ঠিকানা বদলে যায়

আহমেদ চঞ্চল
আহমেদ চঞ্চল
16 মিনিটে পড়ুন
আহমেদ চঞ্চল

অনেকদিন পর গ্রামে ভোর হওয়া দেখলাম। এ বাড়িতে শেষ কবে যে সকাল হতে দেখেছি আজ তা মনেও পড়ে না। কোনার ঘর থেকে ছোট দার গলা ভেসে এলো, “মিহির এত ভোরে উঠে কোথায় যাচ্ছিস? এখন দিনকাল ভালো না, অনেকেই এখন আর তোকে চিনতে পারবে না। বেশি দূরে যেন যাসনে।”
: না, দাদা। বড় জোর নদী অব্দি যাবো। আর আমার সাথে আরিফ থাকবে অসুবিধা নেই।
বারান্দা থেকে সিঁড়ি ভেঙে উঠোনে নামছি; সিঁড়ির দূরত্বটা আমার কাছে কেমন যেন কম বলে মনে হলো। বারান্দা থেকে উঠোন অব্দি পথটুকু আমার চিরচেনা, যতদিন পরেই আসি না কেন এ পথের হিসেব-নিকেষ আমার কাছে ভুল হবার নয়। অবারিত মাঠের মত ছড়ানো উঠোনের ঠিক মাঝখানে এসে ব্যাপারটা ধরতে পারলাম। নতুন করে মাটি ফেলে উঠোনটাকে উঁচু করা হয়েছে, ফলে দুটো সিঁড়ি মাটিতে ঢাকা পড়েছে। তুলসী বেদীর নিচের অংশে তাকিয়ে বিষয়টা আরো নিশ্চিত হতে পারলাম। গত বন্যার সময় আমি তখন ওপারে, বদ্দা স্কাইপিতে বলেছিল যে, মাটি ফেলা জরুরি হয়ে পড়েছে।

