সমুদ্র দর্শনে আরও একবার (পর্ব ৭)

কামরুল হাসান
কামরুল হাসান
7 মিনিটে পড়ুন
ঘটিভাঙা ব্রিজ

ভাগ্যিস একটা সমুদ্র আছে আমাদের, তার নাম বাংলার নামেই, বঙ্গোপসাগর, নইলে চারপাশে ভূমিবেষ্টিত (landlocked) দেশগুলোর মতো হাঁসফাঁস করতে হতো একটুকরো সমুদ্রের আশায়। যেমন নেপাল, হিমালয় পেয়ে ধনী, কিন্তু তার চারপাশেই তো ভূমি। ২০১৫ সালে গিয়েছিলাম মোঘলদের দেশ উজবেকিস্তান। সেটিও ভূমিবেষ্টিত। হিমালয় থেকে উৎপন্ন নদীদের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি, যেমন গঙ্গা ও ব্রক্ষ্মপুত্র, অজস্র শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে বাংলাদেশকে করে তুলেছে শত নদীর দেশ। সকল নদ ও নদী গড়িয়ে নামে সাগরে। আমাদের হিমালয় নেই, বঙ্গোপসাগর রয়েছে। পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত এই বাংলাদেশে, ভাবা যায়? কী এক দুর্বার আকর্ষণে আমরা সমুদ্র দর্শনে ছুটে যাই। ফিরে আসি নিসর্গহীন এক নগরে, কিন্তু ভেতরে কাজ করে পুনর্বার সমুদ্র দর্শনে যাবার আকাঙ্ক্ষা।

ঘটিভাংগা জেলে গ্রাম সমুদ্র দর্শনে আরও একবার (পর্ব ৭)
ঘটিভাঙা জেলে গ্রাম

টমটম এসে থেমেছে ঘটিভাঙ্গা নামক বাজারে। কোনো কালে কোনো নাবিক এখানে তার জলপাত্র (ঘটি) ভেঙ্গেছিল কি না জানি না, তবে এখানে আসার ইউনিয়ন বোর্ডের রাস্তাটি বেশ ভাঙ্গা। যেকোনো ছোট্ট গ্রাম্য বাজারের মতোই কয়েকটি ভাঙাচোরা দোকানের সমাবেশ, তাতে আশেপাশের মানুষের বৈকালিক সময়ক্ষেপণ, সোনাদিয়ার যাত্রীদের ক্ষণিক বিরতি, চা-পান। বাজার ও সড়ক ছেড়ে মাটির ঢালুতে নামতেই মনে হলো ‘জেলের ছেলে’ উপন্যাসের এক জেলে গ্রামে এসে পড়েছি। মাটিতে আসন পেতে তিনজন জেলে গোঁয়ার মাছেরা ঢুঁ মেরে জালে যেসব ছিদ্র করেছে সেসব সেলাই করছে। একজন জেলে-বৌও রয়েছে দলটিতে। পশ্চিম পার্শ্বে কয়েকজন নৌকা নির্মাণের কারিগর একটি নতুন ট্রলার তৈরি করছে। এর বিপরীতে স্কুল বাড়ির মতো একতলা লম্বা টিনের ঘরের সমুখে উঁচু ও সমান, যেন একটানা বারান্দা, বসে বারোজন মানুষ প্লাস্টিকের গামলা থেকে চিংড়ির পোনা বাছাই করছে। সবগুলো গামলার রঙ উজ্জ্বল লাল। এর কারণ, অনুমান করি, ওই রঙের বৈপরীত্যে চিংড়ির প্রায় অদৃশ্য পোনাগুলো দেখা যায়। চারটি শিশু, জেলেদের সন্তান, মাটিতে দাগ কেটে কী যেন খেলছে। আমি কৌতুহলী হতেই আড়ষ্ট হয়ে গেল। সমুখেই একটি খাল, এর নাম বড়োধার খাল, তাতে ভাসমান অনেকগুলো ট্রলার, কয়েকটি মাত্র ডাঙায়, বাকিগুলো পানিতেই। এই জেলে গ্রামকে দরিদ্র মনে হতে পারে, কিন্তু যখন আপনি ট্রলারগুলোর দিকে তাকাবেন, তখন মনে হবে একটি ধনী এলাকায় এসে পৌঁছেছেন। অর্ধ কোটি থেকে কোটি ছাড়ানো দাম একেকটির। তিনজন জেলে দুজনের হাতে দুটি এলুমিনিয়ামের পাতিল, অন্যজনের কাঁধে বেতের দুই ঝুড়ি একটি বাঁশের আড়ার দুপাশে ঝুলছে। এগুলো যে মাছভরা বুঝতে বেগ পেতে হয় না, ওই এলুমিনিয়াম পাতিলগুলোও মৎস্যভরা। আমার এই মৎস্যমায়া জড়ানো জেলে গ্রামটিকে ভালো লেগে গেল, যদিও জানি তা দুধের স্বাদ ঘোলেই মেটানো।

