আদিবাসী ছড়া ও ছড়ার চিত্রকল্প

অনিন্দ্য বড়ুয়া
অনিন্দ্য বড়ুয়া
7 মিনিটে পড়ুন


অ আ ক খ এর বাংলাদেশে সুপ্রাচীন কাল থেকে বাঙলা ভাষার পাশাপাশি প্রায় ৪০টি ভাষা লালিত হচ্ছে বাংলাদেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মুখে মুখে। কোন কোনটির আছে আবার লিখিত রূপ।স্বাভাবিক ভাবেই সব ক’টি ভাষায় সৃষ্টি হয়েছে; বিকশিত হয়েছে লোকজ ছড়ার। বাংলা ভাষার আঞ্চলিক-ভাষা বা উপ-ভাষায় সৃষ্ট ছড়ার সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। ছড়ার জন্ম হয়েছে আধো আধো বোল শেখা বা না-শেখা শিশুর হৃদয়কে ছন্দের দোলায় দুলিয়ে ঘুম পাড়ানোর জন্যে, প্রতিপক্ষকে ভিন্ন পথে ব্যঙ্গ করার জন্য; উত্ত্যক্ত করার জন্য, ঠাট্টা করার জন্য। রাজনৈতিক কারণে সৃষ্ট দুরবস্থার চিত্র তুলে ধরার কাজেও হয়েছে ছড়ার সার্থক ব্যবহার। পরবর্তীতে ছড়া প্রেম, রাজনীতি, সমাজ, বিদ্রোহ, শোক, প্রশংসা, স্তুতি সহ আরো সব নতুন নতুন বিষয়কে ধারণ করে সমৃদ্ধ হয়ে উঠলেও প্রেমানুভূতিকে ধারণ করায় এগিয়ে ছিলো আদিবাসী লোকজ ছড়া। নীচের তঞ্চঙ্গ্যা ভাষার লোকজ ছড়াটিতে তার কিছুটা ছোঁয়া আমরা পেতে পারি-

‘তঞ্চঙ্গ্যা’
জুম ঘরত চাইর কাইত
চলাহ চনাহ ফুলর বাইচ্
ভঙরায় গত্ন গুন্ গুন্ গুন্
চুষতন্ রেণু ফুলত্তুন্
রু রু রু বাঁশি তালে তালে
খেংখ্রন বা-দন তার তালে
পুনং চানান আকাশ্যত ঘুম নাই আচ্যা
লাঙ্যাআ লাঙনি চুগত।

‘বাংলা’
মৌ মৌ মৌ ফুলের সুবাস
জুমের চারি পাশে
গুন গুন গুন গুঞ্জে ভ্রমর
ফুলের লোভে আসে,
রু রু রু বাঁশি বাজে
খেংখ্রন বাজে সাথে
ঘুমায় না আজ দম্পতিকুল
পূর্ণিমা চাঁদ রাতে।

চাকমাভাষায় খেংঘ্রং, তঞ্চঙ্গ্যাভাষায় খেংখ্রন, মার্মাভাষায় খ্রেংখ্রং উচ্চারিত হলেও অনুবাদে চাকমাভাষার খেংঘ্রং শব্দটি বেছে নিয়েছি। বাঁশের ক্ষুদ্র ফালির মাঝখানটায় চিড়ে জিভের মতো অংশ সৃষ্টি করে সুতোর টানে বাজানো নিনাদি বাদ্য যন্ত্রটি চাকমাভাষার খেংঘ্রং নামেই বাঙালি মহলে অধিক পরিচিত।

অন্য অনুসঙ্গ থাক বা না থাক প্রতিটি আদিবাসী ভাষায়, বাংলাভাষার প্রতিটি উপভাষায় ঘুমপাড়ানী লোকজ ছড়ার খোঁজ পাওয়া যাবেই। এ যেন মাতৃদুগ্ধের মতোই শিশুর আরেকটি অনুচ্চারিত দাবী। প্রত্যেক ভাষার ঘুমপাড়ানী ছড়ার মতোই ত্রিপুরা ভাষার ছড়াটিতে মিশে আছে তাঁদের নিজস্ব প্রতিবেশের চিত্রকল্প-

‘ত্রিপুরা’
মাখাং কোয়ার মাসা-মা
খাস্ত্র মাথাং আমিং-মা
খিতং না লৈ তা ফাইদি
আনি ককই থুননি
ওয়ায়িং-রা চক্ খাচিজাক্
রুফাই বুদোক্ দা-রগ
আনি ককই থুতিজাক্
এমা রাইজ্য বিছিংগ
সিবাই সিবাই নাল্জাকগৈ
আনি কহহ থু নানি
কুসুম মাথাং আমি মা
মুখপ্রে মাথাং মাসা-মা
খিতং নালৈ তা-ফিইদি।

