হেফাজতকে ‘তেহেরিক-ই-লাব্বায়িক’র আদলে জঙ্গি সংগঠন করতে চেয়েছিলেন মামুনুল

সাময়িকী ডেস্ক
সাময়িকী ডেস্ক
7 মিনিটে পড়ুন

অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম ব্যানারে পাকিস্তানের ‘তেহেরিক-ই-লাব্বায়িক’ নামের সংগঠনের আদলে এ সংগঠনকে গড়ে তুলতে চেয়েছিল হেফাজতের বিলুপ্ত কমিটির যুগ্ম-মহাসচিব জঙ্গি নেতা মামুনুল হক সহ সংঘঠটির আরও কয়েজন নেতা। বাংলাদেশকে তারা পাকিস্তান বা আফগানিস্তানের মতো পরিচালিত করার স্বপ্ন নিয়ে সংগঠনটিকে এগিয়ে নিতে চেয়েছিল। এসব পরিকল্পনাকারী ও বাস্তবায়নকারীদের অগ্রভাগে ছিলেন হেফাজতের সাবেক যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক।

মামুনুল হক তার ভগ্নিপতি নেয়ামতুল্লার মাধ্যমে পাকিস্তানের বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠী ও গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতো। ২০০৫ সালে মামুনুল হক ও তার বোন টানা ৪৫ দিন পাকিস্তানে অবস্থান করে বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠীর সাথে বৈঠক করে। তিনি হেফাজতে ইসলামকে পাকিস্তানি সংগঠন- তেহরিক ই লাব্বায়িক এর আদলে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন বলে প্রমাণ পেয়েছে পুলিশ। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সদর দপ্তরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানিয়েছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা।

দেশ বিদেশ থেকে হেফাজতে ইসলামের অর্থের যোগানদাতা হিসেবে ৩১৩ জনকে চিহ্নিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার। মামুনুল হকের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ৬ কোটি টাকার লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। মাওলানা মামুনুল হকসহ কয়েকজন নেতা এসব টাকা নাশকতামূলক কাজে খরচ করেছেন। মামুনুল ঢাকা শহরে বাবরি মসজিদ প্রতিষ্ঠার কথা বলেও টাকা সংগ্রহ করেন।

Untitled 1 copy 23 600x337 1 হেফাজতকে ‘তেহেরিক-ই-লাব্বায়িক’র আদলে জঙ্গি সংগঠন করতে চেয়েছিলেন মামুনুল
মামুনুল হক

পুলিশ সুপার বলেন, পাকিস্তানে ৪০ দিন এক সঙ্গে ছিলেন নেয়ামতুল্লা ও মামুন। তারা সেখান থেকে উগ্র ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদের একটা মডেল বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। বাংলাদেশকে আফগানিস্তান বা পাকিস্তান মডেলের তালেবানি রাষ্ট্র বানানোর স্বপ্নে বিভোর ছিল অনেক হেফাজত নেতা।

১৯৯৭ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে মামুনুল হকের বাবা আজিজুল হক জানিয়েছিলেন, ‘বসনিয়ায় যুদ্ধ করার জন্য এক লাখ মুজাহিদকে ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে বলে । তালেবানরা চাইলে এক-দুইজন নয়, লাখ লাখ যোদ্ধা পাঠানো হবে।’

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম বলেন, তারা (হেফাজত) চায় সরকার পতনের মাধ্যমে যে ক্ষমতায় আসতে পারে তাহলে বাংলাদেশকে পাকিস্তান ও আফগানিস্তান মডেল বানানোর পরিকল্পনা নিয়েছিল।

