প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় কাঁকড়া নিধনে নিষেধাজ্ঞা জরুরী

আরিফ আহমেদ
আরিফ আহমেদ
5 মিনিটে পড়ুন

পর্যটন মৌসুমে পটুয়াখালী জেলার কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে চলাচলকারী মটরসাইকেলের চাকায় পৃষ্ঠ হয়ে প্রতিদিন প্রায় ছয় হাজার কাঁকড়া নিধন হচ্ছে। এছাড়াও পটুয়াখালী উপকুল এলাকায় ও সুন্দরবন এলাকার জেলেদের হাতে নিধন হচ্ছে প্রজননক্ষম মা কাঁকড়া। আর অপরিকল্পিত পর্যটন ব্যবস্থা এবং সরকারী কোনো তদারকি না থাকায় এক শ্রেণির জেলে অবাধে এই ডিমওয়ালা কাঁকড়া নিধন করে চলছে। যা প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় হুমকী হতে পারে বলে মনে করছেন পরিবেশবিদগণ।

সম্প্রতি এক গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে সমুদ্র পরিবেশ বিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন মেরিন জার্নালিস্টস নেটওয়ার্কের এক পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে। গত বৃহস্পতিবার (২৭ মে) ২০২১ এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করে সংগঠনটি।

তাদের প্রদত্ত তথ্য সুত্রে জানা গেছে, পর্যটন মৌসুমে কুয়াকাটায় প্রতি সপ্তাহে অন্তত ৫০-৬০ হাজার পর্যটক ভ্রমণ করেন। কিন্তু এদের ব্যবস্থাপনার জন্য কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেই। যার কারণে প্রতিদিন এই সৈকতে পর্যটকদের ফেলা প্লাস্টিকের ৯০ শতাংশই চলে যাচ্ছে সমুদ্রে। এর কারণে সমুদ্রের পরিবেশ ব্যবস্থা ধ্বংস হচ্ছে । এছাড়াও কুয়াকাটার সৈকতে যাত্রী পরিবহনের জন্য প্রতিদিন অন্তত ২০০টি মোটরসাইকেল চলাচল করছে। যার প্রতিটির দৈনিক আয় এক হাজার ৫০০ থেকে দুই হাজার টাকা পর্যন্ত। এসব মোটরসাইকেল দিনে অন্তত দুই থেকে তিনবার সৈকত হয়ে কাঁকড়ার দ্বীপে যায়।

পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, প্রতিবার একটি মোটরসাইকেলের চাপায় গড়ে ১০টি করে কাঁকড়ার মৃত্যু হয়। এই হিসেবে দেখা যায়, বাইকচাপায় প্রতিদিন অন্তত ছয় হাজার কাঁকড়ার মৃত্যু হচ্ছে।
কুয়াকাটায় বন ধংস, বেদখল, ভাঙনে বসতি হারানো ও মৎস্য সম্পদের হুমকির তথ্যও উঠে এসেছে মেরীন জার্নালিস্টস নেটওয়ার্কের এই প্রতিবেদনে।

অন্যদিকে সরেজমিনে পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া এলাকার কয়েকজন বাসিন্দার সাথে কথা বলে জানা গেছে, জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কাঁকড়ার প্রজনন সময়। এ সময় শ্বাসমূলীয় (ম্যানগ্রোভ) বনাঞ্চলের লোনা পানিতে স্ত্রী কাঁকড়া ডিম ছাড়ে। তবে সবচেয়ে বেশি ডিম ছাড়ে মাঘ মাসের প্রথম অমাবস্যায়।

1 প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় কাঁকড়া নিধনে নিষেধাজ্ঞা জরুরী
প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় কাঁকড়া নিধনে নিষেধাজ্ঞা জরুরী 39