বাবার আমলের সেগুন কাঠের সদর দরজাটা এখনো আছে; শুধু তার গায়ে নতুন কিছু মেরামতের চিহ্ন বলে দিচ্ছে এ বাড়ির মানুষ নিরাপত্তার ব্যাপারে ইদানিং বেশ সচেতন হয়েছে। দরজার খিল খুলতেই একটা ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দের আশঙ্কা করেছিলাম কিন্তু কোন রকম শব্দ ছাড়াই সদর দরজাটা খুলে গেল। তার মানে দরজার গায়ে নিয়মিত যত্ন-আত্তি পড়ছে। দরজা খুলে বের হতে প্রথমেই বড় একটা ধাক্কা খেলাম। আমাদের বাড়ি ঘেঁষে ঠিক ডান পাশে মাহমুদদের ছোট্ট একটা বাগান ছিল। সেই বাগানে হরেক রকমের ফুল ও ফলের গাছ ছিল। বাগানের ঠিক পশ্চিম কোনায় ছিল একটা বয়সী শেফালি ফুলের গাছ। প্রতিদিন ভোরবেলা পূজার জন্য আমি আর দিপালী পিসি মাহমুদদের বাগানে ফুল কুড়োতে আসতাম। মাহমুদ ছিল আমার খুব ছোটবেলার বন্ধু। একবার মাহমুদ আমার ডালিতে খুব যত্ন করে টগর আর কাঠ মালতি তুলে দিয়েছিল। তারপর বাড়ি ফিরে এসে পিসি বলেছিল, “সব ফুল ফেলে দে মিহির, ওতে মুসলমানের ছোঁয়া পড়েছে।” সেইদিন থেকে বুঝলাম আমার আর মাহমুদের মধ্যে বিশাল একটা বিভেদ আছে। তখন আমাদের আর কতই বা বয়স হবে? সবেমাত্র স্কুলে যাওয়া শুরু করেছি।
মাহমুদদের সেই ছোট্ট বাগানে এখন প্রকান্ড দুটি দালান উঠে গেছে। ইট-সুরকির বড় বড় ইমারত দেখে এতটুকু বোঝার উপায় নেই যে, একদা এখানে নিকুঞ্জ ছিল। সদর রাস্তায় দাঁড়াতেই আরিফের সাথে দেখা হয়ে গেল। বুঝলাম ও সেই আগের মতই পাঙ্কচুয়াল আছে।
: মিহির, তোর চেহারা যে মলিন হয়ে গেছে!
: বয়স তো আর কম হলো না বন্ধু! আচ্ছা, মাহমুদের খবর কী? কোথায় থাকে এখন?
: মাহমুদ এখন ঢাকাতে সেটেল্ড। একটা ছেলে ওর। মাঝে মাঝে বাড়ি আসে তবে দু-এক দিনের বেশি থাকে না।
মাহমুদ ও আরিফ দুজনেই আমার খুব ছোটবেলার বন্ধু। আমরা একসাথে সব খেলাধুলো করতাম, এক সাথে এক নদীর জলে স্নান করতাম আবার এক সাথে দল বেঁধে স্কুলে যেতাম। আরিফ এখন সরকারি প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করে। আরিফের বাবা মারা গেছেন ও যখন খুব ছোট, তারপরই ওর মা বাবার বাড়িতে চলে আসে। সেই থেকে আরিফ নানা বাড়িতে মানুষ হয়েছে। হাঁটতে হাঁটতে কখন যে একেবারে অঞ্জনা নদীর পাড়ে চলে এসেছি বুঝতেই পারিনি। এক সময়ের প্রমত্তা অঞ্জনা নদী এখন অনেকটাই ক্ষীণকায়।
: আরিফ, নদীর ওপারে গ্রামটার নাম যেন কী?
: কৃষ্ণপুর। মনে নেই আমরা সাঁতরে গিয়ে ওপার থেকে আম চুরি করে আনতাম।
: হ্যাঁ, ওপারে তো বিশাল একটা আম বাগান ছিল! বাবলু গাছের মগ ডালে উঠতো আর নিচে ধপ ধপ করে আম ফেলতো। আমরা বালির উপর থেকে আমগুলো কুড়িয়ে গামছাতে বেঁধে আবার দ্রুত সাঁতরে এপারে চলে আসতাম। এপারে এসে আম ভাগাভাগির পর প্রায়ই দেখা যেত বাবলুর ভাগে কোন আম নেই। আমার কথা শেষ না হতেই দেখি আরিফের চোখে জল। যেন অনন্তকালের মত সময় নিয়ে আমরা নীরব হয়ে গেলাম। শিশির ভেজা ঘাসের উপর বসে মাঝ নদীর দিকে স্থির হয়ে রইলাম দুজন। টানাটানির সংসারে হাল ধরবার জন্য ইন্টারমিডিয়েট পাশের পরেই পুলিশের চাকুরিতে ঢুকে পড়েছিল। কীভাবে যেন পোস্টিংটা ও পেয়েছিল পাশের জেলা ঝিনেদায়। সেই সময় ঝিনেদাতে নিষিদ্ধ ঘোষিত নকশাল বাহিনীর প্রচন্ড দাপট ছিল। এক মাঘ মাসের শীতের রাতে টহলরত অবস্থায় নকশাল বাহিনীর অতর্কিত গুলিতে ষ্পটেই মারা যায় আমাদের সব থেকে হাস্যোজ্জ্বল বন্ধু বাবলু। বাবলু যে রাতে মারা যায় সেই রাতে ভীষণ কুয়াশা পড়েছিল। এখনো যেকোন কুয়াশা ভেজা রাতে বাবলুকে আমার ভীষণ মনে পড়ে।

আমি কী উদ্দেশ্য নিয়ে এবার বাংলাদেশে এসেছি তা আরিফকে বলা হয়ে ওঠেনি। বলা হয়ে ওঠেনি মানে ইচ্ছে করেই এড়িয়ে গেছি। শুধু আরিফ নয়, আমার পরিবারের বাইরে আর কেউ-ই এ কথা জানে না। আমি ইন্ডিয়া চলে যাবার পর এদেশে যেমন দু-এক বছর পর পর বেড়াতে আসি। সবাই ভাবছে আমার এবারের আসাটাও বুঝি সেরকম। অঞ্জনা নদীর ঠিক পশ্চিম পাশ দিয়ে একটা একটা চোরা পিচ ঢালা রাস্তা চলে গেছে। এই রাস্তাটা কলেজ মোড় হয়ে একদম আমাদের বাড়ির পেছনের দরজায় গিয়ে মিশেছে। আরিফ প্রস্তাব দিলো,
: চল মিহির, শোভাদের বাড়ির সামনে দিয়ে যাই।
: শোভারা কি আর বাংলাদেশে আসে?
: নাহ। সেই যে ওপারে চলে গেল আর কখনোই আসেনি। শুনেছিলাম, শোভার বাবা লাখনোতে উনার ভাইয়ের বাড়ির পাশে বাড়ি করে ওখানেই সেটেল্ড হয়ে গেছেন।

