নতুন আতঙ্কের নাম ব্ল্যাক ফাঙ্গাস:
ভারতে কোভিড রোগীদের অন্ধ করে দিচ্ছে বিরল এই ছত্রাক

সাময়িকী ডেস্ক
সাময়িকী ডেস্ক
8 মিনিটে পড়ুন
ছবি: সংগৃহিত

করোনা সংক্রমণের ভয়াবহ দ্বিতীয় ঢেউ কেড়ে নিচ্ছে বহু মানুষের জীবন। কেউ কেউ সেরে উঠলেও ভুগতে হচ্ছে নানা জটিলতায়। সম্প্রতি এই তালিকায় যোগ হয়েছে ‘ব্ল্যাক ফাঙ্গাস’ বা ‘কালো ছত্রাক’, বৈজ্ঞানিক নাম মিউকোরমাইকোসিস।

ভারতের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, কোভিড থেকে আরোগ্যের পথে বা সুস্থ হয়ে ওঠা ব্যক্তিদের শরীরে এক বিরল এক সংক্রমণ ‘ব্ল্যাক ফাঙ্গাস’ ছড়িয়ে পড়ছে। বিরল এই ছত্রাকের সংক্রমণ খুবই মারাত্মক, যা নাক, চোখ এবং কখনও কখনও মস্তিষ্কেও আক্রমণ করে।

গত শনিবার শনিবার মুম্বাইয়ে চোখের ডাক্তার ডা. অ্যখশে নায়ার ২৫ বছর বয়সী এক নারীর চোখে অস্ত্রোপচারের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ঐ নারী তিন সপ্তাহ আগে কোভিড থেকে সেরে উঠেছেন। ঐ রোগী, যিনি ডায়াবেটিক, ক্লিনিকের ভেতর সেসময় একজন কান, নাক ও গলার ডাক্তার তার নাকের ভেতর নল ঢুকিয়ে মিউকোমাইকোসিস বা বিপজ্জনক ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত কোষগুলো বের করে আনছিলেন। অন্য চিকিৎসকের কাজ শেষ হলে ডা. নায়ার ঐ রোগীর চোখে অস্ত্রোপচার শুরু করবেন। ঐ রোগীর ওপর তিন ঘন্টার অস্ত্রোপচার চালিয়ে তিনি তার চোখ কেটে বাদ দেবেন।

”জীবন বাঁচাতে তার চোখ আমাকে বাদ দিতে হবে। এই রোগ থেকে বাঁচার আর কোন উপায় নেই,” আমাকে জানান ডা. নায়ার। – সূত্র বিবিসি বাংলা

ইন্ডিয়া ডট কম- এ প্রকাশিত সংবাদ সূত্রে জানাগেছে, দিল্লির মানসম্পন্ন চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান স্যার গঙ্গারাম হাসপাতাল গত সপ্তাহে ৬ জন রোগী কালো ছত্রাকে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন। পুনের একটি হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরে যাওয়া রোগীদের ১০ জন কালো ছত্রাক নিয়ে আবার ফিরে আসেন হাসপাতালে। তাদের দশ জনেরই মুখে অস্ত্রোপচার করতে হয়েছিল। এদের মধ্যে পাঁচজন মারা গেছেন। এইসব রোগীদের কমবেশি অনেকে তাদের দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছে। ভারতের গুজরাতের সুরাট শহরে গত দুই সপ্তাহে অন্তত ৪০ জনকে ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের রোগী হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের মধ্যে আটজন দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে পুরোপুরি অন্ধ হয়ে গেছেন। বিশেষ করে যারা আইসিইউ থেকে বে্ঁচে ফিরেছিলেন তারাই এই কালো ছত্রাকে আক্রান্ত হয়েছে বেশি।

ভারতের জাতীয় গবেষণা সংস্থা ইন্ডিয়ান কাউন্সিল ফর মেডিক্যাল রিসার্চ (আইসিএমআর) এ নিয়ে সতর্ক হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।

‘ব্ল্যাক ফাঙ্গাস’ বা মিউকোরমাইকোসিস কী ধরনের সংক্রমণ?