‘বাংলা’
বিশালমুখি বাঘিনী তুই
দেখাস নারে তেজ
পোড়ামুখি বিড়ালী তুই
নাড়িস না তোর লেজ,
দুলছে সোনার দোলনাখানা
রূপার দড়িতে
ঘুমের ঘোরে খোকা গেছে
স্বপ্ন পুরিতে,
দুদুল দুদুল দোলনা দোলে
খোকন আছে ঘুমের কোলে;
বিশালমুখি বাঘিনী তুই
দেখাস নারে তেজ
পোড়ামুখি বিড়ালী তুই
নাড়িস না তোর লেজ।

বাংলার ছড়া-/খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো/ বর্গি এলো দেশে/ বুলবুলিতে ধান খেয়েছে/ খাজনা দেব কীসে / অথবা–/তেলের শিশি ভাঙলো বলে/ খুকুর ‘পরে রাগ কর/ তোমরা যারা বুড়ো খোকা/ ভারত ভেঙে ভাগ কর/ তার বেলা, তার বেলা?/ সহ অনেক ছড়া যেমন ঐতিহাসিক সময় এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে ধারণ করে আছে, আদিবাসী ছড়াতেও আছে অনুরূপ ছড়ার দীপ্ত উপস্থিতি। বরং বলা যায়, বাংলা সাহিত্যেই সমকালীন রাজনীতিকে ধারণ করা ছড়ার প্রেক্ষাপটটি তাদের তুলনায় নবীন। আরাকানী (রাখাইন), চাকমা, ত্রিপুরা, মার্মা (মগ) বাঙালি তথা মোগলদের মধ্যে বর্তমান আরাকান রাজ্য থেকে ঢাকা পর্যন্ত (ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য সহ) বিস্তৃত অঞ্চল নিয়ে দখল-বেদখলের লড়াই চলেছে সুদীর্ঘকাল। দুই ভাইয়ের রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণে বিভক্ত চাকমারা কোন কোন সময় বিজয়ী হলেও শান্তিতে ঘরে থাকতে পারতো না মগ/আরাকানীদের লুট-তরাজ আর ঝটিকা আক্রমণের মুখে। এক সময় চাকমারা বিজিত আরাকান ছেড়ে স্বদেশভূমি ফিরে যেতে ইচ্ছুক হয়, তখন তাদের পুতুল-নেতা ছিলেন সম্ভবত একজন নবদীক্ষিত বৌদ্ধ-শ্রামণ– যাদের বর্মী আরাকানী সহ বেশ কয়েকটি আদিবাসী ভাষায় ‘মৈসাং‘ বলা হয়। সেই নেতা সম্ভবত নিমরাজি ছিলেন ফিরে যেতে, যা আমাদের জানিয়ে দেয় নীচের চাকমা ছড়াটি-

‘চাকমা’
চল্ বাবভেই যে যে যে
চম্পক নগরত ফিরি যে,
এরে মৈসাং লালস নেই
ন এলে মৈসাং কেলেশ নেই।
ঘরত থেলে মগে পায়
ঝাড়ৎ গেলে বাঘে খায়।
মগে ন পেলে বাঘে পায়
বাঘে ন পেলে মগে পায়।

‘বাংলা’
চল্ বাপ-ভাই চলে যাই
চম্পক নগর ফিরে যাই
এলে শ্রামণ ক্ষতি নেই
না এলে শ্রামণ ক্লেশও নেই।
থাকলে ঘরে মগে পায়
লুকালে ঝাড়ে বাঘে খায়।
মগে না পেলে বাঘে পায়
বাঘে না পেলে মগে পায়।

উদ্বেগাকুল বিরূপ পরিস্থিতিতে মানুষ ছড়া আওরাতে পারে কি না বা নতুন ছড়ার জন্ম দিতে পারে কি না তা ভাবার বিষয়। বিরূপ পরিস্থিতিতে ছোট ভাই বোনের দায়িত্বে থাকা নিবেদিত কোন লুসেই কিশোরী সুরে-মিত্রাক্ষরে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে হয়তোবা সৃষ্টি করেছিলো নীচের ছড়াটির প্রথম দুটি বা চারটি লাইন, পরবর্তীতে তার সাথে কথার পিঠে কথা; ছন্দের পিঠে ছন্দ যুক্ত হয়ে তাদের লোকজ সাহিত্যে যুক্ত হয়েছে একটি পূর্ণাঙ্গ মুক্তোমালা-

‘লুসেই’
Kanu Kapa
Lo Haw Thuai Thuai Rawh
T Tlangah Ruahpcci A Sure,
Lenngi A Tape
Tolengi A Tape
Ka Mumang Mang
Chu Ni Sela
Ka Zuk Auna Ruai Ruai
Tru Che.

