’সন্ধ্যা নদীর জলে’ ও কবি শঙ্খ ঘোষ

সুশান্ত ঘোষ
সুশান্ত ঘোষ
5 মিনিটে পড়ুন
ছবি সংগৃহিত

সন্ধ্যানদী। বাংলাদেশের বরিশাল জেলার অন্যতম প্রধান নদী। কবি শঙ্খ ঘোষের নাড়ি ছেঁড়া নদী। নিজ পৈতৃক বাড়ি বরিশালের বানারীপাড়া ছুঁয়ে আছে এই নদী। কবি এখানে ফিরে আসতে চেয়েছিলেন। বরিশালের কাউকে দেখলেই সন্ধ্যা নদীর জলে ফিরে আমার আকুতির কধা জানিয়েছিলেন। ১৯৯৭ সালে কবির নিজ গ্রামে ফিরে আসার উপর লিখেছিলেন এক ভ্রমন কাহিনী ‘সন্ধ্যা নদীর জলে।’ প্রথমা প্রকাশন ২০১৯ সালে বইটি বের করেছে। বইটির পরতে পরতে কবি তার দেখা সন্ধ্যা নদীকে তুলে এনেছেন বারংবার।

১৯৯৭ সালে কবির এই নিজগ্রাম দেখার সময়ে উপস্থিত ছিলেন সে সময়ের বানারীপাড়া হাই স্কুলের ছাত্র, বর্তমানে সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত সুজন হালদার। তিনি জানান আমরা দেখেছি কবিকে খালধরে নৌকায় সিনেমা হল সংলগ্ন জায়গায় নামতে, পরে তিনি নিজ ভিটা বাড়ি সহ বানারীপাড়ার স্মৃতিময় জায়গা ঘুড়ে দেখেন। এখন যেখানে আওয়ামী লীগ নেতা মঞ্জু মোল্লার বাড়ি সে সংলগ্ন স্থানেই কবি নিজ ভিটা বাড়ির অবশেষ খুঁজে পান। যাওয়ার সময়ে তিনি নিজ ভিটাবাড়ির মাটি নিয়ে যান। পরে গত বছর মার্চ মাসে তার সাথে কফি হাউসে আবার দেখা হয়। সে সময় তিনি জানান শরীরটা যদি একটু সুস্থ হয়, তাহলে আবার বানারীপাড়া যেতে চাই।’

সুজন নিজ ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন,
অন্তিম প্রনতি কবি শঙ্খ ঘোষ।।।
বানারীপাড়ায় (বরিশাল) কবি শঙ্খ ঘোষের বাড়িতে
‘কবি শঙ্খ ঘোষ স্মৃতি জাদুঘর’ প্রতিষ্ঠার দাবি জানাচ্ছি।

েহরো ’সন্ধ্যা নদীর জলে’ ও কবি শঙ্খ ঘোষ
’সন্ধ্যা নদীর জলে’ ও কবি শঙ্খ ঘোষ 39

গতবছর বাংলা একাডেমিতে কবির লিখিত ভাষণ পাঠ করেন রামেন্দু মজুমদার। সেখানেও লিখিত ভাষণের পরতে পরতে কবি নিজ পৈত্রিক ভিটা বিশেষ করে সন্ধ্যা নরদীতে ফিরে আসার আকুতি জানান।

কবির মৃত্যুর পরে নিজ ফেইসবুক স্ট্যাটাসে কবি টোকন ঠাকুর লেখেন ‘কথা ছিল, আবার দেখা হবে, এক সঙ্গে বরিশাল যাব..’
কবি নিজেই ’সন্ধ্যা নদীর জলে’ স্মৃতি কথায় বিধৃত করেছেন-
‘‘ সন্ধ্যা ১৯৯৭
মাইলফলক দেখেই যে এত রোমহর্ষণ হয়, তা কে জানত। পঞ্চাশ ঠিক পঞ্চাশ বছর পরে চলেছি নিজের গ্রামে। বরিশাল শহর থেকে পাকা রাস্তা ধরে গাড়ি চলছে, আর ভাবছি এভাবে কি কখনও গিয়েছি আগে দেশের বাড়িতে? আমাদের তো বাহন ছিল নৌকা, আমাদের তো পথ ছিল খাল -বিল। কীর্তনখোলা, কীর্তিনাশা, কালিজিরা খালের মধ্যে দিয়ে দেশের বাড়ি।

