সমস্যা মেয়েদের পোশাকে, নাকি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে!

অতিথি লেখক
অতিথি লেখক
5 মিনিটে পড়ুন

বাংলাদেশে যেসব মেয়ে ঘরে বা ঘরের বাইরে যৌন হয়রানির শিকার হন, তাদের একটা বিরাট অংশই সেটা মুখ বুঁজে সয়ে যান। কিন্তু অবস্থা পাল্টাচ্ছে। অনেক মেয়েই এখন সংকোচ ঝেড়ে ফেলে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদের পথ বেছে নিচ্ছেন, এমনকি উত্ত্যক্তকারী পুরুষকে হাতে-নাতে ধরে নাকালও করছেন। এরকম কয়েকজন নারীর সঙ্গে কথা বলে নিচের প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।

প্রতিদিনের মতো কারওয়ান বাজারের অফিসে দিনের কাজ শেষে বাসে চেপে বাড়ি ফিরছিলেন সিরাজুম মুনিরা। বাসে নিত্যদিনের মতো সেদিনও বেশ ভিড়। সেই ভিড়ের মধ্যে সেদিন এক ভয়ংকর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হলেন তিনি।

”আমি কিছুদূর যাওয়ার পর হঠাৎ করে অনুভব করছিলাম, আমার শরীরের পেছনের স্পর্শকাতর অংশে শক্ত কিছু এসে লাগছে। প্রথমে ভেবেছিলাম আমার পেছনের যাত্রীর হাতে হয়তো ফাইল জাতীয় কিছু আছে, যেটা আমার গায়ে লাগছে। অনেক ভিড় ছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম না। বার বার সরে যাচ্ছিলাম।”

ব্যাপারটা ভালো করে বোঝার জন্য মুনিরা ঘুরে দাঁড়ালেন। দেখলেন, সুবেশী এক মানুষ, চোখে রিমলেস চশমা। এই মানুষটি এতক্ষণ তার পুরুষাঙ্গ ঘষছিলেন তাঁর পেছনে। মুনিরা ছেড়ে দেবার পাত্র নন। তিনি প্রতিবাদ করলেন। কিন্তু বিস্ময়ের সঙ্গে দেখলেন, উল্টো তাকেই দুষছেন লোকটি।

যে লোকটা আমার সঙ্গে এ রকম একটা কাণ্ড করলো, সে উল্টো দাবি করতে লাগলো যে আমিই নাকি তাকে উত্তেজিত করেছি। কিন্তু একটু দূরে বসা অন্য দুজন যাত্রী ব্যাপারটা দেখেছেন। তারা আমার পক্ষে সাক্ষী দিলেন। এই দুজন আমার পক্ষে দাঁড়ানোর পরই কেবল বাসের অন্য যাত্রীরা বিশ্বাস করলেন যে ওই সুবেশি লোকটি আমাকে উত্ত্যক্ত করছিল।

ঢাকায় গণপরিবহনে যে মেয়েদের চলাচল করতে হয়, তাদের সবার কম-বেশি এ রকম অভিজ্ঞতা আছে। কারওয়ান বাজারে সিরাজুম মুনিরার অফিস থেকে বেরিয়ে আমি উঠে পড়ি মতিঝিলগামী এক বাসে। সামনের দিকে মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসনে তিন মহিলা যাত্রী। পুরো বাসে আর সব পুরুষ যাত্রী।

পুরুষ যাত্রীর ভূমিকা

বাসের ভেতর যখন নারী যাত্রীদের এ রকম যৌন হয়রানির শিকার হতে হয়, তখন সহযাত্রী পুরুষরা কি করেন? ”আমি সব সময় প্রতিবাদ করার চেষ্টা করি, বাধা দেওয়ার চেষ্টা করি,” বললেন এক তরুণ যাত্রী।

মেয়েরা এ রকম ঘটনার শিকার হলে যখন প্রতিবাদ করেন, তখন কিন্তু অন্যান্য যাত্রীরা তার সঙ্গে প্রতিবাদে সামিল হন, দাবি করলেন আরেক পুরুষ যাত্রী।

কিন্তু তৃতীয় পুরুষ যাত্রী এ রকম ঘটনার দায় চাপালেন মেয়েদের ওপরই। ”মেয়েরা কেমন পোশাকে ঘুরছে, সেটা তাদের খেয়াল রাখতে হবে। এটা তো বিদেশ নয়, বাংলাদেশ। তারা কেন বাংলাদেশে এমন পোশাকে ঘুরবে?”

