আলো অন্ধকারে যাই (পর্ব ১১)

গৌতম রায়
গৌতম রায়
9 মিনিটে পড়ুন
ছবি প্রতীকী

আমাদের ইংরেজি ভাষা শিক্ষা

ভাষা শিক্ষা সকল দেশেই শিক্ষার্থীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আর সকল দেশেই বোধ করি মাতৃভাষার বাইরে শিক্ষার্থীদের এক বা একাধিক বিদেশি ভাষা শেখার প্রয়োজন হয়। ঐতিহ্যগতভাবেই আমাদের দেশে শিক্ষার্থীরা ইংরেজি ভাষা শেখে মাতৃভাষার পাশাপাশি।

আমরা ভাষা শিখি কেন? নিশ্চয় অন্যের সাথে যোগাযোগের জন্য। আমরা যদিও শুধু মৌখিক ভাষা দিয়েই যোগাযোগ করি না – ইশারা, শরীরী ভাষা, চিত্র, সাইন/সংকেত এসবের মাঝ দিয়েও যোগাযোগ করি। কিন্তু মৌখিক ভাষা অবশ্যই যোগাযোগের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। তবে যেভাবেই যোগাযোগ করি না কেন, ভাষা ও যোগাযোগ একে অন্যের সাথে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত।  দেখা যাক, আমাদের সময়ে আমরা (সত্তর ও আশির দশকে) ভাষা কীভাবে শিখেছি, আর সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত ভাষা শিক্ষায় আমাদের অগ্রগতি হয়েছে কতটা। 

প্রাথমিকে আমাদের ভাষা শিক্ষা বলতে অক্ষর চেনা, নিজের নাম-পরিচয় লিখতে পারা, পাঠ্যপুস্তকের লিখিত অংশটুকু পড়তে পারা বা ইনফরমেশন রিকল করা আর কিছু শব্দের বাংলা অর্থ বলতে পারার মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিছু গ্রামার আইটেম যেমন parts of speech কাকে বলে, কত প্রকার ও কী কী, sentence কাকে বলে, vowel কাকে বলে, consonant কাকে বলে এসবের সংজ্ঞা লিখতে হতো বাংলাতে কিন্তু উদাহরণ লিখতে হতো ইংরেজিতে।

ষষ্ঠ শ্রেণিতে এসে আমাদের উদাহরণসহ noun এর শ্রেণি বিভাগ শেখানো হয়। পরীক্ষাতে টেস্ট আইটেম হিসেবে কয়েকটি noun দিয়ে বলা হতো এর কোনটি কোন ধরনের সেটি যেন আমরা পাশে লিখে দেই। সেই সাথে subject কাকে বলে, predicate কাকে বলে এবং অতি অবশ্যই tense বা কাল শেখানোর চেষ্টা করা হতো।   

সপ্তম শ্রেণিতে এসে আমাদের parts of speech এর উদাহরণ শেখানো হয়। এই শ্রেণিতে ইংরেজিতে পত্র লিখনও ছিল, ছিল প্যারাগ্রাফ লিখন। অষ্টম শ্রেণিতে এসে voice change, এবং নবম-দশম শ্রেণিতে narration ও ইংরেজি রচনা শিখতে হয়।

যতটা মনে করতে পারি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত আমরা ইংরেজি শিখতাম tense এর সনাতনী conjugation দিয়ে –

I go                    You go

You go              You go

He goes            They go

এর পরেই, I do, I come, I eat, I play, I sleep ইত্যাদি।   

মুখস্থ করেই ভালো ছেলেরা নম্বর পেতে থাকলো। আর তাদের অনুসরণ করে ক’দিন পরে আমরাও। এই প্রক্রিয়া থেকে কোনো শিক্ষককেই সেই সময় ব্যতিক্রম দেখিনি। আমাদের বিদ্যালয়ে অনেকেই ইংরেজি পড়িয়েছেন। পঞ্চম শ্রেণিতে আব্দুর রউফ স্যার, ষষ্ঠ শ্রেণিতে সম্ভবত আব্দুস সামাদ স্যার ও আব্দুস শদীদ স্যার, সপ্তম শ্রেণিতে বিষ্ণু পদ স্যার, অষ্টম শ্রেণিতে আলী আহমেদ স্যার, নবম শ্রেণিতে নগেন্দ্র নাথ স্যার, দশম শ্রেণিতে আব্দুল মালেক স্যার। কিন্তু এই একটি জায়গায় মোটামুটি সকলেই একই ফর্মুলা ব্যবহার করেছেন। 

কোনো সন্দেহ নেই, আমার সম্মানিত শিক্ষকদের প্রত্যেকেই গ্রামারটা বুঝতেন। কিন্তু tense শেখাতে তারা ঘর্মাক্ত হয়েছেন প্রত্যেকেই – সে বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে হোক বা বাড়িতে প্রাইভেট পড়ানোর প্রাক্কালে। আর tense শেখাতে সকলেই কিছু কমন ফর্মুলা ও উদাহরণ ব্যবহার করেছেন। present indefinite tense শেখাতে সকলেই – আমি ভাত খাই এর উদাহরণ দিয়ে সেটিকে ইংরেজি করে (I eat rice) tense শেখাতে চেষ্টা করেছেন। ধীরে ধীরে আমি স্কুলে যাই / I go to school, বা আমি বাজারে যাই / I go to market, বা আমি বাড়ি যাই / I go home.   