জেলেদের চিংড়ি পোনা বাছাই সমুদ্র দর্শনে আরও একবার (পর্ব ৭)
জেলেদের চিংড়ি পোনা বাছাই

আমাদের অগ্রসর দলটির দেখা পাই। আমাদের অপেক্ষায় তাদের বেলা চারটা-পাঁচটা হয়েছে। তবে তারা নয়, আমার মনোযোগ কেড়ে নেয় বড়োধার খালের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে যাওয়া সিমেন্টের সেতুটি। মোটা গোল পিলারসারি চোখ ও ক্যামেরার জন্য একটি সিমেট্রি (Symmetry) তৈরি করেছে। অদ্ভুত ব্যাপার হলো, এ প্রান্তে সেতুতে ওঠার কোন সড়ক নেই, ভূমি শুয়ে আছে নিচে, সেতু উঠে আছে অনেকটা উঁচুতে, সেতু যেন কুলিন ব্রাহ্মণ, তার পায়ের কাছে সাঙ্গাষ্ট প্রণাম করে আছে রাস্তা। কী করে হলো? আমার মনে পড়লো ময়মনসিংহের বিরিশিরি যাওয়ার পথে এমনি দুপাশে সংযোগ সড়কহীন সেতু দেখেছি। মনে হয়েছে সেতুর দুপাশ কেউ শক্ত ইরেজার দিয়ে মুছে দিয়েছে বা এক অতিকায় কাচি দিয়ে কেটে দিয়েছে দুই ডানা। সেতু দেখে শান্তি পাবেন কিন্তু দ্রুতই অনুধাবন করবেন ওটা একটি শো-পীস ছাড়া আর কিছু নয়। কারণ না পারবেন উঠতে, না পারবেন নামতে। এ সেতুটির অন্যপ্রান্তের কী চেহারা আমি জানি না, তবে বিরিশিরির সেতুগুলোর মতোই হওয়ার কথা। ডানাকাটা পক্ষী। এ সেতুতে তবু তো একসময় সংযোগ সড়ক ছিল, বিরিশিরির সেতুগুলোর সংযোগ সড়ক নাকি বাজেট বরাদ্দ ছিল না, ছিল কেবল সেতুর। এই অদ্ভুত দর্শন সেতু কোন কন্ট্রাক্টর বানিয়েছেন জানি না, তবে বিরিশিরির সেই বিলাসী তামাশার কন্ট্রাক্টর ছিল বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী। জনশ্রুতি, সেতুর কাজ শেষ না করেই প্রভাব খাটিয়ে বিল তুলে নিয়েছিলেন ‘বঙ্গবীর’।