শোভা দত্ত। কালো কিন্তু অবিকল দেবীর মত দেখতে ছিল। আমাকে পাগলের মত পছন্দ করতো। হয়তো আমিও করতাম। আমাদের থেকে এক ক্লাশ নিচে একই স্কুলে পড়তো। শোভার বাবা ছিলেন গ্রাম্য ডাক্তার। খুব ভালো চিকিৎসা করতেন, রোগীর জিভ আর চোখ দেখেই রোগ ধরে ফেলতেন। সাথে ব্যবহারটাও ছিল বড় অমায়িক। এসব কিছুর গুণে অল্প কদিনেই নাম ও যশের শীর্ষে পৌঁছে গিয়েছিলেন হরেণ ডাক্তার। এমনকি সেই সময়ে এ অঞ্চলে হরেণ ডাক্তারের জনপ্রিয়তার সাথে পাশ করা ডাক্তাররাও পেরে উঠছিলেন না। এক সময় সকল অজনপ্রিয় ডাক্তাররা একযোগ হয়ে হরেণ কাকাকে হিংসা করতে শুরু করলেন। রাত-বিরাতে উনার বাড়িতে ঢিল ছোঁড়া হতো, গরু জবাইয়ের পর উচ্ছিষ্ট অংশ ফেলা হতো। শোভাকে রাস্তা-ঘাটে উত্যক্তও করতে শুরু করলো একদল বখাটে। প্রথমে থানা পুলিশের সহযোগিতায় লড়াইটা ভালো মতই চালিয়ে যাচ্ছিলেন হরেণ কাকা। শেষ পর্যন্ত তা আর কুলিয়ে ওঠেননি। অবশেষে এক শ্রাবণ মাসের ভোর বেলায় সপরিবারে কাউকে না জানিয়ে অনেকটা পালিয়েই ওপারে চলে গেলেন। পরে শোনা গিয়েছিল তিনি ভারতে উনার ভাইদের সাথে সেটেল্ড হয়েছেন। আমি আর আরিফ কলেজ মোড় ঘুরে শোভাদের বাড়িটার সামনে এসে কিছুক্ষণ দাঁড়ালাম। আগেকার সেই গোল রেলিং দেওয়া বারান্দা ভেঙে ফেলে চারকোনা বারান্দা করা হয়েছে। সেই পুরনো কোন কিছুই আর চোখে পড়লো না, শুধু বাড়ির পাশের ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকা বুড়ো তালগাছটা ছাড়া। দক্ষিণের জানালার ধারে বুড়ো তালগাছটা যেন এখনো কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

ফাল্গুন মাসের পড়ন্ত দুপুর বেলা। উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রারের অফিস থেকে আমি আর ছোট দা অটোরিক্সাযোগে গ্রামে ফিরছি। প্রকৃতিতে বারোয়ারি ফুলের আনাগোনা। রাস্তার দুপাশে দিগন্ত বিস্তৃত সরিষা ক্ষেত। চারিদিকে সরিষা ফুলের অবারিত হলুদ গালিচা, যতদূর চোখ যায় শুধু হলুদ আর হলুদ। মাঝে মাঝে বেশ কিছু আম গাছে মুকুল ধরতে শুরু করেছে। ইদানিং এ অঞ্চলে বাহারি জাতের ফুলের চাষ শুরু করা হচ্ছে। মাঠের পর মাঠ জুড়ে রং-বেরংয়ের বাহারি জাতের গাঁদা, ইনকা, চন্দ্রমল্লিকা, জারবেরা প্রভৃতি ফুল ফুটে রয়েছে। নানা রকম ফুলের মিহি গন্ধের সাথে আমের মুকুলের গন্ধ মিশে এক অদ্ভুত নেশা ভরা ঘ্রাণে চারিদিক মৌ-মৌ করছে। রেল লাইন ক্রসিংয়ের কাছে এসে হঠাৎ আমাদের অটোটা স্লো হয়ে গেল। আমি পাশে বসা ছোট দার দিকে তাকাতেই দেখি দাদার চোখে জল।
: ছোট দা, কাঁদছিস কেন?
: মিহির, এই কয় বছরে তুই তো তাও ওপারে গিয়ে থেকে অভ্যস্ত হয়ে গেছিস। আমি ভারতে নতুন দেশে গিয়ে কিভাবে থাকব বল? জন্মের পর থেকেই আমি এদেশের আলো-বাতাসে মানুষ হয়েছি। কোন দিনই ওপারটা আমার ভালো লাগেনি রে। দুঃস্বপ্নেও কখনোই ভাবিনি আমি এই শহর, এই দেশ ছেড়ে গিয়ে অন্য কোথাও থাকবো।
আমি কিছু বলে যে দাদাকে সান্ত্বনা দেবো কেন জানি ইচ্ছে হলোনা। শুধু আমার বাম হাতটা খুব আলতো করে দাদার কাঁধের উপর ফেলে রাখলাম।

