কবি আতোয়ার রহমানের ছ’টি কবিতা

আতোয়ার রহমান
আতোয়ার রহমান
8 মিনিটে পড়ুন

এমন কাউকে চেয়েছিলাম

আমার এমন একজন নারীর প্রয়োজন ছিল
যে শিশির পরাগের মতো লেগে থাকবে
আমার চোখ মুখ ঠোঁটের সবুজ মাঠে
যে ধরে রাখবে আমাকে, রাতের আকাশ
যেমন তারাগুলোকে ধরে রাখে।
আমি ভুল মানুষ বেছে নিয়েছিলাম অতীতে।
আমার সত্যিকারের একজন সঠিক বন্ধুর
বড্ড প্রয়োজন ছিল, যার কাছে সহজেই
নিজেকে ময়ূরের পেখমের মত মন খুলে
মেলে ধরতে পারতাম।
আমার এমন কারও প্রয়োজন ছিল
যে সবসময় আমার গদগদ প্রশংসা করবে,
রেডিও টেলিভিশনে মানুষ যেমন সেলিব্রিটিদের
প্রশংসা করে।
আমি ভেবেছিলাম আমার সন্ধান করতে হবে
এমন কাউকে যে বুঝে সম্পর্কটা ড্রাইভথ্রু
বা ফাস্টফুড নয়।
আমি এমন একজনকে খুঁজেছিলাম
যে আমার বকবকানির চেয়ে
আমার নীরবতাকেই বেশি বুঝবে,
আমার শত কোলাহলে ডুবে থেকেও
আমার একাকীত্বের গল্প শুনবে, শুনতে শুনতে
হাসবে, হাসতে হাসতে চোখ মুছবে আঁচলে।
এমন কাউকে আমি খুঁজেছিলাম
যে রেশমের মতো কোমল হাতে আমার
হৃদয়ের বেশবাস খুলে ফেলবে,
কিন্তু আমি ঠান্ডা অনুভব করব না।
আমি এমন একজনকে খুঁজেছিলাম
যে পাগলের মত অপেক্ষা করবে আমার
জন্য কখন ফিরবো, বেশি রাতে ফিরলে
দরজা খুলে জড়িয়ে ধরবে আমাকে,
তৃষ্ণার্ত ঠোঁটের চুম্বনে সিক্ত করবে।
যে এমন ভাবে ভালোবাসবে আমাকে
যেন আমরা দুজন জন্মেছিই দুজনের জন্য,
যেন আর কেঁউ আমাদের হৃদয়ে ঠাঁই
পেতে পারেনা।আমার জন্য যার সদা
অস্থিরতা, যে আমার জন্য নির্ঘুম রাত কাটাবে।

আমি এমন কাউকে চাই যে আমাকে
অবধারিতভাবে ধরে নিবে না,
যে জানে আমি লড়াইয় করে পাওয়ার যোগ্য,
অগ্রাধিকারের তালিকায় আমাকে সবার উপরে রাখবে,
ঐচ্ছিক হিসেবে নিবে না।
এমন কাউকে আমি খুঁজেছিলাম
যে আমাকে পরিবর্তন করার চেষ্টা করবে
না, আমার স্বভাবজাত দোষগুণ জুড়ে
আমাকে মেনে নেবে; আমার শোধরানোর
মানষিকতা নেই জেনেও।

এমন কাউকে আমি চেয়েছিলাম
যে বিকেল বেলা আমার সাথে হাঁটতে বের হবে,
নদীর পাড়ে বসে বাদাম খেতে খেতে
প্রেমের সব কথা আমার কাছে উজাড় করে দিবে,
বিলের ঘাটে দেখবে বেগুনি কলমি ফুলের
উপর বসা সবুজ ফড়িং, ঘরে ফিরবে
দুহাতে নিয়ে গোছা গোছা শিউলি শালুক-শাপলা।

এমন কাউকে আমি চেয়েছিলাম
যে আমাকে বাতাসের স্মৃতি ভুলে দিবে,
বাতাসের পরিবর্তে আমি তাকে শ্বাস নিবো।

