ্ড পরিচয়- প্রেমই চিরন্তন।

সৃষ্টির মৌল প্রেরণা প্রেম; কবিজীবনের মূল উৎসও প্রেম। নজরুল বিদ্রোহের কবি হলেও প্রেমাঙ্গন থেকে কখনও তিনি দূরত্ব বজায় রাখেননি। ফলে বিদ্রোহাত্মক কবিতার চেয়ে তার প্রেমের কবিতার সংখ্যাধিক্য। ভাবের গভীরতায় দিক থেকেও তা অতলাসমুদ্রসম। কবি সে অতল সমুদ্রে ডুব দেয়ায় আমরা কী তাকে বিদ্রোহীর ভূষণে ভূষিত করতে পারি? শুধু তাই নয়- কবির এক হাতে ছিল রণতূর্য; আরেক হাতে ছিল বাঁকা বাঁশের বাঁশি। যা ছিল প্রেম-বিদ্রোহের জ্বলন্ত আর এক প্রতীক। ফলে তাঁকে কেলমাত্র বিদ্রোহের কবি আাখ্যা না দিয়ে প্রেম- বিদ্রোহের কবি বলা ভালো। তবে নজরুলের কবি ভূষণ একমাত্র ‘বিদ্রেহী’ অথবা অথবা প্রেম-বিদ্রেহী না হয়ে; প্রেমিক কবি হওয়া উত্তম।

নজরুল যে প্রেমের কবির তার আর এক উজ্জ্বল প্রমাণ রয়েছে কাজী আব্দুল ওয়াদুদের ‘নজরুল ইসলাম’ প্রবন্ধে এভাবে:
বিদ্রোহী কবিতায় কবি কি বলতে চেয়েছেন এ সম্পর্কে নানা মত শুনতে পাওয়া যায়। কবির প্রায় ২৩ বছরের বিপুল সাহিত্য সাধনার উপরে চোখ বুলিয়ে আমার মনে হয়েছে, ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি প্রকৃতই কোনো বিদ্রোহী-বাণীর বাহক নয়, এর মর্মকথা হচ্ছে এক অপূর্ব উন্মাদনা- এক অভূতপূর্ব আত্মবোধ সেই আত্মবোধের প্রচণ্ডতায় ও ব্যাপকতায় কবি উচ্চকিত প্রায় দিশাহারা।২

‘বিদ্রোহী’ কাবতায় সৈনিক কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর প্রেমিপ্রেয়সীকে আঁকড়ে ধরে ভালোবাসার যে আকুতি-মিনতি জানিয়েছেন, তার আরও জ্বলন্ত প্রমাণ রয়েছে খোদ কবি নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার নিম্নোক্ত উচ্চারণে :
আমি গোপন-প্রিয়ার চকিত চাহনি, ছল ক’রে দেখা অনুখন,
আমি চপল মেয়ের ভালোবাসা, তার কাঁকন-চুড়ির কন্-কন্…
আমি চির-শিশু, চির-কিশোর,
আমি যৌবন-ভীতু পল্লীবালার আঁচল কাঁচলি নিচোর!
(বিদ্রোহী)

‘বিদ্রোহী’ কবিতার উপরোক্ত চরণগুলো শ্রীকৃষ্ণের লীলা চাঞ্চল্যকে স্মরণ করিয়ে দেয়। যে কবিতার কবি এক সময় ‘বল বীর বল উন্নত মম শির,’ বলে রণহুঙ্কার দিয়ে ভগবানের বুকে ‘পদচিহ্ন’ এঁকে দিতে চেয়েছেন। যিনি ‘ইস্রাফিলের হাতের শিঙা,’ ‘মহা প্রলয়ের নটরাজ’সহ ‘আমি ধুর্জটি,’ ‘আমি সৃষ্টি, আমি ধ্বংস বলে হুঙ্কার দিয়েছেন; সেখানে একই কবিতায় কবি কী-করে ‘চপল মেয়ের ভালোবাসা,’ ‘আমি অভিমানী,’ ‘চিত চুম্বন চোর,’ ‘প্রথম পরশ কুমারী,’ ‘গোপন প্রিয়ার চকিত চাহনি,’ ‘যৌবন ভীতু পল্লীবালার আঁচল,’ ‘কাঁচলি নিচোর’-এর মতো প্রেম-ব্যঞ্জনামূলক শব্দো ব্যবহার করে- প্রেমিক মনের গভীরে প্রবেশ করার ইচ্ছা প্রকাশ করতে পারেন! নজরুলের ‘বিদ্রেহী’ কবিতার শব্দব্যবহার নিরিক্ষা করে নির্দ্বিধায় বলা যায়- বিদ্রোহ ছিল নজরুলের খণ্ড পরিচয়; প্রেমই ছিল মূল উপকরণ।

