রাজধানীর কলাবাগানে ডা. সাবিরা হত্যার নেপথ্যে কী!

ঢাকা প্রতিনিধি
ঢাকা প্রতিনিধি
7 মিনিটে পড়ুন
ছবি: সংগৃহীত

ঢাকার কলাবাগানে সোমবার (৩১ মে) সকালে ডা. কাজী সাবিরা রহমান লিপি (৪৭) নামে এক নারী চিকিৎসকের রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। তিনি রাজধানীর গ্রিন লাইফ হাসপাতালের চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
খে ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর পরে পুলিশ জানায়, তার শরীরে একাধিক গভীর ক্ষতের চিহ্ন রয়েছে। পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হতে পারে।

পুলিশের ধারণা, ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যার পর মরদেহ আগুনে পুড়িয়ে ফেলার চেষ্টা করা হতে পারে। আত্মীয়-স্বজনদের পাশাপাশি বিষয়টি দেখে হতবাক পুলিশও। সাবিরাকে খুন করা হয়েছে নাকি তিনি আত্মহত্যা করেছেন তা নিয়ে চলছে তদন্ত।

জানা গেছে, রাজধানীর কলাবাগান ফার্স্ট লেনের ৫০/১ সাততলা ভবনের তিনতলার একটি ফ্ল্যাটে একাই থাকতেন নিহত ডা. কাজী সাবিরা রহমান লিপি। তিন রুমের এই ফ্ল্যাটের একটি কক্ষে থাকতেন ডা. সাবিরা। বাকী দুইটা কক্ষ তিনি বাড়ীর মালিককে না জানিয়েই সাবলেট হিসেবে ভাড়া দিয়েছিলেন। দ্বিতীয় কক্ষে থাকতেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া একজন শিক্ষার্থী। আর তৃতীয় কক্ষে থাকতেন আরও একজন শিক্ষার্থী, তবে তিনি মডেল হিসেবে পরিচিত বলে জানান স্থানীয়রা।

ওই ফ্ল্যাটে সাবলেট হিসেবে থাকা একজন ঈদের আগে বাড়ি গিয়ে ফেরেননি। অপরজন ভোরে বাসা থেকে বের হন শরীর চর্চা করতে। তার নাম কানিজ সুবর্ণা। তিনি সকাল পৌনে ১০টায় ঘরে ফিরে দেখেন চিকিৎসকের কক্ষ থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে। এই তরুণী একজন মডেল। স্নাতক পাস করেছেন। মডেলের এক ছেলেবন্ধু যার নাম মাহাথির মোহাম্মদ স্পন্দন সহ মডেলকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে গেছে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে ডাক্তারি পড়া শেষ করে ঢাকায় এসে কয়েকটি হাসপাতালে চাকরির পর তিনি যোগ দেন গ্রিন লাইফ হাসপাতালে। ডা. সাবিরা আট থেকে নয় বছর ধরে গ্রিন লাইফ হাসপাতালে চাকরি করছেন। বছর পাঁচেক আগে তার চাকরি স্থায়ী হয়। কাজ করতেন রেডিওলজি বিভাগে। তার প্রথম স্বামী ছিলেন চিকিৎসক। এক সড়ক দুর্ঘটনায় প্রথম স্বামীর মৃত্যুর পরে শামসুর আজাদ নামের একজন ব্যাংকারকে বিয়ে করেন লিপি। দুই সংসারে তার দুইটি সন্তান রয়েছে। বর্তমান স্বামীর সঙ্গে মনোমালিন্য হওয়ায় ডা. সাবিরা আলাদা থাকতেন বলে জানা গেছে। তিনি গত কয়েক মাস ধরে ক্যানাডা যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।

আজ সোমবার সকালে খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ক্রাইম সিন ইউনিট। তারা মরদেহ থেকে আলামত সংগ্রহ করে। ক্রাইম সিন জানায়, সাবিরাকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছে। তাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাতের পর বিছানায় আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। দাহ্য পদার্থ না থাকায় আগুন তেমন ছড়ায়নি। তবে, সাবিরার শরীরের কিছু অংশ এতে দগ্ধ হয়।

1 রাজধানীর কলাবাগানে ডা. সাবিরা হত্যার নেপথ্যে কী!
রাজধানীর কলাবাগানে ডা. সাবিরা হত্যার নেপথ্যে কী! 39

সকালে কেউ বাসায় ঢুকেছেন, এমনটি দেখেননি বলে দাবি করেছেন ঐ ভবনের দারোয়ান রমজান আলী।

ঘটনার দিন সকাল সাড়ে ৯টার দিকে সাবিরা তার কর্মস্থল গ্রিন লাইফ হাসপাতালে যাওয়ার কথা ছিল। সেখান থেকে কয়েকজনের সঙ্গে বাইরে যাওয়ার কথা ছিল বলে জানিয়েছেন একজন স্বজন। তবে কাদের সঙ্গে কোথায় যাওয়ার কথা ছিল, তা এখনো জানা যায়নি।

সোমবার সকাল সাড়ে ৯টায় রোগী দেখার কথা ছিল ডা. সাবিরার। গ্রিন লাইফ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, ডা. সাবিরা রোববার রাতে বলে এসেছিলেন তিনি সোমবার সকাল ৯টার দিকে আসবেন।

হাসপাতালের আয়া সাথি বেগম বলেন, ‘সকাল সাড়ে ৯টা থেকে ম্যাডামকে ফোন দেয়া হচ্ছিল। কিন্তু ম্যাডাম ফোন রিসিভ করেননি। সকাল সাড়ে ৯টায় রোগী দেখার টাইম দেয়া ছিল। ম্যাডাম বলে গিয়েছিলেন- তিনি ৯টায় হাসপাতালে আসবেন।’

