মূক সৈনিক ফের বাগ্মী

সিদ্ধার্থ সিংহ
সিদ্ধার্থ সিংহ
3 মিনিটে পড়ুন
ছবি: প্রতীকী ও সংগৃহীত।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন উনিশশো চুয়াল্লিশ সালের ডিসেম্বর মাসে গোলাগুলি চলার সময় আচমকা কোথা থেকে যেন একটা‌ গুলি এসে লাগল রাশিয়ার এক সৈনিক আরখিপ মেকসিমেং কোঁ-র মাথায়। গুলিটা লাগতেই তিনি‌ তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।‌ সহযোদ্ধারা তড়িঘড়ি তাঁকে একটি স্ট্রেচারে করে নিয়ে যান শুধুমাত্র আহত সৈনিকদের চিকিৎসার জন্য অস্থায়ী ভাবে তৈরি হওয়া নিকটবর্তী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। ডাক্তারেরা চেকআপ করে বলেন, তিনি বেঁচে আছেন ঠিকই, তবে সংজ্ঞাহীন। কবে জ্ঞান ফিরবে বা আদৌ কোনও দিন ফিরবে কি না এক্ষুনি কিচ্ছু বলা যাচ্ছে না। প্রাথমিক চিকিৎসার পর তাঁকে অস্থায়ী হাসপাতাল থেকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় শহরের এক বড় হাসপাতালে।

যখন জ্ঞান ফিরল, তিনি‌ তখন হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে এবং তাঁর নাকে-মুখে নল গোঁজা। এর মধ্যে‌ই পার হয়ে গেছে বেশ কয়েকটা দিন। জ্ঞান ফিরল ঠিকই, কিন্তু তখন তিনি একেবারে বধির। শুধু ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকেন আর তাঁর চোখ দিয়ে টপটপ করে ঝরে পড়ে জল। মাঝে মাঝে আঁতকে ওঠেন। বহু ডাক্তার-বদ্যি করেও যখন কিছু হল না, তখন অনেকেই ভেবেছিলেন, দেশকে রক্ষা করা গেছে এই সংবাদ শুনলে হয়তো আনন্দে চিৎকার করে উঠবেন তিনি। কিন্তু শুধু রক্ষা করা নয়, শত্রুদেশ নির্মম ভাবে পরাজিত হয়ে তাঁদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে, দখলে এসেছে একটা বড় দ্বীপ, এ‌ সংবাদেও তাঁর কোনও হেলদোল লক্ষ্য করা হল না। তিনি ভ্রূক্ষেপহীন।

এই ভাবে দেখতে দেখতে কেটে গেল দীর্ঘ প্রায় বিয়াল্লিশ বছর‌ দু’মাস।‌ যখন তাঁর সেরে ওঠার আর কোনও সম্ভাবনাই নেই, সবাই হাল ছেড়ে দিয়েছেন, ঠিক তখনই উনিশশো‌ সাতাশি সালের ফেব্রুয়ারি মাসের একদিন গভীর রাতে তিনি হঠাৎ চিৎকার করে উঠলেন। সেই যে তিনি মুখ খুললেন, তার পর থেকে তাঁর মাতৃভাষা ইউক্রেনীয় ভাষায় আগের মতোই অনর্গল কথা বলতে লাগলেন তিনি।‌ তাঁর বাড়ির লোকজন, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীদের সঙ্গে। না, তাঁর কথা বলার যেন আর ‌কোনও বিরাম নেই। খালি বকবক আর বকবক।

কিন্তু দীর্ঘদিন মূক ও বধির হয়ে পড়ে থাকার পরে কী এমন ঘটল যে তিনি আবার বাগ্মী হয়ে উঠলেন?

তিনি নিজেই জানিয়েছেন সে কথা। সে দিন রাতে তিনি এক ভয়ঙ্কর যুদ্ধের স্বপ্ন দেখছিলেন। যুদ্ধের সৈনিক তিনি, তাই তাঁর হাতেও ছিল রাইফেল। দল বেঁধে এগিয়ে যাচ্ছিলেন সামনে। শত্রু শিবিরের দিকে। হঠাৎ কোথা থেকে যেন অনবরত ছুটে আসতে লাগল গোলাগুলি। সঙ্গীদের সতর্ক করে দেওয়ার জন্য তিনি চিৎকার করে উঠলেন। চিৎকার মানে, একেবারে বিকট চিৎকার। গলা ফাটিয়ে। সেই চিৎকার শুধু স্বপ্নে নয়, বাস্তবেও তাঁর গলা থেকে বেরিয়ে এল।‌

আর সেই চিৎকার এতটাই জোরে হল যে, নিজের চিৎকারে নিজেরই ঘুম ভেঙে গেল তাঁর। বিছানা থেকে উঠে খুব স্বাভাবিক ভাবেই আর পাঁচজনের মতোই তিনি শুরু করলেন কথা বলা। ব্যস।
মূক-বধির হয়ে যাওয়া কোনও মানুষের এই ভাবে, বিয়াল্লিশ বছর বাদে ফের বাগ্মী হয়ে ওঠা নজির সম্ভবত এই প্রথম।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
২০২০ সালে 'সাহিত্য সম্রাট' উপাধিতে সম্মানিত এবং ২০১২ সালে 'বঙ্গ শিরোমণি' সম্মানে ভূষিত সিদ্ধার্থ সিংহের জন্ম কলকাতায়। আনন্দবাজার পত্রিকার পশ্চিমবঙ্গ শিশু সাহিত্য সংসদ পুরস্কার, স্বর্ণকলম পুরস্কার, সময়ের শব্দ আন্তরিক কলম, শান্তিরত্ন পুরস্কার, কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত পুরস্কার, কাঞ্চন সাহিত্য পুরস্কার, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা লোক সাহিত্য পুরস্কার, প্রসাদ পুরস্কার, সামসুল হক পুরস্কার, সুচিত্রা ভট্টাচার্য স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার, অণু সাহিত্য পুরস্কার, কাস্তেকবি দিনেশ দাস স্মৃতি পুরস্কার, শিলালিপি সাহিত্য পুরস্কার, চেখ সাহিত্য পুরস্কার, মায়া সেন স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার ছাড়াও ছোট-বড় অজস্র পুরস্কার ও সম্মাননা। পেয়েছেন ১৪০৬ সালের 'শ্রেষ্ঠ কবি' এবং ১৪১৮ সালের 'শ্রেষ্ঠ গল্পকার'-এর শিরোপা সহ অসংখ্য পুরস্কার। এছাড়াও আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত তাঁর 'পঞ্চাশটি গল্প' গ্রন্থটির জন্য তাঁর নাম সম্প্রতি 'সৃজনী ভারত সাহিত্য পুরস্কার' প্রাপক হিসেবে ঘোষিত হয়েছে।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!