গত ২৮শের এপ্রিল বুধবার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে চট্টগ্রামের হাটহাজারিতে সহিংসতা ও তাণ্ডবের দায়ে নেজামে ইসলাম পার্টির সভাপতি মুফতি ইজহারুল ইসলাম চৌধুরীর বড় ছেলে এবং হেফাজতে ইসলামের সদ্য বিলুপ্ত কেন্দ্রীয় কমিটির শিক্ষা ও সংস্কৃতি সম্পাদক মুফতি হারুন ইজহারকে করেছে আইন-শৃংখলাবাহিনী। এর আগে ২০১৩ সালের ১০ জুলাই চট্টগ্রামের লালখান বাজার মাদ্রাসায় ভয়াবহ গ্রেনেড বিস্ফোরণের ঘটনায় হারুন ইজহার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন।

২০১৩ সালের ৭ই অক্টেবর লালখান বাজার মাদ্রাসার ভেতরে এক ভয়ংকর গ্রেনেড বিস্ফোরণের ঘটনায় তিনজন নিহত হন। হাবিব ও নূরনবী নামে তিনজন মারাযায়। এরপরেই চট্টগ্রাম লালখান বাজারে পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত জামিয়াতুল উলুম আল-ইসলামিয়ামাদ্রাসায়্ অভিযান চালিয়ে মাদ্রাসার একটি কক্ষ থেকে ১৮টি বোতলে ৫০০ গ্রাম করে নয় হাজার গ্রাম অ্যাসিড উদ্ধার করা হয়। প্রতিটি বোতলের গায়ে লেখা আছে, এআরটি, ৫২৮০ পিকরিক অ্যাসিড এক্সট্রা পিউর, লোবা চেমি প্রাইভেট লিমিটেড, মুম্বাই, ৪০০০৫ ইন্ডিয়া। ঐ মামলায় হারুন ইজাহার ও তার পিতা মুফতি ইজাহারুল ইসলামের বিরুদ্ধে হত্যা, বিস্ফোরক, অ্যাসিড ও দুদকের নোটিশ অমান্য করার মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছিল আদালত। হারুন ইজহার কারাগারে থাকলেও মুফতি ইজহার ঘটনার পর থেকে পলাতক রয়েছেন।

২০১০ সালে র‍্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া হুজি আমির ইয়াহিয়া জানিয়েছিল লালখান মাদ্রাসায় হরকাতুল জিহাদ (হুজি)র আঞ্চলিক শাখা খোলা হয়েছে।

এর আগে ২০০৯ সালে হারুন ইজহারের পরিচালনাধীন লালখান বাজারে জামিয়াতুল উলুম আল-ইসলামিয়া মাদরাসা ঘিরে আন্তঃদেশীয় জঙ্গিরা একটি ঘাঁটি তৈরি করেছিল। ঐ বছরের শেষ দিকে তারা ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস ও ভারতীয় হাইকমিশনারের কার্যালয়ে হামলা ও পরিকল্পনার সঙ্গে ছিল ভারতে নিষিদ্ধ ঘোষিত ইসলামি জঙ্গি সংগঠন লস্কর ই-তৈয়্যবা। হারুন ইজহার পুরো এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। পরে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে সেসময় ওই মাদ্রাসায় অভিযান চালিয়ে লস্কর-ই-তৈয়্যবার কয়েকজন সদস্য ভারতীয় নাগরিক সহ হারুন ইজহারকে গ্রেফতার করা হয় সে বছরে। মাস কয়েক আগে আতিকুল্লাহ নামে হরকাতুল জিহাদের এক শীর্ষ নেতাকে গ্রেফতার করেছিল ঢাকার কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট-সিটিটিসি। সে সময় পুলিশ কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদে আতিকুল্লাহ জানিয়েছিল, হরকাতুল জিহাদ ও আফগান ফেরত মুজাহিদদের অনেকেই বর্তমানে হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে মিশে গিয়ে তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে। হরকাতুল জিহাদ ও আফগান ফেরত মুজাহিদদের নতুন করে হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়ার কাজটি মূলত হারুন ইজহার করতেন।

মুফতি হারু ইজহার হেফাজতকে ‘তেহেরিক-ই-লাব্বায়িক’র আদলে জঙ্গি সংগঠন করতে চেয়েছিলেন মামুনুল
হারুন ইজহার