মিউকোরমাইকোসিস খুবই বিরল ফাঙ্গাস বা ছত্রাকসৃষ্ট রোগ। মিউকোর নামে একটি ছত্রাকের সংস্পর্শে এলে এই সংক্রমণ হয়। সাধারণত এই ছত্রাক পাওয়া যায় মাটি, গাছপালা, সার, ফসল এবং পচন ধরা ফল, শাকসবজিতে। এই ছত্রাক পরিবারের সদস্য সংখ্যা প্রায় ৪০। এক ধরনের বিশেষ ছত্রাক পরিবার থেকে মানুষের শরীরে রোগটি বাসা বাঁধে। পরিবারের নাম ‘মিউকোর (Mucor)’। ছত্রাকসৃষ্ট রোগকে বলা হয় ‘মাইকোসিস (Mycosis)’। তাই মিউকোর ছত্রাকসৃষ্ট এ রোগের নাম ‘মিউকোর-মাইকোসিস’।

এটা মাটি এবং বাতাসে এমনিতেই বিদ্যমান থাকে। এমনকি নাক ও সুস্থ মানুষের শ্লেষ্মার মধ্যেও এটা স্বাভাবিক সময়ে থাকতে পারে। এতে আক্রান্ত স্থানে কালো দাগ তৈরি হয়। আক্রান্তদের নাক থেকে শ্লেষ্মা মিশ্রিত কালো শক্ত পদার্থ বের হয়। এ কারণেই একে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস বা কালো ছত্রাক রোগ বলা হয়।

একজন সুস্থ মানুষ সাধারণত ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হয় না। তবে রোগ বা কোনও বিশেষ চিকিৎসার কারণে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেলে মিউকোর গ্রুপের ছত্রাক কামড় বসানোর সুযোগ পায়।

ব্ল্যাক ফাঙ্গাস যেভাবে মানুষের শরীরে ছড়ায়:

ব্ল্যাক ফাঙ্গাস বায়ুবাহিত রোগ। এই ছত্রাকের বীজগুটি বাতাসে ভেসে বেড়ায়। শ্বাসগ্রহণের সময় নাসারন্ধ্র দিয়ে সাইনাস ও ফুসফুসে প্রবেশ করে। এ ছাড়া পরিপাকতন্ত্রেও এ ছত্রাক প্রবেশ করে রোগ বাঁধাতে পারে। ত্বকে কাটা, ক্ষত বা পোড়া ঘা থাকলে সেগুলোও মিউকর ছত্রাকের প্রবেশপথ হিসেবে কাজ করে। এ ছাড়া দেহের দুর্বল প্রতিরোধ ক্ষমতার সুযোগেও ছত্রাকটি শরীরে প্রবেশ করে ছড়িয়ে পড়তে পারে।

উপসর্গ কী?

নাক বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং নাক থেকে রক্ত পড়া
চোখে ব্যথা এবং চোখ ফুলে যাওয়া
চোখের পাতা ঝুলে পড়া
চোখে ঝাপসা দেখা, যার থেকে পরে দৃষ্টিশক্তি চলে যায়
নাকের চামড়ার চারপাশে কালো ছোপ ছোপ দাগ দেখা দেয়া
জ্বর, কাশি, বুকব্যথা ও শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি
চামড়ায় ফুসকুড়ি বা ক্ষত। আক্রান্ত স্থান কালো হয়ে যাওয়া ও জায়গাটিতে ব্যথা হবে এবং গরম থাকবে। ক্ষতের চারপাশ বেশ ফুলে যাবে।
পরিপাকতন্ত্রে সংক্রমণ হলে পেটব্যথা, বমিভাব ও বমি হয়। পরিপাকপ্রণলীতে রক্তক্ষরণ হতে পারে। যার কারণে কালো পায়খানা ও কফি রঙের বমি হতে পারে।

যাদের রোগ প্রতিরোধ শক্তি কম তাদের দেহে এই ছত্রাক প্রবেশ করে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়তে পারে। তখন ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের লক্ষণ বোঝার উপায় থাকে না। এই ছত্রাক দ্বারা মস্তিষ্ক আক্রান্ত হয়ে রোগী কোমায় পর্যন্ত চলে যেতে পারে এবং মৃত্যুও হতে পারে।

কোভিড-পরবর্তী সময় কেন হয়?

করোনাভাইরাসের আক্রমণে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। করোনার চিকিৎসায় অনেক ক্ষেত্রে উচ্চমাত্রার স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ ব্যবহার করা হয়। স্টেরয়েড দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়।

এছাড়াও ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, হৃদযন্ত্রের বড় অস্ত্রোপচার, কিডনি ও লিভারের অকার্যকারিতা, কিছু বিশেষ রক্তরোগ ইত্যাদি অসুখগুলো দেহের সুরক্ষাশক্তি এমনিতেই কমিয়ে দেয়। তার সঙ্গে করোনা যুক্ত হলে সেটি হয়ে যায় গোদের ওপর বিষফোঁড়া। করোনাক্রান্ত যেসব রোগীকে আইসিইউতে যেতে হয়, তাদের মধ্যে কালো ছত্রাকের সংক্রমণের আশঙ্কা অনেক বেশি।

প্রতিকার কী?

