প্রতিক্ষার সমাপ্তি

অতিথি লেখক
অতিথি লেখক
9 মিনিটে পড়ুন

আমাদের দুজনেরই বাড়ি একই গ্রামে। আমাদের বাড়ি থেকে তমাদের বাড়ির দূরত্ব এক কিলোমিটারের বেশি না হলেও হাফ কিলোমিটারের বেশি তো হবেই। আজ থেকে প্রায় ৮-৯ বছর আগেই তমাকে বড্ড ভালো লেগেছিলো। তমা তখন আমাদের বাড়ির পাশেই একটা সংগীত একাডেমিতে সংগীত চর্চা করতো বা গান শিখতো । তখন তমার একটা যৌথ গানের এ্যালবামও বের হয়েছিলো । তমার মায়াবী চাহনি, মধুমাখা কন্ঠই মূলত আমাকে মুগ্ধ করে। ভালো লেগে যায় তমাকে, ভালো লাগে তমার প্রতিটি সক্রিয়তা। মজার ব্যাপারটি হলো, তমাকে এতোটা ভালো লাগলেও কখনই সেটা তাকে বলা হয়ে উঠেনি। না বলার কিছু কারনের একটি ছিলো, তমা তখন সবে মাত্র ক্লাস এইটের ছাত্রী। ওকে এসব বললে নির্ঘাত খালাম্মাকে বলে দিবে অথবা ভাইয়াকেও বলে দিতে পারে, এমন আশংকায় আর ভালোলাগার ব্যাপারটি তখনোও জানানো হয়নি। নিজের মাঝেই চেপে রেখেছিলাম। তমার একটা ভাইয়া আমার বন্ধু হওয়ায়, প্রায় সময়ে ওদের বাড়িতেই চলতে থাকতো আমার আনাগোনা । যতোটা সময়ে ওদের বাড়িতে আমার থাকা হতো, পুরোটা সময়ে আমার চোখ দুটো খুঁজে বেড়াতো শুধুই তমাকে ! তখন তমার দেখা পাওয়াটাই যেন ছিলো দু’চোখের একমাত্র চাওয়া। তমার সাথে আমার তেমন একটা কথা-বার্তা হতো না। যতোটুকুই বা হতো, সেটা ওই ‘কেমন আছেন ভাইয়া?’ বা ‘তুমি কেমন আছো?’, অথবা, ‘তোমার পড়ালেখা কেমন চলছে?’ এই টাইফের টুকটাক সামান্য কিছু সহজ-স্বাভাবিক টুকরো কথা । তমার সাথে হওয়া এই টুকরো কথোপকথন গুলোই যেন, আগামী কয়েক দিনের জন্য আমার হৃদয়ের ভালোলাগার সম্বল হয়ে জমা থাকতো । তমাকে অনেক কিছু বলতে চাইতাম, কিন্তু কেন জানি কিছুই বলতে পারতাম না, শুধু ঐ দূর থেকেই ভালোবাসতে পারতাম।  আর এভাবেই আমার একতরফা ভাবে ভালোবাসা চলতে লাগলো । ওকে নিয়ে স্বপ্ন বুনতে থাকলাম হৃদয়ের গভীরে। তমাকে একপলক দেখার জন্য চোখ দুটো যেন উদগ্রীব হয়ে থাকতো সারাটা  সময়ে! তমার গাওয়া গান গুলো আমার হৃদয়ে প্রতিটিক্ষণ দোলা দিতো । সেই তমা এখন খুলনা মেডিকেল কলেজের স্টুডেন্ট, সে আমাদের ভবিষ্যৎ ডাক্তার। তার তুলনা সে শুধুই নিজে । অলিখিত ভাবে আমাদের মাঝে তখন থেকে বর্তমান অনেক দিনের জন্য দূরত্বের সৃস্টি হয়ে যায় । মনের গহীনে তমাকে স্থান দিলেও জীবনে চলার পথের ব্যস্ততায় এতোটাই মগ্ন ছিলাম, যে তমার সাথে তেমন আর নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করা হয়নি। এই ক’টা বছর তমাকে নিয়ে স্বপ্নে বিভোর থাকলেও, সেই তমার থেকে দূরে থাকা হয়েছে ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে । অবশেষে মাত্র কিছুদিন আগে ফেইসবুকের কল্যাণে আবারও তমার সাথে সখ্যতা গড়ে উঠে । এর মধ্যে এতোগুলো বসন্ত পার হলো, তমা তার পড়ালেখায়, নিজস্ব সৃষ্টিশীল বৈশিষ্ঠ্যে আর যোগ্যতায় যেমন সবার দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম হয়েছে, তেমনিভাবে রূপে-লাবণ্যে ঠিক যেন ডানাকাটা পরীতে পরিনত হয়েছে। এখন তমাকে দেখলে, ওর দিক থেকে চোখ ফেরানোই কস্টকর ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে!  