১৯৯৯ সালের ১৮ জানুয়ারি শামসুর রাহমানের রাজধানীর শ্যামলীর বাড়িতে ঢুকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে তাকে আঘাত করেছিল একদল উগ্র ধর্মীয় জঙ্গী। কবি শামসুর রাহমান হত্যা চেষ্টা মামলায় কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার মৃত মহিউদ্দিন বিশ্বাসের ছেলে মো. মাহতাব উদ্দিন, হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলার ডা. এ কে আ. আজিজের ছেলে ফজলে এলাহী আহসান ওরফে হাছান, খুলনার রূপসা উপজেলার শেখ আকরাম হোসেনের ছেলে মো. মোজাম্মেল হোসেন এবং বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলার মো. তোফাজ্জল হোসেনের ছেলে মো. তারেক আজিজ- গ্রেপ্তার হওয়া চারজন জঙ্গী আসামী জানিয়েছিল, হারুন ইজহারের মাদরাসায় বসেই এ হামলার পরিকল্পনা করা হয়েছিল।

এছাড়াও হেফাজতে ইসলামে ‘মানহাজি’ এবং ‘গাজওয়াতুল হিন্দ’ নামে দুইটি বড় গ্রুপের নেতৃত্বে রয়েছে হারুন ইজহার। ধর্মীয় রাজনীতি ও জঙ্গিবাদের পরিভাষায় যারা সরাসরি জিহাদের ডাক দিয়ে কথিত খেলাফত প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তাদেরকে মানহাজি বলে। আর হিন্দুস্থান বা ভারতীয় উপমহাদেশে একটি যুদ্ধে মুসলিমদের জয়লাভ ও যোদ্ধাদের শামে (সিরিয়া) ফিরে যাওয়ার বর্ণনা সংবলিত একটি হাদিস উল্লেখ করে তাকে গাজওয়াতুল হিন্দ বলা হয়।

হেফাজতে ইসলামের সদ্য বিলুপ্ত কমিটির আমির জুনায়েদ বাবুনগরীর ছেলের বিয়েতেই সাবেক আমির আল্লামা শফীকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা হয়। ওই বিয়ের অনুষ্ঠানে মামুনুল হক, জুনায়েদ আল হাবিবসহ কয়েকজন নেতার বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে আল্লামা শফীকে সরিয়ে বাবুনগরীকে আমির করার পরিকল্পনা হয় বলেও জানান ডিবির শীর্ষ এ কর্মকর্তা। আল্লামা আহমেদ শফীর মৃত্যুর পর ২০২০ সালে ১৫ নভেম্বর হেফাজতে ইসলামের ১৫১ সদস্য বিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করা হয়- যার মধ্যে অর্ধেকের বেশি কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত। আর এদের মধ্যে অন্তত আট জন হরকাতুল জিহাদ (হুজি)’র সাবেক সদস্য কিংবা জঙ্গি সংগঠনটির সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতা আছে।

সম্প্রতি, ২৬ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সফরকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ধারাবাহিক সহিংসতার ঘটনায় হেফাজতে ইলামের নেতাদের পর্যায়ক্রমে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। এরপরেই ২৫শে এপ্রিল রবিবার হেফাজতের কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়।

পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা (আইএসআই) সরাসরি বাংলাদেশে জঙ্গি সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য অর্থের জোগান দিচ্ছে বলে জানিয়েছে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ আলী সিকদার।

ধর্মীয় জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্তরা যাতে জামিন না পায় এবং নামে-বেনামে বিভিন্ন সামাজিক ও অরাজনৈতিক সংগঠনের নামে যেন সন্ত্রাসী জঙ্গী কার্যক্রম পরিচালনা করার সুযোগ না পায় সে জন্য সংশ্লিষ্টদের সর্তক থাকার আহ্বান জানিয়েছে নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা ।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!