লক্ষ করুন, এই বাক্যগুলির প্রতিটি তিন শব্দের এবং এগুলি subject, verb, object ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে। তবে I go home তিন শব্দের হলেও এখানে subject, verb, object এই ফর্মুলাটি প্রযোজ্য নয়। এখানে subject, intransitive verb, adverbial আছে। The earth moves round the sun – এই বাক্যেও তাই। আমাদের দৈনন্দিন কথোপকথনে আমরা সকল সময় এই subject, verb, object এর গঠনপ্রণালি অনুসরণ করে কথা বলি না। বলা সম্ভবও না। তবুও এমন একটি ধারণা দেয়া হয়েছে যে এভাবেই সকল বাক্য গঠন করা সম্ভব।   

এই বাক্যগুলি বেশ হাস্যকরও বটে। বাড়ি, স্কুল বা মার্কেট ছাড়া কি অন্য কোথাও যাবার নেই? আমি স্কুলে যাই – এটি পূর্ণাঙ্গ বাক্য কি? এটি কি চিরসত্য? আমি স্কুলে বা মার্কেটে কবে যাই আর কবে যাইনা সেটিও শেখানো হয়নি। সেটি শেখালে তবুও real life বা বাস্তব জীবনের সাথে একটা সম্পর্ক থাকতো। আমাদের শেখানো যেত I go to school except Fridays.  I go to school at 8 in the morning during the week days. I do not go to school on Fridays and Saturdays.  শেখানো যেত – I eat rice twice a day or three times a day. শেখানো যেত আমি সকালে কী খাই, দুপুরে কী খাই বা রাতে কী খাই সেটি বলানো কিন্তু সেটি করা হয়নি। আর এর খেসারত আজ দিতে হচ্ছে। আমাদের এখনকার যারা শিক্ষক, এমনকি তাঁদেরকেও present simple tense এর উদাহরণ দিতে বললেই তাঁদের বেশিরভাগই যে উদাহরণ দেন তার একটির সাথেও জীবনের কোনো সম্পর্ক নেই; এই উদাহরণ তৃতীয় বা পঞ্চম শ্রেণির একজন ছাত্রও দেয়। উদাহরণগুলো এরকম – I eat rice/ I play football/ I like mango/ I go to school/ I go home/ I love my mother/The earth moves round the sun. যখন একজন পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র ও একজন এমএ পাশ করা শিক্ষকের ভাষা বিষয়ক উদাহরণ একই হয়, তখন বুঝতে পারিনা language development-টি কোথায় হলো। 

আমাদের সময়ের সেই I do/We do এর এই ফর্মুলা এখনো চলছে সমানে। নেই শুধু এর ভিতরে আমাদের জীবন, জীবনের অভ্যাস, জীবনের গল্প। তোতাপাখির মতো I do বলার পরে সে কি করে সেটি শিক্ষার্থী বলতে ঘেমে নেয়ে যায়। শ্রেণিকক্ষে এমনভাবে শেখানো হয় যে বাংলাদেশের সবাই শুধু ভাত খায়, স্কুলে যায়, কখনো মার্কেটে যায়, সবাই শুধু ফুটবল খেলে, সবাই শুধু আম, কলা, আপেল বা কমলা খায়, অন্য কিছু নয়। শিক্ষার্থী বলতে পারে না – I don’t play anything. অথবা বলতে পারেনা – I like singara/ pineapple/ melon. অথবা I love my family.  অথচ এদেশের সব থেকে জনপ্রিয় স্ন্যাক সম্ভবত সিঙ্গারা। বাজারে এতো আনারস আর তরমুজ অথচ আমাদের ছেলেমেয়েরা সেগুলির কথা বলে না। ইংরেজি বাক্য গঠন করতে গিয়ে এদেশে নারী, পুরুষ, আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সকলেই শুধু ফুটবল খেলে; এমনকি যে কোনোদিন একবারের জন্যও ফুটবলে লাথি দেয়নি – সেও।    

এই যে, এখন কোভিডকালীন অনলাইন ক্লাসের ভিড়, সেখানেও সেই transformation of sentences, types of tense, I do/we do, voice change, বা জীবনের সাথে সম্পর্কহীন অন্য কোন গ্রামার আইটেম পড়ানোর/শেখানোর আয়োজন। কিন্তু ভাষা? প্রায় সকলেই মনে করছেন গ্রামার মানেই ভাষা। কেউ ভাবছেন না, গ্রামার ভাষার একটি অনুষঙ্গ; একমাত্র নয়। বাচ্চাদের ভাষাটা তো শেখাতে হবে!