ভাবলাম, এবার তো আমার মনের কথাটা বলার সময় বা সুযোগ দুটোই হয়েছে। তাহলে আর দেরি করবো কেন? ভালোলাগার কথাটি তমাকে জানিয়ে দেই।  জানানোর আগে বিভিন্ন ভাবে তমার কাছ থেকে জানার চেস্টা করলাম। ও কাউকে পছন্দ করে কিনা? তখন তমার থেকে কোনো প্রকার বিপদ সংকেত পেলাম না বরং তমা সিংগেল থাকার এক ধরনের গ্রীন সিগনাল পেয়ে গেলাম। প্লান করতে লাগলাম, কিভাবে তমাকে প্রপোজ করা যায়? একটা সময়ে ওর থেকে জেনে নিলাম ওর প্রিয় লেখক শরৎচন্দ্র চট্টোপধ্যায়। 
তমার প্রিয়তার গুরুত্ব দিয়েই বইমেলা থেকে শরৎ এর “চরিত্রহীন” এবং হুমায়ূন আহমেদের “ময়ূরাক্ষী” উপন্যাস দুটি  সংগ্রহ করলাম। যাতে করে প্রপোজ করার সময়ে গোলাপের সাথে এই দুটোও উপহার দিতে পারি। তমাকে প্রপোজ করার জন্য বেছে নিলাম এবারের ‘বিশ্ব প্রপোজ ডে’ দিনটিকেই । কিন্তু কপাল খারাপ হলে যা হয় আর কি, তার প্রমান পেলাম আবারও ! সেদিন সেই সকাল থেকেই তমা একটু ফ্রী হওয়ার সময়ের অপেক্ষা করতে করতেই দিন শেষ ! গুরুত্বপূর্ণ ক্লাশ, প্রাকটিক্যাল ক্লাশে রুগীর পর্যবেক্ষণ, নিজের ব্যস্ততা ইত্যাদি কারনেই আমাকে আর সেদিন সময় দিতে পারেনি । কিন্তু হ্যাঁ, সময় ঠিকই দিয়েছে তবে রাতে ফেইসবুক চ্যাটে। সে বারবার জানতে চাইলে এতো জরুরীভাবে তাকে তলব করছি কেন? তমাকে বললাম, তোমার সানিধ্যে যেয়ে  তোমার থেকে একটা জিনিস চাওয়ার আছে! তমা জানতে চাইলো কি? বললাম, “আমার চাওয়াটা হলোঃ তোমার পায়ের পদতল দু’টি দিবে আমাকে? আমার সন্তানের জান্নাত হিসেবে! বেশি দিনের জন্য নয়, শুধুমাত্র মাত্র বাকি জীবনটার জন্য?” তমা তখন একদম চুপ। আরোও বললাম! দেখ তমা, সেই ছোট্টবেলা থেকেই তোমাকে অনেক পছন্দ করি আমি! মনে মনে তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি অনেক আগেই ! এসব শুনে তমা যেন আকাশ থেকে পড়লো। তমা এসব মানতেই নারাজ। প্রথমত আমি তো ওর ভাইয়ার মতো, আমার থেকে ও এমনটা কখনই আশা করেনি। তখন তমার একটাই কথা, আমার সাথে সম্পর্ক করা ওর পক্ষে কখনই সম্ভব না। এটা শোনার পরে বুঝতেই পারছেন, আমার অবস্থা কি হয়? এতোদিন অপেক্ষার পর এই যদি হয় ফলাফল! কতোটা কষ্ট এবং খারাপ লেগেছিলো, তা আপনাদের বলে বোঝাতে পারবো না। মনে হচ্ছে যেন হৃদয়টা ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। কষ্ট টাকে গভীরভাবে বোঝানোর জন্যই তো, তমার ‘কখনই নাহ!’ উত্তর শোনার পরেও হাসি মুখে বললাম, খুশি হয়েছি! 
তমা আমার অভিনয়ের হাসি মাখানো খুশিটাই দেখলো, তবুও লুকানো কষ্টের বিন্দু পরিমানও বুঝলো না! তমা এক পর্যায়ে জানতে চাইলো, কিভাবে? কেন? ওকে ভালো লাগলো বা ভালোবাসলাম? আমি বললাম,
“দেখ, তোমাকে ভালোলাগার জন্য আমাকে অপরাধী ভেবো না! এর জন্য মোটেও আমি দায়ী নই। দোষটা ছিলো আমার দুই নয়নের, ওরা তোমার মায়াবী চাহনি দেখেই মুগ্ধ হয়ে তোমার প্রেমে পড়েছে ! দোষটা ছিলো আমার শ্রবণ শক্তির, যে তোমার মধুমাখা কন্ঠ শুনে এক নিমিষেই ভালোবেসে ফেলেছে তোমাকে !”