‘বাংলা’
মা বাবাগো তাড়াতাড়ি
ফিরে এসো ঘরে
পাহাড়জুড়ে আজতো বেশি
বৃষ্টি বাদল ঝরে।
ছোটভাই বোন লেঙলি-লোরেঙ
কাঁদছে মাগো কাঁদছে
ঘুরে ঘুরে এ’ঘর ও’ঘর
তোমরা কোথায় খুঁজছে,
এসব যদি মিথ্যে হতো
স্বপ্ন দেখার মতো
ডেকে দিতাম উঁচু গলায়
দূরে থাকো যতো।

দরিদ্র প্রতিবেশীদের সন্তাদের উপর ধনীর দুলালদের অকারণ ঈর্ষাপ্রসূত অনাচারের চিত্রকল্প ফুটে উঠেছে ম্রো ভাষার ছোট্ট ছড়াটিতে, ছড়াটির চিত্রকল্প উপমহাদেশের যে কোন প্রান্তেই খুব বেশি চেনা বলে ছোট হলেও এর করুণ আবেদনের ব্যাপ্তিটি বিশাল-

‘ম্রো’
আওয়া ওয়াং মাং বদ বদ
আপা-অ-ওয়াংমাং বদ বদ
ম্রো কুরেং কুরাই চাওয়া
ওয়াং কোরাক কিমখুং
কিমবেত খাই খাই।

‘বাংলা’
মা বাবাগো ফিরে এস
তোমরা ত্বরা করে
বড় লোকের ছাওয়ালগুলো
ঢিল ছুঁড়ছে ঘরে।

একটা কথা/ ব্যাঙের মাথা/ কী ব্যাঙ?/ কোলা ব্যাং, অথবা /ওটা কে রে?/ আমি; খোকা/ মাথায় কী রে?/ আমের ঝাঁকা/, অথবা /মনারে মনা কই যাস?/ বিলের ধারে-কাটব ঘাস/, বাংলা ছড়ায় এরকম প্রশ্ন-উত্তর সহযোগে কৌতুকাবহ ছড়া অনেক আছে। খুমি আদিবাসীদের ছড়াটাতেও দেখা যাচ্ছে একই আবহ এবং ধারা-

‘খুমি’
A Low Ma Mo?
Toma Mow Ke Wing Bo
Toma Low Ma Mo?
Thlng Kleing Mow Teowing Bo.
Thing Kleing Ma Mo?
Mai Now Kaing Wing Bo.
Mai Low Ma Mo.
Kasai Amseing Mow-
Low Hai Wing Bo.
Kasai Amseing Low Ma Mow?
Twi Mow Low Hai Wing Bo.

‘বাংলা’
মুরগি কোথায় মুরগি কোথায়?
বনবিড়ালে খেয়েছে।
বিড়াল কোথায় বিড়াল কোথায়?
গাছে চাপা পড়েছে।
মরা গাছটি কোথায় তবে?
আগুন লেগে পুড়েছে।
আগুন কোথায়? আগুন কোথায়?
আগুন নিভে গিয়েছে;
শুড়ে ভরে পানি এনে হাতি পানি ঢেলেছে।
হাতির বুকের শুঁড় গেল কই?
জলে ভেসে গিয়েছে।

চাক-ভাষার একটি ঘুমপাড়ানী ছড়া দিয়ে শেষ করব আজকের আদিবাসী ছড়ার কথা-

‘চাক’
আদিছা আদিছা য়েং য়েং
মালা মালা নাং ইকয়েং।
লাংহে ঝিয়া নাংগা আবা
টাবাংপি ছাগো প্যগা।
ঙাগা আদিছা শেকাহে
ঙাগা আদিছা কানাং হি।
ন্যাংগা আঈ নাংগা আ-উ রাট লাংগা
তাবাইংপি,বংলুং নাবা লাইঙবা।
আদিছা প্রংনেং স্কুয়া লংগা।
পুজু অনেঙ টুগো স্কুয়া লংগা।

‘বাংলা’
সোনামনি য়েংয়েং তুমি
জলদি পড়ো ঘুমিয়ে
তোমার বাবা হাটে গেছে
আসলে দেবো জাগিয়ে।
দেখবে জেগে তোমার জন্যে
খাবার নিয়ে এসেছে
লক্ষ্মীসোনা চাঁদের কণা
ঘুমের দেশে গিয়েছে।
আসবে তোমার দাদা-দাদী
মজার জিনিস নিয়ে
বল বিস্কিট যা চাও তুমি
সবই যাবে দিয়ে।
আমার সোনা বড় হলে
ঘুরতে কোথায় যাবেরে
স্কুলেতে গেলে সোনা
নতুন জামা পাবেরে।

কৃতজ্ঞতা স্বীকার:-
‘মিলিং- পাহাড়ের লোককথা ও ছড়া’- টংগ্যা
সুরেন্দ্রলাল ত্রিপিুরা (লেখক)
বরেন ত্রিপুরা (লেখক)
প্রদীপ চাকমা (সহকর্মী)

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
অনুসরণ করুন:
লেখক, গবেষক
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!