ছন্দহীন পতন

প্রতাপশালী নেতাদের পতনগুলি সর্বদা জটিল,
তবে তারা প্রায়শই একটি বিশাল ঘটনা বা
একটি নতুন ধারণার উত্থানের চারদিকে ঘুরত।
যেমন, লিন্ডন জনসন একটি ঘটনার মাধ্যমে
শেষ হয়েছিলেন-ভিয়েতনাম যুদ্ধ, যা কীভাবে
শেষ হবে সে ব্যাপারে তার কোনও ধারণা ছিল না।
একইভাবে, লেবানন যুদ্ধের কারণে মেনাচেম বিগিনের
প্রধানমন্ত্রীত্বের অবসান ঘটেছিল,
যার ঊর্ধ্বগামী হতাহতের ঘটনা সে হজম করতে পারেনি।
এবং ডেভিড ক্যামেরনের প্রধানমন্ত্রীত্ব ব্রেক্সিট গণভোটের
ফলাফল দ্বারা প্ররোচিত হয়েছিল, যার সাথে তিনি
সম্মত হননি এবং যার জন্য তিনি প্রস্তুতি নেননি।
জার নিকোলাইয়ের কেরিয়ারটি একটি উর্ধ্বমুখী
ধারণা দ্বারা সমাহিত হয়েছিল-কমিউনিজম–
যার সম্ভাবনা তিনি অবধারণ করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন।

তেমনি তোমার আমার সংসার-সাম্রাজ্যের পতন হয়েছিল,
শালফুলের মতো ছন্দপতন নয়;
আমরা ধুপ করে পড়ে যাই
ছন্দহীন, সৌন্দর্যহীন, নিস্ব…
দুজনের চোখ জুড়ানো জুটির পথ চলা
থেমে গিয়েছিল, আমাদের অচল সম্পর্ক বাদুড়ের
মতো ঝুলিয়ে থাকতে থাকতে একসময় খসে পড়েছিল,
কারণ সর্বদা তুমি শুধু আমাকেই
ঠিক করতে চেয়েছিলে, কখনো আমাদের সম্পর্কটা
ঠিক করতে চাওনি।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সন্ধ্যা

অদ্ভুত এক কুমিরের পিঠে চড়ে
এক ঘন নিকষ আঁধার নেমে
আসে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে,
পাম গাছগুলো দীর্ঘশ্বাস ফেলছে।
যেন পাথরের উপর কারুকাজ করা
ভয়ার্ত পাতাগুলোর ভেতর দিয়ে
একটি বিবর্ণ সন্ধ্যার ক্যানভাস।

গূমোট গরমে হাঁসফাঁস করে প্রাণ,
থেমে গেছে পাখিদের আনন্দ গান।
ক্রুর কালো দৃষ্টির রুদ্রতেজ দর্শনে
পাখিদের কোলাহল গেছে থেমে
আঁধার জমছে ক্রমে ইতিহাসের ময়দানে।

কালো তারারা ঝলমল করছে,
ডাকছে প্যাঁচা কালো জ্যোৎস্নায়।
কালো পাতারা উড়ে যাচ্ছে,
প্রজাপতি, ঝিঁঝিঁরা নিরুপায়।

ওরা তোমার মধ্যে লাভ-লোকসান খুঁজেছে,
উষ্ণতা, স্নেহগন্ধ খোঁজেনি।
ছুটে চলা ঘোড়ার খুরের
প্রাচীন শব্দ শোনেনি।
মন্ত্রমুগ্ধের ল্যান্ডস্কেপ দেখেছে,
প্রতিবাদের হৃদয়বিদারক সৌন্দর্য দেখেনি।

বাতাস ফুঁপিয়ে কাঁদছে,
বিষন্ন পাখিগুলো কাৎরায়
বৃক্ষ-খেকোর মহা-উল্লাসে
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সন্ধ্যায়।