সব থেকে বেশি সমস্যা হচ্ছে বছরের পর বছর এই ফর্মুলা শিখে শিক্ষার্থীরা নিজেদের জীবনে সত্যিকার প্রয়োজনে এর বাইরে কোনো বাক্য চিন্তা করতে পারে না, তৈরি করতে পারে না। তখন চলে আসে তোতলামি, বাক্য শেষ করতে না পারা, বা লজ্জা। 

এই বিপদ থেকে মুক্তির প্রয়োজনেই Communicative Language Teaching (CLT) বাংলাদেশে প্রবর্তন করা হয়েছিল। CLT-এর মূল লক্ষ্যই ছিল শিক্ষার্থীকে communication-এ দক্ষ করে তোলা।  শুরুতে fluency-এর উপর জোর দিয়ে আস্তে আস্তে accuracy এর দিকে নিয়ে যাওয়া। গত ২৬টি বছর বাংলাদেশে CLT কাগজে-কলমে চলমান থাকলেও পরিস্থিতির খুব একটা পরিবর্তন বিশেষ হয়নি। আজও শ্রেণিকক্ষে discrete grammar চর্চার পরিবর্তে শিক্ষার্থীকে নিজের জীবনের কথা বলানোর আয়োজনের সাথে যুক্ত হতে পারেননি আমাদের সম্মানিত শিক্ষকেরা।      

তাই আজ থেকে কয়েক দশক আগেও যেমনটি ছিল ইংরেজি ভাষার চর্চা এখনো তেমনই রয়ে গিয়েছে বা কোনো কোনো স্থানে হয়তো পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে। আমার কাছে কারণগুলি এরকম –

  • শ্রদ্বেয় নগেন স্যার, মালেক স্যারদের মতো subject competent শিক্ষকের ভয়াবহ স্বল্পতা এখন আমাদের দেশে। নগেন স্যার বা মালেক স্যার তো ইংরেজিটা খুব ভালো করে জানতেন, grammar-টা জানতেন নিঁখুতভাবে; হয়তো পেডাগজির ধারণার জায়গাটিতে তাঁদের আরও যুগোপযোগী হবার প্রয়োজন ছিলো। এখন তো সারা বছর ধরে শিক্ষক প্রশিক্ষণ লেগেই আছে কিন্তু কাঙ্খিত ফল অনার্জিতই থেকে যাচ্ছে। 
  • কারিকুলামের একটি ভালো দলিল, অথবা পেডাগজির প্রশিক্ষণ দিয়ে খুব একটা এগোনো যায় না যদি শিক্ষকের নিজস্ব গুণাবলির মাঝে subject competency ও সৃজনশীলতার অভাব থাকে। 
  • কারিকুলাম বা পাঠ্যপুস্তক যত ভালোই হোক না কেন শ্রেণিকক্ষে যদি সেগুলি ঠিকমতো অনুসরণ করা না হয়, শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক যদি ফসিলাইজড ধারণা বা ক্লিশে (cliché) থেকে বের হতে না পারেন, তাহলে বছরের পর বছর আমাদের শিক্ষার্থীদের ইংরেজি শিক্ষা Aim in Life, A Winter Morning জাতীয় কম্পোজিশন আর application for leave, full-free scholarship ঘরানার application লেখার মাঝেই আটকে থাকবে; সে আমরা নামজাদা কোনো বিদ্যালয়েই পড়ি বা চূড়ান্ত কোনো অজ-পাড়াগাঁয়ে।

শহুরে মধ্যবিত্তের ছেলেমেয়েরা এখন যেটুকু ইংরেজি শিখছে সেখানে বিদ্যালয়ের ভূমিকা কতটা আর কতটা YouTube বা Google এর, সেটি নিয়ে গবেষণা হলে হয়তো আমাদের লজ্জাই পেতে হবে।

(চলবে)

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
লেখক: গৌতম রায়
গৌতম রায় ইংরেজির অধ্যাপক। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজীতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেবার পর বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বেশ তরুণ বয়সেই শিক্ষকতা পেশায় যোগ দেন। পড়িয়েছেন দেশে ও দেশের বাইরে বিভিন্ন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে। শিক্ষার প্রতি ভালোবাসা থেকেই পরবর্তীতে ছাত্র হয়েছেন ইংল্যান্ডের এক্সিটার ইউনিভার্সিটির।‌ যুক্তরাষ্ট্রের অরেগন ইউনিভার্সিটি, ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটি ও ওয়ার্ল্ড লার্নিং থেকে নিয়েছেন পেশাগত প্রশিক্ষণ। এখন কারিকুলাম বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করছেন বাংলাদেশের জাতীয় ‌শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে। শিক্ষা বিষয়ক বর্ণিল কাজে নিজেকে ‌সম্পৃক্ত রাখার জন্যই বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যাবস্থাকে তিনি দেখেছেন খুব কাছে থেকে। শিক্ষা ক্ষেত্রে গৌতম রায়ের পছন্দের আঙ্গিনা শিক্ষকের অনিঃশেষ পেশাগত দক্ষতা, ইন্টারেক্টিভ মেটিরিয়ালস ডিভ্যালপমেন্ট, ও লার্নিং এসেসমেন্ট।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!