ব্ল্যাক ফাঙ্গাস রোগের চিকিৎসা আছে। অ্যান্টি-ফাঙ্গাল বা ছত্রাকনিরোধী ওষুধ দিয়েই চিকিৎসা করা হয়। সাধারণভাবে কালো ছত্রাকের চিকিৎসার জন্য মলম, খাওয়ার ওষুধ ও ইনজেকশন আছে। করোনা পরবর্তী কালো ছত্রাক আক্রান্তদের প্রায় শতভাগকেই ছত্রাক নিরোধী ইনজেকশনের মাধ্যমে চিকিৎসা দিতে হয়।

প্রধানত যে ওষুধটি ব্যবহার করা হয় সেটির নাম অ্যাম্ফোটেরিসিন-বি। বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি কোম্পানি ওষুধটি প্রস্তুত করে। করোনা পরবর্তী কালো ছত্রাকে আক্রান্তদের একটি বড় অংশের মুখের একদিকে বেশখানিকটা ফুলে যায়। তখন রোগীর মুখমণ্ডলে অস্ত্রোপচারের দরকার হয়। কখনও গাল ও চোয়ালের হাড় কেটে ফেলতে হয়।

পরিসংখ্যান বলছে, কালো ছত্রাকে আক্রান্ত রোগীর শতকরা ৫০ ভাগই মারা যায়। তবে রোগটি যদি প্রথমদিকে শনাক্ত করা যায় তবে মৃত্যুর হার কিছুটা কমিয়ে আনা সম্ভব।

কোভিড-১৯ থেকে সেরে ওঠা রোগীর নাকবন্ধ, মাথাব্যথা, মুখ-গাল ফুলে যাওয়া এবং নাক দিয়ে শুকনো কালো শ্লেষ্মা বের হলে তৎক্ষণাৎ তাকে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস রোগী হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। অতিদ্রুত নাক দিয়ে আসা কালো পদার্থটি বায়োপসি করে চিকিৎসা শুরু করতে হবে।

মুম্বাইয়ের ডায়াবেটিসের চিকিৎসক ডা. রাহুল বক্সি বলছেন, ‘এই ছত্রাক সংক্রমণ এড়ানো একমাত্র সম্ভব কোভিড-১৯এর রোগীর চিকিৎসার সময় এবং তার সুস্থ হয়ে ওঠার সময় যদি নিশ্চিত করা যায় তাকে সঠিক পরিমাণ স্টেরয়েড দেয়া হচ্ছে, সঠিক সময় ধরে।’

ব্যাঙ্গালোরে তিনি তার দুই দশকের চিকিৎসা জীবনে বছরে কখনও একটা বা দুটোর বেশি কেস দেখেননি বলে হানান ডা. হেগড়ে। তিনি বলেছেন, ‘এই ভাইরাসের ধরনটা আরও প্রাণঘাতী বলে মনে হচ্ছে। এতে রক্তে শর্করার মাত্রা খুবই বেড়ে যাচ্ছে। আর সবচেয়ে উদ্বেগের ব্যাপার হল আক্রান্ত অনেক তরুণ।’

সাবধানতা অবলম্বন করবেনযেভাবে:

করোনাক্রান্ত রোগীদের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে যত্নবান হতে হবে। এক্ষেত্রে স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধের ব্যবহারে সতর্ক হতে হবে। আইসিইউতে থাকা করোনা রোগীর কোনও দৃশ্যমান কারণ ছাড়া অবস্থা খারাপ হতে থাকলে তখন অবশ্যই কালো ছত্রাক রোগের কথা বিবেচনায় নিতে হবে। সে অনুযায়ী পরীক্ষাও করাতে হবে।

এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে কোভিড-১৯ পরবর্তী কোনও রোগীর ব্ল্যাক ফাঙ্গাসে আক্রান্ত হওয়ার খবর জানা যায়নি। তবে ভারতের অবস্থা দেখে আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে আমাদের সাবধান থাকার বিকল্প নেই। করোনা-নিবেদিত প্রতিটি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান ও আইসিইউর ‘সংক্রমণ নিরোধী প্রটোকল’ বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে। – সূত্র বাংলা ট্রিবিউন

সংবাদ সূত্র: বিবিসিবাংলা ও বাংলা ট্রিবিউন থেকে সংগ্রহিত।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!