সমস্ত আয়োজনই প্রায় শেষের দিকে, শুধু কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ বাকি রয়ে গেছে। তার মধ্যে একটা বড় কাজ হলো ওদেশে টাকাটা পাঠানো। আগামীকাল সকালে সে কাজটা সেরেই ছোট দা ওপারে রওনা দিয়ে দেবে। তারপর আমি একা, টুকটাক বিদায়ী কাজগুলো সমাধান হয়ে গেলেই কেল্লা ফতে। হঠাৎ করেই আজ থেকে বেশ গরম পড়তে শুরু করেছে। দুপুরে ঘুম থেকে উঠেই দেখি ঘামে আমার সমস্ত শরীর ভিজে জবজবে হয়ে গেছে। রোয়াকের দড়িতে ঝুলানো গামছাটা টেনে নিয়ে ছেলেবেলার মত বাড়ির পেছনের দরজা দিয়ে মাহমুদদের আম বাগানের দিকে চলে গেলাম। আদি আম বাগানটার অনেক পরিবর্তন এসেছে। আগের সেই পুরাতন বয়সী গাছগুলো নেই বল্লেই চলে। এখন সেই শুন্য স্থানে নতুন নতুন গাছ স্থান পেয়েছে। চারপাশে তাল গাছের সংখ্যাও বেশ কমে এসেছে। পড়ন্ত বিকালের একটা সোনালী আভা দীঘির বিশাল জলরাশির উপর এসে ঠিকরে পড়ছে। আমাদের বাড়ি সোজাসুজি যে ঘাট, সে জায়গাটা একবারে জন-মানব শূন্য। আমি বাঁধানো ঘাটের সিঁড়ির উপর বেশ অনেকটা সময় চুপচাপ বসে থাকলাম। এখান থেকে তাকালে আগে দীঘির অপর প্রান্তে বড় রাস্তা দেখা যেত। আজ আর ঠিক বড় রাস্তাটা দেখা যাচ্ছে না। বড় বড় অট্টালিকার আড়ালে পাকা জায়গাগুলো ঢাকা পড়ে গিয়েছে। দীঘির জলে নামতে যাবো হঠাৎ আমার গায়ের ভেতর কেমন যেন ছমছম করে ওঠে। দীঘির হলদে হয়ে আসা জলটাও খুব বেশি সুবিধার মনে হলো না। এক সময় যে দীঘিটা আমার এত বেশি আপন ছিল আজ কেন জানি দীঘিটাকেই অচেনা ভুতুড়ে একটা জলাশয় মনে হতে লাগলো। শেষ পর্যন্ত আমার আর দীঘির জলে স্নান করা হলো না। আমি দ্রুত পা ফেলে বাড়ি ফিরে আসলাম।