ওই ভবনে কোনো সিসিটিভি ক্যামেরা নেই বলে জানিয়েছেন ফ্ল্যাটের মালিক মাহবুব ইসলাম। ফলে কে বা কারা ঘরে ঢুকেছেন সেটি দেখার সুযোগ নেই। তিনি বলেন, ‘খুনি সেই ফ্ল্যাটেও অবস্থান করতে পারেন, তবে আপাতত কাউকে সন্দেহও করতে পারছি না।’

বাড়ীওয়ালা মাহবুব আরও বলেন, ‘স্বামী বিদেশে থাকেন, দুই সন্তান নিয়ে থাকবেন বলে ২৩ হাজার টাকায় ফ্ল্যাট ভাড়া নেন ডা. সাবিরা। তবে সোমবার ঘটনার পরে জেনেছি, ফ্ল্যাটের তিন কক্ষের মধ্যে দুই কক্ষ দুই নারীকে ভাড়া দিয়েছিলেন তিনি।’

বাড়ির দারোয়ান রমজান আলীকে উদ্ধৃত করে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে মাহবুব বলেন, ‘সাবলেট দেয়া দুই কক্ষের মধ্যে একটি কক্ষের নারী ঈদের আগে বাড়ি গিয়ে এখনো ফেরেননি। অন্য কক্ষের নারী কানিজ সুবর্ণা প্রতিদিনের মতো শরীর চর্চা শেষে বাসায় ফিরে সাবিরার কক্ষ থেকে ধোঁয়া বের হতে দেখেন। পরে ডাকাডাকি করে ভেতর থেকে সাড়া না পেয়ে এবং ভেতর থেকে দরজা বন্ধ থাকায় দৌঁড়ে নিচে নেমে দারোয়ানসহ কয়েকজনকে নিয়ে উপরে ওঠেন। পরে ফায়ার সার্ভিসের টিম এসে কিছুক্ষণ পানি ছিটিয়ে ধোঁয়া নিভিয়ে চলে যায়। এরপরেই পুলিশ আসে।’

বর্তমান স্বামীর সঙ্গে মনোমালিন্য হওয়ায় ডা. সাবিরা আলাদা থাকতেন বলে জানা গেছে। তবে তাদের মধ্যে যোগাযোগ ছিল বলে জানিয়েছেন সাবিরার একজন স্বজন। দ্বিতীয় স্বামী শামসুর আজাদের বাসা রাজধানীর শান্তিনগরে। সাবিরা খুনের সংবাদ পেয়ে তিনি কলাবাগানের বাসায় আসেন।

তিনি আরও বলেন, ‘শাশুড়ি ফোন করে কাঁদতে কাঁদতে আমাকে বলেন, লিপি হয়তো বেঁচে নেই, তুমি একটু ঘটনাস্থলে যাও। এরপর বাসায় ছুটে আসি। তবে প্রথমে পুলিশ আমাকে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়নি। দুপুর আড়াইটার দিকে ঘরে প্রবেশ করে বিছানার ওপর স্ত্রীকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখতে পাই।

নিউ মার্কেট-কলাবাগান জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) শরীফ মোহাম্মদ ফারুকুজ্জামান বলেন, কলাবাগানের এই ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে দুইজনকে সাবলেট দিয়েছিলেন সাবিরা। সকালের দিকে তার কক্ষের বাইরে থেকে ধোঁয়া দেখেন পাশের সাবলেটে থাকা এক নারী। পরে তিনি ভবনের দারোয়ানসহ কয়েকজনকে এনে দরজা ভেঙে ভেতরে যান। তারা ঢুকে দেখতে পান, লিপি বিছানায় পড়ে আছেন এবং ঘরে ধোঁয়া। পরে ফায়ার ব্রিগেড এসে পানি ছিটিয়ে চলে যায়। পুলিশ বেলা ১২টার দিকে এসে তাকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করে। সাবিরার মরদেহে গভীর ক্ষত ছিল। কাটা হয়েছিল তার শ্বাসনালী। পিঠে ও কোমরের উপরে এবং গলার ক্ষতগুলো লক্ষ্য করা যায়। ওই কক্ষে আগুনের সূত্রপাতও হয়। কিন্তু এসব বিষয়ে তদন্ত না করে এখনই বিস্তারিত কিছু জানাতে পারছি না।

তিনি আরও বলেন, এরপর বিকেলে মরদেহ উদ্ধার করে একজন নারী এসআই এবং নারী কনস্টেবলের সহায়তায় মরদেহের সুরতহাল শেষে ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়েছে।

ফায়ার সার্ভিসের লোকেরা সংবাদ দিলে পুলিশ ঘটনাস্থলে যায় ও আলামত সংগ্রহ করে। এ বিষয়ে এখনই কিছু বলা যাচ্ছেনা বলে জানান কলাবাগান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) পরিতোষ চন্দ্র পাল।

ফায়ার সার্ভিস জানায়, মরদেহটির গলা ও পায়ের সামনের কিছু অংশ দগ্ধ ছিল। ঘরের তোশক পুড়ে গিয়েছিল। এসব দেখে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা পুলিশে খবর দিতে বলেন। পরে পুলিশ এসে মরদেহ উদ্ধার করে।

ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে গোয়েন্দা পুলিশের রমনা বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) আজিমুল হক বলেন, ‘সবাই ভেবেছিলেন ডা. সাবিরা আগুনে পুড়ে মারা গেছেন। পরে ডিবি পুলিশ এসে তার শরীরে আঘাতের চিহ্ন পায়। আমরা তদন্ত করছি। চারজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। আশা করছি, দ্রুত রহস্য উদঘাটন করতে পারব।’

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!