চ্যানেলে জেলে নৌকা সমুদ্র দর্শনে আরও একবার (পর্ব ৭)
চ্যানেলে জেলে নৌকা

বড়োধার খালের সেতুটির ওই দুর্দশা দেখে আমি কিন্তু খুশি। কারণ ডানাকাটা পরী যদি ডানাওয়ালা পরী হতো তবে টমটম গমগম করে ওর উপর দিয়ে চলে যেত সোনাদিয়া দ্বীপে, টমটমের রমরমা দিন কাটতো, কিন্তু আমাদের নৌ ভ্রমণটি হতো না। দ্বীপ তো জলবেষ্টিত, তার দিকে জলযাত্রাই মানায়, সড়কপথে নয়। তাই ওই যে কবি হাফিজ রশিদ খান চট্টগ্রাম থেকে বাসে করে চকরিয়া এসে আবার সেই সড়ক পথেই বদরখালি সেতু পেরিয়ে মহেশখালী এলেন একে ঠিক দ্বীপযাত্রা বলে না। থাক না সেই সেতুর নিচে কুহেলিয়া নামের কুহক জাগানো নদী, সমুদ্র প্রণালীর স্বাদ তো সে পেল না।

জেলে সম্প্রদায় সমুদ্র দর্শনে আরও একবার (পর্ব ৭)
জেলে সম্প্রদায়

কক্সবাজার থেকে স্পিড বোটে চ্যানেলের প্রশস্ত ও ঢেউ মাতাল বুক পেরিয়ে আমার জল যাত্রাটি ছিল সত্যিকারের দ্বীপযাত্রা। জল সাম্রাজ্য থেকে দারুচিনি বন না দেখলে দ্বীপ ভ্রমণ হয় কী করে? সেতু, খাল ও ট্রলারের পর্যাপ্ত ছবি ক্যামেরাবন্দী করে আমি মানুষের দিকে মনোযোগ ফেরাই। দেখি একটি লালরঙা বডির গান বোট সেতুর পূর্বপাশে যাত্রী বোঝাই হয়ে ‘এই রওয়ানা হয় তো সেই রওয়ানা হয়’ করছে। যাত্রীর ভারে গান বোটটি মাটির কাছে ভিড়তে পারছে না। যাত্রীরা, যেন এটাই সায়গন ছেড়ে আমেরিকান জিআইদের শেষ ফ্লাইট, মিস হলেই ভিয়েতকংয়ের হাতে কচুকাটা, যাত্রীরা উঠছে তো উঠছেই, যাকে বলে টইটম্বুর, আর্কিমিডিসের সূত্রকে কঠিন পরীক্ষায় ফেলে দিচ্ছে। সামাজিক দূরত্ব কথাটি বহুদূরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সাইনবোর্ডে টাঙানো আছে। লোনা হাওয়ায় নাকি করোনা থাকে না, লোনাজল হলো ন্যাচারাল স্যানিটাইজার! গান বোট যাত্রীরা মুখোশ পরার মতো কোনো ঝামেলা করেনি।

গানবোটে চড়ছে স্থানীয় যাত্রীরা সমুদ্র দর্শনে আরও একবার (পর্ব ৭)
গান বোটে চড়ছে স্থানীয় যাত্রীরা

গান বোট চলে গেলে ঘাটে যাত্রী বলতে আমরা ১২ জন। একজন এক্সট্রা নিয়ে ফুল ফুটবল টিম। দলনেতা বলব না মূল আয়োজক বলব, কবি সাইয়্যিদ মঞ্জু অভয় দিল, নৌকা আসিতেছে। এর আগে বলেছিল, জোয়ার আসিতেছে। জোয়ার এসে পদপ্রান্ত ভেজাচ্ছে, নৌকার দেখা নেই। আমরা কিছু দলবদ্ধ ছবি তুলি। আমাদের মুখের উপর বেলা পাঁচটার সূর্য গোধূলির রক্তিমাভা ছড়াচ্ছে, ছবি উঠছে ফটো স্টুডিয়োর মতো উজ্জ্বলতায়। তাকিয়ে দেখি পুরো বনভোজনের প্রস্তুতি; জন্মদিনের কেকের তো এতক্ষণে গলে ভর্তা হয়ে যাওয়ার কথা, পায়ে বাঁধা মুরগীগুলো উল্টো হয়ে ঝুলতে ঝুলতে মানব জাতিকে শাপশাপান্ত করছিল, তাদের মাটির উপর শুইয়ে রেখে কিছুটা শান্তি দেওয়া হচ্ছে, ফাঁসির কাষ্ঠে ঝোলাবার আগে মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত আসামীদের যেভাবে যত্ন করা হয়। আনন্দের ছবি হয়ে আমাদের ইঞ্জিন লাগানো নৌকা এলো। সুদর্শন নয় সে, দরকারও নেই, নিয়ে যেতে পারলেই হবে। আমরা বিভিন্ন প্রকার সার্কাস করে তার ডেকে উঠি। সেতু হিমালয়ে ওঠা স্থানীয় যুবারা সেতুর রেলিঙ ঘেরা প্রান্তে ঝুঁকে এই দৃশ্য কৌতুহলের চোখে দেখে আর কৌতুক অনুভব করে।