বিগত সাতাশটা দিন কীভাবে যে পার হয়ে গেল তা বুঝে উঠতে পারলাম না। নানান প্রকারের কাজের ঝামেলা আর গোছগাছের ব্যস্ততায় পুরো মাথাটা যেন ভারী হয়ে ছিল। এখন বিছানার উপর শরীরটা এলিয়ে দিতেই জগতের সমস্ত ক্লান্তি এসে ধরা দিলো। তবে কেন যেন আজ রাতে আমার এক ফোঁটাও ঘুমাতে ইচ্ছে করছে না। এই বাড়িতে, এই শহরে, এমনকি এই দেশে আজই আমার শেষ রাত। কখনো শখ করে বেড়াতে আসলে সেটা ভিন্ন কথা কিন্তু এই শহরে হয়তো এই জীবনে আর আমার আসা হবে না। যে বাড়িটা ছেড়ে একদিন আমি একটা রাত কোথাও গিয়ে শান্তি পাইনি, এখন জীবনের প্রয়োজনে সেই বাড়িটা ছেড়ে চিরদিনের জন্য একটা ভিন্ন দেশে আমি চলে যাচ্ছি। শৈশব-কৈশোরের চিরচেনা এই বাড়ি, এই শহর ছেড়ে আমি ভোরেই চলে যাবো নতুন এক দেশের কোন এক শহরে। আমাদের ক্ষুদ্র এই জীবনে একটা ছোট্ট সুখের জন্য, একটু ভালোভাবে থাকার জন্য আমার নিজের শহর, নিজের দেশ, নিজের মানচিত্র এমন কি আমার প্রিয় জাতীয় সংগীতটাও কাল থেকে পরিবর্তন হয়ে যাবে।
আমি বিছানায় অসাড় হয়ে পড়ে আছি, হঠাৎ কানে সিডি প্লেয়ারে বাজতে থাকা একটা প্রিয় গানের সুর ভেসে এলো। আমি কি যেন একটা অজানা মোহে বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। গানের আওয়াজটা স্পষ্ট মাহমুদদের বাড়ি থেকে ভেসে আসছে। আহা! কতদিন পরে প্রিয় গানের সুরটা আমার কানে এলো। আমার প্রিয় শিল্পী বশির আহমেদের মিষ্টি গলা,
“এই তো শুধু আমার জন্যে কারাগার …”

এক সময় আমি আর মাহমুদ সারাদিন ক্যাসেট প্লেয়ারে গান শুনতাম। গানের ক্ষেত্রে ওর আর আমার প্রায় একই রকম পছন্দ ছিল। পান্না লাল আর অনুপ জালোটার ভজন মাহমুদ খুব পছন্দ করতো। নজরুল সংগীতও ওর খুব প্রিয় ছিল তবে যে কোন কন্ঠে নয়। ধীরেন বসু, মানবেন্দ্র নতুবা ফিরোজা বেগমের কন্ঠে ছাড়া মাহমুদ কখনো নজরুল গীতি শুনতো না। মাহমুদ ভীষণ মেধাবী ও বিনয়ী ছিল। ও যখন ক্লাশ ওয়ানে পড়ে তখন ওর বাবা মারা যায়। মাহমুদের মাকে আমার বাবা “বড় বুবু” বলে ডাকতেন। একেবারে আপন মায়ের পেটের বোনের মত করে দেখতেন। এই সব হাবিজাবি পুরাতন ভাবনায় কতক্ষণ ডুবে ছিলাম তা ঠিক মনে নেই তবে আমার সম্বিত ফিরে আসলো গানটা থেমে যাওয়ায়। আমার মনের ভেতর দৃঢ় বিশ্বাস জন্মালো যে, আজ মাহমুদ বাড়ি এসেছে। নিশ্চয়ই এসেছে। মাহমুদের নাম ধরে কয়েকবার ডাক দিলাম। ঠিক কয়েক সেকেন্ড পরেই আমাদের দোতলার জানালা বরাবর খোলা ছাদে এসে দাড়ালো মাহমুদ।
: আরে মি-হি-র! কবে এলি?
: প্রায় এক মাস হতে এলো। কাল সকালেই চলে যাবো। তুই কি আজ এসেছিস?
: হ্যাঁ। একটু আগেই এলাম। এসেই ভাত খেয়ে গান শুনছি আর অমনি তুই ডাক দিলি। তোর সাথে অনেক কথা আছে রে, সময় নিয়ে বলতে হবে। আবার কবে আসবি তুই?
: জানি না। হয়তো আর আসবোই না।