সেদিন আর তেমন কোনো কথা বললো না তমা। 
এরপর থেকে বুঝতে পারলাম তমা কেমন জানি সবকিছু থেকে আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছে! ফোন কল, এসেমেস, ফেইসবুক, দেখা না করা সব কিছু থেকে। অনেকটা সময় তমার থেকে অবহেলা আর অবজ্ঞা পেতে থাকলাম! 
ওকে একবার বলেই ফেললাম, এমন করছো কেন?
“জানি, তোমার বড্ড বেশি অহমিকা রয়েছে । 
ভালোবাসি কথাটাই তো বলেছি, ঘৃণা করি বলিনি তো ! তার জন্য এতো টা অবজ্ঞা আর অবহেলা না করলেও কি পারতে না?”
তমা তখনও চুপ। চ্যাট অপশনে কথা গুলো সিন হলেও তেমন কোনো রিপ্লেই নেই! তারপর একটা সময়ে তমা নিজেই জানালো, সে আসলে অন্য একজনকে খুব ভালোবাসে। যার সাথে তার এইচএসসির প্রথম বর্ষ থেকেই রিলেশন চলছে। ছেলেটি বর্তমানে খুলনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইলেক্টিক্যাল ডিপার্টমেন্ট থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং লাস্ট সেমিস্টার কভার করছে। তার নাম ফাত্তাহ। ওরা দুজনেই পড়ালেখা কমপ্লিট করেই বিয়ের পিড়িতে বসবে। সব প্লানিং শেষ। এসব শুনে মনে হচ্ছে আমিই বরং ওদের বাড়া ভাতে ছাই দিতে এসেছি। তমাকে বললাম, আগে যখন জানতে চেয়েছি তখন কেন বললে না ফাত্তাহ’র কথা? তমা বললো, রিলেশনটার গোপনীয়তার খাতিরে বলা হয়নি, কিন্তু আমি যে পাগলামী শুরু করেছি, এটা ঠেকানোর জন্যই নাকি ফাত্তাহ’র কথা বলতে বাধ্য হয়েছে। 
কেন জানি আজ, তমার কাছে নিজেকে বড্ড বেশি অপরাধী মনে হচ্ছে। 
ভালোলাগার বিপরীতে এতোটা অপরাধ, অভিশাপ আর দূরত্ব লুকিয়ে থাকে, জানা ছিলো না।
জানলে হয়তো তমাকে ভালোলাগার কথাটি কোনোদিনই জানানোর মতো দুঃসাহস দেখানোর চেস্টাটিও করতাম না!
“সৃষ্টিকর্তা যদি সবাইকে আগেই বোঝার শক্তি দিতেন যে, কাকে পছন্দ করলে সে তাকে ফিরিয়ে দিবে না, তাহলে হয়তো তমাকে পাবার জন্য মনটা এমন বেহায়া হতো না!”
“ভালোবাসা যদি ভিক্ষা চাইলে পাওয়ার কোনো সিস্টেম থাকতো, তাহলে আজ হয়তো দু হাত পেতে দিতাম তমার সমীপে!”
নিজের মনই এমন সব উদ্ভট ভাবনা ভাবতে থাকলো। ওদের দুজনের প্রেমের গল্প শোনার পর তমাকে শুধু একটা কথাই বললাম, “আমি মনে প্রাণে চাইবো, তবু কখনই বলবো না আমাকেই ভালোবাসো!” বরং তুমি এবং ফাত্তাহ ই সুখে থাকো! তাছাড়া আমার চাওয়াটাই হয়তো ভুল। কেননা তোমরা দুজনই-দুজনার জন্যই পারফেক্ট। একজন ডাক্তার, অন্যজন ইঞ্জিনিয়ার। বাহ কতো মিল? সেখানে আমি তো সামান্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন নগন্য ছাত্র ! এই অবস্থায় এখন আমি করবো টা কি? হঠাৎ কেন জানি মনে হলো, প্রকৃত ভালোবাসা তো সবসময়ে ব্যর্থই হয়, আমার ভালোবাসাটাও না হয় সেই কাতারে চলে যাক । স্বপ্ন ভাঙার আওয়াজটাই যখন কেউ শুনতে পায় না, তখন স্বপ্ন ভাঙার ব্যাথাটাই বা আর  কাকে দেখাবো? 
আমি বরং এই গল্পটিকে তমা এবং ফাত্তাহ কে এবারের ‘বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে’র উপহার হিসেবেই দিয়ে দিলাম! ওদের সুখটাই হোক আমার জন্য ভালোবাসা না পাবার সান্তনা। সাথে সাথে আমিও না হয় আমার ভালোবাসার মানুষ তমাকে পাওয়ার ‘প্রতিক্ষার সমাপ্তি’ টেনে দিলাম ! 

আরিফ বিন নজরুল
গিলাতলা, খুলনা

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
অনুসরণ করুন:
সাময়িকীর অতিথি লেখক একাউন্ট। ইমেইল মাধ্যমে প্রাপ্ত লেখাসমূহ অতিথি লেখক একাউন্ট থেকে প্রকাশিত হয়।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!