ঐ দুই মাসে সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, হংকং, চীনসহ বিভিন্ন দেশে নানা ধরনের উৎসব হয়। এসব উৎসবে ডিমওয়ালা কাঁকড়ার চাহিদা বেশি। সে কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে এ সময় ডিমওয়ালা কাঁকড়ার চাহিদা ও দাম থাকে বেশি। তাই বেশি লাভের আশায় ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলসহ বঙ্গোপসাগরের তীরঘেঁষা সুন্দরবন, কুয়াকাটা, গঙ্গামতি, কাউয়ার চর, খালগোড়া, ঢোস, জালালপুর, তালতলীর ফাতরার চর, সওদাগর পাড়া, নিউপাড়া, রাঙ্গাবালীর মৌডুবি, কোরালিয়া, নিচ কাটা, বড় বাইশদিয়া, ছোট বাইশদিয়া, জাহাজ মারার চরে এক শ্রেণির জেলে অবাধে ডিমওয়ালা কাঁকড়া নিধন করছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশে এখন পর্যন্ত ১৫ প্রজাতির কাঁকড়া পাওয়া গেছে। এর মধ্যে চার প্রজাতির কাঁকড়া মিষ্টি পানিতে এবং ১১ প্রজাতির কাঁকড়া লবণাক্ত বা আধা লবণাক্ত পানিতে পাওয়া যায়। সাইলা সিরাটা নামে কাঁকড়ার বাণিজ্যিক চাহিদা সবচেয়ে বেশি। এগুলো ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলে পাওয়া যায়। স্থানীয় ব্যক্তিরা একে শিল কাঁকড়া বলে থাকে। শিল কাঁকড়া এবং এর বাইরে অলিভিসিয়া, প্যারামসিন, ট্রাংকুবুরকিয়া—এ চার প্রজাতির কাঁকড়া উপকূলের জেলেরা প্রতিদিন শিকার করছেন।

এদিকে কাঁকড়ার প্রজনন সময়ে জেলেরা সাগর-নদীতে কারেন্ট, বেহুন্দিসহ ছোট ফাঁসের জালে মাছ শিকারের সময় জালে কাঁকড়ার ডিমও উঠছে। এতে প্রতিদিন নষ্ট হচ্ছে হাজার হাজার ডিম। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবসহ নানা কারণেও কাঁকড়া ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

কলপাড়ার কাঁকড়ার আড়তদার গোলাম মোস্তফা পাহলান ও দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘এখন ডিমওয়ালা কাঁকড়া বেশি ধরা পড়ছে। ঢাকার আড়তে এসব কাঁকড়ার চাহিদা বেশি। শুনেছি আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁকড়ার দাম বেড়ে গেছে। প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকার অন্তত ৫০টি কাঁকড়ার আড়ত থেকে ১০০ মণ কাঁকড়া ঢাকায় চালান করা হয়।’

খেপুপাড়া মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ আশরাফুল হক বলেন, ‘প্রতিটি পূর্ণ বয়সের স্ত্রী কাঁকড়া ১৫ লাখ থেকে ২০ লাখ ডিম ছাড়ে। অভয়াশ্রম না থাকায় ও জলবায়ু পরিবর্তনে জীববৈচিত্র্য বিপন্ন হওয়ায় মাত্র ১০ শতাংশ ডিম পূর্ণাঙ্গ গ্রেডে পরিণত হয়। কাঁকড়ার ডিম পূর্ণতা পেতে দু-তিন মাস সময় লাগে। এ খাত টিকিয়ে রাখতে হলে প্রজনন সময়ে কাঁকড়া ধরা বন্ধ করতে হবে।’

কলাপাড়ার জ্যেষ্ঠ মৎস্য কর্মকর্তা মো. কামরুল ইসলাম বলেন, ‘মৎস্য রক্ষা ও সংরক্ষণ আইনে কাঁকড়া ধরা সম্পর্কে নিষেধাজ্ঞা নেই। প্রজনন সময় দেশে কাঁকড়া আহরণ বা বাজারজাত বন্ধ করা উচিত।’

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ অ্যান্ড মেরিন রিসোর্স টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের শিক্ষক ও কাঁকড়া বিশেষজ্ঞ খন্দকার আনিসুল হক বলেন, প্রজনন ও পরবর্তী সময়ে কাঁকড়া শিকার বন্ধে আইনি পদক্ষেপ ও অভয়াশ্রম গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তেমন উদ্যোগ নেই। কিছু কিছু এলাকা চিহ্নিত করে ইলিশের মতো কাঁকড়া নিয়েও গবেষণা ও অভয়াশ্রম গড়ে তোলা যেতে পারে।

আন্তর্জাতিক বাজারে চিংড়ির চেয়ে কাঁকড়ার দাম ও চাহিদা ব্যাপক হওয়ায় কাঁকড়া ধরার ক্ষেত্রে সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞগণ।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

বিষয়:
এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!