পরিশেষে বলা যায়- নজরুলকাব্যের মূল উৎস ছিল প্রেম এবং সে উৎসের উৎপত্তি ঘটেছিল কবির বাল্যকালে। প্রমাণ স্বরূপ উপস্থাপন করা যায় তাঁর বাল্যেপ্রেমের কবিতা ‘চিঠি’-র প্রেমানুভূতি:
‘বিনু!
তোমায় আমায় ফুল পাতিয়েছিনু,
মনে কি তা পড়ে?
যেদিন সাঁজে নতুন দেখা বোশেখ মাসের ঝড়ে
আম বাগানের একটি গাছের তলায়
দুইটি প্রাণই দুলেছিল হিন্দোলেরই দোলায় ?
তুমি তখন পা দিয়েছ তরুণ কৈশোরে।
(‘নির্ঝর’: চিঠি)
আঠারো বছর বয়সে (১৯১৭) নজরুল স্কুল ছেড়ে সেনাদলে চাকরিতে যোগ দেন। সে বয়সে কবিমানসে প্রেমের ঢেউ জাগা অবাস্তব কিছু নয়। করাচির সেনা ছাউনিতে বসে নজরুলের লেখা প্রথম গল্প ‘বাউন্ডেলের আত্মকাহিনী’তেও (১৯১৮) ছিল নজরুলের ব্যর্থ প্রেমের বাস্তব উচ্ছ্বাস। ‘ব্যথার-দান’ গল্পগ্রন্থও (১৯২০) এ থেকে বাদ পড়েনি। এ গ্রন্থের উৎসর্গ পত্রে কাবিমানসী যে কবির অতি নিকটন্থ প্রেমিকা, তার প্রমাণ রয়েছে কবির নিজের উচ্চারণ :
মানসী আমার
মাথার কাঁটা দিয়াছিলুম বলে
ক্ষমা করোনি
তাই বুকের কাঁটা দিয়ে
প্রায়শ্চিত্ত করলুম।

মানসীর নিকট নজরুলের এ করুণ মিনতি প্রমাণ করে কবি কৈশোর জীবন থেকেই প্রেমের সিঁড়ি ভাঙতে শুরু করেছিলেন। কৈশোরের বিদ্রোহসত্তার পূর্বেই তাঁর প্রেমেরসত্তার জন্ম হয়েছিল- যা কবিকে বিদ্রেহীর পূর্বে প্রেমিক কবিতে রূপান্তরিত করতে সাহায্য করেছিল।

নজরুলের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অগ্নিবীণা’র (১৯২২) মূল সুরও ছিল বিদ্রোহ। তবে কবির কারাবাসের সুযোগে তাঁর ‘মানস প্রিয়া’ কবিকে অগ্রাহ্য করে অন্যের অঙ্কলক্ষ্মী হতে যাচ্ছেন- এ হৃদয় বিদারক লীলার বর্ণনা রয়েছে কবির দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘দোলন-চাঁপা’র (১৯৩০) বিভিন্ন দৃশ্যকল্পে। এ কাব্যেও কবির বিদ্রোহী চেতনার চেয়ে প্রেমচেতনার প্রকাশ বেশি।
এক সময় নজরুল নিজেকে ব্যর্থ-প্রণয়ী কীট্-এর সঙ্গে তুলনা করে লিখেছেন:
‘আচ্ছা আমার রক্তে শেলী, কীটসকে এত করে অনুভব করছি কেন বলতে পার?’৩

এ উক্তিতে সৈনিক কবি কাজী নজরুল ইসলামের যৌবন যে প্রেম-সংঘাতে ভরপুর ছিল তার আভাস মেলে।

প্রেমকে বলা যায় পঙ্কজ। প্রেম দেহগত ও দেহনির্ভর। দেহকে অতিক্রম করে প্রেমের যাত্রা উর্ধ্বগ। প্রেমে যেমনি রয়েছে স্বর্গসুষমা; তেমনি রয়েছে নরকের পূঁতগন্ধ। প্রেম-সাগরে ডুব দিলে মিলনের সুনিবিড় আনন্দের সঙ্গে বিরহের সুকঠোর জ্বালা। প্রেমে রয়েছে পুলক-মাধুর্য; রয়েছে দ্বন্দ্ব-সংশয়-যাতনা- যা আধুনিক যুদ্ধের ভয়াবহতার চেয়েও অনেক বেশি ভয়াবহ। নজরুল এর বাইরে কখনও ছিলেন না।

ব্যক্তিজীবনে কাজী নজরুল ইসলাম যেমনি ছিলেন; কাব্যজীবনেও তিনি ঠিক তেমনি ছিলেন। ব্যক্তিপ্রেমই ছিল তাঁর সৃষ্টির মূল উৎস। প্রেমের অশ্রুকোমল রূপ ছিল তাঁর আকর্ষণের মূল বস্তু। প্রেমালাভের জন্য ছিল তাঁর প্রচণ্ড বিদ্রোহ- যার পটভূমিতে রচিত হয়েছে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা। সুতরাং পুনরায় বলা যায়, কাজী নজরুল ইসলাম কখনই ষোলআনা বিদ্রোহী কবি ছিলেন না। ছিলেন প্রেমের কবি, প্রেমিক কবি; প্রেম-বিদ্রোহের কবি। ‘বিদ্রোহী’ ছিল তাঁর খণ্ড পরিচয়: প্রেম ছিল তার চিরন্তন সঙ্গী।

তথ্যনির্দেশ
১. আজহারউদ্দীন খান;‘বাংলা সাহিত্যে নজরুল’; ডি. এম. লাইব্রেরি, কলকাতা, ৪র্থ সংস্করণ ১৩৬৯, পৃষ্ঠা ২২১।
২. ড. সুশীল কুমার গুপ্ত, ‘নজরুল-মানস’; দে’জ পাবলিশিং, ভারতী সংস্করণ ১৩৭০, পৃষ্ঠা ১২৫।
৩. আবদুল কাদির সম্পাদিত ‘নজরুল রচনাসম্ভার’; পাইওনিয়ার পাবলিশার্স, ঢাকা ১৩৭৬, পৃষ্ঠা ১৯৬।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
চিত্রকর, লেখক ও গবেষক।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!