সোনাদিয়ার অভিযাত্রী কবি ও শিল্পীগণ 1 সমুদ্র দর্শনে আরও একবার (পর্ব ৭)
সোনাদিয়ার অভিযাত্রী কবি ও শিল্পীগণ

সোনাদিয়া দ্বীপে তাহলে সত্যি যাচ্ছি আমরা! এক ডজন কবি, গায়ক ও শিল্পী, সঙ্গে কিছু মৃত্যুভীত মুরগী।

(চলবে)

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
কামরুল হাসানের জন্ম ২২ ডিসেম্বর, ১৯৬১ সালে বাংলাদেশের শরীয়তপুর জেলায়। তিনি আশির দশকের কবি। প্রথম কাব্য ‘সহস্র কোকিলের গ্রীবা’ প্রকাশিত হয় ১৯৯১ সালে। এরপরে আরও ১১টি কাব্য প্রকাশ করেন। ২০১২ সালে প্রকাশিত হয় ‘নির্বাচিত কবিতা’। কবিতার পাশাপাশি গল্প ও কবিতা বিষয়ক প্রবন্ধ লেখেন এবং বিদেশি সাহিত্য থেকে অনুবাদ করেন। ২০০৫ সালে প্রকাশিত হয় একমাত্র গল্পগ্রন্থ ‘মধ্যবিত্ত বারান্দা ও অন্যান্য গল্প’। ২০১৬ সালে প্রকাশিত হয় প্রবন্ধের বই ‘প্রহরের প্রস্তাবনা’। ভ্রমণপিপাসু এ কবি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সুপ্রচুর ভ্রমণকাহিনী লিখছেন। এপর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে চারটি ভ্রমণকাহিনী। ছাত্রাবস্থায় তার কবিতা সাপ্তাহিক ‘দেশ’ ও ত্রৈমাসিক ‘জিজ্ঞাসা’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তার অনুদিত গ্রন্থের সংখ্যা দুই। ২০০৩ সালে সমীর রায়চৌধুরী ও তুষার গায়েনের সাথে সম্পাদনা করেন দুই বাংলার যৌথ সংকলন Post Modern Bangla Poetry 2003। তিনি বেশ কয়েকবার আমন্ত্রিত কবি হিসেবে দক্ষিণ এশীয় সাহিত্য উৎসবে যোগ দিয়েছেন। কবিতার জন্য পেয়েছেন ‘মৈনাক সন্মাননা স্মারক’ ও ‘কবিকুল, কক্সবাজার কবিতা সম্মাননা‘। ছাত্রজীবনে মেধাবী কামরুল হাসান ভারতের বিখ্যাত আইআইটি খড়গপুর থেকে প্রকৌশলবিদ্যায় স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। পরবর্তী পড়াশোনা ব্যবসায় প্রশাসনে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ থেকে এমবিএ ডিগ্রি অর্জন করেন। পেশাগত জীবনে বহুবার চাকরি বদল করেছেন। করপোরেট জগৎ থেকে শিক্ষকতায় যোগ দেন। গত ১৫ বছর ধরে পড়াচ্ছেন ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সটিতে। তিনি বিবাহিত ও চার সন্তানের জনক। সম্প্রতি তিনি মহেশখালির দক্ষিণে সোনাদিয়া দ্বীপে সেখানকার তরুণ কবিদের আমন্ত্রণে কবি হাফিজ রশিদ খানের জন্মদিন পালনে গিয়েছিলেন। সে ভ্রমণ অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা ‘সমুদ্রদর্শনে আরও একবার’।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!