কথা বলি

পৃথিবীটা কতোদিন মন খুলে কথা বলে না, চলো
আমরা আজ দুজন প্রাণখুলে কথা বলি পৃথিবীর সাথে।
চলো কথা বলি কবুতরের মতো
মুখ খুলে, মন খুলে, জবান খুলে হৃদয় খুলে
আমরা যারা দেশটাতে আছি
এসো আমরা কথা বলি একে অপরের সাথে,
কথা বলি যারা আমাদের শাসন করে
তাদের মাথার উপরে, কথা বলি যে
কেউ আমার সাথে কথা বলতে ইচ্ছুক –
এমনকি আমাদের নিকৃষ্টতম শত্রুর সাথেও
কারণ সংলাপ শান্তির প্রথম পদক্ষেপ।
কথা না বলতে বলতে
কথা না বলতে বলতে
জীভ তার নাচ কবেই ভুলে গিয়েছে।

কচুরিপানার উপর বসে থাকা অন্যমনস্ক সাদা
বকের মতো আমাদের অসাড় নিস্তব্দতা দেখে ওরা
ওদের কৌশলগত প্রতারণাকে শিল্পের পর্যায়ে
নিয়ে গেছে, আমাদের ভিতর থেকে ভাগ করছে,
আমাদের ভেতরের দানবটা।

যারা জনারণ্যের ভেতরেও কৌটায় কথা পুরে রেখে
গোঙ্গাচ্ছে সারা দিন রাত, বাঁচাতে হবে
তাদের আজ, মিছিলের রাস্তা খুলে দাও,
মিটিং এর মাঠ এর গেট খুলে দাও,
মুখের সেলাই খুলে দাও আলো আসতে দাও,
বাতাস আসতে দাও।

নদী বক্ষে ভ্রমণ করেছো কিন্তু নদীর সাথে
কথা বলেছো কখোনো? তার চোখে চোখ রেখে,
চোখের মায়ায় ডুবে, বাদামের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে
কান পেতে শুনেছো খল খল ঢেউয়ের আড়ালে
তার মর্মবেদনা, তার কষ্টের কথা, সুখের কথা?
নদীরও অনেক গোপন কথা আছে,
কথা না বললে নদী রোগা হাড়জিরজিরে হয়।
ছোট ছোট সম্পর্কের ঢেউগুলো উঠেই ভেঙ্গে যায়
জলের ভেতর, অজস্র কণাতে টুকরো টুকরো করে,
স্রোতগুলো তলিয়ে যায় অতলে, যেমন অভাবী
মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ক্রমশ চলে যায় তলানিতে।
আমাদের সংসারো যেন এই ছোটো নদীটার মতোই,
ঢেউগুলো সংসারকে উথালপাথাল করে দেয়।
নদীর পেটের তলায় শুয়ে শুয়ে কান পেতে দিও
একটি ঝিনুকের গায়, মুক্তার মর্মবেদনা শুনতে পাবে।

সাফল্যের ইঁদুরদৌড় সাময়িক বিরতি দিয়ে
উচ্চাকাঙ্ক্ষার পারদের মাঝে প্রাণ ভরে শ্বাস নিতে চলো
জঙ্গলে যাই, গাছের কাছে গিয়ে দাঁড়াই,
বনভূমিতে দাড়িয়ে নৈশব্দের মাঝে শুনতে পাবো গাছেদের কথা,
গাছেরাও ফিসফিস করে, গসিপ করে।
বুনো ফুলের মাতাল গন্ধে গাছপালার মাতৃভাষা আয়ত্ব করে
অনুভূতির কোমল চাদরে গুঁড়িকে জড়িয়ে ওদের সাথে কথা বলি,
কান পেতে শুনি কী আছে গাছেদের অন্তরাত্মায়,
তাদের মুখে শুনি হাসির আড়ালে লুকানো
সহস্র কন্টক বেদনা আর অদৃশ্য দুঃখগাথার কথা।
আসুন নদী গাছ ফুল পাখি মানুষের
সাথে কথা বলি, ডিভাইসের সাথে নয়।

বর্ষা

বর্ষা এলে আমি কবিতা মনস্ক হয়ে যাই,
বৃষ্টিতে ভিজে যায় দিগন্ত, গাছ বন, নদী,
আমন ধানের চারা রোপনে ব্যস্ত সাঁওতাল রমনী।