সমস্যা আমাদের পোশাকে নয়, পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে, জোরালো প্রতিবাদ জানিয়ে বললেন দুই নারী যাত্রী। আমি বৃদ্ধ লোককেও দেখেছি মেয়েদেরকে উত্ত্যক্ত করতে, ক্ষোভের সঙ্গে বললেন একজন।

”বাসে একটু বেশি ভিড় থাকলেই ইচ্ছে করে এসে ধাক্কা দিয়ে গায়ে পড়ে। তখন বলে যে বাস ব্রেক করায় ধাক্কা লাগছে,” বললেন অপরজন।

বোরকায় সুরক্ষা?

বাসে উঠলেন এক বোরকা পরা নারী। তার কণ্ঠে শোনা গেল একেবারেই ভিন্ন ভাষ্য। ”আমরা মেয়েরা যদি উচ্ছৃঙ্খল আর খোলামেলা পোশাক পরি, তাহলে ছেলেরা এ রকম করতেই পারে। আমরা যদি ধর্মীয় বিধান মেনে পোশাক পরতাম, চলাফেরা করতাম, তাহলে এ রকম ঘটতো না।”

প্রতিবাদী নারী

রাস্তাঘাটে এ রকম ঘটনার শিকার যারা হন, তাদের অনেকেই লজ্জায় মুখ বুঁজে সয়ে যান। কিন্তু অবস্থা পাল্টাচ্ছে, অনেক মেয়েই এখন প্রতিবাদ করছেন, প্রতিরোধেও পিছপা হচ্ছেন না।

শিক্ষার্থী লাভলি আক্তার এ রকম এক অভিজ্ঞতার কথা শোনাচ্ছিলেন আমাকে।

”একদিন রাস্তার পার হওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ দেখি বাসের দরোজায় ফর্মাল কাপড়-চোপড় পরা এক পুরুষ আমাকে জিহ্বা দেখিয়ে কুৎসিত ইঙ্গিত করছে, ইশারা করে আমাকে তার সঙ্গে যেতে বলছে। আমি একটু ভাবলাম, তারপর এগিয়ে গিয়ে তার কলার চেপে ধরলাম। তাকে মারতে শুরু করলাম। বাস চলছে, তার মধ্যে আমি এই লোকটাকে পেটাচ্ছি।”

লাভলির মতো আরও অনেকেই এখন প্রতিবাদী হচ্ছেন, কিন্তু তাদের সংখ্যা হাতে গোনা, বলছেন ‘ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান রোকসানা সুলতানা। শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে কাজ করছেন তিনি।

”আমরা কেবল ধর্ষণকেই কেবল যৌন নির্যাতন বলে গণ্য করি। কিন্তু মেয়েরা যে আরও কতরকমের যৌন নির্যাতনের মুখোমুখি হন, টাচিং, ফন্ডলিং, যৌনাঙ্গ দেখানো, যৌনাঙ্গ স্পর্শ করা—-এগুলোও তো যৌন নির্যাতন। কিন্তু কেউই আমরা এগুলো নিয়ে কথা বলি না লোকলজ্জার ভয়ে।”

”মুখ বুঁজে সয়ে গেলে এর কোন সমাধান নেই, প্রতিবাদে সোচ্চার হলেই কেবল এর প্রতিকার সম্ভব,” বলছেন রোকসানা সুলতানা।

শায়লা রুখসানা, বিবিসি বাংলার সৌজন্যে

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
অনুসরণ করুন:
সাময়িকীর অতিথি লেখক একাউন্ট। ইমেইল মাধ্যমে প্রাপ্ত লেখাসমূহ অতিথি লেখক একাউন্ট থেকে প্রকাশিত হয়।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!