থামল গাড়ি নদীর ঠিক সামনে। হ্যাঁ, ওই তো বাজার। এক ঝাপে নেমে পড়ি। সঙ্গীদের পিছনে রেখে ছুটে যাই জলের একেবারে সামনে। সকাল বেলার আলোয় ঝলমল করছে সন্ধ্যা নদীর জল। ষ্টিমারঘাটা এখন এখন আর নেই। আছে শুধু সারবাধা নৌকা। তারই মধ্যে এক নৌকায় উঠতে গিয়ে থমকে দাড়ান এক বৃদ্ধ। মাঝিরাও তাকিয়ে থাকে, জানতে চায় আমি কি ওপারে যেতে চাই?…
এই নদী অনেক অনেক আত্মীয় নদী। এর কোনও ভাঙন-উল্লাস নেই পঞ্চাশ বছর জুড়ে একই জায়গায় স্থির থাকতে পারে এর তীর।’’
গোটা গ্রাম ঘুরে ফিরে আসেন তিনি এক স্মৃতিময়তা নিয়ে- আসার সময়ে নিজভিটার মাটি নিয়ে যাত্রা করেন।

‘‘চারঘন্টা গোটা গ্রাম পায়ে হেটে বেড়বার সেই সময়টা জুড়ে এক মুহুর্তও আর আমাদের সঙ্গ ছাড়েনি জব্বর। এমন নয় যে তিনি পথ পরিচায়কের কাজ করছিলেন। সে কাজ কাউকেই করতে করতে দিইনি আর। পশ্চিমে ষ্টীমারঘাটের সেই বিন্দু থেকে শুরু করে একেবারে পূবপ্রান্তে আমাদের ছেড়ে-আসা বাড়িটা পর্যন্ত প্রত্যেক কোন আমার চেনা, পড়ে আছে যেন সেই পুরোনো চেহারায়, কিছু বা ভগ্নাবশেষ হয়ে। এক যে বিন্দুতে বিন্দুতে চিনি আমি। সবারই আগে আগে চলে সেটা বোঝাতে চাইছিলাম। তবু জব্বর আমাকে ছুঁয়ে থাকলেন ঠিক সেইরকমই আলতোভাবে, সন্ধ্যানদী যেভাবে ছুঁয়ে আছে আমাদের গ্রাম।’’

সন্ধ্যা নদীর জলে ছুয়ে যাওয়া এই কবি অসুস্থ ছিলেন কিছুদিন ধরেই। ১৪ এপ্রিল তার কোভিড-১৯ সংক্রমন প্রথম ধরা পড়ে। বুধবার সাড়ে ১১ টায় নিজ বাসায় ৮৯ বছর বয়সে তিনি পরলোকগমন করেন।

শঙ্খ ঘোষের আসল নাম চিত্তপ্রিয় ঘোষ। পিতা মণীন্দ্র কুমার ঘোষ, মাতা অমলা ঘোষ। ১৯৩২ সালের ৫ ফ্রেবুয়ারী তিনি বাংলাদেশের চাদপুর জেলায় জন্মগ্রহন করেন। তার পৈতিৃক বাড়ি ও শৈশব বরিশালের বাণারীপাড়ায় কাটলেও পড়াশুনা করেছিলেন পরবনার চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠে। এখান থেকেই ম্যাট্রিকুলেশন, ১৯৫১ সালে প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে বাংলায় স্নাতক ও কলকাতা বিকশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকত্তোর ডিগ্রী লাভ করেন। কর্মজবনে শঙ্খ ঘোষ যাদবপুর ও বিশ্বভারতীতে অধ্যাপনা করেন ও যাদবপুর থেকেই ১৯৯২ সালে অবসর নেন।

কবি শঙ্খ ঘোষ শুধুমাত্র নির্বিবাদে কবিতা লিখে যান নি, সময়ের প্রয়োজনে সোচ্চার হয়ে উঠেছিল তার কলম। বিশেষ করে নন্দীগ্রামে গুলির ঘটনায়, ভারতের নাগরিকত্ব বিরোধী আন্দোলনে, কিংবা ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে বার বার কলম ধরেন তিনি। তার কাব্য সত্তার মাঝেই প্রতিবাদীর সত্তার এক অপূর্ব যুগলবন্ধী। ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’ ’গান্ধর্ব কবিতা গুচ্ছ’ ’বাবরের প্রার্থনা’ জন্মদিনে’ ‘আড়ালে’‘সবিনয়ে নিবেদন’ ‘দিনগুলি রাতগুলি’ তার কবিতাগ্রন্থ।

এ ছাড়াও ‘শব্দ আর সত্য’ উবশীর হাসি’ ’ এখন সব অলীক’ তার প্রবন্ধ গ্রন্থ‘ ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথ’ রবীন্দ্র বিষয়ে তার গবেষণা গ্রন্থ। ১৯৭৭ সালে সাহিত্য আকাদেমি পুরষ্কার, রবীন্দ্র পুরষ্কার, সরস্বতী সম্মান, জ্ঞানপীঠ পুরষ্কার, ১৯৯৯ সালে বিশ্বভারতীর দেশিকোত্তম সম্মান ও ২০১১ সালে ভারত সরকারের পদ্মভূষণ সম্মানে সম্মানিত হন এই কবি।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
সাংবাদিক, গবেষক ও সাংস্কৃতিক কর্মী
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!