আকাশের অধর থেকে মেঘের গুরু গুরু গর্জন,
টিনের চালে টাপুর টুপুর শব্দের অনন্য নৃত্যকলায়
বিরহপ্লাবিত মনে বিষাদ উছলায়।
বৃষ্টির জলকণায় আর্দ্র হয়ে ওঠে মনের অলিগলি।
আমার সাদা-কালো জীবনে তোমার এমন অচেনা,
বর্ণময় রূপ ফিরে ফিরে পাওয়ার জন্যই
আজকাল আমি বৃষ্টির প্রতীক্ষায় থাকি।
টিনের চালে বৃষ্টির ঘুংঘুর,
মাতিয়ে তুলেছে নদী খাল পুকুর।
ভাতের হাড়ির মতন উপুড় করা
আকাশ থেকে ঝরে পড়ে রিনিঝিনি
ঘনকালো মেঘের ডাকে ওঠে চরাচর আনন্দে নাচি।

বৃষ্টি এলে আমি ডাহুকের বিষন্ন ডাক শুনতে পাই
আমার গ্রামের বাড়ির সামনের ডাবরি থেকে,
যা আমার শিরাকে প্রশান্ত করে।এমন দিনে আমার
হৃদয়ের কক্ষে গোপনে সংরক্ষণ করা পুরানো ক্ষতটি
ভালো হয়ে যায়, চাঁদ তার অপমান মুছে দেয়
মেঘের রুমাল দিয়ে।

আমার জানালার বাইরে কাঠগোলাপের
গাছ থেকে বৃষ্টির ফোটা ঝরে পড়ে,
যেমন কোন যুবতী বিধবার অশ্রু ঝরে।
পুরানো স্মৃতি পা টিপে টিপে আসে, যখন কেউ দেখে না,
কেউ খেয়াল করে না পায়ের ছাপ।
শূন্যতা অনুভব করে আমার হৃদয়
এই বৃষ্টির সন্ধ্যায়।
আমি বৃষ্টিতে তোমার বুনো চোখ মিস করছি,
মিস করছি আর্দ্র কপাল, আদিম চেহারা
এই সন্ধ্যায় বৃষ্টি এত নিরর্থক,
তুমি কি আবার আমার শহরে বেড়াতে আসতে পার না?

আগের মতই আছে

সব কিছু আগের মতই আছে
কোনকিছুরই পরিবর্তন হয় নাই,
দেয়ালে ঝুলন্ত জয়নুলের তৈলচিত্র,
ফ্যাকাশে চাঁদের দুঃখী ছায়াচিত্র,
এমনকি রাহুগ্রস্ত আকাশের মুমূর্ষু তারকারাজি,
শিমুল গাছে বসা শালিকের মিষ্টি মধুর গৃহস্থালি ঝগড়া
সিনেমা হলে বিরতিহীন প্রেমের পিকচার
কোনকিছুই পরিবর্তিত হয়নি।
শহীদ মিনারে পুস্পাঞ্জলির পাহাড়,
গ্রামের স্কুল শিক্ষকের জং ধরা জানালা,
ভন্ড প্রেমিকের হাতে প্রেমিকার পৈশাচিক হত্যাকান্ড
কাজ হারানো শ্রমিকের সাহায্যের আবেদনে
নিশ্চুপ মালিক,
হাতে ভর দিয়ে হাঁটা পঙ্গু মানুষটিকে মিষ্টির দোকানের
সামনে থেকে ভাগ ভাগ বলে তাড়িয়ে দেয়া,
মানবাধিকার বিষয়ে সংবাদমাধ্যমের
কম্বল চাপা নিরবতা,
বিভাজনের দেয়াল তুলে ভোটের মাছ শিকার,
এমনকি ডিসি অফিসের কোটিপতি পিয়নরাও
আগের মতই আছে, একদম ঠিক ঠাক।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
কবি ও গল্পকার। জন্ম ১৫ জুলাই, রংপুরে। বর্তমানে বসবাস করছেন কানাডার টরন্টো শহরে। ১৯৯১ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন। সাংবাদিকতা ও পরে শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত ছিলেন। ছোটগল্প ও কবিতা লিখছেন দীর্ঘদিন ধরে। গল্পগ্রন্থ “যাপিত জীবন” বিভাস থেকে বেরিয়েছিল ২০১৫ সালে।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!