এ কথা সে কথায় সব কিছু ভুলে গেলাম আমি। মনে হলো আমরা দুই বন্ধু আবার ঠিক সেই ছোটবেলায় ফিরে গেছি। আমি মাহমুদের কাছে কোন কিছুই গোপন না করে খোলামেলা সব বলে দিলাম। এই বাড়িটা আমরা বিক্রি করে দিয়েছি, আমরা সবাই ওপারে অলরেডি সেটেল্ড হয়ে গেছি। ছোট দা সহ সবাই আগেই চলে গেছে, আমিও কাল সকালেই চলে যাচ্ছি। সব কিছুই মাহমুদকে ভেঙেচুরে বলে দিলাম। খুব ছোটবেলা থেকে মাহমুদকে দেখে আসছি। খুবই ঠান্ডা মাথা আর শক্ত গোছের ছেলে সে। আজ এই প্রথম তাকে আবেগপ্রবণ হতে দেখলাম। আমি ষ্পষ্ট টের পেলাম আমার শৈশব-কৈশোরের প্রিয় বন্ধুর দু’চোখ জলে ভরে এসেছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে আমি প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বললাম –
: মাহমুদ, তোর বলে একটা কবিতার বই বের হয়েছে? নাম কি দিয়েছিস?
: হ্যাঁ। প্রথম কবিতার শিরোনাম অনুসারে কবিতার বইয়ের নাম দিয়েছি, “ভাগ”।
: বাহ! সাবজেক্ট আছে মনে হচ্ছে! কত দিন তোর দরাজ কন্ঠে আবৃত্তি শুনিনি! একটু শোনা তো!
কিছুক্ষণ নীরবতার পর মাহমুদ খুব ধীর অথচ দৃঢ় কন্ঠে আবৃত্তি করতে লাগলো –

“সেই ৪৭-এ মানচিত্র ভাগ হয়েছিল
তাই আমার আর আমার মায়ের দেশ ভিন্ন,
সেদিন আমাদের বাড়িটাও ভাগ হয়ে গেল
তাই আমার আর আমার সহোদরের ঘর আলাদা
সেভাবে হৃদয়টাকে তো ভাগ করিনি
তবে তোমার কষ্ট আমাকে কেন পোড়াবে না!”

ফাল্গুনের শেষ সপ্তাহের ঝকঝকে মিষ্টি সকাল। ছবির মত মসৃণ বাঁকানো সরু পথের সারি সারি আম-কাঁঠাল-মেহগনি বাগান পেছনে ফেলে রেখে আমি জয়নগর-গেদে সীমান্ত চেকপোস্টের দিকে ছুটে চলেছি। আমার রিক্সাওয়ালার নাম সৈয়দ আলী, অনেক দিনের পরিচিত, বাবার প্রাইভেট রিক্সাচালক ছিলেন। সৈয়দ আলী যেতে যেতে হাতের গামছা দিয়ে মুখটা মুছে নিয়ে বললো –
: দাদা, তালি আবার কবে আসপানি?
আমি ইচ্ছে করেই তার কথার কোন উত্তর দিলাম না। আমি বিশেষ ভঙ্গিমায় চেয়ে আছি দূর আকাশের দিকে। সেখানে আকাশের বুকে এক ঝাক সাদা পাখি হঠাৎ করেই দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেল। একদল গেল পূর্বে আরেক দল পশ্চিমে। গভীর মনযোগ দিয়ে আমি পাখিদের ভাগ হয়ে যাবার দৃশ্য দেখতে লাগলাম।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
আহমেদ চঞ্চল লেখালেখি করেন সেই ছোটবেলা থেকেই। তিনি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার সাহিত্য পাতা, ওয়েবসাইট এবং ব্লগে নিয়মিত লিখে থাকেন। মূলত: কবিতা এবং গল্পই লিখতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ বোধ করেন। ২০১৬ সালে নিখিল প্রকাশন থেকে বের হয়েছিল আহমেদ চঞ্চলের প্রথম কাব্যগ্রন্থ “মাথাভাঙ্গার জলে”। তার প্রতিটি ছোট গল্পে-ই বিশেষ একটা স্বকীয়তা খুজে পাওয়া যায়। পেশাগত জীবনে আহমেদ চঞ্চল একটি বহুজাতিক কোম্পানিতে “বিক্রয় ব্যবস্থাপক” হিসাবে কর্মরত আছেন।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!